আহসান ইকবাল
জোৎস্নার মতো ঘোরলাগা রোদে দাঁড়িয়ে ছেলেটা আঙ্গুল দিয়ে পায়ের মাটিতে বৃত্তের মতো আঁকিবুঁকি কাটে। সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো অনেকক্ষণ না, এটা তারই বিভ্রম এইতো কিছুক্ষণ হবে হয়তো। তখন মাথার ওপর কৃষ্ণচূড়ার ডালপালাগুলো ছায়ার বিস্তৃতি ঘটিয়ে চলেছে গুটিগুটি পায়ে। সকালের দিকে একপশলা বৃষ্টি নেমেছিলো সারাদিন বয়ে যাবে এমন আষাঢ়স্য উচ্ছ্বাস নিয়েই। একটু পরেই থেমে থেমে ঝির ঝিরে গরমে সবাইকে অতিষ্ঠ করে থেমে গেলেও আকাশটা থমথমে নীলাভ ছাই ছাই মুখে তাকিয়ে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ছড়ানো ছিটানো ফুলগুলো দেখছিলো। তার কিছু থেতলে গেছে, কিছু এখনো হাতে তুলে নেবার মতো ঝকঝকে। ছেলেটা দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়তে মুখ তুলে আকাশের ছাই ছাই নীলে সিঁদুর লাল আর সবুজের ওপর আলগা বাম্প করা আলোয় পুরো গাছটায় কতগুলো ফুল ফুটে আছে গুনে ফেলে যেন।
বাতাসে দুলতে দুলতে তাদের কিছু সখা-সখি তখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সে সব মনে করে আমরা বলতে পারি ছেলেটি অনেকক্ষণ অপেক্ষায় এখানেই দাঁড়িয়ে আছে, আর বাতাসটাকে তার মতো দম আটকে রাখতে বাধ্য করেছে। আজ সে সময়কেও আটকে ফেলতে মরিয়া। আনমনে বাঁ-হাতের দিকে তাকিয়ে ঘড়িচাপা হয়ে থাকা উজ্জ¦ল অংশটা দেখে সে পকেট থেকে টিকটিক শব্দটা আন্দাজে আনতে পারে। আর একটু এগিয়ে সামনের রাস্তার মোড়ের দিকে গলা বাঁকিয়ে একটা রিকশা তার দিকে এগিয়ে আসছে কি না দেখবার ইচ্ছা করে মুহূর্তে লুট হয়ে যাবার মতো সম্বলহীন মনে করে টাল খায় একটু। হয়তো মাটিটা একটু ভেজা ছিলো বা সে সামনের দিকে ঝুঁকবার কারণেই একটু ইমব্যালান্স হয়ে পড়েছিলো। অনেক কষ্টে পকেটে থাকা ফোনটায় হাত বুলিয়েও কোনো মেসেজ এলো কি না দেখে নেবার লোভ সম্বরণ করে। একটা তক্ষক তখন তার একাকিত্ব বাড়িয়ে দেবার জন্য থেমে থেমে একভাবে ডাকতে শুরু করে। হালকা একটু বাতাস দুপুরের গুমোট ভাবটা কাটাতেই যেন পাতার ফাঁকফোকড়ে জমে থাকা কিছু বৃষ্টির পানি তখনই ঝরিয়ে দেয়। নির্দ্দিষ্ট সময় থেকে তখন ১৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। ছেলেটা তার সময়ের হিসাব নিকাশ বাদ দিতে পকেটে হাত দিয়ে ঘড়িটা চেপে ধরে চুনা আর শ্যাওলা ধরা দেওয়ালে হেলান দেয়।
এরও প্রায় ১৩ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড পর মেয়েটার রিকশা এসে দাঁড়ায় ছেলেটার কাছাকাছি দেওয়ালের গা ঘেঁষে। ছেলেটা তার হাতের মুঠোয় ধরা ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার মিহি ধাক্কার সাথে সাথে সময় গুনতে এত মগ্ন ছিলো যে প্রথমে মেয়েটিকে ঠিক দেখতে পায়নি। সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করে আর দোতালা ছাদে উঠবার সিঁড়িতে উঠতে উঠতে পিছনে কাপড়ের মৃদু খসখস শব্দে বুঝে নেয় মেয়েটাও তার পিছু পিছু উঠে আসছে।
ছোট্ট একটা চিলেকোঠার মতো সিঁড়ির শেষে ল্যান্ডিং এ একটা খাট পাতা। যার বিছানা, তেলশিটে পড়া বালিশ আর দেওয়ালে ঝোলানো গুটিয়ে রাখা মশারির ওপর কয়েকটা জামাকাপড় দেখে বোঝা যায় এখানে কেউ নিয়মিত থাকে। তার সামনে রেলিংয়ের দেওয়ালে ঠেস দেওয়া একটা একপা ভাঙ্গা টেবিল যার উপর একটা থালা আর গ্লাস উপুড় করে রাখা। ছেলেটি চেয়ারে বসে পড়তে মেয়েটি ছাদে যাবার দরজার দিকের খাটের কোনায় বসে পড়ে। দু’জন দু’জনের দিকে এতক্ষণ একবারও তাকায় না। ছেলেটি চেয়ারের পেছনের দু’পায়ার উপর ভর দিয়ে পেছনে হেলে একটু দোল খেতে খেতে এসব আলতো করে দেখতে দেখতে ভাবছিলো কোথা থেকে শুরু করা যায় এমন অবস্থায় যখন তাদের অনেক দিন কোনো কথা হয় না, এমনকি দেখাও নেই। আগে হলে হয়তো এতক্ষণে নিঃশব্দ হাসি মিলিয়ে যেত দু’জনের ঠোঁটের বন্ধনে। যতক্ষণ পাওয়া যায় দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে বুঝে নিতে চাইতো, খুঁজে নিতে চাইতো তাদের আটকে রাখা অনুভূতিগুলোকে। ছেলেটি দেওয়ালে সিমেন্ট লেপা বিচিত্র, গোপন শিল্পকর্মের মিনিং উদ্ধার করতে করতে, মনে করতে পারে না তাদের সহজ না হবার সেই কারণ। তার বুকের ভেতর গড়িয়ে চলা পাথর বরফের মতো ভিজতে থাকে। সে আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয় মেয়েটি আজ শাড়ি পরেছে। হালকা ইয়লো একটা সুতি শাড়িতে তাকে একদম অচেনা না লাগলেও অন্যরকম লাগছে। এতদিনের চেনা মানুষটাকে অপ্রত্যাশিতভাবে এমন অচেনা পোশাকে দেখে তার নিজেকে আরো অচিন লাগে। আচ্ছা ছেলেটা কি তখন মেয়েটার গায়ে তার পরিচিত কাপড়ের ডিটারেজেন্ট, এনচেন্টার পাউডার আর সাবান, হালকা বডি স্প্রে বা পারফিউম, ঘামের মিশ্র গন্ধটা খুঁজতে চাইবে? সে তখন একটা ভারি নিশ্বাস টেনে সেটা পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিনা বোঝা যায় না। মেয়েটি তার ঝোলানো পায়ের সেন্ডেলটা মৃদু বাতাসের মতো দোলাতে দোলাতে আঁচল দিয়ে ঘেমে ওঠা ঠোঁটের ওপর জমা ঘাম মোছে, গলাটা মুছতে মুখটা একটু তুলতে ছেলেটার কাছে মেয়েটার গায়ের রংটা আরো চাপা লাগে।
- খুব গরম লাগছে!
- হুম
মেয়েটা আলতো বলা না বলার মতো একটা শব্দ করে অস্থিরভাবে আঁচলের খুটে আঙ্গুল পেঁচাতে ব্যস্ত হয়। ছেলেটাও দ্রুত উঠে ছাদের লোহার দরজার হুড়কো তুলে দিতে দিতে মনে মনে বুঝিয়ে দিতে চায়, আজ তোমাকে আমার ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছা নাই। জোৎস্নার মতো এক ফালি রোদ বাতাসের সাথে সাথে ল্যান্ডিং-এর এই রুমের মতো জায়গাটায় ঢুকে পড়ে গুমোট ভাবটা একটু তাড়িয়ে দেয়। আনমনা বাতাসে মেয়েটার খোলা চুলের কিছু, কপালের কয়েকটা চুল সামনের দিকে এলোমেলো দোল খেলে ছেলেটা ফের চেয়ারে বসতে বসতে ভাবে চুলগুলো কানের পাশে এনে গুঁজে দেবে। মেয়েটার মুখে, হাতের খোলা অংশে তখন উজ্জ্বল হলুদ আভা পিতলের মতো উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়েছে। কোথা থেকে একটা মৌমাছি মেয়েটার মুখে আচমকা গুঁতা খেতে খেতে সামলে নিয়ে সামনে দিয়ে গুনগুনিয়ে চলে যেতেই মেয়েটি একটু আঁতকে ওঠে।
- চলে গেছে।
মেয়েটা একটু অপ্রস্তুত ভাবে হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সহজ হতে চায়।
- পা উঠিয়ে বসো।
- না থাক, কাপড়ে ভাঁজ পড়বে।
মেয়েটা মৃদু বিব্রত স্বরে বলে বুঝিয়ে দেয় যেন, আজ তারও কাছে যাবার ইচ্ছা নেই, সে জন্যই সে শাড়ি পরেছে। অন্য সময় হলে ছেলেটি বলতো ‘আমি শাড়ি পরিয়ে দেবো, এমন আর কঠিন কি!’, মেয়েটি তখন বলতো, “জি না, থাক। আমি লুঙ্গির গিঁট দেওয়া শাড়ি পরে বাসায় যেতে পারবো না।”
তারা দু’জন কি একই ভাবছিলো? মেয়েটি অস্বস্তিতে ভাবনাটা সরাতেই যেন মুখ নিচু না করে, এবার ঘুরিয়ে দরজা দিয়ে ছাদের দিকে তাকায়। মেয়েটার দৃষ্টি লক্ষ্য করে ছেলেটি বাইরে তাকিয়েই যেন মাথার ভেতর মৃদু ধাক্কা অনুভব করে। নিউরনের ভেতর রাগের মেঘমালা পরতে পরতে ঘন হতে হতে সারা শরীরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। রোদ পড়ে আসছে, আর তার চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে মনে করাতেই কি সে বাইরে তাকালো এমন করে!
- আবার বৃষ্টি নামতে পারে।
অস্ফুটে বলেই মেয়েটা থমকে যায়। সে বোঝে ছেলেটা কথাটা সহজভাবে নিতে পারবে না। মেয়েটা পায়ের স্লিপারটা খসিয়ে আসনগড়া হয়ে বসার চেষ্টা করে, এখনই উঠছে না বোঝাতেই যেন। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে মেয়েটাকে এলো চুল পেছনে বাঁধতে দেখে ভিতরে ভিতরে টুপটাপ ভিজতে থাকে। দু’হাতে মেয়েটির মুখটা চেপে ধরে তার চোখের দীঘিতে ডুব সাঁতার কাটতে ইচ্ছা হয়। মেয়েটি অনেকক্ষণ আটকে থাকা শ্বাসটা খুব লুকিয়ে ছাড়তে ছাড়তে ভাবে, এখন ওর হাতটা একটু এগিয়ে ধরা যাবে কেমন করে যদি ও এগিয়ে না আসে। আর ঠিক তখনই ছেলেটা তার সবসময়ের ভঙ্গি পাল্টে চেয়ারের সামনের পায়া দু’টো নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে। মেয়েটার অনেকটাই কাছে এগিয়ে, আবার এতটা কাছে না যে মেয়েটা একটু হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁতে পারবে।
- কী বলে বের হলে?
এতক্ষণে তারা দু’জন দু’জন চোখের দিকে তাকিয়ে আটকে থাকে। মুহূর্তে মেয়েটা বুঝে নেবার চেষ্টা করে তার এই কথার অন্য কোনো মানে আছে নাকি।
- বললাম বান্ধবীর বাসায় যাবো, মিস করা ক্লাসগুলোর নোটস নিতে।
ছেলেটা একটু থমকায়। মনে মনে বুঝে, হিসাব কষে নিতে চায় তাহলে আর কতক্ষণ সময় ওকে পাওয়া যাবে। মেয়েটি ছেলেটিকে বুঝেই হাতের সোনার চুড়িটা ঘুরাতে ঘরাতে বলে
- আমি বলেছি বিকালের দিকে চলে আসবো।
বলে স্মিত হেসে ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি মেয়েটির হাতঘড়ির জায়গায় চুড়ি পরা হাতটা দেখতে থাকে। তার হাতটা ধরবার জন্য মন টানে। দু’হাতের দশটা আঙ্গুলে ওর আঙ্গুল জড়ানোর অভিজ্ঞতা জেগে ওঠে। ওর বারবার ঘড়ি দেখবার ব্যাপারটা সে নিতে পারে না বলেই কি মেয়েটা আজ ঘড়ি পরেনি। সে মেয়েটার পাশে শুয়ে থাকা মানিব্যাগের মতো পার্সটার ঢাউস পেটটা দেখে বুঝে ফেলে মোবাইল আর ঘড়ি দুইটাই ব্যাগটায় ঠাসাঠাসি করে জায়গা করে নিয়েছে। মেয়েটি অস্ফুট স্বরে, “কী বলবে যেন, বল?”
মেয়েটি দেখে ছেলেটি কোথা থেকে শুরু করবে, কী বলবে বুঝতে না পেরেই যেন ব্যস্তভাবে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে, কাঁপাকাঁপা হাতে সিগারেট ঠোঁটে দেয়, দেখে সে একটু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে চোখ ফেরায়। সিঁড়িগুলো কেমন আলো থেকে ছায়া ছায়া হয়ে নেমে আঁধারে ব্লেন্ড হয়ে গেছে। ঠিক তখনই এক ঝলক ধোঁয়া তার ফুসফুসে ঢুকে পড়লে সে একটু কেশে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চাপতে গিয়েও হাতটা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটা একটু অপ্রস্তুত ভাবে সিগারেট নামিয়ে, “আসছি” বলে চেয়ার ছেড়ে ছাদের দিকে উঠে চলে যায়। ধোঁয়ার কারণে কিনা, ঠিক বোঝা যায় না মেয়েটার চোখ জ¦ালা করতে থাকে। ছেলেটার পরে থাকা ভাজ পড়া টিশার্টটা যেন হ্যাঙ্গারে ঝুলে যেতে যেতে কড়া তামাকের গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে গেল। এই মুহূর্তে শ্বাসকষ্টটা যেন ফিরে না আসে, সেই জন্য প্রার্থনা করতে করতে মেয়েটা সোজা হয়ে বসে বুক ভরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে। নিজেকে সহজ স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে সে ভেবে নেয়, কটা বাজতে পারে। বা এমন হতে পারে শ্বাসকষ্টের ব্যাপার থেকে সে মনোযোগ অন্য কোথাও দিতে চাইছে। ক’দিন হবে, শেষ দেখা হবার পর সাতটা দিন পার হয়ে গেছে! প্রতিবছর বসন্তের পরপরই শ্বাসের কষ্টটা শুরু হয়, এবার একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে সপ্তাহখানেক হলো আনবেয়ারেবল রকম বেড়ে গেছে। রাতের পর রাত নির্ঘুম, শুধু শ্বাসকষ্টের সাথে তার একার যুদ্ধ। একটু সোজা হলে বা নড়েচড়ে বসলেই বুকের মধ্যে কে যেন হাত ঢুকিয়ে ফুসফুসটা চেপে ধরে রাখে। এমন অবস্থায় ঝুঁকে বুকের নিচে বালিস দিয়ে মোবাইলে চ্যাট সহজ হলেও শ্বাসকষ্টটা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে অসহ্য হয়ে উঠলে ইচ্ছাটাও চলে যায়। পাফ বা ওষুধ কিছুক্ষণের জন্য কাজ করলে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে আবার কাশির দমকে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে ছেলেটার রাগী রাগী সব ম্যাসেজ দেখে তার রিপ্লাই দেবার ইচ্ছাটা মরে যেত। বাইরে ততোদিনে অঝর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, ঘরে-বাইরে-মনে স্যাঁতসে্যঁতে ভাব নিয়ে মাঝ রাতে তার কান্নার শব্দ যেমন বৃষ্টি ঢেকে দিত, তেমন পাশে শুয়ে থাকা মা ঘুম ভেঙ্গে তড়িঘড়ি করে উঠে শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে মনে করে তার পিঠে, গলায় গরম রসুন তেল ঘষে চোখের জল মুছিয়ে দিত। ছেলেটাকে কখনো কি সেসব বলা হবে? ও কি বুঝতে চাইবে। রাগ আর সন্দেহ যেভাবে ওর সব অস্তিত্ব দখল করে আছে, সে কীভাবে সে সব দূর করবে! হ্যাঁ প্রথম প্রথম অনলাইনে না থাকলেও যখন থেকে ছেলেটার ম্যাসেজ, বিচ্ছিরি সব পোস্ট দেখেছে তখন থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, আর ইচ্ছা করেনি সে সবের কোনো অ্যানসার করার। দূরত্বটা এমনভাবে বাড়তে বাড়তে বিশাল গ্লেসিয়ারের পাহাড় হয়ে উঠেছে।
আর সেই গ্লেসিয়ারের দু’পাশের দুই গুহাবাসি তারা। তাদের চিন্তা দু’জন দু’জনকে শব্দে খুঁজে ফেরে, বরফ খুঁড়ে খুঁড়ে একজন আরেকজনের কাছে পৌঁছাতে চায়, দিনের পর দিন ক্লান্ত হয়ে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। যখন সেই হীম শীতল ঘুম ভেঙ্গে একটু উষ্ণ হতে বরফ খুঁড়তে উন্মুখ হয় তখনই দেখে বরফের স্তর সেই আগের মতোই পুরু, ভরাট হয়ে উঠেছে। তারা চিৎকার করে। সেই শব্দ কারো কাছেই পৌঁছায় না, হারিয়ে যায় কোন গভীর অতলে। তারা নিজেদের মাথার ভেতরে অন্যজনকে পুরে কথা বলে, তাদের অসহায়ত্বের কথা, তাদের নিরুপায় দিনের কথা, কষ্টের, রাগের, সন্দেহের যুক্তি-তর্কে দু’জন দু’জনকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে সান্তনা খুঁজে পায়, নৈকট্য অনুভব করে আর বাস্তবে দু’জন যোজন যোজন দূরের দুই গুহাবাসী হয়ে ওঠে। তাদের কথা ফুরিয়ে যায়, প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে।
শ্বেদবিন্দুর মতো বিন্দু বিন্দু জলে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে মেয়েটার। দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সে অচেনা হয়ে-ওঠা ছেলেটার মুখটা মনে করতে চেষ্টা করে। যার হাসিতে মেয়েটির চারপাশ মুহূর্তে সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠতো, সেই মুখে একরাশ লেপ্টানো কালির মতো খোঁচা খোঁচা বেয়াড়া দাড়ি! অন্যসময় হলে হয়তো মুখটা তার মুখে ঘষটে নিতে নিতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে দেওয়া যেত যে, পাপোশে মুখ ঘষতে তার বড়ই বিরক্ত। দাড়ির স্পর্শের অনুভূতি মনে করে মেয়েটির শরীরে কাঁপন ধরে। সে অস্থিরতা অনুভব করে তার পার্স খুলে সন্তর্পণে মোবাইলটা বের করে বাটন টিপে সময়টা দেখে নিতে চায়। অন্যকিছু করে নিজেকে সরিয়ে রাখতেও সে মোবাইল বের করতে পারে। তবে সময়টা দেখা তার জন্য জরুরি আর ছেলেটার সামনে সেটা করা যাবে না বলেই সে হ্যান্ডসেট বের করে। ছেলেটাকে খুশি করতেই আজ সে হাতঘড়ি খুলে রেখেছে কারণ যতবার তারা দু’জন একসাথে থেকেছে শুধু দু’জনার মতো করে ততোবারই, সময় কখন হাওয়াইয়ের মতো হারিয়ে যেত আর সে বাসায় ফিরবার জন্য বারবার ঘড়িতে চোখ বুলালে ছেলেটা রেগে গিয়ে এই ঘড়িই তাদের সময় গিলে খাবার মূলে মনে করে সময়কে শাপ-শাপান্ত করতো। মেয়েটা সারা সকাল থেকে ভেবে ভেবে আজকে ওর পছন্দের কালারের শাড়িটাই পরেছে, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ দিয়েছে যার দিকে একবার ছেলেটা ফিরে তাকিয়েছে কি না সন্দেহ! সে ম্রিয়মাণ-আনমনে হ্যান্ডসেটর স্ক্রিন স্লাইড করতে করতে থমকে যায়। আর স্লাইড করা যাচ্ছে না। মেয়েটি তার পার্সের ভিতর ফোনটা রাখতে যেতেই ছেলেটি ঘরে ঢুকে পড়ে। মেয়েটার হাত ফসকে ফোনটা তার পায়ে পড়ে মেঝেতে সেন্ডেলের উপর ড্রপ খায়। ছেলেটা উবু হয়ে ফোনটা তুলে তার হাতে দিতে দিতে মেয়েটার একটু বেশি বাড়ানো আঙ্গুলে ছেলেটার আঙ্গুল ছুঁয়ে যায় আর সে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে সিগারেট আর লাইটারটা মেয়েটার পার্সের পাশে রাখে।
-তাড়াহুড়া করলে সবই নষ্ট হবে...
নিচু স্বরে বলা ছেলেটার কথাগুলো শুনে মেয়েটা যখন ভ্রুকুটি করে ছেলেটার দিকে ফিরে তার কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছে, তখনই ছেলেটা তার দু’চোখ পড়ে নিতে নিতে কপালের টিপটা খেয়াল করে।
- কি যাবার সময় হয়ে গেল?
- না সময়টা দেখলাম।
- ও, অন্য কোথাও যাবে?
মেয়েটার আর এক মুহূর্ত ছেলেটার সামনে বসে থাকতে ইচ্ছা করে না। সে খুব ধীরে ধীরে বসার ভঙ্গি পাল্টে পা দু’টো খাট থেকে নামিয়ে দেয়।
- তুমি কি যেন বলতে চাও বলেছিলে।
- না তোমার বোধহয় যাবার সময় হয়ে গেছে...
ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে মেয়েটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
- যেতে তো হবেই...
বলে মেয়েটা একটু থমকে নিজেকে অনেক কষ্টে বাজে কিছু বলে ফেলা থেকে রোখে।
ছেলেটা পকেট থেকে তার ঘড়িটা বের করে ধীরে ধীরে হাতে পরে নেয়। সময় নিয়ে সময় দেখে। মেয়েটা একদৃষ্টিতে ছেলেটাকে দেখতে থাকে। ছেলেটাও মুখ তুলে তার চোখে চোখ রাখে। ততোক্ষণে মেয়েটার দৃষ্টি রুখো থেকে জলজ হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আর ছেলেটা সেই চোখে সারা বিশ্বজোড়া প্রশ্ন খুঁজে খুঁজে নিস্ব নিজেকে খুঁজতে থাকে। তাদের নিস্তব্ধতাকে ভাঙতে পারে এমন একটা শব্দের বড় প্রয়োজন হয়ে পড়ে, না হলে হয়তো এই নিস্তব্ধতায় তার ডুবে যেতে যেতে শ্বাস নিতেও ভুলে বসবে। সময়গুলো বদলে যেতে থাকে। ছায়ারা বদলে যায়। তারা অসহায় হয়ে একে অন্যের ভাষা খুঁজে ফিরতে থাকে, নিদেন পক্ষে একটা এমন শব্দ যা তাদের নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকার, নিস্তব্ধতায় ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করতে পারে, এমন একটা উপযুক্ত শব্দ খুঁজতে তারা তাদের শব্দ ভাণ্ডার নিস্ব করে ফেলে। ছেলেটি ধীরে ধীরে মেয়েটির চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরে তাকায়। গাঢ় নীল জলজ আকাশে তখন কয়েকটা চাতক শেষবারের মতো বৃষ্টির কণা লুটে নিতে ভীষণ ব্যস্ত।
- যাও তাহলে...
মেয়েটা পার্স হাতে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। কিছু একটা বলতে চায়। ছেলেটাকে দেখতে থাকে। তাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। প্রচণ্ডভাবে জাঁপটে ধরে চুপ করে তার বুকের ধুঁকপুকানি শুনতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে অনর্গল, অবিশ্রান্ত, অবান্তর কথায় কথায় ভেসে যেতে, ভাসিয়ে নিতে। কিন্তু কোনো ভাষা খুঁজে পায় না বলে, কিছু বলাও হয়ে ওঠে না। ভাষা হারিয়ে যায় যখন ছেলেটি আবারও বলে ওঠে
- দ্যা ডোর ওয়াজ ওপেন!
মেয়েটা আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে যেতে শুরু করে। ছেলেটা একটা সিগারেট ধরিয়ে জোর টানে বুক ভরে নিকোটিন টেনে নিতে নিতে সিঁড়িতে মেয়েটির পায়ের শব্দ শোনে। মেয়েটির পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। তার মাথার ভেতর বিষম ভারি কণ্ঠে ‘আজ জানে কি জিদ মাত কারো...’ গানটি গুনগুনিয়ে ওঠে। যদিও সে এ ভাষা বোঝে কি বোঝে না এমন, তবু গানের আধবোঝা কথা, সুর তার যেন খুব আপন বলে মনে হতে থাকে।
আহসান ইকবাল
বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১
জোৎস্নার মতো ঘোরলাগা রোদে দাঁড়িয়ে ছেলেটা আঙ্গুল দিয়ে পায়ের মাটিতে বৃত্তের মতো আঁকিবুঁকি কাটে। সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো অনেকক্ষণ না, এটা তারই বিভ্রম এইতো কিছুক্ষণ হবে হয়তো। তখন মাথার ওপর কৃষ্ণচূড়ার ডালপালাগুলো ছায়ার বিস্তৃতি ঘটিয়ে চলেছে গুটিগুটি পায়ে। সকালের দিকে একপশলা বৃষ্টি নেমেছিলো সারাদিন বয়ে যাবে এমন আষাঢ়স্য উচ্ছ্বাস নিয়েই। একটু পরেই থেমে থেমে ঝির ঝিরে গরমে সবাইকে অতিষ্ঠ করে থেমে গেলেও আকাশটা থমথমে নীলাভ ছাই ছাই মুখে তাকিয়ে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ছড়ানো ছিটানো ফুলগুলো দেখছিলো। তার কিছু থেতলে গেছে, কিছু এখনো হাতে তুলে নেবার মতো ঝকঝকে। ছেলেটা দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়তে মুখ তুলে আকাশের ছাই ছাই নীলে সিঁদুর লাল আর সবুজের ওপর আলগা বাম্প করা আলোয় পুরো গাছটায় কতগুলো ফুল ফুটে আছে গুনে ফেলে যেন।
বাতাসে দুলতে দুলতে তাদের কিছু সখা-সখি তখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সে সব মনে করে আমরা বলতে পারি ছেলেটি অনেকক্ষণ অপেক্ষায় এখানেই দাঁড়িয়ে আছে, আর বাতাসটাকে তার মতো দম আটকে রাখতে বাধ্য করেছে। আজ সে সময়কেও আটকে ফেলতে মরিয়া। আনমনে বাঁ-হাতের দিকে তাকিয়ে ঘড়িচাপা হয়ে থাকা উজ্জ¦ল অংশটা দেখে সে পকেট থেকে টিকটিক শব্দটা আন্দাজে আনতে পারে। আর একটু এগিয়ে সামনের রাস্তার মোড়ের দিকে গলা বাঁকিয়ে একটা রিকশা তার দিকে এগিয়ে আসছে কি না দেখবার ইচ্ছা করে মুহূর্তে লুট হয়ে যাবার মতো সম্বলহীন মনে করে টাল খায় একটু। হয়তো মাটিটা একটু ভেজা ছিলো বা সে সামনের দিকে ঝুঁকবার কারণেই একটু ইমব্যালান্স হয়ে পড়েছিলো। অনেক কষ্টে পকেটে থাকা ফোনটায় হাত বুলিয়েও কোনো মেসেজ এলো কি না দেখে নেবার লোভ সম্বরণ করে। একটা তক্ষক তখন তার একাকিত্ব বাড়িয়ে দেবার জন্য থেমে থেমে একভাবে ডাকতে শুরু করে। হালকা একটু বাতাস দুপুরের গুমোট ভাবটা কাটাতেই যেন পাতার ফাঁকফোকড়ে জমে থাকা কিছু বৃষ্টির পানি তখনই ঝরিয়ে দেয়। নির্দ্দিষ্ট সময় থেকে তখন ১৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। ছেলেটা তার সময়ের হিসাব নিকাশ বাদ দিতে পকেটে হাত দিয়ে ঘড়িটা চেপে ধরে চুনা আর শ্যাওলা ধরা দেওয়ালে হেলান দেয়।
এরও প্রায় ১৩ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড পর মেয়েটার রিকশা এসে দাঁড়ায় ছেলেটার কাছাকাছি দেওয়ালের গা ঘেঁষে। ছেলেটা তার হাতের মুঠোয় ধরা ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার মিহি ধাক্কার সাথে সাথে সময় গুনতে এত মগ্ন ছিলো যে প্রথমে মেয়েটিকে ঠিক দেখতে পায়নি। সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করে আর দোতালা ছাদে উঠবার সিঁড়িতে উঠতে উঠতে পিছনে কাপড়ের মৃদু খসখস শব্দে বুঝে নেয় মেয়েটাও তার পিছু পিছু উঠে আসছে।
ছোট্ট একটা চিলেকোঠার মতো সিঁড়ির শেষে ল্যান্ডিং এ একটা খাট পাতা। যার বিছানা, তেলশিটে পড়া বালিশ আর দেওয়ালে ঝোলানো গুটিয়ে রাখা মশারির ওপর কয়েকটা জামাকাপড় দেখে বোঝা যায় এখানে কেউ নিয়মিত থাকে। তার সামনে রেলিংয়ের দেওয়ালে ঠেস দেওয়া একটা একপা ভাঙ্গা টেবিল যার উপর একটা থালা আর গ্লাস উপুড় করে রাখা। ছেলেটি চেয়ারে বসে পড়তে মেয়েটি ছাদে যাবার দরজার দিকের খাটের কোনায় বসে পড়ে। দু’জন দু’জনের দিকে এতক্ষণ একবারও তাকায় না। ছেলেটি চেয়ারের পেছনের দু’পায়ার উপর ভর দিয়ে পেছনে হেলে একটু দোল খেতে খেতে এসব আলতো করে দেখতে দেখতে ভাবছিলো কোথা থেকে শুরু করা যায় এমন অবস্থায় যখন তাদের অনেক দিন কোনো কথা হয় না, এমনকি দেখাও নেই। আগে হলে হয়তো এতক্ষণে নিঃশব্দ হাসি মিলিয়ে যেত দু’জনের ঠোঁটের বন্ধনে। যতক্ষণ পাওয়া যায় দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে বুঝে নিতে চাইতো, খুঁজে নিতে চাইতো তাদের আটকে রাখা অনুভূতিগুলোকে। ছেলেটি দেওয়ালে সিমেন্ট লেপা বিচিত্র, গোপন শিল্পকর্মের মিনিং উদ্ধার করতে করতে, মনে করতে পারে না তাদের সহজ না হবার সেই কারণ। তার বুকের ভেতর গড়িয়ে চলা পাথর বরফের মতো ভিজতে থাকে। সে আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয় মেয়েটি আজ শাড়ি পরেছে। হালকা ইয়লো একটা সুতি শাড়িতে তাকে একদম অচেনা না লাগলেও অন্যরকম লাগছে। এতদিনের চেনা মানুষটাকে অপ্রত্যাশিতভাবে এমন অচেনা পোশাকে দেখে তার নিজেকে আরো অচিন লাগে। আচ্ছা ছেলেটা কি তখন মেয়েটার গায়ে তার পরিচিত কাপড়ের ডিটারেজেন্ট, এনচেন্টার পাউডার আর সাবান, হালকা বডি স্প্রে বা পারফিউম, ঘামের মিশ্র গন্ধটা খুঁজতে চাইবে? সে তখন একটা ভারি নিশ্বাস টেনে সেটা পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিনা বোঝা যায় না। মেয়েটি তার ঝোলানো পায়ের সেন্ডেলটা মৃদু বাতাসের মতো দোলাতে দোলাতে আঁচল দিয়ে ঘেমে ওঠা ঠোঁটের ওপর জমা ঘাম মোছে, গলাটা মুছতে মুখটা একটু তুলতে ছেলেটার কাছে মেয়েটার গায়ের রংটা আরো চাপা লাগে।
- খুব গরম লাগছে!
- হুম
মেয়েটা আলতো বলা না বলার মতো একটা শব্দ করে অস্থিরভাবে আঁচলের খুটে আঙ্গুল পেঁচাতে ব্যস্ত হয়। ছেলেটাও দ্রুত উঠে ছাদের লোহার দরজার হুড়কো তুলে দিতে দিতে মনে মনে বুঝিয়ে দিতে চায়, আজ তোমাকে আমার ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছা নাই। জোৎস্নার মতো এক ফালি রোদ বাতাসের সাথে সাথে ল্যান্ডিং-এর এই রুমের মতো জায়গাটায় ঢুকে পড়ে গুমোট ভাবটা একটু তাড়িয়ে দেয়। আনমনা বাতাসে মেয়েটার খোলা চুলের কিছু, কপালের কয়েকটা চুল সামনের দিকে এলোমেলো দোল খেলে ছেলেটা ফের চেয়ারে বসতে বসতে ভাবে চুলগুলো কানের পাশে এনে গুঁজে দেবে। মেয়েটার মুখে, হাতের খোলা অংশে তখন উজ্জ্বল হলুদ আভা পিতলের মতো উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়েছে। কোথা থেকে একটা মৌমাছি মেয়েটার মুখে আচমকা গুঁতা খেতে খেতে সামলে নিয়ে সামনে দিয়ে গুনগুনিয়ে চলে যেতেই মেয়েটি একটু আঁতকে ওঠে।
- চলে গেছে।
মেয়েটা একটু অপ্রস্তুত ভাবে হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সহজ হতে চায়।
- পা উঠিয়ে বসো।
- না থাক, কাপড়ে ভাঁজ পড়বে।
মেয়েটা মৃদু বিব্রত স্বরে বলে বুঝিয়ে দেয় যেন, আজ তারও কাছে যাবার ইচ্ছা নেই, সে জন্যই সে শাড়ি পরেছে। অন্য সময় হলে ছেলেটি বলতো ‘আমি শাড়ি পরিয়ে দেবো, এমন আর কঠিন কি!’, মেয়েটি তখন বলতো, “জি না, থাক। আমি লুঙ্গির গিঁট দেওয়া শাড়ি পরে বাসায় যেতে পারবো না।”
তারা দু’জন কি একই ভাবছিলো? মেয়েটি অস্বস্তিতে ভাবনাটা সরাতেই যেন মুখ নিচু না করে, এবার ঘুরিয়ে দরজা দিয়ে ছাদের দিকে তাকায়। মেয়েটার দৃষ্টি লক্ষ্য করে ছেলেটি বাইরে তাকিয়েই যেন মাথার ভেতর মৃদু ধাক্কা অনুভব করে। নিউরনের ভেতর রাগের মেঘমালা পরতে পরতে ঘন হতে হতে সারা শরীরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। রোদ পড়ে আসছে, আর তার চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে মনে করাতেই কি সে বাইরে তাকালো এমন করে!
- আবার বৃষ্টি নামতে পারে।
অস্ফুটে বলেই মেয়েটা থমকে যায়। সে বোঝে ছেলেটা কথাটা সহজভাবে নিতে পারবে না। মেয়েটা পায়ের স্লিপারটা খসিয়ে আসনগড়া হয়ে বসার চেষ্টা করে, এখনই উঠছে না বোঝাতেই যেন। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে মেয়েটাকে এলো চুল পেছনে বাঁধতে দেখে ভিতরে ভিতরে টুপটাপ ভিজতে থাকে। দু’হাতে মেয়েটির মুখটা চেপে ধরে তার চোখের দীঘিতে ডুব সাঁতার কাটতে ইচ্ছা হয়। মেয়েটি অনেকক্ষণ আটকে থাকা শ্বাসটা খুব লুকিয়ে ছাড়তে ছাড়তে ভাবে, এখন ওর হাতটা একটু এগিয়ে ধরা যাবে কেমন করে যদি ও এগিয়ে না আসে। আর ঠিক তখনই ছেলেটা তার সবসময়ের ভঙ্গি পাল্টে চেয়ারের সামনের পায়া দু’টো নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে। মেয়েটার অনেকটাই কাছে এগিয়ে, আবার এতটা কাছে না যে মেয়েটা একটু হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁতে পারবে।
- কী বলে বের হলে?
এতক্ষণে তারা দু’জন দু’জন চোখের দিকে তাকিয়ে আটকে থাকে। মুহূর্তে মেয়েটা বুঝে নেবার চেষ্টা করে তার এই কথার অন্য কোনো মানে আছে নাকি।
- বললাম বান্ধবীর বাসায় যাবো, মিস করা ক্লাসগুলোর নোটস নিতে।
ছেলেটা একটু থমকায়। মনে মনে বুঝে, হিসাব কষে নিতে চায় তাহলে আর কতক্ষণ সময় ওকে পাওয়া যাবে। মেয়েটি ছেলেটিকে বুঝেই হাতের সোনার চুড়িটা ঘুরাতে ঘরাতে বলে
- আমি বলেছি বিকালের দিকে চলে আসবো।
বলে স্মিত হেসে ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি মেয়েটির হাতঘড়ির জায়গায় চুড়ি পরা হাতটা দেখতে থাকে। তার হাতটা ধরবার জন্য মন টানে। দু’হাতের দশটা আঙ্গুলে ওর আঙ্গুল জড়ানোর অভিজ্ঞতা জেগে ওঠে। ওর বারবার ঘড়ি দেখবার ব্যাপারটা সে নিতে পারে না বলেই কি মেয়েটা আজ ঘড়ি পরেনি। সে মেয়েটার পাশে শুয়ে থাকা মানিব্যাগের মতো পার্সটার ঢাউস পেটটা দেখে বুঝে ফেলে মোবাইল আর ঘড়ি দুইটাই ব্যাগটায় ঠাসাঠাসি করে জায়গা করে নিয়েছে। মেয়েটি অস্ফুট স্বরে, “কী বলবে যেন, বল?”
মেয়েটি দেখে ছেলেটি কোথা থেকে শুরু করবে, কী বলবে বুঝতে না পেরেই যেন ব্যস্তভাবে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে, কাঁপাকাঁপা হাতে সিগারেট ঠোঁটে দেয়, দেখে সে একটু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে চোখ ফেরায়। সিঁড়িগুলো কেমন আলো থেকে ছায়া ছায়া হয়ে নেমে আঁধারে ব্লেন্ড হয়ে গেছে। ঠিক তখনই এক ঝলক ধোঁয়া তার ফুসফুসে ঢুকে পড়লে সে একটু কেশে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চাপতে গিয়েও হাতটা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটা একটু অপ্রস্তুত ভাবে সিগারেট নামিয়ে, “আসছি” বলে চেয়ার ছেড়ে ছাদের দিকে উঠে চলে যায়। ধোঁয়ার কারণে কিনা, ঠিক বোঝা যায় না মেয়েটার চোখ জ¦ালা করতে থাকে। ছেলেটার পরে থাকা ভাজ পড়া টিশার্টটা যেন হ্যাঙ্গারে ঝুলে যেতে যেতে কড়া তামাকের গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে গেল। এই মুহূর্তে শ্বাসকষ্টটা যেন ফিরে না আসে, সেই জন্য প্রার্থনা করতে করতে মেয়েটা সোজা হয়ে বসে বুক ভরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে। নিজেকে সহজ স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে সে ভেবে নেয়, কটা বাজতে পারে। বা এমন হতে পারে শ্বাসকষ্টের ব্যাপার থেকে সে মনোযোগ অন্য কোথাও দিতে চাইছে। ক’দিন হবে, শেষ দেখা হবার পর সাতটা দিন পার হয়ে গেছে! প্রতিবছর বসন্তের পরপরই শ্বাসের কষ্টটা শুরু হয়, এবার একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে সপ্তাহখানেক হলো আনবেয়ারেবল রকম বেড়ে গেছে। রাতের পর রাত নির্ঘুম, শুধু শ্বাসকষ্টের সাথে তার একার যুদ্ধ। একটু সোজা হলে বা নড়েচড়ে বসলেই বুকের মধ্যে কে যেন হাত ঢুকিয়ে ফুসফুসটা চেপে ধরে রাখে। এমন অবস্থায় ঝুঁকে বুকের নিচে বালিস দিয়ে মোবাইলে চ্যাট সহজ হলেও শ্বাসকষ্টটা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে অসহ্য হয়ে উঠলে ইচ্ছাটাও চলে যায়। পাফ বা ওষুধ কিছুক্ষণের জন্য কাজ করলে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে আবার কাশির দমকে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে ছেলেটার রাগী রাগী সব ম্যাসেজ দেখে তার রিপ্লাই দেবার ইচ্ছাটা মরে যেত। বাইরে ততোদিনে অঝর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, ঘরে-বাইরে-মনে স্যাঁতসে্যঁতে ভাব নিয়ে মাঝ রাতে তার কান্নার শব্দ যেমন বৃষ্টি ঢেকে দিত, তেমন পাশে শুয়ে থাকা মা ঘুম ভেঙ্গে তড়িঘড়ি করে উঠে শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে মনে করে তার পিঠে, গলায় গরম রসুন তেল ঘষে চোখের জল মুছিয়ে দিত। ছেলেটাকে কখনো কি সেসব বলা হবে? ও কি বুঝতে চাইবে। রাগ আর সন্দেহ যেভাবে ওর সব অস্তিত্ব দখল করে আছে, সে কীভাবে সে সব দূর করবে! হ্যাঁ প্রথম প্রথম অনলাইনে না থাকলেও যখন থেকে ছেলেটার ম্যাসেজ, বিচ্ছিরি সব পোস্ট দেখেছে তখন থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, আর ইচ্ছা করেনি সে সবের কোনো অ্যানসার করার। দূরত্বটা এমনভাবে বাড়তে বাড়তে বিশাল গ্লেসিয়ারের পাহাড় হয়ে উঠেছে।
আর সেই গ্লেসিয়ারের দু’পাশের দুই গুহাবাসি তারা। তাদের চিন্তা দু’জন দু’জনকে শব্দে খুঁজে ফেরে, বরফ খুঁড়ে খুঁড়ে একজন আরেকজনের কাছে পৌঁছাতে চায়, দিনের পর দিন ক্লান্ত হয়ে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। যখন সেই হীম শীতল ঘুম ভেঙ্গে একটু উষ্ণ হতে বরফ খুঁড়তে উন্মুখ হয় তখনই দেখে বরফের স্তর সেই আগের মতোই পুরু, ভরাট হয়ে উঠেছে। তারা চিৎকার করে। সেই শব্দ কারো কাছেই পৌঁছায় না, হারিয়ে যায় কোন গভীর অতলে। তারা নিজেদের মাথার ভেতরে অন্যজনকে পুরে কথা বলে, তাদের অসহায়ত্বের কথা, তাদের নিরুপায় দিনের কথা, কষ্টের, রাগের, সন্দেহের যুক্তি-তর্কে দু’জন দু’জনকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে সান্তনা খুঁজে পায়, নৈকট্য অনুভব করে আর বাস্তবে দু’জন যোজন যোজন দূরের দুই গুহাবাসী হয়ে ওঠে। তাদের কথা ফুরিয়ে যায়, প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে।
শ্বেদবিন্দুর মতো বিন্দু বিন্দু জলে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে মেয়েটার। দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সে অচেনা হয়ে-ওঠা ছেলেটার মুখটা মনে করতে চেষ্টা করে। যার হাসিতে মেয়েটির চারপাশ মুহূর্তে সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠতো, সেই মুখে একরাশ লেপ্টানো কালির মতো খোঁচা খোঁচা বেয়াড়া দাড়ি! অন্যসময় হলে হয়তো মুখটা তার মুখে ঘষটে নিতে নিতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে দেওয়া যেত যে, পাপোশে মুখ ঘষতে তার বড়ই বিরক্ত। দাড়ির স্পর্শের অনুভূতি মনে করে মেয়েটির শরীরে কাঁপন ধরে। সে অস্থিরতা অনুভব করে তার পার্স খুলে সন্তর্পণে মোবাইলটা বের করে বাটন টিপে সময়টা দেখে নিতে চায়। অন্যকিছু করে নিজেকে সরিয়ে রাখতেও সে মোবাইল বের করতে পারে। তবে সময়টা দেখা তার জন্য জরুরি আর ছেলেটার সামনে সেটা করা যাবে না বলেই সে হ্যান্ডসেট বের করে। ছেলেটাকে খুশি করতেই আজ সে হাতঘড়ি খুলে রেখেছে কারণ যতবার তারা দু’জন একসাথে থেকেছে শুধু দু’জনার মতো করে ততোবারই, সময় কখন হাওয়াইয়ের মতো হারিয়ে যেত আর সে বাসায় ফিরবার জন্য বারবার ঘড়িতে চোখ বুলালে ছেলেটা রেগে গিয়ে এই ঘড়িই তাদের সময় গিলে খাবার মূলে মনে করে সময়কে শাপ-শাপান্ত করতো। মেয়েটা সারা সকাল থেকে ভেবে ভেবে আজকে ওর পছন্দের কালারের শাড়িটাই পরেছে, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ দিয়েছে যার দিকে একবার ছেলেটা ফিরে তাকিয়েছে কি না সন্দেহ! সে ম্রিয়মাণ-আনমনে হ্যান্ডসেটর স্ক্রিন স্লাইড করতে করতে থমকে যায়। আর স্লাইড করা যাচ্ছে না। মেয়েটি তার পার্সের ভিতর ফোনটা রাখতে যেতেই ছেলেটি ঘরে ঢুকে পড়ে। মেয়েটার হাত ফসকে ফোনটা তার পায়ে পড়ে মেঝেতে সেন্ডেলের উপর ড্রপ খায়। ছেলেটা উবু হয়ে ফোনটা তুলে তার হাতে দিতে দিতে মেয়েটার একটু বেশি বাড়ানো আঙ্গুলে ছেলেটার আঙ্গুল ছুঁয়ে যায় আর সে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে সিগারেট আর লাইটারটা মেয়েটার পার্সের পাশে রাখে।
-তাড়াহুড়া করলে সবই নষ্ট হবে...
নিচু স্বরে বলা ছেলেটার কথাগুলো শুনে মেয়েটা যখন ভ্রুকুটি করে ছেলেটার দিকে ফিরে তার কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছে, তখনই ছেলেটা তার দু’চোখ পড়ে নিতে নিতে কপালের টিপটা খেয়াল করে।
- কি যাবার সময় হয়ে গেল?
- না সময়টা দেখলাম।
- ও, অন্য কোথাও যাবে?
মেয়েটার আর এক মুহূর্ত ছেলেটার সামনে বসে থাকতে ইচ্ছা করে না। সে খুব ধীরে ধীরে বসার ভঙ্গি পাল্টে পা দু’টো খাট থেকে নামিয়ে দেয়।
- তুমি কি যেন বলতে চাও বলেছিলে।
- না তোমার বোধহয় যাবার সময় হয়ে গেছে...
ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে মেয়েটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
- যেতে তো হবেই...
বলে মেয়েটা একটু থমকে নিজেকে অনেক কষ্টে বাজে কিছু বলে ফেলা থেকে রোখে।
ছেলেটা পকেট থেকে তার ঘড়িটা বের করে ধীরে ধীরে হাতে পরে নেয়। সময় নিয়ে সময় দেখে। মেয়েটা একদৃষ্টিতে ছেলেটাকে দেখতে থাকে। ছেলেটাও মুখ তুলে তার চোখে চোখ রাখে। ততোক্ষণে মেয়েটার দৃষ্টি রুখো থেকে জলজ হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আর ছেলেটা সেই চোখে সারা বিশ্বজোড়া প্রশ্ন খুঁজে খুঁজে নিস্ব নিজেকে খুঁজতে থাকে। তাদের নিস্তব্ধতাকে ভাঙতে পারে এমন একটা শব্দের বড় প্রয়োজন হয়ে পড়ে, না হলে হয়তো এই নিস্তব্ধতায় তার ডুবে যেতে যেতে শ্বাস নিতেও ভুলে বসবে। সময়গুলো বদলে যেতে থাকে। ছায়ারা বদলে যায়। তারা অসহায় হয়ে একে অন্যের ভাষা খুঁজে ফিরতে থাকে, নিদেন পক্ষে একটা এমন শব্দ যা তাদের নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকার, নিস্তব্ধতায় ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করতে পারে, এমন একটা উপযুক্ত শব্দ খুঁজতে তারা তাদের শব্দ ভাণ্ডার নিস্ব করে ফেলে। ছেলেটি ধীরে ধীরে মেয়েটির চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরে তাকায়। গাঢ় নীল জলজ আকাশে তখন কয়েকটা চাতক শেষবারের মতো বৃষ্টির কণা লুটে নিতে ভীষণ ব্যস্ত।
- যাও তাহলে...
মেয়েটা পার্স হাতে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। কিছু একটা বলতে চায়। ছেলেটাকে দেখতে থাকে। তাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। প্রচণ্ডভাবে জাঁপটে ধরে চুপ করে তার বুকের ধুঁকপুকানি শুনতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে অনর্গল, অবিশ্রান্ত, অবান্তর কথায় কথায় ভেসে যেতে, ভাসিয়ে নিতে। কিন্তু কোনো ভাষা খুঁজে পায় না বলে, কিছু বলাও হয়ে ওঠে না। ভাষা হারিয়ে যায় যখন ছেলেটি আবারও বলে ওঠে
- দ্যা ডোর ওয়াজ ওপেন!
মেয়েটা আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে যেতে শুরু করে। ছেলেটা একটা সিগারেট ধরিয়ে জোর টানে বুক ভরে নিকোটিন টেনে নিতে নিতে সিঁড়িতে মেয়েটির পায়ের শব্দ শোনে। মেয়েটির পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। তার মাথার ভেতর বিষম ভারি কণ্ঠে ‘আজ জানে কি জিদ মাত কারো...’ গানটি গুনগুনিয়ে ওঠে। যদিও সে এ ভাষা বোঝে কি বোঝে না এমন, তবু গানের আধবোঝা কথা, সুর তার যেন খুব আপন বলে মনে হতে থাকে।