সুশীল সাহা
সৈয়দ শামসুল হক প্রকৃত অর্থেই সব্যসাচী লেখক। কত রকমের লেখাই না লিখেছেন সারাজীবন! গল্প কবিতা উপন্যাস নাটক কাব্যনাট্য। নানারকম লেখার মধ্যেও সব সময় উঁকি মেরেছে তাঁর কবিস্বভাব। শব্দচয়নে আর বাক্যনির্মাণে এক অদ্ভুত ধরনের সংযম তাঁকে সর্বদা ভর করেছে। কবির গদ্যের মত তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাস নির্মিত হয়েছে এক অসাধারণ ভাষায়। অনেক ভাল লেখার ভিড়ে মাঝে মাঝে যেমন হারিয়ে যেতে চায় অপেক্ষাকৃত কম ভাল লেখা, তেমনি কীভাবে যেন লুকিয়ে ছিল তাঁর একটি ছোট উপন্যাস ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’- পাদপ্রদীপের আলোয় এলো কলকাতার ‘একুশ শতক’ নাট্যদলের প্রযোজনায় ওই একই নামে পরিবেশিত নাটকের মাধ্যমে। পরিচালনা ও অভিনয়ে শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়। প্রায় একক অভিনয়ে এক অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন দোহক সর্বজীৎ ঘোষ ও সহ অভিনেত্রী সুহানিশি, বাঁশিতে সুশ্রুত গোস্বামী, তার বাদ্যে জয়ন্ত সাহা আর কণ্ঠসংগীত ও তালবাদ্যে চক্রপাণি দেব এবং সর্বোপরি আছেন সঙ্গীত পরিচালক শুভদীপ গুহ। চন্দন দাসের আলো আর কৌস্তভ চক্রবর্তী ও অনির্বাণ চক্রবর্তীর মঞ্চ পরিকল্পনা ছিমছাম ও মনোগ্রাহী।
একটি ছোট্ট উপন্যাসের আদলে এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। আর তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণী নাট্যকর্মী। আশ্চর্যের কথা, কোন রকম নাট্যরূপান্তরের কথা ভাবেননি তিনি। অবিকল উপন্যাসটি তিনি তাঁর ওজস্বী গলায় বিবৃত করে গেছেন
উপন্যাসের নামও ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’। একান্ন পাতার ছোট্ট উপন্যাস। এই ছোট্ট পরিসরেই অনেক বড় একটা ব্যাপারকে ধরেছেন সৈয়দ হক। মধ্যযুগের পটভূমিকায় এক মহৎ প্রেমোপখ্যান। আশ্চর্যের কথা, খুব ছোট্ট পরিসরেই তিনি ধরেছেন এক বিরাট পটভূমিকে, বিবৃত করেছেন অসাধারণ এক ব্যর্থ প্রেমের আখ্যানকে। শুরুতেই তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন পাঁচশো বছর আগের গহীন অতীতে, জীবন্ত করেছেন তাঁর কলমের আঁচড়ে সেই সময়কার কয়েকটি চরিত্রকে, বিন্যাস করেছেন বিবিধ ঘটনাকে।
“...লোকসকল, আমাকে অনুমতি করুন, আপনাদের নিয়ে যাই আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে, ব্রহ্মপুত্রের তীরে।
তেরোশত নদীমাতা এই পলিমাটির দেশে আমাদের একালের কথাকার আর নাট্যকারদের পূর্বপুরুষ মনসুর বয়াতির জীবনের কথা আমি কত খুঁজেছি। কত দীর্ঘদিন আমি পালাগানের পাতায় পাতায়, মনসুর বয়াতির ইতিহাস সন্ধান করেছি। কিছুই তো পাই নি আমি কোনো গানে, গাথায়, কী পালায়। শুধু এইটুকু আবিষ্কার করি যে, আমাদের প্রত্যেকের অন্তর্গত বুকঝিম এক ভালবাসার ভেতরে আছে এই মানুষটির নিঃশ্বাস। লেখায় তিনি আমার অগ্রজ, ভালবাসায় তিনি আমার প্রেমকাঠামো।
পূর্ববাংলার যাবৎ পালা ও গাথা থেকে ঘটনার শতসূত্র নিয়ে, সেই সকল পালাকার গাথাকারের শত সঙ্গীত থেকে শব্দ ঋণ করে পদ বেঁধে, আমি এখন রচনা করি মনসুর বয়াতির জীবন কথা, তাঁর প্রেমজীবনের কথা, এক জীবন-বৃক্ষের তুল্য তাঁর অমর প্রেমগাথা।”
এইভাবে শুরু হয় উপন্যাস, শুরু হয় নাটক। একা শ্রমণ দেখা দেন মঞ্চে। উপরের কথাগুলো তিনি বিবৃত করেন নাটকের প্রস্তাবনার মত। সেই অর্থে উপন্যাসটি নাট্যরূপায়িত এক পালাগান। সৈয়দ হকের বিবরণ অনুযায়ী শ্রমণ উপন্যাসটি পরপর আউড়ে যান, বিভিন্ন চরিত্রকে হাজির করেন তাঁর নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বজায় রেখে। অতি সাধারণ সাজ পোশাকে মাত্র একটি গামছাকে বাড়তি আভরণ করে তিনি একেকটি চরিত্রকে সজীব করে তোলেন। মনে পড়ে যায় দক্ষিণের অসাধারণ গায়ক ‘গদর’-এর কথা। তিনিও এমন একটি গামছাকেই হাতে করে নানা অঙ্গভঙ্গিমায় গান করেন, নানা চরিত্র তথা গানের বাণীকে জীবন্ত করেন। সেইসব দৃশ্য যারা চাক্ষুষ করেন নি, তাঁদেরকে ঠিক বোঝানো যাবে না সেই অসাধারণ গানগুলোরর অপরূপ দৃশ্যায়নের কথা।
আমি এই নির্মাণের মধ্যে ঢুকতে চাই স্রষ্টার ভাষায়। কারণ যে আবহ তিনি রচনা করেছেন, মধ্যযুগীয় বাতাবরণে তিনি যে বর্ণনার আশ্রয় নিয়েছেন যে ভাষা আর উপমা উৎপ্রেক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন তা সত্যি সত্যি একজন বড় কবির পক্ষেই সম্ভব। আসুন আমরা প্রবেশ করি ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’র গভীরে যা আমাদের নিয়ে যাবে পাঁচশ বছর আগেকার ব্রহ্মপুত্রের তীরঘেঁষা অখ- বাংলার এক সমৃদ্ধ প্রান্তরে।
“লোকসকল, পথ যায় কোথায় কেউ কি জানে? পথ হয় জগতের এক কথা। জগৎ জুড়ে পথ/একেক পথে একেক পাওয়া। সকল পাওয়ার বড় পাওয়া মনের মতো মন পাওয়া। পথে নেমে আকুল বিকুল হাঁটে দুই বন্ধু। মনসুর বলে, আজ খুব বাঁচা বেঁচেছি রে, আবুল। আজ এক বড় ফাঁড়া গুরুর আশীর্বাদে কেটে গেল রে। ঘরবাড়ি আমার ভালো লাগে না। কী সুখ আছে ঘরবাড়িতে? চলতে চলতে জমিদার মহব্বত জঙ্গের সাতমহলা বাড়ি দেখা যায়। মনসুর বলে, ওই যে জমিদার বাড়ি, মহলের পর মহল, লোকজন, দাসদাসী, সোনাদানা। কোনো যাদুমন্ত্রে ওই রাজবাড়িও কেউ আমাকে দিলে, মন আমার বসবে না রে। আমার কী ইচ্ছে করে জানিস, আবুল? যেদিকে দুই চোখ যায়, চলে যাই। সব ঠাঁই আছে মানুষ। আর মানুষ তো সোনার মতন রে। সোনার মতন মানুষের দেশে ঘুরে বেড়াই। গান বাঁধি আর গাই। মানুষের মনের কথা মুক্তার মালার মতো করে গাঁথি। মানুষের সুখে হাসি। মানুষের দুঃখে কাঁদি। কাঁদি আর কাঁদাই। পথে পথে গান করি। গান গাই।”
এই হলো মনসুর বয়াতি, সংসার বিবাগি এক শিল্পী, যার গানে ফুল ফোটে, আকাশের পাখি ডানা মেলে। মেঘের নানা রঙের মধ্যে তার সুর ঘুরে বেড়ায়। এ হেন মনসুরের প্রেমে পড়ে চাঁদ সুলতানা, জমিদার মহব্বত জঙ্গের বোন। গান শুনে পাগল হয়ে যায় সে। চোখে না দেখেও ভালবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়ে। তার এই প্রেমে পাগলিনী মনের খবর পায় ভাবী নূরজাহান। “ননদের বুকের মধ্যে যে কথা সে সেই কথা শুনতে পেয়েছে বিনিভাষায়।” সে তার স্বামীর কাছে আবদার করে, ওই মানুষটিকে নিয়ে আসার জন্যে। গান শুনবে সামনে বসিয়ে। জমিদারের পাইক ছোটে তাঁকে ধরে আনতে। মনসুরের শুভাগমন ঘটে রাজপ্রাসাদে। শুরু হয় তাঁর গান। চিকের আড়ালে চাঁদ আর ভাবী শোনে। মনসুর সারিন্দা বাজাতে বাজাতে গেয়ে চলে,
“বন্দি করে, বন্দি করে,
সুরের এই যাদু মন্তরে
পাষাণও গলিয়া যায়
চক্ষুও ভাসিয়া যায়
শিকলও কাটিয়া যায়
সুরের এই যাদুমন্তরে।
বঁধুরও বন্দি হিয়া
যায় সে পাখি হইয়া
সুরের এই যাদু মন্তরে
মনের সুরে গানের সুরে
বঁধুর অঞ্চল টেনে রে
ঘরেরও বাহির করে রে।”
“...লোকসকল, অন্দরে যদি আপনাদের নিয়ে যেতে পারতাম, তবে দেখাতে পারতাম চাঁদ সুলাতানার মুখ যেমন ডালিম ফুলের বরণ, তার ঘর-বাহিরের দিকে ঝুঁকে পড়া ডাল।”
এই হলো সৈয়দ হক, তাঁর বুকঝিম করা ভালবাসার স্পন্দন এইভাবেই তিনি বিবৃত করেন। ননদিনীর অন্তরের ভাষা বোঝেন নূরজাহান। তারই আয়োজনে মনসুরের এই শুভাগমন কিন্তু তাও বাধা পড়ে চাঁদের পাণিপ্রার্থী ফিরোজ দেওয়ানের আকস্মিক উপস্থিতিতে। চাঁদের মন মানে না, আশাপূরণের ব্যর্থতায় সে ভাবীর সহায়তায় মনসুরকে দিতে চায় উপহার। একখানি শাল। কিন্তু তা গ্রহণ করতে অপারগ মনসুর। সে আসে মহব্বত জঙ্গের বাগানে, যেখানে চাঁদের দেখা মেলে। তাঁর হাতে শাল ফিরিয়ে দিতে চায় মনসুর। চাঁদ ফিরিয়ে না নিলে যে তারই অপমান। কেন এই ফিরিয়ে দেয়া? বিস্মিত চাঁদের প্রশ্ন?
“...চাদর সে নিতে পারে-আরেকজনের গলার চাদর, তাকে গানে হারিয়ে দিয়ে। জয় করে নিলেই নিতে পারি আমরা, এই আমাদের রীতি। চোখের পলক পড়বার আগেই চাঁদ বলে ওঠে, বেশ তুমি জয় করেই নাও না তাহলে। তখন তো নিতে পারবে? আমাকে গানে গানে হারিয়ে দিয়ে। দাও পাল্লা। অবাক হয়ে মনসুর বয়াতি প্রশ্ন করে, কার সঙ্গে? কেন? আমার সঙ্গে। আমি গাইতে জানি। পদ রচনাও করতে জানি। জানি না সে কেমন জানি, কিছুটা তো জানি, এই আমি নিশ্চয় করে জানি।”
শুরু হয় গানের লড়াই। লড়াই তো নয়, ভালবাসার রঙ্গে রাঙ্গা এ এক অদ্ভুত অসম পাল্লা। গান গাইতে গাইতে মালা গাঁথে চাঁদ। মনসুরের গলায় পরিয়ে সে তার সাধ মেটাতে চায়। কিন্তু মনসুর ফিরিয়ে দিতে চায় চাঁদকে। সে জানে আসমানের চাঁদের সঙ্গে ধুলামাটির তফাৎ। সে গেয়ে ওঠে,
“মালা পরাইও না বিবি চাঁদ সুলতানা।
আসমানেতে আছ তুমি পূর্ণিমারই চাঁন,
ধুলামাটির উঠানেতে নামতে চাইও না।”
হাতের মালা হাতে থেকে যায়। চোখের জলে ভেসে চাঁদ শুধু বলে, তবে আমার এই মালাও তুমি নেবে না, মনসুর? বারবার তুমি আমার সব উপহার ফিরিয়ে দেবে? তুমি আমাকে জয় করে নিয়েছ, বয়াতি, আমাকে তুমি একবারও দেবে না তোমাকে জয় করে নিতে? এত বলে আবার মালা নিয়ে মনসুরের গলায় দিতে চায় চাঁদ। এমনই তো হয়, ঠাটা পড়ে পরিষ্কার নীল আকাশে। চিৎকার শোনা যায় মহব্বত জঙ্গের, কুত্তাটাকে কয়েদ করো। শত পাইক এসে ঘিরে ধরে মনসুরকে। অজ্ঞান আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় চাঁদ। এ চাঁদ মানুষ বলেই শতখান হয় না।”
শুরু হয় অন্য লড়াই। পাইক পেয়াদার টানাহ্যাঁচড়ায় জ্ঞান হারিয়েছে মনসুর। প্রাণে মারেনি তারা। শুধু একটু হুকুমের অপেক্ষা। কিন্তু এই হুকুম দিতে পারেন না মহব্বত প্রজারোষের ভয়ে, বরং চতুর নায়েবের মন্ত্রণায় মনসুরকে বিষ দিতে চায় সে। তবে “এ বিষ প্রাণ হরণের বিষ নয়। এ বিষ গান হরণের। গান তো গান, গলা দিয়ে স্বর পর্যন্ত ফুটবে না, কথা বলতে পারবে না। চিরদিনের মতো বোবা হয়ে যাবে।” আর সেই চাঁদের হাত দিয়েই মনসুরকে খাওয়াবার সুচতুর কৌশল করে মহব্বত। ধ্বস্ত অশক্ত জীবন্মৃত মনসুরকে বাঁচিয়ে তোলার আশায় চাঁদ তাঁর নিজের হাতে মেঠাই খাওয়ায়। প্রহরীরা নিয়ে চলে যায় মনসুরকে।
“লোকসকল, বিষ যে কত রূপ নেয়, বিষও মেঠাই হয়ে জঠরে যায়, জঠর সে বিষ ধরে, তারপর রক্তের ধারায় পাঠায়। মনসুরের স্বর স্তব্ধ হয়ে যায়।”
এ কথা অন্দরমহলে পৌঁছায় যখন, তখন চাঁদের বিয়ের আয়োজন চলছে। পাত্র মহব্বত জঙ্গের অতি পছন্দের ফিরোজ দেওয়ান। কিন্তু চাঁদ তো মনসুরের প্রেমপাশে বাঁধা পড়ে আছে। তাঁকে বাঁচিয়ে তোলার জায়গায় বোবা করে দিয়েছে সে! বয়াতির গলার স্বরই যদি না থাকে, তবে সে জীবন তো মরে যাবারই শামিল। ভাইয়ের চক্রান্তে সরল মনে চাঁদ সেই বিষ নিজের হাতে খাইয়েছে মনসুরকে। এই গ্লানির ভার সে কী করে বহন করবে! আত্মধিক্কারে খান খান হয়ে যায় সে। সেও বিষ খেয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে চায়। সুচতুর মহব্বত বিষ বলে ঘুমের ওষুধ তুলে দেয় তার হাতে। অঘোর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে অপাপবিদ্ধ চাঁদ। এই মওকায় ফিরোজের সঙ্গে বিবাহপর্ব সেরে ফেলেন মহব্বত। কিন্তু ফিরোজ তখনও জানে না, এ বিয়ে আসলে চাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটেছে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘটানো হয়েছে এই বিয়ে। চাঁদের যখন সংবিৎ আসে, তখন তাঁর হাহারবে ব্যথিত হয় ফিরোজ। কেননা সেও তো এক সঙ্গীতপাগল প্রেমিক। সে বোঝে মানুষের মন। সে কেড়ে নিতে জানে না মানুষের হৃদয়। অবোধ এক অজানা জিজ্ঞাসায় সে বিদ্ধ হয়ে যায়। জানতে চায় চাঁদের মনের মণিকোঠায় কার সেই স্থান, যার বিহনে চাঁদও আজ জীবন্মৃত! অধীর ফিরোজ চাঁদকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে। ওদিকে স্তব্ধবাক মনসুর তাঁর শিষ্য আবুলের গান রচনার সাক্ষী হয়ে থাকে। নির্বাক নির্জীব “মনসুর ভুলে যায় নিজের ভালবাসার কথা। রচনার যাদু তার চোখে সাতরঙ খেলায়। শিল্পীর তো এইই হয়- ব্যক্তিগত আর থাকে না ব্যক্তিগত, নিজেই সে নিজের সৃষ্টির বিষয় হয়ে যায়। নিজসৃষ্টি নিজকষ্টের পাশে বড় সুখের হয়।
“আ, এই পানি যায়, ভেসে যায়,
নিয়ে যায় একখানা বাঁশি। আর নাই,
সুর নাই, বাঁশি, এই বাঁশি। ও কি মোহন কোনো বাঁশি।
ও কি বন্ধুর বাঁশি তবে?
কারো প্রাণের আকুলতায় একদিন বেজেছিল এই বাঁশি?”
“... সারিন্দার তারে মনসুর বয়াতি তার নিজ রচনার সুর পথে পথে বাজায়। পুরাতন সেই সুরে কণ্ঠ দিতে আবুলের বুক ফেটে যায়। যতক্ষণ মনসুর বাজায়, সে বোবা হয়ে যায়। আবুল কেবল গায়- এই পানি যায়, বহে যায়, দরিয়ায়। কিন্তু অনেক সে পুরাতন সুর, নিজের রচনার সুর, সেইসব সুর-তার মধ্যে ‘সুরের এই যাদু মন্তর’-এর মনসুর অবিরাম পথে পথে বাজায় বাজায়। চরণে বিন্ধিলে কাঁটা বক্ষে বাহিরায়।”
ওদিকে অস্থির ও উ™£ান্ত ফিরোজ সত্যের মুখোমুখি হতে চায়, জানতে চায় চাঁদের মনের মণিকোঠায় সত্যি সত্যি কার স্থান। ঘোড়া ছুটিয়ে আসে মহব্বত জঙ্গের রাজপ্রাসাদে। মুখোমুখি হয় নূরজাহানের। এই আখ্যানে নূরজাহান আর ফিরোজ সেই অর্থে মনুষ্যত্বের পাঠ নেওয়া এক প্রকৃত মানুষ। তাঁদের অন্তরে নেই খল চাতুর্যের অধিকার বোধ। তাই তো ফিরোজ জানতে চায় প্রকৃত সত্য, চাঁদকে ফিরিয়ে চায় তাঁর ভালবাসাকে, আর নূরজাহান তাঁর ননদিনীর মন বোঝে। তাই অতি নির্ভয়ে ফিরোজের কাছে সত্যপ্রকাশ করে “... আপনি তাকে দেখেছেন আপনি যেদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, সেদিন সে কাছারির সদর প্রাঙ্গনে গান করছিল।” গানপাগল ফিরোজের অন্তরে সেই সুরের রেশ এখনও দোলা দেয়। সেই সুরের রেশটুকু সে তাঁর বাঁশিতে ধরে নিজের মহলে এসে। ঘুমের ভিতরে চাঁদের কানে পৌঁছায় সেই সুর। ছুটে এসে মনসুর ভেবে ফিরোজকে জড়িয়ে ধরে সে। অচিরেই সংবিৎ ফিরে পায় সে। ছেড়ে দেয় ফিরোজকে। তার আর বুঝতে বাকি থাকে না চাঁদের অন্তরের মানুষটি আসলে কে। তবে সে নিজের কানে শুনতে চায় চাঁদের প্রেমিকের নাম। “...মনসুর বয়াতিকে তুমি ভালোবাস? সত্য কথা কও তুমি, সত্য কথা কও। থরথর করে কেঁপে ওঠে চাঁদের রাঙ্গা ঠোঁট। সেই ঠোঁটে ভাষা ভর করতে চায়, ‘ভালোবাসি তারে আমি, সাক্ষী আছে যমুনার জল, চন্দনে মিশায়া তারে রাখবাম, করবাম তারে আমি চক্ষের কাজল।’ কিন্তু এক বর্ণও উচ্চারণ করতে পারে না সে।” কিন্তু ফিরোজ নিজ কানে শুনতে চায় তার নাম! ...আমাকে একবার তুমি নিজমুখে বলো, তার কাছে যেতে চাও। মাথার ওপরে আছেন, তিনি জানেন, সোনা, রুপা, রূপ-যৌবন তুচ্ছ, আর এই তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে আছে এক-কী সেই এক? সেই এক - বুকঝিম করা এক ভালোবাসা। আমি সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে চাই চাঁদ।” অনেক অনুনয়ের পরে চাঁদ মুখ খোলে। ফিরোজের বাঁশির সুরের মূর্ছনায় সজীব হয়ে ওঠে মনসুর। যেন “কেঁদে ওঠে আকাশের চাঁদ। ধরনীর চাঁদ ভাসে জ্যোৎস্নার প্লাবনে। আত্মহারা হয়ে বলে চাঁদ, নাম তার মনসুর বয়াতি।” আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্বল ফিরোজের অন্তর। সে চাঁদের কাতর আবেদনে ফিরিয়ে আনতে চায় মনসুরের কণ্ঠ। কেননা সে বোঝে বয়াতির আসল সত্তা তার কণ্ঠে, যে কণ্ঠের মধুরিমায় পাগলিনী হয়েছে চাঁদ। অতএব ডাকা হল রাজবৈদ্য ভোলানাথ শাস্ত্রীকে। বাঁচাতে হবে মনসুরকে, ফেরাতে হবে তাঁর মায়াবী কণ্ঠস্বরকে। কিন্তু বিষক্রিয়ায় মনসুরের শুধু কণ্ঠ নয়, প্রাণপাখিও বুঝি উড়ে যেতে যায়। “কাছারির বাইরে যে অতিথিশালা, নিজ হাতে বড় যত্নে শয্যা পেতে ফিরোজ দেওয়ান অচতেন মনসুরকে শোয়ান। অন্দরে গিয়ে তিনি চাঁদ সুলতানাকে কন, আমি তাকে নিয়ে এসেছি। আমি তার কণ্ঠ ফিরে দেবার জন্যে আমার সাধ্যে যতটুকু আছে, মানুষের আছে যতটুকু, সবই করব।”
ওদিকে রাজবৈদ্য তাঁর সর্বসাধ্য দিয়ে মনসুরের নির্জীব শরীরে প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ক্লান্ত হতোদ্যম হয়ে তিনি ফিরোজকে শোনান এই শরীরে প্রাণ ফেরানোর শেষ এবং নিদারুণ ঝুঁকির এক অমোঘ সত্য। এর চিকিৎসা জানে ‘বেদের সর্দার। নাম তার হোমরা বাইদ্যা।’ বিষে বিষক্ষয়ের এক মারণ চিকিৎসা। রোগী বাঁচতেও পারে, আবার চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে চলেও যেতে পারে। ত্রিশিরা সাপের কামড়ই হলো এর একমাত্র চিকিৎসা। ওই সাপের নাম শুনে সবার অন্তর কেঁপে ওঠে। এ যে এক পরম ঝুঁকি ! এ তো “যে সে সাপ নয়, ত্রিশিরা সাপ, যার দংশন মাত্রে মানুষের মৃত্যু শুধু নয়, দেহমাংস গলে খসে যায়। এ যে বড় ভীষণ চিকিৎসা, বাপ। মৃত্যুর সম্ভাবনা ষোলআনা।” “... এ বড় বিষম চিকিৎসা। ত্রিশিরা সাপের বিষ একমাত্র ওষুধ। ত্রিশিরার দংশনে যদি বোবা ভাল হয়। আর যদি না-ই হয়, মৃত্যু নিশ্চয়। তাই ওরা কলার ভেলা বানায়। যদি মারা যায়, বলবে ভেলায় তবে লখিন্দর ভাসাবে তখন এরা ব্রহ্মপুত্র জলে।” কিন্তু হোমরা বেদের চিকিৎসাও বিফল হয়। ত্রিশিরা সাপের দংশনে মনসুর আরো নির্জীব হয়ে পড়ে। কান্নার রোল ওঠে চারদিকে। “... সর্বনাশ, সর্বনাশ, সাপের বিষে ফিরে নাই প্রাণ। ঢলে পড়েছে নীল দেহ, পশ্চিম মুখে মাথা।” অন্দরমহল থেকে ছুটে আসে চাঁদ। তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা, “মরে গেছে?” “হরকরা বলে, না, এখনো প্রাণ আছে। এই দণ্ডে সাপের বিষ তার শরীর থেকে চুষে বের করতে না পারলে এক্ষুণি সে শেষ হয়ে যাবে।” এবার চাঁদের আত্মত্যাগের পালা। এ সবই তো তাঁরই কারণে হয়েছে! অতএব সেইই বিষ চুষে প্রাণ ফিরিয়ে দেবে মনসুরের। “যে হাত সারিন্দা বাজায়, সেই হাত, ডান সেই হাতের গোড়ায়, রক্তজমা দুটি বিন্দু। সেই বিষবিন্দু দুটিতে চাঁদ তার দুই ঠোঁট..., এখন স্থাপন করে, টানে বিষ... কন্যা বিষ টানে আর কালো রক্ত উগরায়, টানে আবার উগরায়।” মনসুর বেঁচে ওঠে। কিন্তু এই বাঁচা যে তার প্রার্থিত নয়। হঠাৎ সে তার হাতের সারিন্দা ছুড়ে ফেলে দেয় ব্রহ্মপুত্রের জলে। আপনমনে গেয়ে ওঠে, জীবনের শেষ গান।
“শোনো শোনো কন্যা, আমি কহি যে তোমারে,
আইজ বিসর্জন দিলাম আমি আমার সারিন্দারে
আর করিব না গান, তোমার কানে লো ডংশিয়া।
চায়া দ্যাখো ওই বুঝি যায় আমার যা ছিল ভাসিয়া।
কেঁদে উঠে চাঁদ বলে,
‘বিয়া হইছে লোকে জানে কবুল করি নাই,
আমারে যে চেতনহারা কইরাছিল ওষুধ খাওয়াই।
পতি বলি ডাকি মাইরে লোকের চক্ষে যিনি পতি।
তোমারেই সকল দছি, তুমিই আমার গতি।’
এমন কথা কইও না কন্যা, সমাজ মন্দ কবে।
নারীর কবুল বিয়ার কবুল জানিতে কে চায় কবে?
এ সংসারে নারীর অন্তর কেবান স্বীকার করে?
পুরুষ নাহি জানে কন্যা, আগুন ঘরে ঘরে।
নারীর সে আগুনে নারী নিজে পুইড়া ছাই।
আমার কী সাধ্য আছে জগৎ বদলাই?
আমি কবি, পারি শুধু রচিতে যে পদ আর বচন।
তাহাতে যদি বা হয় বিশ্বের চেতন।
নিজের জীবন দিয়া আমি ইতি করলাম পালা।
কঠিন এ জগতে আমি জুড়াইলাম জ্বালা।”
এ শুধু কথার কথা নয়। মনসুর তাঁর অমেয় কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েও, আপন প্রাণের স্পন্দনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না, জীবনের শেষ গান চাঁদকে শুনিয়েই সে জলে ঝাঁপ দেয়। ভেসে যায় ব্রহ্মপুত্রের অগাধ সলিলে। এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে না চাঁদ। তার সকল আয়োজন এইভাবে ব্যর্থ হতে দেখে সে নিজেও মনসুরের অনুগামী হয়ে হারিয়ে যায় ব্রহ্মপুত্রের বিশাল জলরাশির মধ্যে। “... স্রোতের টানে ভাসে গান ও গায়ক, প্রেম ও বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও মিলন ভাসে, ভেসে যায়, খর স্রোতে সকলই তো দরিয়ার দিকে ভেসে যায়।” শেষ হয়ে যায় চাঁদ ও মনসুর বয়াতির পালা, ফিরোজ দেওয়ানের পালা।
একটি ছোট্ট উপন্যাসের আদলে এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। আর তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণী নাট্যকর্মী। আশ্চর্যের কথা, কোনও রকম নাট্যরূপান্তরের কথা ভাবেননি তিনি। অবিকল উপন্যাসটি তিনি তাঁর ওজস্বী গলায় বিবৃত করে গেছেন। মাঝে মাঝেই ভাষ্যকার থেকে নিজেকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন চরিত্রের গভীরে। বাড়তি একটি গামছার আভরণে তিনি চরিত্রগুলোকে বিন্যাস করেছেন। আর তার দোহক ও সহঅভিনেত্রী আর অন্যরা গান ও তালবাদ্যে, বাঁশির সুতীব্র নিনাদে যোগ্য সঙ্গত করে গেছেন। অনধিক এই দু’ঘন্টার নাটক আমি দেখেছি প্রায় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায়। স্বভাবতই এর নির্মাতাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জেগেছে। স্রষ্টার সঙ্গে তাঁর মতবিনিময়ের পর্বটি জানতে মন চেয়েছে। সুখের কথা ছোট্ট হলেও তিনি উত্তর দিয়েছেন। “কবিসাহেবের সঙ্গে আমার দূরভাষে যখন আলাপ হয়, তখন উনি ভীষণ অসুস্থ, লন্ডনে চিকিৎসা চলছে। জানিয়েছিলাম, বুকঝিম এক ভালোবাসা করছি। তবে নাটক নিয়ে প্রচুর কথা হয়নি, হয়েছিল অন্য বিষয়ে।
তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এক অদ্ভুত মৃত্যুকথন। আজও সে কথা লেখার মতো মানসিক স্থিতি আমার আসেনি। শুধু এটুকু বলতে পারি, প্রত্যক্ষ করেছিলাম, জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে রাজরোগের সাথে যুযুধান এক কবিকে। তিনি বলেছিলেন, এখনও লিখছেন, লেখা বাকি আছে, আছে কিছু বলার এখনও। আশীর্বাদ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন উপায় থাকলে নাটক দেখতেন। উপায় ছিল না। এর পর নিয়মিত হোয়াটস আপ-এ যোগাযোগ ছিল, নাটকের ছবি, অডিও প্রোমো, সব পাঠাতাম, শুনে পড়ে খুব আনন্দ করতেন। চলে যাবার আগে পিয়াসদা (পিয়াস মজিদ), আনোয়ারা আপা (ওঁর সহধর্মিণী) সবাইকে জানিয়েছিলেন আমাদের কাজের কথা। একদিন মনে আছে, নাটক নিয়ে বেশ অসুবিধায় ছিলাম, ওঁকে বলেছিলাম, যে আমি একা কাজ করছি, সেভাবে এখনও গোটা শহরকে জানাতে পারছি না কাজের কথা, পাত্তা পাচ্ছি না। উত্তরে যা বলেছিলেন, তা বলব না, সে কথা আমার একার ইন্ধন, কারো সাথে ভাগ করার নয়, তবে এইটুকু বলতে পারি, উনি শিখিয়েছিলেন সেদিন, যে ঔজ্জ্বল্যকে নক্ষত্র ভেবে আফসোস করতে নেই, চলতে থাকাই এক এবং একমাত্র কর্তব্য। শুধু উপন্যাস বিবৃত করা কেন, চলার পথে প্রতিমুহূর্তে অনুপ্রেরণা উনি। স্বার্থপরের মতো বলি, ওনার জীবনের শেষ দিনগুলি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন! তারপরে কিছুদিনের কাজে বোম্বে যাই। ভিনশহরে বসে খবর পেলাম, আমাদের কবিসাহেবের ঠিকানা এখন শুধুই সময়ে, চিরন্তনে।”
এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে একটি অপরূপ নাটক ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’। আমরা যেন এক নতুন সৈয়দ শামসুল হককে আবিষ্কার করি এই বিনির্মাণে। আর সেইসঙ্গে আমাদের এই দুঃসময়ের সন্ধিক্ষণে এক নতুন আশার আলো হাতে নিয়ে হাজির হন নতুন প্রজন্মের নতুন এক দূত শ্রমণ চট্টোপাধায়।
স্বভাবতই এই দুই স্রষ্টাকেই একসঙ্গে বলতে ইচ্ছে করে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’?
একজন নিরুত্তর। যিনি এই নির্মাণের প্রধান হোতা সেই সৈয়দ শামসুল হক, তিনি তো আর কোনওদিন সাড়া দেবেন না। অন্যজন শ্রমণ, এই বিনির্মাণের স্রষ্টা; নিজের কোনও কৃতিত্ব দাবি করেন না। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তিনি জানান,
“স্রষ্টা ও অভিনেতার মধ্যে দেওয়াল তখনই থাকে যখন অভিনেতা সৃষ্টিকে নিজের দ্যাখনদারীর সোপান হিসেবে ব্যবহার করেন। বিরত থেকেছি এই বিকৃতি থেকে। ওঁর ভাষার সুধায় পাপস্খলন হবে, এই আশায় মঞ্চে উঠি, বীণাপাণি যতদিন কোল দেবেন, উঠবো।”
শ্রমণ, আপনার এই বিনত আত্মবয়ানের ভাবটি চিরস্থায়ী হোক। নিত্যনতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠুন আপনি। পরিশেষে আমার এই শুভ কামনা।
সুশীল সাহা
বুধবার, ১৬ আগস্ট ২০২৩
সৈয়দ শামসুল হক প্রকৃত অর্থেই সব্যসাচী লেখক। কত রকমের লেখাই না লিখেছেন সারাজীবন! গল্প কবিতা উপন্যাস নাটক কাব্যনাট্য। নানারকম লেখার মধ্যেও সব সময় উঁকি মেরেছে তাঁর কবিস্বভাব। শব্দচয়নে আর বাক্যনির্মাণে এক অদ্ভুত ধরনের সংযম তাঁকে সর্বদা ভর করেছে। কবির গদ্যের মত তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাস নির্মিত হয়েছে এক অসাধারণ ভাষায়। অনেক ভাল লেখার ভিড়ে মাঝে মাঝে যেমন হারিয়ে যেতে চায় অপেক্ষাকৃত কম ভাল লেখা, তেমনি কীভাবে যেন লুকিয়ে ছিল তাঁর একটি ছোট উপন্যাস ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’- পাদপ্রদীপের আলোয় এলো কলকাতার ‘একুশ শতক’ নাট্যদলের প্রযোজনায় ওই একই নামে পরিবেশিত নাটকের মাধ্যমে। পরিচালনা ও অভিনয়ে শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়। প্রায় একক অভিনয়ে এক অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন দোহক সর্বজীৎ ঘোষ ও সহ অভিনেত্রী সুহানিশি, বাঁশিতে সুশ্রুত গোস্বামী, তার বাদ্যে জয়ন্ত সাহা আর কণ্ঠসংগীত ও তালবাদ্যে চক্রপাণি দেব এবং সর্বোপরি আছেন সঙ্গীত পরিচালক শুভদীপ গুহ। চন্দন দাসের আলো আর কৌস্তভ চক্রবর্তী ও অনির্বাণ চক্রবর্তীর মঞ্চ পরিকল্পনা ছিমছাম ও মনোগ্রাহী।
একটি ছোট্ট উপন্যাসের আদলে এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। আর তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণী নাট্যকর্মী। আশ্চর্যের কথা, কোন রকম নাট্যরূপান্তরের কথা ভাবেননি তিনি। অবিকল উপন্যাসটি তিনি তাঁর ওজস্বী গলায় বিবৃত করে গেছেন
উপন্যাসের নামও ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’। একান্ন পাতার ছোট্ট উপন্যাস। এই ছোট্ট পরিসরেই অনেক বড় একটা ব্যাপারকে ধরেছেন সৈয়দ হক। মধ্যযুগের পটভূমিকায় এক মহৎ প্রেমোপখ্যান। আশ্চর্যের কথা, খুব ছোট্ট পরিসরেই তিনি ধরেছেন এক বিরাট পটভূমিকে, বিবৃত করেছেন অসাধারণ এক ব্যর্থ প্রেমের আখ্যানকে। শুরুতেই তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন পাঁচশো বছর আগের গহীন অতীতে, জীবন্ত করেছেন তাঁর কলমের আঁচড়ে সেই সময়কার কয়েকটি চরিত্রকে, বিন্যাস করেছেন বিবিধ ঘটনাকে।
“...লোকসকল, আমাকে অনুমতি করুন, আপনাদের নিয়ে যাই আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে, ব্রহ্মপুত্রের তীরে।
তেরোশত নদীমাতা এই পলিমাটির দেশে আমাদের একালের কথাকার আর নাট্যকারদের পূর্বপুরুষ মনসুর বয়াতির জীবনের কথা আমি কত খুঁজেছি। কত দীর্ঘদিন আমি পালাগানের পাতায় পাতায়, মনসুর বয়াতির ইতিহাস সন্ধান করেছি। কিছুই তো পাই নি আমি কোনো গানে, গাথায়, কী পালায়। শুধু এইটুকু আবিষ্কার করি যে, আমাদের প্রত্যেকের অন্তর্গত বুকঝিম এক ভালবাসার ভেতরে আছে এই মানুষটির নিঃশ্বাস। লেখায় তিনি আমার অগ্রজ, ভালবাসায় তিনি আমার প্রেমকাঠামো।
পূর্ববাংলার যাবৎ পালা ও গাথা থেকে ঘটনার শতসূত্র নিয়ে, সেই সকল পালাকার গাথাকারের শত সঙ্গীত থেকে শব্দ ঋণ করে পদ বেঁধে, আমি এখন রচনা করি মনসুর বয়াতির জীবন কথা, তাঁর প্রেমজীবনের কথা, এক জীবন-বৃক্ষের তুল্য তাঁর অমর প্রেমগাথা।”
এইভাবে শুরু হয় উপন্যাস, শুরু হয় নাটক। একা শ্রমণ দেখা দেন মঞ্চে। উপরের কথাগুলো তিনি বিবৃত করেন নাটকের প্রস্তাবনার মত। সেই অর্থে উপন্যাসটি নাট্যরূপায়িত এক পালাগান। সৈয়দ হকের বিবরণ অনুযায়ী শ্রমণ উপন্যাসটি পরপর আউড়ে যান, বিভিন্ন চরিত্রকে হাজির করেন তাঁর নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বজায় রেখে। অতি সাধারণ সাজ পোশাকে মাত্র একটি গামছাকে বাড়তি আভরণ করে তিনি একেকটি চরিত্রকে সজীব করে তোলেন। মনে পড়ে যায় দক্ষিণের অসাধারণ গায়ক ‘গদর’-এর কথা। তিনিও এমন একটি গামছাকেই হাতে করে নানা অঙ্গভঙ্গিমায় গান করেন, নানা চরিত্র তথা গানের বাণীকে জীবন্ত করেন। সেইসব দৃশ্য যারা চাক্ষুষ করেন নি, তাঁদেরকে ঠিক বোঝানো যাবে না সেই অসাধারণ গানগুলোরর অপরূপ দৃশ্যায়নের কথা।
আমি এই নির্মাণের মধ্যে ঢুকতে চাই স্রষ্টার ভাষায়। কারণ যে আবহ তিনি রচনা করেছেন, মধ্যযুগীয় বাতাবরণে তিনি যে বর্ণনার আশ্রয় নিয়েছেন যে ভাষা আর উপমা উৎপ্রেক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন তা সত্যি সত্যি একজন বড় কবির পক্ষেই সম্ভব। আসুন আমরা প্রবেশ করি ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’র গভীরে যা আমাদের নিয়ে যাবে পাঁচশ বছর আগেকার ব্রহ্মপুত্রের তীরঘেঁষা অখ- বাংলার এক সমৃদ্ধ প্রান্তরে।
“লোকসকল, পথ যায় কোথায় কেউ কি জানে? পথ হয় জগতের এক কথা। জগৎ জুড়ে পথ/একেক পথে একেক পাওয়া। সকল পাওয়ার বড় পাওয়া মনের মতো মন পাওয়া। পথে নেমে আকুল বিকুল হাঁটে দুই বন্ধু। মনসুর বলে, আজ খুব বাঁচা বেঁচেছি রে, আবুল। আজ এক বড় ফাঁড়া গুরুর আশীর্বাদে কেটে গেল রে। ঘরবাড়ি আমার ভালো লাগে না। কী সুখ আছে ঘরবাড়িতে? চলতে চলতে জমিদার মহব্বত জঙ্গের সাতমহলা বাড়ি দেখা যায়। মনসুর বলে, ওই যে জমিদার বাড়ি, মহলের পর মহল, লোকজন, দাসদাসী, সোনাদানা। কোনো যাদুমন্ত্রে ওই রাজবাড়িও কেউ আমাকে দিলে, মন আমার বসবে না রে। আমার কী ইচ্ছে করে জানিস, আবুল? যেদিকে দুই চোখ যায়, চলে যাই। সব ঠাঁই আছে মানুষ। আর মানুষ তো সোনার মতন রে। সোনার মতন মানুষের দেশে ঘুরে বেড়াই। গান বাঁধি আর গাই। মানুষের মনের কথা মুক্তার মালার মতো করে গাঁথি। মানুষের সুখে হাসি। মানুষের দুঃখে কাঁদি। কাঁদি আর কাঁদাই। পথে পথে গান করি। গান গাই।”
এই হলো মনসুর বয়াতি, সংসার বিবাগি এক শিল্পী, যার গানে ফুল ফোটে, আকাশের পাখি ডানা মেলে। মেঘের নানা রঙের মধ্যে তার সুর ঘুরে বেড়ায়। এ হেন মনসুরের প্রেমে পড়ে চাঁদ সুলতানা, জমিদার মহব্বত জঙ্গের বোন। গান শুনে পাগল হয়ে যায় সে। চোখে না দেখেও ভালবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়ে। তার এই প্রেমে পাগলিনী মনের খবর পায় ভাবী নূরজাহান। “ননদের বুকের মধ্যে যে কথা সে সেই কথা শুনতে পেয়েছে বিনিভাষায়।” সে তার স্বামীর কাছে আবদার করে, ওই মানুষটিকে নিয়ে আসার জন্যে। গান শুনবে সামনে বসিয়ে। জমিদারের পাইক ছোটে তাঁকে ধরে আনতে। মনসুরের শুভাগমন ঘটে রাজপ্রাসাদে। শুরু হয় তাঁর গান। চিকের আড়ালে চাঁদ আর ভাবী শোনে। মনসুর সারিন্দা বাজাতে বাজাতে গেয়ে চলে,
“বন্দি করে, বন্দি করে,
সুরের এই যাদু মন্তরে
পাষাণও গলিয়া যায়
চক্ষুও ভাসিয়া যায়
শিকলও কাটিয়া যায়
সুরের এই যাদুমন্তরে।
বঁধুরও বন্দি হিয়া
যায় সে পাখি হইয়া
সুরের এই যাদু মন্তরে
মনের সুরে গানের সুরে
বঁধুর অঞ্চল টেনে রে
ঘরেরও বাহির করে রে।”
“...লোকসকল, অন্দরে যদি আপনাদের নিয়ে যেতে পারতাম, তবে দেখাতে পারতাম চাঁদ সুলাতানার মুখ যেমন ডালিম ফুলের বরণ, তার ঘর-বাহিরের দিকে ঝুঁকে পড়া ডাল।”
এই হলো সৈয়দ হক, তাঁর বুকঝিম করা ভালবাসার স্পন্দন এইভাবেই তিনি বিবৃত করেন। ননদিনীর অন্তরের ভাষা বোঝেন নূরজাহান। তারই আয়োজনে মনসুরের এই শুভাগমন কিন্তু তাও বাধা পড়ে চাঁদের পাণিপ্রার্থী ফিরোজ দেওয়ানের আকস্মিক উপস্থিতিতে। চাঁদের মন মানে না, আশাপূরণের ব্যর্থতায় সে ভাবীর সহায়তায় মনসুরকে দিতে চায় উপহার। একখানি শাল। কিন্তু তা গ্রহণ করতে অপারগ মনসুর। সে আসে মহব্বত জঙ্গের বাগানে, যেখানে চাঁদের দেখা মেলে। তাঁর হাতে শাল ফিরিয়ে দিতে চায় মনসুর। চাঁদ ফিরিয়ে না নিলে যে তারই অপমান। কেন এই ফিরিয়ে দেয়া? বিস্মিত চাঁদের প্রশ্ন?
“...চাদর সে নিতে পারে-আরেকজনের গলার চাদর, তাকে গানে হারিয়ে দিয়ে। জয় করে নিলেই নিতে পারি আমরা, এই আমাদের রীতি। চোখের পলক পড়বার আগেই চাঁদ বলে ওঠে, বেশ তুমি জয় করেই নাও না তাহলে। তখন তো নিতে পারবে? আমাকে গানে গানে হারিয়ে দিয়ে। দাও পাল্লা। অবাক হয়ে মনসুর বয়াতি প্রশ্ন করে, কার সঙ্গে? কেন? আমার সঙ্গে। আমি গাইতে জানি। পদ রচনাও করতে জানি। জানি না সে কেমন জানি, কিছুটা তো জানি, এই আমি নিশ্চয় করে জানি।”
শুরু হয় গানের লড়াই। লড়াই তো নয়, ভালবাসার রঙ্গে রাঙ্গা এ এক অদ্ভুত অসম পাল্লা। গান গাইতে গাইতে মালা গাঁথে চাঁদ। মনসুরের গলায় পরিয়ে সে তার সাধ মেটাতে চায়। কিন্তু মনসুর ফিরিয়ে দিতে চায় চাঁদকে। সে জানে আসমানের চাঁদের সঙ্গে ধুলামাটির তফাৎ। সে গেয়ে ওঠে,
“মালা পরাইও না বিবি চাঁদ সুলতানা।
আসমানেতে আছ তুমি পূর্ণিমারই চাঁন,
ধুলামাটির উঠানেতে নামতে চাইও না।”
হাতের মালা হাতে থেকে যায়। চোখের জলে ভেসে চাঁদ শুধু বলে, তবে আমার এই মালাও তুমি নেবে না, মনসুর? বারবার তুমি আমার সব উপহার ফিরিয়ে দেবে? তুমি আমাকে জয় করে নিয়েছ, বয়াতি, আমাকে তুমি একবারও দেবে না তোমাকে জয় করে নিতে? এত বলে আবার মালা নিয়ে মনসুরের গলায় দিতে চায় চাঁদ। এমনই তো হয়, ঠাটা পড়ে পরিষ্কার নীল আকাশে। চিৎকার শোনা যায় মহব্বত জঙ্গের, কুত্তাটাকে কয়েদ করো। শত পাইক এসে ঘিরে ধরে মনসুরকে। অজ্ঞান আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় চাঁদ। এ চাঁদ মানুষ বলেই শতখান হয় না।”
শুরু হয় অন্য লড়াই। পাইক পেয়াদার টানাহ্যাঁচড়ায় জ্ঞান হারিয়েছে মনসুর। প্রাণে মারেনি তারা। শুধু একটু হুকুমের অপেক্ষা। কিন্তু এই হুকুম দিতে পারেন না মহব্বত প্রজারোষের ভয়ে, বরং চতুর নায়েবের মন্ত্রণায় মনসুরকে বিষ দিতে চায় সে। তবে “এ বিষ প্রাণ হরণের বিষ নয়। এ বিষ গান হরণের। গান তো গান, গলা দিয়ে স্বর পর্যন্ত ফুটবে না, কথা বলতে পারবে না। চিরদিনের মতো বোবা হয়ে যাবে।” আর সেই চাঁদের হাত দিয়েই মনসুরকে খাওয়াবার সুচতুর কৌশল করে মহব্বত। ধ্বস্ত অশক্ত জীবন্মৃত মনসুরকে বাঁচিয়ে তোলার আশায় চাঁদ তাঁর নিজের হাতে মেঠাই খাওয়ায়। প্রহরীরা নিয়ে চলে যায় মনসুরকে।
“লোকসকল, বিষ যে কত রূপ নেয়, বিষও মেঠাই হয়ে জঠরে যায়, জঠর সে বিষ ধরে, তারপর রক্তের ধারায় পাঠায়। মনসুরের স্বর স্তব্ধ হয়ে যায়।”
এ কথা অন্দরমহলে পৌঁছায় যখন, তখন চাঁদের বিয়ের আয়োজন চলছে। পাত্র মহব্বত জঙ্গের অতি পছন্দের ফিরোজ দেওয়ান। কিন্তু চাঁদ তো মনসুরের প্রেমপাশে বাঁধা পড়ে আছে। তাঁকে বাঁচিয়ে তোলার জায়গায় বোবা করে দিয়েছে সে! বয়াতির গলার স্বরই যদি না থাকে, তবে সে জীবন তো মরে যাবারই শামিল। ভাইয়ের চক্রান্তে সরল মনে চাঁদ সেই বিষ নিজের হাতে খাইয়েছে মনসুরকে। এই গ্লানির ভার সে কী করে বহন করবে! আত্মধিক্কারে খান খান হয়ে যায় সে। সেও বিষ খেয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে চায়। সুচতুর মহব্বত বিষ বলে ঘুমের ওষুধ তুলে দেয় তার হাতে। অঘোর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে অপাপবিদ্ধ চাঁদ। এই মওকায় ফিরোজের সঙ্গে বিবাহপর্ব সেরে ফেলেন মহব্বত। কিন্তু ফিরোজ তখনও জানে না, এ বিয়ে আসলে চাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটেছে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘটানো হয়েছে এই বিয়ে। চাঁদের যখন সংবিৎ আসে, তখন তাঁর হাহারবে ব্যথিত হয় ফিরোজ। কেননা সেও তো এক সঙ্গীতপাগল প্রেমিক। সে বোঝে মানুষের মন। সে কেড়ে নিতে জানে না মানুষের হৃদয়। অবোধ এক অজানা জিজ্ঞাসায় সে বিদ্ধ হয়ে যায়। জানতে চায় চাঁদের মনের মণিকোঠায় কার সেই স্থান, যার বিহনে চাঁদও আজ জীবন্মৃত! অধীর ফিরোজ চাঁদকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে। ওদিকে স্তব্ধবাক মনসুর তাঁর শিষ্য আবুলের গান রচনার সাক্ষী হয়ে থাকে। নির্বাক নির্জীব “মনসুর ভুলে যায় নিজের ভালবাসার কথা। রচনার যাদু তার চোখে সাতরঙ খেলায়। শিল্পীর তো এইই হয়- ব্যক্তিগত আর থাকে না ব্যক্তিগত, নিজেই সে নিজের সৃষ্টির বিষয় হয়ে যায়। নিজসৃষ্টি নিজকষ্টের পাশে বড় সুখের হয়।
“আ, এই পানি যায়, ভেসে যায়,
নিয়ে যায় একখানা বাঁশি। আর নাই,
সুর নাই, বাঁশি, এই বাঁশি। ও কি মোহন কোনো বাঁশি।
ও কি বন্ধুর বাঁশি তবে?
কারো প্রাণের আকুলতায় একদিন বেজেছিল এই বাঁশি?”
“... সারিন্দার তারে মনসুর বয়াতি তার নিজ রচনার সুর পথে পথে বাজায়। পুরাতন সেই সুরে কণ্ঠ দিতে আবুলের বুক ফেটে যায়। যতক্ষণ মনসুর বাজায়, সে বোবা হয়ে যায়। আবুল কেবল গায়- এই পানি যায়, বহে যায়, দরিয়ায়। কিন্তু অনেক সে পুরাতন সুর, নিজের রচনার সুর, সেইসব সুর-তার মধ্যে ‘সুরের এই যাদু মন্তর’-এর মনসুর অবিরাম পথে পথে বাজায় বাজায়। চরণে বিন্ধিলে কাঁটা বক্ষে বাহিরায়।”
ওদিকে অস্থির ও উ™£ান্ত ফিরোজ সত্যের মুখোমুখি হতে চায়, জানতে চায় চাঁদের মনের মণিকোঠায় সত্যি সত্যি কার স্থান। ঘোড়া ছুটিয়ে আসে মহব্বত জঙ্গের রাজপ্রাসাদে। মুখোমুখি হয় নূরজাহানের। এই আখ্যানে নূরজাহান আর ফিরোজ সেই অর্থে মনুষ্যত্বের পাঠ নেওয়া এক প্রকৃত মানুষ। তাঁদের অন্তরে নেই খল চাতুর্যের অধিকার বোধ। তাই তো ফিরোজ জানতে চায় প্রকৃত সত্য, চাঁদকে ফিরিয়ে চায় তাঁর ভালবাসাকে, আর নূরজাহান তাঁর ননদিনীর মন বোঝে। তাই অতি নির্ভয়ে ফিরোজের কাছে সত্যপ্রকাশ করে “... আপনি তাকে দেখেছেন আপনি যেদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, সেদিন সে কাছারির সদর প্রাঙ্গনে গান করছিল।” গানপাগল ফিরোজের অন্তরে সেই সুরের রেশ এখনও দোলা দেয়। সেই সুরের রেশটুকু সে তাঁর বাঁশিতে ধরে নিজের মহলে এসে। ঘুমের ভিতরে চাঁদের কানে পৌঁছায় সেই সুর। ছুটে এসে মনসুর ভেবে ফিরোজকে জড়িয়ে ধরে সে। অচিরেই সংবিৎ ফিরে পায় সে। ছেড়ে দেয় ফিরোজকে। তার আর বুঝতে বাকি থাকে না চাঁদের অন্তরের মানুষটি আসলে কে। তবে সে নিজের কানে শুনতে চায় চাঁদের প্রেমিকের নাম। “...মনসুর বয়াতিকে তুমি ভালোবাস? সত্য কথা কও তুমি, সত্য কথা কও। থরথর করে কেঁপে ওঠে চাঁদের রাঙ্গা ঠোঁট। সেই ঠোঁটে ভাষা ভর করতে চায়, ‘ভালোবাসি তারে আমি, সাক্ষী আছে যমুনার জল, চন্দনে মিশায়া তারে রাখবাম, করবাম তারে আমি চক্ষের কাজল।’ কিন্তু এক বর্ণও উচ্চারণ করতে পারে না সে।” কিন্তু ফিরোজ নিজ কানে শুনতে চায় তার নাম! ...আমাকে একবার তুমি নিজমুখে বলো, তার কাছে যেতে চাও। মাথার ওপরে আছেন, তিনি জানেন, সোনা, রুপা, রূপ-যৌবন তুচ্ছ, আর এই তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে আছে এক-কী সেই এক? সেই এক - বুকঝিম করা এক ভালোবাসা। আমি সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে চাই চাঁদ।” অনেক অনুনয়ের পরে চাঁদ মুখ খোলে। ফিরোজের বাঁশির সুরের মূর্ছনায় সজীব হয়ে ওঠে মনসুর। যেন “কেঁদে ওঠে আকাশের চাঁদ। ধরনীর চাঁদ ভাসে জ্যোৎস্নার প্লাবনে। আত্মহারা হয়ে বলে চাঁদ, নাম তার মনসুর বয়াতি।” আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্বল ফিরোজের অন্তর। সে চাঁদের কাতর আবেদনে ফিরিয়ে আনতে চায় মনসুরের কণ্ঠ। কেননা সে বোঝে বয়াতির আসল সত্তা তার কণ্ঠে, যে কণ্ঠের মধুরিমায় পাগলিনী হয়েছে চাঁদ। অতএব ডাকা হল রাজবৈদ্য ভোলানাথ শাস্ত্রীকে। বাঁচাতে হবে মনসুরকে, ফেরাতে হবে তাঁর মায়াবী কণ্ঠস্বরকে। কিন্তু বিষক্রিয়ায় মনসুরের শুধু কণ্ঠ নয়, প্রাণপাখিও বুঝি উড়ে যেতে যায়। “কাছারির বাইরে যে অতিথিশালা, নিজ হাতে বড় যত্নে শয্যা পেতে ফিরোজ দেওয়ান অচতেন মনসুরকে শোয়ান। অন্দরে গিয়ে তিনি চাঁদ সুলতানাকে কন, আমি তাকে নিয়ে এসেছি। আমি তার কণ্ঠ ফিরে দেবার জন্যে আমার সাধ্যে যতটুকু আছে, মানুষের আছে যতটুকু, সবই করব।”
ওদিকে রাজবৈদ্য তাঁর সর্বসাধ্য দিয়ে মনসুরের নির্জীব শরীরে প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ক্লান্ত হতোদ্যম হয়ে তিনি ফিরোজকে শোনান এই শরীরে প্রাণ ফেরানোর শেষ এবং নিদারুণ ঝুঁকির এক অমোঘ সত্য। এর চিকিৎসা জানে ‘বেদের সর্দার। নাম তার হোমরা বাইদ্যা।’ বিষে বিষক্ষয়ের এক মারণ চিকিৎসা। রোগী বাঁচতেও পারে, আবার চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে চলেও যেতে পারে। ত্রিশিরা সাপের কামড়ই হলো এর একমাত্র চিকিৎসা। ওই সাপের নাম শুনে সবার অন্তর কেঁপে ওঠে। এ যে এক পরম ঝুঁকি ! এ তো “যে সে সাপ নয়, ত্রিশিরা সাপ, যার দংশন মাত্রে মানুষের মৃত্যু শুধু নয়, দেহমাংস গলে খসে যায়। এ যে বড় ভীষণ চিকিৎসা, বাপ। মৃত্যুর সম্ভাবনা ষোলআনা।” “... এ বড় বিষম চিকিৎসা। ত্রিশিরা সাপের বিষ একমাত্র ওষুধ। ত্রিশিরার দংশনে যদি বোবা ভাল হয়। আর যদি না-ই হয়, মৃত্যু নিশ্চয়। তাই ওরা কলার ভেলা বানায়। যদি মারা যায়, বলবে ভেলায় তবে লখিন্দর ভাসাবে তখন এরা ব্রহ্মপুত্র জলে।” কিন্তু হোমরা বেদের চিকিৎসাও বিফল হয়। ত্রিশিরা সাপের দংশনে মনসুর আরো নির্জীব হয়ে পড়ে। কান্নার রোল ওঠে চারদিকে। “... সর্বনাশ, সর্বনাশ, সাপের বিষে ফিরে নাই প্রাণ। ঢলে পড়েছে নীল দেহ, পশ্চিম মুখে মাথা।” অন্দরমহল থেকে ছুটে আসে চাঁদ। তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা, “মরে গেছে?” “হরকরা বলে, না, এখনো প্রাণ আছে। এই দণ্ডে সাপের বিষ তার শরীর থেকে চুষে বের করতে না পারলে এক্ষুণি সে শেষ হয়ে যাবে।” এবার চাঁদের আত্মত্যাগের পালা। এ সবই তো তাঁরই কারণে হয়েছে! অতএব সেইই বিষ চুষে প্রাণ ফিরিয়ে দেবে মনসুরের। “যে হাত সারিন্দা বাজায়, সেই হাত, ডান সেই হাতের গোড়ায়, রক্তজমা দুটি বিন্দু। সেই বিষবিন্দু দুটিতে চাঁদ তার দুই ঠোঁট..., এখন স্থাপন করে, টানে বিষ... কন্যা বিষ টানে আর কালো রক্ত উগরায়, টানে আবার উগরায়।” মনসুর বেঁচে ওঠে। কিন্তু এই বাঁচা যে তার প্রার্থিত নয়। হঠাৎ সে তার হাতের সারিন্দা ছুড়ে ফেলে দেয় ব্রহ্মপুত্রের জলে। আপনমনে গেয়ে ওঠে, জীবনের শেষ গান।
“শোনো শোনো কন্যা, আমি কহি যে তোমারে,
আইজ বিসর্জন দিলাম আমি আমার সারিন্দারে
আর করিব না গান, তোমার কানে লো ডংশিয়া।
চায়া দ্যাখো ওই বুঝি যায় আমার যা ছিল ভাসিয়া।
কেঁদে উঠে চাঁদ বলে,
‘বিয়া হইছে লোকে জানে কবুল করি নাই,
আমারে যে চেতনহারা কইরাছিল ওষুধ খাওয়াই।
পতি বলি ডাকি মাইরে লোকের চক্ষে যিনি পতি।
তোমারেই সকল দছি, তুমিই আমার গতি।’
এমন কথা কইও না কন্যা, সমাজ মন্দ কবে।
নারীর কবুল বিয়ার কবুল জানিতে কে চায় কবে?
এ সংসারে নারীর অন্তর কেবান স্বীকার করে?
পুরুষ নাহি জানে কন্যা, আগুন ঘরে ঘরে।
নারীর সে আগুনে নারী নিজে পুইড়া ছাই।
আমার কী সাধ্য আছে জগৎ বদলাই?
আমি কবি, পারি শুধু রচিতে যে পদ আর বচন।
তাহাতে যদি বা হয় বিশ্বের চেতন।
নিজের জীবন দিয়া আমি ইতি করলাম পালা।
কঠিন এ জগতে আমি জুড়াইলাম জ্বালা।”
এ শুধু কথার কথা নয়। মনসুর তাঁর অমেয় কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েও, আপন প্রাণের স্পন্দনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না, জীবনের শেষ গান চাঁদকে শুনিয়েই সে জলে ঝাঁপ দেয়। ভেসে যায় ব্রহ্মপুত্রের অগাধ সলিলে। এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে না চাঁদ। তার সকল আয়োজন এইভাবে ব্যর্থ হতে দেখে সে নিজেও মনসুরের অনুগামী হয়ে হারিয়ে যায় ব্রহ্মপুত্রের বিশাল জলরাশির মধ্যে। “... স্রোতের টানে ভাসে গান ও গায়ক, প্রেম ও বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও মিলন ভাসে, ভেসে যায়, খর স্রোতে সকলই তো দরিয়ার দিকে ভেসে যায়।” শেষ হয়ে যায় চাঁদ ও মনসুর বয়াতির পালা, ফিরোজ দেওয়ানের পালা।
একটি ছোট্ট উপন্যাসের আদলে এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। আর তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণী নাট্যকর্মী। আশ্চর্যের কথা, কোনও রকম নাট্যরূপান্তরের কথা ভাবেননি তিনি। অবিকল উপন্যাসটি তিনি তাঁর ওজস্বী গলায় বিবৃত করে গেছেন। মাঝে মাঝেই ভাষ্যকার থেকে নিজেকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন চরিত্রের গভীরে। বাড়তি একটি গামছার আভরণে তিনি চরিত্রগুলোকে বিন্যাস করেছেন। আর তার দোহক ও সহঅভিনেত্রী আর অন্যরা গান ও তালবাদ্যে, বাঁশির সুতীব্র নিনাদে যোগ্য সঙ্গত করে গেছেন। অনধিক এই দু’ঘন্টার নাটক আমি দেখেছি প্রায় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায়। স্বভাবতই এর নির্মাতাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জেগেছে। স্রষ্টার সঙ্গে তাঁর মতবিনিময়ের পর্বটি জানতে মন চেয়েছে। সুখের কথা ছোট্ট হলেও তিনি উত্তর দিয়েছেন। “কবিসাহেবের সঙ্গে আমার দূরভাষে যখন আলাপ হয়, তখন উনি ভীষণ অসুস্থ, লন্ডনে চিকিৎসা চলছে। জানিয়েছিলাম, বুকঝিম এক ভালোবাসা করছি। তবে নাটক নিয়ে প্রচুর কথা হয়নি, হয়েছিল অন্য বিষয়ে।
তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এক অদ্ভুত মৃত্যুকথন। আজও সে কথা লেখার মতো মানসিক স্থিতি আমার আসেনি। শুধু এটুকু বলতে পারি, প্রত্যক্ষ করেছিলাম, জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে রাজরোগের সাথে যুযুধান এক কবিকে। তিনি বলেছিলেন, এখনও লিখছেন, লেখা বাকি আছে, আছে কিছু বলার এখনও। আশীর্বাদ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন উপায় থাকলে নাটক দেখতেন। উপায় ছিল না। এর পর নিয়মিত হোয়াটস আপ-এ যোগাযোগ ছিল, নাটকের ছবি, অডিও প্রোমো, সব পাঠাতাম, শুনে পড়ে খুব আনন্দ করতেন। চলে যাবার আগে পিয়াসদা (পিয়াস মজিদ), আনোয়ারা আপা (ওঁর সহধর্মিণী) সবাইকে জানিয়েছিলেন আমাদের কাজের কথা। একদিন মনে আছে, নাটক নিয়ে বেশ অসুবিধায় ছিলাম, ওঁকে বলেছিলাম, যে আমি একা কাজ করছি, সেভাবে এখনও গোটা শহরকে জানাতে পারছি না কাজের কথা, পাত্তা পাচ্ছি না। উত্তরে যা বলেছিলেন, তা বলব না, সে কথা আমার একার ইন্ধন, কারো সাথে ভাগ করার নয়, তবে এইটুকু বলতে পারি, উনি শিখিয়েছিলেন সেদিন, যে ঔজ্জ্বল্যকে নক্ষত্র ভেবে আফসোস করতে নেই, চলতে থাকাই এক এবং একমাত্র কর্তব্য। শুধু উপন্যাস বিবৃত করা কেন, চলার পথে প্রতিমুহূর্তে অনুপ্রেরণা উনি। স্বার্থপরের মতো বলি, ওনার জীবনের শেষ দিনগুলি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন! তারপরে কিছুদিনের কাজে বোম্বে যাই। ভিনশহরে বসে খবর পেলাম, আমাদের কবিসাহেবের ঠিকানা এখন শুধুই সময়ে, চিরন্তনে।”
এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে একটি অপরূপ নাটক ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’। আমরা যেন এক নতুন সৈয়দ শামসুল হককে আবিষ্কার করি এই বিনির্মাণে। আর সেইসঙ্গে আমাদের এই দুঃসময়ের সন্ধিক্ষণে এক নতুন আশার আলো হাতে নিয়ে হাজির হন নতুন প্রজন্মের নতুন এক দূত শ্রমণ চট্টোপাধায়।
স্বভাবতই এই দুই স্রষ্টাকেই একসঙ্গে বলতে ইচ্ছে করে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’?
একজন নিরুত্তর। যিনি এই নির্মাণের প্রধান হোতা সেই সৈয়দ শামসুল হক, তিনি তো আর কোনওদিন সাড়া দেবেন না। অন্যজন শ্রমণ, এই বিনির্মাণের স্রষ্টা; নিজের কোনও কৃতিত্ব দাবি করেন না। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তিনি জানান,
“স্রষ্টা ও অভিনেতার মধ্যে দেওয়াল তখনই থাকে যখন অভিনেতা সৃষ্টিকে নিজের দ্যাখনদারীর সোপান হিসেবে ব্যবহার করেন। বিরত থেকেছি এই বিকৃতি থেকে। ওঁর ভাষার সুধায় পাপস্খলন হবে, এই আশায় মঞ্চে উঠি, বীণাপাণি যতদিন কোল দেবেন, উঠবো।”
শ্রমণ, আপনার এই বিনত আত্মবয়ানের ভাবটি চিরস্থায়ী হোক। নিত্যনতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠুন আপনি। পরিশেষে আমার এই শুভ কামনা।