alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিএনপি নেতৃত্বের সংকট ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩

বাংলাদেশে যে দুটি ধারার রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্বের আসনে- বিএনপি তার একটি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়ে দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। বিএনপি একটি মিশ্র ধারার রাজনৈতিক শক্তি। ২০০৬ সালের পর থেকে টানা ক্ষমতার বাইরে তাদের অবস্থান। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে কাটিয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে জামিন লাভ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে আজও মুক্ত হতে পারেননি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে দেশের বাইরে।

দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিএনপির রাজনীতির অনুসারী। মধ্যপন্থী রাজনীতির জনপ্রিয় একটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করেও বিএনপি দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে। জনসমর্থন থাকলেও দলটির নেতৃত্ব সেটিকে কাজে লাগিয়ে কার্যকর কোন রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারেনি। বলা যায় বিএনপি নেতৃত্ব বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী? দলটি কী পারবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নেতৃত্ব দিতে? কিংবা সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে? এ প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর খুবই কঠিন।

ঐতিহাসিক বিচারে বিএনপি কখনোই র‌্যাডিক্যাল কিংবা মিলিট্যান্ট রাজনৈতিক দলের মতো ছিল না। ক্ষমতার অলিন্দে গড়ে উঠলেও এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি কিংবা দর্শন বিএনপি গ্রহণ করেছে, যা এ দেশের বিপুল মানুষ সাদরে গ্রহণ করে। ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বিএনপি তাই এগিয়েছে বহুদূর। তাত্ত্বিকভাবে এ কথা সত্য। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন মেরুকরণে দলটির অবস্থান কোথায়? দলের নেতৃত্বের কথা এক্ষেত্রে বারবার ঘুরে ফিরে আসে। বহু মত ও পথের সংমিশ্রণে বিএনপির যে রাজনৈতিক রূপ তার উদারনৈতিকতাই মানুষের পছন্দের।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এক সামরিক অভ্যুথানে নিহত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন। যদিও খালেদা জিয়ার কোনরূপ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না, উনি কোনভাবেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না কিংবা রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠেননি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি হাইকমান্ড তাকে সামনে নিয়ে আসে এবং চেয়ারপারসনের আসনে বসান। এরপর মূলত এরশাদবিরোধী আন্দোলন তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচন না করার ঘোষণা , কোন নির্বাচন না করা এবং কয়েকবার কারাবরণের উদহারণ টেনে বিএনপি নেতারা তাকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে মানুষের সামনে তুলে ধরে এবং তারা সফল ও হয়। যার ফলশ্রুতিতে বিএনপি তার নেতৃত্বে এককভাবে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে। রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার বড় সফলতা মূলত এটাই।

ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই মনে করেন, বিএনপি নেতৃত্ব দক্ষতার সঙ্গে এবারের আন্দোলনে জনগণের সামনে একটি সহজ-সরল সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সে সিদ্ধান্তটি হলো স্বৈরতন্ত্রের পতন হলে দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে; অন্যথায় মুক্তির সব পথই রুদ্ধ। ফলে গণতন্ত্রকামী নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আন্দোলনে সাড়া দেবে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে আসা কিংবা বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া এমন অনেক নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ কিংবা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পারস্পরিক নানা আলোচনা থেকে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানও বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। যেখানে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে বলেও নেতাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে ১৯৯৯ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট গঠনের শুরুতে ছিল এই জাতীয় পার্টি। তবে পরে দলটির তৎকালীন সভাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জোট থেকে বেরিয়ে গেলে তার দলের মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে তখন জাতীয় পার্টির একটি অংশ বিএনপির জোটের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে মরহুম কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির আরেকটি অংশ বিএনপির জোটে আসে। যে দলটি এখনো ২০ দলীয় জোটে রয়েছে।

দল হিসেবে বিএনপি অবস্থা বা অবস্থান কতটা সংহত বা সুদৃঢ়। তারা এদেশে ইতোপূর্বে কয়েক দফায় ক্ষমতা মসনদে আসীন ছিলেন। তবে পূর্বেকার ক্ষমতা দম্ভে তারাও অনেক অসংহত, এলোমেলো ও অগোছালো। সবলতা, সক্ষমতা ও দূর্বলতার মানদন্ডে সব দলের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে যে অনুশীলন আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের করার দরকার তা থেকে বিএনপি কেন, কোন রাজনৈতিক দলই সে অনুসরণ হয় না।

যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলসমূহ আবির্ভূত হয়ে থাকে, সেগুলো কাগুজে কর্মসূচি ছাড়া আর কিছুই নয়। নেতৃত্ব সৃষ্টি, নেতার গুণাবলী অর্জন এবং গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের জন্য যে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন সেগুলো অর্জনের জন্য ধাপভিত্তিক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন, মহড়া, স্টাডি, পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ইত্যাদির কোনটাই অনুসরণ করা হয় না। আমাদের এদেশে মা লক্ষ্মীর বর পেয়ে অথবা বড় ভাই বা বড় দাদার আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে রাতারাতি বড় নেতায় পরিণত হতে দেখা যায়। যাকে বলে ভুঁইফোঁড় নেতৃত্ব।

অভিজ্ঞতাহীন ও মেধাশূন্য এ নেতৃত্বের ফলাফল ভালো হয় না। নেতৃত্বের কোন পর্যায়ে কী যোগ্যতা কতটা অর্জন এগুলোর কোনটারই বালাই নাই। এমনকি সাংগঠনিক শক্তিকে মজবুত ও টেকসই করতে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা আবশ্যক তার কোন চর্চা আমাদের দলসমূহে নেই। সেক্ষেত্রে বিএনপিও ব্যতিক্রম নয়। বড় দলগুলোতে বিএনপিসহ স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ভুল বোঝাবুঝির প্রাবল্য দেখা যায়। এতে মনোমালিন্য দূরত্ব ও ব্যবধান সৃষ্টি হয় এবং একে অন্যের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হতে থাকে। এ সংকট ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হয়।

আজকাল অনেকক্ষেত্রে বড় দলসমূহে মাস্তানি ও সন্ত্রাসীর মহড়ার জন্য আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ সমস্ত বাজে কাজে দৌরাত্ম্য ও রাহাজানি সৃষ্টিতে পারঙ্গমতায় রাজনৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠত্ব ও যোগ্যতার অধিকারীদের নেতৃত্বের আসন দেয়া হয়ে থাকে। ধিক্ এ অধপতিত অবস্থাকে। অন্যায় অনৈতিকতানির্ভর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে অনেকক্ষেত্রেই উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। অথচ উন্নত দেশে দৃশ্যমান হয় তার বিপরীত চিত্র। সেখানে কত কতটা সুনাগরিক ও সভ্যতার চিত্র তুলে ধরবেন তাকে মাপকাঠি ধরেই শাসনতান্ত্রিক ধারায় যোগ্যতম প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়।

পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয় যেন, আমাদের দেশে নেতা ও নেতৃত্ব এমনই শক্তিশালী যে, সব প্রতিযোগিতায় তারাই সেরা। এহেন মনোভাব অনেকক্ষেত্রে ভালো বটে। তবে সে মনোভাবে বা মানসিকতায় যদি কোন প্রতারণা বা বঞ্চনা থাকে তবে তাকে আর গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ কিভাবে বলা যাবে? যাই হোক বিএনপিতে যে নেতৃত্বে সংকট তাকে জনগণ হয়তো বা বিএনপি জন্যসমস্যা ও দুর্বলতা হিসেবে দেখছে। এ সংকট অতিক্রম করা বিএনপির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জও বটে। এক্ষেত্রে কোন চালাকি বা চতুরতা নয়। কৌশলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনগণের আস্থা অর্জনে সক্রিয় ভূমিকায় ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির পথে আসতে হবে।

দল হিসেবে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এত শক্তিশালী নয়-তবে আওয়ামী বিরোধীতাই যেন অনেকটা বিএনপির শক্তির উৎস। তবে চালাকি, চতুরতা বা ছলনার আশ্রয় নিয়ে কোন সুবিধা করতে পারবে না বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা তাদের প্রতিপক্ষরা চালাকি ও চতুরতায় কোন সাধারণ খেলোয়াড় নয়। যাই হোক, বিএনপি যত সংযমী ও সহনশীল হবে এবং আগামী দিনে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে সরকার পরিচালনার নৈতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগাতে পারবে তাহলে তাদের এযাবৎকালের ক্ষতিসমূহ পুষিয়ে লক্ষ্য পূরণের এগুতে সক্ষম হবে।

বিএনপির রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিন্ত অপরিহার্য কেউ নন, তার রাজনৈতিক বিদায় কিংবা পার্মানেন্ট দেশত্যাগ বিএনপিতে আর বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না। বর, এখন বিএনপির সিনিয়র নেতাদের উচিত দলকে অমূলভাবে সংস্কার করে পরিবর্তিত জাতীয় রাজনীতি এবং বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দলকে ঢেলে সাজানো। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিএনপির ভোটব্যাংক হচ্ছে মূলত আওয়ামীবিরোধী ভোট। বাংলাদেশের ভোটার রাজনীতি দুইভাগে বিভক্ত, আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগবিরোধী। বিএনপি হয়তো এই আওয়ামী লীগবিরোধী প্ল্যাটফর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আজ বিএনপি না থাকলে কাল অন্যদল সে জায়গা দখল করবে। তাই খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে সর্বদা সক্রিয়ও থাকতেই হবে এমন কোনো দায়বদ্ধতা নেই। বিএনপির উচিত এখন খালেদা পরবর্তী রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণ ও কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

রোজায় দ্রব্যমূল্য বাড়ে কেন

‘স্যার’ সম্বোধন নিয়ে তুলকালাম কান্ড

পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতি

‘সেপা’ চুক্তি নিয়ে কিছু কথা

ব্যাংক খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা

অবৈধ নোট-গাইড চলে কিভাবে

‘স্যার’ সম্বোধনের সংস্কৃতি

ছবি

ফসলের গায়ে পাখির রক্ত কেন?

খাদ্যে ভেজাল : আইনগত ও স্বাস্থ্যগত দিক

অসম্পূর্ণ এক সিঁড়ি ঘাট

পানি কেন পণ্য?

কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে পারিবারিক শিক্ষা

খাদ্যপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন জরুরি

স্বাধীনতার ৫২ বছর : কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই

মালাকারটোলা গণহত্যা : দুঃসহ স্মৃতি

ছবি

স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

ছবি

বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা ও মুক্তির চেতনা

ছবি

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা

সিপিআই (এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেতৃত্বের মূল্যায়ন

ছবি

অরক্ষিত নন ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ব্যাংক ও মানুষের আস্থা

চাই ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাবার

ছবি

তিতাস অববাহিকার বিপন্ন কৃষিজমিন

প্রিয়েমশন মামলা সম্পর্কিত আইনি সমস্যা ও সমাধান

ছবি

স্মরণ : মাস্টার’দা সূর্যসেন

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা

খাদ্য পর্যটন : নবদিগন্তের হাতছানি

ধূপখোলা মাঠ রক্ষা করতে হবে

হজ বাণিজ্যিক পণ্য নয়

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

পশ্চিম বাংলায় নির্বাচন হোক রক্তপাতহীন

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কালক্ষেপণ নয়

ছবি

কৃষিজমি সুরক্ষায় সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিএনপি নেতৃত্বের সংকট ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩

বাংলাদেশে যে দুটি ধারার রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্বের আসনে- বিএনপি তার একটি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়ে দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। বিএনপি একটি মিশ্র ধারার রাজনৈতিক শক্তি। ২০০৬ সালের পর থেকে টানা ক্ষমতার বাইরে তাদের অবস্থান। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে কাটিয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে জামিন লাভ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে আজও মুক্ত হতে পারেননি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে দেশের বাইরে।

দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিএনপির রাজনীতির অনুসারী। মধ্যপন্থী রাজনীতির জনপ্রিয় একটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করেও বিএনপি দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে। জনসমর্থন থাকলেও দলটির নেতৃত্ব সেটিকে কাজে লাগিয়ে কার্যকর কোন রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারেনি। বলা যায় বিএনপি নেতৃত্ব বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী? দলটি কী পারবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নেতৃত্ব দিতে? কিংবা সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে? এ প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর খুবই কঠিন।

ঐতিহাসিক বিচারে বিএনপি কখনোই র‌্যাডিক্যাল কিংবা মিলিট্যান্ট রাজনৈতিক দলের মতো ছিল না। ক্ষমতার অলিন্দে গড়ে উঠলেও এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি কিংবা দর্শন বিএনপি গ্রহণ করেছে, যা এ দেশের বিপুল মানুষ সাদরে গ্রহণ করে। ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বিএনপি তাই এগিয়েছে বহুদূর। তাত্ত্বিকভাবে এ কথা সত্য। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন মেরুকরণে দলটির অবস্থান কোথায়? দলের নেতৃত্বের কথা এক্ষেত্রে বারবার ঘুরে ফিরে আসে। বহু মত ও পথের সংমিশ্রণে বিএনপির যে রাজনৈতিক রূপ তার উদারনৈতিকতাই মানুষের পছন্দের।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এক সামরিক অভ্যুথানে নিহত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন। যদিও খালেদা জিয়ার কোনরূপ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না, উনি কোনভাবেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না কিংবা রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠেননি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি হাইকমান্ড তাকে সামনে নিয়ে আসে এবং চেয়ারপারসনের আসনে বসান। এরপর মূলত এরশাদবিরোধী আন্দোলন তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচন না করার ঘোষণা , কোন নির্বাচন না করা এবং কয়েকবার কারাবরণের উদহারণ টেনে বিএনপি নেতারা তাকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে মানুষের সামনে তুলে ধরে এবং তারা সফল ও হয়। যার ফলশ্রুতিতে বিএনপি তার নেতৃত্বে এককভাবে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে। রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার বড় সফলতা মূলত এটাই।

ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই মনে করেন, বিএনপি নেতৃত্ব দক্ষতার সঙ্গে এবারের আন্দোলনে জনগণের সামনে একটি সহজ-সরল সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সে সিদ্ধান্তটি হলো স্বৈরতন্ত্রের পতন হলে দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে; অন্যথায় মুক্তির সব পথই রুদ্ধ। ফলে গণতন্ত্রকামী নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আন্দোলনে সাড়া দেবে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে আসা কিংবা বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া এমন অনেক নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ কিংবা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পারস্পরিক নানা আলোচনা থেকে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানও বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। যেখানে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে বলেও নেতাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে ১৯৯৯ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট গঠনের শুরুতে ছিল এই জাতীয় পার্টি। তবে পরে দলটির তৎকালীন সভাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জোট থেকে বেরিয়ে গেলে তার দলের মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে তখন জাতীয় পার্টির একটি অংশ বিএনপির জোটের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে মরহুম কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির আরেকটি অংশ বিএনপির জোটে আসে। যে দলটি এখনো ২০ দলীয় জোটে রয়েছে।

দল হিসেবে বিএনপি অবস্থা বা অবস্থান কতটা সংহত বা সুদৃঢ়। তারা এদেশে ইতোপূর্বে কয়েক দফায় ক্ষমতা মসনদে আসীন ছিলেন। তবে পূর্বেকার ক্ষমতা দম্ভে তারাও অনেক অসংহত, এলোমেলো ও অগোছালো। সবলতা, সক্ষমতা ও দূর্বলতার মানদন্ডে সব দলের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে যে অনুশীলন আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের করার দরকার তা থেকে বিএনপি কেন, কোন রাজনৈতিক দলই সে অনুসরণ হয় না।

যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলসমূহ আবির্ভূত হয়ে থাকে, সেগুলো কাগুজে কর্মসূচি ছাড়া আর কিছুই নয়। নেতৃত্ব সৃষ্টি, নেতার গুণাবলী অর্জন এবং গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের জন্য যে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন সেগুলো অর্জনের জন্য ধাপভিত্তিক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন, মহড়া, স্টাডি, পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ইত্যাদির কোনটাই অনুসরণ করা হয় না। আমাদের এদেশে মা লক্ষ্মীর বর পেয়ে অথবা বড় ভাই বা বড় দাদার আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে রাতারাতি বড় নেতায় পরিণত হতে দেখা যায়। যাকে বলে ভুঁইফোঁড় নেতৃত্ব।

অভিজ্ঞতাহীন ও মেধাশূন্য এ নেতৃত্বের ফলাফল ভালো হয় না। নেতৃত্বের কোন পর্যায়ে কী যোগ্যতা কতটা অর্জন এগুলোর কোনটারই বালাই নাই। এমনকি সাংগঠনিক শক্তিকে মজবুত ও টেকসই করতে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা আবশ্যক তার কোন চর্চা আমাদের দলসমূহে নেই। সেক্ষেত্রে বিএনপিও ব্যতিক্রম নয়। বড় দলগুলোতে বিএনপিসহ স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ভুল বোঝাবুঝির প্রাবল্য দেখা যায়। এতে মনোমালিন্য দূরত্ব ও ব্যবধান সৃষ্টি হয় এবং একে অন্যের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হতে থাকে। এ সংকট ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হয়।

আজকাল অনেকক্ষেত্রে বড় দলসমূহে মাস্তানি ও সন্ত্রাসীর মহড়ার জন্য আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ সমস্ত বাজে কাজে দৌরাত্ম্য ও রাহাজানি সৃষ্টিতে পারঙ্গমতায় রাজনৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠত্ব ও যোগ্যতার অধিকারীদের নেতৃত্বের আসন দেয়া হয়ে থাকে। ধিক্ এ অধপতিত অবস্থাকে। অন্যায় অনৈতিকতানির্ভর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে অনেকক্ষেত্রেই উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। অথচ উন্নত দেশে দৃশ্যমান হয় তার বিপরীত চিত্র। সেখানে কত কতটা সুনাগরিক ও সভ্যতার চিত্র তুলে ধরবেন তাকে মাপকাঠি ধরেই শাসনতান্ত্রিক ধারায় যোগ্যতম প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়।

পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয় যেন, আমাদের দেশে নেতা ও নেতৃত্ব এমনই শক্তিশালী যে, সব প্রতিযোগিতায় তারাই সেরা। এহেন মনোভাব অনেকক্ষেত্রে ভালো বটে। তবে সে মনোভাবে বা মানসিকতায় যদি কোন প্রতারণা বা বঞ্চনা থাকে তবে তাকে আর গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ কিভাবে বলা যাবে? যাই হোক বিএনপিতে যে নেতৃত্বে সংকট তাকে জনগণ হয়তো বা বিএনপি জন্যসমস্যা ও দুর্বলতা হিসেবে দেখছে। এ সংকট অতিক্রম করা বিএনপির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জও বটে। এক্ষেত্রে কোন চালাকি বা চতুরতা নয়। কৌশলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনগণের আস্থা অর্জনে সক্রিয় ভূমিকায় ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির পথে আসতে হবে।

দল হিসেবে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এত শক্তিশালী নয়-তবে আওয়ামী বিরোধীতাই যেন অনেকটা বিএনপির শক্তির উৎস। তবে চালাকি, চতুরতা বা ছলনার আশ্রয় নিয়ে কোন সুবিধা করতে পারবে না বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা তাদের প্রতিপক্ষরা চালাকি ও চতুরতায় কোন সাধারণ খেলোয়াড় নয়। যাই হোক, বিএনপি যত সংযমী ও সহনশীল হবে এবং আগামী দিনে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে সরকার পরিচালনার নৈতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগাতে পারবে তাহলে তাদের এযাবৎকালের ক্ষতিসমূহ পুষিয়ে লক্ষ্য পূরণের এগুতে সক্ষম হবে।

বিএনপির রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিন্ত অপরিহার্য কেউ নন, তার রাজনৈতিক বিদায় কিংবা পার্মানেন্ট দেশত্যাগ বিএনপিতে আর বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না। বর, এখন বিএনপির সিনিয়র নেতাদের উচিত দলকে অমূলভাবে সংস্কার করে পরিবর্তিত জাতীয় রাজনীতি এবং বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দলকে ঢেলে সাজানো। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিএনপির ভোটব্যাংক হচ্ছে মূলত আওয়ামীবিরোধী ভোট। বাংলাদেশের ভোটার রাজনীতি দুইভাগে বিভক্ত, আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগবিরোধী। বিএনপি হয়তো এই আওয়ামী লীগবিরোধী প্ল্যাটফর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আজ বিএনপি না থাকলে কাল অন্যদল সে জায়গা দখল করবে। তাই খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে সর্বদা সক্রিয়ও থাকতেই হবে এমন কোনো দায়বদ্ধতা নেই। বিএনপির উচিত এখন খালেদা পরবর্তী রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণ ও কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top