সাঈদ চৌধুরী
প্রাণীর জন্য মায়া হয়। খুব মায়া হয়। ওরা কথা বলতে পারে না কিন্তু ওদের অনভূতি আছে। আমরা অনেকেই স্পর্শ না করলেও ওদের সুখ-দুঃখ ইচ্ছে করলেই বোঝা যায়। সাফারি পার্কের হাতিটি মারা গেছে শুনলাম। সংবাদ মাধ্যম বলছে দুই হাতি মারামারি করে মারা গেছে। তারপর আবার একটি সিংহিও মারা গেছে।
প্রাণ থাকলে সে মারা যাবে একদিন এটাই সত্য। কিন্তু কেন যেন মন খারাপ হয়। খেয়াল করেছেন নিশ্চই কদিন আগে অনেক পাখি মারা গিয়েছে, আহত হয়েছে, রাস্তায় ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে থেকেছে। কেমন যেন অসহ্য লেগেছে! বাজি ফুটনো আর পটকার শব্দে কী এক ভীতি নিয়ে এরা দৌড়ে পালাতে গিয়ে মারা পড়েছে।
আমাদের আনন্দ করতে হয় আর সে আনন্দ সব অভিশাপ হয়ে পড়ে অসহায়ের ওপর। আমরা কোনো কিছু ভাবতে জানি না, আমরা বুঝি না আমাদের মানুষদের সঙ্গে আর কী কী উপাদান প্রকৃতিতে বাস করে!
ভাওয়াল বনের ভেতর দিয়ে প্রায়ই কিছু ছেলে মোটরসাইকেলে হর্ন চাপ দিয়ে ধরে বন অতিক্রম করে। বেশি শব্দে মোটরসাইকেল চালায়। বন্যপ্রাণীরা ভয়ে এখন আর রাস্তার পাশের কোনো গাছে থাকতে পারে না। বিদ্যুতের তার নেয়ার জন্য অনেক গাছ কেটেও ফেলা হয়েছে বনের ভেতর বিভিন্ন জায়গায়! আমাদের বন সুরক্ষায় যারা দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বিকার এবং অনেকটা অথর্ব ও দুর্নীতিবাজও! তাদের এগুলো দেখে না দেখার ভান অনেক সহজাত! তারা হয়তো প্রাণীর কোন কষ্ট ছোটবেলায় উপলব্ধি করে বনের অফিসার হয়ে উঠতে পারেননি !
যে মানুষগুলো বছরের প্রথমদিন বলে পটকা ফুটিয়ে পুরো দেশ জানান দিল তারা কোনোদিন কী একটা পাখি, একটা হাঁস, বা একটা প্রাণীর সংস্পর্শে আসেননি? যদি আসতেন তবে এমন কখনই করতে পারতেন না ! তারাও এক ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে নিজেদের আত্মাকে আবৃত করে বড় হয়েছে। কিছুদিন আগে একজন মেয়ের একটা সংবাদ টিভি চ্যানেলে দেখছিলাম। তিনি কুকুরকে আদর করেন, খাওয়ান, ভালোবাসেন। তাই কুকুরগুলো তার খুব কাছে আসে। আশ্চর্যজনক বিষয় সেই সংবাদের নিচে গিয়ে দেখলাম শত শত নেগেটিভ মন্তব্য। এমনও কেউ কেউ লিখেছেন যে কুকুরকে ভালোবেসে লাভ কী যে দেশে মানুষকে ভালোবেসে লাভ নেই। কেউ লিখেছেন মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে না আসছে কুকুরকে খাওয়াতে। মন্তব্য ভালো কয়েকজনের মাত্র। যেন কুকুরকে ভালোবেসে তিনি অপরাধ করেছেন। এর চেয়ে মনে হয় ভালো ছিল কুকুরগুলোকে মেরে ফেলা। এসব দেখে লজ্জা পাই, নিজেকে পরাজিত মনে হয়। আমরা কবে সুশিক্ষিত হব এটা যেন আজন্মের প্রশ্ন আমাদের। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন এখন আমরা কবে দয়াশীল হব।
যাই হোক সাফারি পার্কের কথায় ছিলাম। হাতিটি মারা গেল- সিংহীও। এর আগে জেব্রাসহ অনেক প্রাণী মারা গিয়েছে। আমাদের দেশে কারণ উদ্ঘাটনের চেয়েও কারণ ধামাচাপা দিতে একশ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বেশি লেগে থাকে। তাদের মধ্যে সবাই ভাবে কারণ উদ্ঘাটিত হলে আমরা যদি এখানে ফেঁসে যাই। দায়িত্বে অবহেলোর একটা ভয় থেকে কেউ আর কারণ বের করতে চান না। তারপরও জেব্রা নিয়ে তদন্ত হয়েছিল। এটা ভালো দিক হলেও প্রি-কশন বা আগে যে সাবধানতা গ্রহণ করা প্রয়োজন তা আমরা কী নিতে পেরেছিলাম ?
হাতি, সিংহির বেলাও একই প্রশ্নের জন্ম দিল আবার। সাফারি পার্ক ঘুরে এসে একটা সারস পাখির কথা লিখেছিলাম। ওর কোনো সঙ্গী নেই। তাই ওর মন খারাপ থাকে। আসলে প্রাণীর ভাষা বুঝতে পারলে ওদের কাছে যারা যায়, ওদের স্পর্শ করা যায়। জীবনে চলার পথে আমাদের মায়ার অভাব হলে আমরা আর মানুষ থাকি না। এখন আমাদের মায়ার অভাব দেখা দিয়েছে। আমরা নিয়ম-কানুন, পরিবেশের ওপর দায়িত্ব সব থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। শিশুদের আমরা শুধু আর্টিফিশিয়াল পণ্যের সঙ্গে এত বেশি নিবীড় স¤পর্ক গড়ে দিচ্ছি যে এখন আর শিশুরা হাঁস, মুরগি, গরু দেখে আনন্দও পায় না। পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসর যতটা চেনে বাচ্চারা ততটা গরু ঘোড়াও চেনে কিনা সন্দেহ।
মায়া আর প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টির মাধ্যমেই কেবল শিশুদের কোমল হৃদয়কে পৃথিবীর উপযোগী করে তোলা যেতে পারে। আসুন শিশুদের প্রাণীর সংস্পর্শে রাখি এবং প্রাণীর নিরাপত্তায় তাদেরও যে দায়িত্ব আছে তা শেখাই।
[লেখক: রসায়নবিদ]
সাঈদ চৌধুরী
শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৩
প্রাণীর জন্য মায়া হয়। খুব মায়া হয়। ওরা কথা বলতে পারে না কিন্তু ওদের অনভূতি আছে। আমরা অনেকেই স্পর্শ না করলেও ওদের সুখ-দুঃখ ইচ্ছে করলেই বোঝা যায়। সাফারি পার্কের হাতিটি মারা গেছে শুনলাম। সংবাদ মাধ্যম বলছে দুই হাতি মারামারি করে মারা গেছে। তারপর আবার একটি সিংহিও মারা গেছে।
প্রাণ থাকলে সে মারা যাবে একদিন এটাই সত্য। কিন্তু কেন যেন মন খারাপ হয়। খেয়াল করেছেন নিশ্চই কদিন আগে অনেক পাখি মারা গিয়েছে, আহত হয়েছে, রাস্তায় ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে থেকেছে। কেমন যেন অসহ্য লেগেছে! বাজি ফুটনো আর পটকার শব্দে কী এক ভীতি নিয়ে এরা দৌড়ে পালাতে গিয়ে মারা পড়েছে।
আমাদের আনন্দ করতে হয় আর সে আনন্দ সব অভিশাপ হয়ে পড়ে অসহায়ের ওপর। আমরা কোনো কিছু ভাবতে জানি না, আমরা বুঝি না আমাদের মানুষদের সঙ্গে আর কী কী উপাদান প্রকৃতিতে বাস করে!
ভাওয়াল বনের ভেতর দিয়ে প্রায়ই কিছু ছেলে মোটরসাইকেলে হর্ন চাপ দিয়ে ধরে বন অতিক্রম করে। বেশি শব্দে মোটরসাইকেল চালায়। বন্যপ্রাণীরা ভয়ে এখন আর রাস্তার পাশের কোনো গাছে থাকতে পারে না। বিদ্যুতের তার নেয়ার জন্য অনেক গাছ কেটেও ফেলা হয়েছে বনের ভেতর বিভিন্ন জায়গায়! আমাদের বন সুরক্ষায় যারা দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বিকার এবং অনেকটা অথর্ব ও দুর্নীতিবাজও! তাদের এগুলো দেখে না দেখার ভান অনেক সহজাত! তারা হয়তো প্রাণীর কোন কষ্ট ছোটবেলায় উপলব্ধি করে বনের অফিসার হয়ে উঠতে পারেননি !
যে মানুষগুলো বছরের প্রথমদিন বলে পটকা ফুটিয়ে পুরো দেশ জানান দিল তারা কোনোদিন কী একটা পাখি, একটা হাঁস, বা একটা প্রাণীর সংস্পর্শে আসেননি? যদি আসতেন তবে এমন কখনই করতে পারতেন না ! তারাও এক ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে নিজেদের আত্মাকে আবৃত করে বড় হয়েছে। কিছুদিন আগে একজন মেয়ের একটা সংবাদ টিভি চ্যানেলে দেখছিলাম। তিনি কুকুরকে আদর করেন, খাওয়ান, ভালোবাসেন। তাই কুকুরগুলো তার খুব কাছে আসে। আশ্চর্যজনক বিষয় সেই সংবাদের নিচে গিয়ে দেখলাম শত শত নেগেটিভ মন্তব্য। এমনও কেউ কেউ লিখেছেন যে কুকুরকে ভালোবেসে লাভ কী যে দেশে মানুষকে ভালোবেসে লাভ নেই। কেউ লিখেছেন মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে না আসছে কুকুরকে খাওয়াতে। মন্তব্য ভালো কয়েকজনের মাত্র। যেন কুকুরকে ভালোবেসে তিনি অপরাধ করেছেন। এর চেয়ে মনে হয় ভালো ছিল কুকুরগুলোকে মেরে ফেলা। এসব দেখে লজ্জা পাই, নিজেকে পরাজিত মনে হয়। আমরা কবে সুশিক্ষিত হব এটা যেন আজন্মের প্রশ্ন আমাদের। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন এখন আমরা কবে দয়াশীল হব।
যাই হোক সাফারি পার্কের কথায় ছিলাম। হাতিটি মারা গেল- সিংহীও। এর আগে জেব্রাসহ অনেক প্রাণী মারা গিয়েছে। আমাদের দেশে কারণ উদ্ঘাটনের চেয়েও কারণ ধামাচাপা দিতে একশ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বেশি লেগে থাকে। তাদের মধ্যে সবাই ভাবে কারণ উদ্ঘাটিত হলে আমরা যদি এখানে ফেঁসে যাই। দায়িত্বে অবহেলোর একটা ভয় থেকে কেউ আর কারণ বের করতে চান না। তারপরও জেব্রা নিয়ে তদন্ত হয়েছিল। এটা ভালো দিক হলেও প্রি-কশন বা আগে যে সাবধানতা গ্রহণ করা প্রয়োজন তা আমরা কী নিতে পেরেছিলাম ?
হাতি, সিংহির বেলাও একই প্রশ্নের জন্ম দিল আবার। সাফারি পার্ক ঘুরে এসে একটা সারস পাখির কথা লিখেছিলাম। ওর কোনো সঙ্গী নেই। তাই ওর মন খারাপ থাকে। আসলে প্রাণীর ভাষা বুঝতে পারলে ওদের কাছে যারা যায়, ওদের স্পর্শ করা যায়। জীবনে চলার পথে আমাদের মায়ার অভাব হলে আমরা আর মানুষ থাকি না। এখন আমাদের মায়ার অভাব দেখা দিয়েছে। আমরা নিয়ম-কানুন, পরিবেশের ওপর দায়িত্ব সব থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। শিশুদের আমরা শুধু আর্টিফিশিয়াল পণ্যের সঙ্গে এত বেশি নিবীড় স¤পর্ক গড়ে দিচ্ছি যে এখন আর শিশুরা হাঁস, মুরগি, গরু দেখে আনন্দও পায় না। পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসর যতটা চেনে বাচ্চারা ততটা গরু ঘোড়াও চেনে কিনা সন্দেহ।
মায়া আর প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টির মাধ্যমেই কেবল শিশুদের কোমল হৃদয়কে পৃথিবীর উপযোগী করে তোলা যেতে পারে। আসুন শিশুদের প্রাণীর সংস্পর্শে রাখি এবং প্রাণীর নিরাপত্তায় তাদেরও যে দায়িত্ব আছে তা শেখাই।
[লেখক: রসায়নবিদ]