মহাদেব সাহা
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৈশাখের আনন্দধ্বনি এখনো আমার কানে বাজে; আমি শুনতে পাই সেই ঝুমঝুমি বাঁশির শব্দ, কী সে পাগলকরা বাঁশি, শিহরন জাগানো শৈশব জেগে ওঠে আমার মধ্যে, আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই নদীর তীরে সেই অষ্টমীর মেলা, হাতে হাতে শোলার পাখি, সুতো ধরে ঘোরালে কিচির মিচির শব্দ করে, মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, কাঠের পানসি, নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, তাতে চোখ লাগালে কতো সব ছবি, আকাশ, পাতাল, তাজমহল, হাওড়া ব্রিজ, কোনারক, আকুল করা সেই বৈশাখ; কোথায়, কোন দূর দেশে যে আমি চলে যাই, কোন পরী রাজ্যে, কোন রূপকথার দেশে? এই বৈশাখ, এই বালকবেলা, এই আনন্দের জগত খুঁজতে খুঁজতে আমি স্বপ্নরাজ্যে চলে যাই, বড়ো মধুর মায়াময়, কলমুখরিত, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, সারা মনপ্রাণ কাঁপিয়ে তোলে, মর্মমূল ছিঁড়ে যায়। আমার সেই বৈশাখ ছিল অসমাপ্ত এক সংগীত, এক অনিঃশেষ নদী, এক মাতাল ঝর্না।
সেই ভোর, সেই প্রসন্ন সকাল, সেই প্রথম দিনের প্রথম সূর্য, যেন প্রাণে গেঁথে আছে, ঘুম ভাঙতেই গ্রামোফোন রেকর্ডে আঙুরবালার গান, অসম্ভব মায়াবী সেই দিনরাত্রি, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি; মা ভোরের স্নান সেরে ঘরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালাচ্ছে, ধূপের গন্ধ, মঙ্গলঘট নিয়ে মঙ্গলজল ছিটোচ্ছে সারা বাড়ি, আমার মাথায় দিচ্ছে শান্তিজল, সে যেন স্বর্গের আলো, আলোকিত হয়ে ওঠে এই মর্ত্যলোক, আমার পৃথিবী; মায়ের হাতে দেওয়া সেই শান্তিজল আমি এখনো মাথায় দিয়ে আছি, সেই বৈশাখে, সেই পহেলা বৈশাখে আমি ডুবে আছি। এতো দুঃখ, এতো বঞ্চনার মধ্যেও সেই সুখ আমি কোথায় রাখি? সে যেন ভরিয়ে দেয় জীবন, ভরিয়ে তোলে, সেই লোকায়ত আনন্দধারা, সেই সবুজ প্রশান্ত কল্লোলিত গ্রাম, লোকঐতিহ্যের সেই অপার ঐশ্বর্য আমার শৈশব-কৈশোরের অফুরন্ত সম্পদ। মনে হয়, ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’ এই নানা দুঃখ-যাতনাভরা ক্ষুদ্র জীবনে মনে হয় ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, মনে হয়, কোথায় ‘ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ’, বর্ষে বর্ষে নববর্ষ পহেলা বৈশাখ আমাকে আনন্দস্রোতে ভাসিয়ে দেয়, আমার প্রাণে বেজে ওঠে সেই বাঁশি, সেই মঙ্গলধ্বনি, সেই নবজীবনের গান। এই বর্ণে গন্ধে বৈভবে আমি আজো সমান রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। যা হারিয়ে গেছে সেই সব ছোটো ছোটো সুখ, ছোটো ছোটো আনন্দ, ছোটো ছোটো স্বপ্ন আমি আহরণ করতে চাই। কিন্তু ‘কোথায় পাবো তারে’।
পাওয়ার কি উপায় নেই একেবারেই?
একটু স্পর্শ, একটু ঘ্রাণ, একটু মাদকতা? মন বড় কেঁদে ওঠে, বড়ো ব্যাকুল হয়ে যাই, যেতে ইচ্ছে করে সেই বিভূতিভূষণের নিশ্চিন্তপুরে, অপু, দূর্গার দুঃখের সংসারে, সেই কালবৈশাখী, সেই ঝড় বাউকুড়ানি, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কোঁচড় ভরে আম কুড়ানো, এই জীবনে বড় ইচ্ছে করে আবার সেই জীবনের গন্ধ নিতে, ছুঁয়ে দেখতে সেই মিষ্টি ভোর, মিষ্টি শৈশব, পাওয়া কি যায় না? একবারও না? যদি যেতো, যদি এই কপট মিথ্যা জীবনটাকে সরিয়ে দিয়ে সেই শুদ্ধ অমলিন আলোকিত জীবনকে এই জীবনের মধ্যে ফিরিয়ে আনা, যদি মুছে যেতো গ্লানি, মুছে যেতো জরা; সে কি যাবার নয়? তবে, ‘কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?’
তোমার গান যে গাইতে বলো, বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ, আমি সেই সুর খুঁজে পাইনে, হারিয়ে ফেলেছি, সেই আকাশ, সেই উন্মুক্ত প্রকৃতি, সেই আলো; প্রতিদিনের অসংখ্যা মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়েছি আমরা, হারিয়ে ফেলেছি শুদ্ধতা, হারিয়ে ফেলেছি সৌন্দর্য, হারিয়ে ফেলেছি সৌরভ; আজ শুধু সেই দূরের বাঁশি শুনি, শুনি শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ, ঝমঝম বৃষ্টির নৃত্যধ্বনি।
নব আনন্দে জাগো, জাগো দুর্বল, নিপীড়িত, হতমান, জাগো দেশ, জাগো জীবন, প্রস্ফুটিত হও, প্রসারিত হও, প্রবুদ্ধ হও; মুক্তিচেতনায় বলীয়ান হয়ে ওঠো স্বদেশ, ধ্বনিত হোক তোমার অভয়মন্ত্র, তোমার বিজয়গাথা, পরাজিত হোক অশুভ, অপশক্তি, দানব, তুমি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠো, প্রকাশিত হও, পুষ্পিত হও, বৈশাখের খরতাপে অগ্নিস্নানে তুমি শুচি হও, শুদ্ধ, জীবন্ত হও।
দূর হোক গ্লানি, দূর হোক জরা, তুমি শুচিস্মিতা হও বসুন্ধরা, ধরিত্রী, তোমার কণ্ঠে ধ্বনিত হোক নতুনের আগমনী বার্তা, নবজন্মের জয়গান, তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসায়, তোমার গন্ধে তোমার বিভোরতায় মুগ্ধ মথিত নিমজ্জিত করো; তুমি উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো, মঙ্গল করো। আমার মায়ের হাতে জ্বালানো পিলসুজে সেই মাটির প্রদীপ, সেই মঙ্গলশঙ্খের মঙ্গলধ্বনি আমাকে জাগ্রত করুক, বিমোহিত করুক, উদ্ভাসিত করুক; এই আকাশ এই প্রকৃতি এই লোকালয় ভরে উঠুক আলোয়, গন্ধে, ফলেফুলে জীবনে; কল্লোলিত বাংলার তেরো শত নদী, স্নিগ্ধ প্রশান্ত জলাশয় জীবনের সকল অপূর্ণতা ভরিয়ে দিক; সেই মিষ্টান্ন, সেই কলাপাতায় চিড়া-মুড়কি, দই-সন্দেশ, সেই মঁ মঁ গন্ধ চিনিচম্পা কলা, ঢ্যাপের মোয়া, তিলের লাড়–, সেই সোনামুখ, সেই সুক্ত, ডাঁটা চচ্চড়ি, ইঁচড়, ভাজা ইলিশের গন্ধ, বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ, তুমি ফিরে এসো আমাদের জীবনে, মাতৃস্নেহ হয়ে, ভরা বর্ষা হয়ে, মাটির গন্ধ হয়ে, আমি তোমাকে নমস্কার করি, হে বৈশাখ, রুদ্র মধুর, হে নতুন, হে ভাস্বর।
মহাদেব সাহা
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫
বৈশাখের আনন্দধ্বনি এখনো আমার কানে বাজে; আমি শুনতে পাই সেই ঝুমঝুমি বাঁশির শব্দ, কী সে পাগলকরা বাঁশি, শিহরন জাগানো শৈশব জেগে ওঠে আমার মধ্যে, আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই নদীর তীরে সেই অষ্টমীর মেলা, হাতে হাতে শোলার পাখি, সুতো ধরে ঘোরালে কিচির মিচির শব্দ করে, মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, কাঠের পানসি, নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, তাতে চোখ লাগালে কতো সব ছবি, আকাশ, পাতাল, তাজমহল, হাওড়া ব্রিজ, কোনারক, আকুল করা সেই বৈশাখ; কোথায়, কোন দূর দেশে যে আমি চলে যাই, কোন পরী রাজ্যে, কোন রূপকথার দেশে? এই বৈশাখ, এই বালকবেলা, এই আনন্দের জগত খুঁজতে খুঁজতে আমি স্বপ্নরাজ্যে চলে যাই, বড়ো মধুর মায়াময়, কলমুখরিত, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, সারা মনপ্রাণ কাঁপিয়ে তোলে, মর্মমূল ছিঁড়ে যায়। আমার সেই বৈশাখ ছিল অসমাপ্ত এক সংগীত, এক অনিঃশেষ নদী, এক মাতাল ঝর্না।
সেই ভোর, সেই প্রসন্ন সকাল, সেই প্রথম দিনের প্রথম সূর্য, যেন প্রাণে গেঁথে আছে, ঘুম ভাঙতেই গ্রামোফোন রেকর্ডে আঙুরবালার গান, অসম্ভব মায়াবী সেই দিনরাত্রি, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি; মা ভোরের স্নান সেরে ঘরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালাচ্ছে, ধূপের গন্ধ, মঙ্গলঘট নিয়ে মঙ্গলজল ছিটোচ্ছে সারা বাড়ি, আমার মাথায় দিচ্ছে শান্তিজল, সে যেন স্বর্গের আলো, আলোকিত হয়ে ওঠে এই মর্ত্যলোক, আমার পৃথিবী; মায়ের হাতে দেওয়া সেই শান্তিজল আমি এখনো মাথায় দিয়ে আছি, সেই বৈশাখে, সেই পহেলা বৈশাখে আমি ডুবে আছি। এতো দুঃখ, এতো বঞ্চনার মধ্যেও সেই সুখ আমি কোথায় রাখি? সে যেন ভরিয়ে দেয় জীবন, ভরিয়ে তোলে, সেই লোকায়ত আনন্দধারা, সেই সবুজ প্রশান্ত কল্লোলিত গ্রাম, লোকঐতিহ্যের সেই অপার ঐশ্বর্য আমার শৈশব-কৈশোরের অফুরন্ত সম্পদ। মনে হয়, ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’ এই নানা দুঃখ-যাতনাভরা ক্ষুদ্র জীবনে মনে হয় ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, মনে হয়, কোথায় ‘ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ’, বর্ষে বর্ষে নববর্ষ পহেলা বৈশাখ আমাকে আনন্দস্রোতে ভাসিয়ে দেয়, আমার প্রাণে বেজে ওঠে সেই বাঁশি, সেই মঙ্গলধ্বনি, সেই নবজীবনের গান। এই বর্ণে গন্ধে বৈভবে আমি আজো সমান রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। যা হারিয়ে গেছে সেই সব ছোটো ছোটো সুখ, ছোটো ছোটো আনন্দ, ছোটো ছোটো স্বপ্ন আমি আহরণ করতে চাই। কিন্তু ‘কোথায় পাবো তারে’।
পাওয়ার কি উপায় নেই একেবারেই?
একটু স্পর্শ, একটু ঘ্রাণ, একটু মাদকতা? মন বড় কেঁদে ওঠে, বড়ো ব্যাকুল হয়ে যাই, যেতে ইচ্ছে করে সেই বিভূতিভূষণের নিশ্চিন্তপুরে, অপু, দূর্গার দুঃখের সংসারে, সেই কালবৈশাখী, সেই ঝড় বাউকুড়ানি, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কোঁচড় ভরে আম কুড়ানো, এই জীবনে বড় ইচ্ছে করে আবার সেই জীবনের গন্ধ নিতে, ছুঁয়ে দেখতে সেই মিষ্টি ভোর, মিষ্টি শৈশব, পাওয়া কি যায় না? একবারও না? যদি যেতো, যদি এই কপট মিথ্যা জীবনটাকে সরিয়ে দিয়ে সেই শুদ্ধ অমলিন আলোকিত জীবনকে এই জীবনের মধ্যে ফিরিয়ে আনা, যদি মুছে যেতো গ্লানি, মুছে যেতো জরা; সে কি যাবার নয়? তবে, ‘কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?’
তোমার গান যে গাইতে বলো, বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ, আমি সেই সুর খুঁজে পাইনে, হারিয়ে ফেলেছি, সেই আকাশ, সেই উন্মুক্ত প্রকৃতি, সেই আলো; প্রতিদিনের অসংখ্যা মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়েছি আমরা, হারিয়ে ফেলেছি শুদ্ধতা, হারিয়ে ফেলেছি সৌন্দর্য, হারিয়ে ফেলেছি সৌরভ; আজ শুধু সেই দূরের বাঁশি শুনি, শুনি শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ, ঝমঝম বৃষ্টির নৃত্যধ্বনি।
নব আনন্দে জাগো, জাগো দুর্বল, নিপীড়িত, হতমান, জাগো দেশ, জাগো জীবন, প্রস্ফুটিত হও, প্রসারিত হও, প্রবুদ্ধ হও; মুক্তিচেতনায় বলীয়ান হয়ে ওঠো স্বদেশ, ধ্বনিত হোক তোমার অভয়মন্ত্র, তোমার বিজয়গাথা, পরাজিত হোক অশুভ, অপশক্তি, দানব, তুমি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠো, প্রকাশিত হও, পুষ্পিত হও, বৈশাখের খরতাপে অগ্নিস্নানে তুমি শুচি হও, শুদ্ধ, জীবন্ত হও।
দূর হোক গ্লানি, দূর হোক জরা, তুমি শুচিস্মিতা হও বসুন্ধরা, ধরিত্রী, তোমার কণ্ঠে ধ্বনিত হোক নতুনের আগমনী বার্তা, নবজন্মের জয়গান, তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসায়, তোমার গন্ধে তোমার বিভোরতায় মুগ্ধ মথিত নিমজ্জিত করো; তুমি উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো, মঙ্গল করো। আমার মায়ের হাতে জ্বালানো পিলসুজে সেই মাটির প্রদীপ, সেই মঙ্গলশঙ্খের মঙ্গলধ্বনি আমাকে জাগ্রত করুক, বিমোহিত করুক, উদ্ভাসিত করুক; এই আকাশ এই প্রকৃতি এই লোকালয় ভরে উঠুক আলোয়, গন্ধে, ফলেফুলে জীবনে; কল্লোলিত বাংলার তেরো শত নদী, স্নিগ্ধ প্রশান্ত জলাশয় জীবনের সকল অপূর্ণতা ভরিয়ে দিক; সেই মিষ্টান্ন, সেই কলাপাতায় চিড়া-মুড়কি, দই-সন্দেশ, সেই মঁ মঁ গন্ধ চিনিচম্পা কলা, ঢ্যাপের মোয়া, তিলের লাড়–, সেই সোনামুখ, সেই সুক্ত, ডাঁটা চচ্চড়ি, ইঁচড়, ভাজা ইলিশের গন্ধ, বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ, তুমি ফিরে এসো আমাদের জীবনে, মাতৃস্নেহ হয়ে, ভরা বর্ষা হয়ে, মাটির গন্ধ হয়ে, আমি তোমাকে নমস্কার করি, হে বৈশাখ, রুদ্র মধুর, হে নতুন, হে ভাস্বর।