alt

উপ-সম্পাদকীয়

কিছু মানুষের কারণে...

আব্দুল মান্নান খান

: শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩

কিছু মানুষের কারণে হয়তো এ দেশ-দুনিয়া একদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। জীবন হয়ে পড়বে বিপন্ন। শত শত কোটি মানুষকে বিষাক্ত বাতাস আর দুষিত পানির মধ্যে ফেলে রেখে সেই কিছু মানুষ হয়তো একদিন চলে যাবে অন্য কোন খানে-অন্য কোন গ্রহে। হয়তোবা এই পৃথিবীতে আসার আগেও এই কিছু মানুষ একই ভাবে ধ্বংস করে দিয়ে এসেছিল পৃথিবীর মতো অন্য কোন জগৎ।

না, গম্ভীর হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। এটা নিছক একটা কল্পনা মাত্র; কিন্তু কেন এমন কল্পনা এবার সেটাই দেখা যাক। তখন আমি চাকরিতে; গেছি শিক্ষাসফরে চীন দেশে। টিমে আমরা দশজন। ১৫ দিনের সফর। শেষ অবস্থান সাংহাই। সেদিন ছিল সফরের শেষ দিন। সন্ধ্যায় সাংহাইয়ের সেন্ট্রাল হোটেলে ডিনার করতে বসে ছোট্ট এক বোতল পানি হাতে নিয়ে এ কল্পনার উদয়- যা নাকি আজ পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি আমার। না, কোন কল্পকাহিনী লিখতে পারব না। সামান্য কিছুু লেখালেখি করি বটে তাই বলে সায়েন্স ফিকশান! না, তা সম্ভব না। যাই হোক, সেটা বলার আগে আরো কিছু কথা এখানে বলে নিতে হবে। সেই দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন সেটা দেখে আসাই ছিল আমাদের এ সফরের উদ্দেশ্য। আমরা মাঠ থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ছিলাম টিমে। সে দেশের বড় শহরের স্কুল ছোট শহরের স্কুল গ্রামের স্কুল পাহাড়ের ওপরের স্কুল যেমন আমাদের দেখান হয়েছে সাথে বেইজিং ভিত্তিক বিখ্যাত সব নিদর্শন যেমন গ্রেট ওয়াল, ফরবিডেন সিটি, সামার প্যালেস, টেম্পল অব হেভেন, তিয়েনআনমেন স্কয়ারও দেখানো হয়েছে। আবার বেইজিং থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই দূর পাহাড়ি প্রদেশ গানসুতে, যেখানে আমরা কেবলকারে চড়ে স্কুল দেখতে গিয়েছি। সেখানে হোয়াং হো শুধু দেখিনি বোটে করে ঘুরেছিও। সেখান থেকে চীনের পূর্বাঞ্চলের সাংহাই। এখানেও স্কুলের পাশাপাশি অ্যানসিয়েন্ট সিটি, ইউয়ান গার্ডেন, পুডং-এর ওরিয়েন্টাল পার্ল রেডিও অ্যান্ড টিভি টাওয়ার আমাদের দেখানো হয়েছে।

সাংহাইয়ের পুডং- এখানেই সেন্ট্রাল হোটেলে আমরা ডিনারে বসেছি। বলাবাহুল্য সাথে একজন গাইড ছিলেন, যিনি আমাদের বেইজিং এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে সাংহাই পর্যন্ত পুরো প্রোগ্রামে সাথে থেকেছেন। আবার যেখানে গেছি সেখানকার একজন স্থানীয় গাইডও থেকেছেন। সেদিন খাবার টেবিলে পানীয়র মধ্যে সফট ড্রিংকস ছাড়াও ওদের ঐতিহ্যবাহী একটা ড্রিংকস ছিল; যা আমাদের মধ্যে কেউ খেয়েছেন কেউ খাননি। আর ছিল মাত্র দুই-আড়াইশ মিলি পানির একটা ছোট্ট বোতল প্রত্যেকের সামনে। আগের দিনগুলোতে এ দুটো আইটেম এভাবে আমরা দেখিনি। খাওয়ার মাঝে এক সময় বোতলটা হাতে নিতেই পাশেই বসা গাইড ছোট্ট করে বললেন, ‘কস্টলি ওয়াটার’। কথাটা শোনার পরে আমার কেমন যেন একটা আগ্রহ বেড়ে গেল ওটার প্রতি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম। দেখলাম বোতলটার সারা গায়ে চীনা ভাষায় লেখা। এক জায়গায় কেবল ইংরেজিতে ‘আলপস’ শব্দটা লেখা। ডিনার শেষে বোতলটা আমি ওই অবস্থায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ভাবনা আর মাথা থেকে যায় না। পানি বিশুদ্ধ হলেই তো হলো- এর আবার এমন কস্টলির কী আছে। তবে কি এটা আলপস পর্বতমালার পানি! হয়তো তাই হবে। এ পানি খেলে মানুষের হয়তো রোগ-বালাই হতে পারে না। জীবন দীর্ঘায়ু হয়। এতটুকু পানির দাম তা যতই হোক কিছু মানুষ তো আছে যারা এ পানি ছাড়া পান করেন না। হয়তো গোসলও করেন না এমন পানি ছাড়া। সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় তারা কিছু মানুষই তো বটে। সেই কিছু মানুষরা সংখ্যায় কত। অন্যদিকে এ পৃথিবীর কত মানুষ প্রতিদিন খাবার উপযোগী পানির অভাবের মধ্যে আছে, প্রতিদিন কত মানুষ কত কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে একটু সুপেয় পানি সংগ্রহ করার জন্য।

এ প্রসঙ্গে জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত সেই অ্যানিমেলস ফার্ম বইটির কথা এসে যায়। দেখা যায় ফার্মে যত প্রাণী আছে তার মধ্যে কিছু প্রাণী আছে যারা বেশি বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে কিন্তু তাই বলে বাকি অন্য সব প্রাণীদের যার যার মতো স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ-সুবিধার কোন অভাব হয় না। বইয়ের কাহিনী রূপক হলেও মানুষই তো বিষয়। সেই মানুষ কী করছে, ভোগবিলাস আর শক্তিমত্ততার মাত্রা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই যে, বাকি জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

এখানে কথা সেই বাকি জনগোষ্ঠী নিয়ে। বৈশ্বিক জলবায়ু এত যে বিরূপ হয়ে উঠছে সে কি ওই কিছু মানুষের কারণে নয়? সেকথা পরে হবে আগে নিজের দেশের দিকে একটু তাকান যাক। আমাদের নদীমাতৃক দেশের নদ-নদী, খাল-বিলের কী দশা হয়েছে বর্তমানে তা আমরা সবাই দেখছি। নদীর জমিতে এখন ফসল ফলছে ভালো। মানে ক্ষীণ হয়ে এসেছে নদীর প্রবাহ। হারিয়ে গেছে কত নদ-নদীর নাব্যতা। আমরা যেখানে নদী দেখেছি আমাদের নাতি-নাতনিরা না হোক তাদের নাতি-নাতনিরা হয়তো শুনবে ‘এইখানে এক নদী ছিল’। বড় বড় বিল-খালের ভেতর দিয়ে চলেছে বড় বড় রাস্তা। মানে বিল-খাল শুকিয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব কতখানি পড়েছে দেশের একটা অঞ্চলে তা বলতে বলতে এখন আর কেউ তেমন বলছেন না। তিস্তাসহ আরও নদ-নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার কারণেই প্রধানত নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীর এখন এ অবস্থা। বলা হচ্ছে ৫৪টা নদ-নদীর উজানে এ কাজ করা হয়েছে। ফসলাদি উৎপাদন এখন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল যে কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আর আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি সেই প্রায় দুই কোটি মানুষের মহানগরীর চারপাশের এবং ভেতরের নদী-খাল, যানজট, শব্দদূষণ বায়ুদূষণ ও জলাবদ্ধতা নিয়ে এখানে কিছু বলে আর এ লেখার কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ ঢাকায় যা ঘটছে তা সব শ্রেণীর মানুষই দেখছেন এবং কম-বেশি সবাই তার ভুক্তভোগী। আমরা ভালো ভালো দালানকোঠায় ঢুকছি অথচ সেগুলোর পাশ দিয়ে ড্রেনের পানি সরছে না। কেন সরছে না, কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে আর কথা নাই বাড়ালাম। তবে একটা কথা বলা যায়, যতদিন গরু মহিষ ছাগল ভেড়া হাঁস-মুরগি মহানগরীতে প্রসেসড না হয়ে জীবন্ত প্রবেশ করবে, নির্মাণ কাজের রাবিশ অপসারণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা না যাবে- ততদিন এ সংকট দূর হবে না।

এসব নিয়ে কারো যে মাথা ব্যথা নেই তা বলা যাবে না। বরং বলা যায় অতিমাত্রায় মাথা ব্যথা আছে কিছু মানুষের এবং সেই কিছু মানুষই লন্ডন আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া কানাডায় বাড়িঘর বানিয়ে পাড়ি দিচ্ছে। দেশের পানি-বাতাস-খরা অসহনীয় হয়ে উঠুক সাধারণ জনগোষ্ঠী আদিব্যাধী মহামারিতে সব নিপাত যাক তাতে তাদের কী এসে গেল। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হচ্ছে বলে যে শোনা যায় তার পেছনেও তো ওই একই মনমানসিকতা কাজ করছে। সেই কিছু মানুষ যেমন দেশ ছাড়ছে বা ছাড়ার কথা চিন্তা করে পোটলা বাঁধছে তেমন সেসব দেশের কিছু মানুষও পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করছে- ঘটনা তো একই। কাজেই বৈশ্ব্যিক জলবায়ু নিয়ে অন্য দেশের কথা আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

বৈশ্বিক জলবায়ু এত যে বিরূপ হয়ে উঠছে সে কি ওই কিছু মানুষের কারণে

এখন শুনুন আমার সেই কল্পনাটা যা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। ধরুন, এ পৃথিবীতে আসার আগে মানুষ এ রকমই একটা কোন গ্রহে বসবাস করত। সেখানেও এই কিছু মানুষের অতিমাত্রায় ভোগদখলের কারণে সেখানকার পরিবেশ প্রকৃতি এক সময় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ল। দূষিত হয়ে গেল সেখানকার পানি-বাতাস অসহনীয় হয়ে উঠল জীবন। তখন সেই কিছু মানুষ খুঁজতে থাকল বসবাসের জন্য ভালো কোন জায়গা সৌরজগৎ ঘুরে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল পৃথিবী নামক এ গ্রহটি। এসে পড়ল কিছু মানুষ এ পৃথিবীতে আর সেখানে পড়ে রইল কোটি কোটি অসহায় মানুষ। তারপর একদিন সেখানে সব শেষ হয়ে গেল।

পৃথিবীতে এসে কাটিয়ে দিল শত শত কোটি বছর। জ্ঞানবিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে উঠল। তারপর এখানেও সেই অতি ভোগের লালসা চরমে উঠতে লাগল। বেশি ভোগ করতে চাইলেই প্রকৃতির বেশি ক্ষতি হবে প্রকৃতির উপাদান বেশি ধ্বংস হবে। হতেও লাগল তাই। আর কিছু মানুষের হাতে ধনসম্পদের পাহাড় জমে উঠতে লাগল। জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে লাগল। তখন তারা আবার খুঁজতে বের হলো নতুন কোন পৃথিবী। পৌঁছেও গেল একখানে। দেখল সেখানে বিরান সবকিছু। পাহাড় ছিল, নদী-সাগর মরুভূমি বনাঞ্চল সবই ছিল-জীবন ছিল ভরপুর। এখন সব মৃত। সেই মৃত পাহাড় নদী সব কিছুর নমুনা দেখে তারা মোহিত হলো। কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। আসলে এটাই যে তাদের সেই বাসস্থান; যা তারা বসবাসের অনুপযুক্ত করে দিয়ে এক সময় ছেড়ে চলে এসেছিল তা আর বুঝলো না। বুঝতে চাইলোও না। ছুটলো সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহের সন্ধানে। তারপর একদিন পেয়েও গেল এবং চলেও গেল সেই কিছু মানুষ আমাদের এই পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষকে পেছনে ফেলে রেখে। ফেলে রেখে দূষিত বাতাস আর বিশাক্ত জলের মাঝে। পাঠক, সেই ‘কস্টলি’ ছোট্ট এক বোতল পানি থেকে এই আমার কল্পনা।

শেষ করবো যে কথাটা বলে- মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞানে ক্রমাগত এগিয়ে যাবে এটা তার ধর্ম। অজানাকে জানার জন্য ছুটে চলবে এমনকি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, শতায়ু থেকে সহস্রায়ু জীবনের সন্ধানে থাকবে সদা ব্যাপৃত- এটা যেমন সত্য একই সাথে এ সত্যটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, কিছু মানুষই এসব করতে সর্বদা অগ্রগামী থাকবে। ভোগও কিছু মানুষই বেশি করবে; কিন্তু সেটা যেন বাকি জনগোষ্ঠীর জীবন দুর্বিষহ করে দিয়ে না হয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কিছু মানুষের কারণে...

আব্দুল মান্নান খান

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩

কিছু মানুষের কারণে হয়তো এ দেশ-দুনিয়া একদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। জীবন হয়ে পড়বে বিপন্ন। শত শত কোটি মানুষকে বিষাক্ত বাতাস আর দুষিত পানির মধ্যে ফেলে রেখে সেই কিছু মানুষ হয়তো একদিন চলে যাবে অন্য কোন খানে-অন্য কোন গ্রহে। হয়তোবা এই পৃথিবীতে আসার আগেও এই কিছু মানুষ একই ভাবে ধ্বংস করে দিয়ে এসেছিল পৃথিবীর মতো অন্য কোন জগৎ।

না, গম্ভীর হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। এটা নিছক একটা কল্পনা মাত্র; কিন্তু কেন এমন কল্পনা এবার সেটাই দেখা যাক। তখন আমি চাকরিতে; গেছি শিক্ষাসফরে চীন দেশে। টিমে আমরা দশজন। ১৫ দিনের সফর। শেষ অবস্থান সাংহাই। সেদিন ছিল সফরের শেষ দিন। সন্ধ্যায় সাংহাইয়ের সেন্ট্রাল হোটেলে ডিনার করতে বসে ছোট্ট এক বোতল পানি হাতে নিয়ে এ কল্পনার উদয়- যা নাকি আজ পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি আমার। না, কোন কল্পকাহিনী লিখতে পারব না। সামান্য কিছুু লেখালেখি করি বটে তাই বলে সায়েন্স ফিকশান! না, তা সম্ভব না। যাই হোক, সেটা বলার আগে আরো কিছু কথা এখানে বলে নিতে হবে। সেই দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন সেটা দেখে আসাই ছিল আমাদের এ সফরের উদ্দেশ্য। আমরা মাঠ থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ছিলাম টিমে। সে দেশের বড় শহরের স্কুল ছোট শহরের স্কুল গ্রামের স্কুল পাহাড়ের ওপরের স্কুল যেমন আমাদের দেখান হয়েছে সাথে বেইজিং ভিত্তিক বিখ্যাত সব নিদর্শন যেমন গ্রেট ওয়াল, ফরবিডেন সিটি, সামার প্যালেস, টেম্পল অব হেভেন, তিয়েনআনমেন স্কয়ারও দেখানো হয়েছে। আবার বেইজিং থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই দূর পাহাড়ি প্রদেশ গানসুতে, যেখানে আমরা কেবলকারে চড়ে স্কুল দেখতে গিয়েছি। সেখানে হোয়াং হো শুধু দেখিনি বোটে করে ঘুরেছিও। সেখান থেকে চীনের পূর্বাঞ্চলের সাংহাই। এখানেও স্কুলের পাশাপাশি অ্যানসিয়েন্ট সিটি, ইউয়ান গার্ডেন, পুডং-এর ওরিয়েন্টাল পার্ল রেডিও অ্যান্ড টিভি টাওয়ার আমাদের দেখানো হয়েছে।

সাংহাইয়ের পুডং- এখানেই সেন্ট্রাল হোটেলে আমরা ডিনারে বসেছি। বলাবাহুল্য সাথে একজন গাইড ছিলেন, যিনি আমাদের বেইজিং এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে সাংহাই পর্যন্ত পুরো প্রোগ্রামে সাথে থেকেছেন। আবার যেখানে গেছি সেখানকার একজন স্থানীয় গাইডও থেকেছেন। সেদিন খাবার টেবিলে পানীয়র মধ্যে সফট ড্রিংকস ছাড়াও ওদের ঐতিহ্যবাহী একটা ড্রিংকস ছিল; যা আমাদের মধ্যে কেউ খেয়েছেন কেউ খাননি। আর ছিল মাত্র দুই-আড়াইশ মিলি পানির একটা ছোট্ট বোতল প্রত্যেকের সামনে। আগের দিনগুলোতে এ দুটো আইটেম এভাবে আমরা দেখিনি। খাওয়ার মাঝে এক সময় বোতলটা হাতে নিতেই পাশেই বসা গাইড ছোট্ট করে বললেন, ‘কস্টলি ওয়াটার’। কথাটা শোনার পরে আমার কেমন যেন একটা আগ্রহ বেড়ে গেল ওটার প্রতি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম। দেখলাম বোতলটার সারা গায়ে চীনা ভাষায় লেখা। এক জায়গায় কেবল ইংরেজিতে ‘আলপস’ শব্দটা লেখা। ডিনার শেষে বোতলটা আমি ওই অবস্থায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ভাবনা আর মাথা থেকে যায় না। পানি বিশুদ্ধ হলেই তো হলো- এর আবার এমন কস্টলির কী আছে। তবে কি এটা আলপস পর্বতমালার পানি! হয়তো তাই হবে। এ পানি খেলে মানুষের হয়তো রোগ-বালাই হতে পারে না। জীবন দীর্ঘায়ু হয়। এতটুকু পানির দাম তা যতই হোক কিছু মানুষ তো আছে যারা এ পানি ছাড়া পান করেন না। হয়তো গোসলও করেন না এমন পানি ছাড়া। সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় তারা কিছু মানুষই তো বটে। সেই কিছু মানুষরা সংখ্যায় কত। অন্যদিকে এ পৃথিবীর কত মানুষ প্রতিদিন খাবার উপযোগী পানির অভাবের মধ্যে আছে, প্রতিদিন কত মানুষ কত কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে একটু সুপেয় পানি সংগ্রহ করার জন্য।

এ প্রসঙ্গে জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত সেই অ্যানিমেলস ফার্ম বইটির কথা এসে যায়। দেখা যায় ফার্মে যত প্রাণী আছে তার মধ্যে কিছু প্রাণী আছে যারা বেশি বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে কিন্তু তাই বলে বাকি অন্য সব প্রাণীদের যার যার মতো স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ-সুবিধার কোন অভাব হয় না। বইয়ের কাহিনী রূপক হলেও মানুষই তো বিষয়। সেই মানুষ কী করছে, ভোগবিলাস আর শক্তিমত্ততার মাত্রা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই যে, বাকি জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

এখানে কথা সেই বাকি জনগোষ্ঠী নিয়ে। বৈশ্বিক জলবায়ু এত যে বিরূপ হয়ে উঠছে সে কি ওই কিছু মানুষের কারণে নয়? সেকথা পরে হবে আগে নিজের দেশের দিকে একটু তাকান যাক। আমাদের নদীমাতৃক দেশের নদ-নদী, খাল-বিলের কী দশা হয়েছে বর্তমানে তা আমরা সবাই দেখছি। নদীর জমিতে এখন ফসল ফলছে ভালো। মানে ক্ষীণ হয়ে এসেছে নদীর প্রবাহ। হারিয়ে গেছে কত নদ-নদীর নাব্যতা। আমরা যেখানে নদী দেখেছি আমাদের নাতি-নাতনিরা না হোক তাদের নাতি-নাতনিরা হয়তো শুনবে ‘এইখানে এক নদী ছিল’। বড় বড় বিল-খালের ভেতর দিয়ে চলেছে বড় বড় রাস্তা। মানে বিল-খাল শুকিয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব কতখানি পড়েছে দেশের একটা অঞ্চলে তা বলতে বলতে এখন আর কেউ তেমন বলছেন না। তিস্তাসহ আরও নদ-নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার কারণেই প্রধানত নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীর এখন এ অবস্থা। বলা হচ্ছে ৫৪টা নদ-নদীর উজানে এ কাজ করা হয়েছে। ফসলাদি উৎপাদন এখন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল যে কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আর আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি সেই প্রায় দুই কোটি মানুষের মহানগরীর চারপাশের এবং ভেতরের নদী-খাল, যানজট, শব্দদূষণ বায়ুদূষণ ও জলাবদ্ধতা নিয়ে এখানে কিছু বলে আর এ লেখার কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ ঢাকায় যা ঘটছে তা সব শ্রেণীর মানুষই দেখছেন এবং কম-বেশি সবাই তার ভুক্তভোগী। আমরা ভালো ভালো দালানকোঠায় ঢুকছি অথচ সেগুলোর পাশ দিয়ে ড্রেনের পানি সরছে না। কেন সরছে না, কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে আর কথা নাই বাড়ালাম। তবে একটা কথা বলা যায়, যতদিন গরু মহিষ ছাগল ভেড়া হাঁস-মুরগি মহানগরীতে প্রসেসড না হয়ে জীবন্ত প্রবেশ করবে, নির্মাণ কাজের রাবিশ অপসারণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা না যাবে- ততদিন এ সংকট দূর হবে না।

এসব নিয়ে কারো যে মাথা ব্যথা নেই তা বলা যাবে না। বরং বলা যায় অতিমাত্রায় মাথা ব্যথা আছে কিছু মানুষের এবং সেই কিছু মানুষই লন্ডন আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া কানাডায় বাড়িঘর বানিয়ে পাড়ি দিচ্ছে। দেশের পানি-বাতাস-খরা অসহনীয় হয়ে উঠুক সাধারণ জনগোষ্ঠী আদিব্যাধী মহামারিতে সব নিপাত যাক তাতে তাদের কী এসে গেল। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হচ্ছে বলে যে শোনা যায় তার পেছনেও তো ওই একই মনমানসিকতা কাজ করছে। সেই কিছু মানুষ যেমন দেশ ছাড়ছে বা ছাড়ার কথা চিন্তা করে পোটলা বাঁধছে তেমন সেসব দেশের কিছু মানুষও পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করছে- ঘটনা তো একই। কাজেই বৈশ্ব্যিক জলবায়ু নিয়ে অন্য দেশের কথা আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

বৈশ্বিক জলবায়ু এত যে বিরূপ হয়ে উঠছে সে কি ওই কিছু মানুষের কারণে

এখন শুনুন আমার সেই কল্পনাটা যা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। ধরুন, এ পৃথিবীতে আসার আগে মানুষ এ রকমই একটা কোন গ্রহে বসবাস করত। সেখানেও এই কিছু মানুষের অতিমাত্রায় ভোগদখলের কারণে সেখানকার পরিবেশ প্রকৃতি এক সময় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ল। দূষিত হয়ে গেল সেখানকার পানি-বাতাস অসহনীয় হয়ে উঠল জীবন। তখন সেই কিছু মানুষ খুঁজতে থাকল বসবাসের জন্য ভালো কোন জায়গা সৌরজগৎ ঘুরে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল পৃথিবী নামক এ গ্রহটি। এসে পড়ল কিছু মানুষ এ পৃথিবীতে আর সেখানে পড়ে রইল কোটি কোটি অসহায় মানুষ। তারপর একদিন সেখানে সব শেষ হয়ে গেল।

পৃথিবীতে এসে কাটিয়ে দিল শত শত কোটি বছর। জ্ঞানবিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে উঠল। তারপর এখানেও সেই অতি ভোগের লালসা চরমে উঠতে লাগল। বেশি ভোগ করতে চাইলেই প্রকৃতির বেশি ক্ষতি হবে প্রকৃতির উপাদান বেশি ধ্বংস হবে। হতেও লাগল তাই। আর কিছু মানুষের হাতে ধনসম্পদের পাহাড় জমে উঠতে লাগল। জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে লাগল। তখন তারা আবার খুঁজতে বের হলো নতুন কোন পৃথিবী। পৌঁছেও গেল একখানে। দেখল সেখানে বিরান সবকিছু। পাহাড় ছিল, নদী-সাগর মরুভূমি বনাঞ্চল সবই ছিল-জীবন ছিল ভরপুর। এখন সব মৃত। সেই মৃত পাহাড় নদী সব কিছুর নমুনা দেখে তারা মোহিত হলো। কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। আসলে এটাই যে তাদের সেই বাসস্থান; যা তারা বসবাসের অনুপযুক্ত করে দিয়ে এক সময় ছেড়ে চলে এসেছিল তা আর বুঝলো না। বুঝতে চাইলোও না। ছুটলো সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহের সন্ধানে। তারপর একদিন পেয়েও গেল এবং চলেও গেল সেই কিছু মানুষ আমাদের এই পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষকে পেছনে ফেলে রেখে। ফেলে রেখে দূষিত বাতাস আর বিশাক্ত জলের মাঝে। পাঠক, সেই ‘কস্টলি’ ছোট্ট এক বোতল পানি থেকে এই আমার কল্পনা।

শেষ করবো যে কথাটা বলে- মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞানে ক্রমাগত এগিয়ে যাবে এটা তার ধর্ম। অজানাকে জানার জন্য ছুটে চলবে এমনকি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, শতায়ু থেকে সহস্রায়ু জীবনের সন্ধানে থাকবে সদা ব্যাপৃত- এটা যেমন সত্য একই সাথে এ সত্যটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, কিছু মানুষই এসব করতে সর্বদা অগ্রগামী থাকবে। ভোগও কিছু মানুষই বেশি করবে; কিন্তু সেটা যেন বাকি জনগোষ্ঠীর জীবন দুর্বিষহ করে দিয়ে না হয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top