alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

কোভিড-১৯ সচেতনতা ও সাঁওতাল স্বেচ্ছাসেবী

মিথুশিলাক মুরমু

: সোমবার, ০২ আগস্ট ২০২১
image

কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করছেন সাবিত্রী হেমব্রম

১.

গত ১৮ জুন তাবিথা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মি. স্টিফেন সরেন’কে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ‘কোভিড-১৯ হিরো এওয়ার্ড’ (ঈড়ারফ-১৯ ঐঊজঙ অধিৎফং) ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে প্রদান করা হয়েছে। এটি ঘোষিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল জোন ১বি, রিজিওন ১০ হিসেবে আমার দেশ বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে। ঢাকায় তার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন ‘রোটারি ক্লাব অব ঢাকা কারওয়ান বাজার’-এর প্রেসিডেন্ট মহোদয়। রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ও পাস্ট ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর স্বাক্ষরিত স্মারক ক্রেস্ট মি. স্টিফেন সরেনসহ আরও কয়েকজন আমার দেশ থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন। স্মারক ক্রেস্টে লেখা ছিল- Certificate of Appreciation and GOLD AWARD proudly presesented to STEPHEN SOREN for commendable and selfless work at the time of the COVID-19 crisis. স্বাগত জানাই সাঁওতাল উন্নয়ন কর্মী ও কৃতী সন্তান মি. স্টিফেন সরেনকে। মি. স্টিফেন রোটারি ক্লাব অব ঢাকা কাওরান বাজার-এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সুদূর রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় অবহেলিত ও পিছিয়েপড়া আদিবাসী সাঁওতাল, কোলসহ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝেও কোভিড-১৯ সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান প্রদানপূর্বক সচেতনতামূলক পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীরা যেন কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে, সে জন্য খাবার সহায়তা পাশাপাশি দেশি মুরগি, টার্কি মুরগি ও ছাগল প্রদান করা হয়েছে। কর্মহীন মানুষগুলোর সাহাযার্থে এগিয়ে না এলে, দায়িত্ব না নিলে একদিন স্থানচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

কোল আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার অগ্রযাত্রাকে সচল রাখতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া হয়েছে, এতে করে অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে। যারা নার্সিং প্রশিক্ষণে চলমান রয়েছে, তাদের তুলে দেয়া হয়েছে ল্যাপটপও। নিরক্ষর তবে উদ্যমী যুব জুতা সেলাই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আপদকালীন খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তাবিথা ফাউন্ডেশন পরিচালিত কিন্ডারগার্টেন শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় মাস চারেক নিয়মিতভাবে। এই কিন্ডারগার্টেনে সাঁওতাল, বিহারী, হিন্দু-মুসলিম ছেলেমেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে। উল্লেখ্য যে, সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কোল আদিবাসীরাই সম্ভুক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এসব কিছু সম্ভব হয়েছে রোটারি ক্লাব অব ঢাকা কারওয়ান বাজার এবং তাবিথা ফাউন্ডেশনের যৌথ কর্মযজ্ঞে। এ বিষয়ে কথা বলছিলাম স্টিফেন সরেনের সঙ্গে। তার অভিব্যক্তি- নিঃসন্দেহে পুরস্কার হিসেবে নাম ঘোষিত হওয়া আনন্দের। বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, ‘আমরা কখনোই পুরস্কারের জন্যে কাজ করি নাই, স্রষ্টা আমাদের বিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, সুযোগ এবং আকাক্সক্ষা দিয়েছেন; আমরা শুধু সেটিকে প্রয়োগ করেছি। করোনাভাইরাসের প্রাক্কালেও আমরা অসচেতন মানুষের কথা চিন্তা করে সচেতনতার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আর আমি স্টিফেন সরেন আমার টিমকে কখনো সামনে থেকে এবং পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি।’ স্রষ্টার কাছে নিবেদন করি, তাবিথা ফাউন্ডেশন এগিয়ে যাক দূরন্ত গতিতে, আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়–ক দিক-দিগন্তে।

২.

জুলাই ৩১, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে একটি জাতীয় দৈনিকের ছোট্ট কিন্তু চমৎকার শিরোনাম, ‘করোনাভাইরাস সচেতনতার বার্তা নিয়ে যান সাবিত্রী’। সাবিত্রী আদিবাসী সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর একজন সচেতন স্বেচ্ছাসেবী কর্মী। সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসের করাল গ্রাসে চরমভাবে বিপর্যস্ত, সেই ভয়ঙ্করতার ঢেউ নিভৃতপল্লী আদিবাসী সাঁওতাল গ্রামকেও ছুঁয়ে ফেলেছে। ৮ মার্চ, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ পর্যন্ত ইতোমধ্যেই সাঁওতালরাও হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনদের। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যালঘু আদিবাসী সাঁওতালসহ কয়েক ডজন আদিবাসীদের জীবনরক্ষায় ধুলোর রাস্তায় নেমে পড়েছেন সাবিত্রী হেমব্রম। সংখ্যালঘুরা যদি এই বৈশি^ক মহামারীতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন; তাহলে একজন সচেতন আদিবাসী নাগরিক হিসেবে নৈতিক দায়বদ্ধতার দায় অবশ্যই বর্তায়। হতে পারে এমন দায়বদ্ধতার বোধ থেকেই হাতে ধার করা হ্যান্ডমাইক তুলে নিয়েছেন সাবিত্রী হেমব্রম। রোদ-বৃষ্টিকে উপক্ষো করে সাঁওতালসহ আদিবাসীদের গ্রামে গ্রামে ঘোষণা দিয়ে চলেছেন-‘মাস্ক পরুন, নিরাপদে থাকুন’, ‘করোনাকে নয় ভয়, আমরা করব জয়’ ইত্যাদি।

গত ২৯ জুলাই সাবিত্রীকে দেখা গেছে রাজশাহীর পবা উপজেলা ভূমি অফিসের পাশ দিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে সচেতনতায় ঘোষণা করে চলেছেন অবিরতভাবে। তার সহযোগী হিসেবে জুটিছে আদিবাসী শিক্ষার্থী প্রশান্ত মিনজ, লিনা মিনজ, এলিও মার্ডী, ফারজানা তিন্নী ও স্যামুয়েল হাঁসদা। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পরই সাবিত্রী ও তার টিম মেম্বাররা নিরলসভাবে সচেতনতার কাজ উদ্দীপনার সঙ্গে করে যাচ্ছে। কাজে কিছুটা ভাটা পড়লেও আবার পূর্ণোদ্যামে নেমে পড়েছেন, আদিবাসী অধ্যুষিত পবা ও গোদাগাড়ীর উপজেলার নবইবটতলা, নিমঘুটু, হলদিবনা, আন্ধারকোঠা, গোপালপুর, মিঞাপুর, ভুগরোইল, সন্তোষপুর, দর্শনপাড়াসহ আরও আরও গ্রামগুলোতে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন এবং সাবান, মাস্ক তুলে দিচ্ছেন। মূলত যে সব আদিবাসী গ্রামগুলোর মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম বা মাস্ক পরিধানে উদাসীন, সেগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে; শিশুদের হাত ধোয়া অভ্যাস গড়ে তুলতে তুলে দিচ্ছে সাবানও। সুযোগ পেলে সামাজিক সচেতনা- বাল্যবিয়ে সম্পর্কেও কথা বলছেন কারণ এ সমাজে এগুলোই মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।

সাবিত্রীর সাহসিকতা, ইচ্ছাশক্তি ও মানবতার দিক বিবেচনা করে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পদ্মা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রকাক ও সিইও আজিজুল আলম বেল্টু একটি হ্যান্ড মাইক উপহার দিয়েছেন। সাবিত্রীর আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছেন, ‘ধার করে কাজ করা খুবই কঠিন। এখন স্বস্তি পেলাম। আর কারও কাছে চাইতে হবে না। যখন ইচ্ছে তখনই কাজ করতে পারব। আমাদের মতো যুব সমাজের উচিত এই মহামারীকালে মানুষের পাশে থাকা।’ সাবিত্রী ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে এবং সামাজিক কার্যকা-ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত জেলা সমবায় কর্মকর্তা সূর্য হেমব্রম এবং মা জাতীয় আদিবাসী পরিষদের রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি সুমিলা টুডু। সাবিত্রী রাহালা রিমিল ড্যান্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইউএনডিপির স্বেচ্ছাসেবক, রুডো ইয়ূথ গ্রুপের সভাপতি এবং আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সহসভাপতি।

৩.

‘সানাম হেরিটেজ’ সাঁওতালী শব্দ সানাম অর্থ সমস্ত কিছু। মি. বাবলু মুরমু তার এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। মি. বাবলু মুরমু থাকেন রাজশাহীর পুঠিয়াতে। এখান থেকে যেদিকেই যাচ্ছেন, সাধ্যানুযায়ী প্রান্তিক আদিবাসী সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, তুরী জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনভাবে থাকা, করণীয় দিকগুলোর বিষয়গুলো সহজ-সরল ভাষায় বুঝিয়ে থাকেন। এছাড়াও সাঁওতালী ভাষায় করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার সচেতনমূলক গান রেকর্ডিং কিংবা সংগ্রহ করে ফেসবুকে প্রচার করে থাকেন। তার ‘সামান হেরিটেজ’-এর ফলোয়ার হিসেবে কয়েক হাজার সাঁওতালসহ আদিবাসী, আর এই ফলোয়ার’রা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানের সাঁওতালরাও রয়েছেন। সচেতনতা রাষ্ট্রীয় সীমানাকেও ছাপিয়ে যাক, এটি আমাদেরও কামনা।

শীতকালীন জীবন: সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও সহমর্মিতা

অ্যালগরিদমের রাজনীতি

চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা

অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই

দিপু দাস হত্যাকাণ্ড ও মব সন্ত্রাস

ভোগের দৃশ্যপট: ঢাকায় আধুনিকতা কেন কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য?

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

কোভিড-১৯ সচেতনতা ও সাঁওতাল স্বেচ্ছাসেবী

মিথুশিলাক মুরমু

image

কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করছেন সাবিত্রী হেমব্রম

সোমবার, ০২ আগস্ট ২০২১

১.

গত ১৮ জুন তাবিথা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মি. স্টিফেন সরেন’কে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ‘কোভিড-১৯ হিরো এওয়ার্ড’ (ঈড়ারফ-১৯ ঐঊজঙ অধিৎফং) ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে প্রদান করা হয়েছে। এটি ঘোষিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল জোন ১বি, রিজিওন ১০ হিসেবে আমার দেশ বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে। ঢাকায় তার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন ‘রোটারি ক্লাব অব ঢাকা কারওয়ান বাজার’-এর প্রেসিডেন্ট মহোদয়। রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ও পাস্ট ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর স্বাক্ষরিত স্মারক ক্রেস্ট মি. স্টিফেন সরেনসহ আরও কয়েকজন আমার দেশ থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন। স্মারক ক্রেস্টে লেখা ছিল- Certificate of Appreciation and GOLD AWARD proudly presesented to STEPHEN SOREN for commendable and selfless work at the time of the COVID-19 crisis. স্বাগত জানাই সাঁওতাল উন্নয়ন কর্মী ও কৃতী সন্তান মি. স্টিফেন সরেনকে। মি. স্টিফেন রোটারি ক্লাব অব ঢাকা কাওরান বাজার-এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সুদূর রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় অবহেলিত ও পিছিয়েপড়া আদিবাসী সাঁওতাল, কোলসহ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝেও কোভিড-১৯ সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান প্রদানপূর্বক সচেতনতামূলক পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীরা যেন কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে, সে জন্য খাবার সহায়তা পাশাপাশি দেশি মুরগি, টার্কি মুরগি ও ছাগল প্রদান করা হয়েছে। কর্মহীন মানুষগুলোর সাহাযার্থে এগিয়ে না এলে, দায়িত্ব না নিলে একদিন স্থানচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

কোল আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার অগ্রযাত্রাকে সচল রাখতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া হয়েছে, এতে করে অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে। যারা নার্সিং প্রশিক্ষণে চলমান রয়েছে, তাদের তুলে দেয়া হয়েছে ল্যাপটপও। নিরক্ষর তবে উদ্যমী যুব জুতা সেলাই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আপদকালীন খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তাবিথা ফাউন্ডেশন পরিচালিত কিন্ডারগার্টেন শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় মাস চারেক নিয়মিতভাবে। এই কিন্ডারগার্টেনে সাঁওতাল, বিহারী, হিন্দু-মুসলিম ছেলেমেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে। উল্লেখ্য যে, সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কোল আদিবাসীরাই সম্ভুক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এসব কিছু সম্ভব হয়েছে রোটারি ক্লাব অব ঢাকা কারওয়ান বাজার এবং তাবিথা ফাউন্ডেশনের যৌথ কর্মযজ্ঞে। এ বিষয়ে কথা বলছিলাম স্টিফেন সরেনের সঙ্গে। তার অভিব্যক্তি- নিঃসন্দেহে পুরস্কার হিসেবে নাম ঘোষিত হওয়া আনন্দের। বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, ‘আমরা কখনোই পুরস্কারের জন্যে কাজ করি নাই, স্রষ্টা আমাদের বিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, সুযোগ এবং আকাক্সক্ষা দিয়েছেন; আমরা শুধু সেটিকে প্রয়োগ করেছি। করোনাভাইরাসের প্রাক্কালেও আমরা অসচেতন মানুষের কথা চিন্তা করে সচেতনতার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আর আমি স্টিফেন সরেন আমার টিমকে কখনো সামনে থেকে এবং পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি।’ স্রষ্টার কাছে নিবেদন করি, তাবিথা ফাউন্ডেশন এগিয়ে যাক দূরন্ত গতিতে, আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়–ক দিক-দিগন্তে।

২.

জুলাই ৩১, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে একটি জাতীয় দৈনিকের ছোট্ট কিন্তু চমৎকার শিরোনাম, ‘করোনাভাইরাস সচেতনতার বার্তা নিয়ে যান সাবিত্রী’। সাবিত্রী আদিবাসী সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর একজন সচেতন স্বেচ্ছাসেবী কর্মী। সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসের করাল গ্রাসে চরমভাবে বিপর্যস্ত, সেই ভয়ঙ্করতার ঢেউ নিভৃতপল্লী আদিবাসী সাঁওতাল গ্রামকেও ছুঁয়ে ফেলেছে। ৮ মার্চ, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ পর্যন্ত ইতোমধ্যেই সাঁওতালরাও হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনদের। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যালঘু আদিবাসী সাঁওতালসহ কয়েক ডজন আদিবাসীদের জীবনরক্ষায় ধুলোর রাস্তায় নেমে পড়েছেন সাবিত্রী হেমব্রম। সংখ্যালঘুরা যদি এই বৈশি^ক মহামারীতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন; তাহলে একজন সচেতন আদিবাসী নাগরিক হিসেবে নৈতিক দায়বদ্ধতার দায় অবশ্যই বর্তায়। হতে পারে এমন দায়বদ্ধতার বোধ থেকেই হাতে ধার করা হ্যান্ডমাইক তুলে নিয়েছেন সাবিত্রী হেমব্রম। রোদ-বৃষ্টিকে উপক্ষো করে সাঁওতালসহ আদিবাসীদের গ্রামে গ্রামে ঘোষণা দিয়ে চলেছেন-‘মাস্ক পরুন, নিরাপদে থাকুন’, ‘করোনাকে নয় ভয়, আমরা করব জয়’ ইত্যাদি।

গত ২৯ জুলাই সাবিত্রীকে দেখা গেছে রাজশাহীর পবা উপজেলা ভূমি অফিসের পাশ দিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে সচেতনতায় ঘোষণা করে চলেছেন অবিরতভাবে। তার সহযোগী হিসেবে জুটিছে আদিবাসী শিক্ষার্থী প্রশান্ত মিনজ, লিনা মিনজ, এলিও মার্ডী, ফারজানা তিন্নী ও স্যামুয়েল হাঁসদা। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পরই সাবিত্রী ও তার টিম মেম্বাররা নিরলসভাবে সচেতনতার কাজ উদ্দীপনার সঙ্গে করে যাচ্ছে। কাজে কিছুটা ভাটা পড়লেও আবার পূর্ণোদ্যামে নেমে পড়েছেন, আদিবাসী অধ্যুষিত পবা ও গোদাগাড়ীর উপজেলার নবইবটতলা, নিমঘুটু, হলদিবনা, আন্ধারকোঠা, গোপালপুর, মিঞাপুর, ভুগরোইল, সন্তোষপুর, দর্শনপাড়াসহ আরও আরও গ্রামগুলোতে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন এবং সাবান, মাস্ক তুলে দিচ্ছেন। মূলত যে সব আদিবাসী গ্রামগুলোর মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম বা মাস্ক পরিধানে উদাসীন, সেগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে; শিশুদের হাত ধোয়া অভ্যাস গড়ে তুলতে তুলে দিচ্ছে সাবানও। সুযোগ পেলে সামাজিক সচেতনা- বাল্যবিয়ে সম্পর্কেও কথা বলছেন কারণ এ সমাজে এগুলোই মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।

সাবিত্রীর সাহসিকতা, ইচ্ছাশক্তি ও মানবতার দিক বিবেচনা করে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পদ্মা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রকাক ও সিইও আজিজুল আলম বেল্টু একটি হ্যান্ড মাইক উপহার দিয়েছেন। সাবিত্রীর আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছেন, ‘ধার করে কাজ করা খুবই কঠিন। এখন স্বস্তি পেলাম। আর কারও কাছে চাইতে হবে না। যখন ইচ্ছে তখনই কাজ করতে পারব। আমাদের মতো যুব সমাজের উচিত এই মহামারীকালে মানুষের পাশে থাকা।’ সাবিত্রী ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে এবং সামাজিক কার্যকা-ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত জেলা সমবায় কর্মকর্তা সূর্য হেমব্রম এবং মা জাতীয় আদিবাসী পরিষদের রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি সুমিলা টুডু। সাবিত্রী রাহালা রিমিল ড্যান্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইউএনডিপির স্বেচ্ছাসেবক, রুডো ইয়ূথ গ্রুপের সভাপতি এবং আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সহসভাপতি।

৩.

‘সানাম হেরিটেজ’ সাঁওতালী শব্দ সানাম অর্থ সমস্ত কিছু। মি. বাবলু মুরমু তার এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। মি. বাবলু মুরমু থাকেন রাজশাহীর পুঠিয়াতে। এখান থেকে যেদিকেই যাচ্ছেন, সাধ্যানুযায়ী প্রান্তিক আদিবাসী সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, তুরী জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনভাবে থাকা, করণীয় দিকগুলোর বিষয়গুলো সহজ-সরল ভাষায় বুঝিয়ে থাকেন। এছাড়াও সাঁওতালী ভাষায় করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার সচেতনমূলক গান রেকর্ডিং কিংবা সংগ্রহ করে ফেসবুকে প্রচার করে থাকেন। তার ‘সামান হেরিটেজ’-এর ফলোয়ার হিসেবে কয়েক হাজার সাঁওতালসহ আদিবাসী, আর এই ফলোয়ার’রা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানের সাঁওতালরাও রয়েছেন। সচেতনতা রাষ্ট্রীয় সীমানাকেও ছাপিয়ে যাক, এটি আমাদেরও কামনা।

back to top