alt

সাময়িকী

ফুলের আর্তনাদ

রনি রেজা

: বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

ঘড়ির কাঁটা যেন আজ লাগামছাড়া ঘোড়া। লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। কোথা দিয়ে যে দুপুর গড়িয়ে গেছে টেরই পায়নি সোনালী। সব পরিকল্পনা গুলিয়ে যাচ্ছে। বিশ্রী রকম এক অস্থিরতা গ্রাস করেছে তাকে। বিশেষ দিনে এক-আধটু অস্থিরতা সবার মধ্যেই হয়ত কাজ করে। তাই বলে এতটা? ভেবে পায় না সোনালী নিজেই। এমন চাপা স্বভাবের মেয়েকে কেউ কখনো এত অস্থির হতে দেখেছে বলেও মনে হয় না। সকাল থেকেই কিছু না কিছু ভুল হয়ে চলছে। গোসলের সময় ওয়াশরুমে শ্যাম্পু নিয়েছে তো কন্ডিশনার নেয়নি। শাড়ি পছন্দ করতে কাটিয়ে দিল দীর্ঘক্ষণ। আবার শাড়ি পরেছে তো টিপ ম্যাচিংয়ে দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে। আজ কলেজের অনুষ্ঠানে নিজ হাতে ফুল দিয়ে বরণ করবে মন্ত্রীকে। অত বড় নেতাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যইবা ক’জনের হয়। আর নিজ হাতে ফুল দেয়া! ভাবতেই অন্য রকম এক উত্তেজনা কাজ করে। নিত্যদিন একা সাজলেও আজ প্রতিবেশী পিউলি ভাবিকে ডেকে এনেছে। বার বার খুঁটিয়ে দেখছে কোথাও কিছু বাকি রইল কিনা। সৌন্দর্য বাড়াতে আরো কী কী করা যেতে পারে তা নিয়েও অস্থিরতার শেষ নেই। সোনালীর এমন অবস্থা দেখে পিউলি ভাবি তো বলেই ফেলল, ‘মন্ত্রী তো তোমাকে বিয়ের জন্য দেখতে আসছেন না। একটু কম সাজলে ক্ষতির কিছু নেই। বরং এত নজরকাড়া সাজগোজে গেলে আর একা ফেরা হবে না। সঙ্গে কলেজের ছেলেপেলে লাইন দিয়ে আসতে থাকবে। তখন সামলানো হবে আরেক যন্ত্রণার।’

দুই.

তখনো সূর্যের তেজ কমেনি। কাঁঠাল পাকা গরম পড়েছে। গাছের ছায়ায়ও দাঁড়ানো দায়। ভ্যাপসা গরমে মাটি ফুঁড়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাছাড়া অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। আজ এক বিশেষ দিন। বিশেষ ক্ষণের জন্য অপেক্ষা। এমন দিনেও আবিরের খবর নেই। আবিরের এই এক সমস্যা। একটা দিনও ঠিক সময়ে আসতে পারে না। দেরি করে এসেই একটা বাহানা দাঁড় করাবে। মফস্বল শহরে তো আর জ্যাম নেই। পুরো শহর ঘুরে আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় কোনোভাবেই লাগে না। নির্দিষ্ট পরিমাণ ফাঁকা দিয়ে দিয়ে ফালি করে সাজানো দোকান ঘরগুলো। বাজারের পশ্চিম পাশে থানা, হাসপাতাল আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়। তারও খানিক এগিয়ে শহরের অদূরে কলেজ। দক্ষিণ দিকে জনবসতি। এ অংশটুকু পুরোই গ্রাম। এখানের সবাই-ই কমবেশি চেনাজানা। কোথাও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আর একটু সেজেগুঁজে বের হলে তো কথাই নেই। খুবই অস্বস্তি লাগে সোনালীর। অনেকবার বলেছেও আবিরকে। তবুও কোনো গুরুত্ব নেই। তার দেরি করতেই হবে। ‘অমুক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল হঠাৎ। চা না খেয়ে আসতেই দিল না। হৃদয়ের আহ্বান উপেক্ষা করা ঠিক নয়, বুঝলে গিন্নি?’ অথবা ‘চোখের সামনে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। একটা মোটরসাইকেল একটা বাচ্চা ছেলের পায়ের উপর দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় ফেলে আসা যায়? ছেলেটিকে হাসপাতালে দিয়ে তারপর এলাম। চিকিৎসার টাকাও ব্যাটা মোটরসাইকেলওয়ালার থেকে আদায় করে ছেড়েছি।’ এমন কিছু না কিছু গল্প প্রতিদিনই আবিরের সাজানো থাকে। বলে বুক চিতিয়ে। প্রথম প্রথম সোনালীরও গর্ব হতো। বুকের মধ্যে শীতল বাতাস খেলে যেত। কিন্তু এক গল্প আর কতদিন? এখন সোনালী বুঝে ফেলেছে এসব আবিরের বানানো গল্প। সোনালী একদিন বলেছেও- ‘আবির, তুমি রাজনীতি বাদ দিয়ে গল্প লেখা শুরু করো। এতে বরং ভালো করবে।’ এরপরও পরিবর্তন নেই। ওসব টিপ্পনিতে কান দেওয়ার মতো সময় আবিরের নেই।

এগুলো জেনেও সোনালী ঠিক সময়ে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই বুঝতে পারে- আবিরের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে এক দীর্ঘ অপেক্ষা তাকে করতে হবে। আবিরকে বলার জন্য গল্প ফাঁদতে থাকবে আবিরেরই মতো। মনের বারান্দায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে নানা গল্পের ফুলঝুড়ি। বকুল ফুলের মতো টুপটাপ ঝড়তেই থাকবে। যেন কে কার আগে মাটিতে পতিত হতে পারে তারই প্রতিযোগিতা চলছে। আর তা যত্নে কোঁচড়ভর্তি করে রাখবে সোনালী। আবির এলেই সে ফুলে বরণ করে নিবে। কথার ফুলস্তূপে চাপা পড়বে ভেতরের অস্থিরতা। কিন্তু আবিরের কি আর সেদিকে খেয়াল আছে? সে আছে তার রাজনীতি নিয়ে। কীভাবে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করা যায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের সু-নজরে আসা যায় তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে ইদানীং। রাজনীতি যেন সোনালীর সতীন। এসব ভাবনায় এলেই সোনালীর মনে অভিমানের মেঘ জমে। ফর্সা গাল রক্তজবার মতো লাল বর্ণ ধারণ করে। তখন নিজের সঙ্গেই শুরু হয় খুনসুটি। আবিরকেও কিছু বকাঝকা করে মনে মনে। আবার বেফাঁস কিছু মনে হতেই কালী দেবীর মতো বড় করে জিহ্বাটা বের করে দাঁতে কাটে একাই। পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ শুকনো পাতাগুলোর মতোই কাটে তার অপেক্ষার সময়গুলো। আবির এসে যুৎসই একটা গল্প গছিয়ে দিয়ে একবার গালটা আলতো করে টিপে দেয়। ওতেই সব রাগ, অভিমান, ক্ষোভ গলে পড়ে। সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে এভাবেই চলছে...।

তখনো সূর্যের তেজ কমেনি। কাঁঠাল পাকা গরম পড়েছে। গাছের ছায়ায়ও দাঁড়ানো দায়। ভ্যাপসা গরমে মাটি ফুঁড়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাছাড়া অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। আজ এক বিশেষ দিন। বিশেষ ক্ষণের জন্য অপেক্ষা। এমন দিনেও আবিরের খবর নেই

তিন.

অপেক্ষার সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে স্মৃতিতে ডুবে যায় সোনালী। চোখের সামনে টাকায় কেনা হুকুমের গোলামের মতো হাজির হয়ে যায় অতীতের দিনগুলো। কত শান্ত, চুপচাপ মানুষ ছিল আবির। প্রয়োজন মতো মেপে মেপে কথা বলত। ওই চুপচাপ কম কথা বলা স্বভাবই সোনালীকে মুগ্ধ করেছে। তখন তো কম ছেলে সোনালীর পেছনে ঘোরেনি। প্রবাসী টাকাওয়ালা, উচ্চ ডিগ্রিধারী ধনীর দুলাল, বড় বড় চাকরিজীবী থেকে শুরু করে এলাকার হিরো স্টাইলে চলা তরুণ পর্যন্ত সব শ্রেণির ছেলেরাই সোনালীর মন পেতে চেষ্টা চালিয়েছে। অনেকের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদও হয়েছে সোনালীকে নিয়ে। আবার অনেকে দিয়েছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু সোনালী ছিল আবিরের মন জয়ের ব্যস্ততায়। তমাল-রিতা বা জোসেফ-জেনিফা জুটির মতো হুট করেই তাদের সম্পর্কটা হয়ে যায়নি। কী না করেছে আবিরকে জয় করতে! খুব সকালে প্রাইভেট ব্যাচ হওয়ায় জাগতে কষ্ট হতো ঘুমকাতুরে আবিরের। কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আগেভাগে আবিরের বাড়িতে হাজির হতো সোনালী। ঘুম থেকে জাগিয়ে অপেক্ষা করতো। আবিরের প্রস্তুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে অপেক্ষাই করতে হতো। এরপর একসঙ্গে প্রাইভেট ব্যাচে যাওয়া। অতটুকুতেই তৃপ্ত হত সোনালী। সোনালীর বুকের ধুঁকপুঁক আওয়াজ আবির তখন হয়ত বুঝতেই পারতো না। সমবয়সী হলেও মেয়েরা যে একটু আগেই বুঝতে পারে সেসব। আবির তখন বন-বাদারে ঘুরে পাখির ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার অপেক্ষায় থাকতো। ফুলের সামনে বসে প্রার্থনা করতো কবে তা ফল হবে। কচি ফলে পকেট ভরেই তৃপ্ত হতো। অপরপক্ষে ফুলের সৌরভ তো সোনালীই টের পেত। বুঝত ফুলের মমতা। অবুঝ আবিরকে কীভাবে বোঝাবে সে ফুলের মর্মার্থ। শেষে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। জয় করতে পেরেছে আবিরকে। এ জয় মহাকাশ জয়ের সমান। তাইত সাতটি বছর আগলে রেখেছে পরম যত্নে। এখন তারা দ্বাদশ শ্রেণিতে। সাত বসন্ত পার! কম সময় না। একে অপরকে বুঝতে এতটুকুও বাকি নেই। বসুগঞ্জের প্রতিটি রাস্তা, গলি, পাড়া, মহল্লার মতোই মুখস্থ একে অপরের মনের ভাঁজ। চোখ বন্ধ করেই চক্কর দেয়া যায় এমন।

চার.

দীর্ঘদিন পর নতুন কমিটি গঠন হতে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিবাদের কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নতুন কমিটি গঠনের বিষয়টি ঝুলে ছিল। এ কাউন্সিল নিয়ে কারোরই উৎসাহের কমতি নেই। কিভাবে কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। অনুষ্ঠান শুরুর সময় হয়ে আসছে। ঢাকা থেকে নেতারাও চলে এসেছে কাছাকাছি। এমন সময় সুমনের বেঁকে বসায় কিছুটা অপ্রস্তুত সবাই। কিছুতেই সুমনকে বোঝানো যাচ্ছে না। তাই টাওয়ার মার্কেটের ছাদে ওদের ডেকেছে বাবু। বোঝানোর চেষ্টা করছে সুমনকে। এসব আলোচনা চায়ের দোকানে বা পাবলিক প্লেসে করা যায় না। কোনোমতে ফাঁস হলেই বিপদ। প্রতিপক্ষরা কোনোরকম ফুটিফাটা পেলেই নেতার কাছে রঙচঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করবে। তখন পদ তো দূরের কথা নেতার কাছে ঘেঁষাই হবে দায়। সতর্কতামূল অগোছালো নোংরা ছাদটিই বেছে নিয়েছে বাবু। যে কোনো সঙ্কটে বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শের জন্য বাবুর তুলনা নেই। কলেজে ছাত্ররাজনীতি শুরুর দিন থেকে বাবুর পরামর্শেই নানা কার্যক্রম করেছে আবির-সুমনরা। বাবু বলেছে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু সুমনের তর সয় না। বাবুর কথায় ঘাসফড়িংয়ের মতো এক ঝটকায় বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে সুমন। ‘এবার কমিটি গঠন হলে দল ক্ষমতায় থাকতে আর কমিটি হবে না। এবারই যেভাবে হোক পদ বাগিয়ে নিতে হবে। নাহলে বিরোধী দলে থেকে পদ পেলে কী হবে? মার খাব?’ -বলে খানিক থামে সুমন। বোতল থেকে ঢক ঢক করে পনি ঢালে গলায়। ফের বলে, ‘দলের দুর্দিনে যাদের ছায়াটিও দেখা যায়নি তারাই আজ পদের জন্য হামলে পড়েছে। দ্বন্দ্ব বাড়াচ্ছে। ক্ষমতায় থাকলে সুবিধাবাদীদের ভিড়ে ত্যাগীদের টিকে থাকাই দায় হয়ে যায়। কেন্দ্রের নেতারাও অজানা সব কারণে অযোগ্যদের প্রতি বেশি দুর্বল থাকে।’

সুমনের মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় বাবু। বলে- ‘মাঝেমধ্যে যে আমাদের অভিমান হয় না, তা তো নয়। ভুলে যেও না আমরা এক মহান মানবের আদর্শে এ দলকে ভালোবাসি। দলের সংগঠনে যুক্ত হয়েছি তাকে ভালবেসে। শুধু পদ-পদবীর আশা করলে রাজনীতি বাদ দাও। এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাসেবা। তোমার কাজ সেবা দেয়া; সেবা দিয়ে যাবে। কিছু পেলে ভালো। না পেলেও কিছু করার নেই। তাই বলে তো দলের ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ করা যাবে না।’

এতক্ষণ বাদে মুখ খোলে আবির। ‘তাই বলে অবহেলায় তো অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতেও দেয়া যাবে না। নেতাকে এটা বোঝাতে হবে। আমার বিশ্বাস নেতা বুঝবে। বাবু ভাইকে নেতা পছন্দ করেন। তাকে বোঝানোর দায়িত্ব বাবু ভাইকেই নিতে হবে।’

পাঁচ.

বাহারি পোশাকে সেজেছে কলেজের ছেলেমেয়েরা। আসলে সেজেছে গোটা কলেজই। বসুগঞ্জ কলেজের প্রতিষ্ঠাজীবনে এমন অনুষ্ঠান আর হয়নি। অধ্যক্ষর ভবনের উত্তর পাশে শহীদ মিনারের পেছনে দাঁড়িয়ে সোনালীকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দেয় আবির। কীভাবে গিয়ে মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে বরণ করতে হবে। ছবি তোলার সময় কেমন করে দাঁড়াতে হবে। শেষে কীভাবে মঞ্চ ত্যাগ করতে হবে; সবই শিখিয়ে দেয়। বারকয়েক রিহার্সেলও করায় সোনালীকে। এরপরই ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবির। মন্ত্রীসহ ঢাকা থেকে আসা নেতাদের নিয়ে মঞ্চে সামনের সোফায় বসায়। সঞ্চালক রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিছুটা নিজের মতো করে সাজিয়ে বলে ওঠেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি বলছ মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমারই কথা প্রাণখুলে’...। এরপর শতবর্ষ আগে দলটি যার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে সেই মহান নেতার স্মরণে বলেন কিছু কথা। সঙ্গে কলেজের তরুণ ছাত্রনেতাদের সম্পর্কেও বলেন খানিকক্ষণ। তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের পাঠও দিতে ভোলেন না। শেষে একে একে মঞ্চে ডেকে নেন অতিথিদের। শুরু হয় অনুষ্ঠানের মূল পর্ব। পূর্ব পরিকল্পনামতেই একে একে অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় সোনালী, লাবনী, রিয়া, সুবর্ণারা। এরপর পর্যায়ক্রমে ছাত্রনেতা, স্থানীয় নেতা ও অতিথিদের বক্তব্য শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্য শুরু হয়। সবার মধ্যেই চাপা উত্তেজনা কাজ করে। অনুষ্ঠান সূচি অনুযায়ী প্রধান অতিথির বক্তব্যের শেষ দিকেই নতুন কমিটির নাম ঘোষণা করবেন মন্ত্রী। তার হাতে এরকম একটি কাগজও দেখা যায় স্পষ্ট। কিন্তু অবাক করে নাম ঘোষণা ছাড়াই বক্তব্য শেষ করেন তিনি। পরে নোটিশের মাধ্যমে নতুন কমিটির নাম জানিয়ে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন মন্ত্রী।

ছয়.

পদপ্রত্যাশীদের অপেক্ষা করতে হয় আরো মাসখানেক। এর মধ্যে কয়েকবার তাদের ডেকেছেনও মন্ত্রী। আলাদা আলাদাভাবে কথা বলেছেন সবার সঙ্গেই। শেষে অনুমোদিত কমিটি ঘোষণা করতে ছোট্ট এ মফস্বল শহরটিতে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই এসেছেন মন্ত্রী। গতরাতে এসেছেন আকস্মিক। সকালে সবাইকে খবর দেয়া হয়েছে। সদ্য ফোটা সূর্যের কুসুম রোদ গায়ে মেখেই সার্কিট হাউজের সামনে ভিড় করেছে পদপ্রত্যাশীরা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কমিটি ঘোষণা করতে আসেন স্থানীয় এক নেতা। জানান, মন্ত্রী বিশেষ এক কাজে ভোররাতেই বসুগঞ্জ ছেড়েছেন। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে কমিটি ঘোষণা করলেন ওই নেতা নিজেই। ২১ সদস্যের কমিটির সব শেষে সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করলেন আবিরের নাম। মুহূর্তেই উল্লাসে ফেটে পড়লো আবির-সমর্থকরা। আবির কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কাঁপা গলায় নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলো কোনোমতে। বহুল প্রতিক্ষিত সংবাদটি জানাতে প্রথমেই ফোন করলো বাবা-মাকে। এরপরই সোনালীকে। কয়েকবার চেষ্টা করার পরও সোনালী ফোন রিসিভ করে না। সোনালীদের বাড়ির নম্বরও ধরছে না। পরে বন্ধুদের নিয়েই রওয়ানা হয় সোনালীদের বাড়ির দিকে। বাড়ির অদূরে গিয়ে থমকে যায় আবির। সোনালীদের বাড়ি থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজ। কে যেন দৌড়ে এসে সোনালীর আত্মহত্যার খবরটিও দেয়। এত দ্রুত ক্ষরণ-বরণের এপিঠ-ওপিঠ দেখে যেন অবাক হওয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে আবির। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সোনালীর মরদেহ। হাতের মুঠো থেকে বের করে ছোট্ট চিরকুটটি। ওতে লেখা রয়েছে, ‘আবির, মন্ত্রীকে কখনো ক্ষমা করো না।’

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ফুলের আর্তনাদ

রনি রেজা

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

ঘড়ির কাঁটা যেন আজ লাগামছাড়া ঘোড়া। লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। কোথা দিয়ে যে দুপুর গড়িয়ে গেছে টেরই পায়নি সোনালী। সব পরিকল্পনা গুলিয়ে যাচ্ছে। বিশ্রী রকম এক অস্থিরতা গ্রাস করেছে তাকে। বিশেষ দিনে এক-আধটু অস্থিরতা সবার মধ্যেই হয়ত কাজ করে। তাই বলে এতটা? ভেবে পায় না সোনালী নিজেই। এমন চাপা স্বভাবের মেয়েকে কেউ কখনো এত অস্থির হতে দেখেছে বলেও মনে হয় না। সকাল থেকেই কিছু না কিছু ভুল হয়ে চলছে। গোসলের সময় ওয়াশরুমে শ্যাম্পু নিয়েছে তো কন্ডিশনার নেয়নি। শাড়ি পছন্দ করতে কাটিয়ে দিল দীর্ঘক্ষণ। আবার শাড়ি পরেছে তো টিপ ম্যাচিংয়ে দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে। আজ কলেজের অনুষ্ঠানে নিজ হাতে ফুল দিয়ে বরণ করবে মন্ত্রীকে। অত বড় নেতাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যইবা ক’জনের হয়। আর নিজ হাতে ফুল দেয়া! ভাবতেই অন্য রকম এক উত্তেজনা কাজ করে। নিত্যদিন একা সাজলেও আজ প্রতিবেশী পিউলি ভাবিকে ডেকে এনেছে। বার বার খুঁটিয়ে দেখছে কোথাও কিছু বাকি রইল কিনা। সৌন্দর্য বাড়াতে আরো কী কী করা যেতে পারে তা নিয়েও অস্থিরতার শেষ নেই। সোনালীর এমন অবস্থা দেখে পিউলি ভাবি তো বলেই ফেলল, ‘মন্ত্রী তো তোমাকে বিয়ের জন্য দেখতে আসছেন না। একটু কম সাজলে ক্ষতির কিছু নেই। বরং এত নজরকাড়া সাজগোজে গেলে আর একা ফেরা হবে না। সঙ্গে কলেজের ছেলেপেলে লাইন দিয়ে আসতে থাকবে। তখন সামলানো হবে আরেক যন্ত্রণার।’

দুই.

তখনো সূর্যের তেজ কমেনি। কাঁঠাল পাকা গরম পড়েছে। গাছের ছায়ায়ও দাঁড়ানো দায়। ভ্যাপসা গরমে মাটি ফুঁড়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাছাড়া অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। আজ এক বিশেষ দিন। বিশেষ ক্ষণের জন্য অপেক্ষা। এমন দিনেও আবিরের খবর নেই। আবিরের এই এক সমস্যা। একটা দিনও ঠিক সময়ে আসতে পারে না। দেরি করে এসেই একটা বাহানা দাঁড় করাবে। মফস্বল শহরে তো আর জ্যাম নেই। পুরো শহর ঘুরে আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় কোনোভাবেই লাগে না। নির্দিষ্ট পরিমাণ ফাঁকা দিয়ে দিয়ে ফালি করে সাজানো দোকান ঘরগুলো। বাজারের পশ্চিম পাশে থানা, হাসপাতাল আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়। তারও খানিক এগিয়ে শহরের অদূরে কলেজ। দক্ষিণ দিকে জনবসতি। এ অংশটুকু পুরোই গ্রাম। এখানের সবাই-ই কমবেশি চেনাজানা। কোথাও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আর একটু সেজেগুঁজে বের হলে তো কথাই নেই। খুবই অস্বস্তি লাগে সোনালীর। অনেকবার বলেছেও আবিরকে। তবুও কোনো গুরুত্ব নেই। তার দেরি করতেই হবে। ‘অমুক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল হঠাৎ। চা না খেয়ে আসতেই দিল না। হৃদয়ের আহ্বান উপেক্ষা করা ঠিক নয়, বুঝলে গিন্নি?’ অথবা ‘চোখের সামনে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। একটা মোটরসাইকেল একটা বাচ্চা ছেলের পায়ের উপর দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় ফেলে আসা যায়? ছেলেটিকে হাসপাতালে দিয়ে তারপর এলাম। চিকিৎসার টাকাও ব্যাটা মোটরসাইকেলওয়ালার থেকে আদায় করে ছেড়েছি।’ এমন কিছু না কিছু গল্প প্রতিদিনই আবিরের সাজানো থাকে। বলে বুক চিতিয়ে। প্রথম প্রথম সোনালীরও গর্ব হতো। বুকের মধ্যে শীতল বাতাস খেলে যেত। কিন্তু এক গল্প আর কতদিন? এখন সোনালী বুঝে ফেলেছে এসব আবিরের বানানো গল্প। সোনালী একদিন বলেছেও- ‘আবির, তুমি রাজনীতি বাদ দিয়ে গল্প লেখা শুরু করো। এতে বরং ভালো করবে।’ এরপরও পরিবর্তন নেই। ওসব টিপ্পনিতে কান দেওয়ার মতো সময় আবিরের নেই।

এগুলো জেনেও সোনালী ঠিক সময়ে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই বুঝতে পারে- আবিরের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে এক দীর্ঘ অপেক্ষা তাকে করতে হবে। আবিরকে বলার জন্য গল্প ফাঁদতে থাকবে আবিরেরই মতো। মনের বারান্দায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে নানা গল্পের ফুলঝুড়ি। বকুল ফুলের মতো টুপটাপ ঝড়তেই থাকবে। যেন কে কার আগে মাটিতে পতিত হতে পারে তারই প্রতিযোগিতা চলছে। আর তা যত্নে কোঁচড়ভর্তি করে রাখবে সোনালী। আবির এলেই সে ফুলে বরণ করে নিবে। কথার ফুলস্তূপে চাপা পড়বে ভেতরের অস্থিরতা। কিন্তু আবিরের কি আর সেদিকে খেয়াল আছে? সে আছে তার রাজনীতি নিয়ে। কীভাবে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করা যায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের সু-নজরে আসা যায় তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে ইদানীং। রাজনীতি যেন সোনালীর সতীন। এসব ভাবনায় এলেই সোনালীর মনে অভিমানের মেঘ জমে। ফর্সা গাল রক্তজবার মতো লাল বর্ণ ধারণ করে। তখন নিজের সঙ্গেই শুরু হয় খুনসুটি। আবিরকেও কিছু বকাঝকা করে মনে মনে। আবার বেফাঁস কিছু মনে হতেই কালী দেবীর মতো বড় করে জিহ্বাটা বের করে দাঁতে কাটে একাই। পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ শুকনো পাতাগুলোর মতোই কাটে তার অপেক্ষার সময়গুলো। আবির এসে যুৎসই একটা গল্প গছিয়ে দিয়ে একবার গালটা আলতো করে টিপে দেয়। ওতেই সব রাগ, অভিমান, ক্ষোভ গলে পড়ে। সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে এভাবেই চলছে...।

তখনো সূর্যের তেজ কমেনি। কাঁঠাল পাকা গরম পড়েছে। গাছের ছায়ায়ও দাঁড়ানো দায়। ভ্যাপসা গরমে মাটি ফুঁড়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাছাড়া অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। আজ এক বিশেষ দিন। বিশেষ ক্ষণের জন্য অপেক্ষা। এমন দিনেও আবিরের খবর নেই

তিন.

অপেক্ষার সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে স্মৃতিতে ডুবে যায় সোনালী। চোখের সামনে টাকায় কেনা হুকুমের গোলামের মতো হাজির হয়ে যায় অতীতের দিনগুলো। কত শান্ত, চুপচাপ মানুষ ছিল আবির। প্রয়োজন মতো মেপে মেপে কথা বলত। ওই চুপচাপ কম কথা বলা স্বভাবই সোনালীকে মুগ্ধ করেছে। তখন তো কম ছেলে সোনালীর পেছনে ঘোরেনি। প্রবাসী টাকাওয়ালা, উচ্চ ডিগ্রিধারী ধনীর দুলাল, বড় বড় চাকরিজীবী থেকে শুরু করে এলাকার হিরো স্টাইলে চলা তরুণ পর্যন্ত সব শ্রেণির ছেলেরাই সোনালীর মন পেতে চেষ্টা চালিয়েছে। অনেকের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদও হয়েছে সোনালীকে নিয়ে। আবার অনেকে দিয়েছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু সোনালী ছিল আবিরের মন জয়ের ব্যস্ততায়। তমাল-রিতা বা জোসেফ-জেনিফা জুটির মতো হুট করেই তাদের সম্পর্কটা হয়ে যায়নি। কী না করেছে আবিরকে জয় করতে! খুব সকালে প্রাইভেট ব্যাচ হওয়ায় জাগতে কষ্ট হতো ঘুমকাতুরে আবিরের। কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আগেভাগে আবিরের বাড়িতে হাজির হতো সোনালী। ঘুম থেকে জাগিয়ে অপেক্ষা করতো। আবিরের প্রস্তুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে অপেক্ষাই করতে হতো। এরপর একসঙ্গে প্রাইভেট ব্যাচে যাওয়া। অতটুকুতেই তৃপ্ত হত সোনালী। সোনালীর বুকের ধুঁকপুঁক আওয়াজ আবির তখন হয়ত বুঝতেই পারতো না। সমবয়সী হলেও মেয়েরা যে একটু আগেই বুঝতে পারে সেসব। আবির তখন বন-বাদারে ঘুরে পাখির ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার অপেক্ষায় থাকতো। ফুলের সামনে বসে প্রার্থনা করতো কবে তা ফল হবে। কচি ফলে পকেট ভরেই তৃপ্ত হতো। অপরপক্ষে ফুলের সৌরভ তো সোনালীই টের পেত। বুঝত ফুলের মমতা। অবুঝ আবিরকে কীভাবে বোঝাবে সে ফুলের মর্মার্থ। শেষে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। জয় করতে পেরেছে আবিরকে। এ জয় মহাকাশ জয়ের সমান। তাইত সাতটি বছর আগলে রেখেছে পরম যত্নে। এখন তারা দ্বাদশ শ্রেণিতে। সাত বসন্ত পার! কম সময় না। একে অপরকে বুঝতে এতটুকুও বাকি নেই। বসুগঞ্জের প্রতিটি রাস্তা, গলি, পাড়া, মহল্লার মতোই মুখস্থ একে অপরের মনের ভাঁজ। চোখ বন্ধ করেই চক্কর দেয়া যায় এমন।

চার.

দীর্ঘদিন পর নতুন কমিটি গঠন হতে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিবাদের কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নতুন কমিটি গঠনের বিষয়টি ঝুলে ছিল। এ কাউন্সিল নিয়ে কারোরই উৎসাহের কমতি নেই। কিভাবে কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। অনুষ্ঠান শুরুর সময় হয়ে আসছে। ঢাকা থেকে নেতারাও চলে এসেছে কাছাকাছি। এমন সময় সুমনের বেঁকে বসায় কিছুটা অপ্রস্তুত সবাই। কিছুতেই সুমনকে বোঝানো যাচ্ছে না। তাই টাওয়ার মার্কেটের ছাদে ওদের ডেকেছে বাবু। বোঝানোর চেষ্টা করছে সুমনকে। এসব আলোচনা চায়ের দোকানে বা পাবলিক প্লেসে করা যায় না। কোনোমতে ফাঁস হলেই বিপদ। প্রতিপক্ষরা কোনোরকম ফুটিফাটা পেলেই নেতার কাছে রঙচঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করবে। তখন পদ তো দূরের কথা নেতার কাছে ঘেঁষাই হবে দায়। সতর্কতামূল অগোছালো নোংরা ছাদটিই বেছে নিয়েছে বাবু। যে কোনো সঙ্কটে বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শের জন্য বাবুর তুলনা নেই। কলেজে ছাত্ররাজনীতি শুরুর দিন থেকে বাবুর পরামর্শেই নানা কার্যক্রম করেছে আবির-সুমনরা। বাবু বলেছে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু সুমনের তর সয় না। বাবুর কথায় ঘাসফড়িংয়ের মতো এক ঝটকায় বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে সুমন। ‘এবার কমিটি গঠন হলে দল ক্ষমতায় থাকতে আর কমিটি হবে না। এবারই যেভাবে হোক পদ বাগিয়ে নিতে হবে। নাহলে বিরোধী দলে থেকে পদ পেলে কী হবে? মার খাব?’ -বলে খানিক থামে সুমন। বোতল থেকে ঢক ঢক করে পনি ঢালে গলায়। ফের বলে, ‘দলের দুর্দিনে যাদের ছায়াটিও দেখা যায়নি তারাই আজ পদের জন্য হামলে পড়েছে। দ্বন্দ্ব বাড়াচ্ছে। ক্ষমতায় থাকলে সুবিধাবাদীদের ভিড়ে ত্যাগীদের টিকে থাকাই দায় হয়ে যায়। কেন্দ্রের নেতারাও অজানা সব কারণে অযোগ্যদের প্রতি বেশি দুর্বল থাকে।’

সুমনের মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় বাবু। বলে- ‘মাঝেমধ্যে যে আমাদের অভিমান হয় না, তা তো নয়। ভুলে যেও না আমরা এক মহান মানবের আদর্শে এ দলকে ভালোবাসি। দলের সংগঠনে যুক্ত হয়েছি তাকে ভালবেসে। শুধু পদ-পদবীর আশা করলে রাজনীতি বাদ দাও। এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাসেবা। তোমার কাজ সেবা দেয়া; সেবা দিয়ে যাবে। কিছু পেলে ভালো। না পেলেও কিছু করার নেই। তাই বলে তো দলের ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ করা যাবে না।’

এতক্ষণ বাদে মুখ খোলে আবির। ‘তাই বলে অবহেলায় তো অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতেও দেয়া যাবে না। নেতাকে এটা বোঝাতে হবে। আমার বিশ্বাস নেতা বুঝবে। বাবু ভাইকে নেতা পছন্দ করেন। তাকে বোঝানোর দায়িত্ব বাবু ভাইকেই নিতে হবে।’

পাঁচ.

বাহারি পোশাকে সেজেছে কলেজের ছেলেমেয়েরা। আসলে সেজেছে গোটা কলেজই। বসুগঞ্জ কলেজের প্রতিষ্ঠাজীবনে এমন অনুষ্ঠান আর হয়নি। অধ্যক্ষর ভবনের উত্তর পাশে শহীদ মিনারের পেছনে দাঁড়িয়ে সোনালীকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দেয় আবির। কীভাবে গিয়ে মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে বরণ করতে হবে। ছবি তোলার সময় কেমন করে দাঁড়াতে হবে। শেষে কীভাবে মঞ্চ ত্যাগ করতে হবে; সবই শিখিয়ে দেয়। বারকয়েক রিহার্সেলও করায় সোনালীকে। এরপরই ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবির। মন্ত্রীসহ ঢাকা থেকে আসা নেতাদের নিয়ে মঞ্চে সামনের সোফায় বসায়। সঞ্চালক রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিছুটা নিজের মতো করে সাজিয়ে বলে ওঠেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি বলছ মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমারই কথা প্রাণখুলে’...। এরপর শতবর্ষ আগে দলটি যার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে সেই মহান নেতার স্মরণে বলেন কিছু কথা। সঙ্গে কলেজের তরুণ ছাত্রনেতাদের সম্পর্কেও বলেন খানিকক্ষণ। তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের পাঠও দিতে ভোলেন না। শেষে একে একে মঞ্চে ডেকে নেন অতিথিদের। শুরু হয় অনুষ্ঠানের মূল পর্ব। পূর্ব পরিকল্পনামতেই একে একে অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় সোনালী, লাবনী, রিয়া, সুবর্ণারা। এরপর পর্যায়ক্রমে ছাত্রনেতা, স্থানীয় নেতা ও অতিথিদের বক্তব্য শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্য শুরু হয়। সবার মধ্যেই চাপা উত্তেজনা কাজ করে। অনুষ্ঠান সূচি অনুযায়ী প্রধান অতিথির বক্তব্যের শেষ দিকেই নতুন কমিটির নাম ঘোষণা করবেন মন্ত্রী। তার হাতে এরকম একটি কাগজও দেখা যায় স্পষ্ট। কিন্তু অবাক করে নাম ঘোষণা ছাড়াই বক্তব্য শেষ করেন তিনি। পরে নোটিশের মাধ্যমে নতুন কমিটির নাম জানিয়ে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন মন্ত্রী।

ছয়.

পদপ্রত্যাশীদের অপেক্ষা করতে হয় আরো মাসখানেক। এর মধ্যে কয়েকবার তাদের ডেকেছেনও মন্ত্রী। আলাদা আলাদাভাবে কথা বলেছেন সবার সঙ্গেই। শেষে অনুমোদিত কমিটি ঘোষণা করতে ছোট্ট এ মফস্বল শহরটিতে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই এসেছেন মন্ত্রী। গতরাতে এসেছেন আকস্মিক। সকালে সবাইকে খবর দেয়া হয়েছে। সদ্য ফোটা সূর্যের কুসুম রোদ গায়ে মেখেই সার্কিট হাউজের সামনে ভিড় করেছে পদপ্রত্যাশীরা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কমিটি ঘোষণা করতে আসেন স্থানীয় এক নেতা। জানান, মন্ত্রী বিশেষ এক কাজে ভোররাতেই বসুগঞ্জ ছেড়েছেন। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে কমিটি ঘোষণা করলেন ওই নেতা নিজেই। ২১ সদস্যের কমিটির সব শেষে সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করলেন আবিরের নাম। মুহূর্তেই উল্লাসে ফেটে পড়লো আবির-সমর্থকরা। আবির কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কাঁপা গলায় নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলো কোনোমতে। বহুল প্রতিক্ষিত সংবাদটি জানাতে প্রথমেই ফোন করলো বাবা-মাকে। এরপরই সোনালীকে। কয়েকবার চেষ্টা করার পরও সোনালী ফোন রিসিভ করে না। সোনালীদের বাড়ির নম্বরও ধরছে না। পরে বন্ধুদের নিয়েই রওয়ানা হয় সোনালীদের বাড়ির দিকে। বাড়ির অদূরে গিয়ে থমকে যায় আবির। সোনালীদের বাড়ি থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজ। কে যেন দৌড়ে এসে সোনালীর আত্মহত্যার খবরটিও দেয়। এত দ্রুত ক্ষরণ-বরণের এপিঠ-ওপিঠ দেখে যেন অবাক হওয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে আবির। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সোনালীর মরদেহ। হাতের মুঠো থেকে বের করে ছোট্ট চিরকুটটি। ওতে লেখা রয়েছে, ‘আবির, মন্ত্রীকে কখনো ক্ষমা করো না।’

back to top