নাসরীন জাহান
আমার আত্মা হরনিয়া সুমনদা, আগাগোড়া এমনই ভেবে এসেছে টুনিবেবি। এখন যা বয়স তার, বেবিটা নামের সঙ্গে মানায় না, কিন্তু বাবা ডাকত এ নামে, এ নামটা সুমনদার খুব পছন্দ ছিল।
আজীবনই অস্থির প্রকৃতি তার, কেবল সুমনদার সামনে এলে সে একটা স্থিত সংহতার মধ্যে পড়ে যেত সে দীর্ঘসময়ের জন্য ভেতরের কম্পন কিছুতেই বাইরে দেখা যেত না, এক আজব কৌশল রপ্ত করেছিল টুনিবেবি।
ফলে তাকে অনেকটা ভাবলেশহীন ভাবত সুনমদা। শুনেছে একথা সে বন্ধু সার্কেলে।
টুনিবেবির জন্মটা মা’র কাছে রীতিমতো অভিশাপ ছিল। সহ্যই করতে পারতেন না তিনি মেয়েকে। কন্যা জন্ম দিয়ে তাকে আদরে বড় করবেন, এ মার ফলে হেলা-অবহেলায় বিপর্যস্ত শিশুটিকে কোমল মায়ায় বাবা আঁকড়ে ধরলেন।
কিন্তু চাকুরে বাবা ঘরে কতক্ষণ?
মা’র পিণ্ডি চটকানো চিল্লানি আর বিরক্তিতে ঘরের সমস্ত কাজ করতে করতে প্রশ্ন উঠত টুনিবেবির ভেতর, এ সত্যিই আসল মা তো?
নিঃশব্দে বাবাকে প্রশ্নও করেছে।
চুপ! চুপ এভাবে বলে না- আলতো থাপড় ঠোঁটে দিয়েছে বাবা এর মাঝে কী এক সংগঠন করেন সুনমদা। শুনে শুনে বন্ধুদের সূত্র ধরে ঠিক ওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় টুনিবেবি।
ঘনমিশালী দিন-রাত্রির অবয়বে নিথর সময় কাটত অ্যাদ্দিন, হৃৎপিণ্ডির পাঁজর ফুঁড়ে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস বাতাসের পরতে পরতে ভাসত।
আত্মবুঁদ হয়ে নিজের সঙ্গে নিজেই কুণ্ডুলি পাকিয়ে যেত সে।
সারা দিনরাত্রি দেখা নেই বললেই চলে। শুধু ইস্কুল থেকে আসার সময় রোজ দেখত, তার বাড়ির সামনে সুমনদা বাগানের কাজ করাচ্ছে মালিকে দিয়ে।
কখনো দেখত নেই। তখন বুকটায় একটা মস্ত হাহা উঠত, আর তার শূন্য বাড়িটাকে দেখেই ভেতরে কম্পন উঠত। সমস্ত স্কুল আসা-যাওয়া করতই সে এই বাগানটি অতিক্রম করার জন্য।
তখন কথা ছিল না দুজনের পরিচয় করিয়েছিল একজন, যা সুমনদাকে দেখলে বোঝা যায়, ভুলে গেছে।
তাকে দেখত এক-দু’পশলা বাগান কাজের ফাঁকে, তাতেই পা দুটো এমন নিথর হয়ে যেত।
সংগঠনে ঢোকা এবং স্থায়িত্ব লাভের জন্য বন্ধুর কাছ থেকে কিছু ছন্দ মিলিয়ে ছড়া লেখা শিখেছিল। এতেই যেন তুরুপের তাস মিলল।
সপ্তাহে একদিন অনেকটা সময় ধরে সুনমদার সাহচার্যে থাকা যাবে ভাবতেই আসমানের রঙধনু করায়ত্ত হয়ে যায় টুনিবেবির।
পাতলা ক্ষীণ দেহ, চাপ চাপদাড়ির মধ্যে অদ্ভুত রঙের সব পাঞ্জাবি, অবয়বটা এমন প্রখর গেঁথে যায় যে জীবনে আর কাউকে সেই অবয়বের মাঝখানে বসতে দেওয়া শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবই ছিল।
বলত বন্ধুরা সুনমদাও পছন্দ করে তাকে, মুখ দেখে মনেও হতো কিন্তু কোনোদিন শব্দ করে তাকে কিছু বলেনি সে।
এমনকি হৃৎপিণ্ডে প্রস্তর বেঁধে টুনিবেবির বিয়ের দিনও। এসেছিল বন্ধুদের সঙ্গে।
তার সহজাত শান্ত স্বভাব ভেঙে ফুর্তিও করেছিল। ওই ফুর্তিটাই তার কষ্টের প্রকাশ-বন্ধুদের এমন কথায় সীমাহীন থাপ্পড় উঠিয়েছিল টুনিবেবি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যায়, এমন শুনেছে কত, কিন্তু টুনিবেবির হয়নি। এক অসীম বিমর্ষতা নিয়ে সে বরের সঙ্গে চলত।
দূর-দূরতম থেকে ধূসর নীলাভ বাতাস এসে তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। বৃষ্টির টানা নহরের দিকে ভাবলেশহীন তাকাত সে, নিগূঢ় স্ট্যাচু এই স্ত্রীকে নিয়ে হাসব্যান্ড বিপর্যস্ত হওয়ার অবকাশই পেত না নিজ মহাকাজের ব্যস্ততার জন্য। টুনিবেবি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল।
চারপাশে কত যে আলোছায়ার বিচ্ছরণ ভেলকিবাজি। জীবন এভাবে তার প্রহরের ধাপ কেটে কেটে এগোয়, সময় সুমনদা থেকে অনেক দূরবর্তী এক জায়গায় এনে দাঁড় করায় টুনিবেবিকে। সন্তান হয় টুনিবেরির, তার স্কুল যাওয়া-আসা, সংসারের নানা কর্মে টুনিবেবি অনুভব করে, সময়ের অনেক দূরত্বে এসেও সে সুমনদাকে ভুলতে পারেনি।
ওই যে তখন, একটু যদি তার হাতটা ধরতে পারতাম। এই আকুতির অনাহার সত্তার রয়েই গেছে।
তুমি কাউকে ভালোবাসো?
হাসব্যান্ডের এই প্রশ্নে যেন প্রস্তর ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়, জেনে গেছে সে।
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
এ কিন্তু আমার উত্তর হলো না।
সেই পাতলা ফিনফিনে পাঞ্জাবি দেহের উড়তে উড়তে এগিয়ে আসা ভেতরটা আচমকা বিপর্যস্ত করলেও কঠিন অভিমানে উচ্চারণ করে টুনিবেবি না।
কী সুন্দর নাম তোমার টুনির সঙ্গে বেবি, সুমনদা বলত, কেমন যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো, তোমার অস্তিত্বকে সুন্দরতা দিয়েছে নামের সঙ্গে এই বেবি শব্দটি।
ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে পড়ত। বাড়ির যা পরিবেশ ছিল, বিয়ে করার অবকাশ ছিল না, সুনমদা সম্পর্কে এইসব শুনে শুনে নিজেকে থিতু করে সংসারটা সুন্দরভাবেই করছে টুনিবেবি, কিন্তু কোথায় গিয়ে নিজের পরাজিত সত্তায় এমন ঠাসা আসন গেড়ে বসে থাকে, সুমনদা, অসহায় বোধে ক্রোধ মাথায় চড়ে যায় তার।
সময় সব ভুলিয়ে দেয়, এত শুনেছে এই কথা, কিন্তু মানুষটার অবয়ব চোখে এলে এখনো কেন কম্পন টুনিবেবির? এখনো কেন অদ্ভুত এক শূন্যতার ফরফরানি? ভয়ানক নীবরতায় নিথর হয়ে যায় টুনিবেবি।
হামাগুঁড়ি দিয়ে সীমাহীনতা নামছে। এমনই এক রোদ্দুর মেগবতী দিনে হাসব্যান্ড সৈকত এসে খবর দেয়, জার্মানি থেকে তোমার সংগঠনের সুমন আহমেদ এসেছে। আমাদের অফিসের কাজের সঙ্গে তার ভীষণ যুক্ততা। সে আসবে আমাদের বাসায়, বলছিল একসঙ্গে সংগঠন করতে। সমস্ত কথাটা এক চক্করে গিলল টুনিবেবি। অনুভব করে এক কঠিন ঠাণ্ডা বাতাস মাথায় বরফের স্তূপ দিয়ে একটি জায়গায় ঠেসে রেখেছে তাকে।
কিছু বলছ না যে?
তক্ষুণি বন্ধুদের ফোন আসে, ওপাশ থেকে তারাও এই বার্তা জানায়। আমাদের আহ্বায়ক ছিলেন, তোতলা গিলে যথেষ্ট সহজভাবে বলার চেষ্টা করে টুনিবেবি, বাসায় আসবে? ও।
আর এগোতে পারে না।
এইবার পাল্টি খাবে টুনিবেবি, সামনাসামনি দেখা হলে সৈকতের সামনে একেবারে হাতেনাতে ধরা, নিজেকে বিন্যস্ত রাখা অসম্ভব। মাঝখান থেকে এদ্দিন পর সংসারটায় ভাঙন ধরবার সম্ভাবনা। না... না আমি দেখা করব না, বন্ধুদের জানায়, যেভাবেই হোক ক্যান্সেল করো তোমরা অথবা আমি কোথাও পালাচ্ছি। সে সংসার দাম্পত্যে সুখী মানুষ, শখ হয়েছে আমাকে দেখবে, আমার অত শখ নেই। বন্ধুরা নানা কথা বোঝায় টুনিকে।
ফোন রেখে অজস্র কান্নায় ডুবে যায় টুনি।
আমি কি নিজ চিত্তের আদলে গড়েছি তাকে? নইলে এতদিনেও মানুষটার অবয়ব মুছে যায় না কেন? সে অর্থে আমাদের দুজনের তেমন কোনো স্মৃতি নেই, কেবল মাঝে মাঝে সংগঠন থেকে এক সঙ্গে ফিরতাম, তার গায়ের সঙ্গে খুবই আলতো লেগে যাওয়া এবং পারফিউমের ঘ্রাণে প্রায়ই বেহিসেবি পা পড়ত আমার, টাল সামলে আমি নিজেই তো নিজেকে দাঁড় করাতাম, তবে?
এইসব ভাবছে যখন টুনিবেবির আর ভীতিকর প্রচ্ছায়ায় ডুবছে উঠছে আচমকা দরজায় নক।
টুনিবেবি তো ভেবেই ছিল, সেই মানুষটা এলে চরাঞ্চলে পূর্ণিমা নামবে, আলোছায়ার সঙ্গমে প্রহরের মধ্যে নেশা লেগে যাবে আর-
সামনে এসে দাঁড়ায় সুমনদা।
সুস্বাস্থ্যময় গেঞ্জি, কেডস পরিচিত চৌকস এক মানুষ।
বলেছিল বন্ধুরা, দারুণ হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে সুমনদা।
দেহের সমস্ত উষ্ণজল ঠাণ্ডা হয়ে থেতিয়ে যেতে থাকে, কই সেই পাতলা পাঞ্জাবি পরা ফিনফিনে অন্তর্মুখী লোকটা?
এ তো ভরাট শব্দে হাসছে, তার ভঙ্গিতে অহংকার, এই আমাকেই তুমি একতরফা ভালোবাসো। এই সবই টুনিবেবির স্থিত সত্য অনুভব।
তার অন্তরাত্মার জমিনে খা খা শূন্যতার ঢেউ ওঠে, আমার পরান কব্জা করে রাখা সেই পুরুষটা এই পৃথিবী থেকেই উধাও হয়ে গেছে? এ কে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে? যাকে আমি চিনিই না, যাকে দেখে বোধ বিকারের সমস্ত খিড়কি বন্ধ হয়ে গেল আমার-
যখন প্রচ্ছন্ন দাপটে সামনের মানুষটি উদ্ভাসিত, তখন অনন্তে গিয়ে প্রায় উচ্চকিত আর্তনাদেই উচ্চারণ করে টুনিবেবি, এই আপনাকেই এক সময় রাজপুত্র মনে হতো আমার? এই আপনিই আমার সেই ...।
সামনের উজ্জ্বলতা মুহূর্তে নিভে তুলো তুলো ছাই উড়তে থাকে চরাচরে।
নাসরীন জাহান
বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১
আমার আত্মা হরনিয়া সুমনদা, আগাগোড়া এমনই ভেবে এসেছে টুনিবেবি। এখন যা বয়স তার, বেবিটা নামের সঙ্গে মানায় না, কিন্তু বাবা ডাকত এ নামে, এ নামটা সুমনদার খুব পছন্দ ছিল।
আজীবনই অস্থির প্রকৃতি তার, কেবল সুমনদার সামনে এলে সে একটা স্থিত সংহতার মধ্যে পড়ে যেত সে দীর্ঘসময়ের জন্য ভেতরের কম্পন কিছুতেই বাইরে দেখা যেত না, এক আজব কৌশল রপ্ত করেছিল টুনিবেবি।
ফলে তাকে অনেকটা ভাবলেশহীন ভাবত সুনমদা। শুনেছে একথা সে বন্ধু সার্কেলে।
টুনিবেবির জন্মটা মা’র কাছে রীতিমতো অভিশাপ ছিল। সহ্যই করতে পারতেন না তিনি মেয়েকে। কন্যা জন্ম দিয়ে তাকে আদরে বড় করবেন, এ মার ফলে হেলা-অবহেলায় বিপর্যস্ত শিশুটিকে কোমল মায়ায় বাবা আঁকড়ে ধরলেন।
কিন্তু চাকুরে বাবা ঘরে কতক্ষণ?
মা’র পিণ্ডি চটকানো চিল্লানি আর বিরক্তিতে ঘরের সমস্ত কাজ করতে করতে প্রশ্ন উঠত টুনিবেবির ভেতর, এ সত্যিই আসল মা তো?
নিঃশব্দে বাবাকে প্রশ্নও করেছে।
চুপ! চুপ এভাবে বলে না- আলতো থাপড় ঠোঁটে দিয়েছে বাবা এর মাঝে কী এক সংগঠন করেন সুনমদা। শুনে শুনে বন্ধুদের সূত্র ধরে ঠিক ওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় টুনিবেবি।
ঘনমিশালী দিন-রাত্রির অবয়বে নিথর সময় কাটত অ্যাদ্দিন, হৃৎপিণ্ডির পাঁজর ফুঁড়ে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস বাতাসের পরতে পরতে ভাসত।
আত্মবুঁদ হয়ে নিজের সঙ্গে নিজেই কুণ্ডুলি পাকিয়ে যেত সে।
সারা দিনরাত্রি দেখা নেই বললেই চলে। শুধু ইস্কুল থেকে আসার সময় রোজ দেখত, তার বাড়ির সামনে সুমনদা বাগানের কাজ করাচ্ছে মালিকে দিয়ে।
কখনো দেখত নেই। তখন বুকটায় একটা মস্ত হাহা উঠত, আর তার শূন্য বাড়িটাকে দেখেই ভেতরে কম্পন উঠত। সমস্ত স্কুল আসা-যাওয়া করতই সে এই বাগানটি অতিক্রম করার জন্য।
তখন কথা ছিল না দুজনের পরিচয় করিয়েছিল একজন, যা সুমনদাকে দেখলে বোঝা যায়, ভুলে গেছে।
তাকে দেখত এক-দু’পশলা বাগান কাজের ফাঁকে, তাতেই পা দুটো এমন নিথর হয়ে যেত।
সংগঠনে ঢোকা এবং স্থায়িত্ব লাভের জন্য বন্ধুর কাছ থেকে কিছু ছন্দ মিলিয়ে ছড়া লেখা শিখেছিল। এতেই যেন তুরুপের তাস মিলল।
সপ্তাহে একদিন অনেকটা সময় ধরে সুনমদার সাহচার্যে থাকা যাবে ভাবতেই আসমানের রঙধনু করায়ত্ত হয়ে যায় টুনিবেবির।
পাতলা ক্ষীণ দেহ, চাপ চাপদাড়ির মধ্যে অদ্ভুত রঙের সব পাঞ্জাবি, অবয়বটা এমন প্রখর গেঁথে যায় যে জীবনে আর কাউকে সেই অবয়বের মাঝখানে বসতে দেওয়া শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবই ছিল।
বলত বন্ধুরা সুনমদাও পছন্দ করে তাকে, মুখ দেখে মনেও হতো কিন্তু কোনোদিন শব্দ করে তাকে কিছু বলেনি সে।
এমনকি হৃৎপিণ্ডে প্রস্তর বেঁধে টুনিবেবির বিয়ের দিনও। এসেছিল বন্ধুদের সঙ্গে।
তার সহজাত শান্ত স্বভাব ভেঙে ফুর্তিও করেছিল। ওই ফুর্তিটাই তার কষ্টের প্রকাশ-বন্ধুদের এমন কথায় সীমাহীন থাপ্পড় উঠিয়েছিল টুনিবেবি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যায়, এমন শুনেছে কত, কিন্তু টুনিবেবির হয়নি। এক অসীম বিমর্ষতা নিয়ে সে বরের সঙ্গে চলত।
দূর-দূরতম থেকে ধূসর নীলাভ বাতাস এসে তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। বৃষ্টির টানা নহরের দিকে ভাবলেশহীন তাকাত সে, নিগূঢ় স্ট্যাচু এই স্ত্রীকে নিয়ে হাসব্যান্ড বিপর্যস্ত হওয়ার অবকাশই পেত না নিজ মহাকাজের ব্যস্ততার জন্য। টুনিবেবি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল।
চারপাশে কত যে আলোছায়ার বিচ্ছরণ ভেলকিবাজি। জীবন এভাবে তার প্রহরের ধাপ কেটে কেটে এগোয়, সময় সুমনদা থেকে অনেক দূরবর্তী এক জায়গায় এনে দাঁড় করায় টুনিবেবিকে। সন্তান হয় টুনিবেরির, তার স্কুল যাওয়া-আসা, সংসারের নানা কর্মে টুনিবেবি অনুভব করে, সময়ের অনেক দূরত্বে এসেও সে সুমনদাকে ভুলতে পারেনি।
ওই যে তখন, একটু যদি তার হাতটা ধরতে পারতাম। এই আকুতির অনাহার সত্তার রয়েই গেছে।
তুমি কাউকে ভালোবাসো?
হাসব্যান্ডের এই প্রশ্নে যেন প্রস্তর ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়, জেনে গেছে সে।
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
এ কিন্তু আমার উত্তর হলো না।
সেই পাতলা ফিনফিনে পাঞ্জাবি দেহের উড়তে উড়তে এগিয়ে আসা ভেতরটা আচমকা বিপর্যস্ত করলেও কঠিন অভিমানে উচ্চারণ করে টুনিবেবি না।
কী সুন্দর নাম তোমার টুনির সঙ্গে বেবি, সুমনদা বলত, কেমন যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো, তোমার অস্তিত্বকে সুন্দরতা দিয়েছে নামের সঙ্গে এই বেবি শব্দটি।
ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে পড়ত। বাড়ির যা পরিবেশ ছিল, বিয়ে করার অবকাশ ছিল না, সুনমদা সম্পর্কে এইসব শুনে শুনে নিজেকে থিতু করে সংসারটা সুন্দরভাবেই করছে টুনিবেবি, কিন্তু কোথায় গিয়ে নিজের পরাজিত সত্তায় এমন ঠাসা আসন গেড়ে বসে থাকে, সুমনদা, অসহায় বোধে ক্রোধ মাথায় চড়ে যায় তার।
সময় সব ভুলিয়ে দেয়, এত শুনেছে এই কথা, কিন্তু মানুষটার অবয়ব চোখে এলে এখনো কেন কম্পন টুনিবেবির? এখনো কেন অদ্ভুত এক শূন্যতার ফরফরানি? ভয়ানক নীবরতায় নিথর হয়ে যায় টুনিবেবি।
হামাগুঁড়ি দিয়ে সীমাহীনতা নামছে। এমনই এক রোদ্দুর মেগবতী দিনে হাসব্যান্ড সৈকত এসে খবর দেয়, জার্মানি থেকে তোমার সংগঠনের সুমন আহমেদ এসেছে। আমাদের অফিসের কাজের সঙ্গে তার ভীষণ যুক্ততা। সে আসবে আমাদের বাসায়, বলছিল একসঙ্গে সংগঠন করতে। সমস্ত কথাটা এক চক্করে গিলল টুনিবেবি। অনুভব করে এক কঠিন ঠাণ্ডা বাতাস মাথায় বরফের স্তূপ দিয়ে একটি জায়গায় ঠেসে রেখেছে তাকে।
কিছু বলছ না যে?
তক্ষুণি বন্ধুদের ফোন আসে, ওপাশ থেকে তারাও এই বার্তা জানায়। আমাদের আহ্বায়ক ছিলেন, তোতলা গিলে যথেষ্ট সহজভাবে বলার চেষ্টা করে টুনিবেবি, বাসায় আসবে? ও।
আর এগোতে পারে না।
এইবার পাল্টি খাবে টুনিবেবি, সামনাসামনি দেখা হলে সৈকতের সামনে একেবারে হাতেনাতে ধরা, নিজেকে বিন্যস্ত রাখা অসম্ভব। মাঝখান থেকে এদ্দিন পর সংসারটায় ভাঙন ধরবার সম্ভাবনা। না... না আমি দেখা করব না, বন্ধুদের জানায়, যেভাবেই হোক ক্যান্সেল করো তোমরা অথবা আমি কোথাও পালাচ্ছি। সে সংসার দাম্পত্যে সুখী মানুষ, শখ হয়েছে আমাকে দেখবে, আমার অত শখ নেই। বন্ধুরা নানা কথা বোঝায় টুনিকে।
ফোন রেখে অজস্র কান্নায় ডুবে যায় টুনি।
আমি কি নিজ চিত্তের আদলে গড়েছি তাকে? নইলে এতদিনেও মানুষটার অবয়ব মুছে যায় না কেন? সে অর্থে আমাদের দুজনের তেমন কোনো স্মৃতি নেই, কেবল মাঝে মাঝে সংগঠন থেকে এক সঙ্গে ফিরতাম, তার গায়ের সঙ্গে খুবই আলতো লেগে যাওয়া এবং পারফিউমের ঘ্রাণে প্রায়ই বেহিসেবি পা পড়ত আমার, টাল সামলে আমি নিজেই তো নিজেকে দাঁড় করাতাম, তবে?
এইসব ভাবছে যখন টুনিবেবির আর ভীতিকর প্রচ্ছায়ায় ডুবছে উঠছে আচমকা দরজায় নক।
টুনিবেবি তো ভেবেই ছিল, সেই মানুষটা এলে চরাঞ্চলে পূর্ণিমা নামবে, আলোছায়ার সঙ্গমে প্রহরের মধ্যে নেশা লেগে যাবে আর-
সামনে এসে দাঁড়ায় সুমনদা।
সুস্বাস্থ্যময় গেঞ্জি, কেডস পরিচিত চৌকস এক মানুষ।
বলেছিল বন্ধুরা, দারুণ হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে সুমনদা।
দেহের সমস্ত উষ্ণজল ঠাণ্ডা হয়ে থেতিয়ে যেতে থাকে, কই সেই পাতলা পাঞ্জাবি পরা ফিনফিনে অন্তর্মুখী লোকটা?
এ তো ভরাট শব্দে হাসছে, তার ভঙ্গিতে অহংকার, এই আমাকেই তুমি একতরফা ভালোবাসো। এই সবই টুনিবেবির স্থিত সত্য অনুভব।
তার অন্তরাত্মার জমিনে খা খা শূন্যতার ঢেউ ওঠে, আমার পরান কব্জা করে রাখা সেই পুরুষটা এই পৃথিবী থেকেই উধাও হয়ে গেছে? এ কে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে? যাকে আমি চিনিই না, যাকে দেখে বোধ বিকারের সমস্ত খিড়কি বন্ধ হয়ে গেল আমার-
যখন প্রচ্ছন্ন দাপটে সামনের মানুষটি উদ্ভাসিত, তখন অনন্তে গিয়ে প্রায় উচ্চকিত আর্তনাদেই উচ্চারণ করে টুনিবেবি, এই আপনাকেই এক সময় রাজপুত্র মনে হতো আমার? এই আপনিই আমার সেই ...।
সামনের উজ্জ্বলতা মুহূর্তে নিভে তুলো তুলো ছাই উড়তে থাকে চরাচরে।