মিথুশিলাক মুরমু
১.
প্রথমবারের মতো কোনো আদিবাসীকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। আমেরিকান নাগরিক রাউন্ড ভ্যালি ইন্ডিয়ান নারী আদিবাসী নিকোল অনাপু মানকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এরোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) মনোনীত করেছিলো। গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিকোল অনাপু মান স্পেস এক্স ড্রাগন মহাকাশযানে ভ্রমণ করেন। নাসার ২১তম মহাকাশচারী টিমের আটজনের মধ্যে নিকোল একজন। সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মহাকাশচারী ও পাইলট জোশ কাসাডা, জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির নভোচারী কোইচি ওয়াকাটা এবং রাশিয়ান মহাকাশচারী আনা কিকিনা।
আদিবাসী নিকোল অনাপু মান ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে মহাকাশচারী হওয়ার পর এটিই তার প্রথম অভিযান। মহাকাশে যাবার আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি মনে করি এ ব্যাপারটি আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সন্তানেরা এখন উপলব্ধি করতে পারবে যে, আমাদের বাধাগুলো ভেঙে যেতে শুরু করেছে।’ মহাকাশে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন মায়ের দেওয়া ড্রিমক্যাচার, এটি আদিবাসীদের ঐতিহ্যনুযায়ী ঐক্যের প্রতীক, যা সুরক্ষা প্রদান করে।
আদিবাসী এই নারী নভোচারী স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তারপর নৌবাহিনীতে কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ অভিযানে দুইবার নিযুক্ত হয়েছিলেন, যুদ্ধ বিমান পরিচালনায় যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। মার্কিন সেনাবাহিনীতে চৌকস কাজের জন্য ছয়টি পদক হস্তগত করেছেন। মহাকাশ জয়ের মিশনটি পঞ্চমবারের মতো পরিচালিত হয়েছে। মিশনের সদস্যরা মহাকাশে ২৫০টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে। নাসার তথ্যমতে, পৃথিবীর জীবনকে উপকৃত করতে এবং গ্রহের বাইরে মানুষের অনুসন্ধান প্রস্তুত করতে সহায়তা করবে এ অভিযান।
২.
৩০ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকের ছোট শিরোনাম ছিলো- ‘শেষ সদস্যের মৃত্যু, পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল আরও এক আদিবাসী গোষ্ঠী।’ সর্বশেষ আদিবাসী ব্যক্তিটি গভীর গর্ত খুঁড়ে প্রাণী শিকারে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতেন আর কিছু ব্যবহার করতেন লুকিয়ে থাকার জন্য। অভিনব গর্ত খোঁড়ার জন্য বিবিসি তাকে গর্তমানব অভিহিত করেছিলেন। ২৩ আগস্ট নিজের কুঁড়েঘরের বাইরে দোলনাসদৃশ্য বিছানায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। ব্রাজিলের রনডোনিয়া রাজ্যের তানারু আদিবাসী এলাকায় বসবাসকারী একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন। রাজ্যটি বলিভিয়ার সীমান্তের সংলগ্ন। নিজেদের ভূখন্ড বাড়াতে চাওয়া পশুপালকদের হাতে সত্তরের দশকে তার এই আদিবাসী গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য নিহত হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে তার গোত্রের বাকি ছয় সদস্যও অবৈধ খনিশ্রমিকের হামলায় নিহত হন। ফলে এ আদিবাসী গোষ্ঠীর একমাত্র তিনিই বেঁচে ছিলেন।
ব্রাজিলের আদিবাসী বিষয়ক সংস্থা ফুনাই ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে কেবল ওই ব্যক্তির বেঁচে থাকার বিষয়টি জানতে পারে। এরপর থেকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য এলাকাটি নজরদারি করে আসছিল সংস্থাটি। মরদেহ খোঁজ পাওয়ার ৪০-৫০ দিন আগেই গর্তমানবের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করেছেন আদিবাসী বিশেষজ্ঞরা। তার এলাকায় কোনো অনুপ্রবেশের কোনো চিহ্নও নেই, কুঁড়েঘরটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা, তা নিশ্চিত হতে মরদেহকে ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। গর্তমানব ব্যক্তিটি বাইরের কারো সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ এড়িয়ে চলতেন। ফলে তিনি কোন ভাষায় কথা বলতেন, সেটা জানা যায়নি। তবে ফুনাই সদস্যরা তার কুঁড়েঘরগুলো এবং তার খোঁড়া গর্তগুলোর সন্ধান পেয়েছেন। তিনি কোন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর, সেটাও অজানা রয়ে গেল।
২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ফুনাই সদস্যরা জঙ্গলে ওই আদিবাসী সদস্যের একটি ভিডিও করতে সক্ষম হন। ভিডিওতে তাকে কুড়ালের মতো কিছু দিয়ে গাছে আঘাত করতে দেখা গেছে। এরপর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। নিয়মিত টহলের সময় ফুনাই সদস্য আলতাইর জোসে আলগায়ের গর্তমানবের মরদেহ নিজের কুঁড়েঘরের বাইরে দোলনাসদৃশ্য বিছানায় দেখতে পান। ম্যাকাউ পাখির পালক দিয়ে মরদেহটি ঢাকা ছিল। আদিবাসী বিশেষজ্ঞ মার্সেলো দোস সান্তোস মনে করেন, মৃত্যু আসন্ন জেনে ওই ব্যক্তি নিজেই পালক দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়েছিলেন বলে তার ধারণা। ব্রাজিলে প্রায় ২৪০টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। অবৈধ খনিশ্রমিক, কাঠ সংগ্রহকারী ও কৃষকেরা তাদের ভূখন্ড দখল করে নেওয়ায় এসব গোষ্ঠীর অনেকেই হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন বলে সতর্ক করেছে সারভাইবাল ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসছে।
৩.
আমাদের দেশে বিপন্ন কোচ ভাষার অভিধান রচনা করেছেন মি. রায়চাঁদ কোচ। তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় বসবাস করেন। তিনি মনে করেন, ভাষার অভিধান থাকলে প্রজন্মরা ভাষা রক্ষার জন্য উদ্যোগী হবেন এবং সমগ্র জাতি ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত হবেন। রায়চাঁদ তার পা-ুলিপি নিয়ে প্রকাশনার লক্ষ্যে ঢাকার পথে পথে খোঁজ করে চলেছেন। কোচ জাতিগোষ্ঠীর এই মধ্যবয়সী রায়চাঁদ মানসিকভাবে খুবই উদ্যোমী এবং প্রত্যয়ী, দমে যাবার পাত্র নন। পরিচিত লেখালেখির সাথে যুক্ত প্রত্যেকেই তার স্বপ্ন ও বাসনার কথাগুলো জানাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করছেন।
রায়চাঁদ মৃতপ্রায় ভাষাকে বাঁচানোর আকুতি ও চেষ্টা, দৌড়ঝাঁপ ও স্বপ্নের ফেরি করে চলেছেন। এভাবেই খারওয়াল বা খেড়োয়ার, গুর্খা, ডালু, ভিল, লুসাই, হো, রামদাস, কর, বেদিয়া, মালের, খাইরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। এই জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মরা ভাষা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, দুই-একজন ছাড়া খুব অল্পসংখ্যক লোকই মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন।
তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বাংলাসহ ৪১টি ভাষা বিদ্যমান; কিন্তু এর মধ্যে ১৪টি ভাষাই মৃতপ্রায়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে ভাষাগুলো। ভাষা রক্ষার তাগিদ থেকেই বান্দরবানের রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জুয়েল বড়–য়া মারমা বাংলা ভাষায় অভিধান সংকলন করেছেন। মারমা ভাষাভাষি না হয়েও এই দুর্ভেদ্য কাজে জড়িয়ে পড়েছেন শুধু মারমাদের প্রতি তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা থেকে। ইতোমধ্যেই চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লুসাই ও খিয়াং ভাষার অভিধানও স্থানীয় সরকারের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংরক্ষণে উদ্যোগী না হলে দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে সংখ্যাতত্ত্বে নগণ্যরা; বিলুপ্তের হুমকিতে রয়েছে বাকিরাও। ভাষা শহীদের দেশে মাতৃভাষা ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তি সত্যিই লজ্জাকর ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে নিন্দনীয়। আসুন কালক্ষেপন না করে মাতৃভাষা ও আদিবাসীদের বেঁচে থাকার পরিবেশ বিনির্মাণে উদ্যোগী হই এবং পাশে দাঁড়াই।
[লেখক : কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২২
১.
প্রথমবারের মতো কোনো আদিবাসীকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। আমেরিকান নাগরিক রাউন্ড ভ্যালি ইন্ডিয়ান নারী আদিবাসী নিকোল অনাপু মানকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এরোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) মনোনীত করেছিলো। গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিকোল অনাপু মান স্পেস এক্স ড্রাগন মহাকাশযানে ভ্রমণ করেন। নাসার ২১তম মহাকাশচারী টিমের আটজনের মধ্যে নিকোল একজন। সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মহাকাশচারী ও পাইলট জোশ কাসাডা, জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির নভোচারী কোইচি ওয়াকাটা এবং রাশিয়ান মহাকাশচারী আনা কিকিনা।
আদিবাসী নিকোল অনাপু মান ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে মহাকাশচারী হওয়ার পর এটিই তার প্রথম অভিযান। মহাকাশে যাবার আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি মনে করি এ ব্যাপারটি আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সন্তানেরা এখন উপলব্ধি করতে পারবে যে, আমাদের বাধাগুলো ভেঙে যেতে শুরু করেছে।’ মহাকাশে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন মায়ের দেওয়া ড্রিমক্যাচার, এটি আদিবাসীদের ঐতিহ্যনুযায়ী ঐক্যের প্রতীক, যা সুরক্ষা প্রদান করে।
আদিবাসী এই নারী নভোচারী স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তারপর নৌবাহিনীতে কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ অভিযানে দুইবার নিযুক্ত হয়েছিলেন, যুদ্ধ বিমান পরিচালনায় যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। মার্কিন সেনাবাহিনীতে চৌকস কাজের জন্য ছয়টি পদক হস্তগত করেছেন। মহাকাশ জয়ের মিশনটি পঞ্চমবারের মতো পরিচালিত হয়েছে। মিশনের সদস্যরা মহাকাশে ২৫০টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে। নাসার তথ্যমতে, পৃথিবীর জীবনকে উপকৃত করতে এবং গ্রহের বাইরে মানুষের অনুসন্ধান প্রস্তুত করতে সহায়তা করবে এ অভিযান।
২.
৩০ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকের ছোট শিরোনাম ছিলো- ‘শেষ সদস্যের মৃত্যু, পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল আরও এক আদিবাসী গোষ্ঠী।’ সর্বশেষ আদিবাসী ব্যক্তিটি গভীর গর্ত খুঁড়ে প্রাণী শিকারে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতেন আর কিছু ব্যবহার করতেন লুকিয়ে থাকার জন্য। অভিনব গর্ত খোঁড়ার জন্য বিবিসি তাকে গর্তমানব অভিহিত করেছিলেন। ২৩ আগস্ট নিজের কুঁড়েঘরের বাইরে দোলনাসদৃশ্য বিছানায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। ব্রাজিলের রনডোনিয়া রাজ্যের তানারু আদিবাসী এলাকায় বসবাসকারী একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন। রাজ্যটি বলিভিয়ার সীমান্তের সংলগ্ন। নিজেদের ভূখন্ড বাড়াতে চাওয়া পশুপালকদের হাতে সত্তরের দশকে তার এই আদিবাসী গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য নিহত হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে তার গোত্রের বাকি ছয় সদস্যও অবৈধ খনিশ্রমিকের হামলায় নিহত হন। ফলে এ আদিবাসী গোষ্ঠীর একমাত্র তিনিই বেঁচে ছিলেন।
ব্রাজিলের আদিবাসী বিষয়ক সংস্থা ফুনাই ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে কেবল ওই ব্যক্তির বেঁচে থাকার বিষয়টি জানতে পারে। এরপর থেকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য এলাকাটি নজরদারি করে আসছিল সংস্থাটি। মরদেহ খোঁজ পাওয়ার ৪০-৫০ দিন আগেই গর্তমানবের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করেছেন আদিবাসী বিশেষজ্ঞরা। তার এলাকায় কোনো অনুপ্রবেশের কোনো চিহ্নও নেই, কুঁড়েঘরটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা, তা নিশ্চিত হতে মরদেহকে ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। গর্তমানব ব্যক্তিটি বাইরের কারো সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ এড়িয়ে চলতেন। ফলে তিনি কোন ভাষায় কথা বলতেন, সেটা জানা যায়নি। তবে ফুনাই সদস্যরা তার কুঁড়েঘরগুলো এবং তার খোঁড়া গর্তগুলোর সন্ধান পেয়েছেন। তিনি কোন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর, সেটাও অজানা রয়ে গেল।
২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ফুনাই সদস্যরা জঙ্গলে ওই আদিবাসী সদস্যের একটি ভিডিও করতে সক্ষম হন। ভিডিওতে তাকে কুড়ালের মতো কিছু দিয়ে গাছে আঘাত করতে দেখা গেছে। এরপর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। নিয়মিত টহলের সময় ফুনাই সদস্য আলতাইর জোসে আলগায়ের গর্তমানবের মরদেহ নিজের কুঁড়েঘরের বাইরে দোলনাসদৃশ্য বিছানায় দেখতে পান। ম্যাকাউ পাখির পালক দিয়ে মরদেহটি ঢাকা ছিল। আদিবাসী বিশেষজ্ঞ মার্সেলো দোস সান্তোস মনে করেন, মৃত্যু আসন্ন জেনে ওই ব্যক্তি নিজেই পালক দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়েছিলেন বলে তার ধারণা। ব্রাজিলে প্রায় ২৪০টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। অবৈধ খনিশ্রমিক, কাঠ সংগ্রহকারী ও কৃষকেরা তাদের ভূখন্ড দখল করে নেওয়ায় এসব গোষ্ঠীর অনেকেই হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন বলে সতর্ক করেছে সারভাইবাল ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসছে।
৩.
আমাদের দেশে বিপন্ন কোচ ভাষার অভিধান রচনা করেছেন মি. রায়চাঁদ কোচ। তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় বসবাস করেন। তিনি মনে করেন, ভাষার অভিধান থাকলে প্রজন্মরা ভাষা রক্ষার জন্য উদ্যোগী হবেন এবং সমগ্র জাতি ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত হবেন। রায়চাঁদ তার পা-ুলিপি নিয়ে প্রকাশনার লক্ষ্যে ঢাকার পথে পথে খোঁজ করে চলেছেন। কোচ জাতিগোষ্ঠীর এই মধ্যবয়সী রায়চাঁদ মানসিকভাবে খুবই উদ্যোমী এবং প্রত্যয়ী, দমে যাবার পাত্র নন। পরিচিত লেখালেখির সাথে যুক্ত প্রত্যেকেই তার স্বপ্ন ও বাসনার কথাগুলো জানাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করছেন।
রায়চাঁদ মৃতপ্রায় ভাষাকে বাঁচানোর আকুতি ও চেষ্টা, দৌড়ঝাঁপ ও স্বপ্নের ফেরি করে চলেছেন। এভাবেই খারওয়াল বা খেড়োয়ার, গুর্খা, ডালু, ভিল, লুসাই, হো, রামদাস, কর, বেদিয়া, মালের, খাইরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। এই জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মরা ভাষা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, দুই-একজন ছাড়া খুব অল্পসংখ্যক লোকই মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন।
তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বাংলাসহ ৪১টি ভাষা বিদ্যমান; কিন্তু এর মধ্যে ১৪টি ভাষাই মৃতপ্রায়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে ভাষাগুলো। ভাষা রক্ষার তাগিদ থেকেই বান্দরবানের রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জুয়েল বড়–য়া মারমা বাংলা ভাষায় অভিধান সংকলন করেছেন। মারমা ভাষাভাষি না হয়েও এই দুর্ভেদ্য কাজে জড়িয়ে পড়েছেন শুধু মারমাদের প্রতি তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা থেকে। ইতোমধ্যেই চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লুসাই ও খিয়াং ভাষার অভিধানও স্থানীয় সরকারের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংরক্ষণে উদ্যোগী না হলে দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে সংখ্যাতত্ত্বে নগণ্যরা; বিলুপ্তের হুমকিতে রয়েছে বাকিরাও। ভাষা শহীদের দেশে মাতৃভাষা ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তি সত্যিই লজ্জাকর ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে নিন্দনীয়। আসুন কালক্ষেপন না করে মাতৃভাষা ও আদিবাসীদের বেঁচে থাকার পরিবেশ বিনির্মাণে উদ্যোগী হই এবং পাশে দাঁড়াই।
[লেখক : কলামিস্ট]