alt

opinion » post-editorial

মহামারীকালে মানসিক স্বাস্থ্য

সাকিলা পারভীন

: রোববার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১

সব শিশু খেলছে আর অধরা একপাশে বেঞ্চে বসে আছে। চোখে পানি টলটল করছে। কাছে গিয়ে কী হয়েছে জানতে চাইলেই কেঁদে ফেলে চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী অধরা। ভীষণ প্রাণবন্ত চঞ্চল অধরা দীর্ঘদিন পরে দেখা হওয়া সহপাঠীদের সাথে আগের মতো মিশতে পারছে না। ওরা খেলতে ডাকছে কিন্তু সে তাল মেলাতে পারছে না। তাইতো এই কান্না! ঘটনাটি মাত্র কয়েক দিন আগের। করোনা পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হওয়ায় অভিভাবকদের উদ্যোগে ঢাকার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের গেটটুগেদারের আয়োজন করা হয়। সেখানেই ঘটে ঘটনাটি। অথচ এ শিশুটি একেবারেই এমন ছিল না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সীদের মধ্যে কম-বেশি নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে বিষয়টিকে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে সহজে সমাধান করা সম্ভব হবে।

করোনা মহামারীকালে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু, শোক, আইসোলেশন, চাকরি হারানো, আয় কমে যাওয়া, সংক্রমণের আতঙ্ক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে মানসিক অস্থিরতা। মাদকাসক্তও হয়ে পড়েছে অনেকে। মোটকথা বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন সময়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যে করোনার প্রভাব নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে গবেষণা হওয়া দরকার। একই সাথে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের বিষয়েও চরম নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। করোনা মহামারীকালে সেই সংকট আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারী শুরুর দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগের রোগী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। তবে এ সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও করোনাকালে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই করোনাপরবর্তী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এক জরিপে পাওয়া তথ্যানুযায়ী- করোনাকালে প্রায় ৯১ শতাংশ শিশু-কিশোর ও তরুণরা মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের ঘুমের সমস্যা, অস্থিরতাসহ বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

শিশুশিক্ষা নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করা একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের মতে, ইতোপূর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে একটানা ২-৩ মাস স্কুল বন্ধ থাকার পর শিশুদের স্কুলে নিয়মে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আর এ মহামারী পরিস্থিতি তো আরও সংকটাপন্ন। এ সময় পরিবারের আর্থিক সংকট, গৃহবন্দী থাকা, অনেক পরিবারে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা শিশুদের মনোজগতে ভীষণভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ হবে না বলেও তিনি মতপ্রকাশ করেন। তবে এক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা খুব জরুরি।

অন্যদিকে করোনা মহামারীর শুরু থেকেই বয়স্করা আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। আবার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় যারা ভুগছেন তাদের ঝুঁকিও বেশি। বিষয়গুলো অধিক আলোচনা হওয়ায় বয়স্কদের মনেও আতঙ্ক-উদ্বেগ তৈরি হয়। ফলে বয়স্কদেরও মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গত ২০২০ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসে বিশ্বের ৯৩টি দেশে পরিচালিত জরিপের উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল- করোনা মহামারীর সংকটময় সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বিশেষ কর্মসূচিও গ্রহণ করে সংস্থাটি। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিবেচনায় নিয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় পৃথক উপকমিটি গঠন, হেল্পলাইন চালু করার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান কার্যক্রম চালু রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবন-যাপন নিশ্চিত করতে নানাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

মনোচিকিৎসকদের মতে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার হার কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও মানসিক চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেছে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা। কক্সবাজারের উখিয়া ও ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শুরু থেকেই কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন, সাধারণভাবে উদ্বাস্তু এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ছিল। করোনা মহামারীকালে সেই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠছে।

সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (স্কাস) মানসিক স্বাস্থ্য টিমের তথ্যমতে, করোনাকালে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশু ও তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। মানসিক চাপে আছেন বয়স্করাও। এর পাশাপাশি বেশির ভাগই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। করোনাকালে মানসিক যে সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে। সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আতঙ্ক, উদ্বিগ্নতা, হতাশা, সারাদিন মন খরাপ, খাবারে অরুচি বা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক খাবার গ্রহণ, ঘুমের সমস্যা, নেতিবাচক চিন্তা, আত্মহত্যার চেষ্টা বা মৃত্যু চিন্তা, শরীরে নানারকম ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব, অমনোযোগী হওয়া ও নিজেকে ছোট মনে করা ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুযায়ী, করোনাকালে বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন (২৭.৩৯ শতাংশ) কর্মহীন বা বেকার হয়েছে। গৃহবন্দী অবস্থা ও অনাকাক্সিক্ষত বেকারত্বের কারণে মানুষ ধীরে ধীরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আর্থিক সংকট থেকে শুরু করে হঠাৎ আরোপিত নতুন জীবনধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে তরুণরা দুশ্চিন্তা ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। গত এক বছরে দেশের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত যে, আত্মহত্যার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ১৪ হাজার ৪৩৬টি। অথচ ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ করোনাকালীন দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে, বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ, যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৬.৭ শতাংশ বিষন্নতা আর ৪.৭ শতাংশ ছিল অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগজনিত সমস্যা। অথচ করোনাকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর মধ্যে প্রায় ৩৩ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগজনিত সমস্যা এবং ৪৬ শতাংশের মাঝে বিষন্নতার লক্ষণ পাওয়া গেছে। বিগত বছরের তুলনায় দুটোই বহুগুণ বেশি। এসব পরিসংখ্যাণই বলে দেয়, লকডাউন বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে এরই মধ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে করোনার নেতিবাচক প্রভাবকে মাথায় রেখে সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; যারা করোনা মহামারীর শুরু থেকেই বিনামূল্যে অনলাইন অথবা মোবাইল ফোনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা, বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের মনোবিজ্ঞানীরা করোনাকালে বিনামূল্যে টেলিকাউন্সেলিং সেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘মনের বন্ধু ও ইউএনডিপি’, ‘সেরেনিটি’ এবং ‘কান পেতে রই’ ইত্যাদিসহ আরো কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অনলাইনে অথবা টেলিফোনে বিনামূল্যে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা টেলিকাউন্সেলিং সেবা প্রদান করছে।

ওই সব পদক্ষেপের পাশাপাশি এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক, পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও উদ্যোগ বা দায়িত্ব পালন করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়ার জন্য আসুন সবাই মিলে গড়ে তুলি সুন্দর পৃথিবী।

[লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

মহামারীকালে মানসিক স্বাস্থ্য

সাকিলা পারভীন

রোববার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১

সব শিশু খেলছে আর অধরা একপাশে বেঞ্চে বসে আছে। চোখে পানি টলটল করছে। কাছে গিয়ে কী হয়েছে জানতে চাইলেই কেঁদে ফেলে চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী অধরা। ভীষণ প্রাণবন্ত চঞ্চল অধরা দীর্ঘদিন পরে দেখা হওয়া সহপাঠীদের সাথে আগের মতো মিশতে পারছে না। ওরা খেলতে ডাকছে কিন্তু সে তাল মেলাতে পারছে না। তাইতো এই কান্না! ঘটনাটি মাত্র কয়েক দিন আগের। করোনা পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হওয়ায় অভিভাবকদের উদ্যোগে ঢাকার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের গেটটুগেদারের আয়োজন করা হয়। সেখানেই ঘটে ঘটনাটি। অথচ এ শিশুটি একেবারেই এমন ছিল না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সীদের মধ্যে কম-বেশি নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে বিষয়টিকে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে সহজে সমাধান করা সম্ভব হবে।

করোনা মহামারীকালে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু, শোক, আইসোলেশন, চাকরি হারানো, আয় কমে যাওয়া, সংক্রমণের আতঙ্ক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে মানসিক অস্থিরতা। মাদকাসক্তও হয়ে পড়েছে অনেকে। মোটকথা বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন সময়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যে করোনার প্রভাব নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে গবেষণা হওয়া দরকার। একই সাথে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের বিষয়েও চরম নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। করোনা মহামারীকালে সেই সংকট আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারী শুরুর দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগের রোগী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। তবে এ সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও করোনাকালে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই করোনাপরবর্তী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এক জরিপে পাওয়া তথ্যানুযায়ী- করোনাকালে প্রায় ৯১ শতাংশ শিশু-কিশোর ও তরুণরা মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের ঘুমের সমস্যা, অস্থিরতাসহ বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

শিশুশিক্ষা নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করা একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের মতে, ইতোপূর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে একটানা ২-৩ মাস স্কুল বন্ধ থাকার পর শিশুদের স্কুলে নিয়মে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আর এ মহামারী পরিস্থিতি তো আরও সংকটাপন্ন। এ সময় পরিবারের আর্থিক সংকট, গৃহবন্দী থাকা, অনেক পরিবারে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা শিশুদের মনোজগতে ভীষণভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ হবে না বলেও তিনি মতপ্রকাশ করেন। তবে এক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা খুব জরুরি।

অন্যদিকে করোনা মহামারীর শুরু থেকেই বয়স্করা আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। আবার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় যারা ভুগছেন তাদের ঝুঁকিও বেশি। বিষয়গুলো অধিক আলোচনা হওয়ায় বয়স্কদের মনেও আতঙ্ক-উদ্বেগ তৈরি হয়। ফলে বয়স্কদেরও মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গত ২০২০ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসে বিশ্বের ৯৩টি দেশে পরিচালিত জরিপের উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল- করোনা মহামারীর সংকটময় সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বিশেষ কর্মসূচিও গ্রহণ করে সংস্থাটি। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিবেচনায় নিয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় পৃথক উপকমিটি গঠন, হেল্পলাইন চালু করার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান কার্যক্রম চালু রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবন-যাপন নিশ্চিত করতে নানাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

মনোচিকিৎসকদের মতে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার হার কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও মানসিক চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেছে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা। কক্সবাজারের উখিয়া ও ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শুরু থেকেই কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন, সাধারণভাবে উদ্বাস্তু এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ছিল। করোনা মহামারীকালে সেই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠছে।

সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (স্কাস) মানসিক স্বাস্থ্য টিমের তথ্যমতে, করোনাকালে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশু ও তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। মানসিক চাপে আছেন বয়স্করাও। এর পাশাপাশি বেশির ভাগই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। করোনাকালে মানসিক যে সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে। সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আতঙ্ক, উদ্বিগ্নতা, হতাশা, সারাদিন মন খরাপ, খাবারে অরুচি বা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক খাবার গ্রহণ, ঘুমের সমস্যা, নেতিবাচক চিন্তা, আত্মহত্যার চেষ্টা বা মৃত্যু চিন্তা, শরীরে নানারকম ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব, অমনোযোগী হওয়া ও নিজেকে ছোট মনে করা ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুযায়ী, করোনাকালে বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন (২৭.৩৯ শতাংশ) কর্মহীন বা বেকার হয়েছে। গৃহবন্দী অবস্থা ও অনাকাক্সিক্ষত বেকারত্বের কারণে মানুষ ধীরে ধীরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আর্থিক সংকট থেকে শুরু করে হঠাৎ আরোপিত নতুন জীবনধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে তরুণরা দুশ্চিন্তা ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। গত এক বছরে দেশের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত যে, আত্মহত্যার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ১৪ হাজার ৪৩৬টি। অথচ ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ করোনাকালীন দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে, বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ, যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৬.৭ শতাংশ বিষন্নতা আর ৪.৭ শতাংশ ছিল অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগজনিত সমস্যা। অথচ করোনাকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর মধ্যে প্রায় ৩৩ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগজনিত সমস্যা এবং ৪৬ শতাংশের মাঝে বিষন্নতার লক্ষণ পাওয়া গেছে। বিগত বছরের তুলনায় দুটোই বহুগুণ বেশি। এসব পরিসংখ্যাণই বলে দেয়, লকডাউন বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে এরই মধ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে করোনার নেতিবাচক প্রভাবকে মাথায় রেখে সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; যারা করোনা মহামারীর শুরু থেকেই বিনামূল্যে অনলাইন অথবা মোবাইল ফোনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা, বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের মনোবিজ্ঞানীরা করোনাকালে বিনামূল্যে টেলিকাউন্সেলিং সেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘মনের বন্ধু ও ইউএনডিপি’, ‘সেরেনিটি’ এবং ‘কান পেতে রই’ ইত্যাদিসহ আরো কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অনলাইনে অথবা টেলিফোনে বিনামূল্যে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা টেলিকাউন্সেলিং সেবা প্রদান করছে।

ওই সব পদক্ষেপের পাশাপাশি এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক, পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও উদ্যোগ বা দায়িত্ব পালন করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়ার জন্য আসুন সবাই মিলে গড়ে তুলি সুন্দর পৃথিবী।

[লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী]

back to top