alt

সাময়িকী

রাজনীতির জাগরী নয়, আন্তঃসম্পর্কের আত্মকথন

সাদ কামালী

: বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

সতীনাথ ভাদুড়ী

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কেবল শেষ হলেও বাতাসে তীব্র বারুদ পোড়া গন্ধ, রেডিয়েশন, আর্ত হাহাকার আর বিশ্ব রাজনীতিকগণ তুমুল কূটনৈতিক তৎপরতায় সরব, তখন, ১৯৪৫-এর ৪ অক্টোবর, প্রকাশিত হলো সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম গ্রন্থ ‘জাগরী’ উপন্যাস। এর ঠিক তিন বছর আগে, পরাধীন ভারতের নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের চলমান অস্থিরতার ভিতর আইন অমান্য আগস্ট আন্দোলন বিহার প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল মারাত্মকভাবে। সেই ১৯৪২-এর ১৫ বা ১৬ আগস্ট উত্তর-বিহার থেকে সতীনাথ ভাদুড়ীসহ আটজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ভারত রক্ষা আইনের ১২৯ (১) অ ধারায় গ্রেফতার হন। পুলিশের খাতায় তখন সতীনাথের পরিচয় ছিল এমন- ‘... Sri Satinath Bhaduri, a practising Lawyer, ex-Secretary of the District Congress Committee...’। বিহারের পূর্ণিয়া জেলে আটক হওয়ার সময় তাঁর নামমাত্র সাহিত্যিক পরিচয়ও ছিল না। গ্রন্থপ্রকাশ তো দূরের কথা, মফস্বলের সাহিত্যপত্রেও তাঁর প্রকাশিত গল্প-রচনার খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে জেলে বন্দি হওয়ার সময় সরকারিভাবে ‘বী’ হলেও পূর্ণিয়া কংগ্রেসের জেলা-সংগঠনের ভার তখন ছিল সতীনাথের ওপর। পূর্ণিয়া জেলপ্রাচীরের অন্তরালে বসেই কথ্য ভঙ্গিতে ডায়েরির মতো কিছু লিখতে শুরু করেন, কেউ কেউ তো প্রথমে ডায়েরিই ভেবেছিল। অনুজপ্রতিম হিন্দি কথাসাহিত্যিক বন্ধু ফণীশ্বরনাথ রেণু স্মৃতিচারণ করছেন, ‘একদিন ওর ডিগ্রিতে বসে চা খাচ্ছিলাম। সামনে একটা খাতা ছিল। হাতে নিয়ে পাতা খুলে দেখি লেড্পেন্সিল দিয়ে লেখা। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হলো, এ তো ডায়েরি! খাতা বন্ধ করে রেখে দেবার সময় বললাম- ডায়েরি বুঝি? প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন- কেন? ডায়েরি পড়তে নেই বুঝি? ... বললেন- চারপাতা যখন পড়েই ফেলেছ বাকি পৃষ্ঠাগুলি পড়ে নাও। ... চার মাস পরে নীলুর অধ্যায় অর্থাৎ অন্তিম অধ্যায় পড়ে ... ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ে হাত দিতে দিতে বলেছিলাম- আজকে আপনি বারণ করলেও কিছু শুনব না, পায়ের ধুলো দিন (সতীনাথ স্মরণে : ‘ভাদুড়ীজী’ শ্রী সুবল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত)। অন্তর্গত কথনশৈলীতে নির্মিত অন্তগূঢ় যন্ত্রণার অভিনব উপন্যাস ‘জাগরী’র এই হলো শুরুর কথা।

বন্ধুদের সহযোগিতায় ১৯৪৫-এর ৪ অক্টোবর সমবায় পাবলিশার্স থেকে উপন্যাসটি বের হলেও তার চেহারাটি ছিল বলবার মতো : ছাপার ভুলে ভরা, প্যাকিং কাগজের মতো লালচে কাগজ, সস্তা পিজবোর্ডের মলাটে অচেনা অজানা লেখকের ‘জাগরী’ নামের উপন্যাসটি বইবাজারে এলো। যদিও ছাপার দৈন্য আর উপেক্ষার শেষ নেই, মলাটের ওপর লেখকের বা উপন্যাসের নামটি পর্যন্ত মুদ্রিত ছিল না, জীবনরসে জারিত পারিবারিক, ব্যক্তিগত হয়েও সমকালীন রাজনৈতিক বাতাবরণে বা পটভূমিতে আন্তসম্পর্কের আধুনিক উপন্যাসটির-বঙ্কিম রবীন্দ্র ও তিন বাড়ুয্যে সমৃদ্ধ কথাসাহিত্যের আকাশে স্বতন্ত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ফুটে উঠতে সময় লাগেনি।

জাগরী উপন্যাসে মতবাদের সংঘাত নয়, সংঘাত পরবর্তী পরিবারের সদস্যদের ভিতরের সম্পর্ক, যন্ত্রণা মুখ্য হয়ে ওঠে। আন্তঃসম্পর্কের স্বগতোক্তি আর আন্তযন্ত্রণার উপন্যাসে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত বাইরের বারান্দায় তক্তপোশহীন কাঠের চেয়ারেই নিশ্চল থাকে

‘জাগরী’ প্রকাশ আমাদের কথাসাহিত্যে এক আধুনিক, বিশিষ্ট জাগরণ। জাগরীর অভাবিত উৎকর্ষে চমকের কথা বললেন তারাশঙ্কর, ‘বইখানি পড়ে চমকে গেলাম। একেবারে নূতন কথা, নূতন সুর, নূতন সব মানুষের ভিড়, একেবারে সম্পূর্ণ নূতন মনোভাব। লেখকের অপরিচিত নাম, কিন্তু রচনার অভাবিত উৎকর্ষ। চমক লাগল’ (‘সতীনাথ ভাদুড়ী’, স্বস্তি মণ্ডল, ভারতীয় সাহিত্যকার গ্রন্থমালা)। অতুলচন্দ্র গুপ্তবাবুর কথা, ‘একেবারে ওস্তাদ লিখিয়ের লেখা। ...ফটোগ্রাফ নয়, নিপুণ শিল্পীর হাতের ছবি। দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাহিত্যের অজেয় কল্পনাকে উত্তীর্ণ হয়েছে’ (ঐ) বা ‘... চিত্র-কলায় জাগরীর লেখক যে দৃষ্টিশক্তি ও কুশলতার প্রমাণ দিয়েছেন, অকুণ্ঠচিত্তে বলতে পারি তা অসাধারণ। ...এর পূর্বে, বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক জেলের এমন সত্যকারের চিত্র আর আমরা পাইনি। মনে হয়েছে এ শুধু পূর্ণিয়া জেল নয়, বাংলারই কোনো জেল। জেলের প্রত্যেক মানুষ ও নিয়ম এমনি আমাদের অভিজ্ঞতায় বাস্তব’ (গোপাল হালদার, সতীনাথ গ্রন্থাবলী-১)। অতি সংক্ষেপে মহাজন মনীষীদের এমন উদ্ধৃতি শুধু প্রসঙ্গে যাওয়ার ভণিতা বা ভূমিকা মাত্র। এই ভণিতার শেষে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করা জরুরি। ভবিষ্যৎ-কথাবিস্তারে তাঁর বাণীবচন আমাদের অনেকটা সমর্থন যোগাবে। ঔপন্যাসিকের মানসোৎকর্ষ বা কোয়ালিটি অব্ মাইন্ড-এর খোঁজে তিনি দেখেছেন ‘সতীনাথের মধ্যে ছিল সেই উচ্চাঙ্গের মানসিকতা, অভিজ্ঞতাকে যে অনাসক্ত জীবন ভাষ্যের রূপ দিতে পারেন’ (বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ, কলকাতা)। তিনি বলেন, ‘সতীনাথই বোধকরি শেষ মননদীপ্ত লেখক যিনি কলকাতা এবং কলকাতাইয়া মধ্যবিত্তকে তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেননি। অথচ সব দিক দিয়ে তিনি আধুনিকেরও আধুনিক’ (্ঐ)। ‘জাগরী’ উপন্যাসে শুধু নয়, আজন্ম আবাস বিহারের জনপদকে সতীনাথ তাঁর সমস্ত উপন্যাসেই ব্যবহার করেছেন। ‘জাগরী’ (১৯৪৫)-এর পর চিত্রগুপ্তের ফাইল (১৯৪৯), ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’ (প্রথম চরণ, ১৯৪৯; দ্বিতীয় চরণ, ১৯৫১), ‘অচিন রাগিণী’ (১৯৫৪), ‘সংকট’ (১৯৫৭), ‘দিগ্ভ্রান্তি’ (১৯৬৬) উপন্যাসসহ তাঁর গল্পেরও জনপদ ওই পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার বাইরে বিহারের জনমানুষ ও জনপদের সমস্তটুকু হলেও স্থান-কাল পাত্রের সীমা অতিক্রম করে তাঁর সৃষ্টি আঞ্চলিক না হয়ে ভারতীয় ও সার্বজনীন হয়ে ওঠে। অন্য দিকে তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের বিষয় বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ‘তাঁর আধুনিক জীবন-সচেতনতা ও বিষয়-অনুধাবনের অন্তহীন ফল’ (্ঐ)। সরোজবাবু বলছেন, ‘বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে এ-বিষয়ে তিনি একমাত্র রবীন্দ্রনাথের কাছেই দ্বিতীয়’ (্ঐ)। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসের আধুনিক স্বরূপ ও স্বতন্ত্রতার কথা-বিস্তারের আগে খুব সংক্ষেপে একটি সাধারণ কাঠামোয় গল্পটি উপস্থিত করে দিলে ভালো হয়।

বিহার প্রদেশের পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতা স্থানীয় সরকারি স্কুলের হেডমাস্টার, যিনি মাস্টারসাহেব হিসেবে পরিচিত। বড় ছেলে বিলু, ছোট নীলু, তাদের মাকে নিয়ে তিনি গান্ধী আশ্রমে বসবাস করতে থাকেন গান্ধীর আহ্বানে চাকরি থেকে ইস্তেফা দেয়ার পর। বিলু নীলু দু’জনই প্রথম দিকে বাবার আদর্শে গান্ধী ও কংগ্রেসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও পরে দু’জনই প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণ করে মূল কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে ফেলে। বিলু কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য হলে নীলু দাদাকে অনুসরণ করলেও পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। ‘জাগরী’ উপন্যাস শুরু হয় এই বিলুর আত্মকথন দিয়ে। পূর্ণিয়া সেন্ট্রাল জেলের এক রাত্রির ঘটনাই পুরো জাগরী উপন্যাস। সময়টা ১৯৪৩ সালের মে মাসের একটি রাতের কথা। এই রাত শেষ হতে হতে আগস্ট আন্দোলনে নানাবিধ ধ্বংসাত্মক কাজের কথিত অপরাধে বিশেষ করে রেললাইন উৎপাটনের দায়ে ফাঁসিদণ্ডে দণ্ডিত বিলুর ফাঁসি হয়ে যাবে। এক নম্বর ফাঁসি-সেলে বসে জেলের সহবন্দিদের সহানুভূতি ও সকাতর নানা আচরণের ভিতর নিজের জীবন রাজনীতি দর্শন নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা আর আত্মসমালোচনায় ডুবে ফাঁসি মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করে। জাগরীর এই অধ্যায়ের নাম ‘ফাঁসি সেল’। চার অধ্যায়ের উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আপার ডিভিশন ওয়ার্ড : বাবা।’ গান্ধীভক্ত আদর্শবাদী সৎ মাস্টার সাহেবও বিলুর মতো সহবন্দিদের সকাতর সহানুভূতি, প্রার্থনাসঙ্গীত ইত্যাদির মাঝেও ছেলেদের সঙ্গে, বিশেষ করে বিলুর সঙ্গে সম্পর্ক, দুই ছেলে সম্পর্কে তাঁর ধারণা, স্মৃতি, কংগ্রেস ও সোশ্যালিস্টদের রাজনৈতিক ও দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসা এবং পুত্র বিয়োগের গভীর বেদনা নিয়ে রাত কাটায়।

তৃতীয় অধ্যায় ‘আওরৎ কিতা : মা’-য় বিলুর মা একইভাবে বিলুর এই করুণ পরিণতি দেখে গভীর যন্ত্রণায় আত্ম-আহাজারি করে সময় পার করে। কত স্মৃতি দুই ছেলেকে ঘিরে, কত কথা, শাশ্বত জননীর সকল অনুভূতি নিয়ে বিলুর জন্য শোকাক্রান্ত হলেও বাইরে তেমন প্রকাশ নেই। জেলের সকলের সে মা, কিন্তু তার শাশ্বত মাতৃসত্তা বলে, না আমি সবার মা হতে চাই না, আমি শুধু বিলু নীলুর মা। একই জেলে তিন ওয়ার্ডে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত ছেলে, বাবা এবং মা।

ছোট ছেলে নীলু উপন্যাসের শেষ অধ্যায় ‘জেলগেট : নীলু’। জেলেগেটে সারারাত জেগে নীলু অপেক্ষা করে দাদা বিলুর মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই অপক্ষোর মুহূর্তে সে রাত্রির জেল পরিবেশের দর্শক হয়েও গভীর আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন থাকে। নিজের রাজনীতির স্বরূপের সঙ্গে দাদার রাজনীতি, তার আপন দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ায় দাদার ফাঁসির আদেশ চূড়ান্ত হওয়ার ঘটনায় নিজের আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান খতিয়ে দেখে। এমন নিমগ্ন আত্মগত বোঝাপড়ার মধ্যে রাত্রি শেষ হওয়ার মুহূর্তে নীলু প্রথম জানতে পারে সরকারের আদেশ মতে বিলুর ফাঁসির আদেশ আরও দুই তিন দিন আগেই স্থগিত হয়ে গেছে। ওই দিন ভোরে তিন নম্বর সেলের অন্য একজন আসামীর ফাঁসি কার্যকর হবে। বিলুকে এক নম্বর সেল থেকে না সরানোর জন্য জেলের কেউ তা অবগত ছিল না। আড়াই শতাধিক পৃষ্ঠার ‘জাগরী’ উপন্যাসের এই সংক্ষিপ্ত বয়ানে শুধু গল্পের একটি অবয়ব চিহ্নিত হলেও এর অভিনব স্টাইলটি দেখবার মতো।

জাগরী উপন্যাসে যেমন প্রচলিত ধারায় শুধু গল্পই ফেনিয়ে ওঠে না, তেমন এর নির্মাণ কোনো প্রথাগত প্লটের ভিতর সীমায়িত নয়। চরিত্র এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও কাহিনীর কার্যকারণ সূত্রে উপন্যাসের চিরাচরিত প্রথায় প্লটের গণ্ডি তৈরি হয় না। আবার প্লটের ভিতর নিহিত থাকে যে ‘মানবিক তাৎপর্য’ জাগরীতে তা অনুপস্থিত নয়। প্রথাসম্মত না হলেও একরকম প্লট তৈরি হয় বৈকি।

রাজনৈতিক পরিবারের চারজন সদস্যই জেলবন্দি। নিরন্তর চৈতন্য প্রবাহের সূক্ষ্ম বুননে প্রতিটি ব্যক্তিই ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হয়। নীলু একসময় দাদার সঙ্গে হাজত বাস করেছে। আইন অমান্য আগস্ট আন্দোলনের এক পর্যায়ে সতীনাথ জেলবন্দি হয়ে জেলের অভিজ্ঞতা ও আধারকে ব্যবহার করে জাগরী লিখতে শুরু করলেও জেলের অনুপুঙ্খ বিবরণ, অত্যাচার অনাচারের কাহিনী আর নিজের আদর্শের সোচ্চার ভাষণ, আবেগ আর দ্বেষ মিলিয়ে রচনার পথে গেলেন না। সেই সময়কালে সতীনাথ কংগ্রেসের জেলা কমিটির নেতা হয়েও বেছে নিলেন এমন একটি প্রধান চরিত্র বিলু যার গান্ধীবাদে বিশ্বাস নেই, এমনকি বিলুর নিজের আদর্শ পার্টির আদর্শ নিয়েও বড় কথা নয়, কথনশৈলীতে আত্মকথন, স্মৃতি রোমন্থন, স্মৃতিরই অসংলগ্ন পরম্পরা ও গভীর অনুভূতিময় অভিব্যক্তি মাত্র। রাত পোহালেই ফাঁসি! মৃত্যু ভয় মৃত্যু উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে জীবনের প্রতি আকাক্সক্ষা, কিন্তু কণ্ঠস্বর অতি নিম্ন। বাহুল্যবর্জিত, পরিমিত আবেগ, যুক্তি ও বাস্তববোধের যে পরিচয় মেলে তা শুধু বিলুর ক্ষেত্রেই নয়, বাবা মা ছোটভাই সবার মধ্যেই দেখা যায় চরিত্রানুগ অভাবিত নিয়ন্ত্রণ। বাতাবরণে যে বিশাল রাজনৈতিক প্রবাহ, দ্বন্দ্ব তার শুধু মন্থনটুকু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্মৃতি ও আত্মকথনে মিশে থাকে। তথাকথিত চরিত্র নির্মাণ নয়, এখানে ব্যক্তি অস্তিত্ব স্বরূপে বাক্সময়।

সতীনাথ তৃতীয়বার জেলে যাবার দিন ৫/৬ আগে ’৪২-এর ৯ আগস্ট গান্ধীসহ বড় বড় নেতা গ্রেফতার হয়ে যান। দেশজুড়ে প্রতিবাদ, স্লোগানমুখর- ‘মহাত্মাজির গ্রেফতার, হো যাও তৈয়ার’। বিহার-পূর্ণিয়াও তখন অগ্নিগর্ভ। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের বিরুদ্ধে শ্রেণী ও পার্টি নির্বিশেষে আন্দোলন মুখর, সতীনাথ স্বয়ং ১২ আগস্ট তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ থেকে ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারেও আইন অমান্য, কর্মবিরতি পালন, জেল ভেঙে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। জাগরী উপন্যাসে বিলু বা অন্য কোনো নেতার এমন অসহযোগিতার বিবরণ নেই, পুলিশের লাঠিচার্জে সতীনাথ ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু জাগরীতে চরিত্রগুলোর আত্মকথনের ভিতর দিয়ে ব্যক্তির এবং ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব সংঘাতের এমন এক জাগৃতির বিশ্বাসযোগ্য প্রকাশ ঘটে যেখানে শারীরিক আঘাত বা জেলকর্মীদের আচরণের কথা হয়তো তিনি তুচ্ছ মনে করেন। জেলে এবং বাইরে ওই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণ, গঙ্গাশরণ সিং, এবং বিহারের আরও সোশ্যালিস্টদের সংস্পর্শে সতীনাথ আসেন। মার্ক্স্বাদ ও প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ শুধু তাঁর ভালভাবে পড়াই ছিল না, তিনি প্রাঞ্জল করে তা বোঝাতেও পারতেন। তো জেলে বসে উপন্যাস লিখতে যেয়ে কল্পনায় সৃষ্ট বিলুকে তিনি সোশ্যালিস্ট বানালেন। উল্লেখ্য, ’৪৭-এর দেশ স্বাধীনতার পর ’৪৮-এ তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে সোশ্যালিস্ট পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। কেন তিনি ক্ষমতাসীন নিজ দল থেকে পদত্যাগ করলেন, সতীনাথের সাফ উত্তর, ‘কংগ্রেসের কাজ ছিল স্বাধীনতা লাভ করা। সে-কাজ হাসিল হয়ে গেছে, রাজকাজ ছাড়া কোনো কাজ নেই আর।’ এ হয়তো নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিকের গভীর অভিমান। ওই সময়ে লেখা ‘গণনায়ক’ গল্পে কংগ্রেস বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বেশ স্পষ্ট হয়। দেশের স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের অভ্যন্তরে স্বার্থসংঘাত দেখে তিনি বিরূপ হয়েছিলেন, গণনায়ক চরিত্রটি তার স্মারক- ‘একটি খদ্দরের টুপি আগেই কিনে রাখলে বোধহয় আরেকটু সুবিধে হতো, হয়তো হিসেবে ভুল হয়ে গেছে’ (গণনায়াক)। কংগ্রেসের সংকট দুর্বলতা এবং অন্ত্যজদের জন্য করবার ক্ষমতা ও ইচ্ছা সম্পর্কে বুর্জোয়া, পেটি ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার পার্টি কংগ্রেস সম্পর্কে সংবেদনশীল সতীনাথের ধারণা দিনে দিনে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। অগ্রসর চিন্তার রাজনৈতিক কর্মী বিলু সহজেই তাঁর প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনপ্রিয় কংগ্রেসী বিলুর বাবা ‘মাস্টারসাহেব’ সমাজতন্ত্রীদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা, বিলুর রাজনীতির প্রতি উদাসীনতা এ-সবের মধ্যে কংগ্রেসকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দেখিয়ে দেন কোনো নেতিবাচক মন্তব্য বা উষ্মা প্রকাশ না করেই। উপরন্তু ‘জাগরী’তে মাস্টারসাহেবের প্রতি একরকম শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিই তৈরি হয়। তৈরি হয় তার কারণ সতীনাথের সংযমী, নির্মোহ আধুনিক ভঙ্গি ছাড়াও হয়তো কাজ করে শোকাতুর পিতার প্রতি স্বাভাবিক আবেগ। নীলু তার পার্টির এবং নিজের কৃতকর্মের পক্ষেই যুক্তি খোঁজে, দাদা বিলুর দলের ত্রুটি সম্পর্কে সে পুরো নিশ্চিত। একদিকে দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে ফাঁসির শাস্তিকে ত্বরান্বিত করার পক্ষে সে একান্ত নিজের মনে, আত্মগত কথনেও মনে করে ‘পৃথিবীসুদ্ধ লোকের ভুল হইতে পারে, আমার ভুল হয় নাই। সেই ১৯৪২-এর আগস্টের ঘটনাসমূহের পরিবেশে আমার কার্যের বিচার করিতে হইবে’ (জাগরী, জেলগেট : নীলু)। অন্যদিকে আগস্ট আন্দোলনের সময়ের যে ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে নিজেই বর্ণনা করে শেষে বলছে, ‘হোলির দিন গ্রামসুদ্ধ লোক নেশা করিয়া যেইরূপ হইয়া যায়, ইহারাও ঠিক সেইরূপ। এই অধীর উত্তেজনাকেই দাদার দল বলে বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল, ইহাই ক্রান্তির প্রচেষ্টা। ... এই ধরনের নেতৃত্বে এইরূপ সংগঠনে এইরূপ সময়ে হইবে ক্রান্তি? ... কে এ-কথা দাদাদের বুঝাইত? আমি কিছুতেই অন্যায় করি নাই। আমার কর্তব্য করিয়াছি মাত্র। আর আমি সাক্ষ্য না দিলেও অন্য লোক দিত। গভর্নমেন্টের লোকের অভাব নাই। তফাতের মধ্যে আমি দিয়াছি নিজের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য ও কর্তব্যের খাতিরে; আর অন্য লোক দিত লোভে পড়িয়া’ (ঐ)। সতীনাথ সূক্ষ্ম কৌশলে দেখান চপলমতি, অল্পেই উত্তেজিত নীলুর এই সাফাই বয়ানের মাধ্যমে অপরাধের বোঝা ও অন্যদের নিন্দনীয় দৃষ্টির চাপ লাঘব করার চেষ্টা, আত্মপ্রবোধ, অন্যদিকে আগস্ট আন্দোলনকে নীলুর কমিউনিস্ট পার্টি তখন যেমন মনে করেছিল- এই আন্দোলন ফ্যাসিবাদী শক্তিকেই মজবুত করবে তার পরোক্ষ সমালোচনাও প্রকাশ হয়ে যায়। বিলুর মতো শ্রমিক ফ্রন্টের নেতার বিরুদ্ধে বৃটিশের আদালতে সাক্ষ্য প্রদান নিন্দনীয় রাজনীতিই বটে।

নীলু আত্মপ্রবোধের চেষ্টায় বারবার চেয়েছে তার কথা, অবস্থান বিলুকে বোঝাতে কিন্তু বিলু গভীরে নীলুর এই আচরণে কষ্ট পেলেও যেমন নীলুর যুক্তি শোনার প্রয়োজন মনে করে না তেমন নীলুকে সে প্রকাশ্যে কেন অন্তরেও অপরাধী মনে করে না, কষ্ট হয়তো হয়। সতীনাথের নিজের রাজনৈতিক দর্শন ও ব্যক্তিত্বের অনুরূপ বিলু ভাবে, নীলু ওর অবস্থান থেকে হয়তো ঠিকই করেছে। ওকে দোষ দিতে পারে না, অপ্রকাশ্যে যেন ওর রাজনীতিই এর জন্য দায়ী হয়ে যায়। নীলু বলতে চাইলেই বিলু সব শুনবে না, প্রয়োজন নেই, নীলু ঠিক জানে, শুনলেও... ‘দাদা নীরবে ধৈর্যের সহিত তাহা শুনিয়া মধ্যে মধ্যে অল্প হাসিত। হয়তো বা এক আধটি এমন কথা বলিত, যাহাতে আমার যুক্তিস্রোত ঘোলাটে হইয়া যাইত। ঐ মৃদু হাসিতে বাঁ গালে টোল পড়িলেই, আমি বুঝিতে পারি যে আমার আপাততীক্ষè যুক্তি, উহার দৃঢ় বিচারশক্তির উপর সামান্য দাগও কাটিতে পারে নাই। হাসিটি আমাকে পরাস্ত করিবার জন্য নয়; উহা কেবল আমাকে নিরস্ত করিবার জন্য’ (জাগরী)। নীলুর এমন রাত্রি জোড়া আত্মপ্রবোধ আত্মকথনে দাদার জন্য তার ভালবাসা, শ্রদ্ধা, হাহাকার ধীরে পাঠকের মনেও সঞ্চার হয়। নিজের যুক্তিমতে ঠিক কাজটি করলেও নীলু জানে এর জন্য দাদার ফাঁসি, মা-বাবার কাছে তার মুখ দেখাবার সুযোগ থাকবে না, সমাজের কাছে সে নিন্দনীয়। উপন্যাসের শেষে বিলুর ফাঁসি স্থগিত হলে পাঠক হয়তো একবার নীলুর জন্যও স্বস্তি বোধ করে। কারণ নীলুর অনুতাপও খুব দুর্বোধ্য থাকে না। নীলু যতই নিজেকে বলুক, বিলু দাদার ‘পার্টির প্রোগ্রাম কার্যকরী করার অর্থই পরোক্ষে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে দৃঢ় করা ইহা কি দাদা বুঝে নাই?’ কিন্তু সকল যুক্তিকে পরাস্ত করিয়া অন্তরের ভিতর কোথায় যেন খচখচ করিয়া কী একটা বিঁধিতেছে’ (্ঐ)। অন্তরে এই যন্ত্রণার কাঁটা পাঠক হৃদয়েও অবচেতনেই হয়তো বিঁধে।

মাস্টারসাহেব তাঁর ব্যক্তিত্ব আদর্শ সম্পর্কের অভ্যাসগত ধরন উপেক্ষা করে একই জেলে হলেও একবারের জন্যও তিনি ছেলের কাছে যেতে পারেন না। অনেকবার তাঁর ইচ্ছা হয়, এই শেষ রাতটা ছেলের কাছে থাকে, শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে, কিন্তু তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাৎসল্য বোধ, অকৃত্রিম আবেগ বোধ করলেও তা সকলের সামনে প্রকাশ করতে তিনি পারেন না, এমন সরল ভাবপ্রবণতা হয়তো কষ্ট আরও বাড়াবে। সহবন্দিদের প্রার্থনা, গীত, চরকাটাতেও মনোযোগ দিতে পারেন না। মন একদিকে ছেলের কাছে, অন্যদিকে রাজনীতি-সমালোচনা আত্ম-সমালোচনায় বিভোর থাকে, কোনো ভাব সঙ্গীতেই তাঁর মন বসে না, বরং সকলে তাঁর সামনে থেকে সরে পড়লেই একা নিজেকে আরও বেশি পান। বিলুর শিশু-কৈশোর-যৌবনের স্মৃতি, বেড়ে ওঠা নীলুর ভূমিকা নিয়ে বারবার খতিয়ে দেখতে পারেন এবং এই একান্ত মুহূর্তেও ছেলেদের কংগ্রেস ছেড়ে সোশ্যালিস্ট হওয়া তাঁর কাছে অবোধ্য ঠেকে। চরখায় সুতা কাটার মধ্যে প্রতীকীভাবে হলেও তিনি ভারতের মুক্তি দেখতেন। গান্ধী ও চরখার প্রতি তাঁর আবেগ ও আস্থা, পুত্রদের প্রতি স্নেহের থেকেও যেন বেশি,- ‘একসঙ্গে অনেকগুলি চরখার নানারকম শব্দ শুনিতে ভারি ভাল লাগে। ... মনে পড়াইয়া দেয় যে সোনার ভারত গড়িয়া তুলিবার পথে আমি একলা পথিক নই। ইহা তো কেবল এত গজ এত হাত সুতা কাটা মাত্র নয়। এখন যে চরখার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছে, ইহা যে রামরাজ্য ফিরাইয়া আনিবার একমাত্র অস্ত্র। রামরাজ্য হইবে প্রেমের রাজ্য, গৌরাঙ্গের রাজ্য; লোকে হিংসা দ্বেষ ভুলিবে’ (জাগরী, আপার ডিভিশন ওয়ার্ড : বাবা)। এরকম রোমান্টিক ভাবালু স্বপ্নচারী মাস্টারসাহেব চরখা নিয়ে সামান্য কৌতুকও সহ্য করতে পারেন না। জেলের ভিতর তাঁর ও সঙ্গীদের চরখা কাটা দেশসেবায় নিয়োজিত থাকারই নামান্তর। পাশের সিটের অন্য কারও চরখা ঘুরানো একই মাত্রায় ধর্ম ব্রত মনে নাও হতে পারে। ‘ডানদিকের একটি সিট হইতে চরখার শব্দের নকল করিয়া একজন মুখ দিয়া শব্দ করিতে আরম্ভ করিল, আর দুই তিনজন হাসিয়া উঠিল। সুখলাল না হইলে আর কে হইবে? না, সুখলাল নয়, কমরেড সুখলাল!’ (্ঐ)। বিলুর রাজনীতির সমর্থক এ কমরেডের কথা বলতে মাস্টারসাহেবের কণ্ঠে কেমন শেষ ঝরে পড়ে। ছেলেরা, বিশেষ করে নীলু বাবার অতি কংগ্রেস বা গান্ধী ভক্তিকে ঠেস দিতে ছাড়ে না। ‘আওরাত ফিতা : মা’ অধ্যায়ে মা এমন এক পারিবারিক ক্রান্তিকালে নীলু বিলুর স্মৃতিচারণ মুহূর্তে মনে করে নীলুর এমন দুষ্টুমির কথা- ‘... ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসে। লঘুগুরুর জ্ঞান ওর একটুও নেই। নিজের খেয়ালে উন্মত্ত। একদিন করেছে কী, এই বড় হয়ে, ছারপোকা মেরে মেরে তার রক্ত দিয়ে সাইনবোর্ডের মতো লিখেছে- অহিংসা পরমোধর্ম- আমি তো বুঝি কাকে ঠেস দিয়ে এ লেখা।’

অভিনব আঙ্গিকের ভিতর পরিবারের চার সদস্যেরই বিশিষ্ট ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যের গুণে নিজেদের ব্যক্তিত্বের বলয় তৈরি হয়, এই বলয়ের ঘেরের রাজনৈতিক পরিচয় দেয়া সম্ভব, হয়তো আছেও, কিন্তু অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতাদর্শ সামান্যই প্রবেশ অধিকার পায়

জেলের ভিতর শেষ প্রহরের অপেক্ষায় কত শত কথার মধ্যে যেমন বারবার নীলুর প্রসঙ্গ মনে হয় বিলুর, তেমনি তেত্রিশ বছর জীবনের কোনকিছুই না পাওয়ার, কোনো স্বপ্ন সাধ পূরণ না হওয়ার আক্ষেপও তার মনে জাগে। নীলুর কর্তব্যনিষ্ঠা, পার্টির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে নীলু ঠিক কাজই করেছে বলে মনে করলেও মনের ভিতর থেকে কষ্ট দূর হয় না বিলুর। ‘কোনো আত্মসম্মানশীল, সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মীর ইহা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু ইহা যুক্তির কথা। সুপ্ত চেতনা হয়তো ভাবে যে এ-যুক্তি কোর্টে চলিতে পারে, বই-এ ছাপার কালিতে ইহা দেখিতে ভাল, কিন্তু অন্যত্র ইহার স্থান নাই। ... নিজের পার্টির প্রতি একনিষ্ঠতা দেখাইবার জন্য সহোদর ভাইয়ের ফাঁসির পথ করিয়া দেওয়া হৃদয়ের সততার প্রমাণ না রুগ্ন মনের শুচিবায়ের পরিচয়?’ (জাগরী)। অর্থাৎ সতীনাথের বিলু নিরেট আদর্শবাদী অতিমানব মাত্র নয়, রক্ত, মাংস, হৃদয়ের মানুষ। বিলু শুধু কল্পনার অবাস্তব ফানুস, আদর্শে মোড়ানো শুষ্ক প্রাণী নয়। অনুভূতিপ্রবণ বিলুর মন কতভাবে নানা বৈপরীত্যে আলোড়িত হয়। জেলের সীমাবদ্ধ জগতের ভিতর রেলগাড়ির বাঁশির শব্দ উন্মুক্ত উদার পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগের সূত্র বলে মনে হয় তার। বিলুর সৌন্দর্যপ্রিয় মন বলে, ‘এত প্রাণ উদাস করা, মন উতলা করা বাঁশির স্বর কোনো বৈষ্ণব কবিও কোনদিন কল্পনা করিতে পারেন নাই। ... কোন্ অজ্ঞাত ইথারের কম্পন মনের অবরুদ্ধ তন্ত্রীকে এত তরঙ্গিত করে? চটকলের ভোরের ভেঁপু মজুর-বস্তিতে সাময়িক আলোড়ন জাগায় বটে, কিন্তু রেলের বাঁশি আনে প্রতিটি কয়েদী হৃদয়ে দ্রুততার স্পন্দন; প্রাণে জোগায় সুপ্ত মধুর স্মৃতি, রূপ দেয় কত ছায়াহীন আকুতি ও বাসনাকে।’ (জাগরী, ফাঁসি সেল)।

এই রাজনৈতিক পরিবারের অনুভূতিপ্রবণ মানুষগুলিকে বহিরঙ্গে আদর্শনিষ্ঠ শক্ত ধাতের মনে হলেও হৃদয়ে মানবিক সুর, জীবনের প্রতি, স্বজনের প্রতি প্রেম ও বিয়োগ যন্ত্রণার হাহাকার স্রোতও বয়ে যায়। বিলু যেমন প্রকাশ্যে নীলুর কোনো অপরাধ অন্যায় দেখতে পায় না, মনে করে নীলু ন্যায়নিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে ঠিকই করেছে, আবার অন্তরে মনের কোথায় যেন তা মেনে নিতেও পারে না, মনে হয় রুগ্ন মনের শুচিবায়। বাবা মাস্টারসাহেব একই জেলে থেকেও একবার ছেলেকে দেখতে যেতে পারেন না, ছেলের দল ও আদর্শের সমালোচনা করেন, অন্যদিকে নীলু নয় বিলুর দিকেই তাঁর পক্ষপাতিত্ব, বিলুর সেলে ছুটে যেতে চান, শেষ রাতটা অন্তত বিলুর সঙ্গে কাটাবার আকুতিতে দীর্ণ হয়। মা স্বামীর আদর্শে বন্দি হলেও সংগ্রেস গান্ধীই সবকিছু হলেও, কংগ্রেসীদের মা হয়ে উঠলেও তাঁর মন হাহাকার করে ওঠে, প্রতিবাদ করে, আমি শুধু বিলু নীলুর মা হতে চাই। অন্তর ও বাইরের ভাবনাস্রোতের বৈপরীত্যে সমান্তরালভাবে কত সহজ আত্মকথনের ভিতর দিয়ে ধীরে ফুটে ওঠে মানবিক সম্পর্কের তাৎপর্য। কাহিনী ও চৈতন্য প্রবাহের এই আয়োজনের ভিতরই জাগরী উপন্যাসের প্লটের নতুনত্ব ও বিশিষ্টতা। পরিবারের আন্তঃসম্পর্কের মায়াজাল ও গূঢ় যন্ত্রণার বাস্তবনিষ্ঠ প্রকাশ ও পাঠকের মনে তার আলোড়ন সঞ্চারের সাফল্যে শেষ পর্যন্ত মনে হয় ব্যক্তি ও মানব সম্পর্কের এই মহৎ রচনাটিকে রাজনৈতিক উপন্যাস বললে এর আন্তরশক্তিকে খর্ব করেই দেখানো হয়। বহিরঙ্গে রাজনৈতিক বাতাবরণের প্রবল উপস্থিত সত্ত্বেও রাজনৈতিক উপন্যাস হয়ে ওঠে না। জাগরী উপন্যাসের এমন অভিনব চিত্তগ্রাহী চরিত্রের আন্তঃসম্পর্কের বাস্তবনিষ্ঠ কাহিনীর প্রয়োজনেই ওই রাজনৈতিক অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। এর স্রষ্টা সতীনাথ স্বয়ং একজন রাজনীতির লোক বলেই হয়তো রাজনীতির এই সহজ ব্যবহার।

জাগরী উপন্যাসের ভরকেন্দ্রে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ, চিন্তা এবং প্রস্তাবনা নেই, কোনো রাজনৈতিক জিজ্ঞাসায় আলোড়িত করে না। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে যেমন স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, যৌক্তিকতা, পরিণতি নিয়ে উপন্যাসের কাহিনী দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আবর্তিত হয়, সকল পক্ষ স্পষ্টই থাকে, ‘আনন্দমঠ’-এও প্রবল পক্ষ বিপক্ষ এবং রাজনৈতিক বিতর্কে উপন্যাস তৈরি হতে থাকে বা ‘মা’ উপন্যাসে মা ও পাভেলের একটি বিশেষ আদর্শের প্রতি আবেগ, ভালবাসা, প্রচার এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই আর নির্যাতনের কাহিনী ঘিরে সম্পন্ন হয় এবং রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। জাগরী উপন্যাস সেখানে পরিবারের চারজন সদস্যের আত্মসম্পর্ক ও যন্ত্রণার আত্মকথন মাত্র। জাগরীকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে পাঠ করা গেলে এর গঠনশৈলীতে মারাত্মক ত্রুটি মূর্ত হয়ে উঠবে। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সভ্য নীলুর ভূমিকাতে সতীনাথ কতটা রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত দেখেছেন! বিলু বাবা মা’র আত্মকথনে এবং নীলু পর্বে নীলুর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, তাতে এই রকম সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিতে পারে। আর বিলু একবার বলেছেও, ‘নীলু কখনো তার নিজের অবস্থান থেকে এক পা’ও সরে আসবে না।’ নীলুও তার সিদ্ধান্ত শতকরা শতভাগ ঠিক বলেই জানে। পার্টির দোহাই সে দেয়নি। আর এটি পার্টির সিদ্ধান্ত হতে হলে কিছু বিবেচনার প্রশ্ন থাকে, কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার কথা সতীনাথ ভাল করেই জানেন। অন্যদিকে বিলুর যে রাজনৈতিক অবস্থান ও পরিচয় তারও কি পর্যাপ্ত বিবরণ আছে! আজন্ম গান্ধীভক্ত পরিবারের ছেলে, নিজেও কংগ্রেসী ছিল, কোন্ প্রেক্ষাপটে কেন সোশ্যালিস্ট হয়ে গেল, এইসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তরের অভাবেও জাগরীকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে গ্রহণ করতে বাধে। বিশিষ্ট আলোচক নীরেন্দ্রনাথ রায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘বিলুর মতো স্থিতধী ব্যক্তি মার্কস্বাদ পরিপূর্ণ আয়ত্ত করার পরও এমন আত্মকেন্দ্রিক রহিল, কী করিয়া? নীলুর আচরণের প্রতি তাহার যে অনুকম্পা, সেও আনুষ্ঠানিক গান্ধীবাদের খানিকটা সচেতন খানিকটা অবচেতন বাহ্য বিনয়ের নামান্তর’ (সতীনাথ গ্রন্থাবলী-১)। অর্থাৎ নীরেন্দ্রবাবু রাজনৈতিক উপন্যাসের এই ‘গুরুতর ত্রুটি’ তুলে ধরে সমালোচনার প্রয়াস পেলেন। কিন্তু সতীনাথের জাগরী উপন্যাসে রাজনৈতিক পরিম-লের নীলু বিলুর চরিত্র দুটি পার্টি বা কোনো মতাদর্শের প্রচারক, স্মারক বা তত সমালোচক হয়ে ওঠে না, বরং পরিবারকে ঘিরে (রাষ্ট্র বা সমাজকে নিয়ে নয়) নানা স্মৃতি, ঘটনা, কলহ, আনন্দের কথা নিজের মনে মনে আওড়ে যায়, রাজনীতির কথা যেখানে সামান্যই। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীর প্রসঙ্গ প্রায় অনুপস্থিতই থাকে। বিলু নীলু এখানে যতটা পরিবারের ব্যক্তি স্বরূপে উপস্থিত তা আত্মকেন্দ্রিক বা সমষ্টিক হোক না কেন, যতটা তারা ব্যক্তিগত তার সামান্যও তারা দলীয় নয়। জেলগেটে ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য সারারাত্রি নীলুর অপেক্ষা শুধু ব্যক্তি সম্পর্কের ওপরই দাঁড়িয়ে, অন্যকিছু নয়। অন্তর্গূঢ় যন্ত্রণার চাপ ও আবহ উপন্যাস ঘিরে তৈরি হয় যেভাবে সেখানেই বা রাজনীতির হাত পা কোথায়!

অভিনব আঙ্গিকের ভিতর পরিবারের চার সদস্যেরই বিশিষ্ট ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যের গুণে নিজেদের ব্যক্তিত্বের বলয় তৈরি হয়, এই বলয়ের ঘেরের রাজনৈতিক পরিচয় দেয়া সম্ভব, হয়তো আছেও, কিন্তু অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতাদর্শ সামান্যই প্রবেশ অধিকার পায়। চারজন মানুষের স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে সতীনাথের প্রথম উপন্যাস, বাংলায়ও এমন আঙ্গিকের প্রথম সৃষ্টি গড়ে ওঠে। স্বগতোক্তির কথনভঙ্গিও একটি বিশিষ্ট ধরনের সাধুরূপ হলেও নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার মতো ভাষা ও শব্দ চয়ন, সাধু হলেও পোশাকি হয়ে ওঠে না। ভঙ্গিটি খুব ব্যক্তিগত ও আন্তরিক, এমন ভঙ্গিতে সমষ্টির লক্ষ্যের রাজনীতিসর্বস্ব রচনা নির্মাণ যথাযথ হতো না। জাগরীর প্রথম সংস্করণের ভূমিকাতেও সতীনাথ জানিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক পটভূমিকায় একটি পরিবারের কাহিনীর কথা, ‘রাজনৈতিক জাগৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। এই আলোড়নের তরঙ্গবিক্ষোভ কোনো কোনো স্থলে পারিবারিক জীবনের ভিত্তিতেও আঘাত করিতেছে। এইরূপ একটি কাহিনী পরিবারের কাহিনী।’ এ-কথাও অসত্য নয়, যে লেখকেরা নিজেদের লেখার বিচারক নন। ‘লেখকেরা কি নিজেদের লেখার প্রকৃতি সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন? মনে হয় না। সতীনাথ নিজে তাঁর পরিচায়িকায় লিখেছেন, “... গল্পটি ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের পটভূমিকায় পড়িতে হইবে।” এর থেকে বোঝা যায় পিতামাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বিচারক নয়। প্রকৃতপক্ষে জাগরী-তে উপাদান হিসেবে রাজনীতি আছে। কিন্তু ওটা বাহ্য, পাঠককে উপন্যাসটির প্রাণকেন্দ্রের জন্য অন্যত্র সন্ধান করতে হবে’ (বাংলা উপন্যাসের শিল্পাঙ্গিক, গুণময় মান্না, ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা)। জাগরী উপন্যাসে মতবাদের সংঘাত নয়, সংঘাত পরবর্তী পরিবারের সদস্যদের ভিতরের সম্পর্ক, যন্ত্রণা মুখ্য হয়ে ওঠে। আন্তঃসম্পর্কের স্বগতোক্তি আর আন্তযন্ত্রণার উপন্যাসে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত বাইরের বারান্দায় তক্তপোশহীন কাঠের চেয়ারেই নিশ্চল থাকে। ভারতের রাজনৈতিক তরঙ্গের পরিবর্তে ফুটে ওঠে পারিবারিক জীবনরস।

রাজনীতি একটি আধার মাত্র, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘আসল আধেয় হল জীবনরস। নীলু-বিলু-বাবা-মায়ের অন্তর্গত কথনের মাধ্যমে ভাবরীতি দু’য়ের দিক থেকেই জাগরী সেই সুপরিণত জীবনরস বোধে সাক্ষ্য দেয়।’

সতীনাথের আধুনিক জীবন-সচেতনতা, নিয়ন্ত্রিত আবেগ এবং নিরাসক্ত অভিব্যক্তি জাগরী উপন্যাসকে আধুনিক উপন্যাসের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

tab

সাময়িকী

রাজনীতির জাগরী নয়, আন্তঃসম্পর্কের আত্মকথন

সাদ কামালী

সতীনাথ ভাদুড়ী

বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কেবল শেষ হলেও বাতাসে তীব্র বারুদ পোড়া গন্ধ, রেডিয়েশন, আর্ত হাহাকার আর বিশ্ব রাজনীতিকগণ তুমুল কূটনৈতিক তৎপরতায় সরব, তখন, ১৯৪৫-এর ৪ অক্টোবর, প্রকাশিত হলো সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম গ্রন্থ ‘জাগরী’ উপন্যাস। এর ঠিক তিন বছর আগে, পরাধীন ভারতের নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের চলমান অস্থিরতার ভিতর আইন অমান্য আগস্ট আন্দোলন বিহার প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল মারাত্মকভাবে। সেই ১৯৪২-এর ১৫ বা ১৬ আগস্ট উত্তর-বিহার থেকে সতীনাথ ভাদুড়ীসহ আটজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ভারত রক্ষা আইনের ১২৯ (১) অ ধারায় গ্রেফতার হন। পুলিশের খাতায় তখন সতীনাথের পরিচয় ছিল এমন- ‘... Sri Satinath Bhaduri, a practising Lawyer, ex-Secretary of the District Congress Committee...’। বিহারের পূর্ণিয়া জেলে আটক হওয়ার সময় তাঁর নামমাত্র সাহিত্যিক পরিচয়ও ছিল না। গ্রন্থপ্রকাশ তো দূরের কথা, মফস্বলের সাহিত্যপত্রেও তাঁর প্রকাশিত গল্প-রচনার খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে জেলে বন্দি হওয়ার সময় সরকারিভাবে ‘বী’ হলেও পূর্ণিয়া কংগ্রেসের জেলা-সংগঠনের ভার তখন ছিল সতীনাথের ওপর। পূর্ণিয়া জেলপ্রাচীরের অন্তরালে বসেই কথ্য ভঙ্গিতে ডায়েরির মতো কিছু লিখতে শুরু করেন, কেউ কেউ তো প্রথমে ডায়েরিই ভেবেছিল। অনুজপ্রতিম হিন্দি কথাসাহিত্যিক বন্ধু ফণীশ্বরনাথ রেণু স্মৃতিচারণ করছেন, ‘একদিন ওর ডিগ্রিতে বসে চা খাচ্ছিলাম। সামনে একটা খাতা ছিল। হাতে নিয়ে পাতা খুলে দেখি লেড্পেন্সিল দিয়ে লেখা। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হলো, এ তো ডায়েরি! খাতা বন্ধ করে রেখে দেবার সময় বললাম- ডায়েরি বুঝি? প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন- কেন? ডায়েরি পড়তে নেই বুঝি? ... বললেন- চারপাতা যখন পড়েই ফেলেছ বাকি পৃষ্ঠাগুলি পড়ে নাও। ... চার মাস পরে নীলুর অধ্যায় অর্থাৎ অন্তিম অধ্যায় পড়ে ... ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ে হাত দিতে দিতে বলেছিলাম- আজকে আপনি বারণ করলেও কিছু শুনব না, পায়ের ধুলো দিন (সতীনাথ স্মরণে : ‘ভাদুড়ীজী’ শ্রী সুবল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত)। অন্তর্গত কথনশৈলীতে নির্মিত অন্তগূঢ় যন্ত্রণার অভিনব উপন্যাস ‘জাগরী’র এই হলো শুরুর কথা।

বন্ধুদের সহযোগিতায় ১৯৪৫-এর ৪ অক্টোবর সমবায় পাবলিশার্স থেকে উপন্যাসটি বের হলেও তার চেহারাটি ছিল বলবার মতো : ছাপার ভুলে ভরা, প্যাকিং কাগজের মতো লালচে কাগজ, সস্তা পিজবোর্ডের মলাটে অচেনা অজানা লেখকের ‘জাগরী’ নামের উপন্যাসটি বইবাজারে এলো। যদিও ছাপার দৈন্য আর উপেক্ষার শেষ নেই, মলাটের ওপর লেখকের বা উপন্যাসের নামটি পর্যন্ত মুদ্রিত ছিল না, জীবনরসে জারিত পারিবারিক, ব্যক্তিগত হয়েও সমকালীন রাজনৈতিক বাতাবরণে বা পটভূমিতে আন্তসম্পর্কের আধুনিক উপন্যাসটির-বঙ্কিম রবীন্দ্র ও তিন বাড়ুয্যে সমৃদ্ধ কথাসাহিত্যের আকাশে স্বতন্ত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ফুটে উঠতে সময় লাগেনি।

জাগরী উপন্যাসে মতবাদের সংঘাত নয়, সংঘাত পরবর্তী পরিবারের সদস্যদের ভিতরের সম্পর্ক, যন্ত্রণা মুখ্য হয়ে ওঠে। আন্তঃসম্পর্কের স্বগতোক্তি আর আন্তযন্ত্রণার উপন্যাসে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত বাইরের বারান্দায় তক্তপোশহীন কাঠের চেয়ারেই নিশ্চল থাকে

‘জাগরী’ প্রকাশ আমাদের কথাসাহিত্যে এক আধুনিক, বিশিষ্ট জাগরণ। জাগরীর অভাবিত উৎকর্ষে চমকের কথা বললেন তারাশঙ্কর, ‘বইখানি পড়ে চমকে গেলাম। একেবারে নূতন কথা, নূতন সুর, নূতন সব মানুষের ভিড়, একেবারে সম্পূর্ণ নূতন মনোভাব। লেখকের অপরিচিত নাম, কিন্তু রচনার অভাবিত উৎকর্ষ। চমক লাগল’ (‘সতীনাথ ভাদুড়ী’, স্বস্তি মণ্ডল, ভারতীয় সাহিত্যকার গ্রন্থমালা)। অতুলচন্দ্র গুপ্তবাবুর কথা, ‘একেবারে ওস্তাদ লিখিয়ের লেখা। ...ফটোগ্রাফ নয়, নিপুণ শিল্পীর হাতের ছবি। দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাহিত্যের অজেয় কল্পনাকে উত্তীর্ণ হয়েছে’ (ঐ) বা ‘... চিত্র-কলায় জাগরীর লেখক যে দৃষ্টিশক্তি ও কুশলতার প্রমাণ দিয়েছেন, অকুণ্ঠচিত্তে বলতে পারি তা অসাধারণ। ...এর পূর্বে, বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক জেলের এমন সত্যকারের চিত্র আর আমরা পাইনি। মনে হয়েছে এ শুধু পূর্ণিয়া জেল নয়, বাংলারই কোনো জেল। জেলের প্রত্যেক মানুষ ও নিয়ম এমনি আমাদের অভিজ্ঞতায় বাস্তব’ (গোপাল হালদার, সতীনাথ গ্রন্থাবলী-১)। অতি সংক্ষেপে মহাজন মনীষীদের এমন উদ্ধৃতি শুধু প্রসঙ্গে যাওয়ার ভণিতা বা ভূমিকা মাত্র। এই ভণিতার শেষে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করা জরুরি। ভবিষ্যৎ-কথাবিস্তারে তাঁর বাণীবচন আমাদের অনেকটা সমর্থন যোগাবে। ঔপন্যাসিকের মানসোৎকর্ষ বা কোয়ালিটি অব্ মাইন্ড-এর খোঁজে তিনি দেখেছেন ‘সতীনাথের মধ্যে ছিল সেই উচ্চাঙ্গের মানসিকতা, অভিজ্ঞতাকে যে অনাসক্ত জীবন ভাষ্যের রূপ দিতে পারেন’ (বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ, কলকাতা)। তিনি বলেন, ‘সতীনাথই বোধকরি শেষ মননদীপ্ত লেখক যিনি কলকাতা এবং কলকাতাইয়া মধ্যবিত্তকে তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেননি। অথচ সব দিক দিয়ে তিনি আধুনিকেরও আধুনিক’ (্ঐ)। ‘জাগরী’ উপন্যাসে শুধু নয়, আজন্ম আবাস বিহারের জনপদকে সতীনাথ তাঁর সমস্ত উপন্যাসেই ব্যবহার করেছেন। ‘জাগরী’ (১৯৪৫)-এর পর চিত্রগুপ্তের ফাইল (১৯৪৯), ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’ (প্রথম চরণ, ১৯৪৯; দ্বিতীয় চরণ, ১৯৫১), ‘অচিন রাগিণী’ (১৯৫৪), ‘সংকট’ (১৯৫৭), ‘দিগ্ভ্রান্তি’ (১৯৬৬) উপন্যাসসহ তাঁর গল্পেরও জনপদ ওই পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার বাইরে বিহারের জনমানুষ ও জনপদের সমস্তটুকু হলেও স্থান-কাল পাত্রের সীমা অতিক্রম করে তাঁর সৃষ্টি আঞ্চলিক না হয়ে ভারতীয় ও সার্বজনীন হয়ে ওঠে। অন্য দিকে তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের বিষয় বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ‘তাঁর আধুনিক জীবন-সচেতনতা ও বিষয়-অনুধাবনের অন্তহীন ফল’ (্ঐ)। সরোজবাবু বলছেন, ‘বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে এ-বিষয়ে তিনি একমাত্র রবীন্দ্রনাথের কাছেই দ্বিতীয়’ (্ঐ)। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসের আধুনিক স্বরূপ ও স্বতন্ত্রতার কথা-বিস্তারের আগে খুব সংক্ষেপে একটি সাধারণ কাঠামোয় গল্পটি উপস্থিত করে দিলে ভালো হয়।

বিহার প্রদেশের পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতা স্থানীয় সরকারি স্কুলের হেডমাস্টার, যিনি মাস্টারসাহেব হিসেবে পরিচিত। বড় ছেলে বিলু, ছোট নীলু, তাদের মাকে নিয়ে তিনি গান্ধী আশ্রমে বসবাস করতে থাকেন গান্ধীর আহ্বানে চাকরি থেকে ইস্তেফা দেয়ার পর। বিলু নীলু দু’জনই প্রথম দিকে বাবার আদর্শে গান্ধী ও কংগ্রেসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও পরে দু’জনই প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণ করে মূল কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে ফেলে। বিলু কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য হলে নীলু দাদাকে অনুসরণ করলেও পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। ‘জাগরী’ উপন্যাস শুরু হয় এই বিলুর আত্মকথন দিয়ে। পূর্ণিয়া সেন্ট্রাল জেলের এক রাত্রির ঘটনাই পুরো জাগরী উপন্যাস। সময়টা ১৯৪৩ সালের মে মাসের একটি রাতের কথা। এই রাত শেষ হতে হতে আগস্ট আন্দোলনে নানাবিধ ধ্বংসাত্মক কাজের কথিত অপরাধে বিশেষ করে রেললাইন উৎপাটনের দায়ে ফাঁসিদণ্ডে দণ্ডিত বিলুর ফাঁসি হয়ে যাবে। এক নম্বর ফাঁসি-সেলে বসে জেলের সহবন্দিদের সহানুভূতি ও সকাতর নানা আচরণের ভিতর নিজের জীবন রাজনীতি দর্শন নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা আর আত্মসমালোচনায় ডুবে ফাঁসি মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করে। জাগরীর এই অধ্যায়ের নাম ‘ফাঁসি সেল’। চার অধ্যায়ের উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আপার ডিভিশন ওয়ার্ড : বাবা।’ গান্ধীভক্ত আদর্শবাদী সৎ মাস্টার সাহেবও বিলুর মতো সহবন্দিদের সকাতর সহানুভূতি, প্রার্থনাসঙ্গীত ইত্যাদির মাঝেও ছেলেদের সঙ্গে, বিশেষ করে বিলুর সঙ্গে সম্পর্ক, দুই ছেলে সম্পর্কে তাঁর ধারণা, স্মৃতি, কংগ্রেস ও সোশ্যালিস্টদের রাজনৈতিক ও দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসা এবং পুত্র বিয়োগের গভীর বেদনা নিয়ে রাত কাটায়।

তৃতীয় অধ্যায় ‘আওরৎ কিতা : মা’-য় বিলুর মা একইভাবে বিলুর এই করুণ পরিণতি দেখে গভীর যন্ত্রণায় আত্ম-আহাজারি করে সময় পার করে। কত স্মৃতি দুই ছেলেকে ঘিরে, কত কথা, শাশ্বত জননীর সকল অনুভূতি নিয়ে বিলুর জন্য শোকাক্রান্ত হলেও বাইরে তেমন প্রকাশ নেই। জেলের সকলের সে মা, কিন্তু তার শাশ্বত মাতৃসত্তা বলে, না আমি সবার মা হতে চাই না, আমি শুধু বিলু নীলুর মা। একই জেলে তিন ওয়ার্ডে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত ছেলে, বাবা এবং মা।

ছোট ছেলে নীলু উপন্যাসের শেষ অধ্যায় ‘জেলগেট : নীলু’। জেলেগেটে সারারাত জেগে নীলু অপেক্ষা করে দাদা বিলুর মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই অপক্ষোর মুহূর্তে সে রাত্রির জেল পরিবেশের দর্শক হয়েও গভীর আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন থাকে। নিজের রাজনীতির স্বরূপের সঙ্গে দাদার রাজনীতি, তার আপন দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ায় দাদার ফাঁসির আদেশ চূড়ান্ত হওয়ার ঘটনায় নিজের আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান খতিয়ে দেখে। এমন নিমগ্ন আত্মগত বোঝাপড়ার মধ্যে রাত্রি শেষ হওয়ার মুহূর্তে নীলু প্রথম জানতে পারে সরকারের আদেশ মতে বিলুর ফাঁসির আদেশ আরও দুই তিন দিন আগেই স্থগিত হয়ে গেছে। ওই দিন ভোরে তিন নম্বর সেলের অন্য একজন আসামীর ফাঁসি কার্যকর হবে। বিলুকে এক নম্বর সেল থেকে না সরানোর জন্য জেলের কেউ তা অবগত ছিল না। আড়াই শতাধিক পৃষ্ঠার ‘জাগরী’ উপন্যাসের এই সংক্ষিপ্ত বয়ানে শুধু গল্পের একটি অবয়ব চিহ্নিত হলেও এর অভিনব স্টাইলটি দেখবার মতো।

জাগরী উপন্যাসে যেমন প্রচলিত ধারায় শুধু গল্পই ফেনিয়ে ওঠে না, তেমন এর নির্মাণ কোনো প্রথাগত প্লটের ভিতর সীমায়িত নয়। চরিত্র এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও কাহিনীর কার্যকারণ সূত্রে উপন্যাসের চিরাচরিত প্রথায় প্লটের গণ্ডি তৈরি হয় না। আবার প্লটের ভিতর নিহিত থাকে যে ‘মানবিক তাৎপর্য’ জাগরীতে তা অনুপস্থিত নয়। প্রথাসম্মত না হলেও একরকম প্লট তৈরি হয় বৈকি।

রাজনৈতিক পরিবারের চারজন সদস্যই জেলবন্দি। নিরন্তর চৈতন্য প্রবাহের সূক্ষ্ম বুননে প্রতিটি ব্যক্তিই ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হয়। নীলু একসময় দাদার সঙ্গে হাজত বাস করেছে। আইন অমান্য আগস্ট আন্দোলনের এক পর্যায়ে সতীনাথ জেলবন্দি হয়ে জেলের অভিজ্ঞতা ও আধারকে ব্যবহার করে জাগরী লিখতে শুরু করলেও জেলের অনুপুঙ্খ বিবরণ, অত্যাচার অনাচারের কাহিনী আর নিজের আদর্শের সোচ্চার ভাষণ, আবেগ আর দ্বেষ মিলিয়ে রচনার পথে গেলেন না। সেই সময়কালে সতীনাথ কংগ্রেসের জেলা কমিটির নেতা হয়েও বেছে নিলেন এমন একটি প্রধান চরিত্র বিলু যার গান্ধীবাদে বিশ্বাস নেই, এমনকি বিলুর নিজের আদর্শ পার্টির আদর্শ নিয়েও বড় কথা নয়, কথনশৈলীতে আত্মকথন, স্মৃতি রোমন্থন, স্মৃতিরই অসংলগ্ন পরম্পরা ও গভীর অনুভূতিময় অভিব্যক্তি মাত্র। রাত পোহালেই ফাঁসি! মৃত্যু ভয় মৃত্যু উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে জীবনের প্রতি আকাক্সক্ষা, কিন্তু কণ্ঠস্বর অতি নিম্ন। বাহুল্যবর্জিত, পরিমিত আবেগ, যুক্তি ও বাস্তববোধের যে পরিচয় মেলে তা শুধু বিলুর ক্ষেত্রেই নয়, বাবা মা ছোটভাই সবার মধ্যেই দেখা যায় চরিত্রানুগ অভাবিত নিয়ন্ত্রণ। বাতাবরণে যে বিশাল রাজনৈতিক প্রবাহ, দ্বন্দ্ব তার শুধু মন্থনটুকু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্মৃতি ও আত্মকথনে মিশে থাকে। তথাকথিত চরিত্র নির্মাণ নয়, এখানে ব্যক্তি অস্তিত্ব স্বরূপে বাক্সময়।

সতীনাথ তৃতীয়বার জেলে যাবার দিন ৫/৬ আগে ’৪২-এর ৯ আগস্ট গান্ধীসহ বড় বড় নেতা গ্রেফতার হয়ে যান। দেশজুড়ে প্রতিবাদ, স্লোগানমুখর- ‘মহাত্মাজির গ্রেফতার, হো যাও তৈয়ার’। বিহার-পূর্ণিয়াও তখন অগ্নিগর্ভ। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের বিরুদ্ধে শ্রেণী ও পার্টি নির্বিশেষে আন্দোলন মুখর, সতীনাথ স্বয়ং ১২ আগস্ট তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ থেকে ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারেও আইন অমান্য, কর্মবিরতি পালন, জেল ভেঙে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। জাগরী উপন্যাসে বিলু বা অন্য কোনো নেতার এমন অসহযোগিতার বিবরণ নেই, পুলিশের লাঠিচার্জে সতীনাথ ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু জাগরীতে চরিত্রগুলোর আত্মকথনের ভিতর দিয়ে ব্যক্তির এবং ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব সংঘাতের এমন এক জাগৃতির বিশ্বাসযোগ্য প্রকাশ ঘটে যেখানে শারীরিক আঘাত বা জেলকর্মীদের আচরণের কথা হয়তো তিনি তুচ্ছ মনে করেন। জেলে এবং বাইরে ওই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণ, গঙ্গাশরণ সিং, এবং বিহারের আরও সোশ্যালিস্টদের সংস্পর্শে সতীনাথ আসেন। মার্ক্স্বাদ ও প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ শুধু তাঁর ভালভাবে পড়াই ছিল না, তিনি প্রাঞ্জল করে তা বোঝাতেও পারতেন। তো জেলে বসে উপন্যাস লিখতে যেয়ে কল্পনায় সৃষ্ট বিলুকে তিনি সোশ্যালিস্ট বানালেন। উল্লেখ্য, ’৪৭-এর দেশ স্বাধীনতার পর ’৪৮-এ তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে সোশ্যালিস্ট পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। কেন তিনি ক্ষমতাসীন নিজ দল থেকে পদত্যাগ করলেন, সতীনাথের সাফ উত্তর, ‘কংগ্রেসের কাজ ছিল স্বাধীনতা লাভ করা। সে-কাজ হাসিল হয়ে গেছে, রাজকাজ ছাড়া কোনো কাজ নেই আর।’ এ হয়তো নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিকের গভীর অভিমান। ওই সময়ে লেখা ‘গণনায়ক’ গল্পে কংগ্রেস বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বেশ স্পষ্ট হয়। দেশের স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের অভ্যন্তরে স্বার্থসংঘাত দেখে তিনি বিরূপ হয়েছিলেন, গণনায়ক চরিত্রটি তার স্মারক- ‘একটি খদ্দরের টুপি আগেই কিনে রাখলে বোধহয় আরেকটু সুবিধে হতো, হয়তো হিসেবে ভুল হয়ে গেছে’ (গণনায়াক)। কংগ্রেসের সংকট দুর্বলতা এবং অন্ত্যজদের জন্য করবার ক্ষমতা ও ইচ্ছা সম্পর্কে বুর্জোয়া, পেটি ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার পার্টি কংগ্রেস সম্পর্কে সংবেদনশীল সতীনাথের ধারণা দিনে দিনে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। অগ্রসর চিন্তার রাজনৈতিক কর্মী বিলু সহজেই তাঁর প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনপ্রিয় কংগ্রেসী বিলুর বাবা ‘মাস্টারসাহেব’ সমাজতন্ত্রীদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা, বিলুর রাজনীতির প্রতি উদাসীনতা এ-সবের মধ্যে কংগ্রেসকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দেখিয়ে দেন কোনো নেতিবাচক মন্তব্য বা উষ্মা প্রকাশ না করেই। উপরন্তু ‘জাগরী’তে মাস্টারসাহেবের প্রতি একরকম শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিই তৈরি হয়। তৈরি হয় তার কারণ সতীনাথের সংযমী, নির্মোহ আধুনিক ভঙ্গি ছাড়াও হয়তো কাজ করে শোকাতুর পিতার প্রতি স্বাভাবিক আবেগ। নীলু তার পার্টির এবং নিজের কৃতকর্মের পক্ষেই যুক্তি খোঁজে, দাদা বিলুর দলের ত্রুটি সম্পর্কে সে পুরো নিশ্চিত। একদিকে দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে ফাঁসির শাস্তিকে ত্বরান্বিত করার পক্ষে সে একান্ত নিজের মনে, আত্মগত কথনেও মনে করে ‘পৃথিবীসুদ্ধ লোকের ভুল হইতে পারে, আমার ভুল হয় নাই। সেই ১৯৪২-এর আগস্টের ঘটনাসমূহের পরিবেশে আমার কার্যের বিচার করিতে হইবে’ (জাগরী, জেলগেট : নীলু)। অন্যদিকে আগস্ট আন্দোলনের সময়ের যে ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে নিজেই বর্ণনা করে শেষে বলছে, ‘হোলির দিন গ্রামসুদ্ধ লোক নেশা করিয়া যেইরূপ হইয়া যায়, ইহারাও ঠিক সেইরূপ। এই অধীর উত্তেজনাকেই দাদার দল বলে বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল, ইহাই ক্রান্তির প্রচেষ্টা। ... এই ধরনের নেতৃত্বে এইরূপ সংগঠনে এইরূপ সময়ে হইবে ক্রান্তি? ... কে এ-কথা দাদাদের বুঝাইত? আমি কিছুতেই অন্যায় করি নাই। আমার কর্তব্য করিয়াছি মাত্র। আর আমি সাক্ষ্য না দিলেও অন্য লোক দিত। গভর্নমেন্টের লোকের অভাব নাই। তফাতের মধ্যে আমি দিয়াছি নিজের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য ও কর্তব্যের খাতিরে; আর অন্য লোক দিত লোভে পড়িয়া’ (ঐ)। সতীনাথ সূক্ষ্ম কৌশলে দেখান চপলমতি, অল্পেই উত্তেজিত নীলুর এই সাফাই বয়ানের মাধ্যমে অপরাধের বোঝা ও অন্যদের নিন্দনীয় দৃষ্টির চাপ লাঘব করার চেষ্টা, আত্মপ্রবোধ, অন্যদিকে আগস্ট আন্দোলনকে নীলুর কমিউনিস্ট পার্টি তখন যেমন মনে করেছিল- এই আন্দোলন ফ্যাসিবাদী শক্তিকেই মজবুত করবে তার পরোক্ষ সমালোচনাও প্রকাশ হয়ে যায়। বিলুর মতো শ্রমিক ফ্রন্টের নেতার বিরুদ্ধে বৃটিশের আদালতে সাক্ষ্য প্রদান নিন্দনীয় রাজনীতিই বটে।

নীলু আত্মপ্রবোধের চেষ্টায় বারবার চেয়েছে তার কথা, অবস্থান বিলুকে বোঝাতে কিন্তু বিলু গভীরে নীলুর এই আচরণে কষ্ট পেলেও যেমন নীলুর যুক্তি শোনার প্রয়োজন মনে করে না তেমন নীলুকে সে প্রকাশ্যে কেন অন্তরেও অপরাধী মনে করে না, কষ্ট হয়তো হয়। সতীনাথের নিজের রাজনৈতিক দর্শন ও ব্যক্তিত্বের অনুরূপ বিলু ভাবে, নীলু ওর অবস্থান থেকে হয়তো ঠিকই করেছে। ওকে দোষ দিতে পারে না, অপ্রকাশ্যে যেন ওর রাজনীতিই এর জন্য দায়ী হয়ে যায়। নীলু বলতে চাইলেই বিলু সব শুনবে না, প্রয়োজন নেই, নীলু ঠিক জানে, শুনলেও... ‘দাদা নীরবে ধৈর্যের সহিত তাহা শুনিয়া মধ্যে মধ্যে অল্প হাসিত। হয়তো বা এক আধটি এমন কথা বলিত, যাহাতে আমার যুক্তিস্রোত ঘোলাটে হইয়া যাইত। ঐ মৃদু হাসিতে বাঁ গালে টোল পড়িলেই, আমি বুঝিতে পারি যে আমার আপাততীক্ষè যুক্তি, উহার দৃঢ় বিচারশক্তির উপর সামান্য দাগও কাটিতে পারে নাই। হাসিটি আমাকে পরাস্ত করিবার জন্য নয়; উহা কেবল আমাকে নিরস্ত করিবার জন্য’ (জাগরী)। নীলুর এমন রাত্রি জোড়া আত্মপ্রবোধ আত্মকথনে দাদার জন্য তার ভালবাসা, শ্রদ্ধা, হাহাকার ধীরে পাঠকের মনেও সঞ্চার হয়। নিজের যুক্তিমতে ঠিক কাজটি করলেও নীলু জানে এর জন্য দাদার ফাঁসি, মা-বাবার কাছে তার মুখ দেখাবার সুযোগ থাকবে না, সমাজের কাছে সে নিন্দনীয়। উপন্যাসের শেষে বিলুর ফাঁসি স্থগিত হলে পাঠক হয়তো একবার নীলুর জন্যও স্বস্তি বোধ করে। কারণ নীলুর অনুতাপও খুব দুর্বোধ্য থাকে না। নীলু যতই নিজেকে বলুক, বিলু দাদার ‘পার্টির প্রোগ্রাম কার্যকরী করার অর্থই পরোক্ষে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে দৃঢ় করা ইহা কি দাদা বুঝে নাই?’ কিন্তু সকল যুক্তিকে পরাস্ত করিয়া অন্তরের ভিতর কোথায় যেন খচখচ করিয়া কী একটা বিঁধিতেছে’ (্ঐ)। অন্তরে এই যন্ত্রণার কাঁটা পাঠক হৃদয়েও অবচেতনেই হয়তো বিঁধে।

মাস্টারসাহেব তাঁর ব্যক্তিত্ব আদর্শ সম্পর্কের অভ্যাসগত ধরন উপেক্ষা করে একই জেলে হলেও একবারের জন্যও তিনি ছেলের কাছে যেতে পারেন না। অনেকবার তাঁর ইচ্ছা হয়, এই শেষ রাতটা ছেলের কাছে থাকে, শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে, কিন্তু তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাৎসল্য বোধ, অকৃত্রিম আবেগ বোধ করলেও তা সকলের সামনে প্রকাশ করতে তিনি পারেন না, এমন সরল ভাবপ্রবণতা হয়তো কষ্ট আরও বাড়াবে। সহবন্দিদের প্রার্থনা, গীত, চরকাটাতেও মনোযোগ দিতে পারেন না। মন একদিকে ছেলের কাছে, অন্যদিকে রাজনীতি-সমালোচনা আত্ম-সমালোচনায় বিভোর থাকে, কোনো ভাব সঙ্গীতেই তাঁর মন বসে না, বরং সকলে তাঁর সামনে থেকে সরে পড়লেই একা নিজেকে আরও বেশি পান। বিলুর শিশু-কৈশোর-যৌবনের স্মৃতি, বেড়ে ওঠা নীলুর ভূমিকা নিয়ে বারবার খতিয়ে দেখতে পারেন এবং এই একান্ত মুহূর্তেও ছেলেদের কংগ্রেস ছেড়ে সোশ্যালিস্ট হওয়া তাঁর কাছে অবোধ্য ঠেকে। চরখায় সুতা কাটার মধ্যে প্রতীকীভাবে হলেও তিনি ভারতের মুক্তি দেখতেন। গান্ধী ও চরখার প্রতি তাঁর আবেগ ও আস্থা, পুত্রদের প্রতি স্নেহের থেকেও যেন বেশি,- ‘একসঙ্গে অনেকগুলি চরখার নানারকম শব্দ শুনিতে ভারি ভাল লাগে। ... মনে পড়াইয়া দেয় যে সোনার ভারত গড়িয়া তুলিবার পথে আমি একলা পথিক নই। ইহা তো কেবল এত গজ এত হাত সুতা কাটা মাত্র নয়। এখন যে চরখার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছে, ইহা যে রামরাজ্য ফিরাইয়া আনিবার একমাত্র অস্ত্র। রামরাজ্য হইবে প্রেমের রাজ্য, গৌরাঙ্গের রাজ্য; লোকে হিংসা দ্বেষ ভুলিবে’ (জাগরী, আপার ডিভিশন ওয়ার্ড : বাবা)। এরকম রোমান্টিক ভাবালু স্বপ্নচারী মাস্টারসাহেব চরখা নিয়ে সামান্য কৌতুকও সহ্য করতে পারেন না। জেলের ভিতর তাঁর ও সঙ্গীদের চরখা কাটা দেশসেবায় নিয়োজিত থাকারই নামান্তর। পাশের সিটের অন্য কারও চরখা ঘুরানো একই মাত্রায় ধর্ম ব্রত মনে নাও হতে পারে। ‘ডানদিকের একটি সিট হইতে চরখার শব্দের নকল করিয়া একজন মুখ দিয়া শব্দ করিতে আরম্ভ করিল, আর দুই তিনজন হাসিয়া উঠিল। সুখলাল না হইলে আর কে হইবে? না, সুখলাল নয়, কমরেড সুখলাল!’ (্ঐ)। বিলুর রাজনীতির সমর্থক এ কমরেডের কথা বলতে মাস্টারসাহেবের কণ্ঠে কেমন শেষ ঝরে পড়ে। ছেলেরা, বিশেষ করে নীলু বাবার অতি কংগ্রেস বা গান্ধী ভক্তিকে ঠেস দিতে ছাড়ে না। ‘আওরাত ফিতা : মা’ অধ্যায়ে মা এমন এক পারিবারিক ক্রান্তিকালে নীলু বিলুর স্মৃতিচারণ মুহূর্তে মনে করে নীলুর এমন দুষ্টুমির কথা- ‘... ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসে। লঘুগুরুর জ্ঞান ওর একটুও নেই। নিজের খেয়ালে উন্মত্ত। একদিন করেছে কী, এই বড় হয়ে, ছারপোকা মেরে মেরে তার রক্ত দিয়ে সাইনবোর্ডের মতো লিখেছে- অহিংসা পরমোধর্ম- আমি তো বুঝি কাকে ঠেস দিয়ে এ লেখা।’

অভিনব আঙ্গিকের ভিতর পরিবারের চার সদস্যেরই বিশিষ্ট ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যের গুণে নিজেদের ব্যক্তিত্বের বলয় তৈরি হয়, এই বলয়ের ঘেরের রাজনৈতিক পরিচয় দেয়া সম্ভব, হয়তো আছেও, কিন্তু অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতাদর্শ সামান্যই প্রবেশ অধিকার পায়

জেলের ভিতর শেষ প্রহরের অপেক্ষায় কত শত কথার মধ্যে যেমন বারবার নীলুর প্রসঙ্গ মনে হয় বিলুর, তেমনি তেত্রিশ বছর জীবনের কোনকিছুই না পাওয়ার, কোনো স্বপ্ন সাধ পূরণ না হওয়ার আক্ষেপও তার মনে জাগে। নীলুর কর্তব্যনিষ্ঠা, পার্টির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে নীলু ঠিক কাজই করেছে বলে মনে করলেও মনের ভিতর থেকে কষ্ট দূর হয় না বিলুর। ‘কোনো আত্মসম্মানশীল, সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মীর ইহা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু ইহা যুক্তির কথা। সুপ্ত চেতনা হয়তো ভাবে যে এ-যুক্তি কোর্টে চলিতে পারে, বই-এ ছাপার কালিতে ইহা দেখিতে ভাল, কিন্তু অন্যত্র ইহার স্থান নাই। ... নিজের পার্টির প্রতি একনিষ্ঠতা দেখাইবার জন্য সহোদর ভাইয়ের ফাঁসির পথ করিয়া দেওয়া হৃদয়ের সততার প্রমাণ না রুগ্ন মনের শুচিবায়ের পরিচয়?’ (জাগরী)। অর্থাৎ সতীনাথের বিলু নিরেট আদর্শবাদী অতিমানব মাত্র নয়, রক্ত, মাংস, হৃদয়ের মানুষ। বিলু শুধু কল্পনার অবাস্তব ফানুস, আদর্শে মোড়ানো শুষ্ক প্রাণী নয়। অনুভূতিপ্রবণ বিলুর মন কতভাবে নানা বৈপরীত্যে আলোড়িত হয়। জেলের সীমাবদ্ধ জগতের ভিতর রেলগাড়ির বাঁশির শব্দ উন্মুক্ত উদার পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগের সূত্র বলে মনে হয় তার। বিলুর সৌন্দর্যপ্রিয় মন বলে, ‘এত প্রাণ উদাস করা, মন উতলা করা বাঁশির স্বর কোনো বৈষ্ণব কবিও কোনদিন কল্পনা করিতে পারেন নাই। ... কোন্ অজ্ঞাত ইথারের কম্পন মনের অবরুদ্ধ তন্ত্রীকে এত তরঙ্গিত করে? চটকলের ভোরের ভেঁপু মজুর-বস্তিতে সাময়িক আলোড়ন জাগায় বটে, কিন্তু রেলের বাঁশি আনে প্রতিটি কয়েদী হৃদয়ে দ্রুততার স্পন্দন; প্রাণে জোগায় সুপ্ত মধুর স্মৃতি, রূপ দেয় কত ছায়াহীন আকুতি ও বাসনাকে।’ (জাগরী, ফাঁসি সেল)।

এই রাজনৈতিক পরিবারের অনুভূতিপ্রবণ মানুষগুলিকে বহিরঙ্গে আদর্শনিষ্ঠ শক্ত ধাতের মনে হলেও হৃদয়ে মানবিক সুর, জীবনের প্রতি, স্বজনের প্রতি প্রেম ও বিয়োগ যন্ত্রণার হাহাকার স্রোতও বয়ে যায়। বিলু যেমন প্রকাশ্যে নীলুর কোনো অপরাধ অন্যায় দেখতে পায় না, মনে করে নীলু ন্যায়নিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে ঠিকই করেছে, আবার অন্তরে মনের কোথায় যেন তা মেনে নিতেও পারে না, মনে হয় রুগ্ন মনের শুচিবায়। বাবা মাস্টারসাহেব একই জেলে থেকেও একবার ছেলেকে দেখতে যেতে পারেন না, ছেলের দল ও আদর্শের সমালোচনা করেন, অন্যদিকে নীলু নয় বিলুর দিকেই তাঁর পক্ষপাতিত্ব, বিলুর সেলে ছুটে যেতে চান, শেষ রাতটা অন্তত বিলুর সঙ্গে কাটাবার আকুতিতে দীর্ণ হয়। মা স্বামীর আদর্শে বন্দি হলেও সংগ্রেস গান্ধীই সবকিছু হলেও, কংগ্রেসীদের মা হয়ে উঠলেও তাঁর মন হাহাকার করে ওঠে, প্রতিবাদ করে, আমি শুধু বিলু নীলুর মা হতে চাই। অন্তর ও বাইরের ভাবনাস্রোতের বৈপরীত্যে সমান্তরালভাবে কত সহজ আত্মকথনের ভিতর দিয়ে ধীরে ফুটে ওঠে মানবিক সম্পর্কের তাৎপর্য। কাহিনী ও চৈতন্য প্রবাহের এই আয়োজনের ভিতরই জাগরী উপন্যাসের প্লটের নতুনত্ব ও বিশিষ্টতা। পরিবারের আন্তঃসম্পর্কের মায়াজাল ও গূঢ় যন্ত্রণার বাস্তবনিষ্ঠ প্রকাশ ও পাঠকের মনে তার আলোড়ন সঞ্চারের সাফল্যে শেষ পর্যন্ত মনে হয় ব্যক্তি ও মানব সম্পর্কের এই মহৎ রচনাটিকে রাজনৈতিক উপন্যাস বললে এর আন্তরশক্তিকে খর্ব করেই দেখানো হয়। বহিরঙ্গে রাজনৈতিক বাতাবরণের প্রবল উপস্থিত সত্ত্বেও রাজনৈতিক উপন্যাস হয়ে ওঠে না। জাগরী উপন্যাসের এমন অভিনব চিত্তগ্রাহী চরিত্রের আন্তঃসম্পর্কের বাস্তবনিষ্ঠ কাহিনীর প্রয়োজনেই ওই রাজনৈতিক অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। এর স্রষ্টা সতীনাথ স্বয়ং একজন রাজনীতির লোক বলেই হয়তো রাজনীতির এই সহজ ব্যবহার।

জাগরী উপন্যাসের ভরকেন্দ্রে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ, চিন্তা এবং প্রস্তাবনা নেই, কোনো রাজনৈতিক জিজ্ঞাসায় আলোড়িত করে না। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে যেমন স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, যৌক্তিকতা, পরিণতি নিয়ে উপন্যাসের কাহিনী দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আবর্তিত হয়, সকল পক্ষ স্পষ্টই থাকে, ‘আনন্দমঠ’-এও প্রবল পক্ষ বিপক্ষ এবং রাজনৈতিক বিতর্কে উপন্যাস তৈরি হতে থাকে বা ‘মা’ উপন্যাসে মা ও পাভেলের একটি বিশেষ আদর্শের প্রতি আবেগ, ভালবাসা, প্রচার এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই আর নির্যাতনের কাহিনী ঘিরে সম্পন্ন হয় এবং রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। জাগরী উপন্যাস সেখানে পরিবারের চারজন সদস্যের আত্মসম্পর্ক ও যন্ত্রণার আত্মকথন মাত্র। জাগরীকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে পাঠ করা গেলে এর গঠনশৈলীতে মারাত্মক ত্রুটি মূর্ত হয়ে উঠবে। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সভ্য নীলুর ভূমিকাতে সতীনাথ কতটা রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত দেখেছেন! বিলু বাবা মা’র আত্মকথনে এবং নীলু পর্বে নীলুর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, তাতে এই রকম সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিতে পারে। আর বিলু একবার বলেছেও, ‘নীলু কখনো তার নিজের অবস্থান থেকে এক পা’ও সরে আসবে না।’ নীলুও তার সিদ্ধান্ত শতকরা শতভাগ ঠিক বলেই জানে। পার্টির দোহাই সে দেয়নি। আর এটি পার্টির সিদ্ধান্ত হতে হলে কিছু বিবেচনার প্রশ্ন থাকে, কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার কথা সতীনাথ ভাল করেই জানেন। অন্যদিকে বিলুর যে রাজনৈতিক অবস্থান ও পরিচয় তারও কি পর্যাপ্ত বিবরণ আছে! আজন্ম গান্ধীভক্ত পরিবারের ছেলে, নিজেও কংগ্রেসী ছিল, কোন্ প্রেক্ষাপটে কেন সোশ্যালিস্ট হয়ে গেল, এইসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তরের অভাবেও জাগরীকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে গ্রহণ করতে বাধে। বিশিষ্ট আলোচক নীরেন্দ্রনাথ রায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘বিলুর মতো স্থিতধী ব্যক্তি মার্কস্বাদ পরিপূর্ণ আয়ত্ত করার পরও এমন আত্মকেন্দ্রিক রহিল, কী করিয়া? নীলুর আচরণের প্রতি তাহার যে অনুকম্পা, সেও আনুষ্ঠানিক গান্ধীবাদের খানিকটা সচেতন খানিকটা অবচেতন বাহ্য বিনয়ের নামান্তর’ (সতীনাথ গ্রন্থাবলী-১)। অর্থাৎ নীরেন্দ্রবাবু রাজনৈতিক উপন্যাসের এই ‘গুরুতর ত্রুটি’ তুলে ধরে সমালোচনার প্রয়াস পেলেন। কিন্তু সতীনাথের জাগরী উপন্যাসে রাজনৈতিক পরিম-লের নীলু বিলুর চরিত্র দুটি পার্টি বা কোনো মতাদর্শের প্রচারক, স্মারক বা তত সমালোচক হয়ে ওঠে না, বরং পরিবারকে ঘিরে (রাষ্ট্র বা সমাজকে নিয়ে নয়) নানা স্মৃতি, ঘটনা, কলহ, আনন্দের কথা নিজের মনে মনে আওড়ে যায়, রাজনীতির কথা যেখানে সামান্যই। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীর প্রসঙ্গ প্রায় অনুপস্থিতই থাকে। বিলু নীলু এখানে যতটা পরিবারের ব্যক্তি স্বরূপে উপস্থিত তা আত্মকেন্দ্রিক বা সমষ্টিক হোক না কেন, যতটা তারা ব্যক্তিগত তার সামান্যও তারা দলীয় নয়। জেলগেটে ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য সারারাত্রি নীলুর অপেক্ষা শুধু ব্যক্তি সম্পর্কের ওপরই দাঁড়িয়ে, অন্যকিছু নয়। অন্তর্গূঢ় যন্ত্রণার চাপ ও আবহ উপন্যাস ঘিরে তৈরি হয় যেভাবে সেখানেই বা রাজনীতির হাত পা কোথায়!

অভিনব আঙ্গিকের ভিতর পরিবারের চার সদস্যেরই বিশিষ্ট ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যের গুণে নিজেদের ব্যক্তিত্বের বলয় তৈরি হয়, এই বলয়ের ঘেরের রাজনৈতিক পরিচয় দেয়া সম্ভব, হয়তো আছেও, কিন্তু অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতাদর্শ সামান্যই প্রবেশ অধিকার পায়। চারজন মানুষের স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে সতীনাথের প্রথম উপন্যাস, বাংলায়ও এমন আঙ্গিকের প্রথম সৃষ্টি গড়ে ওঠে। স্বগতোক্তির কথনভঙ্গিও একটি বিশিষ্ট ধরনের সাধুরূপ হলেও নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার মতো ভাষা ও শব্দ চয়ন, সাধু হলেও পোশাকি হয়ে ওঠে না। ভঙ্গিটি খুব ব্যক্তিগত ও আন্তরিক, এমন ভঙ্গিতে সমষ্টির লক্ষ্যের রাজনীতিসর্বস্ব রচনা নির্মাণ যথাযথ হতো না। জাগরীর প্রথম সংস্করণের ভূমিকাতেও সতীনাথ জানিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক পটভূমিকায় একটি পরিবারের কাহিনীর কথা, ‘রাজনৈতিক জাগৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। এই আলোড়নের তরঙ্গবিক্ষোভ কোনো কোনো স্থলে পারিবারিক জীবনের ভিত্তিতেও আঘাত করিতেছে। এইরূপ একটি কাহিনী পরিবারের কাহিনী।’ এ-কথাও অসত্য নয়, যে লেখকেরা নিজেদের লেখার বিচারক নন। ‘লেখকেরা কি নিজেদের লেখার প্রকৃতি সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন? মনে হয় না। সতীনাথ নিজে তাঁর পরিচায়িকায় লিখেছেন, “... গল্পটি ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের পটভূমিকায় পড়িতে হইবে।” এর থেকে বোঝা যায় পিতামাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বিচারক নয়। প্রকৃতপক্ষে জাগরী-তে উপাদান হিসেবে রাজনীতি আছে। কিন্তু ওটা বাহ্য, পাঠককে উপন্যাসটির প্রাণকেন্দ্রের জন্য অন্যত্র সন্ধান করতে হবে’ (বাংলা উপন্যাসের শিল্পাঙ্গিক, গুণময় মান্না, ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা)। জাগরী উপন্যাসে মতবাদের সংঘাত নয়, সংঘাত পরবর্তী পরিবারের সদস্যদের ভিতরের সম্পর্ক, যন্ত্রণা মুখ্য হয়ে ওঠে। আন্তঃসম্পর্কের স্বগতোক্তি আর আন্তযন্ত্রণার উপন্যাসে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত বাইরের বারান্দায় তক্তপোশহীন কাঠের চেয়ারেই নিশ্চল থাকে। ভারতের রাজনৈতিক তরঙ্গের পরিবর্তে ফুটে ওঠে পারিবারিক জীবনরস।

রাজনীতি একটি আধার মাত্র, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘আসল আধেয় হল জীবনরস। নীলু-বিলু-বাবা-মায়ের অন্তর্গত কথনের মাধ্যমে ভাবরীতি দু’য়ের দিক থেকেই জাগরী সেই সুপরিণত জীবনরস বোধে সাক্ষ্য দেয়।’

সতীনাথের আধুনিক জীবন-সচেতনতা, নিয়ন্ত্রিত আবেগ এবং নিরাসক্ত অভিব্যক্তি জাগরী উপন্যাসকে আধুনিক উপন্যাসের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।

back to top