একুশ আমাদের চেতনার নাম

বিমল গুহ

http://thesangbad.net/images/2021/February/21Feb21/news/aaaaaa%20%281%29.jpg

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি- ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি দিন মাত্র নয়। সভ্যতার ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা এক অধ্যায়। একুশের আন্দোলনের প্রধান প্রেরণাই ছিলো এই ভূখন্ডের মানুষের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানান স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু অনেক দেশ স্ব-শাসনের অধিকার পেলেও প্রকৃত-মুক্তির স্বাদ তারা এখনো পায়নি। বাঙালিরা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের কবল থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিলো বটে, কিন্তু দেশীয় শোষকের যাঁতাকলে আবার যেন নূতন করে আবদ্ধ হয়ে পড়ে! এও অন্য ধরনের এক শোষণ। নতুন রাষ্ট্রের শাসককুল আত্মম্ভরিতায় এমনভাবে ডুবে ছিলো যে, তারা ন্যায্য-অন্যায্যের ফারাকও বুঝে উঠতে অক্ষম ছিলো। তারা জানতো- সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের দুই অঞ্চল- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব ছিলো হাজার মাইলেরও বেশি। তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষার দূরত্বও কম ছিলো না! কী দুর্ভাগ্য- এই সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির শাসককুল বুঝতেই চাইলো না, তাদের ন্যায় অন্য এক প্রদেশের জনগোষ্ঠী বাঙালিদেরও কিছু দাবি থাকতে পারে, অধিকার থাকতে পারে। শুধু কি তাই- এ দুই অঞ্চলের জনসংখ্যার দিক থেকেও পূর্ব পাকিস্তান ছিলো গরিষ্ঠ। তবুও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলাকে দারুণভাবে অগ্রাহ্য করা হলো। একটি নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কদেও এ কী অদূরদর্শী একনায়কতুল্য মনোভাব!

স্পষ্টতই পাকিস্তান নামক দেশটির পূর্ব ও পশ্চিম- এই দুই অংশের মাঝে সহসা দেখা দিয়েছিলো চেতনাগত বিভক্তি। এর শক্তিশালী অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসককুল একসময় শোষণের হাত বাড়িয়ে দেয় দুর্বল অংশের দিকে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের দিকে- বাঙালির দিকে। এভাবে ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে একাট্টা হতে তারা পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করেছিলো বাঙালিদের। বাঙালিরা মাতৃভাষার প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে নারাজ। এখানে ছিলো বাঙালির অস্তিত্বের প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও আমরা দেখি- ১৯৪৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে পাকিস্তানের সংবিধান সভার যে বৈঠক বসেছিলো, সেখানে মুসলিম লীগ নেতারা সবাই মত দিয়েছিলো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। সেই বৈঠকে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি তুলেছিলেন ‘পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক’। তাতে অদূরদর্শী মুসলিম লীগ সদস্যরা কর্ণপাত করেনি। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে পূর্ববাংলার সর্বত্র ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, এবং এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ গঠিত হয়- সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে (পৃ. ৯২) লিখেছেন- “সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম।” প্রতিবাদের এই যে বীজ রোপিত হয়েছিলো সেদিন- দিনে দিনে পুঞ্জীভূত হতে হতে নানা ত্যাগের মধ্য দিয়ে তা একদিন পূর্ণতা পায়, একসময় আসে বাঙালির স্বাধীনতা। সেই সংহতি ছিলো বাঙালির জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। বাঙালি জাতির সেই ঐক্যের ফল সম্মিলিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। এমন জাতীয় সংহতি ও জনগণের সম্মিলিত কণ্ঠের প্রতিবাদ অকল্পনীয় ছিলো পশ্চিমা শাসকদের কাছে। এই ‘জাতীয় সংহতি’ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিলো মানুষের অস্তিত্বের মূলে আঘাত এসেছিলো বলেই। তখন এই অঞ্চলের সকল মানুষের কণ্ঠ যেন এক কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়ে উঠেছিলো।

১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে, আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে বাঙালিরা ছিলো অনড়, অবিচল এবং দূরতম অরস্থানে! নিজের অস্তিত্বে যখনই কোনো আঘাত এসেছে, বাঙালিরা তখনই সচেতন হয়েছে- হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী। মাতৃভাষার প্রশ্নে বাঙালিদের সংহতি আরও দৃঢ়তর হয়েছিলো তখন। স্ব স্ব ধর্মে বিশ্বাসী থেকেও বাঙালি জাতি একসঙ্গে বসবাস করে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে কখনো কখনো শান্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেও- বাঙালি জাতি ভ্রাতৃত্ববোধে সবসময় ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। আমাদের বড় পরিচয় আমরা বাঙালি- আমাদের ভাষা বাংলা। আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্যচিন্তা ও বোধ- এক। বাঙালি হিসেবে অহংকার করার মতো আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আজ আমাদের গর্বিত পরিচয়- মাতৃভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। আমরা একুশের উত্তরাধিকার। এটাও বলা দরকার যে, ধর্মীয় বোধের দিক থেকে এ-অঞ্চলের মানুষ ধর্মপ্রাণ। নিজ নিজ ধর্ম পালন করেও সহাবস্থানে থেকে বাঙালি বিশ্বে এক শান্তিকামী জাতি। আজকের দিনে কোনো কোনো সুবিধাবাদী মহল এই বোধে ফাটল ধরাবার সুযোগ নিতে চাইলেও তা সম্ভব হয় না। কারণ- ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আমাদের সমন্বিত অহংকারের বহু বিষয় রয়েছে- শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- এসবই আমাদের অহংকারের বিষয়।

http://thesangbad.net/images/2021/February/21Feb21/news/up-2%20%281%29.jpg

একুশে ফেব্রুয়ারির যে-আন্দোলন তা দৃশ্যত ভাষার আন্দোলন হলেও- তা ছিলো বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির আন্দোলন। আর এটিই ছিলো আমাদের জাতীয় ইতিহাসে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই আন্দোলন যখন দানা বেঁধে ওঠে, তখন সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদ-ই-আজম এসেছিলেন ঢাকায়। তিনি ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছিলেন- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সাথে সাথে নির্ভীক যুবকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলো ‘না’-‘না’ ধ্বনি। তা ছিলো বাঙালির সম্মিলিত আওয়াজ। এর মধ্য দিয়ে দৃঢ় হয়েছিলো বাঙালির জাতীয় সংহতি। ভাষার দাবি একসময় রূপ নেয় বাঙালির মরণপণ সংগ্রামে। সেদিন প্রত্যেক বাঙালির কাছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ছিলো বীজমন্ত্র স্বরূপ। দেশের সাধারণ মানুষও বুঝে গিয়েছিলো- পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়, সকল ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে চায়! বাঙালিদের কাছে ‘মা’ ও মায়ের মুখের ভাষা ‘বাংলা’- দুইই সমান পবিত্র।

বাংলা ভাষা ও বাঙালি সত্তা পূর্ব বাংলার সমগ্র বাঙালির কাছে অভিন্ন এক চেতনা। সময়ের আবর্তে খাজা নাজিমউদ্দিনও একসময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। আর নুরুল আমিন তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৫২-এর ২৬ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সফরে। ক্ষমতালোভী নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে পুনরায় ব্যক্ত করলেন- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এই বক্তব্যে পূর্ববাংলার জনগণের মনের অসন্তোষ আরো সংহত হলো, প্রদেশ জুড়ে শুরু হলো প্রতিবাদ। অথচ এই খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সাথে ভাষার দাবির শর্ত মেনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ক্ষমতার এমনই মোহ- প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি ভুলে গেলেন সেই প্রতিশ্রুতি, বিশ্বাসঘাতকতা করলেন বাঙালিদের সাথে, বাংলা ভাষার সাথে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তখন আরো বেগবান হয়ে উঠেছিলো।

বাংলার ছাত্রজনতা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি হাতে নেয়। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৫২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালিত হয় ছাত্রধর্মঘট। বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনটি ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন বসার দিন। আর সেই ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনেই সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তে ছাত্রজনতা ছিলো ঐক্যবদ্ধ, যেন জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত সেদিনের সেই তারুণ্য দেশের ভবিষ্যৎ আলোকবর্তিকা হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠেছিলো। আর সেই হরতাল বানচাল করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে জারি করে ১৪৪-ধারা। এই ঘটনা সকলকে স্তম্ভিত করে দিলেও ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গতিকে শ্লথ করতে পারেনি। সমগ্র জাতির প্রত্যাশাদীপ্ত এই প্রতিবাদ যেন আরো বেগবান হয়ে বাঙালিকে ধাবিত করলো মরণপণ সংগ্রামের দিকে।

সেদিন ১৪৪-ধারা জারি করেও প্রতিবাদী ও সংঘবদ্ধ জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি পাকিস্তান সরকার। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই দিনে সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রজনতা এসে সমবেত হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ছাত্রসভা। সেই সভায় মাতৃভাষার মুক্তির লক্ষ্যে দীপ্ত তারুণ্য ১৪৪-ধারা ভেঙে ভাষার দাবিকে নিয়ে এগিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সভাশেষে ছাত্রজনতা প্রতি দশজনের এক-একটি দল স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নামে এবং গ্রেফতার বরণ করতে থাকে। বেলা গড়িয়ে গেলে- এক পর্যায়ে বিকেলের দিকে পুলিশ ও ছাত্রজনতার সংঘাত বাধে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে ছাত্রদের উপর। ঘটনাস্থলেই মারা যায়- রফিক উদ্দিন ও আবদুল জব্বার, আর আহত হয় অনেকেই। আহতদের মধ্যে আবুল বরকত শহীদ হন হাসপাতালে। এই হলো ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি- আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক মহান দিন। আজ যা মর্যাদার সাথে সারা পৃথিবীতে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। ‘একুশ’ প্রসঙ্গে আমার একটা পদ্যে লিখেছিলাম- ‘মায়ের ভাষা বলতে গিয়ে হঠাৎ কাঁপে বুক/ আকাশ থেকে শকুন দেখি ঝাপটে ধরে মুখ।/ শকুন তাড়াও- উঠলো দাবি ঝরলো তাজা প্রাণ/ এই তো একুশ কাকডাকা ভোর প্রভাতফেরির গান।’ এই একুশ- আমাদের সম্মানের স্মারক, আমাদের গৌরবগাথা। এই একুশের হাত ধরে আমরা পেয়েছি আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়। একুশের চেতনা- মাতৃভাষার প্রতি পরম মমত্ববোধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আত্মপরিচয়ের তাগিদ থেকে উৎসারিত এক বোধ। আমার প্রত্যাশা- একুশের এই চেতনাই হোক আমাদের জাতীয় সংহতি ও ভবিষ্যত সকল কর্মকান্ডের অনুপ্রেরণা।

সম্প্রতি