alt

উপ-সম্পাদকীয়

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিখন-শেখানো কেমন হবে

মাছুম বিল্লাহ

: রোববার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৩

নতুন শিক্ষাক্রমে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে শিখনকালীন মূল্যায়ন যেটি প্রাকটিক্যাল টিচিং লার্নিংয়ের কথাই বলে। একটি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা ভারতের হিন্দি ফিল্ম আর সিরিয়াল দেখে হিন্দি কথা বলতে পারেন এবং হিন্দি বোঝেন। যদিও তারা হিন্দি অক্ষরের সঙ্গেও পরিচিত নন, হিন্দি বিদ্যালয়ে পড়েননি, শিক্ষকদের সহায়তা নেননি, কোন পরীক্ষাও দেননি। শুধুমাত্র ভারতীয় ছবি দেখেই হিন্দি শিখে ফেলেছেন।

ইংরেজির ক্ষেত্রে হয়েছে পুরোপুরি উল্টো। আমরা দীর্ঘ ১২ বছর বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াচ্ছি। শুধু কী পড়াচ্ছি? তারা কোচিং করছে, ক্লাস করছে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, বোর্ড থেকে ইংরেজিতে একটি গ্রেড নিয়ে পাস করছে কিন্তু ইংরেজি না পারছে বলতে, না পারছে বুঝতে, না পারছে নিজ থেকে দু’ চার লাইন লিখতে (ব্যতিক্রম দু’চারজন ছাড়া)।

মাতৃভাষার বাইরে অন্য কোন ভাষা শেখাতে হলে সেই ভাষাতেই শেখানোর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়। তা না হলে শিক্ষার্থী বারবার তার মাতৃষায় ফিরে আসবে, বাধাগ্রস্ত হবে তার দ্বিতীয় ভাষাশিক্ষা। নতুন বইয়ে যেটি করা হয়েছে পুরো ইন্ট্রাকশন বাংলায় করা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক ইংরেজি প্রাকটিস করবেন না। এটি ন্যাচারাল। তারা ইংরেজির দিকে তাকাবেনই না, তাহলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি কোথা থেকে শিখবে? ইনস্ট্রকাশনগুলো সব সময়ই ইংরেজিতে ছিল। এখন পাঠকে আনন্দময় করতে গিয়ে সব বাংলায় করা হলো- এ কেমন ভাষাশিক্ষার পদ্ধতি? আমরাতো আবারও গ্রামার ট্রানস্লেশন মেথডে ফিরে গেলাম। ইংরেজিতে যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বাংলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা শিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু ভাষা শেখার জায়গাটি কোথায়? এমনিতেই ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি প্রাকটিসের সুযোগ নেই বললেই চলে, ক্লাসরুম আর বই থেকে কিছুটা শিখবে। সেখানোও ইংরেজি শেখার সুযোগ সংকুচিত করা হলো।

আমাদের শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচেছ সিচুয়েশন সব জানা থাকলেও নিজ থেকে ইংরেজিতে কিছু লিখতে পারে না, একইভাবে বলে প্রকাশ করতে পারে না যদিও তাদের পটেনশিয়াল আছে। অন্যের ইংরেজি শুনে, বিদেশিদের ইংরেজি শুনে বুঝতে পারে না, ইংরেজিতে লেখা কোন বিষয় পড়ে বুঝতে পারে না শুধুমাত্র নিজ টেক্সট বইয়ের নির্দিষ্ট কিছু চ্যাপ্টার ছাড়া। ঘুরেফিরে তারা ওই কয়েকটি চ্যাপ্টার এবং প্যাসেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ফলে, পাশের হার বাড়ছে প্রচুর কিন্তু ইংরেজি শেখার ধারে কাছেও নেই দু’চারজন অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া। ইংরেজির এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা চিৎকার করছি, আবেদন করছি, লিখছি, টিচার সংগঠন করছি কারণ টিচারদের আগে এই প্র্যাকটিসগুলো করতে হবে তা না হলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখায় কোন পরিবর্তন আসবে না। ভেবেছিলাম নতুন কারিকুলামে অনেকটাই পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দেখলাম উল্টো এবং পূর্বের ইংরেজি বইয়ের চেয়ে আরও একধাপ পিছিয়ে। এজন্যই বারবার শুনতাম ‘আনন্দময় কারিকুলাম’ আসছে। শিক্ষার্থীরা ইংরেজি অর্থ বুঝতে পারে না, তাই বাংলায় ট্রানস্লেট করে দেয়া হয়েছে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে এ কেমন পদ্ধতি? এই আনন্দের কথাই তাহলে শুনে আসছিলাম?

কেউ কেউ বলছেন, নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে ব্যাপকভাবে task based language teaching theory প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা সিএলটি মেথড, সঙ্গে জিটিম পদ্ধতিতে ইংরেজি শিখবে। গ্রামার ট্রান্সস্লেশন পদ্ধতি তো পুরনো, সেটি বাদ দিয়ে তো কমিউনিকেটিভ মেথড (সিএলটি) আমদানি করা হলো। দুই পদ্ধতির বেস্ট প্রাকটিসগুলো একসঙ্গে ব্যবহৃত হলে সেটিকে বলা হয় একলেকটিস অ্যাপ্রোস। এটি কিন্তু কোনটিই হয়নি। তাহলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখার কী হবে? তারা আরও বলছেন যে, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ভাষার চারটি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবে। সেটি কিভাবে? বলা হয়েছে যে, প্রথমবারের মতো ইংরেজি বই দুটোতে বাংলা যোগ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের বাংলার মাধ্যমে ইংরেজি শিখতে উৎসাহিত করার জন্য। সেটিতো গ্রামার ট্রান্সলেশন মেথড যা বহু বছর চালু ছিল কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভাষার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি তাই সিএলটি আমদানী করা হলো। আবার সেই পুরনো পদ্ধতিতে যাওয়া হচ্ছে কেন?

ইংরেজিতে সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট ও কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট দুটো পদ্ধতিতেই অ্যাসেসমেন্ট হবে। বলা হচ্ছে সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে রিডিং ও রাইটিং স্কিল আর কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে স্পিকিং ও লিসেনিং স্কিলসহ অন্যান্য স্কিল মূল্যায়ন করা হবে। এতে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন করা হলো বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এখন ক্রিটিক্যাল থিংকিং ডেভেলপ করতে পারবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভাষায় বিশেষভাবে পিছিয়ে আছে, ইংরেজিতে কিভাবে তারা ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল উন্নত করবে? নতুন নতুন ভোকাব্যুলারি সব লেসনের প্রথমে আছে আর সবগুলোর অর্থ বাংলায় বইয়ের শেষে দেয়া আছে। আসলে কোন শব্দের অর্থ জানলেই ভোকাব্যুলারি উন্নত হয় না, শিক্ষার্থীরা যদি সেইসব নতুন শব্দ ব্যবহার করে নিজেরা বাক্য তৈরি করতে না পারে। যতটা সম্ভব ইংরেজিতেই শব্দগুলোর ব্যবহার ও অর্থ দেয়াটা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু সেসব বাদ দিয়ে বাংলায় শব্দের অর্থ দেয়া হয়েছে, সম্ভবত এটিকেও তারা আনন্দময় বলে প্রকাশ করতে চেয়েছেন।

নতুন বইয়ে যেটি করা হয়েছে পুরো ইন্ট্রাকশন বাংলায় করা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক ইংরেজি প্রাকটিস করবেন না। এটি ন্যাচারাল। তারা ইংরেজির দিকে তাকাবেনই না, তাহলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি কোথা থেকে শিখবে?

সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে ‘এ ড্রিম স্কুল’ নামক প্রথম চ্যাপ্টারটিতে দেখলাম আঠারোটি প্রশ্ন করা হয়েছে , সবগুলোই ‘ডু’ দিয়ে শুরু? এ কেমন ভাষা শিক্ষার ক্লাস, আর আনন্দই বা কোথায়? বিভিন্ন রকম সাহায্যকারী ক্রিয়া দিয়ে বাক্যগুলো গঠন করা যেত। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘প্লেলিং উইথ ওয়ার্ডস’ এ ‘সাফিক্স’ আর ‘প্রেফিক্স’ বুঝানোর জন্য পুরোপুরি ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে জটিলভাবে গ্রামারের নিয়ম-কানুন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে আনন্দের তো কিছুই দেখছি না। আমরা দেখি অনেক সময় গল্পকার গল্প বলে নিজেই হাসেন কারণ শ্রোতা কিছুই বোঝেনি। তবে শুরুতে কয়টি প্রশ্ন ছিল সে প্রশ্ন কটি ভালো। যেমন-ডু ইউ লাইক অর ডিজলাইক ক্রিকেট? আর দ্য প্লেয়ারস স্পিরিটেড অর স্পিরিটলেস? তাছাড়া ‘ Present Continuous আর Past Continuous tense শেখানোর জন্য বেশ ভালো কিছু উদাহরণ দেয়া হয়েছে। যেমন— Today I am having breakfast with my little sister but yesterday I was having my breakfast with my grandparents. এভাবে কিছু কিছু চ্যাপ্টারে ভালো কিছু অ্যাক্টিভিটি আছে। কিন্তু অধিকাংশ জায়গাতেই দেখা যায় ট্রাডিশনাল পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর বইয়ের ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটেছে। স্থানাভাবে সবকিছু এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। পরবর্তীতে হয়তো আরও লেখা নিয়ে হাজির হব।

বইয়ের পক্ষে বলা হয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের ’ প্যারাগ্রাফ’ আর ’রচনা’ মুখস্থ করতে হবে না। গাইড বই ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। বিভিন্ন সিচুয়েশনে শিক্ষার্থীরা ডেমোক্র্যাটিক ওয়েতে নাকি সমস্যা ডিল করতে করতে এগিয়ে যাবে। ইংরেজির স্কিলগুলো ধারালো করা না হলে কিভাবে তারা লিখবে আর কিভাবে ডেমোক্র্যাটিক ওয়েতে আগাবে। আগাবে যেমন তাদের ইংরেজির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে পুরোটাই বাংলায় এবং এইসব কথাগুলোই বেশি বেশি আলোচিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ল্যাংগুয়েজ ডেভেলপ করতে গিয়ে শিক্ষকদের যে, ডেভেলপ করতে হবে তার তেমন কোন আলোচনা বা প্রশিক্ষণ অনুপস্থিত। আরও বলা হয়েছে যে, ইংরেজিতে ফেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। ইংরেজিতে এখন কত শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করে?

কৃষিবিজ্ঞান, ইতিহাস কিংবা ইসলামিয়াতে ফেল করতে পারে, কিন্তু ইংরেজিতে তো ফেল করা কঠিন। বোর্ড পরীক্ষার ফল তো তাই বলে। এখন ৬০ শতাংশ নম্বর শিক্ষকের হাতে, অতএব ফেলের কোন প্রশ্নই ওঠে না। ইংরেজি না শিখে পাশ, এখন না শিখে না পড়ে, পাশ হবে। এটিকেও আনন্দের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কিনা জানি না। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, একজন দক্ষ শিক্ষক কিন্তু পত্রিকার কিংবা বইয়ের একটি পাতা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের হাসাতে পারেন, নাচাতে পারেন, গান গাওয়াতে পারেন, গ্রামার শেখাতে পারেন, ভাষার চারটি স্কিল প্রাকটিস করাতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে শেখাতে পারেন মানবিকতা, সহানভূতি, দেশপ্রেম। অর্থাৎ জাদু কিন্তু শিক্ষকের হাতে। শিক্ষকদের সেভাবে প্রস্তুত করতে পারলে এত ঢাক-ঢোল পেটানো দরকার হয় না। শিক্ষকরা নিজেরাই আনন্দের মাধ্যমে পড়াতে পারবেন, বিষয় শেখাতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষকদের সেই উন্নয়নের ব্যবস্থাটি কোথায়? এটি নিয়ে ভেবে দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

[লেখক: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স

অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিখন-শেখানো কেমন হবে

মাছুম বিল্লাহ

রোববার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৩

নতুন শিক্ষাক্রমে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে শিখনকালীন মূল্যায়ন যেটি প্রাকটিক্যাল টিচিং লার্নিংয়ের কথাই বলে। একটি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা ভারতের হিন্দি ফিল্ম আর সিরিয়াল দেখে হিন্দি কথা বলতে পারেন এবং হিন্দি বোঝেন। যদিও তারা হিন্দি অক্ষরের সঙ্গেও পরিচিত নন, হিন্দি বিদ্যালয়ে পড়েননি, শিক্ষকদের সহায়তা নেননি, কোন পরীক্ষাও দেননি। শুধুমাত্র ভারতীয় ছবি দেখেই হিন্দি শিখে ফেলেছেন।

ইংরেজির ক্ষেত্রে হয়েছে পুরোপুরি উল্টো। আমরা দীর্ঘ ১২ বছর বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াচ্ছি। শুধু কী পড়াচ্ছি? তারা কোচিং করছে, ক্লাস করছে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, বোর্ড থেকে ইংরেজিতে একটি গ্রেড নিয়ে পাস করছে কিন্তু ইংরেজি না পারছে বলতে, না পারছে বুঝতে, না পারছে নিজ থেকে দু’ চার লাইন লিখতে (ব্যতিক্রম দু’চারজন ছাড়া)।

মাতৃভাষার বাইরে অন্য কোন ভাষা শেখাতে হলে সেই ভাষাতেই শেখানোর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়। তা না হলে শিক্ষার্থী বারবার তার মাতৃষায় ফিরে আসবে, বাধাগ্রস্ত হবে তার দ্বিতীয় ভাষাশিক্ষা। নতুন বইয়ে যেটি করা হয়েছে পুরো ইন্ট্রাকশন বাংলায় করা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক ইংরেজি প্রাকটিস করবেন না। এটি ন্যাচারাল। তারা ইংরেজির দিকে তাকাবেনই না, তাহলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি কোথা থেকে শিখবে? ইনস্ট্রকাশনগুলো সব সময়ই ইংরেজিতে ছিল। এখন পাঠকে আনন্দময় করতে গিয়ে সব বাংলায় করা হলো- এ কেমন ভাষাশিক্ষার পদ্ধতি? আমরাতো আবারও গ্রামার ট্রানস্লেশন মেথডে ফিরে গেলাম। ইংরেজিতে যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বাংলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা শিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু ভাষা শেখার জায়গাটি কোথায়? এমনিতেই ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি প্রাকটিসের সুযোগ নেই বললেই চলে, ক্লাসরুম আর বই থেকে কিছুটা শিখবে। সেখানোও ইংরেজি শেখার সুযোগ সংকুচিত করা হলো।

আমাদের শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচেছ সিচুয়েশন সব জানা থাকলেও নিজ থেকে ইংরেজিতে কিছু লিখতে পারে না, একইভাবে বলে প্রকাশ করতে পারে না যদিও তাদের পটেনশিয়াল আছে। অন্যের ইংরেজি শুনে, বিদেশিদের ইংরেজি শুনে বুঝতে পারে না, ইংরেজিতে লেখা কোন বিষয় পড়ে বুঝতে পারে না শুধুমাত্র নিজ টেক্সট বইয়ের নির্দিষ্ট কিছু চ্যাপ্টার ছাড়া। ঘুরেফিরে তারা ওই কয়েকটি চ্যাপ্টার এবং প্যাসেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ফলে, পাশের হার বাড়ছে প্রচুর কিন্তু ইংরেজি শেখার ধারে কাছেও নেই দু’চারজন অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া। ইংরেজির এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা চিৎকার করছি, আবেদন করছি, লিখছি, টিচার সংগঠন করছি কারণ টিচারদের আগে এই প্র্যাকটিসগুলো করতে হবে তা না হলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখায় কোন পরিবর্তন আসবে না। ভেবেছিলাম নতুন কারিকুলামে অনেকটাই পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দেখলাম উল্টো এবং পূর্বের ইংরেজি বইয়ের চেয়ে আরও একধাপ পিছিয়ে। এজন্যই বারবার শুনতাম ‘আনন্দময় কারিকুলাম’ আসছে। শিক্ষার্থীরা ইংরেজি অর্থ বুঝতে পারে না, তাই বাংলায় ট্রানস্লেট করে দেয়া হয়েছে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে এ কেমন পদ্ধতি? এই আনন্দের কথাই তাহলে শুনে আসছিলাম?

কেউ কেউ বলছেন, নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে ব্যাপকভাবে task based language teaching theory প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা সিএলটি মেথড, সঙ্গে জিটিম পদ্ধতিতে ইংরেজি শিখবে। গ্রামার ট্রান্সস্লেশন পদ্ধতি তো পুরনো, সেটি বাদ দিয়ে তো কমিউনিকেটিভ মেথড (সিএলটি) আমদানি করা হলো। দুই পদ্ধতির বেস্ট প্রাকটিসগুলো একসঙ্গে ব্যবহৃত হলে সেটিকে বলা হয় একলেকটিস অ্যাপ্রোস। এটি কিন্তু কোনটিই হয়নি। তাহলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখার কী হবে? তারা আরও বলছেন যে, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ভাষার চারটি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবে। সেটি কিভাবে? বলা হয়েছে যে, প্রথমবারের মতো ইংরেজি বই দুটোতে বাংলা যোগ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের বাংলার মাধ্যমে ইংরেজি শিখতে উৎসাহিত করার জন্য। সেটিতো গ্রামার ট্রান্সলেশন মেথড যা বহু বছর চালু ছিল কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভাষার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি তাই সিএলটি আমদানী করা হলো। আবার সেই পুরনো পদ্ধতিতে যাওয়া হচ্ছে কেন?

ইংরেজিতে সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট ও কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট দুটো পদ্ধতিতেই অ্যাসেসমেন্ট হবে। বলা হচ্ছে সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে রিডিং ও রাইটিং স্কিল আর কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে স্পিকিং ও লিসেনিং স্কিলসহ অন্যান্য স্কিল মূল্যায়ন করা হবে। এতে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন করা হলো বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এখন ক্রিটিক্যাল থিংকিং ডেভেলপ করতে পারবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভাষায় বিশেষভাবে পিছিয়ে আছে, ইংরেজিতে কিভাবে তারা ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল উন্নত করবে? নতুন নতুন ভোকাব্যুলারি সব লেসনের প্রথমে আছে আর সবগুলোর অর্থ বাংলায় বইয়ের শেষে দেয়া আছে। আসলে কোন শব্দের অর্থ জানলেই ভোকাব্যুলারি উন্নত হয় না, শিক্ষার্থীরা যদি সেইসব নতুন শব্দ ব্যবহার করে নিজেরা বাক্য তৈরি করতে না পারে। যতটা সম্ভব ইংরেজিতেই শব্দগুলোর ব্যবহার ও অর্থ দেয়াটা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু সেসব বাদ দিয়ে বাংলায় শব্দের অর্থ দেয়া হয়েছে, সম্ভবত এটিকেও তারা আনন্দময় বলে প্রকাশ করতে চেয়েছেন।

নতুন বইয়ে যেটি করা হয়েছে পুরো ইন্ট্রাকশন বাংলায় করা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক ইংরেজি প্রাকটিস করবেন না। এটি ন্যাচারাল। তারা ইংরেজির দিকে তাকাবেনই না, তাহলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি কোথা থেকে শিখবে?

সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে ‘এ ড্রিম স্কুল’ নামক প্রথম চ্যাপ্টারটিতে দেখলাম আঠারোটি প্রশ্ন করা হয়েছে , সবগুলোই ‘ডু’ দিয়ে শুরু? এ কেমন ভাষা শিক্ষার ক্লাস, আর আনন্দই বা কোথায়? বিভিন্ন রকম সাহায্যকারী ক্রিয়া দিয়ে বাক্যগুলো গঠন করা যেত। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘প্লেলিং উইথ ওয়ার্ডস’ এ ‘সাফিক্স’ আর ‘প্রেফিক্স’ বুঝানোর জন্য পুরোপুরি ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে জটিলভাবে গ্রামারের নিয়ম-কানুন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে আনন্দের তো কিছুই দেখছি না। আমরা দেখি অনেক সময় গল্পকার গল্প বলে নিজেই হাসেন কারণ শ্রোতা কিছুই বোঝেনি। তবে শুরুতে কয়টি প্রশ্ন ছিল সে প্রশ্ন কটি ভালো। যেমন-ডু ইউ লাইক অর ডিজলাইক ক্রিকেট? আর দ্য প্লেয়ারস স্পিরিটেড অর স্পিরিটলেস? তাছাড়া ‘ Present Continuous আর Past Continuous tense শেখানোর জন্য বেশ ভালো কিছু উদাহরণ দেয়া হয়েছে। যেমন— Today I am having breakfast with my little sister but yesterday I was having my breakfast with my grandparents. এভাবে কিছু কিছু চ্যাপ্টারে ভালো কিছু অ্যাক্টিভিটি আছে। কিন্তু অধিকাংশ জায়গাতেই দেখা যায় ট্রাডিশনাল পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর বইয়ের ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটেছে। স্থানাভাবে সবকিছু এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। পরবর্তীতে হয়তো আরও লেখা নিয়ে হাজির হব।

বইয়ের পক্ষে বলা হয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের ’ প্যারাগ্রাফ’ আর ’রচনা’ মুখস্থ করতে হবে না। গাইড বই ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। বিভিন্ন সিচুয়েশনে শিক্ষার্থীরা ডেমোক্র্যাটিক ওয়েতে নাকি সমস্যা ডিল করতে করতে এগিয়ে যাবে। ইংরেজির স্কিলগুলো ধারালো করা না হলে কিভাবে তারা লিখবে আর কিভাবে ডেমোক্র্যাটিক ওয়েতে আগাবে। আগাবে যেমন তাদের ইংরেজির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে পুরোটাই বাংলায় এবং এইসব কথাগুলোই বেশি বেশি আলোচিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ল্যাংগুয়েজ ডেভেলপ করতে গিয়ে শিক্ষকদের যে, ডেভেলপ করতে হবে তার তেমন কোন আলোচনা বা প্রশিক্ষণ অনুপস্থিত। আরও বলা হয়েছে যে, ইংরেজিতে ফেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। ইংরেজিতে এখন কত শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করে?

কৃষিবিজ্ঞান, ইতিহাস কিংবা ইসলামিয়াতে ফেল করতে পারে, কিন্তু ইংরেজিতে তো ফেল করা কঠিন। বোর্ড পরীক্ষার ফল তো তাই বলে। এখন ৬০ শতাংশ নম্বর শিক্ষকের হাতে, অতএব ফেলের কোন প্রশ্নই ওঠে না। ইংরেজি না শিখে পাশ, এখন না শিখে না পড়ে, পাশ হবে। এটিকেও আনন্দের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কিনা জানি না। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, একজন দক্ষ শিক্ষক কিন্তু পত্রিকার কিংবা বইয়ের একটি পাতা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের হাসাতে পারেন, নাচাতে পারেন, গান গাওয়াতে পারেন, গ্রামার শেখাতে পারেন, ভাষার চারটি স্কিল প্রাকটিস করাতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে শেখাতে পারেন মানবিকতা, সহানভূতি, দেশপ্রেম। অর্থাৎ জাদু কিন্তু শিক্ষকের হাতে। শিক্ষকদের সেভাবে প্রস্তুত করতে পারলে এত ঢাক-ঢোল পেটানো দরকার হয় না। শিক্ষকরা নিজেরাই আনন্দের মাধ্যমে পড়াতে পারবেন, বিষয় শেখাতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষকদের সেই উন্নয়নের ব্যবস্থাটি কোথায়? এটি নিয়ে ভেবে দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

[লেখক: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স

অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ]

back to top