alt

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই

মিথুশিলাক মুরমু

: রোববার, ২৬ মার্চ ২০২৩

মায়ের ভাষাকে বাঁচাতে লড়াইয়ে নেমেছে বাংলাদেশের আদিবাসীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আকাশ সংস্কৃতি, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা প্রভৃতির দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলো। ভাষা রক্ষায় সরকারের উদাসীনতা রয়েছে। তবে ব্যক্তি উদ্যোগের কমতি নেই। সেই উদ্যোগে আন্তরিকতাও রয়েছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ আয়োজিত মণিপুরী ভাষায় লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। উদ্দেশ্য একটাই- মাতৃভাষায় প্রতি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তিনটি কাজ করার কথা- ভাষা প্রমিতকরণ, বিপন্ন বা বিলুপ্ত ভাষার গবেষণা ও সংরক্ষণ এবং শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর অনেক বছর পেরিয়েছে। মাত্র পাঁচটি মাতৃভাষায় আটকে আছে ইনস্টিটিউট। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং উরাঁওয়ের মাতৃভাষাতে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও মাঝপথে স্থবির হয়ে পড়েছে। সমতলের সংখ্যাগুরু আদিবাসী হচ্ছে সাঁওতাল। তাদের মধ্যে বর্ণমালার বিভেদ সৃষ্টি করে সাঁওতালি ভাষার মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মাহাতো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ‘কুড়মালি’কে রক্ষা করতে মাঠে নেমেছেন উজ্জ্বল মাহাতো। ইতোমধ্যে তিনি এই ভাষায় ডিকশানারি বের করেছেন। নিজেই পরিচালনা করেন ৫০ জনকে নিয়ে মাতৃভাষার একটি বিদ্যালয়। পাশাপাশি রচনা করেছেন উপন্যাস। মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করতে ৭ মার্চের বিপ্লবী ভাষণ, জাতীয় সংগীতসহ বেশ কিছু সরকারি প্রকাশনা অনুবাদ করে নিজ জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। দেশের ১৮টি জেলার ৩৩টি উপজেলায় মাহাতোদের উপস্থিতি রয়েছে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের জরিপ তালিকায় মাহাতো ভাষার নাম না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছে পুরো জাতিগোষ্ঠী।

সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা উদ্যোক্তা উজ্জ্বল মাহাতে বলেছেন, ‘এটি আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক। এই ভাষায় রয়েছে অনেক গীত, ঝুমুর, গল্প; যা কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে। এই ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ জরুরি। না হলে ভাষাটি গবেষণা ও পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাবে।’

খাসিয়া জাতিগোষ্ঠী সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস করেন। ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করেই অভিভাবকরা শহরে পাঠাচ্ছে পড়াশোনা করতে। আর এখানেই বিপত্তি, ছেলে-মেয়েরা বাংলা ছাড়া মায়ের ভাষা বুঝতে অক্ষম। অভিভাবকরা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, যেভাবেই হোক মাতৃভাষাকে বাঁচাতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে হবে হাজার বছরের সম্পদ মাতৃভাষা। খাসিয়াদের মাতৃভাষাকে রক্ষার্থে মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলের টিএনও মো. নজরুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করেছেন বই-পুস্তক। তার উদ্যোগে স্থানীয় হোসনাবাদ পুঞ্জি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভাষাচর্চার সূচনা হয়। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়টিতে বেলা ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত খাসি ভাষায় পাঠদান করা হচ্ছে। পুঞ্জির পক্ষ থেকে গ্লোরিয়া সুমের নামে একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২৫ জন শিক্ষার্থীকে ভাষা শিক্ষার বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে। খাসি ভাষায় গ্লোরিয়া সুমেরের দক্ষতা শিশুদের মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগছে। খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সাজু মাচিয়াং বলেছেন, ‘খাসি মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের এগিয়ে আসা দরকার। নতুবা খাসি শিশুরা নিজস্ব মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত হবে। একসময় দেখা যাবে এ ভাষায় কথা বলার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এভাবে ভাষাটি হারিয়ে যাবে।’

বান্দরবানের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রো’র মাতৃভাষাকে বাঁচাতে ইয়াংঙান ম্রো প্রণয়ন করেছেন ‘ততোং’ নামের ব্যাকরণ পুস্তক। বইয়ের স্বত্বাধিকারী জানান, বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারের অনুকরণে ম্রো ভাষার ব্যাকরণ প্রণীত। মাত্র ৪০ বছর পূর্বে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ম্রো ভাষার বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছিলেন ক্রামাদি মেনলে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি। ম্রোদের বর্ণমালা আবিষ্কারের পরবর্তীতে লিখিতরূপে চর্চা ও অনুশীলন শুরু হয়। কিন্তু ব্যাকরণ না থাকায় স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ব্যবহারের ভিন্নতা খোলা চোখে ধরা পড়ে। শব্দের প্রয়োগ ও ক্রিয়াপদের ব্যবহার; একজনের লিখিতরূপ অন্যজনের বোঝাও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। এরূপ প্রেক্ষাপট থেকেই ইয়াংঙন ম্রো’র ব্যাকরণ প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে ম্রোদের ক্রামাধর্মের প্রধান ধর্মগুরু লেংয়াং ম্রো নিজ মাতৃভাষার ব্যাকরণ বই মোড়ক উম্মোচন করেছেন। বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সমৃদ্ধকরণে সহমত পোষণ করেছেন- ঙানসিং ম্রো, রেংয়েং ম্রো, তনপাউ ম্রো প্রমুখরা।

বাংলাদেশে ভাষা নিয়ে কাজ করে ‘সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিক’ (সিল)। সিল বাংলাদেশ-এর তথ্যানুযায়ী ২০টি ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। ভাষাগুলোর মধ্যে কন্দ, হুদি, পাত্র ও বানাই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা উল্লেখযোগ্য। শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার ১৫টি উপজেলায় ১২৬টি গ্রামে ২১৪৩টি হুদি পরিবার বসবাস করে। হুদি জনগোষ্ঠীর কেউই মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন না, দু-একজন রয়েছেন যারা হাতেগোনা কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করতে সক্ষম। কন্দ জাতিগোষ্ঠী ১২টি উপজেলায় ৩০টি চা বাগানে প্রায় ৫৩৯টি পরিবার উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ করা হয়েছে। কন্দরা মায়ের ভাষাকে হারিয়ে উড়িয়াদের ভাষায় অভ্যস্ত হয়েছেন। অবশ্য পাশর্^বর্তী ভারতে কন্দরা- উড়িয়া, কুইভ ও তেলেগু ভাষায় অভ্যস্ত হয়েছেন। ভাষার জগাখিচুড়িতে নতুন ভাষার উদ্ভব হয়েছে যা ‘বাগানিয়া ভাষা’ বলেই স্থানীয়দের কাছে সমাধিক পরিচিত।

গোটা সিলেটে ৩১টি চা বাগানে ৬৩৭টি পাত্র পরিবার বাস করে। নিজেদের সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মাতৃভাষা পুনরুদ্ধারের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় তারা হাবুডুবু খাচ্ছে। পাত্রদের লালেংথার ভাষার বর্ণমালা অনুপস্থিতিতে বাংলাকে মাধ্যম হিসেবেই গ্রহণ করেছে। এই ভাষায় রক্ষায় সরকারের সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার। নইলে ভাষাটি হারিয়ে যাবে। বানাই ভাষাভাষীর লোকজন নিরাপত্তার বেষ্টনীকে ভেঙে উন্মুক্ত আকাশের খোঁজে আসাম ও মেঘালয়ে পাড়ি জমিয়েছে। বর্তমানে দেশের তিনটি উপজেলায় সাতটি গ্রামে ৭৭টি বানাই পরিবার রয়েছে। বর্ণমালা না থাকলেও মৌখিকভাবে চর্চিত হয়ে চলেছে। বিশেষত মাতৃভাষায় প্রার্থনা ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে মাতৃভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়। অর্থাৎ মাতৃভাষার ব্যবহার ক্ষেত্র ও সীমানা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিশে^র ভাষার অবস্থা বিবেচনার একটি গ্রহণযোগ্য নিরিখ হলো ‘ফিশম্যান মানদন্ড’। ফিশম্যান মানদন্ডানুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেক আদিবাসীর ভাষাই বিপন্নের তালিকায় তালিকাবদ্ধ।

নীতি-নির্ধারকরা বলেন, আমরা সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার উদ্যোগ সত্যিই হতাশাজনক। আসুন, আদিবাসীদের মাতৃভাষাকে সম্মান করার পাশপাশি সেগুলোকে রক্ষা করি।

[লেখক: কলামিস্ট]

দুর্নীতির দৌলতে বিভাজনের রাজনীতি সহজ হয়েছে

ছবি

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব

ছবি

হাতি ও মানুষের সংঘাত বাড়ল কেন?

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন : সাদামাটা কিছু কথা

ছবি

পানি সংকট মোকাবিলায় করণীয়

বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলো কী

রসনাবাদ : উপকূলের একটি গ্রামের আত্মকথা

মার্কিন ভিসানীতি : লক্ষ্য কি শুধুই অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন?

বাজেটে শিক্ষার প্রাপ্তি কী?

প্লাস্টিক ও পরিবেশ

ছবি

ছয় দফা : স্বাধীনতা অভিমুখে চলার মহাসড়ক

মিথ্যা মামলায় জড়ালে কী করবেন?

প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে চাই সামাজিক সচেতনতা

স্বাধীনতার প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ও শেখ কামাল

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

ছবি

স্মরণ : বৃক্ষের মতো সবুজ এক মানুষ

ভিসানীতি, রাজনীতি

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

ভারতের নতুন সংসদ ভবন এবং হিন্দু আধিপত্যবাদ

প্রত্যাশা পূরণে চাই গতিময় প্রশাসন

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও আমি

পংকজ ভট্টাচার্যের ‘আদিবাসী জিজ্ঞাসা’

চিঠি : একটি ব্রিজ চাই

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

মার্কিন ভিসানীতি ও কিছু প্রশ্ন

ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কিভাবে

জ্বালানি সংকটে আশার আলো ইলিশা গ্যাসক্ষেত্র

তামাক নয়, খাদ্য ফলান

খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তি

আপনি তো আছেন নিজের সঙ্গে

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কি প্রাথমিক থাকা যৌক্তিক?

কর্নাটকের ভোট বনাম ভারতের আসন্ন লোকসভার ভোট

স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নে প্রয়োজন স্মার্ট কৃষক

দূতাবাসের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার ও অবরোধের আশঙ্কা

দাদা ও নানার বাড়ির সম্পত্তি কিভাবে উদ্ধার করবেন?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই

মিথুশিলাক মুরমু

রোববার, ২৬ মার্চ ২০২৩

মায়ের ভাষাকে বাঁচাতে লড়াইয়ে নেমেছে বাংলাদেশের আদিবাসীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আকাশ সংস্কৃতি, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা প্রভৃতির দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলো। ভাষা রক্ষায় সরকারের উদাসীনতা রয়েছে। তবে ব্যক্তি উদ্যোগের কমতি নেই। সেই উদ্যোগে আন্তরিকতাও রয়েছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ আয়োজিত মণিপুরী ভাষায় লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। উদ্দেশ্য একটাই- মাতৃভাষায় প্রতি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তিনটি কাজ করার কথা- ভাষা প্রমিতকরণ, বিপন্ন বা বিলুপ্ত ভাষার গবেষণা ও সংরক্ষণ এবং শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর অনেক বছর পেরিয়েছে। মাত্র পাঁচটি মাতৃভাষায় আটকে আছে ইনস্টিটিউট। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং উরাঁওয়ের মাতৃভাষাতে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও মাঝপথে স্থবির হয়ে পড়েছে। সমতলের সংখ্যাগুরু আদিবাসী হচ্ছে সাঁওতাল। তাদের মধ্যে বর্ণমালার বিভেদ সৃষ্টি করে সাঁওতালি ভাষার মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মাহাতো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ‘কুড়মালি’কে রক্ষা করতে মাঠে নেমেছেন উজ্জ্বল মাহাতো। ইতোমধ্যে তিনি এই ভাষায় ডিকশানারি বের করেছেন। নিজেই পরিচালনা করেন ৫০ জনকে নিয়ে মাতৃভাষার একটি বিদ্যালয়। পাশাপাশি রচনা করেছেন উপন্যাস। মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করতে ৭ মার্চের বিপ্লবী ভাষণ, জাতীয় সংগীতসহ বেশ কিছু সরকারি প্রকাশনা অনুবাদ করে নিজ জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। দেশের ১৮টি জেলার ৩৩টি উপজেলায় মাহাতোদের উপস্থিতি রয়েছে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের জরিপ তালিকায় মাহাতো ভাষার নাম না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছে পুরো জাতিগোষ্ঠী।

সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা উদ্যোক্তা উজ্জ্বল মাহাতে বলেছেন, ‘এটি আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক। এই ভাষায় রয়েছে অনেক গীত, ঝুমুর, গল্প; যা কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে। এই ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ জরুরি। না হলে ভাষাটি গবেষণা ও পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাবে।’

খাসিয়া জাতিগোষ্ঠী সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস করেন। ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করেই অভিভাবকরা শহরে পাঠাচ্ছে পড়াশোনা করতে। আর এখানেই বিপত্তি, ছেলে-মেয়েরা বাংলা ছাড়া মায়ের ভাষা বুঝতে অক্ষম। অভিভাবকরা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, যেভাবেই হোক মাতৃভাষাকে বাঁচাতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে হবে হাজার বছরের সম্পদ মাতৃভাষা। খাসিয়াদের মাতৃভাষাকে রক্ষার্থে মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলের টিএনও মো. নজরুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করেছেন বই-পুস্তক। তার উদ্যোগে স্থানীয় হোসনাবাদ পুঞ্জি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভাষাচর্চার সূচনা হয়। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়টিতে বেলা ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত খাসি ভাষায় পাঠদান করা হচ্ছে। পুঞ্জির পক্ষ থেকে গ্লোরিয়া সুমের নামে একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২৫ জন শিক্ষার্থীকে ভাষা শিক্ষার বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে। খাসি ভাষায় গ্লোরিয়া সুমেরের দক্ষতা শিশুদের মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগছে। খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সাজু মাচিয়াং বলেছেন, ‘খাসি মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের এগিয়ে আসা দরকার। নতুবা খাসি শিশুরা নিজস্ব মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত হবে। একসময় দেখা যাবে এ ভাষায় কথা বলার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এভাবে ভাষাটি হারিয়ে যাবে।’

বান্দরবানের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রো’র মাতৃভাষাকে বাঁচাতে ইয়াংঙান ম্রো প্রণয়ন করেছেন ‘ততোং’ নামের ব্যাকরণ পুস্তক। বইয়ের স্বত্বাধিকারী জানান, বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারের অনুকরণে ম্রো ভাষার ব্যাকরণ প্রণীত। মাত্র ৪০ বছর পূর্বে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ম্রো ভাষার বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছিলেন ক্রামাদি মেনলে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি। ম্রোদের বর্ণমালা আবিষ্কারের পরবর্তীতে লিখিতরূপে চর্চা ও অনুশীলন শুরু হয়। কিন্তু ব্যাকরণ না থাকায় স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ব্যবহারের ভিন্নতা খোলা চোখে ধরা পড়ে। শব্দের প্রয়োগ ও ক্রিয়াপদের ব্যবহার; একজনের লিখিতরূপ অন্যজনের বোঝাও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। এরূপ প্রেক্ষাপট থেকেই ইয়াংঙন ম্রো’র ব্যাকরণ প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে ম্রোদের ক্রামাধর্মের প্রধান ধর্মগুরু লেংয়াং ম্রো নিজ মাতৃভাষার ব্যাকরণ বই মোড়ক উম্মোচন করেছেন। বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সমৃদ্ধকরণে সহমত পোষণ করেছেন- ঙানসিং ম্রো, রেংয়েং ম্রো, তনপাউ ম্রো প্রমুখরা।

বাংলাদেশে ভাষা নিয়ে কাজ করে ‘সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিক’ (সিল)। সিল বাংলাদেশ-এর তথ্যানুযায়ী ২০টি ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। ভাষাগুলোর মধ্যে কন্দ, হুদি, পাত্র ও বানাই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা উল্লেখযোগ্য। শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার ১৫টি উপজেলায় ১২৬টি গ্রামে ২১৪৩টি হুদি পরিবার বসবাস করে। হুদি জনগোষ্ঠীর কেউই মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন না, দু-একজন রয়েছেন যারা হাতেগোনা কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করতে সক্ষম। কন্দ জাতিগোষ্ঠী ১২টি উপজেলায় ৩০টি চা বাগানে প্রায় ৫৩৯টি পরিবার উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ করা হয়েছে। কন্দরা মায়ের ভাষাকে হারিয়ে উড়িয়াদের ভাষায় অভ্যস্ত হয়েছেন। অবশ্য পাশর্^বর্তী ভারতে কন্দরা- উড়িয়া, কুইভ ও তেলেগু ভাষায় অভ্যস্ত হয়েছেন। ভাষার জগাখিচুড়িতে নতুন ভাষার উদ্ভব হয়েছে যা ‘বাগানিয়া ভাষা’ বলেই স্থানীয়দের কাছে সমাধিক পরিচিত।

গোটা সিলেটে ৩১টি চা বাগানে ৬৩৭টি পাত্র পরিবার বাস করে। নিজেদের সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মাতৃভাষা পুনরুদ্ধারের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় তারা হাবুডুবু খাচ্ছে। পাত্রদের লালেংথার ভাষার বর্ণমালা অনুপস্থিতিতে বাংলাকে মাধ্যম হিসেবেই গ্রহণ করেছে। এই ভাষায় রক্ষায় সরকারের সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার। নইলে ভাষাটি হারিয়ে যাবে। বানাই ভাষাভাষীর লোকজন নিরাপত্তার বেষ্টনীকে ভেঙে উন্মুক্ত আকাশের খোঁজে আসাম ও মেঘালয়ে পাড়ি জমিয়েছে। বর্তমানে দেশের তিনটি উপজেলায় সাতটি গ্রামে ৭৭টি বানাই পরিবার রয়েছে। বর্ণমালা না থাকলেও মৌখিকভাবে চর্চিত হয়ে চলেছে। বিশেষত মাতৃভাষায় প্রার্থনা ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে মাতৃভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়। অর্থাৎ মাতৃভাষার ব্যবহার ক্ষেত্র ও সীমানা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিশে^র ভাষার অবস্থা বিবেচনার একটি গ্রহণযোগ্য নিরিখ হলো ‘ফিশম্যান মানদন্ড’। ফিশম্যান মানদন্ডানুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেক আদিবাসীর ভাষাই বিপন্নের তালিকায় তালিকাবদ্ধ।

নীতি-নির্ধারকরা বলেন, আমরা সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার উদ্যোগ সত্যিই হতাশাজনক। আসুন, আদিবাসীদের মাতৃভাষাকে সম্মান করার পাশপাশি সেগুলোকে রক্ষা করি।

[লেখক: কলামিস্ট]

back to top