alt

উপ-সম্পাদকীয়

যোগাযোগে নতুন দিনের সূচনা

রেজাউল করিম খোকন

: বৃহস্পতিবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যমতে, বছরে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৫ শতাংশ ক্ষতি করছে যানজট। টাকার অঙ্কে যা ৮৭ হাজার কোটি টাকা। দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন এমআরটি-৬ লাইন যানজটের ক্ষতি কমাবে ৯ শতাংশ। বর্তমান সরকারের আমলে যে কটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, মেট্রোরেল তার অন্যতম। গত বছর ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের যোগযোগ অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে।

মেট্রোরেল চালু হওয়ায় ঢাকা শহরের যানজট ও মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে বলে আশা করা যায়। মেট্রোরেল শুধু দ্রুত পরিবহন নয়, এটি পরিবেশবান্ধবও। মেট্রোরেল ঢাকার জনজীবনে গতি আনবে। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ বড় শহরগুলোতে মেট্রোরেল-ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের গণপরিবহন চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের যোগাযোগকে সহজ সময় সাশ্রয়ী করা। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিও বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। এসব দিক বিবেচনায় রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হওয়া একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার। মেট্রোরেল যানজট এড়িয়ে আমাদের গণমানুষের যাতায়াতের সময় বাঁচাবে। এর ফলে অনেক কর্মঘণ্টা আমরা পাব। যে কর্মঘণ্টাগুলো মানুষ কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারবে। এমনকি মানুষ যদি বিশ্রামও নেয়, তাতে তাদের অন্য কাজের গতিশীলতাও বাড়বে।

অর্থাৎ মেট্রোরেলের মাধ্যমে শুধু যে তাৎক্ষণিক যাতায়াতের সময় বাঁচবে তা নয়, গণমানুষের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। মেট্রোরেলের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, অসুস্থ মানুষসহ সবাই উপকৃত হবেন। যেহেতু অর্থনীতিকে চালায় মানুষ। আর এই মানুষ যত বেশি দক্ষ ও কর্মক্ষম হবে, তত বেশি সে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে নাগরের বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়বে। এসব দিক থেকে মেট্রোরেল অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে।

অর্থনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি মেট্রোরেল চালুর ফলে ঢাকায় দূষণের পরিমাণও কমাতে পারে। প্রধানমন্ত্রীও মেট্রোরেলকে পরিবেশবান্ধব বাহন বলেছেন। তবে মেট্রোরেল কোনোভাবেই বাস বা অন্যান্য গণপরিবহনের পুরোপুরি বিকল্প নয়। তাই মেট্রোরেলে পাশাপাশি উন্নত গণপরিবহনের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

মেট্রোরেলে এখন রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও- পৌনে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে ১০ মিনিটে। যানজটের নগরী ঢাকার মানুষ কয়েক মাস আগেও এটা বিশ্বাস করতে চাইতেন না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। সড়কপথে এখন ঢাকা থেকে চার ঘণ্টায় বরিশালে যাওয়া যাচ্ছে। অথচ লঞ্চে বরিশাল যেতে সারা রাত লাগে। ফেরিতে পার হলে কখনো কখনো ১০ ঘণ্টা বা এরও বেশি সময় সড়কে কাটাতে হয়। আর ফেরিঘাটের ভোগার্ন্তি, হকারের উৎপাত, ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে টানাহেঁচড়া তো আছেই। এখন কম সময়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়া যাচ্ছে পদ্মা সেতু দিয়ে।

বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষ সবাই স্বীকার করছেন, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নতুন যুগে নিয়ে গেছে। বাস্তবায়নাধীন ১০টি বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে অগ্রাধিকারের তালিকায় (ফাস্ট ট্র্যাক) রেখেছে সরকার। এর মধ্যে যোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলো হচ্ছে পদ্মার দুইপারে রেলসংযোগ স্থাপন ও মেট্রোরেল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল অগ্রাধিকারের তালিকায় না থাকলেও এটি বড় ও ব্যতিক্রমী প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চালুর পরিকল্পনা আছে। আগামী জুনে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্র্যন্ত রেললাইন চালুর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর দুইপাড় জুড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে সরকার গত নভেম্বরে এক দিনে সারা দেশে ছোট-বড় ১০০ সেতু চালু করেছে। গত ডিসেম্বরে ১০০টি জাতীয় মহাসড়কে দুই হাজার কিলোমিটার নতুন সড়ক একই দিনে উদ্বোধন করা হয়। বিদায়ী ২০২২ সাল যোগাযোগ খাতে অনেক সুখবর দিয়েছে। এর রেশ হয়তো আগামী বছরও থাকবে।

তবে এসব সেতু, সড়ক ও রেল যোগাযোগে স্বস্তি আনলেও মানুষের মনে কিছু প্রশ্ন-সন্দেহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কেননা একটি প্রকল্পও সময়মতো এবং নির্ধারিত ব্যয়ের মধ্যে শেষ করা হয়নি। এর ফলে মানুষ যে সময়ের মধ্যে এর সুফল ভোগ করতে পারত, তা থেকে অনেক পরে সেই ফল পাচ্ছে। সরকারের কোষাগার খালি করা এবং বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। ২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প গ্রহণের পর তা চালু হতে ১৫ বছর লেগেছে। ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে নেওয়া মেট্রোরেল প্রকল্প এক দশক পর আংশিক চালু হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে ১১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। নগরবাসী দীর্ঘদিন নির্মাণকাজের জন্য ভোগার্ন্তির শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে সম্ভব না হলেও বেশি দেরি হচ্ছে না। তবে প্রকল্পের ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকা বাড়ছে।

পদ্মা সেতু শুধু যে যাত্রার সময় কমাচ্ছে তা-ই নয়। গত ২৫ জুন চালু হওয়ার পর পদ্মা সেতু দিয়ে ৩০ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে। টোল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহনের চলাচল থেকে বোঝা যায়, ওই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকাও ঘুরছে। এর মধ্যে বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের তাজা মাছ কম সময়ে ঢাকার বাজারে চলে আসার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। স্থানীয় অনেক পণ্য এখন কম সময়ে ঢাকায় আসছে। শিল্পোদ্যোক্তারা কারখানা করার লক্ষ্যে জমি কিনছেন দেদার। ফলে জমির বাজার ব্যাপক গরম হয়েছে। অথচ এই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর এর সুফল পেতে লেগেছে দুই যুগের মতো। সমীক্ষায় এসেছিল- সেতুটি চালুর পর দেশের জিডিপির হার বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে এ প্রভাব কতটা অর্জিত হলো, তা পরে মূল্যায়নে স্পষ্ট হবে।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন সংযোজন। নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। দুই টিউবসংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অন্য ভাগে রয়েছে ভারি শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর উপর ইতোমধ্যে তিনটি সেতু নির্মিত হয়েছে। তবে তা যানবাহনের চাপ সামলাতে যথেষ্ট নয়। এর বাইরে কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, একে ঘিরে পর্যটন বাড়ছে। এর মধ্যে মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে চলছে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকাজ। সব মিলিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। চট্টগ্রামে বে-টার্মিনাল হবে। কর্ণফুলী নদীর এই দুই পারের কর্মযজ্ঞ বিবেচনায় নিয়ে নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়, যা চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোকে ‘স্মার্ট হাইওয়ে’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আছে সরকারের। এজন্য সারা দেশের নদী-খাল-বিলের দুইপাড়ের সংযোগ ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনগ্রসর অঞ্চলগুলোকে যোগাযোগ কাঠামোতে আনার চেষ্টা চলছে। এর অংশ হিসেবে গত ৭ নভেম্বর সারা দেশে এক দিনে ‘শত সেতু’ উদ্বোধন করা হয়। আশির দশকে দেশের যোগাযোগ খাতে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের ধারা শুরু হয়েছিল। গত এক যুগে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বেড়েছে। পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের বিষয়টি দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। মেট্রোরেলের একাংশ চালুর মাধ্যমেও ঢাকার মানুষের মধ্যে একধরনের সাড়া ফেলেছে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

যোগাযোগে নতুন দিনের সূচনা

রেজাউল করিম খোকন

বৃহস্পতিবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যমতে, বছরে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৫ শতাংশ ক্ষতি করছে যানজট। টাকার অঙ্কে যা ৮৭ হাজার কোটি টাকা। দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন এমআরটি-৬ লাইন যানজটের ক্ষতি কমাবে ৯ শতাংশ। বর্তমান সরকারের আমলে যে কটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, মেট্রোরেল তার অন্যতম। গত বছর ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের যোগযোগ অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে।

মেট্রোরেল চালু হওয়ায় ঢাকা শহরের যানজট ও মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে বলে আশা করা যায়। মেট্রোরেল শুধু দ্রুত পরিবহন নয়, এটি পরিবেশবান্ধবও। মেট্রোরেল ঢাকার জনজীবনে গতি আনবে। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ বড় শহরগুলোতে মেট্রোরেল-ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের গণপরিবহন চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের যোগাযোগকে সহজ সময় সাশ্রয়ী করা। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিও বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। এসব দিক বিবেচনায় রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হওয়া একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার। মেট্রোরেল যানজট এড়িয়ে আমাদের গণমানুষের যাতায়াতের সময় বাঁচাবে। এর ফলে অনেক কর্মঘণ্টা আমরা পাব। যে কর্মঘণ্টাগুলো মানুষ কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারবে। এমনকি মানুষ যদি বিশ্রামও নেয়, তাতে তাদের অন্য কাজের গতিশীলতাও বাড়বে।

অর্থাৎ মেট্রোরেলের মাধ্যমে শুধু যে তাৎক্ষণিক যাতায়াতের সময় বাঁচবে তা নয়, গণমানুষের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। মেট্রোরেলের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, অসুস্থ মানুষসহ সবাই উপকৃত হবেন। যেহেতু অর্থনীতিকে চালায় মানুষ। আর এই মানুষ যত বেশি দক্ষ ও কর্মক্ষম হবে, তত বেশি সে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে নাগরের বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়বে। এসব দিক থেকে মেট্রোরেল অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে।

অর্থনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি মেট্রোরেল চালুর ফলে ঢাকায় দূষণের পরিমাণও কমাতে পারে। প্রধানমন্ত্রীও মেট্রোরেলকে পরিবেশবান্ধব বাহন বলেছেন। তবে মেট্রোরেল কোনোভাবেই বাস বা অন্যান্য গণপরিবহনের পুরোপুরি বিকল্প নয়। তাই মেট্রোরেলে পাশাপাশি উন্নত গণপরিবহনের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

মেট্রোরেলে এখন রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও- পৌনে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে ১০ মিনিটে। যানজটের নগরী ঢাকার মানুষ কয়েক মাস আগেও এটা বিশ্বাস করতে চাইতেন না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। সড়কপথে এখন ঢাকা থেকে চার ঘণ্টায় বরিশালে যাওয়া যাচ্ছে। অথচ লঞ্চে বরিশাল যেতে সারা রাত লাগে। ফেরিতে পার হলে কখনো কখনো ১০ ঘণ্টা বা এরও বেশি সময় সড়কে কাটাতে হয়। আর ফেরিঘাটের ভোগার্ন্তি, হকারের উৎপাত, ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে টানাহেঁচড়া তো আছেই। এখন কম সময়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়া যাচ্ছে পদ্মা সেতু দিয়ে।

বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষ সবাই স্বীকার করছেন, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নতুন যুগে নিয়ে গেছে। বাস্তবায়নাধীন ১০টি বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে অগ্রাধিকারের তালিকায় (ফাস্ট ট্র্যাক) রেখেছে সরকার। এর মধ্যে যোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলো হচ্ছে পদ্মার দুইপারে রেলসংযোগ স্থাপন ও মেট্রোরেল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল অগ্রাধিকারের তালিকায় না থাকলেও এটি বড় ও ব্যতিক্রমী প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চালুর পরিকল্পনা আছে। আগামী জুনে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্র্যন্ত রেললাইন চালুর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর দুইপাড় জুড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে সরকার গত নভেম্বরে এক দিনে সারা দেশে ছোট-বড় ১০০ সেতু চালু করেছে। গত ডিসেম্বরে ১০০টি জাতীয় মহাসড়কে দুই হাজার কিলোমিটার নতুন সড়ক একই দিনে উদ্বোধন করা হয়। বিদায়ী ২০২২ সাল যোগাযোগ খাতে অনেক সুখবর দিয়েছে। এর রেশ হয়তো আগামী বছরও থাকবে।

তবে এসব সেতু, সড়ক ও রেল যোগাযোগে স্বস্তি আনলেও মানুষের মনে কিছু প্রশ্ন-সন্দেহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কেননা একটি প্রকল্পও সময়মতো এবং নির্ধারিত ব্যয়ের মধ্যে শেষ করা হয়নি। এর ফলে মানুষ যে সময়ের মধ্যে এর সুফল ভোগ করতে পারত, তা থেকে অনেক পরে সেই ফল পাচ্ছে। সরকারের কোষাগার খালি করা এবং বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। ২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প গ্রহণের পর তা চালু হতে ১৫ বছর লেগেছে। ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে নেওয়া মেট্রোরেল প্রকল্প এক দশক পর আংশিক চালু হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে ১১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। নগরবাসী দীর্ঘদিন নির্মাণকাজের জন্য ভোগার্ন্তির শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে সম্ভব না হলেও বেশি দেরি হচ্ছে না। তবে প্রকল্পের ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকা বাড়ছে।

পদ্মা সেতু শুধু যে যাত্রার সময় কমাচ্ছে তা-ই নয়। গত ২৫ জুন চালু হওয়ার পর পদ্মা সেতু দিয়ে ৩০ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে। টোল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহনের চলাচল থেকে বোঝা যায়, ওই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকাও ঘুরছে। এর মধ্যে বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের তাজা মাছ কম সময়ে ঢাকার বাজারে চলে আসার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। স্থানীয় অনেক পণ্য এখন কম সময়ে ঢাকায় আসছে। শিল্পোদ্যোক্তারা কারখানা করার লক্ষ্যে জমি কিনছেন দেদার। ফলে জমির বাজার ব্যাপক গরম হয়েছে। অথচ এই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর এর সুফল পেতে লেগেছে দুই যুগের মতো। সমীক্ষায় এসেছিল- সেতুটি চালুর পর দেশের জিডিপির হার বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে এ প্রভাব কতটা অর্জিত হলো, তা পরে মূল্যায়নে স্পষ্ট হবে।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন সংযোজন। নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। দুই টিউবসংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অন্য ভাগে রয়েছে ভারি শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর উপর ইতোমধ্যে তিনটি সেতু নির্মিত হয়েছে। তবে তা যানবাহনের চাপ সামলাতে যথেষ্ট নয়। এর বাইরে কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, একে ঘিরে পর্যটন বাড়ছে। এর মধ্যে মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে চলছে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকাজ। সব মিলিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। চট্টগ্রামে বে-টার্মিনাল হবে। কর্ণফুলী নদীর এই দুই পারের কর্মযজ্ঞ বিবেচনায় নিয়ে নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়, যা চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোকে ‘স্মার্ট হাইওয়ে’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আছে সরকারের। এজন্য সারা দেশের নদী-খাল-বিলের দুইপাড়ের সংযোগ ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনগ্রসর অঞ্চলগুলোকে যোগাযোগ কাঠামোতে আনার চেষ্টা চলছে। এর অংশ হিসেবে গত ৭ নভেম্বর সারা দেশে এক দিনে ‘শত সেতু’ উদ্বোধন করা হয়। আশির দশকে দেশের যোগাযোগ খাতে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের ধারা শুরু হয়েছিল। গত এক যুগে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বেড়েছে। পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের বিষয়টি দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। মেট্রোরেলের একাংশ চালুর মাধ্যমেও ঢাকার মানুষের মধ্যে একধরনের সাড়া ফেলেছে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top