প্রচ্ছদ : সমর মজুমদার
জলপাইচিহ্ন
আবদুর রাজ্জাক
কুসুমেরা হাততালি দিয়েছিলো, কুসুমেরা স্বাগত জানিয়েছিলো,
কুসুমেরা বুঝতেও পারেনি কেনো সেই হিংস্র পশু
তিন হাজারমাইল দূরের আড়ালে ছিলো?
সে কখনই ধরা দেয় না যে-অস্ত্র পাহারায় থাকে, অস্ত্র লুকিয়ে রাখে।
আর আমাদের প্রিয় সন্তানদের হত্যা করে।
পাপ তখনও ছিলো, এখনও পাপ-পঙ্কলিতার রাজত্ব রয়েছে,
তারা বুঝতেও দেয়নি, কী চাওয়া ছিলো তাদের? জমিন?
আমাদের এক টুকরো কলিজা! প্রিয় বাসভূমি।
বৃষ্টি নেমেছে, শীলা বৃষ্টি, ঝড় প্রপাতে আমরা কুঁকড়ে গিয়েছি,
আশাহত হইনি, মাইলের পর মাইল হেঁটে আশ্রয় খুঁজেছি,
সেইসব দুঃসহ দিনের কোনো তুলনা হয় কি,
জীবনকে রূপায়িত করার যাত্রা হয়তো স্থবির হয়েছে,
কোথাও আগুনে জ¦লেছে, কোথাও সবুজ জীবন দগ্ধ হয়েছে।
তারা বাদ্য বাজিয়ে হাততালি দিয়ে নেচে গেয়ে আমাদের খুন করেছে,
আমাদের জন্মভূমি দখল করেছে, তাদের গোলা-বারুদের আঘাতে
বিদ্ধ হয়েছি, লুটিয়ে পড়েছি, আমাদের লাশ শেয়ালে-কুকুরে খেয়েছে,
পচে গলিত হয়েছে। খেতে খেতে না খেয়ে শেয়াল পালিয়ে গেছে।
আমাদের প্রতিজ্ঞা অশ্রু পেয়েছে, চাঁদ পাথরের ঢেউ প্রভূত আদর দিয়ে
কোলে তুলে নিয়েছে।
একটি অদৃশ্য নদী পাড়ে বসে আছি স্তব্ধ একজন, অপমানিত একজন।
ভেবে কূল পাই না অরণিবৃক্ষের বিষণœ দৃশ্য কেনো সেইসব জীবনকে
তুচ্ছ করেছে, হায়! অদৃশ্য করেছে।
তোমাকে দেখিনি তাই
মনজুরুর রহমান
পহেলা বৈশাখে এবার তোমাকে দেখিনি কোথাও-
না বটমূলে না রমনায় না চিরবসন্তের দেশ-
ভার্সিটি পাড়ায়!
বন্দরের সার্চলাইটের মতো আমার সন্ধানী চোখ
কেবল খুঁজেছে তোমাকে
সাইবেরীয় শীতের পাখি যেমন-
লক্ষ লক্ষ মাইল উড়ে আসে তার
নিশ্চিত সেঞ্চুরিয়ামে।
শুভ সকালের মাঙ্গলিক ধ্বনি তুমি শোননি
রবীন্দ্রনাথের কল্যাণী সুর-বৈশাখী কবিতা
প্রথম প্রভাতের সূর্যোদয় থেকে তুমি নির্বাসিত আজ।
কী অমন দায় তুমি আটকে আছ ঘরে?
কিংবা কোন আতঙ্কিত বৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাসে
পেয়ে গেছ মনে?
তোমাকে খুঁজেছি শুভ্র সকালে গোধূলি-সন্ধ্যায়
তোমাকে দেখিনি তাই শহর দেখেছি ফাঁকা-
জনহীন কোলাহলে!
আকাশ
নির্মলেন্দু গুণ
আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়,
আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার
আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ
যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়,
তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে
স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়
একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ... “আকাশ”।
আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি।
জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু
এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে।
জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে?
আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি
উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে
আর কোনো কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না।
যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো
আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল
এই যন্ত্রণাক্ত আকাশ শব্দটি।
তোমার আমার মাঝে আছে এরকম
বক্ষফাটা অনেক আকাশ। আমি
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে
কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে।
মানুষ প্রতিদিন ঘোলা হয়ে যাচ্ছে
জাহিদ হায়দার
মানুষ নামছে চিত্রা নদীতে,
দাঁড়াচ্ছে পাহাড় থেকে পতনে আনন্দিত ঝরনার নিচে,
সময়ের ব্যবহৃত হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে শূন্যতাভেজা বৃষ্টিতে।
জলেরা পালন করছে নিয়মী কর্তব্য নিরন্তর।
‘তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন?’
‘তোমাকেও দেখাচ্ছে তোমার মতন নয়।’
আরশি ঘুরে ঘুরে কেবল দেখছে তোমাকে।
‘প্রতিবিম্বে ভেসে যাচ্ছো কোথায়?’
দৃষ্টিতে আবর্জনার ¯ূÍপ।
স্পর্শস্বর কালো ধোঁয়ায় আকীর্ণ।
রৌদ্র দিয়ে নিজেকে কাচতে কাচতে হয়ে যাচ্ছো রাত্রি।
যাপনের সূচিপত্র উধাও।
ঘরে বাইরে অরক্ষিত ছায়া।
সীমিত হতে হতে তৃণের সামাজিক।
এতো ঘোলা ছিলে বুঝিনি কখনো।
ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্যে এলিজি
দিলারা হাফিজ
বৃক্ষেরা বাকল ফুঁড়ে
অস্থির বেরিয়ে পড়ছে দলে দলে,
তারা সব যুদ্ধে যাবে,
ফিলিস্তিনি শিশুদের বাঁচাতে,
সময় ছেঁদন করছে রাতের
কাঠঠোকড়া পাখি
কখন ভোর হবে- যুদ্ধে যাবে-
নদী ও জ্যোৎস্নার-তরুবীথি- সৈন্য-সামন্ত যত
বন্য ঘোড়া- সুন্দর বনের হিংস্র-চোখের বাঘ
যুদ্ধে যাবে তারাও
চিত্রল হরিণেরা সভা করছে গোলপাতার ছায়ায়
ভাবছে, তাদেরও কি যাওয়া একান্ত জরুরি?
শিশুদের কোমল বুকে এই রক্ত-বৃষ্টির নৃশংসতা
এই শক্তিশেল নিক্ষেপের গর্জন সত্যি অসহ্য প্রাণ।
যুদ্ধের বল্কল পরে পুরো মানব প্রজাতি
খুঁজে ফেরে তার যুদ্ধংদেহি মনের দুর্বার শেকড়
কোথায় পালালো শেকড়?
লাভে, লোভে ও মাৎসর্যে?
কিংবা ন্যায় নীতির ব্রেকাপে এই উল্লম্ফন?
এই গ্লোবাল ভিলেজে কিছুই পারম্পর্যহীন নয়
ভেদ-বুদ্ধির এই প্রযুক্তি সংসারে-
না সমাজ, না রাষ্ট্র, না ধর্ম, না বর্ম...
তাহলে কে কে যাবে এই ন্যায় যুদ্ধে-
ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার না ওয়াটসঅ্যাপ?
কে হবে আগামীর সমর নেতা?
আত্মস্বর
গোলাম কিবরিয়া পিনু
বৈশাখের রোদ আর তাপ,
ঝাঁপ খুলে দেয় বদ্ধ ঘরের-
তখন অন্ধকার-অমানিশা থাকে না!
রাখে না হৃদয়ে কালি ও কালিমা
বিকিরণ আরও দ্যুতিশীল হয়ে ওঠে,
উদ্দীপন জাগিয়ে তোলে!
কালচিটে দাগ মুছে দিতে
কালবোশেখি আসে,
কালাকানুন থাকে না কালক্রমে,
ভ্রমে ভ্রমর যে ফুলে গিয়ে বসে
সেও ঝড়ো-ঝাপটায়,
আত্মস্বর ফিরে পেয়ে
তার স্বর-ব্যঞ্জনবর্ণ উদ্ধার করে!
আমরাও নববর্ষ ও ষড়ঋতু নিয়ে
নদীর নাব্যতা নিয়ে জেগে উঠি,
আমাদের ধরণীতলে
অঙ্কুর মহীরুহ হয়ে ছায়া দেয়,
সেই ছায়ায় আমরা বেড়ে উঠি!
বৈশাখে আমরা এক ও অভিন্ন হয়ে
প্রকৃতির ভেতর প্রকৃতি হয়ে,
নবীভূত হই!
মিলের অমিল
খালেদ হামিদী
“কোথাও এমন দেশ পাবে নাকো তুমি
কিশোরী ধর্ষণে পটু শ্বশুর ও স্বামী!
আমার বোনের তারা কাটে ছোট্ট অঙ্গ
দেবরও শিউরে তোলে হতভাগা বঙ্গ।”
এমন উক্তির কেউ দেখে, এক মেয়ে
প্রতিবাদে ফেটে কহে: “পোশাকের চেয়ে
শিশুতে আপত্তি, লক্ষ্য হত্যা, বলাৎকার।
এর চাইতে জ্যান্ত গোর দেওয়া চমৎকার!
জাহিলেরা অপমান করেনি অন্তত,
কন্যাজন্ম মাটি চেপে ভুলেছে সতত।”
এ-কথায় কারও চিত্ত আরও উঠলে কেঁপে
ওদিকে আকাশ থেকে মৃত্যু নামে ঝেঁপে।
গাজায় বাচ্চারা ছোটে মা-বাবার খোঁজে।
ভয়ার্ত তাদের শোনে কারা চোখ বুজে!
শুকায় চোখের পানি, রক্ত শুধু ঝরে;
আসিয়া কি এসে বলে বারবার মরে:
“উঠানে সারমেয় ছানা আদরের, তাই
দুশমনকে কুত্তার বাচ্চা ডাকতে পারি নাই।”
যেহেতু নিষাদ
(পৃথিবীজুড়ে সকল যুদ্ধের অবসান চাই)
মিহির মুসাকী
যেহেতু নিষাদ
শিকার তো করতেই হবে;
কিন্তু আজকাল আর অরণ্য নেই,
যেহেতু অরণ্য নেই, তাই পাখিও নেই।
তীর হাতে অরণ্যের খোঁজে তাই
পথ থেকে পথে, দেশ থেকে দেশে
ছুটে বেড়াচ্ছি;
পাখি শিকারের বিদ্যা ভুলতে বসেছি;
এ-কারণে নিজের মধ্যে এক অরণ্যের বিস্তার দেখে
মনে খুব আশা জাগে,
হয়তো তাহলে পাখিও আছে;
আমার অরণ্যস্বভাবী মন
তাকে পোষ মানিয়েছে;
যেহেতু নিষাদ
শিকার তাহলে করেই ফেলি-
এই তীর নিজের দিকেই তাক-
পাখির রক্তে পৃথিবী ভেসে যাক!
আমন্ত্রণ
মঈনউদ্দিন মুনশী
গাছের মতো মাথায় পল্লব জড়োয়া
হাত পা দোলাচ্ছি শাখাপ্রশাখায় বাতাস ভরা
তোমাকে দেব চৈত্রের প্রশান্তি
চোখে এঁকে নিই মেঘের মায়া
রোদ কুড়িয়ে তুলে ধরলে সোনালি আলো
আকাশ ঝরিয়ে দেয় নীল
বুকে জেগে ওঠে মালঞ্চ
ওঠো, পান করো পুষ্প ঘ্রাণ
চোখে নাও পুরোটা বাগান।
হালখাতা
মুজিব ইরম
পরে এসো জামদানি শাড়ি হালখাতা দিনে। দিও কলাপাতা রঙ হাসি। সাজিও দোকান। আম জাম নিম পাতা লালনীল রঙ্গিন কাগজে। যেন ঝলমল করে ইরম বিপণি বিতানের মুখ তোমার ছোঁয়ায়। মনে সাধ ছাপাবো দাওয়াত পত্র তোমার ছবিতে। আর কেউ না আসুক। আসিও দয়ায়। দিনের শুরুতে। লিখিবোতোমার নাম নতুন খাতায়। আগামী বছর যেন লেনদেন ঠিকঠাক হয়। সকলি বাকিতে। তোমার নামের গুণে বিপণি বিতানে।
এই বার বড়ো সাধ খুলিবো নতুন শাখা তোমার নামেতে। যদি অনুমতি পাই। যদি তুমি বানাও শরিক। ফতুর করিবো। আজ বাকি কালকে নগদ- লিখিয়া রাখিবো। দিবারাত্র অধমেরে মনেতে রাখিও। আদরে সোহাগে তুমি দোকানি ডাকিও।
নববর্ষ
হাইকেল হাশমী
বছর নতুন করে শুরু হয় না-
বছর তো গাছের মতো
তার পুরাতন পাতাগুলো ঝেড়ে ফেলে
নতুন সবুজ পাতা গায়ে দিয়ে
প্রত্যেক নববর্ষে উপস্থিত হয়।
বছর তো একটি পুরাণ
আমাদের তাড়া করে এগিয়ে যেতে
যেন আমাদের বিলম্ব হলে
কোনো কাজ শুরু হবে না।
নববর্ষ কোনোপ্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে না
বরং আসে আয়না নিয়ে
তাতে আমরা দেখতে পাই
আমাদের বিগত দিনের প্রতিচ্ছবি।
আমরা এই মুহূর্তকে নাম দিয়েছি “নতুন”
কিন্তু এই মুহূর্ত অতিপ্রাচীন
নক্ষত্রের ধীরগতিতে তার জন্ম
এটা অতীতের মতো চিরন্তন।
তবুও, সময়ের মাঝে
একটি দরজা খুলে যায়
ভবিষ্যতের দিকে
যেন আমরা বেরিয়ে পড়ি
নতুন আশা আকাক্সক্ষার সন্ধানে।
এই নববর্ষের পিছনে ছুটতে ছুটতে
ধাপে ধাপে,
তার পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে
আমরা হারিয়ে যাই নিজের অজান্তে
অনন্তকালের মাঝে।
আহা জীবন
খোরশেদ বাহার
পতাকাটি দুলছিল
শকুনটি উড়ছিল
বৃদ্ধটি ভাবছিল
যুবকটি নেচে ছিল
শিশুটি কাঁদছিল
সময় দৌড়াচ্ছিল
কথাগুলো থেমে ছিল
সাইরেন বেজে ছিল
রাজমহল সেজে ছিল
মানুষগুলো লুকিয়েছিল
শিক্ষক ঘুমিয়ে ছিল
সাংবাদিক লিখোছিল
পেশাজীবী পিষে ছিল
আমলারা আঁকছিল
জীবন স্তব্ধ ছিল
আহা জীবন।
স্বপ্নের দাঁত ও নখ
হাসানাত লোকমান
শিশুটি, যার চোখে আমরা
নীলপরি দেখেছিলাম একদিন,
সে এখন দাঁতের কোণে
হিং¯্রতা ধার দেয়।
আমরা যাকে দিয়েছিলাম
পেনসিলে আঁকা রঙিন ঘর,
সে তাতে আগুন লাগাতে শিখেছে।
আমরা জানতাম না
শীতল কুয়াশার ভেতর
আমাদের রোদগুলো হারিয়ে গেছে,
জানতাম না কলমের কালো কালি
কবে নীল ছাপার অনুমোদন হয়ে গেছে।
আমরা বুঝিনি-
ফাইলের ভাঁজে ভাঁজে
আসলে আমাদের শিরদাঁড়া রেখে এসেছি।
আমরা ‘আব্বা’ থেকে ‘ড্যাডি’ হয়ে
যেদিন উচ্চারণ ভুললাম,
সেদিনই ইতিহাসের খাতা
ছিঁড়ে ফেলেছিলো আমাদের ভবিষ্যৎ।
কেউ বোঝেনি,
আমাদের ঘরে পুষে রাখা স্বপ্নটি
আসলে এক ঘুমন্ত বাঘ।
রাতভর বৃষ্টি
মাসুদার রহমান
রাতভর বৃষ্টি ও ঝড়
তুমি গেছ ঘুমাতে একাকী,
তোমার শিয়রে বসে বসে
আমি এই কবিতাটি লিখি।
কবিতা বা কবিতার মতো
নগণ্য-প্রলাপই তা হোক,
তোমার চোখের পাতা জুড়ে
লেখে এটা এক কবি লোক।
কবি মানে নষ্টের শেষ
তাকে রাখো মন থেকে দূরে,
সে ভিজুক ঝুম বৃষ্টিতে
সে পুড়ুক রোদে-রোদ্দুরে।
শিয়রে নদীকে রেখে ঘুম
তুমি দূর রাজকীয়-শাহী,
কবি সে তো দোয়েল চড়–ই
কিংবা শালিক খড়বাহী।
খড়বাহী পাখি নয় কবি-
ঠোঁটে খড় বাঁধে কই বাসা!
তোমার দু’চোখে রাখে সেই
ঝড়ের রাতে ভালোবাসা।
আমার বৈশাখ
মতিন রায়হান
আমি তো গাজার এক এতিম সন্তান!
তা না হলে কেন সকল স্বপ্ন ডুবে যায়
ভূমধ্যসাগরে?
গুমরে গুমরে কাঁদে আমার বৈশাখ
রঙিন জামাটা মুহূর্তেই হয়ে ওঠে
রক্তাক্ত পিরান
আমি ধ্বস্তপ্রায় গাজা, অসহায় ফিলিস্তিন
পতাকাশোভিত কফিনই আমার নিয়তি
আমাকে কবর দাও, গণকবরই আমার ঠিকানা!
হে বাংলাদেশ, তোমার বৈশাখ কত রঙিন!
এই বৈশাখে
মুশাররাত
যদি তোমাকে ভেবে কাঁদার মতো কেউ না থাকে
তোমার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে কেউ না বাঁচে
তাহলে আর মৃত্যুকে রেখো না আকাক্সক্ষায়
এই বৈশাখে, রাগান্বিত প্রেমিকার মতো তপ্ত রোদে
পীচ ঢালা রাজপথে হেঁটে জীবনকে ভোগের আয়োজনে ব্যস্ত থাকো
অনাদরে বেড়ে ওঠা কচুর পাতায় দুপুর রোদের ঝিলিক
যে আল্পনা আঁকে তার দিকে চেয়ে বলো, হে ক্ষণকাল
ভালোবাসি এই পৃথিবীর পথে
ফুলের মতো হেসে-ওঠা সুখে রৌদ্রদগ্ধ প্রতি বোশেখের
আদরে ভরা প্রথম সকাল।
আমি বৈশাখী
যাকিয়া সুমি সেতু
আমি বৈশাখী, আত্মার দাহকাল, সময়ের রূপান্তরের বিশুদ্ধ চিহ্ন
আমারই রোদের নোলকে কথা বলে প্রেম, বেদনা, রুদ্রতা, সংগ্রাম
আমিই মহাবিদ্রোহের সিঁদুর, রূপের কুসুম, রূপান্তরের অঙ্গিকার
আমারই প্রতাপ মানবিক আকাক্সক্ষার সংঘর্ষে জন্ম গভীরতম শিল্প
আমি বৃষ্টির মতো এসেছি, আমার খরতাপের আগুনে পোড়ে মাটি
জানতো আমার ঘাম, ধুলো, ঝড় পূর্বপুরুষের কৃষপঞ্জির সাথে অন্তর্লীন
আমি কোথাও অনুগত নই, নবজন্মের শর্তে চিরকাল অনিবার্য
আমারই অনিবার্যতায় বাঙালির সাংস্কৃতিক রূপবোধ, সহিষ্ণুতার মনস্তত্ত্ব
শিল্পের স্নানঘাট তাই আন্দোলিত রবীন্দ্র, নজরুল,সুকান্ত, জীবনানন্দে
আমারই জন্য পারস্য, ইরান থেকে আকবর গড়েছিল মনীষার আলোঘর
শশাঙ্ক সাজিয়েছিলেন সোনালি মুক্তো ভরা আলোর শিল্পরথ
আমি বয়ে চলি পদ্মা, গঙ্গা, যমুনা, পুনর্ভবা, কোশি, চন্দনা-বারাশিয়া
পান্তাভাত ইলিশ, পাটশাক, কাঁচাধান গন্ধে আমি বাঙালির বিপ্লব
আমি বৈশাখী, নবজন্ম ঋতুঘরে প্রতিদিন কৃতজ্ঞতার সূর্যলোক
শ্রমজীবী মানুষের নির্ভীক আকাক্সক্ষা থেকে সৃষ্টি করি নতুন চেতনা...
নির্ভেজাল স্বাধীনতা
আব্দুল্লাহ জামিল
স্বাধীন হবার তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে
প্রতিক্ষণ চিৎকার করে করে যারা
গলা বসিয়েছে তারা তো স্বাধীনতার
প্রকৃত মানেটা জানে না সঠিকভাবে
অথচ তাঁদের নিয়ে আমরা গর্বিত।
আকাশের এক কোণে একলা যে মেঘ
ওড়াউড়ি করছে সে তো বৃষ্টি দেয় না
সে কেবল আকাশের একাকিত্বে সঙ্গী
নির্ভেজাল স্বাধীনতা এমনি কি পাবে
তেলে-জলে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে?
ব্রিজ
শারদুল সজল
একটা ব্রিজ
একশ নদীর সমান হয়ে এগিয়ে গেলো
একলক্ষ মানুষের দিকে
একলক্ষ মানুষ এগিয়ে গেলো ভোর উদিত সূর্যের দিকে
সূর্য এগিয়ে গেলো
রাতভোর পায়ের দিকে,
পা এগিয়ে গেলো পথে পথে- মানুষের সুবর্ণধূলি
সূর্যরেণুতে;
পথ আর কতদূর নিয়ে যাবে- মানুষ যদি না হাঁটে
এই পথ রোদ্দুর হিমালয় পাথর ভেঙে,
সূর্য মিশে গেল অন্য অন্য গোলার্ধে
অন্য এক ব্রিজে-
একশ নদীর সমান হয়ে
একলক্ষ্য মানুষ এগিয়ে গেলো নতুন এক সভ্যতার দিকে
সভ্যতা এগিয়ে গেলো ম্যাকখচিত মহাকালের দিকে
মহাকাল এগিয়ে গেলো
মহাশূন্যে,
মহাশূন্য মিশে গেলো মানুষের অসীমে...
চৈত্রের ফ্লোরিন
সঞ্জয় দেওয়ান
আকাশে নিকষ আঁধার
মৃত মানুষের শোকে নিশ্চল পৃথিবী।
গাজা পুড়ছে এখানে
রাফাহ জ্বলছে সেখানে
নিথর মানুষ পতঙ্গের মতন উড়ে বাতাসে
নিদ্রামগ্ন পৃথিবীর মূঢ় মানুষ এখনও ঘুমায় নিশ্চিন্তে!
নবজাতকের কান্নায় কাঁপে শুষ্ক মাটির বুক
পাষাণের চোখে অশ্রু জমে
বিবেকের মুখোশ উড়ে গেছে চৈত্রের ফ্লোরিনে!
মুয়াজ্জিনের করুণ সুরে ফুলের রেণু ঝরে
বোমার আঘাতে ভাঙে পাথরের সংসার
শূন্যে উড়ে নিষ্পাপ শিশুর মাথার খুলি
নারীর আর্তনাদে মহাশ্মশান মর্ত্যভূমি।
লক্ষ্মীকোল
স্বপন আদিত্য
হারিয়েছি শঙ্খধ্বনিময় সন্ধ্যা
মেঘকণা বিচ্ছুরিত ভুবন মোহিনী আলো
স্তব্ধ জলধির পাশে- হয়তো আমাদের
আর কিছু বলার নেই পরস্পর
কেবল নিভৃতে কামিনীর শাখা
থেকে হাওয়া উড়ে গেলে অন্ধকারের দিকে
বটের শরীর থেকে, অন্ধকারের
তলানীতে পড়ে থাকা
মৃত্তিকা থেকে- এতো বেশি উঠে আসে
শৈশবের ঘ্রাণ।
বৈশাখে নবসঞ্চার
তাহিতি ফারজানা
উৎসবের নতুন মোড় আনো বৈশাখ।
কাটাছেঁড়া মুখ, খাঁচাবন্দী মানুষ
পাতার বাঁশিতে ঠোঁট-
ঘষে ঘষে মুছে ফেলুক জীর্ণতা।
ছিন্নবস্ত্র যে উন্মাদ পথে ঘুমাচ্ছে বেঘোর,
মনোযোগ চাপা আছে ভগ্ন স্থাপত্যের নিচে,
তারও কিছু এসে যাক শাড়ির পাড়, চুরির ঝংকারে।
শত্রুর দরজা ভেঙে
অসহ্য বিস্ফোরণে বেরিয়ে আসুক হৃদয়।
সেখানে লিখবো নিরিবিলি দু’লাইন পদ্য,
চুম্বনের কালিতে- মধুর প্রতিশোধ।
মানবিক খরা মুছে প্রত্যয় আনো বৈশাখ
দাও ঝড়ো হাওয়া, ফসলের গান-
তৃষ্ণার অতলান্ত জল।
পহেলা বৈশাখ
ডালিয়া চৌধুরী
আজ পহেলা বৈশাখ বাংলার বর্ষবরণ
উৎসবে মুখরিত প্রকৃতির কু-লীতে
নৃত্যরত তরুণীর নূপুরের শব্দে নবস্বর,
বেজে ওঠে পুবানো মরমর ধ্বনির ভেতরে।
উদ্ভাসিত আকাশ হঠাৎ আজ কোন সাজ!
একটু দুঃখ ভারাক্রান্ত অবয়বে হয়ত
ক্ষাণিক বিরক্ত হালখাতার গরমিলে।
মিছিলের শোভাযাত্রায় ছিটানো লাল সাদায়
উচ্ছল তারুণ?্য প্রাণবন্ত গীতে মুখরিত।
কোন অদৃশ্য সুস্থ হাতের স্পর্শের পরশ
লেগে আছে সমস্ত শহরে, আজ কেবল
বিনোদন একটু নৃত্য, একটু গীতের আবেশ
ছন্দের আবৃত্তিতে নতুনকে আহ্বান।
পানলাল মুখে হাস্যোচ্ছল দোকানী
হালখাতা ধরে আছে সজ্জিত দোকানে।
পুনানো খাতার বিদায়ে মিষ্টিমুখো সবাই
নতুন খাতা লাল ফিতায় বাঁধানো
নতুন হিসেব শুরু নব উদ্যমের ঝলকে।
পুরানো জরাজীর্ণ ঘূর্ণির বলয়ে হারিয়ে যাচ্ছে,
ঝড়ের তীব্র ছোবলে জড়তা হারাচ্ছে
নতুনকে ডেকে যাচ্ছে “অহে জাগো”
নিসর্গের শো শো শব্দে অবিরত এই ডাক
বুঝে নিচ্ছে প্রকৃতির প্রাণি, নব আলোকে
উছলানো সম্ভারিত কার্যালয়ে জেগে উঠছে।
ধ্বংসিত জীবনের ক্রন্দন
তুহীন বিশ্বাস
সুদ-আসলের কর্মযজ্ঞ, জটিল অংক
ক্ষমার অযোগ্য শাস্তির পাল্লা অস্বস্তিকর,
দংশিত অস্তিত্বে ধ্বংসিত জীবনের ক্রন্দন
অতঃপর আমার আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।
কিছু ভুল গোনে মাশুল এলোমেলো কাব্যে
পিছনের দরজায় ঠকঠক করে পিছুটান,
কিংকর্তব্যবিমূঢ় বর্তমানে অমাবস্যার ছোঁয়া
সদরের পাহারাদার অদ্ভুত কিম্ভূতকিমাকার।
সম্পর্কগুলো দূরে সরে যায়, বড্ড স্বার্থপর;
হন্তদন্ত হয়ে অন্ধকারে খুঁজি উপসংহার
অবশেষে...
উত্তরসূরির মেঝেতে আঁকি পরিণতির চিত্র।
ঝরা পাতার দিন
মেহনাজ মুস্তারিন
দিনে দিনে পালটে যাচ্ছে পথ ঘাট মাটি
আমি তুমি আমরা
আমাদের শেষ নির্যাসটুকু
কমে আসছে কথা কমে আসছে দেখা
যেমনটা
পদ্মা, যমুনা, ভৈরবের নতুন পথের আনাগোনায়
পালটে যায় শরীর
জলগুলো দখল নেয় তোমার
আমার চোখে
কোথাও আবার উপচে জলোচ্ছ্বাস
কোথাও চৌচির শুকনো রুটির মতো
যেন কতদিন তৃষ্ণার্ত পথিক ছোঁয়নি উষ্ণ ঠোঁট
যেভাবে ভাঙা ব্রিজ জলকল্লোলের অপেক্ষায় থমকে থাকে!
তারপরঃ একদিন
মুখোমুখি দেখা হবে অথবা শুকনো হৃদয় ঘেঁটে
মনে হবে অবেলায় হেঁটেছি কতো যে!
কোমরের বাঁকে বাঁকে খুঁজেছি অভিলাষ যতো!
তারপর : আবারও একদিন
ঝরাপাতা ধীর পায়ে জেগে উঠবে
আর আমি দাঁড়ি টানা শেষে
ভুলে যাব সবকিছু অথবা ভুলে যেতে দেব
সে কথাই বলবো বলে এসেছি আজ
চুপ কথার রূপকথা
মিলি রায়
নীলের ঘোর নেমেছে, মগ্ন দ্রবীভূত ঘোর
মৃতের উপর বসে জাগছে আঁধার
নরক সা¤্রাজ্যে অসন্তোষের আঁচ
আগুনে স্নাত বীভৎস মূর্তি বেরিয়ে আসছে
একটু একটু করে
মুছে দিচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক পায়ের ছাপ
জোনাকি নয়, জ্বলজ্বল করছে
মৃত্যুর অতল থেকে উঠে আসা আত্মাদের ক্ষুদিত চোখ
ভয়ে মুখ ঢেকেছে ভরা পূর্ণিমা
মাত্রা হীন দুর্বোধ্য কোমল শব্দরা
কুয়াশা বিভ্রমে অলীক লণ্ঠন হাতে
নিরাভরণ হেমন্ত থেমে আছে দিগন্তের ওপারে
দিগন্ত ! সে তো চোরাবালি
দেখা ও দেখানোর ভুল
কখনো কি তাদের হবে দেখা?
চিনে নেবে একে অন্যকে, নির্ভুল?
আসুরিকতা যেখানে স্পর্শ করে
তার বিকৃতি না ঘটিয়ে ছাড়ে?
ধর্ষিতার অগ্নিমালা
মনিকা মারইয়াম
অনন্ত ক্রোশ পার হয়ে ক্লান্ত ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে
উড়াল দিয়েছে যারা- জাদুকরী শূন্যতার শ্মশানে
তাদের ঝলসে যাওয়া নির্মোহ স্বপ্নের পালক থেকে
খসে পড়া উজ্জ্বল অপ্রতিরোধ্য রক্তবিন্দু জানে-
নক্ষত্র ভরা আকাশে ভোঁতা ব্লেডের দাগ কতোটা রুক্ষ
কতোটা অসহায় সেই গুমোট চিৎকারের অগ্নিমালা
যা আটকে থাকে অবরুদ্ধ মুখের অপরিপক্ব গহ্বরে!
নিঃশব্দতার দেয়ালে আটকে যায় সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যপাত
ভেঙে যায় ক্যানভাসে সাজানো খেলা ঘরের রঙিন আয়না
ক্রমাগত হিম শীতল হয়ে আসে চেতনাশূন্য সময়ের ছায়াপথ
কিংবা পরাজিত সমাজের তুমুল বিষণœতা বুকে নিয়ে-
আদিম ফসিলের ভেতর নিষ্পাপ ধর্ষিতার বেদনার্ত চোখ
অবিরাম যন্ত্রণা বুনে যায় মৃত ভোরের অভিশপ্ত ডায়রিতে
সেই রক্তক্ষয়ী ভাষা অনুবাদ করার হিম্মত- কোন রাষ্ট্র রাখে?
চৈত্র সংক্রান্তি
শুক্লা গাঙ্গুলি
সোমদীপের আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে
মনের ভিতর বাস করা
কালবৈশাখী কথা বলে নিত?্যদিন-
মা বলতেন ঠাঁ ঠাঁ পোড়া রোদে কেউ
এলে জল-বাতাসা দাও
হাতপাখায় শান্ত করো তাকে-
কী আশ্চর্য গার্হস্থ্য!
শুধুই ভালোবাসার নিষ্ঠায় পূর্ণ ঘড়া
আমিও রেকাবে শখের মিষ্টান্ন সাজাই
পাণীয় রাখি গ্লাসে-
কেউই আসেনি চৈত্রে অথবা বৈশাখে
শুধু মা দাঁড়িয়ে থাকে রোদ চশমায়- চোখ দুটি রেখে নোনাজলে
জীবন থেকে খসে যায় কিছু সময়
চৈত্র সংক্রান্তিতে...!
যুগলবন্দী জাগরণ
শফিক ইমতিয়াজ
শীতের শাসন শেষে আড়মোড়া ভাঙা চপল প্রকৃতি
চকে মাঠে দলবদ্ধ শালিক; তাদের কলহের সুখ
মেঘের আলাপ ওই আকাশ দিগন্তে
হঠাৎ বৃষ্টির ছোঁয়া চুপজানালায়-
এলো কি গ্রীষ্মের দিন, মাঠের মলাট জুড়ে মৃদু খরবায়ু
বেনেপাড়াজাগে; নয়া বছরের স্বপ্নের রঙে প্রস্তুত হালখাতা।
এই অজর বাংলায় মানুষ ও প্রকৃতির কী যুগলবন্দী জাগরণ!
‘পহেলা বৈশাখ’ নামে এক মহাবৃক্ষতলে অগণিত মেলা
যাপন-নিঃশ^াসে লাগে চিরচেনা ঘ্রাণ
প্রাণের হিল্লোলে আঁকা সেসব মেলার রঙ যে দেখেনি
বোঝেনি বাংলার গূঢ়-গহীন অন্তর
কী বর্গ, কী ধর্ম-বর্ণ; আবালবৃদ্ধবণিতার ঢেউ
ধুম বিকিকিনি আর শুভ্র আনন্দ-উল্লাসে
মানুষের বুকে বুকে এগোবার ওম!
বাংলার জাগনপ্রিয় জন
এই দিনে পুরাতন দাগ ভুলে যেতে চায়
আশা ও সাহসে হাঁটে জীবনের কক্ষপথে, নবোদয় সূর্য যেন।
রোদ
হাবিবা রোজী
পশ্চিমে কাৎ হয়ে শুয়ে সূর্যটা মুচকি হেসে,
আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলেছে চারিধার।
নরম অবাধ্য রোদটা গরাদ গলে এলিয়ে পড়েছে
ঘরের আসবাবে,পাশ বালিশটায়।
বিষাদ ভেজা স্যাঁতসেঁতে মেঝেটা, আঙিনাটা,
কেমন চকচকে করে তুলল বৈশাখী সূর্যটা।
ওম ছুঁয়ে শর্করাহীন চায়ের মগে চুমুক দিতেই
মিষ্টি পুলকের আবেশে আপ্লুত হয়ে ওঠে উড়–ক্কু মন।
এমনদিনে শুকনো পাতার মতো
মুখগুমরো করে উড়ে যায় মেঘদল।
চুপিসারে মেঘ কানে কানে বলে যায়-
আজ মন ভালো করা বসন্তদিন।
এমন রোদধোয়া দিনগুলো স্থায়ী বসত গড়–ক
এপাড়া-ওপাড়া, প্রতিবেশীদের আঙিনায়।
শুক্র মাসে বক্র তাপ
শামস হক
গন্ধরাজ ফুলেরডালের সাথে লেপটে বসে থেকে সে ফুলের
গন্ধ নেয়ার দিন আজ আর নেই।
সুরভীত সেই দিন ভেসে গেছে
জলাধারের পাশের সেই আমগাছটা আজ আর নেই
আছে টুপ করে পড়ে যাওয়া সেই আমের গুটির দিকে
বুক সাঁতার দিয়ে আম কুড়ানোর স্মৃতিটুকু।
সেই জলাধার অট্টালিকার
¯্রােতে এখন ভেসে গেছে।
কাঁঠাল ফুলেরমঁ মঁ গন্ধে যে বাতাস আমার
কিশোর চোখে ঘুম এনে দিত
সেই কাঁঠাল গাছটা আজ আর নেই
সে গাছের কঙ্কালে নির্মিত আমার পালঙ্কে
ডিম লাইটের কান্না এখন ভেঙে ভেঙে পড়ে।
আমার সুখ আর শিহরন আজ ভেসে গেছে
খর বৈশাখের তাপদাহ মনতাপের কাছে আজ ¤্রয়িমাণ।
বশে রেখ
শেখ সালাহ্উদ্দীন
হয়তোবা তুমি নও সাধারণ
তিলোত্তমা, অনন্য
কেউ থাকে খুব উন্মুখ তাই
তোমাকে পাওয়ার জন্য
ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা হাসির অমন
যথেচ্ছ ব্যবহার
কেড়ে নিতে পারে কারো সব সুখ
রাতের ঘুম আহার।
তোমার চোখের মায়াবী অতলে
লুপ্ত যে আহবান
দুর্বল কিছু হৃদয় করবে
নিমেষেই খানখান
প্রশ্রয়-মাখা হাসি, ভ্রূকুটি বা
বিমূর্ত আচরণ
বশে রেখ- যেন অলক্ষ্যে কারো
ভাঙতে না পারে মন।
অভিমান
সাইফুল্লাহ আল মামুন
আমি চুম্বন এঁকেছি মাটিতে দিবানিশি
পেয়েছি দিগন্তে উলম্ব শস্যের উর্বর হাসি
আমি চুম্বন ছুঁড়েছি আকাশে মৃত্তিকা চুষি
দেখেছি মেঘের রূপান্তর, বৃষ্টি রাশি রাশি।
মধু-মল্লিকা দোলে বিদ্রোহী মিছিলে
আমি চুম্বনে এঁকেছি প্রিয়তমার গালে
বিশ্ব নাচে সে-ই আনন্দে সৃষ্টির তালে।
ইন্দ্রধনুর পীড়ন
যৌবনের চাষাবাদে
তুমিই আমায় জ্বালিয়ে দিলে
সুগন্ধীর তাগিদে।
আমি ঝরণার মতো অবশিষ্ট
বালিকা হৃদয়ের বন্ধন স্পষ্ট
প্রেমের চুম্বনে নাচে সমুদ্রের পৃষ্ঠ
বাষ্পের মতো উড়ে যায় ভালোবাসার কষ্ট।
গ্রহ নক্ষত্রের ব্যভিচার পতনের খেলা
আবিরে প্রজ্বলিত কথার গল্পমালা।
দিন শেষে আবেগ মিশ্রিত শব্দের দিন-লিপি
তুমি আমারে কত করুণা করেছো চুপি চুপি
জীবন! কোন শর্তে, কৃষ্ণপক্ষ রাতে
প্রদীপের হাসি বাতাসে মুহূর্তে মুহূর্তে
মুছে দিলে অন্ধকার জোনাকির সাথে।
ধূলিবালি কাদামাটি
অল্প কদমে হাঁটাহাঁটি
শস্যের মতোই শরীরে জমে খুনসুটি।
হেসে হেসে প্রাণবন্তপ্রতিদিনের কত প্রতিশ্রুতি
বলাকার পাখার মতো অনুভূতি পায় সরল গতি।
অভিমানহীন প্রেম ওজনে হালকা
কিছু অভিমান সঞ্চিত রেখো সখা,
অসীমের সীমারেখা হৃদয়ে জাগ্রত
ভালোবাসার জীবন
মান-অভিমানে জীবন্ত।
অভিমান স্বর্গীয় অনুরাগে অভিষিক্ত
স্নেহের ছোঁয়ায় গলে যায় বরফের মতো।
বৈশাখ আসছে
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া
বৈশাখ আসছে
নারীর কাখে কলসি ভরা জল হয়ে।
বৈশাখ আসছে খুশি খুশি
দেখি মুখ টিপে টিপে।
বৈশাখ আসছে হাটের থলেয়
বাবার হাতে সওদা হয়ে।
বৈশাখ আসছে পালকী করে
নতুন বউয়ের আগমনে।
বৈশাখ আসছে অপেক্ষা শেষে
ফলাফলের খবর পাতায়।
আসছে বৈশাখ মেলাজুড়ে
নাগরদোলার দোলায় দোলায়।
এটাও কী এক দৃঢ় বৈশাখ
ফুল গুঁজেছ তোমার খোঁপায়
রঙিন শাড়ির আভায় আভায়!
বৈশাখ আসছে পোয়াতি নারীর সন্তান সুখে
স্বপ্ন দেখেছে সে কত না রাত্রি জেগে জেগে!
বৈশাখ আসছে ভোরের মতো
দীর্ঘ রাতের অবসানে।
নদীবিষয়ক কবিতা
রহমান মুজিব
আরো কাঁদতে হবে কারণ আরো চাই নদী
মেঘের পিঞ্জিরায় গচ্ছিত নদীর জীবনশিরা
ঘুরছে পানিচক্রের লাটিম
ডিঙিতে সোনার পাল খাটিয়ে যে সওদাগর
পাড়ি দেয় এলাচগন্ধের বিকেল, তার চোখের
নীহারিকায় ক্রমশ লঘু হয় পিগমিদের ছায়া
আরো কাঁদতে হবে কারণ আরো চাই নদী
কান্নারা একদিন শরীরময় নদীর নাব্যতা মেখে
¯্রােতের উজানে বাজিয়ে যাবে ধানের কনসার্ট
বৈশাখে চতুর্দশপর্দী-১
আসাদ কাজল
তৃষ্ণার্ত বৈশাখ মাসে বৈশাখ কোথায়?
চৈত্রদাহে বৈশাখ তো আমার ভিতর
জীবনসম্মুখে একাকী বৈশাখী ব্যথায়
স্বপ্ন ছুঁয়ে ল-ভ- আমার এ ঘর।
শুভ্রতার দিনলিপি বৈশাখ কি জানে?
শতাব্দীর জীবন খাতায় সূর্য ওঠে?
মানুষের জীবন খাতায় যা যা ঘটে
বৈশাখ কি দিনশেষে সুর তোলে গানে?
মনচেতনায় তবু বৈশাখ ডেকেছি
আকাশের সান্ধ্যতারা দু’চোখে মেখেছি
কাল সাক্ষী রেখে নতুন যাত্রার পথে
সমর্পণ করি স্বপ্ন-বৈশাখীর রথে।
নববৈশাখ ঋতুর সম্মুখ ছায়ায়
জীবনে হারিয়ে যাই অজানা মায়ায়।
নতুন দুপুর
পুলিন রায়
পুরনো দিনের ছবিতে চোখ রাখি
পাখির পালকে জমা আছে স্মৃতি
আকাশের শরীরে রঙিন ঝালর ঝুলে
আমাকে ঘিরে রাখে সবুজ বন
চৈত্রের ঘুঘু ডাকা প্রহর
পাথরের বুকে ফোটা ফুলের মুচকি হাসি
অলকানন্দায় নতুন দিনের গানে
মন ডুবিয়ে সুখী শতবর্ষী বটবৃক্ষ
হাওর পারে আনন্দউৎসব ঘিরে ধরলে
স্মৃতিতে পড়ে টান, টের পাই
পায়ের নিচের মাটি এখনো বেশ শক্ত-সামর্থ্য
ও মাটি, ও ভাই ভাঁটফুল...
ছেড়ে যেও না, জড়ায়ে নাও বুকে
মেঘ সাক্ষী, সমুদ্রঢেউ গুনে বসে আছি
নতুন দুপুরের প্রতীক্ষায়
বিশাখা উপাখ্যান
আশরাফুল কবীর
বৈশাখের ঝড় হয়ে উড়ে আসো তুমি জলকুক্কুট;
ঘামের সিঁড়ি বেয়ে দিনদুপুরে উঠে আসো কোনো
জলদস্যুর সিলেবাস-বিহীন নিরেট হাত হয়ে;
এদিকে ভেতরে পুড়তে থাকে খাঁখাঁ রোদ্দুর!
নগরোপকণ্ঠে নেই কোনো বিধিনিষেধ
ভাঁটফুল আর নিশিগন্ধার মৌতাতে পঙ্ক্তি লিখে
অস্থির হয় স্বর্গ ও মর্ত্য, জলতেষ্টায় ভুলে যায়
সকল নিয়মতন্ত্র
ঝড় নেমে আসে
উপঢৌকনে ঝড়েরা এলিয়ে হাসে
তফাতে গাঁটছড়া বেঁধে দুঃসাহসী হয়ে ওঠে
আরও কিছু ডানকুনি ফুল
গুঞ্জরিত হয় সকল উত্তপ্ত বনাঞ্চল
নৈঃসঙ্গ্য ভেদ করে কেঁপে কেঁপে ওঠে
অঘোষিত দেবালয়; খানিকটা চঞ্চল ও গীতিময়
চলুক পালাগান নৈবেদ্যের শহরে সাথে নিয়ে প্রত্যয়
জেনে রেখো বিশাখা, জলবুদ্বুদ এ শহরে
-হয়েছে তপাত্যয়।
মুখ
জয়নাল আবেদীন শিবু
তোমার কপাল খুলেছে- নীল নিস্তব্ধতায়
জেগে আছে প্রাচীন নগরী- এ বছর আগাম
কালবৈশাখীর খবর নিয়ে এসেছে বাজপাখি
অরণ্যে অরণ্যে সবুজ সংকেত, ঘণ্টার ধ্বনি
স্বচ্ছ-শান্ত-জলে সাঁতার কাটে তোমার স্বর্ণরেণু শরীর
ফসলের মৌসুম এখন- চোখ খুলে বসে আছো
কমনীয় হাতে। তোমার এ স্থিরতা সুন্দর, সুনীল
অসীম নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তে...
চলমান অন্ধকারে এক অদ্ভুত বিভ্রমের ভিতর
আপাতত দেখে যাই তোমার রঙিন নীরব অবয়ব।
অন্ধকারে অমরাবতী
কুমকুম দত্ত
ভয়ংকর লোডশেডিং ছিল সেদিন সারারাত!
নিষ্পাপ শিশুর মুখ মৃত্যু উপত্যকা অসভ্য ইতর
উলঙ্গের শহরে আস্ফালন শোকের নদী রাতকানা
যে শহরে মৃত আমি নিঃসঙ্গ ভায়োলিন দূরের দূরবীন
নতমস্তকে বশীভূত স্বপ্নের ভূ-ভাগ অন্ধকারে অমরাবতী;
রাজা আসে রাজা যায় পায়ের ছাপ ক্রমাগত মুছে যায়
আড়ালে দৃষ্টি অখ- শিলালিপি বুকের ভূ-ভাগ;
অন্ধকার পলায়নপর রাত অধিগ্রহণ রণাঙ্গনের আকাশ
একটি সকালের শরীর
মহসিন খোন্দকার
হাল-চাষের শব্দের ভেতর বসে আছে জোড়া শালিক, ঘামকবিতায় ঝুলে থাকা মা’র পান্তা-শুটকির প্রেরণা আর বাজানের তৃপ্তির ঢেঁকুর আজ সমান্তরাল সমুচ্ছ্বাস!
হরহামেশা উচ্ছিষ্ট ভাত খাওয়া শালিকটি আম্মাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে,বাজান মাকে দ্বৈত জীবনের চাষবাস দেখান,মা হাসেন,বাজানের খুঁটিনাটি কথার ভেতর থেকে মাথা তুলে গার্হস্থ্য ঘাস, মা’র গোপন পোড়া মরিচের প্রশংসা করতে করতে বাজান-জলি ধানের কথা বলেন,গত কার্তিকে ঋণে মা’র নাকফুল খাওয়া দুঃস্বপ্নটি বাজানের হুক্কার নীল ধোঁয়ায় এখনো কেমন ঘুরাপাক খায়!
রেবাপু
যাকির সাইদ
তুমি আভির্ভূত হলে দেবীর মহিমা নিয়ে
আমার অন্তর্জগতে।
আমার মাথার উপর তোমার
স্নেহের ছায়া হৃদয়কে করেছে শীতল
সমুদ্রের বিশালতা নিয়ে
উন্মুক্ত হলো তোমার সত্যব্রত মন।
তুমি যেন এক আকাশ সুশীতল ছায়া।
বটবৃক্ষের মতো আমাকে দিয়েছ নিরাপদ আশ্রয়।
ঘিরে রখো তুমি মায়াময়, প্রেমময়,
মমতাময় আশীর্বাদের মন্দ্রিত সুরে।
আমার মাথার উপর থেকে নিও না
সরিয়ে এই পবিত্র আশীষ।
তুমি ভালো থেকো রেবাপু
কামনায় রেখো জগতের সকল
প্রাণীর মঙ্গল। আমি মেধাশূন্য, তবু
লিখে যাচ্ছি অক্ষম হাতে।
আমার কলম সচল রেখো তুমি।
মানবনামা
জলিল আহমেদ
কখনও রোদের মুখে মেঘ জমা হলে
দিনকি তাই থেমে থাকে, নাকি
লোকালয়ে হলে আলোঝড়,
রাত কি তাই দিন বলে খ্যাত হবে।
নদীতে জলের ধারা থেমে গেলে,
চরে জন্মালে বাড়িঘর,
তাহলেকি নামহীন হয়ে যাবে নদী।
রোদেরও মন থাক, তাই দিয়ে হয়ে যায় দিন।
রাতের অন্তর দিয়ে ঢেকে ফেলে আলো-অবয়ব,
নদীর সুশ্রী থেকে নেমে আসে মনের নাব্যতা।
পাষ- যতই ওই মানবে থাকুক
মনুষ্য হৃদয় ঠিকই দিবে মানবতা,
মন থেকে ব্যুৎপত্তি এই মানব নামের! ু
ভ্রাতৃত্ব-বৈভবে বৈশাখ
মিশকাত উজ্জ্বল
পৌষের পাতাঝরা বিষণœতার প্রহর শেষে
তৎপর ফাগুনের হরিৎ পল্লব-
পদ্য লেখে রাঙা শিমুল-পলাশের আলপনায়।
চৈত্রদাহে কৃষ্ণচূড়ার ডালে উত্তুঙ্গ লৌহিত্যের আধিপত্য
ঈশান-নৈর্ঋত প্রকম্পিত করে নামে প্রার্থিত বারিধারা।
সজীবতায় প্রাণ পায় ধূলিধূসর ঊষর প্রান্তর, লোকালয়...
চারুশিল্পীর নির্ঘুম রাতের ইজেলে আঁকা- লক্ষ্মীপেঁচা,
রাজহংসী, ময়ূরপক্সক্ষী, হাতিসমেত
রাজপথ দখলে নেয় মঙ্গলশোভাযাত্রার নতুন সূর্যোদয়।
রমনা বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখী গানের কোরাসে
হিঁদু-মুসলিম-খৃস্টান-বৌদ্ধের সৌহার্দের আবহে
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়-
“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...”
বর্ণিল শাড়ি, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত
কোটি বাঙালির প্রাণে জাগে ঐক্যের শিহরন।
দই-খই, মুড়ি-মুরকি, মিষ্টান্ন; বাহারি পসরায় মেতে ওঠে
প্রাণের বৈশাখী মেলা।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্য- ইলিশ-পান্তার মৌতাতে
আদৃত হয় বাঙালিয়ানা ভ্রাতৃত্ব-বৈভবের পহেলা বৈশাখ।
প্রচ্ছদ : সমর মজুমদার
সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫
জলপাইচিহ্ন
আবদুর রাজ্জাক
কুসুমেরা হাততালি দিয়েছিলো, কুসুমেরা স্বাগত জানিয়েছিলো,
কুসুমেরা বুঝতেও পারেনি কেনো সেই হিংস্র পশু
তিন হাজারমাইল দূরের আড়ালে ছিলো?
সে কখনই ধরা দেয় না যে-অস্ত্র পাহারায় থাকে, অস্ত্র লুকিয়ে রাখে।
আর আমাদের প্রিয় সন্তানদের হত্যা করে।
পাপ তখনও ছিলো, এখনও পাপ-পঙ্কলিতার রাজত্ব রয়েছে,
তারা বুঝতেও দেয়নি, কী চাওয়া ছিলো তাদের? জমিন?
আমাদের এক টুকরো কলিজা! প্রিয় বাসভূমি।
বৃষ্টি নেমেছে, শীলা বৃষ্টি, ঝড় প্রপাতে আমরা কুঁকড়ে গিয়েছি,
আশাহত হইনি, মাইলের পর মাইল হেঁটে আশ্রয় খুঁজেছি,
সেইসব দুঃসহ দিনের কোনো তুলনা হয় কি,
জীবনকে রূপায়িত করার যাত্রা হয়তো স্থবির হয়েছে,
কোথাও আগুনে জ¦লেছে, কোথাও সবুজ জীবন দগ্ধ হয়েছে।
তারা বাদ্য বাজিয়ে হাততালি দিয়ে নেচে গেয়ে আমাদের খুন করেছে,
আমাদের জন্মভূমি দখল করেছে, তাদের গোলা-বারুদের আঘাতে
বিদ্ধ হয়েছি, লুটিয়ে পড়েছি, আমাদের লাশ শেয়ালে-কুকুরে খেয়েছে,
পচে গলিত হয়েছে। খেতে খেতে না খেয়ে শেয়াল পালিয়ে গেছে।
আমাদের প্রতিজ্ঞা অশ্রু পেয়েছে, চাঁদ পাথরের ঢেউ প্রভূত আদর দিয়ে
কোলে তুলে নিয়েছে।
একটি অদৃশ্য নদী পাড়ে বসে আছি স্তব্ধ একজন, অপমানিত একজন।
ভেবে কূল পাই না অরণিবৃক্ষের বিষণœ দৃশ্য কেনো সেইসব জীবনকে
তুচ্ছ করেছে, হায়! অদৃশ্য করেছে।
তোমাকে দেখিনি তাই
মনজুরুর রহমান
পহেলা বৈশাখে এবার তোমাকে দেখিনি কোথাও-
না বটমূলে না রমনায় না চিরবসন্তের দেশ-
ভার্সিটি পাড়ায়!
বন্দরের সার্চলাইটের মতো আমার সন্ধানী চোখ
কেবল খুঁজেছে তোমাকে
সাইবেরীয় শীতের পাখি যেমন-
লক্ষ লক্ষ মাইল উড়ে আসে তার
নিশ্চিত সেঞ্চুরিয়ামে।
শুভ সকালের মাঙ্গলিক ধ্বনি তুমি শোননি
রবীন্দ্রনাথের কল্যাণী সুর-বৈশাখী কবিতা
প্রথম প্রভাতের সূর্যোদয় থেকে তুমি নির্বাসিত আজ।
কী অমন দায় তুমি আটকে আছ ঘরে?
কিংবা কোন আতঙ্কিত বৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাসে
পেয়ে গেছ মনে?
তোমাকে খুঁজেছি শুভ্র সকালে গোধূলি-সন্ধ্যায়
তোমাকে দেখিনি তাই শহর দেখেছি ফাঁকা-
জনহীন কোলাহলে!
আকাশ
নির্মলেন্দু গুণ
আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়,
আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার
আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ
যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়,
তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে
স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়
একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ... “আকাশ”।
আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি।
জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু
এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে।
জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে?
আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি
উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে
আর কোনো কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না।
যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো
আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল
এই যন্ত্রণাক্ত আকাশ শব্দটি।
তোমার আমার মাঝে আছে এরকম
বক্ষফাটা অনেক আকাশ। আমি
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে
কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে।
মানুষ প্রতিদিন ঘোলা হয়ে যাচ্ছে
জাহিদ হায়দার
মানুষ নামছে চিত্রা নদীতে,
দাঁড়াচ্ছে পাহাড় থেকে পতনে আনন্দিত ঝরনার নিচে,
সময়ের ব্যবহৃত হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে শূন্যতাভেজা বৃষ্টিতে।
জলেরা পালন করছে নিয়মী কর্তব্য নিরন্তর।
‘তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন?’
‘তোমাকেও দেখাচ্ছে তোমার মতন নয়।’
আরশি ঘুরে ঘুরে কেবল দেখছে তোমাকে।
‘প্রতিবিম্বে ভেসে যাচ্ছো কোথায়?’
দৃষ্টিতে আবর্জনার ¯ূÍপ।
স্পর্শস্বর কালো ধোঁয়ায় আকীর্ণ।
রৌদ্র দিয়ে নিজেকে কাচতে কাচতে হয়ে যাচ্ছো রাত্রি।
যাপনের সূচিপত্র উধাও।
ঘরে বাইরে অরক্ষিত ছায়া।
সীমিত হতে হতে তৃণের সামাজিক।
এতো ঘোলা ছিলে বুঝিনি কখনো।
ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্যে এলিজি
দিলারা হাফিজ
বৃক্ষেরা বাকল ফুঁড়ে
অস্থির বেরিয়ে পড়ছে দলে দলে,
তারা সব যুদ্ধে যাবে,
ফিলিস্তিনি শিশুদের বাঁচাতে,
সময় ছেঁদন করছে রাতের
কাঠঠোকড়া পাখি
কখন ভোর হবে- যুদ্ধে যাবে-
নদী ও জ্যোৎস্নার-তরুবীথি- সৈন্য-সামন্ত যত
বন্য ঘোড়া- সুন্দর বনের হিংস্র-চোখের বাঘ
যুদ্ধে যাবে তারাও
চিত্রল হরিণেরা সভা করছে গোলপাতার ছায়ায়
ভাবছে, তাদেরও কি যাওয়া একান্ত জরুরি?
শিশুদের কোমল বুকে এই রক্ত-বৃষ্টির নৃশংসতা
এই শক্তিশেল নিক্ষেপের গর্জন সত্যি অসহ্য প্রাণ।
যুদ্ধের বল্কল পরে পুরো মানব প্রজাতি
খুঁজে ফেরে তার যুদ্ধংদেহি মনের দুর্বার শেকড়
কোথায় পালালো শেকড়?
লাভে, লোভে ও মাৎসর্যে?
কিংবা ন্যায় নীতির ব্রেকাপে এই উল্লম্ফন?
এই গ্লোবাল ভিলেজে কিছুই পারম্পর্যহীন নয়
ভেদ-বুদ্ধির এই প্রযুক্তি সংসারে-
না সমাজ, না রাষ্ট্র, না ধর্ম, না বর্ম...
তাহলে কে কে যাবে এই ন্যায় যুদ্ধে-
ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার না ওয়াটসঅ্যাপ?
কে হবে আগামীর সমর নেতা?
আত্মস্বর
গোলাম কিবরিয়া পিনু
বৈশাখের রোদ আর তাপ,
ঝাঁপ খুলে দেয় বদ্ধ ঘরের-
তখন অন্ধকার-অমানিশা থাকে না!
রাখে না হৃদয়ে কালি ও কালিমা
বিকিরণ আরও দ্যুতিশীল হয়ে ওঠে,
উদ্দীপন জাগিয়ে তোলে!
কালচিটে দাগ মুছে দিতে
কালবোশেখি আসে,
কালাকানুন থাকে না কালক্রমে,
ভ্রমে ভ্রমর যে ফুলে গিয়ে বসে
সেও ঝড়ো-ঝাপটায়,
আত্মস্বর ফিরে পেয়ে
তার স্বর-ব্যঞ্জনবর্ণ উদ্ধার করে!
আমরাও নববর্ষ ও ষড়ঋতু নিয়ে
নদীর নাব্যতা নিয়ে জেগে উঠি,
আমাদের ধরণীতলে
অঙ্কুর মহীরুহ হয়ে ছায়া দেয়,
সেই ছায়ায় আমরা বেড়ে উঠি!
বৈশাখে আমরা এক ও অভিন্ন হয়ে
প্রকৃতির ভেতর প্রকৃতি হয়ে,
নবীভূত হই!
মিলের অমিল
খালেদ হামিদী
“কোথাও এমন দেশ পাবে নাকো তুমি
কিশোরী ধর্ষণে পটু শ্বশুর ও স্বামী!
আমার বোনের তারা কাটে ছোট্ট অঙ্গ
দেবরও শিউরে তোলে হতভাগা বঙ্গ।”
এমন উক্তির কেউ দেখে, এক মেয়ে
প্রতিবাদে ফেটে কহে: “পোশাকের চেয়ে
শিশুতে আপত্তি, লক্ষ্য হত্যা, বলাৎকার।
এর চাইতে জ্যান্ত গোর দেওয়া চমৎকার!
জাহিলেরা অপমান করেনি অন্তত,
কন্যাজন্ম মাটি চেপে ভুলেছে সতত।”
এ-কথায় কারও চিত্ত আরও উঠলে কেঁপে
ওদিকে আকাশ থেকে মৃত্যু নামে ঝেঁপে।
গাজায় বাচ্চারা ছোটে মা-বাবার খোঁজে।
ভয়ার্ত তাদের শোনে কারা চোখ বুজে!
শুকায় চোখের পানি, রক্ত শুধু ঝরে;
আসিয়া কি এসে বলে বারবার মরে:
“উঠানে সারমেয় ছানা আদরের, তাই
দুশমনকে কুত্তার বাচ্চা ডাকতে পারি নাই।”
যেহেতু নিষাদ
(পৃথিবীজুড়ে সকল যুদ্ধের অবসান চাই)
মিহির মুসাকী
যেহেতু নিষাদ
শিকার তো করতেই হবে;
কিন্তু আজকাল আর অরণ্য নেই,
যেহেতু অরণ্য নেই, তাই পাখিও নেই।
তীর হাতে অরণ্যের খোঁজে তাই
পথ থেকে পথে, দেশ থেকে দেশে
ছুটে বেড়াচ্ছি;
পাখি শিকারের বিদ্যা ভুলতে বসেছি;
এ-কারণে নিজের মধ্যে এক অরণ্যের বিস্তার দেখে
মনে খুব আশা জাগে,
হয়তো তাহলে পাখিও আছে;
আমার অরণ্যস্বভাবী মন
তাকে পোষ মানিয়েছে;
যেহেতু নিষাদ
শিকার তাহলে করেই ফেলি-
এই তীর নিজের দিকেই তাক-
পাখির রক্তে পৃথিবী ভেসে যাক!
আমন্ত্রণ
মঈনউদ্দিন মুনশী
গাছের মতো মাথায় পল্লব জড়োয়া
হাত পা দোলাচ্ছি শাখাপ্রশাখায় বাতাস ভরা
তোমাকে দেব চৈত্রের প্রশান্তি
চোখে এঁকে নিই মেঘের মায়া
রোদ কুড়িয়ে তুলে ধরলে সোনালি আলো
আকাশ ঝরিয়ে দেয় নীল
বুকে জেগে ওঠে মালঞ্চ
ওঠো, পান করো পুষ্প ঘ্রাণ
চোখে নাও পুরোটা বাগান।
হালখাতা
মুজিব ইরম
পরে এসো জামদানি শাড়ি হালখাতা দিনে। দিও কলাপাতা রঙ হাসি। সাজিও দোকান। আম জাম নিম পাতা লালনীল রঙ্গিন কাগজে। যেন ঝলমল করে ইরম বিপণি বিতানের মুখ তোমার ছোঁয়ায়। মনে সাধ ছাপাবো দাওয়াত পত্র তোমার ছবিতে। আর কেউ না আসুক। আসিও দয়ায়। দিনের শুরুতে। লিখিবোতোমার নাম নতুন খাতায়। আগামী বছর যেন লেনদেন ঠিকঠাক হয়। সকলি বাকিতে। তোমার নামের গুণে বিপণি বিতানে।
এই বার বড়ো সাধ খুলিবো নতুন শাখা তোমার নামেতে। যদি অনুমতি পাই। যদি তুমি বানাও শরিক। ফতুর করিবো। আজ বাকি কালকে নগদ- লিখিয়া রাখিবো। দিবারাত্র অধমেরে মনেতে রাখিও। আদরে সোহাগে তুমি দোকানি ডাকিও।
নববর্ষ
হাইকেল হাশমী
বছর নতুন করে শুরু হয় না-
বছর তো গাছের মতো
তার পুরাতন পাতাগুলো ঝেড়ে ফেলে
নতুন সবুজ পাতা গায়ে দিয়ে
প্রত্যেক নববর্ষে উপস্থিত হয়।
বছর তো একটি পুরাণ
আমাদের তাড়া করে এগিয়ে যেতে
যেন আমাদের বিলম্ব হলে
কোনো কাজ শুরু হবে না।
নববর্ষ কোনোপ্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে না
বরং আসে আয়না নিয়ে
তাতে আমরা দেখতে পাই
আমাদের বিগত দিনের প্রতিচ্ছবি।
আমরা এই মুহূর্তকে নাম দিয়েছি “নতুন”
কিন্তু এই মুহূর্ত অতিপ্রাচীন
নক্ষত্রের ধীরগতিতে তার জন্ম
এটা অতীতের মতো চিরন্তন।
তবুও, সময়ের মাঝে
একটি দরজা খুলে যায়
ভবিষ্যতের দিকে
যেন আমরা বেরিয়ে পড়ি
নতুন আশা আকাক্সক্ষার সন্ধানে।
এই নববর্ষের পিছনে ছুটতে ছুটতে
ধাপে ধাপে,
তার পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে
আমরা হারিয়ে যাই নিজের অজান্তে
অনন্তকালের মাঝে।
আহা জীবন
খোরশেদ বাহার
পতাকাটি দুলছিল
শকুনটি উড়ছিল
বৃদ্ধটি ভাবছিল
যুবকটি নেচে ছিল
শিশুটি কাঁদছিল
সময় দৌড়াচ্ছিল
কথাগুলো থেমে ছিল
সাইরেন বেজে ছিল
রাজমহল সেজে ছিল
মানুষগুলো লুকিয়েছিল
শিক্ষক ঘুমিয়ে ছিল
সাংবাদিক লিখোছিল
পেশাজীবী পিষে ছিল
আমলারা আঁকছিল
জীবন স্তব্ধ ছিল
আহা জীবন।
স্বপ্নের দাঁত ও নখ
হাসানাত লোকমান
শিশুটি, যার চোখে আমরা
নীলপরি দেখেছিলাম একদিন,
সে এখন দাঁতের কোণে
হিং¯্রতা ধার দেয়।
আমরা যাকে দিয়েছিলাম
পেনসিলে আঁকা রঙিন ঘর,
সে তাতে আগুন লাগাতে শিখেছে।
আমরা জানতাম না
শীতল কুয়াশার ভেতর
আমাদের রোদগুলো হারিয়ে গেছে,
জানতাম না কলমের কালো কালি
কবে নীল ছাপার অনুমোদন হয়ে গেছে।
আমরা বুঝিনি-
ফাইলের ভাঁজে ভাঁজে
আসলে আমাদের শিরদাঁড়া রেখে এসেছি।
আমরা ‘আব্বা’ থেকে ‘ড্যাডি’ হয়ে
যেদিন উচ্চারণ ভুললাম,
সেদিনই ইতিহাসের খাতা
ছিঁড়ে ফেলেছিলো আমাদের ভবিষ্যৎ।
কেউ বোঝেনি,
আমাদের ঘরে পুষে রাখা স্বপ্নটি
আসলে এক ঘুমন্ত বাঘ।
রাতভর বৃষ্টি
মাসুদার রহমান
রাতভর বৃষ্টি ও ঝড়
তুমি গেছ ঘুমাতে একাকী,
তোমার শিয়রে বসে বসে
আমি এই কবিতাটি লিখি।
কবিতা বা কবিতার মতো
নগণ্য-প্রলাপই তা হোক,
তোমার চোখের পাতা জুড়ে
লেখে এটা এক কবি লোক।
কবি মানে নষ্টের শেষ
তাকে রাখো মন থেকে দূরে,
সে ভিজুক ঝুম বৃষ্টিতে
সে পুড়ুক রোদে-রোদ্দুরে।
শিয়রে নদীকে রেখে ঘুম
তুমি দূর রাজকীয়-শাহী,
কবি সে তো দোয়েল চড়–ই
কিংবা শালিক খড়বাহী।
খড়বাহী পাখি নয় কবি-
ঠোঁটে খড় বাঁধে কই বাসা!
তোমার দু’চোখে রাখে সেই
ঝড়ের রাতে ভালোবাসা।
আমার বৈশাখ
মতিন রায়হান
আমি তো গাজার এক এতিম সন্তান!
তা না হলে কেন সকল স্বপ্ন ডুবে যায়
ভূমধ্যসাগরে?
গুমরে গুমরে কাঁদে আমার বৈশাখ
রঙিন জামাটা মুহূর্তেই হয়ে ওঠে
রক্তাক্ত পিরান
আমি ধ্বস্তপ্রায় গাজা, অসহায় ফিলিস্তিন
পতাকাশোভিত কফিনই আমার নিয়তি
আমাকে কবর দাও, গণকবরই আমার ঠিকানা!
হে বাংলাদেশ, তোমার বৈশাখ কত রঙিন!
এই বৈশাখে
মুশাররাত
যদি তোমাকে ভেবে কাঁদার মতো কেউ না থাকে
তোমার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে কেউ না বাঁচে
তাহলে আর মৃত্যুকে রেখো না আকাক্সক্ষায়
এই বৈশাখে, রাগান্বিত প্রেমিকার মতো তপ্ত রোদে
পীচ ঢালা রাজপথে হেঁটে জীবনকে ভোগের আয়োজনে ব্যস্ত থাকো
অনাদরে বেড়ে ওঠা কচুর পাতায় দুপুর রোদের ঝিলিক
যে আল্পনা আঁকে তার দিকে চেয়ে বলো, হে ক্ষণকাল
ভালোবাসি এই পৃথিবীর পথে
ফুলের মতো হেসে-ওঠা সুখে রৌদ্রদগ্ধ প্রতি বোশেখের
আদরে ভরা প্রথম সকাল।
আমি বৈশাখী
যাকিয়া সুমি সেতু
আমি বৈশাখী, আত্মার দাহকাল, সময়ের রূপান্তরের বিশুদ্ধ চিহ্ন
আমারই রোদের নোলকে কথা বলে প্রেম, বেদনা, রুদ্রতা, সংগ্রাম
আমিই মহাবিদ্রোহের সিঁদুর, রূপের কুসুম, রূপান্তরের অঙ্গিকার
আমারই প্রতাপ মানবিক আকাক্সক্ষার সংঘর্ষে জন্ম গভীরতম শিল্প
আমি বৃষ্টির মতো এসেছি, আমার খরতাপের আগুনে পোড়ে মাটি
জানতো আমার ঘাম, ধুলো, ঝড় পূর্বপুরুষের কৃষপঞ্জির সাথে অন্তর্লীন
আমি কোথাও অনুগত নই, নবজন্মের শর্তে চিরকাল অনিবার্য
আমারই অনিবার্যতায় বাঙালির সাংস্কৃতিক রূপবোধ, সহিষ্ণুতার মনস্তত্ত্ব
শিল্পের স্নানঘাট তাই আন্দোলিত রবীন্দ্র, নজরুল,সুকান্ত, জীবনানন্দে
আমারই জন্য পারস্য, ইরান থেকে আকবর গড়েছিল মনীষার আলোঘর
শশাঙ্ক সাজিয়েছিলেন সোনালি মুক্তো ভরা আলোর শিল্পরথ
আমি বয়ে চলি পদ্মা, গঙ্গা, যমুনা, পুনর্ভবা, কোশি, চন্দনা-বারাশিয়া
পান্তাভাত ইলিশ, পাটশাক, কাঁচাধান গন্ধে আমি বাঙালির বিপ্লব
আমি বৈশাখী, নবজন্ম ঋতুঘরে প্রতিদিন কৃতজ্ঞতার সূর্যলোক
শ্রমজীবী মানুষের নির্ভীক আকাক্সক্ষা থেকে সৃষ্টি করি নতুন চেতনা...
নির্ভেজাল স্বাধীনতা
আব্দুল্লাহ জামিল
স্বাধীন হবার তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে
প্রতিক্ষণ চিৎকার করে করে যারা
গলা বসিয়েছে তারা তো স্বাধীনতার
প্রকৃত মানেটা জানে না সঠিকভাবে
অথচ তাঁদের নিয়ে আমরা গর্বিত।
আকাশের এক কোণে একলা যে মেঘ
ওড়াউড়ি করছে সে তো বৃষ্টি দেয় না
সে কেবল আকাশের একাকিত্বে সঙ্গী
নির্ভেজাল স্বাধীনতা এমনি কি পাবে
তেলে-জলে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে?
ব্রিজ
শারদুল সজল
একটা ব্রিজ
একশ নদীর সমান হয়ে এগিয়ে গেলো
একলক্ষ মানুষের দিকে
একলক্ষ মানুষ এগিয়ে গেলো ভোর উদিত সূর্যের দিকে
সূর্য এগিয়ে গেলো
রাতভোর পায়ের দিকে,
পা এগিয়ে গেলো পথে পথে- মানুষের সুবর্ণধূলি
সূর্যরেণুতে;
পথ আর কতদূর নিয়ে যাবে- মানুষ যদি না হাঁটে
এই পথ রোদ্দুর হিমালয় পাথর ভেঙে,
সূর্য মিশে গেল অন্য অন্য গোলার্ধে
অন্য এক ব্রিজে-
একশ নদীর সমান হয়ে
একলক্ষ্য মানুষ এগিয়ে গেলো নতুন এক সভ্যতার দিকে
সভ্যতা এগিয়ে গেলো ম্যাকখচিত মহাকালের দিকে
মহাকাল এগিয়ে গেলো
মহাশূন্যে,
মহাশূন্য মিশে গেলো মানুষের অসীমে...
চৈত্রের ফ্লোরিন
সঞ্জয় দেওয়ান
আকাশে নিকষ আঁধার
মৃত মানুষের শোকে নিশ্চল পৃথিবী।
গাজা পুড়ছে এখানে
রাফাহ জ্বলছে সেখানে
নিথর মানুষ পতঙ্গের মতন উড়ে বাতাসে
নিদ্রামগ্ন পৃথিবীর মূঢ় মানুষ এখনও ঘুমায় নিশ্চিন্তে!
নবজাতকের কান্নায় কাঁপে শুষ্ক মাটির বুক
পাষাণের চোখে অশ্রু জমে
বিবেকের মুখোশ উড়ে গেছে চৈত্রের ফ্লোরিনে!
মুয়াজ্জিনের করুণ সুরে ফুলের রেণু ঝরে
বোমার আঘাতে ভাঙে পাথরের সংসার
শূন্যে উড়ে নিষ্পাপ শিশুর মাথার খুলি
নারীর আর্তনাদে মহাশ্মশান মর্ত্যভূমি।
লক্ষ্মীকোল
স্বপন আদিত্য
হারিয়েছি শঙ্খধ্বনিময় সন্ধ্যা
মেঘকণা বিচ্ছুরিত ভুবন মোহিনী আলো
স্তব্ধ জলধির পাশে- হয়তো আমাদের
আর কিছু বলার নেই পরস্পর
কেবল নিভৃতে কামিনীর শাখা
থেকে হাওয়া উড়ে গেলে অন্ধকারের দিকে
বটের শরীর থেকে, অন্ধকারের
তলানীতে পড়ে থাকা
মৃত্তিকা থেকে- এতো বেশি উঠে আসে
শৈশবের ঘ্রাণ।
বৈশাখে নবসঞ্চার
তাহিতি ফারজানা
উৎসবের নতুন মোড় আনো বৈশাখ।
কাটাছেঁড়া মুখ, খাঁচাবন্দী মানুষ
পাতার বাঁশিতে ঠোঁট-
ঘষে ঘষে মুছে ফেলুক জীর্ণতা।
ছিন্নবস্ত্র যে উন্মাদ পথে ঘুমাচ্ছে বেঘোর,
মনোযোগ চাপা আছে ভগ্ন স্থাপত্যের নিচে,
তারও কিছু এসে যাক শাড়ির পাড়, চুরির ঝংকারে।
শত্রুর দরজা ভেঙে
অসহ্য বিস্ফোরণে বেরিয়ে আসুক হৃদয়।
সেখানে লিখবো নিরিবিলি দু’লাইন পদ্য,
চুম্বনের কালিতে- মধুর প্রতিশোধ।
মানবিক খরা মুছে প্রত্যয় আনো বৈশাখ
দাও ঝড়ো হাওয়া, ফসলের গান-
তৃষ্ণার অতলান্ত জল।
পহেলা বৈশাখ
ডালিয়া চৌধুরী
আজ পহেলা বৈশাখ বাংলার বর্ষবরণ
উৎসবে মুখরিত প্রকৃতির কু-লীতে
নৃত্যরত তরুণীর নূপুরের শব্দে নবস্বর,
বেজে ওঠে পুবানো মরমর ধ্বনির ভেতরে।
উদ্ভাসিত আকাশ হঠাৎ আজ কোন সাজ!
একটু দুঃখ ভারাক্রান্ত অবয়বে হয়ত
ক্ষাণিক বিরক্ত হালখাতার গরমিলে।
মিছিলের শোভাযাত্রায় ছিটানো লাল সাদায়
উচ্ছল তারুণ?্য প্রাণবন্ত গীতে মুখরিত।
কোন অদৃশ্য সুস্থ হাতের স্পর্শের পরশ
লেগে আছে সমস্ত শহরে, আজ কেবল
বিনোদন একটু নৃত্য, একটু গীতের আবেশ
ছন্দের আবৃত্তিতে নতুনকে আহ্বান।
পানলাল মুখে হাস্যোচ্ছল দোকানী
হালখাতা ধরে আছে সজ্জিত দোকানে।
পুনানো খাতার বিদায়ে মিষ্টিমুখো সবাই
নতুন খাতা লাল ফিতায় বাঁধানো
নতুন হিসেব শুরু নব উদ্যমের ঝলকে।
পুরানো জরাজীর্ণ ঘূর্ণির বলয়ে হারিয়ে যাচ্ছে,
ঝড়ের তীব্র ছোবলে জড়তা হারাচ্ছে
নতুনকে ডেকে যাচ্ছে “অহে জাগো”
নিসর্গের শো শো শব্দে অবিরত এই ডাক
বুঝে নিচ্ছে প্রকৃতির প্রাণি, নব আলোকে
উছলানো সম্ভারিত কার্যালয়ে জেগে উঠছে।
ধ্বংসিত জীবনের ক্রন্দন
তুহীন বিশ্বাস
সুদ-আসলের কর্মযজ্ঞ, জটিল অংক
ক্ষমার অযোগ্য শাস্তির পাল্লা অস্বস্তিকর,
দংশিত অস্তিত্বে ধ্বংসিত জীবনের ক্রন্দন
অতঃপর আমার আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।
কিছু ভুল গোনে মাশুল এলোমেলো কাব্যে
পিছনের দরজায় ঠকঠক করে পিছুটান,
কিংকর্তব্যবিমূঢ় বর্তমানে অমাবস্যার ছোঁয়া
সদরের পাহারাদার অদ্ভুত কিম্ভূতকিমাকার।
সম্পর্কগুলো দূরে সরে যায়, বড্ড স্বার্থপর;
হন্তদন্ত হয়ে অন্ধকারে খুঁজি উপসংহার
অবশেষে...
উত্তরসূরির মেঝেতে আঁকি পরিণতির চিত্র।
ঝরা পাতার দিন
মেহনাজ মুস্তারিন
দিনে দিনে পালটে যাচ্ছে পথ ঘাট মাটি
আমি তুমি আমরা
আমাদের শেষ নির্যাসটুকু
কমে আসছে কথা কমে আসছে দেখা
যেমনটা
পদ্মা, যমুনা, ভৈরবের নতুন পথের আনাগোনায়
পালটে যায় শরীর
জলগুলো দখল নেয় তোমার
আমার চোখে
কোথাও আবার উপচে জলোচ্ছ্বাস
কোথাও চৌচির শুকনো রুটির মতো
যেন কতদিন তৃষ্ণার্ত পথিক ছোঁয়নি উষ্ণ ঠোঁট
যেভাবে ভাঙা ব্রিজ জলকল্লোলের অপেক্ষায় থমকে থাকে!
তারপরঃ একদিন
মুখোমুখি দেখা হবে অথবা শুকনো হৃদয় ঘেঁটে
মনে হবে অবেলায় হেঁটেছি কতো যে!
কোমরের বাঁকে বাঁকে খুঁজেছি অভিলাষ যতো!
তারপর : আবারও একদিন
ঝরাপাতা ধীর পায়ে জেগে উঠবে
আর আমি দাঁড়ি টানা শেষে
ভুলে যাব সবকিছু অথবা ভুলে যেতে দেব
সে কথাই বলবো বলে এসেছি আজ
চুপ কথার রূপকথা
মিলি রায়
নীলের ঘোর নেমেছে, মগ্ন দ্রবীভূত ঘোর
মৃতের উপর বসে জাগছে আঁধার
নরক সা¤্রাজ্যে অসন্তোষের আঁচ
আগুনে স্নাত বীভৎস মূর্তি বেরিয়ে আসছে
একটু একটু করে
মুছে দিচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক পায়ের ছাপ
জোনাকি নয়, জ্বলজ্বল করছে
মৃত্যুর অতল থেকে উঠে আসা আত্মাদের ক্ষুদিত চোখ
ভয়ে মুখ ঢেকেছে ভরা পূর্ণিমা
মাত্রা হীন দুর্বোধ্য কোমল শব্দরা
কুয়াশা বিভ্রমে অলীক লণ্ঠন হাতে
নিরাভরণ হেমন্ত থেমে আছে দিগন্তের ওপারে
দিগন্ত ! সে তো চোরাবালি
দেখা ও দেখানোর ভুল
কখনো কি তাদের হবে দেখা?
চিনে নেবে একে অন্যকে, নির্ভুল?
আসুরিকতা যেখানে স্পর্শ করে
তার বিকৃতি না ঘটিয়ে ছাড়ে?
ধর্ষিতার অগ্নিমালা
মনিকা মারইয়াম
অনন্ত ক্রোশ পার হয়ে ক্লান্ত ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে
উড়াল দিয়েছে যারা- জাদুকরী শূন্যতার শ্মশানে
তাদের ঝলসে যাওয়া নির্মোহ স্বপ্নের পালক থেকে
খসে পড়া উজ্জ্বল অপ্রতিরোধ্য রক্তবিন্দু জানে-
নক্ষত্র ভরা আকাশে ভোঁতা ব্লেডের দাগ কতোটা রুক্ষ
কতোটা অসহায় সেই গুমোট চিৎকারের অগ্নিমালা
যা আটকে থাকে অবরুদ্ধ মুখের অপরিপক্ব গহ্বরে!
নিঃশব্দতার দেয়ালে আটকে যায় সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যপাত
ভেঙে যায় ক্যানভাসে সাজানো খেলা ঘরের রঙিন আয়না
ক্রমাগত হিম শীতল হয়ে আসে চেতনাশূন্য সময়ের ছায়াপথ
কিংবা পরাজিত সমাজের তুমুল বিষণœতা বুকে নিয়ে-
আদিম ফসিলের ভেতর নিষ্পাপ ধর্ষিতার বেদনার্ত চোখ
অবিরাম যন্ত্রণা বুনে যায় মৃত ভোরের অভিশপ্ত ডায়রিতে
সেই রক্তক্ষয়ী ভাষা অনুবাদ করার হিম্মত- কোন রাষ্ট্র রাখে?
চৈত্র সংক্রান্তি
শুক্লা গাঙ্গুলি
সোমদীপের আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে
মনের ভিতর বাস করা
কালবৈশাখী কথা বলে নিত?্যদিন-
মা বলতেন ঠাঁ ঠাঁ পোড়া রোদে কেউ
এলে জল-বাতাসা দাও
হাতপাখায় শান্ত করো তাকে-
কী আশ্চর্য গার্হস্থ্য!
শুধুই ভালোবাসার নিষ্ঠায় পূর্ণ ঘড়া
আমিও রেকাবে শখের মিষ্টান্ন সাজাই
পাণীয় রাখি গ্লাসে-
কেউই আসেনি চৈত্রে অথবা বৈশাখে
শুধু মা দাঁড়িয়ে থাকে রোদ চশমায়- চোখ দুটি রেখে নোনাজলে
জীবন থেকে খসে যায় কিছু সময়
চৈত্র সংক্রান্তিতে...!
যুগলবন্দী জাগরণ
শফিক ইমতিয়াজ
শীতের শাসন শেষে আড়মোড়া ভাঙা চপল প্রকৃতি
চকে মাঠে দলবদ্ধ শালিক; তাদের কলহের সুখ
মেঘের আলাপ ওই আকাশ দিগন্তে
হঠাৎ বৃষ্টির ছোঁয়া চুপজানালায়-
এলো কি গ্রীষ্মের দিন, মাঠের মলাট জুড়ে মৃদু খরবায়ু
বেনেপাড়াজাগে; নয়া বছরের স্বপ্নের রঙে প্রস্তুত হালখাতা।
এই অজর বাংলায় মানুষ ও প্রকৃতির কী যুগলবন্দী জাগরণ!
‘পহেলা বৈশাখ’ নামে এক মহাবৃক্ষতলে অগণিত মেলা
যাপন-নিঃশ^াসে লাগে চিরচেনা ঘ্রাণ
প্রাণের হিল্লোলে আঁকা সেসব মেলার রঙ যে দেখেনি
বোঝেনি বাংলার গূঢ়-গহীন অন্তর
কী বর্গ, কী ধর্ম-বর্ণ; আবালবৃদ্ধবণিতার ঢেউ
ধুম বিকিকিনি আর শুভ্র আনন্দ-উল্লাসে
মানুষের বুকে বুকে এগোবার ওম!
বাংলার জাগনপ্রিয় জন
এই দিনে পুরাতন দাগ ভুলে যেতে চায়
আশা ও সাহসে হাঁটে জীবনের কক্ষপথে, নবোদয় সূর্য যেন।
রোদ
হাবিবা রোজী
পশ্চিমে কাৎ হয়ে শুয়ে সূর্যটা মুচকি হেসে,
আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলেছে চারিধার।
নরম অবাধ্য রোদটা গরাদ গলে এলিয়ে পড়েছে
ঘরের আসবাবে,পাশ বালিশটায়।
বিষাদ ভেজা স্যাঁতসেঁতে মেঝেটা, আঙিনাটা,
কেমন চকচকে করে তুলল বৈশাখী সূর্যটা।
ওম ছুঁয়ে শর্করাহীন চায়ের মগে চুমুক দিতেই
মিষ্টি পুলকের আবেশে আপ্লুত হয়ে ওঠে উড়–ক্কু মন।
এমনদিনে শুকনো পাতার মতো
মুখগুমরো করে উড়ে যায় মেঘদল।
চুপিসারে মেঘ কানে কানে বলে যায়-
আজ মন ভালো করা বসন্তদিন।
এমন রোদধোয়া দিনগুলো স্থায়ী বসত গড়–ক
এপাড়া-ওপাড়া, প্রতিবেশীদের আঙিনায়।
শুক্র মাসে বক্র তাপ
শামস হক
গন্ধরাজ ফুলেরডালের সাথে লেপটে বসে থেকে সে ফুলের
গন্ধ নেয়ার দিন আজ আর নেই।
সুরভীত সেই দিন ভেসে গেছে
জলাধারের পাশের সেই আমগাছটা আজ আর নেই
আছে টুপ করে পড়ে যাওয়া সেই আমের গুটির দিকে
বুক সাঁতার দিয়ে আম কুড়ানোর স্মৃতিটুকু।
সেই জলাধার অট্টালিকার
¯্রােতে এখন ভেসে গেছে।
কাঁঠাল ফুলেরমঁ মঁ গন্ধে যে বাতাস আমার
কিশোর চোখে ঘুম এনে দিত
সেই কাঁঠাল গাছটা আজ আর নেই
সে গাছের কঙ্কালে নির্মিত আমার পালঙ্কে
ডিম লাইটের কান্না এখন ভেঙে ভেঙে পড়ে।
আমার সুখ আর শিহরন আজ ভেসে গেছে
খর বৈশাখের তাপদাহ মনতাপের কাছে আজ ¤্রয়িমাণ।
বশে রেখ
শেখ সালাহ্উদ্দীন
হয়তোবা তুমি নও সাধারণ
তিলোত্তমা, অনন্য
কেউ থাকে খুব উন্মুখ তাই
তোমাকে পাওয়ার জন্য
ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা হাসির অমন
যথেচ্ছ ব্যবহার
কেড়ে নিতে পারে কারো সব সুখ
রাতের ঘুম আহার।
তোমার চোখের মায়াবী অতলে
লুপ্ত যে আহবান
দুর্বল কিছু হৃদয় করবে
নিমেষেই খানখান
প্রশ্রয়-মাখা হাসি, ভ্রূকুটি বা
বিমূর্ত আচরণ
বশে রেখ- যেন অলক্ষ্যে কারো
ভাঙতে না পারে মন।
অভিমান
সাইফুল্লাহ আল মামুন
আমি চুম্বন এঁকেছি মাটিতে দিবানিশি
পেয়েছি দিগন্তে উলম্ব শস্যের উর্বর হাসি
আমি চুম্বন ছুঁড়েছি আকাশে মৃত্তিকা চুষি
দেখেছি মেঘের রূপান্তর, বৃষ্টি রাশি রাশি।
মধু-মল্লিকা দোলে বিদ্রোহী মিছিলে
আমি চুম্বনে এঁকেছি প্রিয়তমার গালে
বিশ্ব নাচে সে-ই আনন্দে সৃষ্টির তালে।
ইন্দ্রধনুর পীড়ন
যৌবনের চাষাবাদে
তুমিই আমায় জ্বালিয়ে দিলে
সুগন্ধীর তাগিদে।
আমি ঝরণার মতো অবশিষ্ট
বালিকা হৃদয়ের বন্ধন স্পষ্ট
প্রেমের চুম্বনে নাচে সমুদ্রের পৃষ্ঠ
বাষ্পের মতো উড়ে যায় ভালোবাসার কষ্ট।
গ্রহ নক্ষত্রের ব্যভিচার পতনের খেলা
আবিরে প্রজ্বলিত কথার গল্পমালা।
দিন শেষে আবেগ মিশ্রিত শব্দের দিন-লিপি
তুমি আমারে কত করুণা করেছো চুপি চুপি
জীবন! কোন শর্তে, কৃষ্ণপক্ষ রাতে
প্রদীপের হাসি বাতাসে মুহূর্তে মুহূর্তে
মুছে দিলে অন্ধকার জোনাকির সাথে।
ধূলিবালি কাদামাটি
অল্প কদমে হাঁটাহাঁটি
শস্যের মতোই শরীরে জমে খুনসুটি।
হেসে হেসে প্রাণবন্তপ্রতিদিনের কত প্রতিশ্রুতি
বলাকার পাখার মতো অনুভূতি পায় সরল গতি।
অভিমানহীন প্রেম ওজনে হালকা
কিছু অভিমান সঞ্চিত রেখো সখা,
অসীমের সীমারেখা হৃদয়ে জাগ্রত
ভালোবাসার জীবন
মান-অভিমানে জীবন্ত।
অভিমান স্বর্গীয় অনুরাগে অভিষিক্ত
স্নেহের ছোঁয়ায় গলে যায় বরফের মতো।
বৈশাখ আসছে
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া
বৈশাখ আসছে
নারীর কাখে কলসি ভরা জল হয়ে।
বৈশাখ আসছে খুশি খুশি
দেখি মুখ টিপে টিপে।
বৈশাখ আসছে হাটের থলেয়
বাবার হাতে সওদা হয়ে।
বৈশাখ আসছে পালকী করে
নতুন বউয়ের আগমনে।
বৈশাখ আসছে অপেক্ষা শেষে
ফলাফলের খবর পাতায়।
আসছে বৈশাখ মেলাজুড়ে
নাগরদোলার দোলায় দোলায়।
এটাও কী এক দৃঢ় বৈশাখ
ফুল গুঁজেছ তোমার খোঁপায়
রঙিন শাড়ির আভায় আভায়!
বৈশাখ আসছে পোয়াতি নারীর সন্তান সুখে
স্বপ্ন দেখেছে সে কত না রাত্রি জেগে জেগে!
বৈশাখ আসছে ভোরের মতো
দীর্ঘ রাতের অবসানে।
নদীবিষয়ক কবিতা
রহমান মুজিব
আরো কাঁদতে হবে কারণ আরো চাই নদী
মেঘের পিঞ্জিরায় গচ্ছিত নদীর জীবনশিরা
ঘুরছে পানিচক্রের লাটিম
ডিঙিতে সোনার পাল খাটিয়ে যে সওদাগর
পাড়ি দেয় এলাচগন্ধের বিকেল, তার চোখের
নীহারিকায় ক্রমশ লঘু হয় পিগমিদের ছায়া
আরো কাঁদতে হবে কারণ আরো চাই নদী
কান্নারা একদিন শরীরময় নদীর নাব্যতা মেখে
¯্রােতের উজানে বাজিয়ে যাবে ধানের কনসার্ট
বৈশাখে চতুর্দশপর্দী-১
আসাদ কাজল
তৃষ্ণার্ত বৈশাখ মাসে বৈশাখ কোথায়?
চৈত্রদাহে বৈশাখ তো আমার ভিতর
জীবনসম্মুখে একাকী বৈশাখী ব্যথায়
স্বপ্ন ছুঁয়ে ল-ভ- আমার এ ঘর।
শুভ্রতার দিনলিপি বৈশাখ কি জানে?
শতাব্দীর জীবন খাতায় সূর্য ওঠে?
মানুষের জীবন খাতায় যা যা ঘটে
বৈশাখ কি দিনশেষে সুর তোলে গানে?
মনচেতনায় তবু বৈশাখ ডেকেছি
আকাশের সান্ধ্যতারা দু’চোখে মেখেছি
কাল সাক্ষী রেখে নতুন যাত্রার পথে
সমর্পণ করি স্বপ্ন-বৈশাখীর রথে।
নববৈশাখ ঋতুর সম্মুখ ছায়ায়
জীবনে হারিয়ে যাই অজানা মায়ায়।
নতুন দুপুর
পুলিন রায়
পুরনো দিনের ছবিতে চোখ রাখি
পাখির পালকে জমা আছে স্মৃতি
আকাশের শরীরে রঙিন ঝালর ঝুলে
আমাকে ঘিরে রাখে সবুজ বন
চৈত্রের ঘুঘু ডাকা প্রহর
পাথরের বুকে ফোটা ফুলের মুচকি হাসি
অলকানন্দায় নতুন দিনের গানে
মন ডুবিয়ে সুখী শতবর্ষী বটবৃক্ষ
হাওর পারে আনন্দউৎসব ঘিরে ধরলে
স্মৃতিতে পড়ে টান, টের পাই
পায়ের নিচের মাটি এখনো বেশ শক্ত-সামর্থ্য
ও মাটি, ও ভাই ভাঁটফুল...
ছেড়ে যেও না, জড়ায়ে নাও বুকে
মেঘ সাক্ষী, সমুদ্রঢেউ গুনে বসে আছি
নতুন দুপুরের প্রতীক্ষায়
বিশাখা উপাখ্যান
আশরাফুল কবীর
বৈশাখের ঝড় হয়ে উড়ে আসো তুমি জলকুক্কুট;
ঘামের সিঁড়ি বেয়ে দিনদুপুরে উঠে আসো কোনো
জলদস্যুর সিলেবাস-বিহীন নিরেট হাত হয়ে;
এদিকে ভেতরে পুড়তে থাকে খাঁখাঁ রোদ্দুর!
নগরোপকণ্ঠে নেই কোনো বিধিনিষেধ
ভাঁটফুল আর নিশিগন্ধার মৌতাতে পঙ্ক্তি লিখে
অস্থির হয় স্বর্গ ও মর্ত্য, জলতেষ্টায় ভুলে যায়
সকল নিয়মতন্ত্র
ঝড় নেমে আসে
উপঢৌকনে ঝড়েরা এলিয়ে হাসে
তফাতে গাঁটছড়া বেঁধে দুঃসাহসী হয়ে ওঠে
আরও কিছু ডানকুনি ফুল
গুঞ্জরিত হয় সকল উত্তপ্ত বনাঞ্চল
নৈঃসঙ্গ্য ভেদ করে কেঁপে কেঁপে ওঠে
অঘোষিত দেবালয়; খানিকটা চঞ্চল ও গীতিময়
চলুক পালাগান নৈবেদ্যের শহরে সাথে নিয়ে প্রত্যয়
জেনে রেখো বিশাখা, জলবুদ্বুদ এ শহরে
-হয়েছে তপাত্যয়।
মুখ
জয়নাল আবেদীন শিবু
তোমার কপাল খুলেছে- নীল নিস্তব্ধতায়
জেগে আছে প্রাচীন নগরী- এ বছর আগাম
কালবৈশাখীর খবর নিয়ে এসেছে বাজপাখি
অরণ্যে অরণ্যে সবুজ সংকেত, ঘণ্টার ধ্বনি
স্বচ্ছ-শান্ত-জলে সাঁতার কাটে তোমার স্বর্ণরেণু শরীর
ফসলের মৌসুম এখন- চোখ খুলে বসে আছো
কমনীয় হাতে। তোমার এ স্থিরতা সুন্দর, সুনীল
অসীম নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তে...
চলমান অন্ধকারে এক অদ্ভুত বিভ্রমের ভিতর
আপাতত দেখে যাই তোমার রঙিন নীরব অবয়ব।
অন্ধকারে অমরাবতী
কুমকুম দত্ত
ভয়ংকর লোডশেডিং ছিল সেদিন সারারাত!
নিষ্পাপ শিশুর মুখ মৃত্যু উপত্যকা অসভ্য ইতর
উলঙ্গের শহরে আস্ফালন শোকের নদী রাতকানা
যে শহরে মৃত আমি নিঃসঙ্গ ভায়োলিন দূরের দূরবীন
নতমস্তকে বশীভূত স্বপ্নের ভূ-ভাগ অন্ধকারে অমরাবতী;
রাজা আসে রাজা যায় পায়ের ছাপ ক্রমাগত মুছে যায়
আড়ালে দৃষ্টি অখ- শিলালিপি বুকের ভূ-ভাগ;
অন্ধকার পলায়নপর রাত অধিগ্রহণ রণাঙ্গনের আকাশ
একটি সকালের শরীর
মহসিন খোন্দকার
হাল-চাষের শব্দের ভেতর বসে আছে জোড়া শালিক, ঘামকবিতায় ঝুলে থাকা মা’র পান্তা-শুটকির প্রেরণা আর বাজানের তৃপ্তির ঢেঁকুর আজ সমান্তরাল সমুচ্ছ্বাস!
হরহামেশা উচ্ছিষ্ট ভাত খাওয়া শালিকটি আম্মাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে,বাজান মাকে দ্বৈত জীবনের চাষবাস দেখান,মা হাসেন,বাজানের খুঁটিনাটি কথার ভেতর থেকে মাথা তুলে গার্হস্থ্য ঘাস, মা’র গোপন পোড়া মরিচের প্রশংসা করতে করতে বাজান-জলি ধানের কথা বলেন,গত কার্তিকে ঋণে মা’র নাকফুল খাওয়া দুঃস্বপ্নটি বাজানের হুক্কার নীল ধোঁয়ায় এখনো কেমন ঘুরাপাক খায়!
রেবাপু
যাকির সাইদ
তুমি আভির্ভূত হলে দেবীর মহিমা নিয়ে
আমার অন্তর্জগতে।
আমার মাথার উপর তোমার
স্নেহের ছায়া হৃদয়কে করেছে শীতল
সমুদ্রের বিশালতা নিয়ে
উন্মুক্ত হলো তোমার সত্যব্রত মন।
তুমি যেন এক আকাশ সুশীতল ছায়া।
বটবৃক্ষের মতো আমাকে দিয়েছ নিরাপদ আশ্রয়।
ঘিরে রখো তুমি মায়াময়, প্রেমময়,
মমতাময় আশীর্বাদের মন্দ্রিত সুরে।
আমার মাথার উপর থেকে নিও না
সরিয়ে এই পবিত্র আশীষ।
তুমি ভালো থেকো রেবাপু
কামনায় রেখো জগতের সকল
প্রাণীর মঙ্গল। আমি মেধাশূন্য, তবু
লিখে যাচ্ছি অক্ষম হাতে।
আমার কলম সচল রেখো তুমি।
মানবনামা
জলিল আহমেদ
কখনও রোদের মুখে মেঘ জমা হলে
দিনকি তাই থেমে থাকে, নাকি
লোকালয়ে হলে আলোঝড়,
রাত কি তাই দিন বলে খ্যাত হবে।
নদীতে জলের ধারা থেমে গেলে,
চরে জন্মালে বাড়িঘর,
তাহলেকি নামহীন হয়ে যাবে নদী।
রোদেরও মন থাক, তাই দিয়ে হয়ে যায় দিন।
রাতের অন্তর দিয়ে ঢেকে ফেলে আলো-অবয়ব,
নদীর সুশ্রী থেকে নেমে আসে মনের নাব্যতা।
পাষ- যতই ওই মানবে থাকুক
মনুষ্য হৃদয় ঠিকই দিবে মানবতা,
মন থেকে ব্যুৎপত্তি এই মানব নামের! ু
ভ্রাতৃত্ব-বৈভবে বৈশাখ
মিশকাত উজ্জ্বল
পৌষের পাতাঝরা বিষণœতার প্রহর শেষে
তৎপর ফাগুনের হরিৎ পল্লব-
পদ্য লেখে রাঙা শিমুল-পলাশের আলপনায়।
চৈত্রদাহে কৃষ্ণচূড়ার ডালে উত্তুঙ্গ লৌহিত্যের আধিপত্য
ঈশান-নৈর্ঋত প্রকম্পিত করে নামে প্রার্থিত বারিধারা।
সজীবতায় প্রাণ পায় ধূলিধূসর ঊষর প্রান্তর, লোকালয়...
চারুশিল্পীর নির্ঘুম রাতের ইজেলে আঁকা- লক্ষ্মীপেঁচা,
রাজহংসী, ময়ূরপক্সক্ষী, হাতিসমেত
রাজপথ দখলে নেয় মঙ্গলশোভাযাত্রার নতুন সূর্যোদয়।
রমনা বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখী গানের কোরাসে
হিঁদু-মুসলিম-খৃস্টান-বৌদ্ধের সৌহার্দের আবহে
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়-
“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...”
বর্ণিল শাড়ি, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত
কোটি বাঙালির প্রাণে জাগে ঐক্যের শিহরন।
দই-খই, মুড়ি-মুরকি, মিষ্টান্ন; বাহারি পসরায় মেতে ওঠে
প্রাণের বৈশাখী মেলা।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্য- ইলিশ-পান্তার মৌতাতে
আদৃত হয় বাঙালিয়ানা ভ্রাতৃত্ব-বৈভবের পহেলা বৈশাখ।