কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মানুষের মানবতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছিলেন। তাঁর সারা জীবনের নমস্য ছিলো মনুষ্যত্বের সাধনা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিকর্ম মানব হিতাকাক্সক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, হাসি-কান্না, সুখদুঃখ এসবের সম্মিলনে সমৃদ্ধ করেছেন। মানব বন্দনা ও মানুষের কৃতিকে তাঁর সাহিত্যে উপস্থাপন করা হয়েছে ভিন্ন মাত্রায়। সীমার মাঝে অসীমতার যে প্রকাশ, মানুষের সহজাত সত্তার বিকাশ তার গণ্ডীর বাইরে গিয়েও যে আরেকটি জগৎকে প্রকাশিত করার মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়, তা রবীন্দ্রনাথ কবিতায় এবং প্রবন্ধে লিখেছেন। অগনিত মানুষের আদর্শের মধ্য দিয়ে একটি সার্বজনীন মানব আদর্শ গড়ে ওঠে। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সার্বজনীন মানুষের অবয়ব সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন এইভাবে- ‘মানুষ উন্নতির সংগে সংগে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎ মানুষ হয়ে উঠছে। তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা বৃহৎ মানুষের সাধনা। এই বৃহৎ মানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরেও আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানান জাত। অন্তরে আছে শুধু এক মানব। এই এক মানব তার অন্তর্জগৎকে ছাপিয়ে বহির্জগতের মানবাত্মাকে এক করে নেয়।’ রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য ‘আমি কি, আমার চরম মূল্য কোথায়।’ তার উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন ‘মানুষ কি করে হবে মানুষের মতো তাই নিয়ে বর্বর দশা থেকে সভ্য অবস্থা পর্যন্ত তার চিন্তা ও প্রয়াসের অন্ত নেই। সে বুঝেছে, সেটা সহজ নয়, তার মধ্যে একটা রহস্য রয়েছে। এই রহস্যের আবরণ উদযাপিত হতে হতে সে আপনাকে চিনবে। শত শত শতাব্দী ধরে চলেছে তার প্রয়াস। এমনি করে বড়ো ভূমিকায় নিজের সত্যকে স্পষ্ট করে উপলব্ধি করতে তার অহেতুক আগ্রহ। যাকে সে পূজা করে তার দ্বারাই সে প্রমান করে তার মতে নিজে সে সত্য, কিসে তার বুদ্ধি, কাকে বলে পূজনীয়, কাকে পূর্ণতা বলে।’ এই যে সত্য উপলব্ধির বিষয়, মানুষের মাঝে এই উপলব্ধি ছড়িয়ে দিতে পারলে সুন্দর ও কল্যানের বিস্তার সম্ভব হয়ে ওঠে।
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ¦লে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’
সুন্দর হল সে।
এই কবিতাটিতে একটি গভীর দর্শন রয়েছে। ‘সোহম’- আমিই সে, এই বার্তাটি ঘোষিত হয়েছে এই কবিতায়। মানুষ আছে বলেই বিধাতার সৃষ্টির সার্থকতা, মানুষের চেতনাতেই সুন্দর ‘সুন্দর’ হয়ে ওঠে, মানুষের উপলব্ধিতেই পৃথিবীতে প্রেমের প্রতিষ্ঠা। সেই প্রেম মানুষের কর্মে, উপলব্ধিতে জাগ্রত হওয়ার মাধ্যমে বিশ^ মানবতার এক অবস্থান তৈরি হয়।
রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন, ‘আমি বলছি আমাদের একদিকে অহং আর একদিকে আত্মা। অহং যেন খণ্ডাকাশ, ঘরের মধ্যকার আকাশ, যা নিয়ে বিষয় কর্ম, মামলা মোকদ্দমা এই সব। সেই আকাশের সংগে যুক্ত মহাকাশ, তা নিয়ে বৈষয়িকতা নেই, সেই আকাশ অসীম- বিশ^ব্যাপী। বিশ^ব্যাপী আকাশে ও খণ্ডাকাশে যে ভেদ, অহং আর আত্মার মধ্যে সেই ভেদ। মানবতা বলতে যে পুরুষ, তিনি আমার খণ্ডাকাশের মধ্যেও আছেন। আমার মধ্যে দুটো দিক আছে, এক আমাতেই বদ্ধ আর এক সর্বত্র ব্যাপ্ত। এই দুইই যুক্ত এবং উভয়কে মিলিয়েই আমার পরিপূর্ণ সত্তা। তাই বলছি, যখন আমরা অহংকে একান্ত আঁকড়ে ধরি তখন আমরা মানব ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ি। সেই মহামানব, সেই বিরাট পুরুষ, যিনি আমার মধ্যে রয়েছেন, তাঁর সংগে বিচ্ছেদ ঘটে।’
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। বিশ্বকবি হিসেবে তাঁর প্রসার ও খ্যাতি অবিসংবাদিত। কিন্তু এত কিছুর পরেও মানব প্রত্যয়ী রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যেই দৈবের সন্ধান করেছেন। এই মানবের কাছেই তিনি তাদের আপন মানুষ হিসেবে অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন।
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমাদেরই লোক।
আর কিছু নয়
এই হোক শেষ পরিচয়।
রবীন্দ্রনাথ মানবাত্মা খুঁজতে গিয়ে এমন এক মানুষকে পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে নিজেকে চেনার অদম্য বাসনা, বাস্তবিকপক্ষে মানবতার সারবত্তা সেখানেই যেখানে মানুষের অভিব্যক্তির গতি অন্তরের দিকে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে বৃটিশ শাসনামলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখেছেন। তাঁর চেতনায় নাড়া দিয়েছিলো একটি প্রশ্ন ‘এ কি হল ধর্মের চেহারা? এই মোহযুক্ত ধর্মবিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো ছিল। ঈশ^রদ্রোহী পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলী পরালে যে কি বীভৎস অবস্থা হয়ে ওঠে তা চোখ খুলে একটু দেখলেই বোঝা যায়।’ রবীন্দ্রনাথ ধর্ম ও ধর্ম মতকে এক করে দেখেননি। তাঁর মতে, ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য, কিন্তু ধর্মমত মানুষের স্বার্থ বুদ্ধির পরিচয়- তা মানুষকে অকল্যানের দিকে ঠেলে দেয়। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি বলেন- ‘ধর্ম সম্বন্ধীয় সব কিছুকেই আমরা নিত্য বলে ধরেছি। ভুলে যাই যে, ধর্মের নিত্য আদর্শকে শ্রদ্ধা করি বলেই ধর্মমতকে নিত্য বলে স্বীকার করতে হবে এমন কথা বলা চলে না। ভৌতিক বিজ্ঞানের মূলে নিত্য সত্য আছে বলেই বৈজ্ঞানিক মত মাত্রই নিত্য, এমন গোঁড়ামির কথা যদি বলি তাহলে আজও বলতে হবে, সূর্যই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। ধর্ম সম্বন্ধে এই ভুলই ঘটে; সম্প্রদায় আপন মতকেই বলে ধর্ম আর ধর্মকেই করে আঘাত।’
রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদের দর্শন বাংলাদেশের বাউলদের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। এক সময় তিনি এই সত্যকে খুঁজেছিলেন উপনিষদে, বৈষ্ণব ধর্মে ও সাহিত্যে। পরিশেষে তা আবিষ্কার করেছিলেন কুষ্টিয়া শিলাইদহ অঞ্চলের বাউলদের মধ্যেই। গীতাঞ্জলি সহ তাঁর সকল কাব্য, সংগীত ও রচনাবলীর মধ্যেই এই জীবন দর্শনকেই আমরা আবিষ্কার করি। প্রশ্ন জাগে রবীন্দ্রনাথ কেন বাউলের প্রতি আকৃষ্ট হলেন? তিনি বাউলের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন যে, মানুষের মুিক্তর স্বপ্ন শাস্ত্রাচারে পিষ্ট। অনুভব করেছিলেন মানবতার উদবোধন। বিশ^ময় মানুষের প্রতি মানুষের যে মানবতার প্রকাশ, সেটাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাগ্রে। কবীর এবং লালন উভয়েই ছিলেন তাঁর সকল প্রেরণার উৎস। এই দুই বাউল ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করেছেন। এই ধর্মান্ধতা থেকেই যে হানাহানির জন্ম হয়েছিলো, তা হিন্দু মুসলমান উভয়কেই নিঃশেষিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ তা লক্ষ্য করেছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন-
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
বাউল আদর্শে আপন অন্তরের মধ্যে আপন আত্মার মনের মানুষকে খোঁজার পক্ষপাতি রবীন্দ্রনাথ। বৃহদারণ্যকের বাণী উধৃত করে তিনি বলেন- ‘যে মানুষ অন্য দেবতাকে উপাসনা করে সেই দেবতা অন্য আর আমি অন্য- এমন কথা যে ভাবে, সে তো দেবতাদের পশুর মতোই।’ অর্থাৎ, সেই দেবতার কল্পনা মানুষকে আপনার বাইরে বন্দি করে রাখে, তখন মানুষ আপন দেবতার দ্বারাই আপন আত্মা হতে নির্বাসিত, অপমানিত। আপনার বাহিরেও ঈশ^রকে সন্ধান করা মানে আত্মাকেই অসম্মান করা। যে দেবতাকে আমার থেকে পৃথক করে বাইরে স্থাপন করি, তাকে স্বীকার করার দ্বারাই নিজেকে নিজের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দিই। নিজের মধ্য থেকেই উৎসারিত হয় আমার নিজের সত্তা যা আমার ভেতরেই অবস্থিত।’
শুদ্ধ মনের মানুষের মাঝে মানবাত্মা সকল দ্বেষ, হিংসা ভুলে অন্য মানুষের কল্যাণের পথ খুঁজে ফেরে। বাংলাদেশের বাউল বলছে-
মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ
একবার দিব্য চক্ষু খুলে গেলে দেখতে পাবি সর্বঠাঁই।
রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে যে, ‘এই যে মনের মানুষকে সন্ধান করা, তাকে জানা, এ তো বাইরে জানা, বাইরে পাওয়া নয়। এ যে আপন অন্তরে আপনি হওয়ার জানা, হওয়ার দ্বারা পাওয়া। মানুষ আপন ব্যক্তিগত সংস্কারকে পার হয়ে যে জ্ঞানকে পায়, যাকে বলে বিজ্ঞান, সেই জ্ঞান নিখিল মানবের, তাকে সকল মানুষ স্বীকার করবে, সেই জন্যে তা শ্রদ্ধেয়। তেমনি মানুষের মধ্যে স্বার্থগত ‘আমি’র চেয়ে যে বড়ো আমি সেই ‘আমি’র সংগে সকলের ঐক্য, তার কর্ম সকলের কর্ম। একলা ‘আমি’র কর্মই বন্ধন, সকল ‘আমি’র কর্মই মুক্তি। সেই মনের মানুষ সকল মনের মানুষ, আপন মনের মধ্যে তাঁকে দেখতে পেলে সকলের মধ্যেই তাকে পাওয়া যায়।’
বাউলের ধর্মকে রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্ম বলে বুঝেছিলেন। তাই মানুষই ছিলো তার আরাধ্য, কারণ এই মানুষের মধ্যেই তিনি তাঁর পরমারাধ্যাকে অবলোকন করেছিলেন। তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে এই মানুষের প্রকাশ ঘটেছে। বাউল সাধনা ছিলো এই মানুষ ভজনার সাধনা। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে এখানে। শিলাইদহের গগন হরকরার গান-
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষ, তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে
এই গান রবীন্দ্রনাথকে এতটাই অভিভূত করেছিলো যে, তিনি শুধু গানটির সার্বিক বিচার ব্যাখ্যাই করেননি, স্বদেশী যুগে রচিত তাঁর অন্যতম প্রধান দেশবন্দনা গান ‘আমার সোনার বাংলা’ য় ঐ বাউল রীতির সুর আরোপ করে তাতে দেশপ্রেমের মমতা ভরা করুণ আবেগ সঞ্চারিত করেন। গগন হরকরার ঐ সত্তা কাঁপানো ‘মনের মানুষ’কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ে নানাভাবে কথা বলেছেন।
‘মানুষের ধর্ম ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের যত কিছু দুর্গতি আছে, সেই আপন মানুষকে হারিয়ে তাকে বাইরের উপকরণে খুঁজতে গিয়ে অর্থাৎ আপনাকেই পার করে দিয়ে।... সেই বাইরে বিক্ষিপ্ত আপনহারা মানুষের বিলাপ গান একদিন শুনেছিলেম পথিক ভিখারির মুখে।... সেই নিরক্ষর গাঁয়ের লোকের মুখেই শুনেছিলেম- ‘তোরই ভিতর অতল সাগর।’
সেই পাগলই গেয়েছিল- ‘মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষণ।’
সেই অন্বেষণেরই প্রার্থনা বেদে আছে।
রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন মানুষের সার্বজনীন কল্যাণের পথ থেকে সরে আসার অবস্থায় বিশ^ভ্রাতৃত্ববোধ বিলীন হয়ে গিয়েছে। স্বার্থবোধ এবং কুসংস্কারের বেড়াজালে পড়ে মানুষ তার নিজস্ব চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে নিতান্তই ধর্মবোধের যৌক্তিকতার বিচারে। এখানে রবীন্দ্রনাথ অন্তত উপলব্ধি করতে পেরেছেন ধর্মীয় সংকীর্ণতার সামাজিক রক্ষণশীলতায় একটি ভয়াবহ মানব বিপর্যয়ের পরিস্থিতির চিত্র। “মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতি রক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে, সেই অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবেই।” (চিঠিপত্র-৩)
মানুষের প্রতি মানুষের অবজ্ঞা তৎকালীন সময়ে সমাজের একটি বিরূপ অবস্থা প্রতীয়মান হয়েছিল। এই বিদ্বেষের ফলাফল শুধু সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও যে মারাত্মক সে তথ্য রবীন্দ্রনাথ বহুবার সভাসমিতিতে, রাজনৈতিক মঞ্চে এবং প্রধানত তাঁর প্রবন্ধাবলীতে তুলে ধরেছেন, আবেদন জানিয়েছেন যাতে বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করা হয়। আধুনিকমনস্কতায় আলোকিত হয়ে সামাজিক অবস্থার উত্তরোত্তর পরিশীলনে মানুষের চেতনা এক নবরূপ আদর্শে অভিষিক্ত হয়। রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল, সর্বজনীনতার গুণে নিষিক্ত হয়ে এর অবয়ব থেকে বিভেদি কাঁটাগুলোর অপসারণ, যাতে মানুষে মানুষে মিলনের পথ মসৃণ হয়ে ওঠে। স্বদেশে কবি এই মানবমুখীন রূপান্তর চেয়েছিলেন ধর্ম ও সম্প্রদায় চেতনার, যা তাঁর মতে ছিলো এদেশে মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম সনদ।
রবীন্দ্রনাথ মানবসম্পদের সংকট উপলব্ধি করেছিলেন এবং তিনি এক জীবন দর্শন চিন্তা করেছিলেন যেখানে তিনি মানুষের জন্মভূমির তিনটি দর্শনের কথা বলেছেন। প্রথমত, মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর সর্বত্র। জাতি হতে পারে ভিন্ন, কিন্তু এই পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতি একই সত্তায় গড়া। সমস্ত পৃথিবীতে মানবজাতি একই সূত্রে গ্রথিত। মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক। মানুষ তার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ইতিহাস নিয়ে এগিয়ে চলে। সে নিজের পরিচয়সূত্রে বিশ^ মানবের একটি বিশেষ অংশ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তৃতীয় হলো বাসস্থান, আত্মিক লোক। সমস্ত পৃথিবীতে এক মানবাত্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে মানুষ, তার উচিত সর্বমানবচিত্তের সমন্বয়ে এক পৃথিবীতে বসবাস করে একে অপরের কল্যাণের পথে এগিয়ে আসা।
রবীন্দ্রনাথ মানবাত্মা খুঁজতে গিয়ে এমন এক মানুষকে পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে নিজেকে চেনার অদম্য বাসনা, বাস্তবিকপক্ষে মানবতার সারবত্তা সেখানেই যেখানে মানুষের অভিব্যক্তির গতি অন্তরের দিকে। এভাবেই নিজেকে চেনা আর নিজেকে চেনার মাধ্যমেই বাইরের সমগ্র মানবজগতকে প্রেমময় চেতনার মাধ্যমে নিজের কাছে টেনে নেয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ মানবতার দর্শন এভাবেই ছড়িয়েছেন আমাদের মাঝে।
সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মানুষের মানবতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছিলেন। তাঁর সারা জীবনের নমস্য ছিলো মনুষ্যত্বের সাধনা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিকর্ম মানব হিতাকাক্সক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, হাসি-কান্না, সুখদুঃখ এসবের সম্মিলনে সমৃদ্ধ করেছেন। মানব বন্দনা ও মানুষের কৃতিকে তাঁর সাহিত্যে উপস্থাপন করা হয়েছে ভিন্ন মাত্রায়। সীমার মাঝে অসীমতার যে প্রকাশ, মানুষের সহজাত সত্তার বিকাশ তার গণ্ডীর বাইরে গিয়েও যে আরেকটি জগৎকে প্রকাশিত করার মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়, তা রবীন্দ্রনাথ কবিতায় এবং প্রবন্ধে লিখেছেন। অগনিত মানুষের আদর্শের মধ্য দিয়ে একটি সার্বজনীন মানব আদর্শ গড়ে ওঠে। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সার্বজনীন মানুষের অবয়ব সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন এইভাবে- ‘মানুষ উন্নতির সংগে সংগে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎ মানুষ হয়ে উঠছে। তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা বৃহৎ মানুষের সাধনা। এই বৃহৎ মানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরেও আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানান জাত। অন্তরে আছে শুধু এক মানব। এই এক মানব তার অন্তর্জগৎকে ছাপিয়ে বহির্জগতের মানবাত্মাকে এক করে নেয়।’ রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য ‘আমি কি, আমার চরম মূল্য কোথায়।’ তার উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন ‘মানুষ কি করে হবে মানুষের মতো তাই নিয়ে বর্বর দশা থেকে সভ্য অবস্থা পর্যন্ত তার চিন্তা ও প্রয়াসের অন্ত নেই। সে বুঝেছে, সেটা সহজ নয়, তার মধ্যে একটা রহস্য রয়েছে। এই রহস্যের আবরণ উদযাপিত হতে হতে সে আপনাকে চিনবে। শত শত শতাব্দী ধরে চলেছে তার প্রয়াস। এমনি করে বড়ো ভূমিকায় নিজের সত্যকে স্পষ্ট করে উপলব্ধি করতে তার অহেতুক আগ্রহ। যাকে সে পূজা করে তার দ্বারাই সে প্রমান করে তার মতে নিজে সে সত্য, কিসে তার বুদ্ধি, কাকে বলে পূজনীয়, কাকে পূর্ণতা বলে।’ এই যে সত্য উপলব্ধির বিষয়, মানুষের মাঝে এই উপলব্ধি ছড়িয়ে দিতে পারলে সুন্দর ও কল্যানের বিস্তার সম্ভব হয়ে ওঠে।
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ¦লে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’
সুন্দর হল সে।
এই কবিতাটিতে একটি গভীর দর্শন রয়েছে। ‘সোহম’- আমিই সে, এই বার্তাটি ঘোষিত হয়েছে এই কবিতায়। মানুষ আছে বলেই বিধাতার সৃষ্টির সার্থকতা, মানুষের চেতনাতেই সুন্দর ‘সুন্দর’ হয়ে ওঠে, মানুষের উপলব্ধিতেই পৃথিবীতে প্রেমের প্রতিষ্ঠা। সেই প্রেম মানুষের কর্মে, উপলব্ধিতে জাগ্রত হওয়ার মাধ্যমে বিশ^ মানবতার এক অবস্থান তৈরি হয়।
রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন, ‘আমি বলছি আমাদের একদিকে অহং আর একদিকে আত্মা। অহং যেন খণ্ডাকাশ, ঘরের মধ্যকার আকাশ, যা নিয়ে বিষয় কর্ম, মামলা মোকদ্দমা এই সব। সেই আকাশের সংগে যুক্ত মহাকাশ, তা নিয়ে বৈষয়িকতা নেই, সেই আকাশ অসীম- বিশ^ব্যাপী। বিশ^ব্যাপী আকাশে ও খণ্ডাকাশে যে ভেদ, অহং আর আত্মার মধ্যে সেই ভেদ। মানবতা বলতে যে পুরুষ, তিনি আমার খণ্ডাকাশের মধ্যেও আছেন। আমার মধ্যে দুটো দিক আছে, এক আমাতেই বদ্ধ আর এক সর্বত্র ব্যাপ্ত। এই দুইই যুক্ত এবং উভয়কে মিলিয়েই আমার পরিপূর্ণ সত্তা। তাই বলছি, যখন আমরা অহংকে একান্ত আঁকড়ে ধরি তখন আমরা মানব ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ি। সেই মহামানব, সেই বিরাট পুরুষ, যিনি আমার মধ্যে রয়েছেন, তাঁর সংগে বিচ্ছেদ ঘটে।’
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। বিশ্বকবি হিসেবে তাঁর প্রসার ও খ্যাতি অবিসংবাদিত। কিন্তু এত কিছুর পরেও মানব প্রত্যয়ী রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যেই দৈবের সন্ধান করেছেন। এই মানবের কাছেই তিনি তাদের আপন মানুষ হিসেবে অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন।
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমাদেরই লোক।
আর কিছু নয়
এই হোক শেষ পরিচয়।
রবীন্দ্রনাথ মানবাত্মা খুঁজতে গিয়ে এমন এক মানুষকে পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে নিজেকে চেনার অদম্য বাসনা, বাস্তবিকপক্ষে মানবতার সারবত্তা সেখানেই যেখানে মানুষের অভিব্যক্তির গতি অন্তরের দিকে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে বৃটিশ শাসনামলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখেছেন। তাঁর চেতনায় নাড়া দিয়েছিলো একটি প্রশ্ন ‘এ কি হল ধর্মের চেহারা? এই মোহযুক্ত ধর্মবিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো ছিল। ঈশ^রদ্রোহী পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলী পরালে যে কি বীভৎস অবস্থা হয়ে ওঠে তা চোখ খুলে একটু দেখলেই বোঝা যায়।’ রবীন্দ্রনাথ ধর্ম ও ধর্ম মতকে এক করে দেখেননি। তাঁর মতে, ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য, কিন্তু ধর্মমত মানুষের স্বার্থ বুদ্ধির পরিচয়- তা মানুষকে অকল্যানের দিকে ঠেলে দেয়। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি বলেন- ‘ধর্ম সম্বন্ধীয় সব কিছুকেই আমরা নিত্য বলে ধরেছি। ভুলে যাই যে, ধর্মের নিত্য আদর্শকে শ্রদ্ধা করি বলেই ধর্মমতকে নিত্য বলে স্বীকার করতে হবে এমন কথা বলা চলে না। ভৌতিক বিজ্ঞানের মূলে নিত্য সত্য আছে বলেই বৈজ্ঞানিক মত মাত্রই নিত্য, এমন গোঁড়ামির কথা যদি বলি তাহলে আজও বলতে হবে, সূর্যই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। ধর্ম সম্বন্ধে এই ভুলই ঘটে; সম্প্রদায় আপন মতকেই বলে ধর্ম আর ধর্মকেই করে আঘাত।’
রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদের দর্শন বাংলাদেশের বাউলদের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। এক সময় তিনি এই সত্যকে খুঁজেছিলেন উপনিষদে, বৈষ্ণব ধর্মে ও সাহিত্যে। পরিশেষে তা আবিষ্কার করেছিলেন কুষ্টিয়া শিলাইদহ অঞ্চলের বাউলদের মধ্যেই। গীতাঞ্জলি সহ তাঁর সকল কাব্য, সংগীত ও রচনাবলীর মধ্যেই এই জীবন দর্শনকেই আমরা আবিষ্কার করি। প্রশ্ন জাগে রবীন্দ্রনাথ কেন বাউলের প্রতি আকৃষ্ট হলেন? তিনি বাউলের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন যে, মানুষের মুিক্তর স্বপ্ন শাস্ত্রাচারে পিষ্ট। অনুভব করেছিলেন মানবতার উদবোধন। বিশ^ময় মানুষের প্রতি মানুষের যে মানবতার প্রকাশ, সেটাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাগ্রে। কবীর এবং লালন উভয়েই ছিলেন তাঁর সকল প্রেরণার উৎস। এই দুই বাউল ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করেছেন। এই ধর্মান্ধতা থেকেই যে হানাহানির জন্ম হয়েছিলো, তা হিন্দু মুসলমান উভয়কেই নিঃশেষিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ তা লক্ষ্য করেছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন-
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
বাউল আদর্শে আপন অন্তরের মধ্যে আপন আত্মার মনের মানুষকে খোঁজার পক্ষপাতি রবীন্দ্রনাথ। বৃহদারণ্যকের বাণী উধৃত করে তিনি বলেন- ‘যে মানুষ অন্য দেবতাকে উপাসনা করে সেই দেবতা অন্য আর আমি অন্য- এমন কথা যে ভাবে, সে তো দেবতাদের পশুর মতোই।’ অর্থাৎ, সেই দেবতার কল্পনা মানুষকে আপনার বাইরে বন্দি করে রাখে, তখন মানুষ আপন দেবতার দ্বারাই আপন আত্মা হতে নির্বাসিত, অপমানিত। আপনার বাহিরেও ঈশ^রকে সন্ধান করা মানে আত্মাকেই অসম্মান করা। যে দেবতাকে আমার থেকে পৃথক করে বাইরে স্থাপন করি, তাকে স্বীকার করার দ্বারাই নিজেকে নিজের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দিই। নিজের মধ্য থেকেই উৎসারিত হয় আমার নিজের সত্তা যা আমার ভেতরেই অবস্থিত।’
শুদ্ধ মনের মানুষের মাঝে মানবাত্মা সকল দ্বেষ, হিংসা ভুলে অন্য মানুষের কল্যাণের পথ খুঁজে ফেরে। বাংলাদেশের বাউল বলছে-
মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ
একবার দিব্য চক্ষু খুলে গেলে দেখতে পাবি সর্বঠাঁই।
রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে যে, ‘এই যে মনের মানুষকে সন্ধান করা, তাকে জানা, এ তো বাইরে জানা, বাইরে পাওয়া নয়। এ যে আপন অন্তরে আপনি হওয়ার জানা, হওয়ার দ্বারা পাওয়া। মানুষ আপন ব্যক্তিগত সংস্কারকে পার হয়ে যে জ্ঞানকে পায়, যাকে বলে বিজ্ঞান, সেই জ্ঞান নিখিল মানবের, তাকে সকল মানুষ স্বীকার করবে, সেই জন্যে তা শ্রদ্ধেয়। তেমনি মানুষের মধ্যে স্বার্থগত ‘আমি’র চেয়ে যে বড়ো আমি সেই ‘আমি’র সংগে সকলের ঐক্য, তার কর্ম সকলের কর্ম। একলা ‘আমি’র কর্মই বন্ধন, সকল ‘আমি’র কর্মই মুক্তি। সেই মনের মানুষ সকল মনের মানুষ, আপন মনের মধ্যে তাঁকে দেখতে পেলে সকলের মধ্যেই তাকে পাওয়া যায়।’
বাউলের ধর্মকে রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্ম বলে বুঝেছিলেন। তাই মানুষই ছিলো তার আরাধ্য, কারণ এই মানুষের মধ্যেই তিনি তাঁর পরমারাধ্যাকে অবলোকন করেছিলেন। তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে এই মানুষের প্রকাশ ঘটেছে। বাউল সাধনা ছিলো এই মানুষ ভজনার সাধনা। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে এখানে। শিলাইদহের গগন হরকরার গান-
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষ, তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে
এই গান রবীন্দ্রনাথকে এতটাই অভিভূত করেছিলো যে, তিনি শুধু গানটির সার্বিক বিচার ব্যাখ্যাই করেননি, স্বদেশী যুগে রচিত তাঁর অন্যতম প্রধান দেশবন্দনা গান ‘আমার সোনার বাংলা’ য় ঐ বাউল রীতির সুর আরোপ করে তাতে দেশপ্রেমের মমতা ভরা করুণ আবেগ সঞ্চারিত করেন। গগন হরকরার ঐ সত্তা কাঁপানো ‘মনের মানুষ’কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ে নানাভাবে কথা বলেছেন।
‘মানুষের ধর্ম ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের যত কিছু দুর্গতি আছে, সেই আপন মানুষকে হারিয়ে তাকে বাইরের উপকরণে খুঁজতে গিয়ে অর্থাৎ আপনাকেই পার করে দিয়ে।... সেই বাইরে বিক্ষিপ্ত আপনহারা মানুষের বিলাপ গান একদিন শুনেছিলেম পথিক ভিখারির মুখে।... সেই নিরক্ষর গাঁয়ের লোকের মুখেই শুনেছিলেম- ‘তোরই ভিতর অতল সাগর।’
সেই পাগলই গেয়েছিল- ‘মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষণ।’
সেই অন্বেষণেরই প্রার্থনা বেদে আছে।
রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন মানুষের সার্বজনীন কল্যাণের পথ থেকে সরে আসার অবস্থায় বিশ^ভ্রাতৃত্ববোধ বিলীন হয়ে গিয়েছে। স্বার্থবোধ এবং কুসংস্কারের বেড়াজালে পড়ে মানুষ তার নিজস্ব চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে নিতান্তই ধর্মবোধের যৌক্তিকতার বিচারে। এখানে রবীন্দ্রনাথ অন্তত উপলব্ধি করতে পেরেছেন ধর্মীয় সংকীর্ণতার সামাজিক রক্ষণশীলতায় একটি ভয়াবহ মানব বিপর্যয়ের পরিস্থিতির চিত্র। “মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতি রক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে, সেই অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবেই।” (চিঠিপত্র-৩)
মানুষের প্রতি মানুষের অবজ্ঞা তৎকালীন সময়ে সমাজের একটি বিরূপ অবস্থা প্রতীয়মান হয়েছিল। এই বিদ্বেষের ফলাফল শুধু সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও যে মারাত্মক সে তথ্য রবীন্দ্রনাথ বহুবার সভাসমিতিতে, রাজনৈতিক মঞ্চে এবং প্রধানত তাঁর প্রবন্ধাবলীতে তুলে ধরেছেন, আবেদন জানিয়েছেন যাতে বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করা হয়। আধুনিকমনস্কতায় আলোকিত হয়ে সামাজিক অবস্থার উত্তরোত্তর পরিশীলনে মানুষের চেতনা এক নবরূপ আদর্শে অভিষিক্ত হয়। রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল, সর্বজনীনতার গুণে নিষিক্ত হয়ে এর অবয়ব থেকে বিভেদি কাঁটাগুলোর অপসারণ, যাতে মানুষে মানুষে মিলনের পথ মসৃণ হয়ে ওঠে। স্বদেশে কবি এই মানবমুখীন রূপান্তর চেয়েছিলেন ধর্ম ও সম্প্রদায় চেতনার, যা তাঁর মতে ছিলো এদেশে মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম সনদ।
রবীন্দ্রনাথ মানবসম্পদের সংকট উপলব্ধি করেছিলেন এবং তিনি এক জীবন দর্শন চিন্তা করেছিলেন যেখানে তিনি মানুষের জন্মভূমির তিনটি দর্শনের কথা বলেছেন। প্রথমত, মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর সর্বত্র। জাতি হতে পারে ভিন্ন, কিন্তু এই পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতি একই সত্তায় গড়া। সমস্ত পৃথিবীতে মানবজাতি একই সূত্রে গ্রথিত। মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক। মানুষ তার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ইতিহাস নিয়ে এগিয়ে চলে। সে নিজের পরিচয়সূত্রে বিশ^ মানবের একটি বিশেষ অংশ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তৃতীয় হলো বাসস্থান, আত্মিক লোক। সমস্ত পৃথিবীতে এক মানবাত্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে মানুষ, তার উচিত সর্বমানবচিত্তের সমন্বয়ে এক পৃথিবীতে বসবাস করে একে অপরের কল্যাণের পথে এগিয়ে আসা।
রবীন্দ্রনাথ মানবাত্মা খুঁজতে গিয়ে এমন এক মানুষকে পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে নিজেকে চেনার অদম্য বাসনা, বাস্তবিকপক্ষে মানবতার সারবত্তা সেখানেই যেখানে মানুষের অভিব্যক্তির গতি অন্তরের দিকে। এভাবেই নিজেকে চেনা আর নিজেকে চেনার মাধ্যমেই বাইরের সমগ্র মানবজগতকে প্রেমময় চেতনার মাধ্যমে নিজের কাছে টেনে নেয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ মানবতার দর্শন এভাবেই ছড়িয়েছেন আমাদের মাঝে।