alt

উপ-সম্পাদকীয়

ফসলের গায়ে পাখির রক্ত কেন?

পাভেল পার্থ

: বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩
image

পাখিদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এবং মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে

নদীমাতৃক বাংলাদেশ পাখপাখালিরও দেশ। জীবনের পরতে পরতে পাখি। বিছানা বালিশ কাঁথায় পাখির নকশা। ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে...’। রাধারমণের ‘কালা কাজলের পাখি’ বা লালনের ‘অচিন পাখি’। পাখিরা তৈরি করেছে জীবনের কত রূপকল্প। রূপকথার শুকসারী থেকে পুরাণের গড়–র। জীবনে নিদেনপক্ষে একবার সবাইই ‘পাখির মতো উড়াল দিতে চায়’। ছোট্ট এই ভূগোলে প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ভিন্নতায় পাখিদের বৈচিত্র্য ও আবাসও ভিন্ন ভিন্ন। তথাকথিত রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন মারাদাঙ্গাই পাখিদের জগতসংসার উল্টেপাল্টে দিয়েছে। পাখি-বাস্তুসংস্থানকে নিশ্চিহ্ন করেছে। পাখিদের আবাসস্থল ও বিচরণস্থলগুলো দখল করেছে।

সব গাছে পাখি বসে না, পাখির ঘরদুয়ার তৈরি হয় না। লম্বা তালগাছে বাবুইয়ের বাসা দোল খায়, বাবুই কি বেগুন গাছে বাসা বানাতে পারবে? কাঁটাবেগুন ঝোপে বাসা বানায় দূর্গা টুনটুনি। পাখিদের আবাসস্থল মানে দেশি স্থানীয় প্রজাতির গাছের সংখ্যা তো দিনে দিনে খুন হয়েছে। বটপাকুড়, অশ্বত্থ, শিমূল, বাঁশঝাড়, হিজল, করচ গাছগুলো কোথায়? ঝড়ঝঞ্চার আগেভাগে পাখিরা টের পায়। প্রকৃতির পরিবর্তনের সংকেতগুলো বুঝতে পারে। পাখিরা বড় গাছে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় দেয়ার মতো গাছগুলো তো আমরা খুন করে ফেলেছি। গ্রামের মানুষও যেমন দমবন্ধ নগরায়নের দালানগিরির চাপে উদ্বাস্তু হয়েছে, তেমনি পাখিরাও তাদের বৃক্ষস্থল হারিয়ে গৃহহারা হয়েছে। পাশাপাশি পাখিদের জন্য তৈরি হয়েছে নির্দয় খাদ্যসংকট। বুনো লতাগুল্ম ফলফলাদি নেই, দানা জাতীয় শস্যের বৈচিত্র্য নেই, জলাভূমির প্রাণসম্পদ নেই।

আজ ধানক্ষেতে বহুজাতিক কোম্পানির রাসায়নিক বিষ। সিনজেনটা, মনস্যান্টো, বায়ার, কারগিলের মতো বহুজাতিক কোম্পানিরা হাইব্রিড বীজের গায়ে বিষ মাখিয়ে বিক্রি করে। কৃষক বিষ মাখানো সেই বীজই জমিনে পুঁতে। বিষের জ্বালায় মরেছে শামুক, পতঙ্গ, ব্যাঙ, কেঁচো। পাখিরা খাবে কী? বিষ মেশানো দানা? খাদ্যসংকটে থাকা দেশের পাখিরা তাই খাচ্ছে। তারপর নির্দয়ভাবে মরেছে। কিংবা জমির ফসল বাঁচানোর নামে নিষিদ্ধ কারেন্টজাল আটকে দিয়ে প্রশ্নহীনভাবে খুন করা হচ্ছে পাখি। কোনো বিচার নাই। পাখিদের জন্য কোনো নাগরিক সমাজ নাই। সরকার নাই। স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নাই। বেশ কয়েকবছর হলো কারেন্টজালের ফাঁদ পেতে নির্মম পাখিহত্যা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে উপকূলে বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে কারেন্টজাল পেতে বাবুই পাখি হত্যা চলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সবিজখেতে চলছে পাখিনিধন। উত্তরাঞ্চলে লিচু ও ফলের বাগানে কারেন্টজালে খুন হচ্ছে পাখি। কারেন্টজাল আইনত নিষিদ্ধ। জলের তলের মাছের সংসার কিংবা ভূমির পাখিকূল নিধনে লোভী নির্দয় মানুষ এই জাল ব্যবহার করছে।

গণমাধ্যমে কারেন্টজাল দিয়ে পাখি হত্যার খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হলেও এ নিয়ে কোনো প্রশাসনিক তৎপরতা শুরু হয়নি। অথচ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২, পরিবেশ আইন, রামসার সনদ ও পাখি সুরক্ষাবিষয়ক বহু প্রজ্ঞাপনে পাখি হত্যার বিচার ও দন্ডের বিধান আছে। ধান জমিন, সবজিখেত কিংবা ফলের বাগানে কারেন্টজালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। এভাবে ফসলের সুরক্ষা হয় না, বরং পাখি ও পতঙ্গের সম্পর্ককে জোরালো করতে হবে। পতঙ্গ খেয়ে ফসল বাঁচানো থেকে শুরু করে পরাগায়ণ ও বীজ বিস্তার ও বিসরণে পাখিদের ভূমিকা ও অনন্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

দেশের প্রতিটি এলাকায় উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকার আছে। কোনো এলাকায় কৃষিজমি বা বাগানে কারেন্টজাল বা ফাঁদ পাতা হলে অবশ্যই তারা সেটি খেয়াল করতে পারেন। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি ও আইনগত প্রক্রিয়ার জন্য তৎপর হতে পারেন। স্থানীয় বনবিভাগ পাখি ও বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা ও আইনগত বিষয়টির দেখভাল করতে পারেন। স্থানীয় প্রশাসন পাখিদের সুরক্ষায় তৎপর হতে পারে এবং দৃষ্টান্তমূলক কিছু উদাহরণ তৈরি করতে পারে। দেশের কোনো এলাকায় ফল-ফসল রক্ষার নামে কারেন্টজালে পাখিহত্যার ঘটনা ঘটলে অবশ্যই সে এলাকার স্থানীয় সরকার, কৃষিবিভাগ ও বনবিভাগকেও এর দায়ভার নিতে হবে। কারণ কোনো এলাকার পাখিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব এদের ওপরও বর্তায়।

সর্বোপরি পাখিদের সুরক্ষায় জনআন্দোলন সক্রিয় করতে হবে। গ্রাম কী নগরে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও তরুণদের অংশগ্রহণকে জোরালো করতে হবে। স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশবাদী সংগঠনকে এ বিষয়ে তৎপর হতে হবে। নানামুখী গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্ষেত্রে রাখতে পারে পাখিবান্ধব ভূমিকা। এমনকি বিষয়টি উৎপাদক-ক্রেতা-ভোক্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত। আমরা এমন কোনো ফল বা ফসল খেতে চাই না, যা বহু পাখিদের মেরে আমাদের সামনে হাজির হয়। এই সমাজ আমাদের সবার সমাজ। এখানে পাখিরা থাকবে, পাখিদের জন্য পতঙ্গ থাকবে। পতঙ্গের জন্য ফুলের রেণু থাকবে। শস্যফসল ফলে কোনো পাখির রক্তদাগ লেগে থাকবে না।

বছর বছর লিচুর জন্য প্রশ্নহীনভাবে পাখি ও বাদুড় হত্যা করছে বাগানমালিকরা। লিচুতে দেয়া বিষে মরছে শিশুরাও। ঝিনাইদহরে শৈলকুপার ত্রিবেণী ইউনিয়নের কুঠিপাড়া গ্রামের লিচুবাগান মালিকরা লিচু বাগানের চারধারে নিষিদ্ধ ‘কারেন্টজালের’ ফাঁদ ব্যবহার করেন। জালের সুতায় নখ, ঠোঁট ও পাখা আটকে করোনা মহামারীর ভেতর ৩০ মে ২০২০ সালে নির্মম মৃত্যু হয় অজ¯্র বুলবুলি ও শালিক পাখির। এর আগেও ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলায় বাউকূল ও বেগুনখেতে কারেন্টজাল আটকে শত শত পাখি নিধনের নিদারুণ ঘটনা ঘটেছে। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের সরালিয়া গ্রামে ধানের জমিনে বিষটোপ দিয়ে ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে হত্যা করা হয় ৪০০ ঘুঘু। ২০২৩ সালেও কারেন্টজাল দিয়ে পাখি হত্যার বিষয়টি থামছে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে রাজবাড়ীর উজানচরে বেগুন ও টমেটোখেতে কারেন্টজাল ব্যবহার করায় মারা যাচ্ছে শালিক, ঘুঘু, বাদুড়, চড়–ই কী বক।

ফসল বাঁচানোর নামে কারেন্টজাল দিয়ে একের পর এক পাখিহত্যার ঘটনায় আজকের কৃষকমন ব্যথাতুর হয় না কেন? কেন কলিজা কেঁপে ওঠে না? সমাজজীবন ও গ্রামীণ মনস্তত্ত্বের জটিল ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলোও আমাদের বুঝতে হবে। বিশেষ করে সবুজবিপ্লবের পর গ্রামীণ কৃষিজগত ও মনস্তত্বে এক আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনের নামে বিষ দিয়ে অণুজীব কী পতঙ্গ মেরে ফেলার ঘটনা মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রবল হন্তারক করে তুলছে। আর তাই মানুষ ফল ফসল সুরক্ষা করতে প্রকৃতির গণিতকে পাঠ করতে পারছে না। বিষ দিয়ে পাখিদের খাদ্য পতঙ্গ মারছে, পাখিদের বসতবাড়ি দখল করছে কিংবা জাল দিয়ে পাখিদের মারছে।

ফল-ফসল বাঁচাতে জাল ও ফাঁদ দিয়ে পাখিদের মেরে ফেলার ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে যেসব অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদন হয় সেসব এলাকায় বেশি। এমনকি এর সঙ্গে বাণিজ্যিক তামাক ও ভুট্টা চাষেরও সম্পর্ক আছে। দেখা গেছে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, রংপুর, যশোরে এভাবে পাখিদের মৃত্যু বেশি ঘটছে এবং এ অঞ্চলে তামাক চাষ সম্প্রসারণের কারণে দেশি বৃক্ষনিধন করা হয়েছে এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট করা হয়েছে। এসব এলাকার পাখিরা মূলত তাদের প্রাকৃতিক খাদ্যভান্ডার হারিয়েছে এবং এমনকি থাকার জায়গার সংকটেও পড়েছে। তাই ক্ষুধাকতর পাখি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফসলের জমিনে নামছে। আবার দেখা গেছে এসব অঞ্চলে দেশি গাছ ও গ্রামীণ বন না থাকায় পাখিরা বাধ্য হয়ে আগ্রাসী জাতের গাছে ঝড়ের সময় আশ্রয় নিতে গিয়েও মরছে। ৬ এপ্রিল ২০১৫ ভোরে এবং ৭ এপ্রিল রাতে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, নড়াইল ও মাগুড়ার বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী ঝড়ে নিহত পাখিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজার। শুধু কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কুলসীবাসা-ছাগলাপাড়া এবং ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ছোট মৌকুড়ি ও পাথরবাড়িয়া গ্রামেই প্রায় ১২ হাজার পাখির গণমৃত্যু ঘটেছিল।

পাখিদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক খাদ্যউৎপাদন ব্যবস্থা এবং মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমরা যদি না চাই তবে কারেন্টজাল দিয়ে আর কোনো জমিন কী বাগান ঢাকা পড়বে না। আমাদের শস্য ফসলের শরীরে পাখিদের রক্তদাগ লেগে থাকবে না। শুধু কারেন্টজাল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধের ভেতর দিয়েই এই সংকটের সুরাহা হবে না, যদি না আমরা পাখিদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করবার অভ্যাস গড়ে না তুলি। পাখি, পতঙ্গ, বৃক্ষ কী মানুষ সবাইই এই রাষ্ট্রের নাগরিক। সবার এখানে স্বাধীনভাবে বসবাস ও জীবন বিকশিত করার অধিকার আছে। রাষ্ট্র এবং জনগণ সবাইকেই এই দর্শন ধারণ করা জরুরি।

পাখিদের তাড়ানোর জন্য মাটির পাতিল, পুরনো কাপড়, খড় বাঁশ, চুন-কালি দিয়ে নানা চেহারার কাকতাড়–য়া স্থাপনের প্রাচীন কৃষিকারিগরি আমাদের আছে। এমনকি টিনের ঢনঢনি বাজানো কিংবা রঙবেরঙের ফিতা ঝুলানোর মতো পদ্ধতি আছে। এছাড়া খেতের মাঝে গাছের ডাল বা বাঁশের খুঁটি পুঁতে রাখা বা পার্চিং এক্ষেত্রে বেশ কার্যকর পরিবেশসম্মত পদ্ধতি। দেখা গেছে এসব লোকায়ত পদ্ধতিতে পাখিরা খেতের পতঙ্গ খেয়ে ফসলের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাছাড়া এসব কৌশল আমাদের প্রাকৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিসরকে পাখিবান্ধব করে তুলে।

[লেখক: গবেষক]

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

প্রসঙ্গ : নিত্যপণ্যের দাম

ছবি

টঙ্ক আন্দোলনের কুমুদিনী হাজং

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে চাই বিকেন্দ্রীকরণ

দূষণমুক্ত পানির বিকল্প নাই

রম্যগদ্য : ‘দুনিয়ার বাঙালি এক হও”

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ফসলের গায়ে পাখির রক্ত কেন?

পাভেল পার্থ

image

পাখিদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এবং মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে

বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩

নদীমাতৃক বাংলাদেশ পাখপাখালিরও দেশ। জীবনের পরতে পরতে পাখি। বিছানা বালিশ কাঁথায় পাখির নকশা। ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে...’। রাধারমণের ‘কালা কাজলের পাখি’ বা লালনের ‘অচিন পাখি’। পাখিরা তৈরি করেছে জীবনের কত রূপকল্প। রূপকথার শুকসারী থেকে পুরাণের গড়–র। জীবনে নিদেনপক্ষে একবার সবাইই ‘পাখির মতো উড়াল দিতে চায়’। ছোট্ট এই ভূগোলে প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ভিন্নতায় পাখিদের বৈচিত্র্য ও আবাসও ভিন্ন ভিন্ন। তথাকথিত রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন মারাদাঙ্গাই পাখিদের জগতসংসার উল্টেপাল্টে দিয়েছে। পাখি-বাস্তুসংস্থানকে নিশ্চিহ্ন করেছে। পাখিদের আবাসস্থল ও বিচরণস্থলগুলো দখল করেছে।

সব গাছে পাখি বসে না, পাখির ঘরদুয়ার তৈরি হয় না। লম্বা তালগাছে বাবুইয়ের বাসা দোল খায়, বাবুই কি বেগুন গাছে বাসা বানাতে পারবে? কাঁটাবেগুন ঝোপে বাসা বানায় দূর্গা টুনটুনি। পাখিদের আবাসস্থল মানে দেশি স্থানীয় প্রজাতির গাছের সংখ্যা তো দিনে দিনে খুন হয়েছে। বটপাকুড়, অশ্বত্থ, শিমূল, বাঁশঝাড়, হিজল, করচ গাছগুলো কোথায়? ঝড়ঝঞ্চার আগেভাগে পাখিরা টের পায়। প্রকৃতির পরিবর্তনের সংকেতগুলো বুঝতে পারে। পাখিরা বড় গাছে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় দেয়ার মতো গাছগুলো তো আমরা খুন করে ফেলেছি। গ্রামের মানুষও যেমন দমবন্ধ নগরায়নের দালানগিরির চাপে উদ্বাস্তু হয়েছে, তেমনি পাখিরাও তাদের বৃক্ষস্থল হারিয়ে গৃহহারা হয়েছে। পাশাপাশি পাখিদের জন্য তৈরি হয়েছে নির্দয় খাদ্যসংকট। বুনো লতাগুল্ম ফলফলাদি নেই, দানা জাতীয় শস্যের বৈচিত্র্য নেই, জলাভূমির প্রাণসম্পদ নেই।

আজ ধানক্ষেতে বহুজাতিক কোম্পানির রাসায়নিক বিষ। সিনজেনটা, মনস্যান্টো, বায়ার, কারগিলের মতো বহুজাতিক কোম্পানিরা হাইব্রিড বীজের গায়ে বিষ মাখিয়ে বিক্রি করে। কৃষক বিষ মাখানো সেই বীজই জমিনে পুঁতে। বিষের জ্বালায় মরেছে শামুক, পতঙ্গ, ব্যাঙ, কেঁচো। পাখিরা খাবে কী? বিষ মেশানো দানা? খাদ্যসংকটে থাকা দেশের পাখিরা তাই খাচ্ছে। তারপর নির্দয়ভাবে মরেছে। কিংবা জমির ফসল বাঁচানোর নামে নিষিদ্ধ কারেন্টজাল আটকে দিয়ে প্রশ্নহীনভাবে খুন করা হচ্ছে পাখি। কোনো বিচার নাই। পাখিদের জন্য কোনো নাগরিক সমাজ নাই। সরকার নাই। স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নাই। বেশ কয়েকবছর হলো কারেন্টজালের ফাঁদ পেতে নির্মম পাখিহত্যা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে উপকূলে বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে কারেন্টজাল পেতে বাবুই পাখি হত্যা চলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সবিজখেতে চলছে পাখিনিধন। উত্তরাঞ্চলে লিচু ও ফলের বাগানে কারেন্টজালে খুন হচ্ছে পাখি। কারেন্টজাল আইনত নিষিদ্ধ। জলের তলের মাছের সংসার কিংবা ভূমির পাখিকূল নিধনে লোভী নির্দয় মানুষ এই জাল ব্যবহার করছে।

গণমাধ্যমে কারেন্টজাল দিয়ে পাখি হত্যার খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হলেও এ নিয়ে কোনো প্রশাসনিক তৎপরতা শুরু হয়নি। অথচ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২, পরিবেশ আইন, রামসার সনদ ও পাখি সুরক্ষাবিষয়ক বহু প্রজ্ঞাপনে পাখি হত্যার বিচার ও দন্ডের বিধান আছে। ধান জমিন, সবজিখেত কিংবা ফলের বাগানে কারেন্টজালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। এভাবে ফসলের সুরক্ষা হয় না, বরং পাখি ও পতঙ্গের সম্পর্ককে জোরালো করতে হবে। পতঙ্গ খেয়ে ফসল বাঁচানো থেকে শুরু করে পরাগায়ণ ও বীজ বিস্তার ও বিসরণে পাখিদের ভূমিকা ও অনন্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

দেশের প্রতিটি এলাকায় উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকার আছে। কোনো এলাকায় কৃষিজমি বা বাগানে কারেন্টজাল বা ফাঁদ পাতা হলে অবশ্যই তারা সেটি খেয়াল করতে পারেন। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি ও আইনগত প্রক্রিয়ার জন্য তৎপর হতে পারেন। স্থানীয় বনবিভাগ পাখি ও বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা ও আইনগত বিষয়টির দেখভাল করতে পারেন। স্থানীয় প্রশাসন পাখিদের সুরক্ষায় তৎপর হতে পারে এবং দৃষ্টান্তমূলক কিছু উদাহরণ তৈরি করতে পারে। দেশের কোনো এলাকায় ফল-ফসল রক্ষার নামে কারেন্টজালে পাখিহত্যার ঘটনা ঘটলে অবশ্যই সে এলাকার স্থানীয় সরকার, কৃষিবিভাগ ও বনবিভাগকেও এর দায়ভার নিতে হবে। কারণ কোনো এলাকার পাখিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব এদের ওপরও বর্তায়।

সর্বোপরি পাখিদের সুরক্ষায় জনআন্দোলন সক্রিয় করতে হবে। গ্রাম কী নগরে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও তরুণদের অংশগ্রহণকে জোরালো করতে হবে। স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশবাদী সংগঠনকে এ বিষয়ে তৎপর হতে হবে। নানামুখী গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্ষেত্রে রাখতে পারে পাখিবান্ধব ভূমিকা। এমনকি বিষয়টি উৎপাদক-ক্রেতা-ভোক্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত। আমরা এমন কোনো ফল বা ফসল খেতে চাই না, যা বহু পাখিদের মেরে আমাদের সামনে হাজির হয়। এই সমাজ আমাদের সবার সমাজ। এখানে পাখিরা থাকবে, পাখিদের জন্য পতঙ্গ থাকবে। পতঙ্গের জন্য ফুলের রেণু থাকবে। শস্যফসল ফলে কোনো পাখির রক্তদাগ লেগে থাকবে না।

বছর বছর লিচুর জন্য প্রশ্নহীনভাবে পাখি ও বাদুড় হত্যা করছে বাগানমালিকরা। লিচুতে দেয়া বিষে মরছে শিশুরাও। ঝিনাইদহরে শৈলকুপার ত্রিবেণী ইউনিয়নের কুঠিপাড়া গ্রামের লিচুবাগান মালিকরা লিচু বাগানের চারধারে নিষিদ্ধ ‘কারেন্টজালের’ ফাঁদ ব্যবহার করেন। জালের সুতায় নখ, ঠোঁট ও পাখা আটকে করোনা মহামারীর ভেতর ৩০ মে ২০২০ সালে নির্মম মৃত্যু হয় অজ¯্র বুলবুলি ও শালিক পাখির। এর আগেও ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলায় বাউকূল ও বেগুনখেতে কারেন্টজাল আটকে শত শত পাখি নিধনের নিদারুণ ঘটনা ঘটেছে। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের সরালিয়া গ্রামে ধানের জমিনে বিষটোপ দিয়ে ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে হত্যা করা হয় ৪০০ ঘুঘু। ২০২৩ সালেও কারেন্টজাল দিয়ে পাখি হত্যার বিষয়টি থামছে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে রাজবাড়ীর উজানচরে বেগুন ও টমেটোখেতে কারেন্টজাল ব্যবহার করায় মারা যাচ্ছে শালিক, ঘুঘু, বাদুড়, চড়–ই কী বক।

ফসল বাঁচানোর নামে কারেন্টজাল দিয়ে একের পর এক পাখিহত্যার ঘটনায় আজকের কৃষকমন ব্যথাতুর হয় না কেন? কেন কলিজা কেঁপে ওঠে না? সমাজজীবন ও গ্রামীণ মনস্তত্ত্বের জটিল ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলোও আমাদের বুঝতে হবে। বিশেষ করে সবুজবিপ্লবের পর গ্রামীণ কৃষিজগত ও মনস্তত্বে এক আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনের নামে বিষ দিয়ে অণুজীব কী পতঙ্গ মেরে ফেলার ঘটনা মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রবল হন্তারক করে তুলছে। আর তাই মানুষ ফল ফসল সুরক্ষা করতে প্রকৃতির গণিতকে পাঠ করতে পারছে না। বিষ দিয়ে পাখিদের খাদ্য পতঙ্গ মারছে, পাখিদের বসতবাড়ি দখল করছে কিংবা জাল দিয়ে পাখিদের মারছে।

ফল-ফসল বাঁচাতে জাল ও ফাঁদ দিয়ে পাখিদের মেরে ফেলার ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে যেসব অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদন হয় সেসব এলাকায় বেশি। এমনকি এর সঙ্গে বাণিজ্যিক তামাক ও ভুট্টা চাষেরও সম্পর্ক আছে। দেখা গেছে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, রংপুর, যশোরে এভাবে পাখিদের মৃত্যু বেশি ঘটছে এবং এ অঞ্চলে তামাক চাষ সম্প্রসারণের কারণে দেশি বৃক্ষনিধন করা হয়েছে এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট করা হয়েছে। এসব এলাকার পাখিরা মূলত তাদের প্রাকৃতিক খাদ্যভান্ডার হারিয়েছে এবং এমনকি থাকার জায়গার সংকটেও পড়েছে। তাই ক্ষুধাকতর পাখি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফসলের জমিনে নামছে। আবার দেখা গেছে এসব অঞ্চলে দেশি গাছ ও গ্রামীণ বন না থাকায় পাখিরা বাধ্য হয়ে আগ্রাসী জাতের গাছে ঝড়ের সময় আশ্রয় নিতে গিয়েও মরছে। ৬ এপ্রিল ২০১৫ ভোরে এবং ৭ এপ্রিল রাতে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, নড়াইল ও মাগুড়ার বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী ঝড়ে নিহত পাখিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজার। শুধু কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কুলসীবাসা-ছাগলাপাড়া এবং ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ছোট মৌকুড়ি ও পাথরবাড়িয়া গ্রামেই প্রায় ১২ হাজার পাখির গণমৃত্যু ঘটেছিল।

পাখিদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক খাদ্যউৎপাদন ব্যবস্থা এবং মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমরা যদি না চাই তবে কারেন্টজাল দিয়ে আর কোনো জমিন কী বাগান ঢাকা পড়বে না। আমাদের শস্য ফসলের শরীরে পাখিদের রক্তদাগ লেগে থাকবে না। শুধু কারেন্টজাল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধের ভেতর দিয়েই এই সংকটের সুরাহা হবে না, যদি না আমরা পাখিদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করবার অভ্যাস গড়ে না তুলি। পাখি, পতঙ্গ, বৃক্ষ কী মানুষ সবাইই এই রাষ্ট্রের নাগরিক। সবার এখানে স্বাধীনভাবে বসবাস ও জীবন বিকশিত করার অধিকার আছে। রাষ্ট্র এবং জনগণ সবাইকেই এই দর্শন ধারণ করা জরুরি।

পাখিদের তাড়ানোর জন্য মাটির পাতিল, পুরনো কাপড়, খড় বাঁশ, চুন-কালি দিয়ে নানা চেহারার কাকতাড়–য়া স্থাপনের প্রাচীন কৃষিকারিগরি আমাদের আছে। এমনকি টিনের ঢনঢনি বাজানো কিংবা রঙবেরঙের ফিতা ঝুলানোর মতো পদ্ধতি আছে। এছাড়া খেতের মাঝে গাছের ডাল বা বাঁশের খুঁটি পুঁতে রাখা বা পার্চিং এক্ষেত্রে বেশ কার্যকর পরিবেশসম্মত পদ্ধতি। দেখা গেছে এসব লোকায়ত পদ্ধতিতে পাখিরা খেতের পতঙ্গ খেয়ে ফসলের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাছাড়া এসব কৌশল আমাদের প্রাকৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিসরকে পাখিবান্ধব করে তুলে।

[লেখক: গবেষক]

back to top