alt

opinion » post-editorial

ফোনে আড়িপাতা রোধ ও ফোনালাপ ফাঁস হওয়া সংক্রান্ত রিট

ফারিয়া ইফফাত মীম

: শুক্রবার, ০৮ অক্টোবর ২০২১

গত ৩১ আগস্ট ২০২১ তারিখে আড়িপাতা রোধে এবং ফাঁস হওয়া ফোনালাপের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের শুনানি পুনরায় আরো দুই সপ্তাহ পিছিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন মহামান্য হাইকোর্ট। ইতোপূর্বে ফোনালাপে আড়িপাতা প্রতিরোধে আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গৃহীত পদক্ষেপ জানতে চেয়ে গত ২২ জুন ২০২১ তারিখে ১০ আইনজীবীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশের কোনো জবাব না পেয়ে ওই ১০ আইনজীবীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির গত ১০ আগস্ট ২০২১ তারিখে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দাখিল করেন, যার শুনানি গত ১৬ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে পেছানো হয়। আবেদনটি সংশ্লিষ্ট কোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চে শুনানির জন্য উঠলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার আদালতে সময়ের আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দুই সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করেছিলেন।

রিটের উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু

টেলিযোগাযোগে গোপনীয়তা রক্ষা ও ফোনে আড়িপাতা-রেকর্ডিং বন্ধে সরকারের গৃহীত উদ্যোগ জানতে চেয়ে এবং তদন্তের নির্দেশনা হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিট আবেদনকারী ১০ আইনজীবী হলেন- মোস্তাফিজুর রহমান, রেজওয়ানা ফেরদৌস, উত্তম কুমার বণিক, শাহ নাবিলা কাশফী, ফরহাদ আহমেদ সিদ্দিকী, মোহাম্মদ নওয়াব আলী, মোহাম্মদ ইবরাহিম খলিল, জিএম মুজাহিদুর রহমান, ইমরুল কায়েস ও একরামুল কবির।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানকে উল্লিখিত রিটে বিবাদী করা হয়। রিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ফোনালাপ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফোনালাপ, প্রয়াত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসানের ফোনালাপ, ভিকারুননিসা নূন কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপ, মামুনুল হকের ফোনালাপ, যশোর-৬ আসনের সাংসদ শাহীন চাকলাদারের ফোনালাপ, ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের ফোনালাপ, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের ফোনালাপসহ ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২০টি বহুল প্রচারিত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত আড়িপাতার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩০ (১)(চ) ধারা এবং সংবিধানের ৩৯ ও ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়। রুল হলে তা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কমিটি গঠন করে ফাঁস হওয়া ব্যক্তিগত ফোনালাপের উল্লিখিত ঘটনাগুলো তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ফোনে আড়িপাতা প্রতিরোধে নিশ্চয়তা ও ফাঁস হওয়া ঘটনাগুলো তদন্তের বিষয়ে ১৭১৭ পৃষ্ঠার নজির রিটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এসব নজিরের মধ্যে আল কোরআন, আল হাদিস এবং বাইবেলের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বেশকিছু আইন ও নীতিমালা নজির হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ ধরনের বিষয়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের আদালতের প্রদত্ত সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ নজির হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৩৬১ সাল থেকে ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বীকৃত। ১৮৯০ সালে হার্ভার্ড ল রিভিউ-এ ‘দি রাইট টু প্রাইভেসি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চৎরাধপু ধং ধহ অংঢ়বপঃ ড়ভ ঐঁসধহ উরমহরঃর’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এ প্রবন্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদপত্রের আর্টিক্যাল-১২ সহ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর সব আধুনিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনসমূহ

২০০১ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়; ২০১০ সালে সেই আইনটি সংশোধন করা হয়। এ আইনে ফোনে আড়িপাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো তদন্তের স্বার্থে বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কোনো নাগরিকের ফোনে আড়িপাততে চাইলে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা এসব বিষয়ে যে কোনো কর্মকর্তাকে সরকারের ও ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতি নিতে হবে, অন্যথায় কাজটি বৈধ বলে গণ্য হবে না। তবে যেহেতু আইনে দায়বদ্ধতার বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলা নেই, সে কারণে বেশিরভাগ সময়ই বিষয়গুলো নিয়ে কড়াকড়ি তেমন থাকে না এবং সঠিকভাবে নজরদারিও করা হয় না।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৩০(চ) অনুযায়ী টেলিযোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষা নিশ্চিত করা টেলিযোগাযোগ কমিশনের দায়িত্ব। ধারা ৭১ অনুসারে আড়িপাতা হলেই সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে এ অপরাধ করা হলে এবং আড়িপাতার অপরাধ প্রমাণিত হলে অনধিক দুই বছর কারাদন্ড এবং অনধিক ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড দেওয়ার বিধান আছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭(ক)(১) ধারা অনুসারে, এ আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ধারা ৯৭(ক)(২) অনুসারে ‘সরকার’ বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝানো হবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এ ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের ‘চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার’ রয়েছে।

জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তার সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না।

২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট বিচারপতি মো. শওকত হোসাইন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ‘মো. আনিস মিয়া বনাম দ্য স্টেট, ফৌজদারি আপিল নম্বর-৬৭৯৯-এর ২০১১’ মামলায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। ওই রায়ে বলা হয়- টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও টেলিফোন সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সর্বাধিক। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ তাদের দায়িত্ব।

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

[লেখক : মানবাধিকারকর্মী]

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

ফোনে আড়িপাতা রোধ ও ফোনালাপ ফাঁস হওয়া সংক্রান্ত রিট

ফারিয়া ইফফাত মীম

শুক্রবার, ০৮ অক্টোবর ২০২১

গত ৩১ আগস্ট ২০২১ তারিখে আড়িপাতা রোধে এবং ফাঁস হওয়া ফোনালাপের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের শুনানি পুনরায় আরো দুই সপ্তাহ পিছিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন মহামান্য হাইকোর্ট। ইতোপূর্বে ফোনালাপে আড়িপাতা প্রতিরোধে আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গৃহীত পদক্ষেপ জানতে চেয়ে গত ২২ জুন ২০২১ তারিখে ১০ আইনজীবীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশের কোনো জবাব না পেয়ে ওই ১০ আইনজীবীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির গত ১০ আগস্ট ২০২১ তারিখে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দাখিল করেন, যার শুনানি গত ১৬ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে পেছানো হয়। আবেদনটি সংশ্লিষ্ট কোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চে শুনানির জন্য উঠলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার আদালতে সময়ের আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দুই সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করেছিলেন।

রিটের উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু

টেলিযোগাযোগে গোপনীয়তা রক্ষা ও ফোনে আড়িপাতা-রেকর্ডিং বন্ধে সরকারের গৃহীত উদ্যোগ জানতে চেয়ে এবং তদন্তের নির্দেশনা হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিট আবেদনকারী ১০ আইনজীবী হলেন- মোস্তাফিজুর রহমান, রেজওয়ানা ফেরদৌস, উত্তম কুমার বণিক, শাহ নাবিলা কাশফী, ফরহাদ আহমেদ সিদ্দিকী, মোহাম্মদ নওয়াব আলী, মোহাম্মদ ইবরাহিম খলিল, জিএম মুজাহিদুর রহমান, ইমরুল কায়েস ও একরামুল কবির।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানকে উল্লিখিত রিটে বিবাদী করা হয়। রিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ফোনালাপ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফোনালাপ, প্রয়াত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসানের ফোনালাপ, ভিকারুননিসা নূন কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপ, মামুনুল হকের ফোনালাপ, যশোর-৬ আসনের সাংসদ শাহীন চাকলাদারের ফোনালাপ, ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের ফোনালাপ, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের ফোনালাপসহ ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২০টি বহুল প্রচারিত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত আড়িপাতার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩০ (১)(চ) ধারা এবং সংবিধানের ৩৯ ও ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়। রুল হলে তা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কমিটি গঠন করে ফাঁস হওয়া ব্যক্তিগত ফোনালাপের উল্লিখিত ঘটনাগুলো তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ফোনে আড়িপাতা প্রতিরোধে নিশ্চয়তা ও ফাঁস হওয়া ঘটনাগুলো তদন্তের বিষয়ে ১৭১৭ পৃষ্ঠার নজির রিটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এসব নজিরের মধ্যে আল কোরআন, আল হাদিস এবং বাইবেলের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বেশকিছু আইন ও নীতিমালা নজির হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ ধরনের বিষয়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের আদালতের প্রদত্ত সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ নজির হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৩৬১ সাল থেকে ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বীকৃত। ১৮৯০ সালে হার্ভার্ড ল রিভিউ-এ ‘দি রাইট টু প্রাইভেসি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চৎরাধপু ধং ধহ অংঢ়বপঃ ড়ভ ঐঁসধহ উরমহরঃর’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এ প্রবন্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদপত্রের আর্টিক্যাল-১২ সহ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর সব আধুনিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনসমূহ

২০০১ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়; ২০১০ সালে সেই আইনটি সংশোধন করা হয়। এ আইনে ফোনে আড়িপাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো তদন্তের স্বার্থে বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কোনো নাগরিকের ফোনে আড়িপাততে চাইলে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা এসব বিষয়ে যে কোনো কর্মকর্তাকে সরকারের ও ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতি নিতে হবে, অন্যথায় কাজটি বৈধ বলে গণ্য হবে না। তবে যেহেতু আইনে দায়বদ্ধতার বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলা নেই, সে কারণে বেশিরভাগ সময়ই বিষয়গুলো নিয়ে কড়াকড়ি তেমন থাকে না এবং সঠিকভাবে নজরদারিও করা হয় না।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৩০(চ) অনুযায়ী টেলিযোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষা নিশ্চিত করা টেলিযোগাযোগ কমিশনের দায়িত্ব। ধারা ৭১ অনুসারে আড়িপাতা হলেই সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে এ অপরাধ করা হলে এবং আড়িপাতার অপরাধ প্রমাণিত হলে অনধিক দুই বছর কারাদন্ড এবং অনধিক ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড দেওয়ার বিধান আছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭(ক)(১) ধারা অনুসারে, এ আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ধারা ৯৭(ক)(২) অনুসারে ‘সরকার’ বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝানো হবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এ ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের ‘চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার’ রয়েছে।

জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তার সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না।

২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট বিচারপতি মো. শওকত হোসাইন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ‘মো. আনিস মিয়া বনাম দ্য স্টেট, ফৌজদারি আপিল নম্বর-৬৭৯৯-এর ২০১১’ মামলায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। ওই রায়ে বলা হয়- টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও টেলিফোন সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সর্বাধিক। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ তাদের দায়িত্ব।

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

[লেখক : মানবাধিকারকর্মী]

back to top