অহনা নাসরিন
“কঠিন পাথর হয়ে গেছি-
এবার দুঃখ পেলে
পাথর কাঁদুক।
আমি আর কোনদিন
কান্না করবো না।”
কবিতা, কাব্য বা পদ্য হচ্ছে শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস- যা একজন কবির আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে নির্মাণের শিল্প।
কবিতা, তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ অথচ এর গভীরতা অকল্পনীয়। কবিতার উৎকৃষ্ট মৌলিক উপাদান জীবনবোধ। কবিতা কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়; আনন্দ দেয় যতখানি ততখানি বিষাদেও ডুবায়।
কবি আদিত্য নজরুলের কবিতা পড়বার পর বারবার বলতে ইচ্ছে করে- ‘মনের ভেতরে তোলপাড় করে; স্বপ্ন নয়- প্রেম নয়- জীবনের দুঃখবোধ’।
ছোট ছোট শব্দ চয়ন এবং সহজ-সরল শব্দের জালে কবিতার শরীর বুনন ঠিক যেন বাবুই পাখির আদল। কবি আদিত্য নজরুলকে বলা যায় নিপুণ কারিগর। ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ কাব্যের বেশিরভাগ কবিতা ১২/২০ চরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সময় ¯্রােতের উজানে নিজস্ব রসায়নের অবাক হাতুড়ির গাঁথুনিতে গাঁথা কবিতাগুলো পাঠক মনে কখনো বিরক্তির কারণ হবে না বরং পাঠক হৃদয়ে পাকাপোক্ত স্থান করে নিবে।
২০২১ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পরিবার পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে আদিত্য নজরুলের ১১তম কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’। এই শিরোনামের বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন মৌমিতা রহমান। পাঠক বইটি হাতে নিলে বুঝতে পারবেন প্রকাশকের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। বইটির পৃষ্ঠা, বাইন্ডিং বেশ উঁচুমানের। তাই কাব্যগ্রন্থটি এককথায় অতুলনীয়। কাব্যগ্রন্থে ছিয়ানব্বইটি কবিতা স্থান পেয়েছে। ছোট ছোট চরণ, চমৎকার বুনন আর অসাধারণ শব্দ চয়ন, অনুপম উপমায় প্রতিটি জীবনঘনিষ্ঠ কবিতা বেশ পরিপাট্য ও শ্রুতিমধুর। অহেতুক কংক্রিটনেস তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত থাকায় সব কবিতাই পাঠকপ্রিয় হতে পারে। পাঠকের অনুসন্ধিৎসু মনের দোরে কড়া নেড়ে জানানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবিতা নিয়ে কথা বলা তবে সবিস্তারে কথা বললে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। তাই আমি কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা দিয়ে আলোচনা শুরু করবো এবং যে যে কবিতাগুলো পাঠকের মনে রেখাপাত করতে পারে সেসব কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনা করবো আর প্রথম কবিতার কয়েক চরণে সমাপ্তি টানবো।
‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ কাব্যগ্রন্থে ‘বিকল্প ভালোবাসা’ শিরোনামের শেষ কবিতায় কবি বেশ কয়েকটি জটিল প্রশ্ন করেছেন, যার উত্তর খুঁজতে একটু মাথা খাটাতে হবে, তিনি লিখেছেন-
মানুষের-
এক জীবনের ভেতর লুকিয়ে থাকে
একাধিক জীবন...
তবু কেন মানুষের নিঃসঙ্গতা কাটে না।
কে বেশি নিঃসঙ্গ- মানুষ নাকি জীবন?
আবার কবিতার শেষে এসে কবি প্রশ্ন তুলেছেন-
কে বেশি নিঃসঙ্গ- মানুষ নাকি মৃত্যু?
জীবনের মতো লজ্জাবতী
এবং মৃত্যুর মতো নির্লজ্জ প্রেমিক থাকতে
মানুষ কেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে?
কবি, তাঁর কবিতায় নিজের কথা লেখেন। এই কথাটি অনেক পাঠকের মনে গোপনে আলোড়ন তোলে। কিন্তু আমি বলবো, পাঠকের মনের গোপন কবিতাটি কবি তাঁর কবিতায় প্রকাশ করেন। ‘পরিচয়’ কবিতায় বলেছেন- ‘আমার জন্মের দিনে/ উপস্থিত থাকলে হয়তো/নামটি নিজের মতো করে রাখতে পারতাম।’
এই আক্ষেপ অনেকেরই থাকে, নাম পছন্দ হয় না। আবার কেউ কেউ নিজের নাম পরিবর্তন করেন যেমন আমিও করেছি। আবার কবিতায় অন্য এক চরণে বলেছেন- ‘মৃত্যুর দিনে আমাকে কি/ লাশ ছাড়া অন্য কোন নামে ডাকবে মানুষ!’
মৃত্যুর পর জাত-ধর্ম, নাম-পরিচয় কোনো কিছুই থাকে না, কবি সত্য কথাটি অবলীলায় তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন।
মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্য মনে ধারণ করে কবি একের পর এক মৌলিক কবিতা নির্মাণ করেছেন পাঠকদের জন্য। পাঠ শেষে পাঠক কবিতা পাঠে সমৃদ্ধ হবেন এই ধারণাটি জন্ম নিয়েছে।
যাকে পেয়েও পাইনি
সে শিখিয়ে দিয়েছে দূরত্ব কাকে বলে?
দূরত্ব হলো আকাশ ও মাটির সুখের দাম্পত্য।
কবি আদিত্য নজরুলের কবিতায় রোমান্টিকতার বোধ ছিল লক্ষণীয়। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোতে আছে ভাষা ও ছন্দের অপূর্ব মেলবন্ধন। কবিতায় কবির প্রেম ভাবনা রূপ পেয়েছে এভাবে-
যে হাত ছুঁয়েছে তোমাকে/ তা কোন মানুষের হাত নয়
পুরুষের হাত নয়, কোন ঘাতকের হাত নয়
প্রেমিকের নিবিড় প্রার্থনা নিয়ে/এই হাত ছুঁতে চায় প্রেম
আদিত্য নজরুলের কবিতার প্রধান উপজীব্য দুঃখবোধ। দুঃখ নিয়ে লেখতে পছন্দ করেন তিনি। এই কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা দুঃখ নিয়ে লেখা। এই গ্রন্থ পাঠে অনেক পাঠক ভাবতে পারেন কবি বড় বেশি দুঃখবিলাসী। দুঃখের কবিতা পাঠকের মনকে নাড়া দেয় বেশি হয়তো এই কথা ভেবে, নয়তো কবির জীবনের পরতে পরতে দুঃখ লুকিয়ে আছে চোরকাঁটার মতন যা নিয়ে কবি ২০২০ সালেও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করেছেন- ‘চিরকুমার দুঃখগুলো-২০২০’।
যন্ত্রণায় দগ্ধ কবি আত্মবিনাশী যাপিত জীবনের বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘অদ্বিতীয়’ কবিতায়- ‘পুষ্প আর কতোটুকু / প্রস্ফুটিত হতে পারে?/ দুঃখ প্রস্ফুটিত হলে/ বিষণœতার বিপুল ঘ্রাণে / ভরে যায়, পুরো সংসার।’
কবির আক্ষেপ কখনো কখনো প্রতিবাদের ভাষা। কবি বলেন- “সময়গুলো চলে যাচ্ছে/ প্রেমিক এবং / যৌনদাসীদের তফাৎ / বুঝতে বুঝতে... / সময় এতই খারাপ যে/ বেশ্যার সুস্পষ্ট ঠোঁট ছাড়া / সুবিচার আশা করা য়ায় না কোথাও।”
‘বিবর্তন’ কবিতায় বিপ্লবের চিত্রকল্প এঁকেছেন চমৎকারভাবে, তিনি কবিতার শেষ অংশে লিখেছেন-
কিন্তু আমার কাছে/ স্তন বিপ্লবের প্রতিভূ মনে হয়।
শুধু বিশ্বস্ত প্রেমিক ঠোঁটে
স্তনাগ্রে কোমল চুমু খেয়ে দেখো
মুহূর্তেই বিপ্লবীর মতো/
কেমন লাফিয়ে ওঠে স্তনজোড়া।
আবার ‘বাস্তবতা’ কবিতায় কবি মানুষকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন সুচারুভাবে- “মানুষই ব্যতিক্রম/ তারা একবার বেঁচে থাকতে/বারবার মরে যায়।”
কবি তাঁর কবিতায় প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে যে সব শব্দ চয়ন করেছেন তাতে যে কোনো মানুষ সহজেই অনুধাবন করতে পারবে কবিতার মূলভাব কিংবা কবি কী বলতে চেয়েছেন, যেমন- “বিচারহীনতার দেশে প্রতিটি মানুষ ই অন্ধ”। এই একটি চরণে ফুটিয়ে তুলেছেন দেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থার চালচিত্র।
এই কাব্যগ্রন্থে কী নেই! একটি তরকারি রান্না করতে যেমন পাঁচ পদের মশলা দরকার তেমনি এই কাব্যগ্রন্থে কবি প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদ, দুঃখ-যাতনা-দ্রোহ, শৈশব কাতরতা, দেশপ্রেম, মায়ের প্রতি ভালোবাসা, বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তৃতীয় লিঙ্গ কিংবা অবহেলিত মানুষের কথাও ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে।
কবি আদিত্য নজরুল একজন নাট্যনির্মাতা, সংবাদকর্মী। তাই তিনি জানেন, কি করে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে হয়, কি করে হৃদয়গ্রাহী হতে হয়। তাইতো শব্দের কারিগর হয়ে সেই দক্ষতা নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর কবিতার শরীর বুননে।
সহজ-সরল ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ “দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে”। ছন্দ, নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে পাঠকের মানসিক পরিতৃপ্তির কথা ভেবে কবিতায় শব্দের প্রলেপ দিয়েছেন। ‘বর্তমান কবিতা দুর্বোধ্য হওয়ায় পাঠক কমে যাচ্ছ’- এই কথাটি ফিসফিস করে অনেকেই বলে, তাদের জন্য এই বইটি হবে চমৎকার কবিতার বই। কোনো না কোনো উদ্ধৃতি পাঠক মনে দাগ কাটবে এবং সারাজীবন মনে রাখবে। আমি কাব্যগ্রন্থটির ঈর্ষণীয় সাফল্য কামনা করি।
কাব্যগ্রন্থটি পড়ে পাঠক একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে পারেন দূর আকাশে কিংবা গহীন অরণ্যে। অবাধ্য শৈশবকে অনুভব করে আনন্দে মেতে উঠতে পারেন, অনুভব করতে পারেন শেকড়ের টান। চেত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো বাবাকে প্রশ্ন করতে পারেন- আগুনে পুড়ে কে বেশি উর্বর হয়েছে, ছইয়ের ভাস্কর্য না আমি? আবার সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চোখের সামনে দেখে নিজেকে কীর্তিমান লাশ ভাবতে পারেন। এসকল ভাবনার রূপকার কবি আদিত্য নজরুল। কবি তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন প্রেম-বিরহ, সুখ-দুঃখ দ্রোহ আর জীবন বোধের দারুণ রসায়ন।
আবার কখনো কখনো দুঃখ-যাতনা-প্রেমের মিশ্রণ ঘটিয়ে সময়ের রঙ তুলি দিয়ে এঁকেছেন জীবনের পোর্ট্রেট।
‘নীল ঘাতক’ কবিতায় কবি প্রশ্ন করেছেন-
“আচ্ছা দুঃখের জন্ম কেমন করে হলো?/দুঃখ নাকি সুখকে নাম রেখে/কে এতো করেছে দ্যুতিময়?/ কারো কাছে না গিয়ে/দুঃখ এবং সুখের কাছে সরাসরি প্রশ্ন করলাম:
এই প্রশ্ন শুনে/ দুঃখ এবং সুখ/সমস্বরে হাসতে হাসতে বললো জীবন।”
‘সন্তপ্ত কুসুম’ কবিতাটি কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। দুঃখ পেতে পেতে কবি বলছেন- ‘এবার দুঃখ পেলে পাথর কাঁদুক আমি আর কোনদিন কান্না করবো না। আবার তিনি নিজের সংসারে নিজেকে লাশ ভেবে লিখেছেন এই অসামান্য কবিতা- ‘লাশ কি কখনো/ কারো সংসারে ঢুকতে পারে?/ ধরো, আজ থেকে,/ সঙ্গত কারণে / তোমাদের সুখি সংসারে
আমি এক কীর্তিমান লাশ।’
অহনা নাসরিন
বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১
“কঠিন পাথর হয়ে গেছি-
এবার দুঃখ পেলে
পাথর কাঁদুক।
আমি আর কোনদিন
কান্না করবো না।”
কবিতা, কাব্য বা পদ্য হচ্ছে শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস- যা একজন কবির আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে নির্মাণের শিল্প।
কবিতা, তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ অথচ এর গভীরতা অকল্পনীয়। কবিতার উৎকৃষ্ট মৌলিক উপাদান জীবনবোধ। কবিতা কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়; আনন্দ দেয় যতখানি ততখানি বিষাদেও ডুবায়।
কবি আদিত্য নজরুলের কবিতা পড়বার পর বারবার বলতে ইচ্ছে করে- ‘মনের ভেতরে তোলপাড় করে; স্বপ্ন নয়- প্রেম নয়- জীবনের দুঃখবোধ’।
ছোট ছোট শব্দ চয়ন এবং সহজ-সরল শব্দের জালে কবিতার শরীর বুনন ঠিক যেন বাবুই পাখির আদল। কবি আদিত্য নজরুলকে বলা যায় নিপুণ কারিগর। ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ কাব্যের বেশিরভাগ কবিতা ১২/২০ চরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সময় ¯্রােতের উজানে নিজস্ব রসায়নের অবাক হাতুড়ির গাঁথুনিতে গাঁথা কবিতাগুলো পাঠক মনে কখনো বিরক্তির কারণ হবে না বরং পাঠক হৃদয়ে পাকাপোক্ত স্থান করে নিবে।
২০২১ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পরিবার পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে আদিত্য নজরুলের ১১তম কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’। এই শিরোনামের বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন মৌমিতা রহমান। পাঠক বইটি হাতে নিলে বুঝতে পারবেন প্রকাশকের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। বইটির পৃষ্ঠা, বাইন্ডিং বেশ উঁচুমানের। তাই কাব্যগ্রন্থটি এককথায় অতুলনীয়। কাব্যগ্রন্থে ছিয়ানব্বইটি কবিতা স্থান পেয়েছে। ছোট ছোট চরণ, চমৎকার বুনন আর অসাধারণ শব্দ চয়ন, অনুপম উপমায় প্রতিটি জীবনঘনিষ্ঠ কবিতা বেশ পরিপাট্য ও শ্রুতিমধুর। অহেতুক কংক্রিটনেস তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত থাকায় সব কবিতাই পাঠকপ্রিয় হতে পারে। পাঠকের অনুসন্ধিৎসু মনের দোরে কড়া নেড়ে জানানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবিতা নিয়ে কথা বলা তবে সবিস্তারে কথা বললে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। তাই আমি কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা দিয়ে আলোচনা শুরু করবো এবং যে যে কবিতাগুলো পাঠকের মনে রেখাপাত করতে পারে সেসব কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনা করবো আর প্রথম কবিতার কয়েক চরণে সমাপ্তি টানবো।
‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ কাব্যগ্রন্থে ‘বিকল্প ভালোবাসা’ শিরোনামের শেষ কবিতায় কবি বেশ কয়েকটি জটিল প্রশ্ন করেছেন, যার উত্তর খুঁজতে একটু মাথা খাটাতে হবে, তিনি লিখেছেন-
মানুষের-
এক জীবনের ভেতর লুকিয়ে থাকে
একাধিক জীবন...
তবু কেন মানুষের নিঃসঙ্গতা কাটে না।
কে বেশি নিঃসঙ্গ- মানুষ নাকি জীবন?
আবার কবিতার শেষে এসে কবি প্রশ্ন তুলেছেন-
কে বেশি নিঃসঙ্গ- মানুষ নাকি মৃত্যু?
জীবনের মতো লজ্জাবতী
এবং মৃত্যুর মতো নির্লজ্জ প্রেমিক থাকতে
মানুষ কেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে?
কবি, তাঁর কবিতায় নিজের কথা লেখেন। এই কথাটি অনেক পাঠকের মনে গোপনে আলোড়ন তোলে। কিন্তু আমি বলবো, পাঠকের মনের গোপন কবিতাটি কবি তাঁর কবিতায় প্রকাশ করেন। ‘পরিচয়’ কবিতায় বলেছেন- ‘আমার জন্মের দিনে/ উপস্থিত থাকলে হয়তো/নামটি নিজের মতো করে রাখতে পারতাম।’
এই আক্ষেপ অনেকেরই থাকে, নাম পছন্দ হয় না। আবার কেউ কেউ নিজের নাম পরিবর্তন করেন যেমন আমিও করেছি। আবার কবিতায় অন্য এক চরণে বলেছেন- ‘মৃত্যুর দিনে আমাকে কি/ লাশ ছাড়া অন্য কোন নামে ডাকবে মানুষ!’
মৃত্যুর পর জাত-ধর্ম, নাম-পরিচয় কোনো কিছুই থাকে না, কবি সত্য কথাটি অবলীলায় তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন।
মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্য মনে ধারণ করে কবি একের পর এক মৌলিক কবিতা নির্মাণ করেছেন পাঠকদের জন্য। পাঠ শেষে পাঠক কবিতা পাঠে সমৃদ্ধ হবেন এই ধারণাটি জন্ম নিয়েছে।
যাকে পেয়েও পাইনি
সে শিখিয়ে দিয়েছে দূরত্ব কাকে বলে?
দূরত্ব হলো আকাশ ও মাটির সুখের দাম্পত্য।
কবি আদিত্য নজরুলের কবিতায় রোমান্টিকতার বোধ ছিল লক্ষণীয়। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোতে আছে ভাষা ও ছন্দের অপূর্ব মেলবন্ধন। কবিতায় কবির প্রেম ভাবনা রূপ পেয়েছে এভাবে-
যে হাত ছুঁয়েছে তোমাকে/ তা কোন মানুষের হাত নয়
পুরুষের হাত নয়, কোন ঘাতকের হাত নয়
প্রেমিকের নিবিড় প্রার্থনা নিয়ে/এই হাত ছুঁতে চায় প্রেম
আদিত্য নজরুলের কবিতার প্রধান উপজীব্য দুঃখবোধ। দুঃখ নিয়ে লেখতে পছন্দ করেন তিনি। এই কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা দুঃখ নিয়ে লেখা। এই গ্রন্থ পাঠে অনেক পাঠক ভাবতে পারেন কবি বড় বেশি দুঃখবিলাসী। দুঃখের কবিতা পাঠকের মনকে নাড়া দেয় বেশি হয়তো এই কথা ভেবে, নয়তো কবির জীবনের পরতে পরতে দুঃখ লুকিয়ে আছে চোরকাঁটার মতন যা নিয়ে কবি ২০২০ সালেও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করেছেন- ‘চিরকুমার দুঃখগুলো-২০২০’।
যন্ত্রণায় দগ্ধ কবি আত্মবিনাশী যাপিত জীবনের বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘অদ্বিতীয়’ কবিতায়- ‘পুষ্প আর কতোটুকু / প্রস্ফুটিত হতে পারে?/ দুঃখ প্রস্ফুটিত হলে/ বিষণœতার বিপুল ঘ্রাণে / ভরে যায়, পুরো সংসার।’
কবির আক্ষেপ কখনো কখনো প্রতিবাদের ভাষা। কবি বলেন- “সময়গুলো চলে যাচ্ছে/ প্রেমিক এবং / যৌনদাসীদের তফাৎ / বুঝতে বুঝতে... / সময় এতই খারাপ যে/ বেশ্যার সুস্পষ্ট ঠোঁট ছাড়া / সুবিচার আশা করা য়ায় না কোথাও।”
‘বিবর্তন’ কবিতায় বিপ্লবের চিত্রকল্প এঁকেছেন চমৎকারভাবে, তিনি কবিতার শেষ অংশে লিখেছেন-
কিন্তু আমার কাছে/ স্তন বিপ্লবের প্রতিভূ মনে হয়।
শুধু বিশ্বস্ত প্রেমিক ঠোঁটে
স্তনাগ্রে কোমল চুমু খেয়ে দেখো
মুহূর্তেই বিপ্লবীর মতো/
কেমন লাফিয়ে ওঠে স্তনজোড়া।
আবার ‘বাস্তবতা’ কবিতায় কবি মানুষকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন সুচারুভাবে- “মানুষই ব্যতিক্রম/ তারা একবার বেঁচে থাকতে/বারবার মরে যায়।”
কবি তাঁর কবিতায় প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে যে সব শব্দ চয়ন করেছেন তাতে যে কোনো মানুষ সহজেই অনুধাবন করতে পারবে কবিতার মূলভাব কিংবা কবি কী বলতে চেয়েছেন, যেমন- “বিচারহীনতার দেশে প্রতিটি মানুষ ই অন্ধ”। এই একটি চরণে ফুটিয়ে তুলেছেন দেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থার চালচিত্র।
এই কাব্যগ্রন্থে কী নেই! একটি তরকারি রান্না করতে যেমন পাঁচ পদের মশলা দরকার তেমনি এই কাব্যগ্রন্থে কবি প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদ, দুঃখ-যাতনা-দ্রোহ, শৈশব কাতরতা, দেশপ্রেম, মায়ের প্রতি ভালোবাসা, বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তৃতীয় লিঙ্গ কিংবা অবহেলিত মানুষের কথাও ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে।
কবি আদিত্য নজরুল একজন নাট্যনির্মাতা, সংবাদকর্মী। তাই তিনি জানেন, কি করে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে হয়, কি করে হৃদয়গ্রাহী হতে হয়। তাইতো শব্দের কারিগর হয়ে সেই দক্ষতা নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর কবিতার শরীর বুননে।
সহজ-সরল ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ “দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে”। ছন্দ, নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে পাঠকের মানসিক পরিতৃপ্তির কথা ভেবে কবিতায় শব্দের প্রলেপ দিয়েছেন। ‘বর্তমান কবিতা দুর্বোধ্য হওয়ায় পাঠক কমে যাচ্ছ’- এই কথাটি ফিসফিস করে অনেকেই বলে, তাদের জন্য এই বইটি হবে চমৎকার কবিতার বই। কোনো না কোনো উদ্ধৃতি পাঠক মনে দাগ কাটবে এবং সারাজীবন মনে রাখবে। আমি কাব্যগ্রন্থটির ঈর্ষণীয় সাফল্য কামনা করি।
কাব্যগ্রন্থটি পড়ে পাঠক একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে পারেন দূর আকাশে কিংবা গহীন অরণ্যে। অবাধ্য শৈশবকে অনুভব করে আনন্দে মেতে উঠতে পারেন, অনুভব করতে পারেন শেকড়ের টান। চেত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো বাবাকে প্রশ্ন করতে পারেন- আগুনে পুড়ে কে বেশি উর্বর হয়েছে, ছইয়ের ভাস্কর্য না আমি? আবার সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চোখের সামনে দেখে নিজেকে কীর্তিমান লাশ ভাবতে পারেন। এসকল ভাবনার রূপকার কবি আদিত্য নজরুল। কবি তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন প্রেম-বিরহ, সুখ-দুঃখ দ্রোহ আর জীবন বোধের দারুণ রসায়ন।
আবার কখনো কখনো দুঃখ-যাতনা-প্রেমের মিশ্রণ ঘটিয়ে সময়ের রঙ তুলি দিয়ে এঁকেছেন জীবনের পোর্ট্রেট।
‘নীল ঘাতক’ কবিতায় কবি প্রশ্ন করেছেন-
“আচ্ছা দুঃখের জন্ম কেমন করে হলো?/দুঃখ নাকি সুখকে নাম রেখে/কে এতো করেছে দ্যুতিময়?/ কারো কাছে না গিয়ে/দুঃখ এবং সুখের কাছে সরাসরি প্রশ্ন করলাম:
এই প্রশ্ন শুনে/ দুঃখ এবং সুখ/সমস্বরে হাসতে হাসতে বললো জীবন।”
‘সন্তপ্ত কুসুম’ কবিতাটি কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। দুঃখ পেতে পেতে কবি বলছেন- ‘এবার দুঃখ পেলে পাথর কাঁদুক আমি আর কোনদিন কান্না করবো না। আবার তিনি নিজের সংসারে নিজেকে লাশ ভেবে লিখেছেন এই অসামান্য কবিতা- ‘লাশ কি কখনো/ কারো সংসারে ঢুকতে পারে?/ ধরো, আজ থেকে,/ সঙ্গত কারণে / তোমাদের সুখি সংসারে
আমি এক কীর্তিমান লাশ।’