alt

নববর্ষ সংখ্যা ২০২৫

অ্যামফিবিয়াস

সিদ্দিক বকর

: সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

লুকমান হেকিম ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে। দরজাটা পাথরের। ওটা খুললেই ঢুকে যাবে ক্ষমতার প্রাচীরঘেরা গুহায়। নির্বাচনের ঘুড়িটা আকাশে উড়ছে। জনগণ ওটাকে ঘুড়ি হিসাবেই জানে। সেই মধ্যযুগ থেকে মানুষ ও সমাজ দুইটা শ্রেণিতে বিভক্ত। বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত। দুই শ্রেণির দ্বন্দ্বের ফসল নতুন নতুন রেসিপি, বাসন-কোসন, থাকার ঘর, পড়ার স্কুল, চিকিৎসার হাসপাতাল, পরিধানের পাতলুন।

গণআন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটলে লুকমান হেকিমের গা-গতর চনমন করে। স্বপ্নের পোনারা দ্রুত ঝাঁকবেঁধে ফুট তুলে নদীর জলে। লুকমান হেকিমের মাথায় কৌশলের যতো প্রকার ডিজাইন ও সফটওয়্যার আছে তার সব চালু হয়ে যায়, স্বয়ংক্রিয়।

আবারো রক্তপাত আর প্রয়োজন নেই, অন্তত একটা লাশও আর নয়। এখন থেকে যা হবে সব অহিংস প্রক্রিয়ায়। এখন শুধু চাইলতা তলার আসনটা দখল করা হলো মূল কাজ। আসনে একবার বসতে পারলে নদীনালা খাল বিল বাজার হাট ঘাট সব আমার পকেটে এসে হামাগুড়ি দিয়ে পড়বে। লুকমান হেকিমের ফুলটঙ্গির খোপে খোপে স্টকে রাখা সর্বপ্রকার কবিরাজি বুদ্ধির পোকাদের ছেড়ে দেয়, ওরা পঙ্গপালের মতো সকল পাবলিকের মাথা দখল করে নিবে।

লুকমান হেকিম স¦প্নের ভিতর উত্তেজনায় পড়ে, দু’চারজন পকেটমানুষ সঙ্গে নিয়ে নদীতে যায় মাছেদের লাফালাফি দেখতে। দীর্ঘ কয়েক বৎসর, এই নদীতে পা রাখেনি লুকমান হেকিম, যা আর কিছুদিন পরই তার হস্তগত হতে যাচ্ছে আবার।

এ অবস্থায় তার মুখম-লে ভেসে ওঠে তেঁতুল, চাইলতা, জলপাই, আমের আচার খাওয়ার কারুকার্য। জিহ্বা ঠোঁট চাটতে চাটতে সে মৎস্যখালি নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ায়। নদীর শীতল বাতাসে বুক ভরে বেলুন হয়ে ওঠে। নদীজুড়ে অবারিত দৃষ্টির মেঘের ছায়া ফেলে। একখান ময়ূরপঙ্খি নাও যৌবনবতী নারীর শরীরের ভাঁজে মেলে ধরে আছে লুকমান হেকিমের সওয়ারের অপেক্ষায়। সেই নারীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট প্রতিস্থাপন করতেই ইঞ্জিন স্টার্ট হয়।

নদীর জল তলতলে শুয়ে আছে, ভীষণ নীরব। ¯্রােতও নেই।

টলটল স্বভাবের তাপটা দূরে, মাথা নিচু করে তাকালে ওপরের স্তরে একটা আলো থিরথির কাঁপে, জড়াজড়ি আলিঙ্গন করে থাকে জলের ভাপ ও তাপ।

লুকমান হেকিম নৌকার মাথায়, ছেওয়ে হাঁটু ভাঁজ করে, দু’হাত হাঁটুর ওপর রেখে বসে সেদিকেই তাকিয়ে আছে, নামাজ পড়ার নৈপুণ্যে। বড় মাছ পানির ওপর দিয়ে সাঁতার কাটলে কাঁটাটা জলের যতটুকু ওপরে ভাসে ঠিক ততটুকু জলের ওপর দিয়ে লুকমান হেকিমের দৃষ্টি প্রসারিত। এ মুহূর্তে নামাজ পড়ার ভঙ্গি অঙ্গে প্রতিস্থাপন করলেও কোনো হেনকালে নামাজ পড়তে কেউ তাকে দেখেছে এমন কথা কারো কাছে এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি।

এ নেহায়েতই ভেতরে অনুভূত প্রবল চাহিদা, কামনা ও বাসনার অনুভূতি ধ্যানে কনভার্ট করে বসার ভঙ্গিকে সাজিয়ে নেয়। সামনের দিকে প্রসারিত দৃষ্টির তীক্ষèতা যতো বাড়ে, দৃষ্টির এলাকার ভেতরের সকল মাছ তার দিকে দৌড়ে আসে, ঝাঁকে ঝাঁকে, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ- লাফিয়ে পড়ে তার রুকু ভঙ্গির কোলে, কোল যেন তার ব্যাংকের একাউন্ট, অশেষ যার জমা নেয়ার ক্ষমতা।

নৌকার হাল ধরে আছে যে মাঝি, নৌকার ছৈয়ার ভেতর দিয়ে বাছুরের মায়ের জিহ্বায় লুকমান হেকিমের রূপলালসা লোকন ও লেহন করে। বৈঠা ফেলছে অনবরত ধীরে, সমান তালে, চলার পদক্ষেপের ছন্দে, নৌকা এগুচ্ছে শীষ দিয়ে, বাঘ ও বিড়ালের শিকার ধরার অঙ্গবিন্যাসে। অতি সন্তর্পণে নৌকা যেন একটা টান টান দড়ির ওপর হেঁটে যাচ্ছে, সকল ভারসাম্য রক্ষা করে।

মাঝির চোখে বিভ্রম- লুকমান হেকিম যেন পাকা শিকারবৃত্তিগ্রস্ত এক শিকারি, দু’হাতে দুটি কুচ, দৃঢ়পায়ে দাঁড়িয়ে আছে নৌকার ছেওয়ে, জলেতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ। মাঝির মনে হয়, মাছের দেশে লুকমান হেকিমের নদীর ভেতর অধিক মনোযোগের কারণে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে নদীতেইনা পতিত হয় শেষে।

লুকমান হেকিম মাছের তলঘোরে পড়ে হঠাৎ তার মনে হয় নৌকা থেকে সে পড়ে যাচ্ছে, নৌকাটা যেন নদীর জল থেকে অনেক ওপরে, পড়ে যাচ্ছে, সহসাই সে নদীর জলে ডুবতে যাবে। পড়তে পড়তে দেখে নদীর জল সব লাল, রক্তনদী। নদীর জলে হাজার হাজার মাছ মাথা বের করে হা-মুখো- বোয়াল, রুই, কাতলা, পাঙ্গাস, আইড়, গজাল, ঘুচি- তার মাঝে মাঝে অগণিত সাপ ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, জিহ্বা লকলক। লুকমান হেকিমের নৌকা, নদী, জল, আসমান মাথায় নিয়ে সারা পৃথিবীসুদ্ধ ঘুরতে থাকে। সময়ের ভেতর অকস্মাৎ লুকমান হেকিম নৌকার ছেও থেকে পানিতে পড়ে যায়। মাঝির চিৎকার, বৈঠা ছেড়ে লাফ দেয় পানিতে, লুকমান হেকিমকে একহাতে, অন্যহাতে নৌকা ধরে সাঁতরায়, নৌকার অণ্য লোকজন তাদের টেনে তুলে। লুকমান হেকিমকে ছৈয়ার ভেতর নিয়ে শোয়ায়। কাপড় বদলে দেয়, গা মুছে। লুকমান হেকিম দেখে একাধিক সাপ তাঁকে পেঁচিয়ে, ছোপে ছোপে সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। নদীর সকল মাছেরা ঠুকরে ঠুকরে টুকরো টুকরো করে শরীরের মাংস খোলে। সে প্রাণপণ সাঁতরায়, নদীর পাড় খোঁজে।

একসময় পুরো নদীটা ছিল তার কাছে বিশাল আস্ত একটা দুধাল গাভী। গাভীটি বাড়ির সামনে একটি ফাঁকা জায়গায় মোটা একটা রেইনট্রি গাছের গোড়ায় বাঁধা, গাভীটার শতশত স্তন। শতশত মানুষ গাভীর বাঁট ধরে টানছে, বেরিয়ে আসছে রুই কাতলা আইড় পাঙ্গাশ ঘুচি কালিবাউশ গোলশা কাচকি। মাছ আর মাছ, খালি বিছরা, আঙ্গিনা, মাছে মাছে সয়লাব। লুকমান হেকিম ব্যাংকের ম্যানেজারের রুমে বসে, ম্যানেজার অনবরত লুকমান হেকিমের একাউন্টে জমা দেয়- মাছমুদ্রা।

লুকমান হেকিম এদিক সেদিক সাঁতরায় নদীর পাড় আর খোঁজে পায়না। মাছেরা তার শরীরের সারা মাংস খুলে খুলে আয়েশে খায়।

চোখে কুয়াশা ও ধোঁয়াশার ভেতর ভেসে ওঠে সেদিনের রক্তাক্ত লড়াইয়ের এপিসোড।

হাজার হাজার জেলে, নৌকা, নিমেষে নদী ঘেরাও। সৃষ্টি হয় নদীর মাঝে এক জীবন্ত শৈল্পিক নিদর্শন, পৃথিবীগোল অভেদ নৌকার প্রাচীর, অভ্রভেদী মানবশৃঙ্খল। আকাশমুখী উঁচিয়ে ধরা হাতে হাতে বৈঠার ফণা। জীবন্ত মানুষ, নৌকা, লগি, বৈঠা মিলে শূন্য সমতল অবলম্বনে তৈরি হয় এক জীব অন্ত কোলাজ। মাঝে একদল শকুনন্বেশী সশস্ত্র ভারাটে দখলদার। জেলেরা সবাই যখন হৈহৈ শব্দে সমবেত উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার দিয়ে ওঠে, আকাশ, চরাচর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়। হঠাৎ গুলির শব্দ- নদী উল্টে যায়, আকাশ বোবা, বাতাস শতচির, বৈঠা নি¤œমুখী, নদীর জল টাটকা লাল, সামনের সারি শৃঙ্খলমুক্ত। লুকমান হেকিম ইঞ্জিনের নৌকার ছৈয়ার ওপর হাতলওয়ালা সেগুন কাঠের চেয়ারে বসা, দুনালা বন্দুক হাতে। তার বাহিনী গুলি করতে করতে বেরিয়ে যায়। লুকমান হেকিম উঠে দাঁড়ায়। রাগে, ক্ষোভে শিকার সামনে বাঘ পায়চারি করে। হঠাৎ ছৈয়ার ওপর দুই পা কুপে বন্দুক শূন্যে উঁচিয়ে ফায়ার করতে থাকে। ধপাস করে চেয়ারে বসে, ওঠে। ইচ্ছে করে নদীতে ঝাপ দেয়। ডুবে মরে।

লুকমান হেকিম আরো প্রাণপণ সাঁতরায়। নদীর পাড়ের দেখা মেলে না।

এই মুহূর্তে লুকমান হেকিম কেঁপে কেঁপে ভাঙ্গে, হেসে হেসে গড়ে। সে ভাবে এ নদী এখন তার। যার হাত ধরে যা কিছু ক্ষমতার বদল ঘটে- তার হাতে সেই ক্ষমতা আসতে বাধ্য। জেলে সমাজের কাছে তার কদর বেড়ে গেছে বহুগুণ। জেলে সমাজ পুরোপুরি একটা অন্ধকার, আবদ্ধ সমাজ। একমাত্র মাছ ধরার ওপর তাদের জীবন নির্বাহ। ওদের একটু সুযোগ দিলে অপার সুযোগ নিজের একাউন্টে জমা, অটো। শিষ্যরা যারা প্রাণ দিবে মিছিলে, বক্তৃতা করবে সাতরাস্তার মোড়ে, ইউএনও অফিস ঘেরাও করবে যে কর্মীরা, জেলেদের কাফেলাকে সংগঠিত করবে, ওদের মাথায় পুরো নদীটা তুলে রাখলে আর কিছু লাগবে না। ওদের মাথায় নদী রেখে আমি খাবো মাছ। কিন্তু মাছের মুক্তিসেনাদের এমন টহল কেন? মাছেরা এমন মুক্তিবাহিনীর মতো আমার ওপর হামলে পড়েছে কেন? মাছেরা কী সব মুক্তিবাহিনী? কীসের লড়াইয়ে এরা নেমেছে! ’৭১ মুক্তিবাহিনী দেশ স্বাধীন করতে নেমেছিলো। এরা কি মুক্ত করতে চায়!

- প্রদীপ তুমি এখানে? তুমি এখানে কোত্থেকে আসলা! তুমি না চাইলতা তলার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলা।

- মরে গিয়ে বেঁচে গেছি কাকা। বেঁচে আছি বলেইনা আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল।

-তুমি আমাকেও বাঁচাও প্রদীপ দাস।

- সেদিনের কথা আমার আজো মনে পড়ে কাকা। আপনি যেন তাড়া খাওয়া এক হরিণ, দৌড়ে এসে, হাসপাতালের বেডে, আমার পাশে বসলেন, কপালে হাত রাখলেন, তখনো আমি মরিনি, যেন আপনার জন্যেই অপেক্ষায় ছিল আমার মৃত্যুর দূত, আমি আপনার হাতের আশ্রয়ে শেষ নিশ^াস ত্যাগ করলাম। একজন লুকমান হেকিম আমার মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে থাকলো, এই সান্ত¡না নিয়েই আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

- প্রদীপ তুমি আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাও ভাই। মাছেরা আমাকে খেয়ে ফেলবে।

- আপনি ভয় পাবেন না কাকা। ওরা আর আপনাকে কিছুই করবে না। ওরা আমার বন্ধু। ওরাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই জলদেশে।

লুকমান হেকিম দেখে, সকল জলপ্রাণি এখন আর তার শরীরের মাংস ঠুকরে ঠুকরে খুলে নিচ্ছে না। সবাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে। প্রদীপ দাস একটি নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাকে পথ দেখিয়ে। প্রদীপ দাস তাকে স্বসম্মানে নদীর পাড়ের দিকে নিয়ে যায়।

নদীর পাড়ে ওঠে সে অজানা গন্তব্যে আপ্রাণ দৌড়ায়।

লুকমান হেকিম ঘেরাওয়ের প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সে ও তার বাহিনী ফায়ার করতে করতে দ্রুত বেগে নৌকার গতি বাড়িয়ে মানবপ্রাচীর ভেঙে ফেলে। আন্দোলনকারীরা বাধ্য হয় ঘেরাও খুলে দিতে।

স্তম্ভিত আন্দোলন। সারাদিনের কøান্তি নিয়ে সূর্যও হেলে পড়েছে আকাশের পশ্চিম তীরে। রোদেরও তেজ নরোম হয়ে এসেছে।

নদীর জলে ¯্রােত নেই। জড়োসরো নিথর পড়ে আছে, সমূহ আতঙ্কগ্রস্ত। চতুর্দিকের বাতাস নিস্পন্দ, দমাটকা। অসংখ্য আন্দোলনকারী আহত। নৌকায় পড়ে আহত মানুষ কাতরাচ্ছে।

লুকমান হেকিম ও অন্যরা মিলে সকল আহত পাখি কাঁধে করে চাইলতা তলার হাসপাতালে যায়।

নদীর জল সূর্যাস্তের লাল পশ্চিমাকাশ। বাংলার পদ্মা মেঘনা যমুনা রক্তে লাল হয়ে যায়। জলদেশের প্রাণিরা ভয়-আতংকে সবাই নদীর তলদেশে মাটি সংলগ্ন হয়ে থাকে। সকল প্রকার জলজ প্রাণি মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে চায়। যাদের মাটির ভেতর বসবাস করে অভ্যস্ত, তারা দ্রুত ঢুকে যায় মাটির ভেতর।

নদীর জলও আতংকে ধীরস্থির। শত শত নৌকার বৈঠা, লগি পদ্ম পাতার মতো নির্বাক জলমগ্ন হয়ে পড়ে আছে জলে, নির্বাক ভাসছে। নদীর একটা অংশ পরিণত হয়েছে লগি বৈঠার বিছানায়। বিছানার আধারে আনন্দের কোনো প্রস্ফুটন নেই। জীবনের মূর্ত কোনো উচ্ছ্বাস নেই। নদীর জলে কোনো মার্চপাস্ট নেই। নদীর কিনারে কিনারে অসংখ্য হাঁস পাখি তরতর করে ভেসে বেড়াতো, আয়েসে আঁধার ধরতো, পাখায় মাথা গুজে ঘুমাতো। ঘুম-খাওয়ার কোনো অভাব ছিল না। সেই হাঁস পাখিরা দ্রুত সরে গেছে গোলাগুলির শব্দে, নদীর কিনারগুলো এখন বিরান শূন্য মাঠে পরিণত হয়েছে। হাঁসের সাঁতার নেই, পানকৌড়ির ডুব নেই। সবই নিস্তব্ধ, নিথর। জলের চলন নেই। শুধু জলের ভেতর রক্তের গতি পরিলক্ষিত হয়। ধীরে ধীরে নদীর জল লাল হয়, হয়ে চলেছে। কোথায় হবে এই লাল জলের নিষ্কাশন? মাছ, হাঁস, পানকৌড়িরা কি আর নির্ভয়ে আনন্দে সাঁতার কাটবে এই কৃত্রিম লাল জলে? মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা কি বিনষ্ট হয়ে যাবে? এই জলজ প্রাণিদের কি আর বংশবিস্তার হবে না!

চাইলতা তলার হাসপাতালও রক্তে ভেসে যায়। রক্তের ওপর হাসপাতাল টলটল কাঁপে। এক এক করে আহত মানুষেরা হাসপাতালে এসে জমায়েত হয়। ডাক্তার নার্সেরা হতবিহ্বল। এতো এতো রোগী যে,তাদের কর্তব্যপালনে ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। কাকে রেখে কাকে ধরে। ইতিমধ্যে আহতদের মা বাবা, আত্মীয়স্বজন এসে অস্থির ভীর করেছে। লুকমান হেকিম সকল আহতদের সেবায় নিয়োজিত। আহতদের কাছে-পিঠে থাকা, ডাক্তার নার্সদের সাথে কুশল বিনিময় করা, আহতদের আত্মীয়স্বজনকে সান্ত¡না দেয়া ইত্যাদি এমন কোনো কর্ম নেই যা লুকমান হেকিম করছে না। তার কর্মীদের সদা সতর্ক সচেতন থাকা, আহতদের প্রতি সহমর্ম থাকা- সকল দিক লুকমান হেকিম একা তদারকি করছে। যখনই সে একটু নীরব হচ্ছে, তখনই তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢেউ তুলছে একটিই ভাবনা- একটা মৃত্যু, শুধু একটা লাশ হলেই নদীর কর্তৃত¦ নিজের হাতের মুঠোয়, আর ঠেকায় কে!

লুকমান হেকিমের চোখের মণি দ্রুত আলোড়িত হয়- মাছ আর মাছ, রুই কাতল পাঙ্গাস চিংড়ি বোয়াল বাইন তারা চান্দা রূপচাঁদা গজার টেংরা কাইকা বেলে টাকি শোল বাউশ সিলভার কাচকি জাল ভরে ওঠে, হাজার হাজার মাছ একত্রে জালে ওঠে অনবরত লাফায়, সেই লাফানো মাছের লেজের জলছিটা এসে লুকমান হেকিমের নাকেমুখে ঝরাৎ ঝরাৎ করে লাগে, লুকমান হেকিম তার চোখ-নাক-মুখ বড়ো করে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। হুঁসে এসে চতুর্দিকে নিরিখ করে স্বাভাবিকে ফিরে আসে।

এদিকে লুকমান হেকিম ও তার দলবল ফায়ার করতে করতে নদী থেকে নিরাপদে পালিয়ে আসতে পারলেও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। যদি একজনও মানুষ মারা যায় তাহলে একটি হত্যা মামলা গলায় ঝুলবে। আবারও অনেকগুলো টাকা খসে যাবে। এতোকিছু করি টাকার জন্য সে টাকাই যদি চলে যায় তার চেয়ে মৃত্যু ভালো।

ঠিক এমন সময় একজন দৌড়ে এসে খবর দেয়, ‘এইমাত্র খবর এসেছে একজন মারা গেছে, আরও অনেকের মুমূর্ষু অবস্থা।’

চাইলতা তলার হাসপাতাল মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত।

হাসপাতালজুড়ে এক ন্যানো সেকেন্ডে খবর ছড়িয়ে পড়ে প্রদীপ দাস নামে একজন এইমাত্র মারা গেছে। এই আন্দোলনে একজনের মৃত্যুবরণ ঘটলো।

সাথে সাথে হাসপাতালের শক্ত প্রাচীর, আকাশ, বাতাস প্রকম্পিত করে শুরু হয় প্রতিবাদ মিছিল।

চাইলতা তলার বাজার বৈঠা ও লগি হাতে হাজার হাজার মানূুষ কাঁধে কাঁধ রেখে মিছিলে যোগ দেয়। স্লোগানে স্লোগানে চাইলতা তলার বাজার থরথর কাঁপে।

লুকমান হেকিম চাইলতা তলার হাসপাতাল থেকে মিছিল নিয়ে বাজারের মিছিলের সাথে যোগ দেয়।

মিছিলের অগ্রভাগে লুকমান হেকিম। সেই কখন সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধ্যার পাখিরা কূজন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সাতরাস্তার মোড়ে মিছিল এসে থামে।

বাজারে চা পানরত চা স্টলের মানুষেরা সামনে গরম চা নিয়ে উৎসুক হয়ে শোনার প্রস্তুতি নেয়, চা চুমুকের উষ্ণতায়।

সাতরাস্তার মোড়ের উপর আকাশ ছড়ানো রেইন-ট্রি গাছটা ডালে ডালে পাতার কা-ের মূলে মূলে সারাদিনের জমে থাকা উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতিতে। কিছুটা নুয়ে এসে মিছিলের অংশ হয়ে ওঠে তারা।

লুকমান হেকিম মিছিল শেষে গোল চত্বরের হাঁটু সমান প্রাচীরে ওঠে দাঁড়ায়।

আকাশের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত তোলে, বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গিও ভেতর, একটি ভাবনাই সাপের ফনারূপে ফুটে ওঠে-- নদীটা হাতের মুঠোয় চলে আসা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।

tab

নববর্ষ সংখ্যা ২০২৫

অ্যামফিবিয়াস

সিদ্দিক বকর

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

লুকমান হেকিম ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে। দরজাটা পাথরের। ওটা খুললেই ঢুকে যাবে ক্ষমতার প্রাচীরঘেরা গুহায়। নির্বাচনের ঘুড়িটা আকাশে উড়ছে। জনগণ ওটাকে ঘুড়ি হিসাবেই জানে। সেই মধ্যযুগ থেকে মানুষ ও সমাজ দুইটা শ্রেণিতে বিভক্ত। বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত। দুই শ্রেণির দ্বন্দ্বের ফসল নতুন নতুন রেসিপি, বাসন-কোসন, থাকার ঘর, পড়ার স্কুল, চিকিৎসার হাসপাতাল, পরিধানের পাতলুন।

গণআন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটলে লুকমান হেকিমের গা-গতর চনমন করে। স্বপ্নের পোনারা দ্রুত ঝাঁকবেঁধে ফুট তুলে নদীর জলে। লুকমান হেকিমের মাথায় কৌশলের যতো প্রকার ডিজাইন ও সফটওয়্যার আছে তার সব চালু হয়ে যায়, স্বয়ংক্রিয়।

আবারো রক্তপাত আর প্রয়োজন নেই, অন্তত একটা লাশও আর নয়। এখন থেকে যা হবে সব অহিংস প্রক্রিয়ায়। এখন শুধু চাইলতা তলার আসনটা দখল করা হলো মূল কাজ। আসনে একবার বসতে পারলে নদীনালা খাল বিল বাজার হাট ঘাট সব আমার পকেটে এসে হামাগুড়ি দিয়ে পড়বে। লুকমান হেকিমের ফুলটঙ্গির খোপে খোপে স্টকে রাখা সর্বপ্রকার কবিরাজি বুদ্ধির পোকাদের ছেড়ে দেয়, ওরা পঙ্গপালের মতো সকল পাবলিকের মাথা দখল করে নিবে।

লুকমান হেকিম স¦প্নের ভিতর উত্তেজনায় পড়ে, দু’চারজন পকেটমানুষ সঙ্গে নিয়ে নদীতে যায় মাছেদের লাফালাফি দেখতে। দীর্ঘ কয়েক বৎসর, এই নদীতে পা রাখেনি লুকমান হেকিম, যা আর কিছুদিন পরই তার হস্তগত হতে যাচ্ছে আবার।

এ অবস্থায় তার মুখম-লে ভেসে ওঠে তেঁতুল, চাইলতা, জলপাই, আমের আচার খাওয়ার কারুকার্য। জিহ্বা ঠোঁট চাটতে চাটতে সে মৎস্যখালি নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ায়। নদীর শীতল বাতাসে বুক ভরে বেলুন হয়ে ওঠে। নদীজুড়ে অবারিত দৃষ্টির মেঘের ছায়া ফেলে। একখান ময়ূরপঙ্খি নাও যৌবনবতী নারীর শরীরের ভাঁজে মেলে ধরে আছে লুকমান হেকিমের সওয়ারের অপেক্ষায়। সেই নারীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট প্রতিস্থাপন করতেই ইঞ্জিন স্টার্ট হয়।

নদীর জল তলতলে শুয়ে আছে, ভীষণ নীরব। ¯্রােতও নেই।

টলটল স্বভাবের তাপটা দূরে, মাথা নিচু করে তাকালে ওপরের স্তরে একটা আলো থিরথির কাঁপে, জড়াজড়ি আলিঙ্গন করে থাকে জলের ভাপ ও তাপ।

লুকমান হেকিম নৌকার মাথায়, ছেওয়ে হাঁটু ভাঁজ করে, দু’হাত হাঁটুর ওপর রেখে বসে সেদিকেই তাকিয়ে আছে, নামাজ পড়ার নৈপুণ্যে। বড় মাছ পানির ওপর দিয়ে সাঁতার কাটলে কাঁটাটা জলের যতটুকু ওপরে ভাসে ঠিক ততটুকু জলের ওপর দিয়ে লুকমান হেকিমের দৃষ্টি প্রসারিত। এ মুহূর্তে নামাজ পড়ার ভঙ্গি অঙ্গে প্রতিস্থাপন করলেও কোনো হেনকালে নামাজ পড়তে কেউ তাকে দেখেছে এমন কথা কারো কাছে এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি।

এ নেহায়েতই ভেতরে অনুভূত প্রবল চাহিদা, কামনা ও বাসনার অনুভূতি ধ্যানে কনভার্ট করে বসার ভঙ্গিকে সাজিয়ে নেয়। সামনের দিকে প্রসারিত দৃষ্টির তীক্ষèতা যতো বাড়ে, দৃষ্টির এলাকার ভেতরের সকল মাছ তার দিকে দৌড়ে আসে, ঝাঁকে ঝাঁকে, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ- লাফিয়ে পড়ে তার রুকু ভঙ্গির কোলে, কোল যেন তার ব্যাংকের একাউন্ট, অশেষ যার জমা নেয়ার ক্ষমতা।

নৌকার হাল ধরে আছে যে মাঝি, নৌকার ছৈয়ার ভেতর দিয়ে বাছুরের মায়ের জিহ্বায় লুকমান হেকিমের রূপলালসা লোকন ও লেহন করে। বৈঠা ফেলছে অনবরত ধীরে, সমান তালে, চলার পদক্ষেপের ছন্দে, নৌকা এগুচ্ছে শীষ দিয়ে, বাঘ ও বিড়ালের শিকার ধরার অঙ্গবিন্যাসে। অতি সন্তর্পণে নৌকা যেন একটা টান টান দড়ির ওপর হেঁটে যাচ্ছে, সকল ভারসাম্য রক্ষা করে।

মাঝির চোখে বিভ্রম- লুকমান হেকিম যেন পাকা শিকারবৃত্তিগ্রস্ত এক শিকারি, দু’হাতে দুটি কুচ, দৃঢ়পায়ে দাঁড়িয়ে আছে নৌকার ছেওয়ে, জলেতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ। মাঝির মনে হয়, মাছের দেশে লুকমান হেকিমের নদীর ভেতর অধিক মনোযোগের কারণে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে নদীতেইনা পতিত হয় শেষে।

লুকমান হেকিম মাছের তলঘোরে পড়ে হঠাৎ তার মনে হয় নৌকা থেকে সে পড়ে যাচ্ছে, নৌকাটা যেন নদীর জল থেকে অনেক ওপরে, পড়ে যাচ্ছে, সহসাই সে নদীর জলে ডুবতে যাবে। পড়তে পড়তে দেখে নদীর জল সব লাল, রক্তনদী। নদীর জলে হাজার হাজার মাছ মাথা বের করে হা-মুখো- বোয়াল, রুই, কাতলা, পাঙ্গাস, আইড়, গজাল, ঘুচি- তার মাঝে মাঝে অগণিত সাপ ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, জিহ্বা লকলক। লুকমান হেকিমের নৌকা, নদী, জল, আসমান মাথায় নিয়ে সারা পৃথিবীসুদ্ধ ঘুরতে থাকে। সময়ের ভেতর অকস্মাৎ লুকমান হেকিম নৌকার ছেও থেকে পানিতে পড়ে যায়। মাঝির চিৎকার, বৈঠা ছেড়ে লাফ দেয় পানিতে, লুকমান হেকিমকে একহাতে, অন্যহাতে নৌকা ধরে সাঁতরায়, নৌকার অণ্য লোকজন তাদের টেনে তুলে। লুকমান হেকিমকে ছৈয়ার ভেতর নিয়ে শোয়ায়। কাপড় বদলে দেয়, গা মুছে। লুকমান হেকিম দেখে একাধিক সাপ তাঁকে পেঁচিয়ে, ছোপে ছোপে সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। নদীর সকল মাছেরা ঠুকরে ঠুকরে টুকরো টুকরো করে শরীরের মাংস খোলে। সে প্রাণপণ সাঁতরায়, নদীর পাড় খোঁজে।

একসময় পুরো নদীটা ছিল তার কাছে বিশাল আস্ত একটা দুধাল গাভী। গাভীটি বাড়ির সামনে একটি ফাঁকা জায়গায় মোটা একটা রেইনট্রি গাছের গোড়ায় বাঁধা, গাভীটার শতশত স্তন। শতশত মানুষ গাভীর বাঁট ধরে টানছে, বেরিয়ে আসছে রুই কাতলা আইড় পাঙ্গাশ ঘুচি কালিবাউশ গোলশা কাচকি। মাছ আর মাছ, খালি বিছরা, আঙ্গিনা, মাছে মাছে সয়লাব। লুকমান হেকিম ব্যাংকের ম্যানেজারের রুমে বসে, ম্যানেজার অনবরত লুকমান হেকিমের একাউন্টে জমা দেয়- মাছমুদ্রা।

লুকমান হেকিম এদিক সেদিক সাঁতরায় নদীর পাড় আর খোঁজে পায়না। মাছেরা তার শরীরের সারা মাংস খুলে খুলে আয়েশে খায়।

চোখে কুয়াশা ও ধোঁয়াশার ভেতর ভেসে ওঠে সেদিনের রক্তাক্ত লড়াইয়ের এপিসোড।

হাজার হাজার জেলে, নৌকা, নিমেষে নদী ঘেরাও। সৃষ্টি হয় নদীর মাঝে এক জীবন্ত শৈল্পিক নিদর্শন, পৃথিবীগোল অভেদ নৌকার প্রাচীর, অভ্রভেদী মানবশৃঙ্খল। আকাশমুখী উঁচিয়ে ধরা হাতে হাতে বৈঠার ফণা। জীবন্ত মানুষ, নৌকা, লগি, বৈঠা মিলে শূন্য সমতল অবলম্বনে তৈরি হয় এক জীব অন্ত কোলাজ। মাঝে একদল শকুনন্বেশী সশস্ত্র ভারাটে দখলদার। জেলেরা সবাই যখন হৈহৈ শব্দে সমবেত উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার দিয়ে ওঠে, আকাশ, চরাচর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়। হঠাৎ গুলির শব্দ- নদী উল্টে যায়, আকাশ বোবা, বাতাস শতচির, বৈঠা নি¤œমুখী, নদীর জল টাটকা লাল, সামনের সারি শৃঙ্খলমুক্ত। লুকমান হেকিম ইঞ্জিনের নৌকার ছৈয়ার ওপর হাতলওয়ালা সেগুন কাঠের চেয়ারে বসা, দুনালা বন্দুক হাতে। তার বাহিনী গুলি করতে করতে বেরিয়ে যায়। লুকমান হেকিম উঠে দাঁড়ায়। রাগে, ক্ষোভে শিকার সামনে বাঘ পায়চারি করে। হঠাৎ ছৈয়ার ওপর দুই পা কুপে বন্দুক শূন্যে উঁচিয়ে ফায়ার করতে থাকে। ধপাস করে চেয়ারে বসে, ওঠে। ইচ্ছে করে নদীতে ঝাপ দেয়। ডুবে মরে।

লুকমান হেকিম আরো প্রাণপণ সাঁতরায়। নদীর পাড়ের দেখা মেলে না।

এই মুহূর্তে লুকমান হেকিম কেঁপে কেঁপে ভাঙ্গে, হেসে হেসে গড়ে। সে ভাবে এ নদী এখন তার। যার হাত ধরে যা কিছু ক্ষমতার বদল ঘটে- তার হাতে সেই ক্ষমতা আসতে বাধ্য। জেলে সমাজের কাছে তার কদর বেড়ে গেছে বহুগুণ। জেলে সমাজ পুরোপুরি একটা অন্ধকার, আবদ্ধ সমাজ। একমাত্র মাছ ধরার ওপর তাদের জীবন নির্বাহ। ওদের একটু সুযোগ দিলে অপার সুযোগ নিজের একাউন্টে জমা, অটো। শিষ্যরা যারা প্রাণ দিবে মিছিলে, বক্তৃতা করবে সাতরাস্তার মোড়ে, ইউএনও অফিস ঘেরাও করবে যে কর্মীরা, জেলেদের কাফেলাকে সংগঠিত করবে, ওদের মাথায় পুরো নদীটা তুলে রাখলে আর কিছু লাগবে না। ওদের মাথায় নদী রেখে আমি খাবো মাছ। কিন্তু মাছের মুক্তিসেনাদের এমন টহল কেন? মাছেরা এমন মুক্তিবাহিনীর মতো আমার ওপর হামলে পড়েছে কেন? মাছেরা কী সব মুক্তিবাহিনী? কীসের লড়াইয়ে এরা নেমেছে! ’৭১ মুক্তিবাহিনী দেশ স্বাধীন করতে নেমেছিলো। এরা কি মুক্ত করতে চায়!

- প্রদীপ তুমি এখানে? তুমি এখানে কোত্থেকে আসলা! তুমি না চাইলতা তলার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলা।

- মরে গিয়ে বেঁচে গেছি কাকা। বেঁচে আছি বলেইনা আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল।

-তুমি আমাকেও বাঁচাও প্রদীপ দাস।

- সেদিনের কথা আমার আজো মনে পড়ে কাকা। আপনি যেন তাড়া খাওয়া এক হরিণ, দৌড়ে এসে, হাসপাতালের বেডে, আমার পাশে বসলেন, কপালে হাত রাখলেন, তখনো আমি মরিনি, যেন আপনার জন্যেই অপেক্ষায় ছিল আমার মৃত্যুর দূত, আমি আপনার হাতের আশ্রয়ে শেষ নিশ^াস ত্যাগ করলাম। একজন লুকমান হেকিম আমার মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে থাকলো, এই সান্ত¡না নিয়েই আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

- প্রদীপ তুমি আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাও ভাই। মাছেরা আমাকে খেয়ে ফেলবে।

- আপনি ভয় পাবেন না কাকা। ওরা আর আপনাকে কিছুই করবে না। ওরা আমার বন্ধু। ওরাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই জলদেশে।

লুকমান হেকিম দেখে, সকল জলপ্রাণি এখন আর তার শরীরের মাংস ঠুকরে ঠুকরে খুলে নিচ্ছে না। সবাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে। প্রদীপ দাস একটি নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাকে পথ দেখিয়ে। প্রদীপ দাস তাকে স্বসম্মানে নদীর পাড়ের দিকে নিয়ে যায়।

নদীর পাড়ে ওঠে সে অজানা গন্তব্যে আপ্রাণ দৌড়ায়।

লুকমান হেকিম ঘেরাওয়ের প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সে ও তার বাহিনী ফায়ার করতে করতে দ্রুত বেগে নৌকার গতি বাড়িয়ে মানবপ্রাচীর ভেঙে ফেলে। আন্দোলনকারীরা বাধ্য হয় ঘেরাও খুলে দিতে।

স্তম্ভিত আন্দোলন। সারাদিনের কøান্তি নিয়ে সূর্যও হেলে পড়েছে আকাশের পশ্চিম তীরে। রোদেরও তেজ নরোম হয়ে এসেছে।

নদীর জলে ¯্রােত নেই। জড়োসরো নিথর পড়ে আছে, সমূহ আতঙ্কগ্রস্ত। চতুর্দিকের বাতাস নিস্পন্দ, দমাটকা। অসংখ্য আন্দোলনকারী আহত। নৌকায় পড়ে আহত মানুষ কাতরাচ্ছে।

লুকমান হেকিম ও অন্যরা মিলে সকল আহত পাখি কাঁধে করে চাইলতা তলার হাসপাতালে যায়।

নদীর জল সূর্যাস্তের লাল পশ্চিমাকাশ। বাংলার পদ্মা মেঘনা যমুনা রক্তে লাল হয়ে যায়। জলদেশের প্রাণিরা ভয়-আতংকে সবাই নদীর তলদেশে মাটি সংলগ্ন হয়ে থাকে। সকল প্রকার জলজ প্রাণি মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে চায়। যাদের মাটির ভেতর বসবাস করে অভ্যস্ত, তারা দ্রুত ঢুকে যায় মাটির ভেতর।

নদীর জলও আতংকে ধীরস্থির। শত শত নৌকার বৈঠা, লগি পদ্ম পাতার মতো নির্বাক জলমগ্ন হয়ে পড়ে আছে জলে, নির্বাক ভাসছে। নদীর একটা অংশ পরিণত হয়েছে লগি বৈঠার বিছানায়। বিছানার আধারে আনন্দের কোনো প্রস্ফুটন নেই। জীবনের মূর্ত কোনো উচ্ছ্বাস নেই। নদীর জলে কোনো মার্চপাস্ট নেই। নদীর কিনারে কিনারে অসংখ্য হাঁস পাখি তরতর করে ভেসে বেড়াতো, আয়েসে আঁধার ধরতো, পাখায় মাথা গুজে ঘুমাতো। ঘুম-খাওয়ার কোনো অভাব ছিল না। সেই হাঁস পাখিরা দ্রুত সরে গেছে গোলাগুলির শব্দে, নদীর কিনারগুলো এখন বিরান শূন্য মাঠে পরিণত হয়েছে। হাঁসের সাঁতার নেই, পানকৌড়ির ডুব নেই। সবই নিস্তব্ধ, নিথর। জলের চলন নেই। শুধু জলের ভেতর রক্তের গতি পরিলক্ষিত হয়। ধীরে ধীরে নদীর জল লাল হয়, হয়ে চলেছে। কোথায় হবে এই লাল জলের নিষ্কাশন? মাছ, হাঁস, পানকৌড়িরা কি আর নির্ভয়ে আনন্দে সাঁতার কাটবে এই কৃত্রিম লাল জলে? মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা কি বিনষ্ট হয়ে যাবে? এই জলজ প্রাণিদের কি আর বংশবিস্তার হবে না!

চাইলতা তলার হাসপাতালও রক্তে ভেসে যায়। রক্তের ওপর হাসপাতাল টলটল কাঁপে। এক এক করে আহত মানুষেরা হাসপাতালে এসে জমায়েত হয়। ডাক্তার নার্সেরা হতবিহ্বল। এতো এতো রোগী যে,তাদের কর্তব্যপালনে ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। কাকে রেখে কাকে ধরে। ইতিমধ্যে আহতদের মা বাবা, আত্মীয়স্বজন এসে অস্থির ভীর করেছে। লুকমান হেকিম সকল আহতদের সেবায় নিয়োজিত। আহতদের কাছে-পিঠে থাকা, ডাক্তার নার্সদের সাথে কুশল বিনিময় করা, আহতদের আত্মীয়স্বজনকে সান্ত¡না দেয়া ইত্যাদি এমন কোনো কর্ম নেই যা লুকমান হেকিম করছে না। তার কর্মীদের সদা সতর্ক সচেতন থাকা, আহতদের প্রতি সহমর্ম থাকা- সকল দিক লুকমান হেকিম একা তদারকি করছে। যখনই সে একটু নীরব হচ্ছে, তখনই তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢেউ তুলছে একটিই ভাবনা- একটা মৃত্যু, শুধু একটা লাশ হলেই নদীর কর্তৃত¦ নিজের হাতের মুঠোয়, আর ঠেকায় কে!

লুকমান হেকিমের চোখের মণি দ্রুত আলোড়িত হয়- মাছ আর মাছ, রুই কাতল পাঙ্গাস চিংড়ি বোয়াল বাইন তারা চান্দা রূপচাঁদা গজার টেংরা কাইকা বেলে টাকি শোল বাউশ সিলভার কাচকি জাল ভরে ওঠে, হাজার হাজার মাছ একত্রে জালে ওঠে অনবরত লাফায়, সেই লাফানো মাছের লেজের জলছিটা এসে লুকমান হেকিমের নাকেমুখে ঝরাৎ ঝরাৎ করে লাগে, লুকমান হেকিম তার চোখ-নাক-মুখ বড়ো করে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। হুঁসে এসে চতুর্দিকে নিরিখ করে স্বাভাবিকে ফিরে আসে।

এদিকে লুকমান হেকিম ও তার দলবল ফায়ার করতে করতে নদী থেকে নিরাপদে পালিয়ে আসতে পারলেও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। যদি একজনও মানুষ মারা যায় তাহলে একটি হত্যা মামলা গলায় ঝুলবে। আবারও অনেকগুলো টাকা খসে যাবে। এতোকিছু করি টাকার জন্য সে টাকাই যদি চলে যায় তার চেয়ে মৃত্যু ভালো।

ঠিক এমন সময় একজন দৌড়ে এসে খবর দেয়, ‘এইমাত্র খবর এসেছে একজন মারা গেছে, আরও অনেকের মুমূর্ষু অবস্থা।’

চাইলতা তলার হাসপাতাল মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত।

হাসপাতালজুড়ে এক ন্যানো সেকেন্ডে খবর ছড়িয়ে পড়ে প্রদীপ দাস নামে একজন এইমাত্র মারা গেছে। এই আন্দোলনে একজনের মৃত্যুবরণ ঘটলো।

সাথে সাথে হাসপাতালের শক্ত প্রাচীর, আকাশ, বাতাস প্রকম্পিত করে শুরু হয় প্রতিবাদ মিছিল।

চাইলতা তলার বাজার বৈঠা ও লগি হাতে হাজার হাজার মানূুষ কাঁধে কাঁধ রেখে মিছিলে যোগ দেয়। স্লোগানে স্লোগানে চাইলতা তলার বাজার থরথর কাঁপে।

লুকমান হেকিম চাইলতা তলার হাসপাতাল থেকে মিছিল নিয়ে বাজারের মিছিলের সাথে যোগ দেয়।

মিছিলের অগ্রভাগে লুকমান হেকিম। সেই কখন সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধ্যার পাখিরা কূজন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সাতরাস্তার মোড়ে মিছিল এসে থামে।

বাজারে চা পানরত চা স্টলের মানুষেরা সামনে গরম চা নিয়ে উৎসুক হয়ে শোনার প্রস্তুতি নেয়, চা চুমুকের উষ্ণতায়।

সাতরাস্তার মোড়ের উপর আকাশ ছড়ানো রেইন-ট্রি গাছটা ডালে ডালে পাতার কা-ের মূলে মূলে সারাদিনের জমে থাকা উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতিতে। কিছুটা নুয়ে এসে মিছিলের অংশ হয়ে ওঠে তারা।

লুকমান হেকিম মিছিল শেষে গোল চত্বরের হাঁটু সমান প্রাচীরে ওঠে দাঁড়ায়।

আকাশের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত তোলে, বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গিও ভেতর, একটি ভাবনাই সাপের ফনারূপে ফুটে ওঠে-- নদীটা হাতের মুঠোয় চলে আসা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।

back to top