গৌতম রায়
তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবার পর বিগত প্রায় বারো বছরে সরকারি স্তরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ ঘিরে যে ধরনের অভিযোগ উঠেছে, সেসব অভিযোগ ঘিরে সিবিআই, ইডি ইত্যাদি তদন্তকারী সংস্থা এবং মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের অনুধ্যান থেকে যেসব ছবি উঠে আসছে, তেমন অভিজ্ঞতা এই রাজ্যের মানুষদের ব্রিটিশ আমলে হয়নি, কংগ্রেস আমলে হয়নি, বামফ্রন্ট আমলেও হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ ঘিরে শাসকবৃত্তের দুর্নীতির জেরে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারি বৃত্তে থাকা একটা বড় অংশের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে জেলে রয়েছেন। অনুব্রত মন্ডল, তৃণমূলের বীরভূম জেলার সভাপতি, গরু পাচারের অভিযোগে এখন দিল্লির তিহার জেলে বন্দি। শাসক শিবিরের একটা বড় অংশের বিশেষ ক্ষমতাশালী লোকজন জেলে রয়েছে, প্রায় রোজই শাসক ঘনিষ্ঠ মহল থেকে কোটি কোটি বেআইনি টাকা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা উদ্ধার করছে- এমন অভিজ্ঞতা কেবল পশ্চিমবঙ্গবাসীই নয়, গোটা ভারতের কোনো রাজ্যের মানুষদের এমন ধারাবাহিকভাবে হয়নি।
সরকারি স্তরের যে কোনো চাকরিকে কার্যত নিলামে তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের লোকজনদের এই চাকরি নিলামে তোলার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেলেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে বিষয়টি পিবিআই, আদালত ইত্যাদির মাধ্যমে প্রথম তথ্য প্রমাণসহ সামনে আসে। তার আগেই বিভিন্ন নিয়োগকারী সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতি ঘিরে, যোগ্য প্রার্থীদের বদলে অযোগ্যদের নিয়োগ- এসব ঘিরে দলীয় বৃত্তের বাইরে মানুষের আন্দোলন, অনশন মমতার সরকারের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিতে শুরু করেছিল।
শিক্ষক নিয়োগে টাকার লেনদেন ঘিরে তদন্ত আটকাটে রাজ্যের মানুষের করের টাকায় যেভাবে দিনের পর দিন মমতার সরকার হাইকোর্ট আর সুপ্রিম কোর্ট করেছে তা ভাবলেও আঁতকে উঠতে হয়। মমতা, তৃণমূল কংগ্রেস, তাদের দলের নেতা-মন্ত্রী-শান্ত্রীরা যদি এতাই নিশ্চিত থাকেন যে কোনো দুর্নীতি হয়নি, মমতাকে কলঙ্কিত করতেই দুর্নীতি, টাকার লেনদেন ইত্যাদির কথা তোলা হচ্ছে, তাহলে যাদের তদন্ত ঘিরে এত ভয় কেন? কেনই বা তদন্ত আটকাটে নাগরিকের করের টাকায় পুষ্ট রাজকোষ থেকে খরচ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হচ্ছে?
তৃণমূল নেতৃত্বের সরকারি নিয়োগ ঘিরে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে তদন্ত আটকাটে আদালতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, তদন্ত হলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ব। তাই কেউটে বের হবার আগে, কেঁচোও যাতে না বের হতে পারে, সেজন্যে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা থেকে তৃণমূলের প্রায় সবস্তরের নেতাকর্মীদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
মমতা, তৃণমূল কংগ্রেস বহু চেষ্টা করেও নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে তদন্ত আটকাটে পারেননি। যেমন পারেননি অতীতে চিটফান্ড নিয়ে তদন্ত আটকাতেও। নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো তদন্ত শুরু করবার অল্প কিছুদিনের ভিতরেই মমতার সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী তথা পরবর্তী শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গ্রেপ্তার করে। পার্থের এক বান্ধবীর বাড়ি থেকে ঠাকার পাহাড় উদ্ধার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এরপর চলতে থাকে একের পর এক গ্রেপ্তার পর্ব। শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূলের বিধায়ক থেকে নানা স্তরের তৃণমূল নেতারা টাকার বিনিময়ে ইস্কুলের বিভিন্ন স্তরে চাকরি দেওয়ার অভিযোগে টপাটপ গ্রেপ্তার হতে থাকেন। কার্যত মমতার মন্ত্রিসভার একটা সময়ের গোটা শিক্ষা দপ্তর টিই এখন শ্রীঘরে বসবাস করছে।
টাকার বিনিময়ে যেভাবে অযোগ্য ফেল করা প্রার্থীদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে খোদ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়সহ তৃণমূলের প্রথমসারির একটা বড় অংশের লোকেদের জড়িয়ে থাকার বিষয়টি কার্যত তদন্তে প্রমাণিত সত্য হিসেবে উঠে এসেছে, এসব অভিযুক্তদের বাড়ি বা গোপন আস্থানা থেকে নগদে কোটি কোটি টাকা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর দাবারা উদ্ধার হয়েছে, তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় চূড়ান্ত ব্যর্থ, কার্যত ‘শূন্য’ পাওয়া প্রার্থী ও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে চাকরি পেয়েছিল। দিনের পর দিন তারা চাকরি করেছিল। আদালতের হস্তক্ষেপে এসব অবৈধভাবে চাকরি পাওয়া লোকজনদের একটা বিপুল অংশ চাকরিচ্যুত হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ চাকরিচ্যুতদের মধ্যে রাজ্যের মন্ত্রীর কন্যা পর্যন্ত আছে। আছে একাধিক সরকার পক্ষের বিধায়কের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন। শাসক শিবিরের বিধায়কদের আত্মীয়-পরিজন, পঞ্চায়েত থেকে পৌরসভায় শাসক তৃণমূলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আত্মীয়-পরিজন, কাছের লোক- কে নেই আদালতের হস্তক্ষেপে অবৈধ উপায়ে চাকরি পাওয়া প্রমাণিত হওয়ার পর চাকরিচ্যুত হওয়ার তালিকায়।
পশ্চিমবঙ্গে এখন কার্যত এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, ২০১১ সালে তৃণমূলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরের ইস্কুলে যেসব শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিযুক্ত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই প্রায় সামাজিকভাবে একটা ভয়ঙ্কর অস্বস্তিকর অবস্থার ভিতরে রয়েছেন। একটা বড় অংশের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা নিজেদের অযোগ্যতাকে টাকার বিনিময়ে যোগ্যতায় পরিণত করতে কার্যত গোটা শিক্ষক জগতকেই সাধারণ মানুষের কাছে একটা সন্দেহের ছোখে ফেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাজিকভাবে এতটাই খারাপ হয়েছে যে, শিক্ষকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক এখন দ্বিধাগ্রস্ত। এমনকি বিবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক। এই বিষয়গুলো রাজনীতির আঙিনাকে অতিক্রম করে এখন পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক প্রক্ষাপটে ইতিমধ্যেই অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। প্রায়ই অবৈধ ভাবে চাকরি পাওয়ার দৌলতে চাকরি খুইয়েছেন, এমন মানুষদের আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।
অতীতে তৃণমূলের চিটফান্ড কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে উত্তাল জনআন্দোলন এবং আইনি আন্দোলন সেভাবে সংগঠিত হতে পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। শিক্ষা কেলেঙ্কারিতেও সাধারণ মানুষ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়েছে, চিটফান্ড কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও তেমনটাই সাধারণ মানুষদের ঘটেছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনকে মানুষের দরবারে এবং একই সঙ্গে আদালতের আঙিনায় টেনে এনে তদন্তের গতিমুখ বাড়াতে তদন্তকারী দলকে বাধ্য করা বিরোধীদের প্রথামাফিক আন্দোলনের ফলে সেভাবে সফল হয়নি।
মহ. সেলিম সিপিআই (এম) দলের পশ্চিমবঙ্গ আখার সম্পাদকের দায়িত্বভার নেওয়ার পর প্রথাতান্ত্রিকতার বাইরে এনে আন্দোলনকে যেভাবে জনআন্দোলনে পরিণত করেছেন, সেই আন্দোলনের চাপ শিক্ষা কেলেঙ্কারি ঘিরে মহামান্য আদালতের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটা বিশেষ রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত শিক্ষা কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে কলকাতা হাইকোর্ট যে ভূমিকা পালন করে চলেছেন, তা সাধারণ মানুষের মনে গভীর আশার সঞ্চার করেছে। চিটফান্ড ঘিরে মানুষের যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, এক ধরনের অনাস্থার পরিবেশের আঁচও ক্রমশ তৈরি হচ্ছিল রাজনৈতিক দল এবং আদালতের প্রতি। মানুষের হারিয়ে যেতে বসা আস্থা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে মহ. সেলিন এবং মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।
নিয়োগ ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের যে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, তার নজির স্বাধীন ভারতে অন্য কোনো রাজ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি ঘিরে অবিভক্ত বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব বা তামিলনাডুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই যে তৎপরতা দেখিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার দলের সতীর্থদের ক্ষেত্রে সিবিআইর সেই তৎপরতা অভাব পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে বহু প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। তবে সিবিআই, ইডি ইত্যাদির তদন্তের জাল যে ভাবে ধীরে ধীরে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বাড়ির দিকে, অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে, তা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যে সমস্ত যোগ্য প্রার্থীরা, অযোগ্য তৃণমূল ঘনিষ্ঠদের জন্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের মনে নতুন করে আশা সঞ্চার করছে।
পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির জেরে তার দলের প্রতি, এমনকি তার নিজের প্রতিও সাধারণ মানুষদের যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষোভের আগুনকে অন্যদিকে পরিচালিত করবার জন্যে মমতা ইতোমধ্যেই নানা কৌশল নিতে শুরু করেছেন। সেই কৌশলের একটা বড় দিক হলো ক্ষমতাসীন হওয়ার বারো বছর পর অতীতের বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কাল্পনিক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী মমতার বা তার বশংবদ দলীয় সতীর্থদের বামফ্রন্ট আমলের নিয়োগ ঘিরে অভিযোগের সত্যিই যদি কোনো সারবত্তা থাকতো, তাহলে কি মমতা বিগত বারো বছরে বামফ্রন্টকে বিশেষ করে সিপিআই (এম) ছেড়ে দিতেন? নিজের দিকে যখন সব সন্দেহের মূল তীরটা ঘন সন্নিবিষ্ট হতে শুরু করেছে, তখন মমতা অত্যন্ত কৌশলে বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে অসত্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ তুলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে অন্য খাতে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে সিপিআইসহ (এম) সমস্ত বিরোধীদের আন্দোলন, আদালতের ভূমিকা- এসব থেকে সাধারণ মানুষের মনে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, তার গতিমুখকে বদলে দেওয়ার জন্যে এক আতি নিকৃষ্ট কৌশল নিয়েছেন মমতা। কৌশলটি হলো এই- নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে ওঠা অভিযোগ মোকাবিলায় মমতা, চিটফান্ড দুর্নীতি ঘিরে দীর্ঘদিন জেল খাটা, খোদ মমতাই চিটফান্ড দুর্নীতির উৎস, এমন অভিযোগ করা কুনাল ঘোষ আর উৎপল দত্তের নাটকের বিস্তৃত অংশ নিজের নাটকে হুবহু টুকে দেওয়ার অভিযোগসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত, বিতর্কিত ব্রাত্য বসুকে দিয়ে নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে ওঠা অভিযোগের জবাব দেওয়ানো হচ্ছে। স্বভাবসুলভ কৌশলে, গোটা বিষয়টি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে কুনাল আর ব্রাত্য ক্রমাগত অরাজনৈতিক, ব্যক্তি আক্রমণাত্মক অভিযোগ তুলে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তরুণ প্রজন্মের একাংশের বামপন্থি নেতাকর্মীরা মমতার এই কৌশলী ফাঁদ কে না বুঝে, সেই ব্যক্তি আক্রমণের পাল্টা ব্যক্তি আক্রমণ করে চলেছেন। আর ফলশ্রুতিতে নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে ওঠা অভিযোগগুলোর মূল রাজনৈতিক আঙ্গিকটাই ক্রমে চাপা পড় যাচ্ছে। এটাই চাইছেন মমতা। বিরোধীদের একটা অংশ ছেলেমানুষি করে কেন মমতার পেতে রাখা এই ফাঁদে পা দেবেন?
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩
তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবার পর বিগত প্রায় বারো বছরে সরকারি স্তরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ ঘিরে যে ধরনের অভিযোগ উঠেছে, সেসব অভিযোগ ঘিরে সিবিআই, ইডি ইত্যাদি তদন্তকারী সংস্থা এবং মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের অনুধ্যান থেকে যেসব ছবি উঠে আসছে, তেমন অভিজ্ঞতা এই রাজ্যের মানুষদের ব্রিটিশ আমলে হয়নি, কংগ্রেস আমলে হয়নি, বামফ্রন্ট আমলেও হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ ঘিরে শাসকবৃত্তের দুর্নীতির জেরে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারি বৃত্তে থাকা একটা বড় অংশের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে জেলে রয়েছেন। অনুব্রত মন্ডল, তৃণমূলের বীরভূম জেলার সভাপতি, গরু পাচারের অভিযোগে এখন দিল্লির তিহার জেলে বন্দি। শাসক শিবিরের একটা বড় অংশের বিশেষ ক্ষমতাশালী লোকজন জেলে রয়েছে, প্রায় রোজই শাসক ঘনিষ্ঠ মহল থেকে কোটি কোটি বেআইনি টাকা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা উদ্ধার করছে- এমন অভিজ্ঞতা কেবল পশ্চিমবঙ্গবাসীই নয়, গোটা ভারতের কোনো রাজ্যের মানুষদের এমন ধারাবাহিকভাবে হয়নি।
সরকারি স্তরের যে কোনো চাকরিকে কার্যত নিলামে তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের লোকজনদের এই চাকরি নিলামে তোলার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেলেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে বিষয়টি পিবিআই, আদালত ইত্যাদির মাধ্যমে প্রথম তথ্য প্রমাণসহ সামনে আসে। তার আগেই বিভিন্ন নিয়োগকারী সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতি ঘিরে, যোগ্য প্রার্থীদের বদলে অযোগ্যদের নিয়োগ- এসব ঘিরে দলীয় বৃত্তের বাইরে মানুষের আন্দোলন, অনশন মমতার সরকারের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিতে শুরু করেছিল।
শিক্ষক নিয়োগে টাকার লেনদেন ঘিরে তদন্ত আটকাটে রাজ্যের মানুষের করের টাকায় যেভাবে দিনের পর দিন মমতার সরকার হাইকোর্ট আর সুপ্রিম কোর্ট করেছে তা ভাবলেও আঁতকে উঠতে হয়। মমতা, তৃণমূল কংগ্রেস, তাদের দলের নেতা-মন্ত্রী-শান্ত্রীরা যদি এতাই নিশ্চিত থাকেন যে কোনো দুর্নীতি হয়নি, মমতাকে কলঙ্কিত করতেই দুর্নীতি, টাকার লেনদেন ইত্যাদির কথা তোলা হচ্ছে, তাহলে যাদের তদন্ত ঘিরে এত ভয় কেন? কেনই বা তদন্ত আটকাটে নাগরিকের করের টাকায় পুষ্ট রাজকোষ থেকে খরচ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হচ্ছে?
তৃণমূল নেতৃত্বের সরকারি নিয়োগ ঘিরে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে তদন্ত আটকাটে আদালতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, তদন্ত হলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ব। তাই কেউটে বের হবার আগে, কেঁচোও যাতে না বের হতে পারে, সেজন্যে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা থেকে তৃণমূলের প্রায় সবস্তরের নেতাকর্মীদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
মমতা, তৃণমূল কংগ্রেস বহু চেষ্টা করেও নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে তদন্ত আটকাটে পারেননি। যেমন পারেননি অতীতে চিটফান্ড নিয়ে তদন্ত আটকাতেও। নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো তদন্ত শুরু করবার অল্প কিছুদিনের ভিতরেই মমতার সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী তথা পরবর্তী শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গ্রেপ্তার করে। পার্থের এক বান্ধবীর বাড়ি থেকে ঠাকার পাহাড় উদ্ধার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এরপর চলতে থাকে একের পর এক গ্রেপ্তার পর্ব। শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূলের বিধায়ক থেকে নানা স্তরের তৃণমূল নেতারা টাকার বিনিময়ে ইস্কুলের বিভিন্ন স্তরে চাকরি দেওয়ার অভিযোগে টপাটপ গ্রেপ্তার হতে থাকেন। কার্যত মমতার মন্ত্রিসভার একটা সময়ের গোটা শিক্ষা দপ্তর টিই এখন শ্রীঘরে বসবাস করছে।
টাকার বিনিময়ে যেভাবে অযোগ্য ফেল করা প্রার্থীদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে খোদ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়সহ তৃণমূলের প্রথমসারির একটা বড় অংশের লোকেদের জড়িয়ে থাকার বিষয়টি কার্যত তদন্তে প্রমাণিত সত্য হিসেবে উঠে এসেছে, এসব অভিযুক্তদের বাড়ি বা গোপন আস্থানা থেকে নগদে কোটি কোটি টাকা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর দাবারা উদ্ধার হয়েছে, তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় চূড়ান্ত ব্যর্থ, কার্যত ‘শূন্য’ পাওয়া প্রার্থী ও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে চাকরি পেয়েছিল। দিনের পর দিন তারা চাকরি করেছিল। আদালতের হস্তক্ষেপে এসব অবৈধভাবে চাকরি পাওয়া লোকজনদের একটা বিপুল অংশ চাকরিচ্যুত হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ চাকরিচ্যুতদের মধ্যে রাজ্যের মন্ত্রীর কন্যা পর্যন্ত আছে। আছে একাধিক সরকার পক্ষের বিধায়কের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন। শাসক শিবিরের বিধায়কদের আত্মীয়-পরিজন, পঞ্চায়েত থেকে পৌরসভায় শাসক তৃণমূলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আত্মীয়-পরিজন, কাছের লোক- কে নেই আদালতের হস্তক্ষেপে অবৈধ উপায়ে চাকরি পাওয়া প্রমাণিত হওয়ার পর চাকরিচ্যুত হওয়ার তালিকায়।
পশ্চিমবঙ্গে এখন কার্যত এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, ২০১১ সালে তৃণমূলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরের ইস্কুলে যেসব শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিযুক্ত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই প্রায় সামাজিকভাবে একটা ভয়ঙ্কর অস্বস্তিকর অবস্থার ভিতরে রয়েছেন। একটা বড় অংশের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা নিজেদের অযোগ্যতাকে টাকার বিনিময়ে যোগ্যতায় পরিণত করতে কার্যত গোটা শিক্ষক জগতকেই সাধারণ মানুষের কাছে একটা সন্দেহের ছোখে ফেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাজিকভাবে এতটাই খারাপ হয়েছে যে, শিক্ষকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক এখন দ্বিধাগ্রস্ত। এমনকি বিবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক। এই বিষয়গুলো রাজনীতির আঙিনাকে অতিক্রম করে এখন পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক প্রক্ষাপটে ইতিমধ্যেই অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। প্রায়ই অবৈধ ভাবে চাকরি পাওয়ার দৌলতে চাকরি খুইয়েছেন, এমন মানুষদের আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।
অতীতে তৃণমূলের চিটফান্ড কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে উত্তাল জনআন্দোলন এবং আইনি আন্দোলন সেভাবে সংগঠিত হতে পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। শিক্ষা কেলেঙ্কারিতেও সাধারণ মানুষ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়েছে, চিটফান্ড কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও তেমনটাই সাধারণ মানুষদের ঘটেছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনকে মানুষের দরবারে এবং একই সঙ্গে আদালতের আঙিনায় টেনে এনে তদন্তের গতিমুখ বাড়াতে তদন্তকারী দলকে বাধ্য করা বিরোধীদের প্রথামাফিক আন্দোলনের ফলে সেভাবে সফল হয়নি।
মহ. সেলিম সিপিআই (এম) দলের পশ্চিমবঙ্গ আখার সম্পাদকের দায়িত্বভার নেওয়ার পর প্রথাতান্ত্রিকতার বাইরে এনে আন্দোলনকে যেভাবে জনআন্দোলনে পরিণত করেছেন, সেই আন্দোলনের চাপ শিক্ষা কেলেঙ্কারি ঘিরে মহামান্য আদালতের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটা বিশেষ রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত শিক্ষা কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে কলকাতা হাইকোর্ট যে ভূমিকা পালন করে চলেছেন, তা সাধারণ মানুষের মনে গভীর আশার সঞ্চার করেছে। চিটফান্ড ঘিরে মানুষের যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, এক ধরনের অনাস্থার পরিবেশের আঁচও ক্রমশ তৈরি হচ্ছিল রাজনৈতিক দল এবং আদালতের প্রতি। মানুষের হারিয়ে যেতে বসা আস্থা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে মহ. সেলিন এবং মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।
নিয়োগ ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের যে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, তার নজির স্বাধীন ভারতে অন্য কোনো রাজ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি ঘিরে অবিভক্ত বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব বা তামিলনাডুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই যে তৎপরতা দেখিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার দলের সতীর্থদের ক্ষেত্রে সিবিআইর সেই তৎপরতা অভাব পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে বহু প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। তবে সিবিআই, ইডি ইত্যাদির তদন্তের জাল যে ভাবে ধীরে ধীরে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বাড়ির দিকে, অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে, তা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যে সমস্ত যোগ্য প্রার্থীরা, অযোগ্য তৃণমূল ঘনিষ্ঠদের জন্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের মনে নতুন করে আশা সঞ্চার করছে।
পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির জেরে তার দলের প্রতি, এমনকি তার নিজের প্রতিও সাধারণ মানুষদের যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষোভের আগুনকে অন্যদিকে পরিচালিত করবার জন্যে মমতা ইতোমধ্যেই নানা কৌশল নিতে শুরু করেছেন। সেই কৌশলের একটা বড় দিক হলো ক্ষমতাসীন হওয়ার বারো বছর পর অতীতের বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কাল্পনিক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী মমতার বা তার বশংবদ দলীয় সতীর্থদের বামফ্রন্ট আমলের নিয়োগ ঘিরে অভিযোগের সত্যিই যদি কোনো সারবত্তা থাকতো, তাহলে কি মমতা বিগত বারো বছরে বামফ্রন্টকে বিশেষ করে সিপিআই (এম) ছেড়ে দিতেন? নিজের দিকে যখন সব সন্দেহের মূল তীরটা ঘন সন্নিবিষ্ট হতে শুরু করেছে, তখন মমতা অত্যন্ত কৌশলে বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে অসত্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ তুলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে অন্য খাতে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে সিপিআইসহ (এম) সমস্ত বিরোধীদের আন্দোলন, আদালতের ভূমিকা- এসব থেকে সাধারণ মানুষের মনে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, তার গতিমুখকে বদলে দেওয়ার জন্যে এক আতি নিকৃষ্ট কৌশল নিয়েছেন মমতা। কৌশলটি হলো এই- নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে ওঠা অভিযোগ মোকাবিলায় মমতা, চিটফান্ড দুর্নীতি ঘিরে দীর্ঘদিন জেল খাটা, খোদ মমতাই চিটফান্ড দুর্নীতির উৎস, এমন অভিযোগ করা কুনাল ঘোষ আর উৎপল দত্তের নাটকের বিস্তৃত অংশ নিজের নাটকে হুবহু টুকে দেওয়ার অভিযোগসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত, বিতর্কিত ব্রাত্য বসুকে দিয়ে নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে ওঠা অভিযোগের জবাব দেওয়ানো হচ্ছে। স্বভাবসুলভ কৌশলে, গোটা বিষয়টি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে কুনাল আর ব্রাত্য ক্রমাগত অরাজনৈতিক, ব্যক্তি আক্রমণাত্মক অভিযোগ তুলে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তরুণ প্রজন্মের একাংশের বামপন্থি নেতাকর্মীরা মমতার এই কৌশলী ফাঁদ কে না বুঝে, সেই ব্যক্তি আক্রমণের পাল্টা ব্যক্তি আক্রমণ করে চলেছেন। আর ফলশ্রুতিতে নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে ওঠা অভিযোগগুলোর মূল রাজনৈতিক আঙ্গিকটাই ক্রমে চাপা পড় যাচ্ছে। এটাই চাইছেন মমতা। বিরোধীদের একটা অংশ ছেলেমানুষি করে কেন মমতার পেতে রাখা এই ফাঁদে পা দেবেন?
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]