মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সৈয়দ শামসুল হককে আমি অনেকের মতোই ‘হক ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটেছিল স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালীন কোনো এক সময়ে। ’৮০-এর দশকে নতুন দৃশ্যপটে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে সংহত করার যে চেষ্টা সেই সময়ে, দীর্ঘ কারাজীবন থেকে মুক্ত হয়ে আসার পরে, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন থেকেই পাশাপাশি থেকে তাঁর সঙ্গে পথচলার শুরু। একসঙ্গে পথ চলতে চলতে সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে। আমার সঙ্গে দেখা হলেই দেশ ও দেশের রাজনীতির হালচাল নিয়ে তিনি মন খুলে কথা বলতেন। দেখা হলেই বলতেন, “কমরেড, কী খবর?” আমার কথা শুনতেন, নানা বিষয়ে মন্তব্য করতেন। আমাদের পার্টির (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) মুখপত্র সাপ্তাহিক একতা’র খুবই উৎসাহী পাঠক ছিলেন তিনি। তাঁর আগ্রহেই পার্টির একজন কর্মীর মাধ্যমে তাঁর বাসায় নিয়মিত একতা পৌঁছে দেওয়ার স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একতা ও পার্টির অন্যান্য কাজে তিনি নিয়মিতভাবে আর্থিক সহযোগিতা করতেন। পার্টির সব চিন্তার সাথে সবসময় একমত না হতে পারলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন দরদী কমরেডের মতোই।
কয়েক বছর আগে পুরনো দিনের নানা বিষয়ে আলাপ করতে করতে তিনি যখন জানতে পারলেন যে, আমি বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলাম, তখন তিনি বললেন, “কী আশ্চর্য ব্যাপার! আমিও তো ফতেহ লোহানীর সঙ্গে কয়েকজন মিলে বসে ওই চলচ্চিত্রের সংলাপ লিখেছিলাম।” এ কথার পর তিনি অনর্গলভাবে ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রের কয়েকটা সংলাপ বলে গেলেন। আমরা দুজনেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম সেই ’৬০-এর দশকের দিনগুলোতে। আন্তরিক আলাপচারিতায় আরও জীবন্ত হয়ে উঠল আমাদের ঘনিষ্ঠতা।
বহুমাত্রিক সৃষ্টির অগ্রগণ্য হিসেবে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে সৈয়দ শামসুল হক এক বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন হয়ে আছেন। সব্যসাচী লেখক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ’৫০-এর দশকে তাঁর লেখালেখি শুরু হয়। অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, কাব্যনাট্য, চিত্রনাট্য লিখেছেন সমান তালে। তিনি অনুবাদও করেছেন। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ‘হৃৎকলমের টানে’ শিরোনামে কলাম লিখেছেন অনেক দিন। কাব্যনাট্য রচনায় পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কলাম- সবটা মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য। মানুষের ভালোবাসা, সমর্থন, স্বীকৃতি, নানা পুরস্কার সবটা মিলিয়ে তিনি চূড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পেরেছেন।
নিপীড়িত মানুষের জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ, অনুভূতি, হতাশা, বিকার ইত্যাদিকে খুব সাবলীলভাবে তিনি তাঁর রচনায় তুলে ধরেছেন। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও দেশের মানুষ, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল তাঁর লেখার বিষয়। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে সমসাময়িক বাংলাদেশ। সাহিত্যের নতুন ভাষা সৃষ্টিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। নতুন দ্যোতনায় তাঁর লেখা হয়ে উঠেছে উজ্জ্বলতর।
নিপীড়িত মানুষের জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ, অনুভূতি, হতাশা, বিকার ইত্যাদিকে খুব সাবলীলভাবে তিনি তাঁর রচনায় তুলে ধরেছেন। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও দেশের মানুষ, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল তাঁর লেখার বিষয়
বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল, তাঁকে ডাক্তারি পড়ানো। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটলেন না। বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল, তাঁকে ডাক্তারি পড়ানো। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটলেন না। ডাক্তারি পড়া আটকানোর জন্য পালিয়ে গেলেন বিদেশে। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও, সেখানকার লেখাপড়া তিনি শেষ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে তিনি বলেছেন, এক সময় তিনি উপলব্ধি করেন যে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে কিছু দিতে পারছে না। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। তারপর লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পেশা হিসেবে লেখালেখি তখন যে কতটা অনিশ্চিত ছিল, সে কথা ভালো করে জেনেও তিনি এ পথই বেছে নিয়েছিলেন।
সৈয়দ শামসুল হকের কাজের প্রধান ক্ষেত্র ছিল সাহিত্য। তিনি সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। তিনি বলেছিলেন, রাজনীতি করলে তিনি বড় রাজনীতিক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি রাজনীতির পথে না গিয়ে পুরোদস্তুর নেমে পড়েন লেখালেখিতে। তবে রাজনীতির বাইরের মানুষও তিনি ছিলেন না। তিনি জানতেন যে, রাজনীতি বাদ দিয়ে শিল্প-সাহিত্য বিশেষত প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য হয় না। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা লেখালেখির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। প্রগতিশীল এই মানুষটির হাত দিয়ে প্রগতিশীল সাহিত্যই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ লেখক হিসেবে সময়ের প্রয়োজন মেটাতে তিনি সাহিত্য অঙ্গনের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সাধ্যমতো ভূমিকা রেখেছেন। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিবিসি বাংলা বিভাগ থেকে সংবাদ পরিবেশন করতেন। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের নানা সংকটকালে তিনি রাজপথে নেমেছেন, নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেননি।
সৈয়দ শামসুল হক এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম জীবন্ত রয়েছে এবং থাকবে। তাঁর অমর সৃষ্টির জন্য বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বর্তমান ও আগামী দিনের কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করবে, পথ দেখিয়ে যাবে। সাহিত্যের অন্য প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, শুধু কাব্যনাট্যের জন্যই তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর রচিত কাব্যনাট্যগুলো তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। তাঁর অন্যতম কাব্যনাট্য ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এর কথাই ধরা যাক। এটা এক মহান সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে এটি এক অনন্য সংযোজন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এ ভূ-খণ্ডের মানুষ নানাভাবে প্রতিরোধ সংগঠিত করেছে। এই জনপদের স্বাধীনতাকামী মানুষের এমন এক প্রতিরোধ সংগ্রামের শিল্পীত বয়ান ‘নূরলদীনের সারাজীবন’। ব্রিটিশের খাতায় দস্যু হিসেবে চিহ্নিত গণনায়ক নূরলদীনকে সৈয়দ শামসুল হক এ কাব্যনাট্যে তুলে ধরেছেন। নূরলদীনের সংগ্রাম ব্রিটিশ আমলের ঘটনা হলেও, সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষুরধার লেখনীতে তা বিস্তৃত হয়েছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজকের ও আগামী দিনের লড়াই পর্যন্ত। নূরলদীনের বাবা মহাজনের খাজনা মেটাতে হালের বলদ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন এবং নিজের ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে জমি চাষ করতে গিয়ে মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর কণ্ঠে মানুষের শব্দের বদলে গরুর ‘হাম্বা’ ‘হাম্বা’ ডাক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলে মানুষের মর্যাদা যেভাবে পশুর স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছিল, সেই বিষয়টি এভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ইতিহাসের সঙ্গে নাট্যকারের প্রতিভাদীপ্ত কল্পনার সম্মিলন কাব্যনাট্যটিকে সমকালীন করে তুলেছে। নূরলদীন এ কাব্যনাট্যের মূল চরিত্র হলেও, কেবল তাঁর জীবন বর্ণনা এ নাটকের লক্ষ্য নয়। বরং সময়ের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের মধ্যে কীভাবে একজন ভূমিপুত্র নূরলদীন আত্মপ্রকাশ করে সংগঠিত হয় এবং গণমানুষের প্রাণের নেতা হয়ে ওঠে, লড়াইয়ের আহ্বান জানায়- সেটাই এখানে দেখানো হয়েছে। ইতিহাসের এমন এক প্রতিরোধ লড়াইয়ের হারিয়ে যাওয়া গণনায়ক নূরলদীনকে তিনি এ কাব্যনাট্যে জীবন্ত করে তুলেছেন। একইসঙ্গে শোষিত মানুষের চেতনায় নাড়া দিয়েছেন, শোষিত মানুষকে শোষণমুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছেন। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের মুক্তির লড়াই এ কাব্যনাট্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। ১১৮৯ সালের (বাংলা) নূরলদীন হয়ে উঠেছেন সমসাময়িক এবং সংগ্রামের প্রতীক।
সৈয়দ শামসুল হককে মনে পড়লেই তাঁর সৃষ্টি নূরলদীনের ছবিটি আমার চেতনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। হক ভাইকে মনে পড়লেই যেন নূরলদীনের সেই ডাক শুনতে পাই।
“নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”
নূরলদীনের জাগিয়ে দেয়া শেষ আহ্বানটিতে যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের অমূল্য বাণী-
“ধৈর্য সবে- ধৈর্য ধরি করো আন্দোলন।
লাগে না লাগুক, বাহে, এক দুই তিন কিংবা কয়েক জীবন।”
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
বুধবার, ১৬ আগস্ট ২০২৩
সৈয়দ শামসুল হককে আমি অনেকের মতোই ‘হক ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটেছিল স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালীন কোনো এক সময়ে। ’৮০-এর দশকে নতুন দৃশ্যপটে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে সংহত করার যে চেষ্টা সেই সময়ে, দীর্ঘ কারাজীবন থেকে মুক্ত হয়ে আসার পরে, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন থেকেই পাশাপাশি থেকে তাঁর সঙ্গে পথচলার শুরু। একসঙ্গে পথ চলতে চলতে সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে। আমার সঙ্গে দেখা হলেই দেশ ও দেশের রাজনীতির হালচাল নিয়ে তিনি মন খুলে কথা বলতেন। দেখা হলেই বলতেন, “কমরেড, কী খবর?” আমার কথা শুনতেন, নানা বিষয়ে মন্তব্য করতেন। আমাদের পার্টির (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) মুখপত্র সাপ্তাহিক একতা’র খুবই উৎসাহী পাঠক ছিলেন তিনি। তাঁর আগ্রহেই পার্টির একজন কর্মীর মাধ্যমে তাঁর বাসায় নিয়মিত একতা পৌঁছে দেওয়ার স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একতা ও পার্টির অন্যান্য কাজে তিনি নিয়মিতভাবে আর্থিক সহযোগিতা করতেন। পার্টির সব চিন্তার সাথে সবসময় একমত না হতে পারলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন দরদী কমরেডের মতোই।
কয়েক বছর আগে পুরনো দিনের নানা বিষয়ে আলাপ করতে করতে তিনি যখন জানতে পারলেন যে, আমি বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলাম, তখন তিনি বললেন, “কী আশ্চর্য ব্যাপার! আমিও তো ফতেহ লোহানীর সঙ্গে কয়েকজন মিলে বসে ওই চলচ্চিত্রের সংলাপ লিখেছিলাম।” এ কথার পর তিনি অনর্গলভাবে ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রের কয়েকটা সংলাপ বলে গেলেন। আমরা দুজনেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম সেই ’৬০-এর দশকের দিনগুলোতে। আন্তরিক আলাপচারিতায় আরও জীবন্ত হয়ে উঠল আমাদের ঘনিষ্ঠতা।
বহুমাত্রিক সৃষ্টির অগ্রগণ্য হিসেবে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে সৈয়দ শামসুল হক এক বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন হয়ে আছেন। সব্যসাচী লেখক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ’৫০-এর দশকে তাঁর লেখালেখি শুরু হয়। অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, কাব্যনাট্য, চিত্রনাট্য লিখেছেন সমান তালে। তিনি অনুবাদও করেছেন। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ‘হৃৎকলমের টানে’ শিরোনামে কলাম লিখেছেন অনেক দিন। কাব্যনাট্য রচনায় পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কলাম- সবটা মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য। মানুষের ভালোবাসা, সমর্থন, স্বীকৃতি, নানা পুরস্কার সবটা মিলিয়ে তিনি চূড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পেরেছেন।
নিপীড়িত মানুষের জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ, অনুভূতি, হতাশা, বিকার ইত্যাদিকে খুব সাবলীলভাবে তিনি তাঁর রচনায় তুলে ধরেছেন। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও দেশের মানুষ, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল তাঁর লেখার বিষয়। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে সমসাময়িক বাংলাদেশ। সাহিত্যের নতুন ভাষা সৃষ্টিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। নতুন দ্যোতনায় তাঁর লেখা হয়ে উঠেছে উজ্জ্বলতর।
নিপীড়িত মানুষের জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ, অনুভূতি, হতাশা, বিকার ইত্যাদিকে খুব সাবলীলভাবে তিনি তাঁর রচনায় তুলে ধরেছেন। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও দেশের মানুষ, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল তাঁর লেখার বিষয়
বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল, তাঁকে ডাক্তারি পড়ানো। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটলেন না। বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল, তাঁকে ডাক্তারি পড়ানো। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটলেন না। ডাক্তারি পড়া আটকানোর জন্য পালিয়ে গেলেন বিদেশে। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও, সেখানকার লেখাপড়া তিনি শেষ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে তিনি বলেছেন, এক সময় তিনি উপলব্ধি করেন যে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে কিছু দিতে পারছে না। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। তারপর লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পেশা হিসেবে লেখালেখি তখন যে কতটা অনিশ্চিত ছিল, সে কথা ভালো করে জেনেও তিনি এ পথই বেছে নিয়েছিলেন।
সৈয়দ শামসুল হকের কাজের প্রধান ক্ষেত্র ছিল সাহিত্য। তিনি সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। তিনি বলেছিলেন, রাজনীতি করলে তিনি বড় রাজনীতিক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি রাজনীতির পথে না গিয়ে পুরোদস্তুর নেমে পড়েন লেখালেখিতে। তবে রাজনীতির বাইরের মানুষও তিনি ছিলেন না। তিনি জানতেন যে, রাজনীতি বাদ দিয়ে শিল্প-সাহিত্য বিশেষত প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য হয় না। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা লেখালেখির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। প্রগতিশীল এই মানুষটির হাত দিয়ে প্রগতিশীল সাহিত্যই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ লেখক হিসেবে সময়ের প্রয়োজন মেটাতে তিনি সাহিত্য অঙ্গনের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সাধ্যমতো ভূমিকা রেখেছেন। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিবিসি বাংলা বিভাগ থেকে সংবাদ পরিবেশন করতেন। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের নানা সংকটকালে তিনি রাজপথে নেমেছেন, নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেননি।
সৈয়দ শামসুল হক এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম জীবন্ত রয়েছে এবং থাকবে। তাঁর অমর সৃষ্টির জন্য বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বর্তমান ও আগামী দিনের কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করবে, পথ দেখিয়ে যাবে। সাহিত্যের অন্য প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, শুধু কাব্যনাট্যের জন্যই তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর রচিত কাব্যনাট্যগুলো তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। তাঁর অন্যতম কাব্যনাট্য ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এর কথাই ধরা যাক। এটা এক মহান সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে এটি এক অনন্য সংযোজন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এ ভূ-খণ্ডের মানুষ নানাভাবে প্রতিরোধ সংগঠিত করেছে। এই জনপদের স্বাধীনতাকামী মানুষের এমন এক প্রতিরোধ সংগ্রামের শিল্পীত বয়ান ‘নূরলদীনের সারাজীবন’। ব্রিটিশের খাতায় দস্যু হিসেবে চিহ্নিত গণনায়ক নূরলদীনকে সৈয়দ শামসুল হক এ কাব্যনাট্যে তুলে ধরেছেন। নূরলদীনের সংগ্রাম ব্রিটিশ আমলের ঘটনা হলেও, সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষুরধার লেখনীতে তা বিস্তৃত হয়েছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজকের ও আগামী দিনের লড়াই পর্যন্ত। নূরলদীনের বাবা মহাজনের খাজনা মেটাতে হালের বলদ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন এবং নিজের ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে জমি চাষ করতে গিয়ে মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর কণ্ঠে মানুষের শব্দের বদলে গরুর ‘হাম্বা’ ‘হাম্বা’ ডাক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলে মানুষের মর্যাদা যেভাবে পশুর স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছিল, সেই বিষয়টি এভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ইতিহাসের সঙ্গে নাট্যকারের প্রতিভাদীপ্ত কল্পনার সম্মিলন কাব্যনাট্যটিকে সমকালীন করে তুলেছে। নূরলদীন এ কাব্যনাট্যের মূল চরিত্র হলেও, কেবল তাঁর জীবন বর্ণনা এ নাটকের লক্ষ্য নয়। বরং সময়ের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের মধ্যে কীভাবে একজন ভূমিপুত্র নূরলদীন আত্মপ্রকাশ করে সংগঠিত হয় এবং গণমানুষের প্রাণের নেতা হয়ে ওঠে, লড়াইয়ের আহ্বান জানায়- সেটাই এখানে দেখানো হয়েছে। ইতিহাসের এমন এক প্রতিরোধ লড়াইয়ের হারিয়ে যাওয়া গণনায়ক নূরলদীনকে তিনি এ কাব্যনাট্যে জীবন্ত করে তুলেছেন। একইসঙ্গে শোষিত মানুষের চেতনায় নাড়া দিয়েছেন, শোষিত মানুষকে শোষণমুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছেন। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের মুক্তির লড়াই এ কাব্যনাট্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। ১১৮৯ সালের (বাংলা) নূরলদীন হয়ে উঠেছেন সমসাময়িক এবং সংগ্রামের প্রতীক।
সৈয়দ শামসুল হককে মনে পড়লেই তাঁর সৃষ্টি নূরলদীনের ছবিটি আমার চেতনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। হক ভাইকে মনে পড়লেই যেন নূরলদীনের সেই ডাক শুনতে পাই।
“নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”
নূরলদীনের জাগিয়ে দেয়া শেষ আহ্বানটিতে যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের অমূল্য বাণী-
“ধৈর্য সবে- ধৈর্য ধরি করো আন্দোলন।
লাগে না লাগুক, বাহে, এক দুই তিন কিংবা কয়েক জীবন।”