alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা ও যুদ্ধবিরোধিতার গুরুত্ব

আলমগীর খান

: বুধবার, ১০ আগস্ট ২০২২

পাঁচ মাসের বেশি হলো ইউক্রেনে রুশ হামলা চলছে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ হওয়া ছাড়া কোনো ভালো লক্ষণ নেই, শুধু ইউক্রেনকে খাদ্য রপ্তানির সুযোগ দিতে রাশিয়ার সঙ্গে সাম্প্রতিক চুক্তি ছাড়া। অন্যদিকে মৃত্যু, উচ্ছেদ, দেশত্যাগ, দারিদ্র্যসহ ক্ষতির তালিকা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে।

যুদ্ধ আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের একটি ব্যবসা ও খেলা দুইই। কিন্তু সাম্র্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাটা যাদের নিয়ে খেলা হয় তাদের কাছে মোটেও বিনোদন নয়, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। আর সাম্র্রাজ্যবাদ নিজেও নিছক বিনোদনের জন্য এ খেলার আয়োজন করে না। এ খেলার সঙ্গে পুঁজি, বিনিয়োগ, লাভ ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক লুণ্ঠন জড়িত।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আচমকা আক্রমণ করে ক্ষুদ্র ইউক্রেন রাষ্ট্রকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পদানত করার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু পুতিনের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একে আদৌ যুদ্ধ বলা ভুল। এ আসলে নিরীহ ইউক্রেনবাসীর ওপর সাম্রাজ্যবাদী পুতিনের বা পুতিনশাসিত রাশিয়ার মরণকামড়। কিন্তু এই আক্রমণ কোনোভাবেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নয়। ইউক্রেনের জনগণ ও রুশ জনগণের মধ্যেও নয় এ যুদ্ধ। আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তান হামলা ও ইরাক হামলার সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। আবার অমিল হলো-এ যুদ্ধ ভায়ে ভায়ে। মার্কিন জনগণের সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরাকের জনগণের যতটা দূরত্ব, ইউক্রেন ও রুশ জনগণের মধ্যে ততটাই নৈকট্য।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার জনগণ প্রায় একই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার অংশীদার। আবার নানাদিক থেকে তাদের স্বাতন্ত্র্যও রয়েছে। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এই স্বাতন্ত্র্যকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়। রুশ বিপ্লবের ১০০ বছর পর পুতিন সব গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। দেশটিকে উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের অবাস্তব পাত্রে চুবিয়ে তিনি ইউক্রেন ও রাশিয়াকে এক করে ফেলতে চান।

এক করে ফেলার ইচ্ছেটা অবশ্য তার আপনা আপনি জাগেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ক্রমাগত উসকানি ও হুমকি এই উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের অস্ত্রে শাণ দিয়েছে। ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটির ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। অথচ দেশটির জনগণের তখন এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন শাসকগোষ্ঠীর আগ্রহ, পশ্চিমা শক্তির উৎসাহ ও রুশ সরকারের দখলদারি আচরণ দেশটির মানুষের মনে ন্যাটোভুক্ত হওয়ার ইচ্ছে বাড়িয়ে তোলে। এভাবেই দুই দেশের মাঝে সম্পর্কটা ঘোলা করে তোলা হয়, যা এখন প্রাণঘাতি যুদ্ধে পরিণতি লাভ করেছে। যা ভবিষ্যতে আরও ক্ষতিকারক ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বিশ^রাজনীতিতে যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত ২৬ মার্চ পোলান্ডের রয়াল ক্যাসেলে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় পুতিন সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই লোক আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।” এই মার্কিন ‘ভদ্রলোক’ আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার ভান করছেন। আমরা যদি পুতিন ও বাইডেনের মধ্যে পার্থক্য করতে বসি তবে তা হবে চোর ও ডাকাতের মাঝে পার্থক্য করার সমতুল্য। সত্য কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতিপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকতে পারে না। পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে তারা একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে ও তাদের টিকে থাকার মদত দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষায় পুতিন একজন ‘খুনি একনায়ক’, ‘কসাই’ ইত্যাদি। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরম ‘মানবদরদী’ ব্যক্তিটি প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে কী বলে ডাকবেন? বুশের কসাইখানায় বসে বাইডেন নিজেও ছুরি ধার দিয়েছেন-আফগানিস্তান-ইরাক আক্রমণে সমর্থন করেছেন।

এই যুদ্ধ বা রুশ হামলায় পক্ষ অবলম্বন করতে অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে হবে যা অতীতের নয়, ভবিষ্যতের। বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশে^ অনেকগুলো যুদ্ধ হয়েছে যাকে পরদেশ আক্রমণ ও দিনদুপুরে ডাকাতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আফগানিস্তানে ও ইরাকে মার্কিন হামলা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আক্রমণকারী দেশ এসব হামলাকে যুদ্ধ বলে থাকে। আক্রমণকারী ও আক্রান্তের মধ্যে এখানে সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তির পার্থক্য বিরাট। তবু আক্রমণকারী দেশের ‘ভদ্র ও সভ্য’ নেতাদের মৃদু ভাষায় এসব হামলা দুই দেশের মাঝে ‘যুদ্ধ’। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে ধর্ম, মানবতা ও জাতীয়তা রক্ষার জিগির তোলে।

ইউক্রেন আক্রমণে ভ্লাদিমির পুতিনও তাই করছেন। তিনি সেখানে নাৎসীবাদের উদ্ভব দেখছেন ও বলছেন যে তা দমনের অভিযানে নেমেছেন। আসলে রুশ আক্রমণই সেখানে ডানপন্থী শক্তিকে আরও শক্তিশালী করছে ও করবে। অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেনের প্রতি যে দরদ দেখাচ্ছে তা কুমিরের কান্নার মতো। পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাকে সর্বপ্রকারে লাই দিয়ে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। এই যুদ্ধকে জিইয়ে রাখাতেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির স্বার্থ নিহিত। দুর্বল রাশিয়া তাদের কাম্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন ভয় পাচ্ছে বিশ^রাজনীতিতে চীনের অদম্য উত্থানকে। এরপর যদি চীন-রাশিয়া গাঁটছড়া বাঁধে তাহলে মার্কিন নেতৃত্বের জন্য তা হবে গোদের উপর বিষফোড়া।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিশে^র মানুষ তিনটি শিবিরে বিভক্ত-পুতিন সমর্থক, ইউক্রেন সমর্থক ও যুদ্ধবিরোধী। এর মধ্যে পুতিন সমর্থক গোষ্ঠী সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়, হাস্যকর ও অযৌক্তিক। এই গোষ্ঠীতে বামপন্থী ও ডানপন্থী সবই আছে। আর তিন শিবিরের মধ্যে যুদ্ধবিরোধীরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই যুদ্ধের প্রতিবাদে রুশ জনগণ রাস্তায় নেমে পুতিনের পুলিশের হামলার শিকার হয়েছে। সেখানকার তরণ জনগোষ্ঠী ও নারীরাও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে ও শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছে। এমনকি ইউক্রেনে বসবাসরত রুশরাও রুশ আক্রমণের বিরোধিতা করছে। এ ছাড়া বিশ^ব্যাপী প্রতিবাদ তো আছেই।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্র ও জনগণ সব সময় টানাপড়েনের সম্পর্কে আবদ্ধ। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রাষ্ট্র বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। সেই তুলনায় জনগণ হয়েছে দুর্বল, অসম ও বিভক্ত। রাষ্ট্রের হাতে মানুষকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখার, ভয় দেখানোর ও নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সে প্রযুক্তির ক্ষমতাও প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে জনগণের সংগঠিত হওয়ার এবং স্বাধীন মত প্রকাশের ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আগের চেয়ে কমছে। আর এ কারণে রাষ্ট্র ও জনগণের টানাপড়েনের সম্পর্কটি আরও খারাপ ও ভারসাম্যহীন হচ্ছে। জনগণের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা বাড়ছে আর রাষ্ট্রের ওপর থেকে জনগণের নিয়ন্ত্রণ ক্রমে কমছে। সে সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র মুনাফাখোর গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ছে আর জনগণ হারিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দুয়ের বিকাশের এই আলাদা পথকে বাস্তবায়ন ও দ্রুততর করছে। এই পরিস্থিতিতে আক্রমণকারী দেশ রাশিয়াসহ বিশ^ব্যাপী জনগণের যুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রিটিশ লেবার পার্টির সমাজতান্ত্রিক নেতা জেরেমি করবিন এ নারকীয় হামলা বিষয়ক আলোচনায় বলেছিলেন, “কেউ কেউ বলেন যে, যুদ্ধবিরোধিতা দুর্বলতার চিহ্ন। কিন্তু এটা শক্তির পরিচয় যে, আপনি চলমান সংঘর্ষের ওপর দৃষ্টিপাত করছেন ও বলছেন এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। সুতরাং আমাদের আরও বেশি শান্তিবাদী কণ্ঠ তুলতে এবং যুদ্ধের নির্বুদ্ধিতা ও বিপদ উন্মোচন করতে ও নিজ নিজ সরকারের ভূমিকার বিরোধিতা করতে বিশ^ব্যাপী আরও যুদ্ধবিরোধী কর্মী প্রয়োজন।”

অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে আজ যুদ্ধবাজরা কল্পনাতীত রকম বেশি ভয়ঙ্কর, নিমর্ম ও গণবিরোধী। অন্যদিকে বিভক্ত ও খন্ডিত জনগণ আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল। এখন জনগণের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের ঐক্যে ও মিলিত কণ্ঠ। তাই চলতি শতাব্দীর পরিবর্তিত বিশে^ ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধবিরোধিতা অনেক বেশি যুগের দাবিই নয় শুধু, অন্যতম প্রগতিশীল মানবিক কর্তব্য।

[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা ও যুদ্ধবিরোধিতার গুরুত্ব

আলমগীর খান

বুধবার, ১০ আগস্ট ২০২২

পাঁচ মাসের বেশি হলো ইউক্রেনে রুশ হামলা চলছে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ হওয়া ছাড়া কোনো ভালো লক্ষণ নেই, শুধু ইউক্রেনকে খাদ্য রপ্তানির সুযোগ দিতে রাশিয়ার সঙ্গে সাম্প্রতিক চুক্তি ছাড়া। অন্যদিকে মৃত্যু, উচ্ছেদ, দেশত্যাগ, দারিদ্র্যসহ ক্ষতির তালিকা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে।

যুদ্ধ আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের একটি ব্যবসা ও খেলা দুইই। কিন্তু সাম্র্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাটা যাদের নিয়ে খেলা হয় তাদের কাছে মোটেও বিনোদন নয়, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। আর সাম্র্রাজ্যবাদ নিজেও নিছক বিনোদনের জন্য এ খেলার আয়োজন করে না। এ খেলার সঙ্গে পুঁজি, বিনিয়োগ, লাভ ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক লুণ্ঠন জড়িত।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আচমকা আক্রমণ করে ক্ষুদ্র ইউক্রেন রাষ্ট্রকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পদানত করার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু পুতিনের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একে আদৌ যুদ্ধ বলা ভুল। এ আসলে নিরীহ ইউক্রেনবাসীর ওপর সাম্রাজ্যবাদী পুতিনের বা পুতিনশাসিত রাশিয়ার মরণকামড়। কিন্তু এই আক্রমণ কোনোভাবেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নয়। ইউক্রেনের জনগণ ও রুশ জনগণের মধ্যেও নয় এ যুদ্ধ। আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তান হামলা ও ইরাক হামলার সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। আবার অমিল হলো-এ যুদ্ধ ভায়ে ভায়ে। মার্কিন জনগণের সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরাকের জনগণের যতটা দূরত্ব, ইউক্রেন ও রুশ জনগণের মধ্যে ততটাই নৈকট্য।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার জনগণ প্রায় একই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার অংশীদার। আবার নানাদিক থেকে তাদের স্বাতন্ত্র্যও রয়েছে। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এই স্বাতন্ত্র্যকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়। রুশ বিপ্লবের ১০০ বছর পর পুতিন সব গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। দেশটিকে উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের অবাস্তব পাত্রে চুবিয়ে তিনি ইউক্রেন ও রাশিয়াকে এক করে ফেলতে চান।

এক করে ফেলার ইচ্ছেটা অবশ্য তার আপনা আপনি জাগেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ক্রমাগত উসকানি ও হুমকি এই উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের অস্ত্রে শাণ দিয়েছে। ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটির ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। অথচ দেশটির জনগণের তখন এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন শাসকগোষ্ঠীর আগ্রহ, পশ্চিমা শক্তির উৎসাহ ও রুশ সরকারের দখলদারি আচরণ দেশটির মানুষের মনে ন্যাটোভুক্ত হওয়ার ইচ্ছে বাড়িয়ে তোলে। এভাবেই দুই দেশের মাঝে সম্পর্কটা ঘোলা করে তোলা হয়, যা এখন প্রাণঘাতি যুদ্ধে পরিণতি লাভ করেছে। যা ভবিষ্যতে আরও ক্ষতিকারক ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বিশ^রাজনীতিতে যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত ২৬ মার্চ পোলান্ডের রয়াল ক্যাসেলে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় পুতিন সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই লোক আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।” এই মার্কিন ‘ভদ্রলোক’ আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার ভান করছেন। আমরা যদি পুতিন ও বাইডেনের মধ্যে পার্থক্য করতে বসি তবে তা হবে চোর ও ডাকাতের মাঝে পার্থক্য করার সমতুল্য। সত্য কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতিপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকতে পারে না। পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে তারা একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে ও তাদের টিকে থাকার মদত দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষায় পুতিন একজন ‘খুনি একনায়ক’, ‘কসাই’ ইত্যাদি। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরম ‘মানবদরদী’ ব্যক্তিটি প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে কী বলে ডাকবেন? বুশের কসাইখানায় বসে বাইডেন নিজেও ছুরি ধার দিয়েছেন-আফগানিস্তান-ইরাক আক্রমণে সমর্থন করেছেন।

এই যুদ্ধ বা রুশ হামলায় পক্ষ অবলম্বন করতে অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে হবে যা অতীতের নয়, ভবিষ্যতের। বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশে^ অনেকগুলো যুদ্ধ হয়েছে যাকে পরদেশ আক্রমণ ও দিনদুপুরে ডাকাতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আফগানিস্তানে ও ইরাকে মার্কিন হামলা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আক্রমণকারী দেশ এসব হামলাকে যুদ্ধ বলে থাকে। আক্রমণকারী ও আক্রান্তের মধ্যে এখানে সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তির পার্থক্য বিরাট। তবু আক্রমণকারী দেশের ‘ভদ্র ও সভ্য’ নেতাদের মৃদু ভাষায় এসব হামলা দুই দেশের মাঝে ‘যুদ্ধ’। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে ধর্ম, মানবতা ও জাতীয়তা রক্ষার জিগির তোলে।

ইউক্রেন আক্রমণে ভ্লাদিমির পুতিনও তাই করছেন। তিনি সেখানে নাৎসীবাদের উদ্ভব দেখছেন ও বলছেন যে তা দমনের অভিযানে নেমেছেন। আসলে রুশ আক্রমণই সেখানে ডানপন্থী শক্তিকে আরও শক্তিশালী করছে ও করবে। অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেনের প্রতি যে দরদ দেখাচ্ছে তা কুমিরের কান্নার মতো। পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাকে সর্বপ্রকারে লাই দিয়ে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। এই যুদ্ধকে জিইয়ে রাখাতেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির স্বার্থ নিহিত। দুর্বল রাশিয়া তাদের কাম্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন ভয় পাচ্ছে বিশ^রাজনীতিতে চীনের অদম্য উত্থানকে। এরপর যদি চীন-রাশিয়া গাঁটছড়া বাঁধে তাহলে মার্কিন নেতৃত্বের জন্য তা হবে গোদের উপর বিষফোড়া।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিশে^র মানুষ তিনটি শিবিরে বিভক্ত-পুতিন সমর্থক, ইউক্রেন সমর্থক ও যুদ্ধবিরোধী। এর মধ্যে পুতিন সমর্থক গোষ্ঠী সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়, হাস্যকর ও অযৌক্তিক। এই গোষ্ঠীতে বামপন্থী ও ডানপন্থী সবই আছে। আর তিন শিবিরের মধ্যে যুদ্ধবিরোধীরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই যুদ্ধের প্রতিবাদে রুশ জনগণ রাস্তায় নেমে পুতিনের পুলিশের হামলার শিকার হয়েছে। সেখানকার তরণ জনগোষ্ঠী ও নারীরাও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে ও শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছে। এমনকি ইউক্রেনে বসবাসরত রুশরাও রুশ আক্রমণের বিরোধিতা করছে। এ ছাড়া বিশ^ব্যাপী প্রতিবাদ তো আছেই।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্র ও জনগণ সব সময় টানাপড়েনের সম্পর্কে আবদ্ধ। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রাষ্ট্র বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। সেই তুলনায় জনগণ হয়েছে দুর্বল, অসম ও বিভক্ত। রাষ্ট্রের হাতে মানুষকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখার, ভয় দেখানোর ও নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সে প্রযুক্তির ক্ষমতাও প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে জনগণের সংগঠিত হওয়ার এবং স্বাধীন মত প্রকাশের ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আগের চেয়ে কমছে। আর এ কারণে রাষ্ট্র ও জনগণের টানাপড়েনের সম্পর্কটি আরও খারাপ ও ভারসাম্যহীন হচ্ছে। জনগণের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা বাড়ছে আর রাষ্ট্রের ওপর থেকে জনগণের নিয়ন্ত্রণ ক্রমে কমছে। সে সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র মুনাফাখোর গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ছে আর জনগণ হারিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দুয়ের বিকাশের এই আলাদা পথকে বাস্তবায়ন ও দ্রুততর করছে। এই পরিস্থিতিতে আক্রমণকারী দেশ রাশিয়াসহ বিশ^ব্যাপী জনগণের যুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রিটিশ লেবার পার্টির সমাজতান্ত্রিক নেতা জেরেমি করবিন এ নারকীয় হামলা বিষয়ক আলোচনায় বলেছিলেন, “কেউ কেউ বলেন যে, যুদ্ধবিরোধিতা দুর্বলতার চিহ্ন। কিন্তু এটা শক্তির পরিচয় যে, আপনি চলমান সংঘর্ষের ওপর দৃষ্টিপাত করছেন ও বলছেন এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। সুতরাং আমাদের আরও বেশি শান্তিবাদী কণ্ঠ তুলতে এবং যুদ্ধের নির্বুদ্ধিতা ও বিপদ উন্মোচন করতে ও নিজ নিজ সরকারের ভূমিকার বিরোধিতা করতে বিশ^ব্যাপী আরও যুদ্ধবিরোধী কর্মী প্রয়োজন।”

অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে আজ যুদ্ধবাজরা কল্পনাতীত রকম বেশি ভয়ঙ্কর, নিমর্ম ও গণবিরোধী। অন্যদিকে বিভক্ত ও খন্ডিত জনগণ আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল। এখন জনগণের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের ঐক্যে ও মিলিত কণ্ঠ। তাই চলতি শতাব্দীর পরিবর্তিত বিশে^ ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধবিরোধিতা অনেক বেশি যুগের দাবিই নয় শুধু, অন্যতম প্রগতিশীল মানবিক কর্তব্য।

[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]

back to top