alt

সাময়িকী

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

অনুপম হায়াৎ

: শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০২৩

‘ধূসরযাত্রা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

মঞ্চ-নাট্য সংস্কৃতির কীর্তিমান শিল্পী-সংগঠক-নির্দেশক চাকলাদার মোস্তফা আল মাস্উদ (মাস্উদ সুমন)। তিনি ২০০০ সাল থেকে মঞ্চের সাথে জড়িত। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘কঞ্জুস’, ‘হ্যামলেট’, ‘তপসী ও তরঙ্গিণী, ‘রথযাত্রা’, ‘শিল্পী’, ‘মাঝরাতের মানুষেরা’, ‘লীলাবতী আখ্যান’ ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ ‘প্রভূতি’। আর নির্দেশিত নাটকের মধ্যে রয়েছে পথনাটক সংবাদনাট্য: ‘ঐশী’। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচিত্র বিভাগের সহকারী পরিচালক (চলচ্চিত্র) পদে কর্মরত। তিনি নিয়মিতভাবে ভিডিওচিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। ‘ধূসরযাত্রা’ (২০২২) তাঁর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র।

‘ধূসরযাত্রা’র মাধ্যমে সুমনের নবঅভিযাত্রা শুরু হয়েছে। সমকালীন বাংলাদেশ তথ্য বিশ্বের আলোচিত ঘটনা মরণব্যাধি মহামারী ছোঁয়াচে রোগ করোনা। পরিচালক মাসউদ সুমন সেই ছোঁয়াচে রোগের পটভূমিকায় ‘ধূসরযাত্রা’র কাহিনি বেছে নিয়েছেন। তাঁর এই নির্মাণ যেমন দৃপ্ত সাহসের তেমন একজন সচেতন মানবতাবাদীরও পরিচায়ক। এই চিত্রের মাধ্যমে তিনি বাস্তবতাকে স্পর্শ করেছেন।

আখ্যান : ‘ধূসরযাত্রা’ বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনি চিত্রের ইতিহাসে নবতর সংযোজন। এ ধরনের কাহিনি নিয়ে ইতোপূর্বে আর কোনো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে কিনা জানা নেই। এর আখ্যান গড়ে উঠেছে পেশাদার লাশ গোসল প্রদানকারী সোবহানের কার্যক্রম ও বিনা গোসলে তারই লাশ দাফন-কাফন নিয়ে। ২৫ বছর আগে সোবহানের স্ত্রী ছোঁয়াচে রোগে মারা গেলে বিনা গোসলেই তার স্ত্রীর লাশ কবরস্থ করা হয়। সেই স্মৃতিকে মনে রেখে সোবহান মুর্দা লাশের গোসল দেয়। ২০২০-২১ সালে মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যায় তাদেরও সে গোসল প্রদানের কাজ নেয়। এক সময় সোবহানও মারা যায়। কিন্তু ছোঁয়াচে রোগের ভয়ে তার লাশও বিনা গোসলে দাফন করা হয়। সেই আখ্যানের সাথে যোগ হয়েছে মসজিদের ইমাম সাহেবের সমবেদনা ও অসহায়ত্ব, মসজিদ কমিটির সভাপতির কর্তৃত্ববাদী কার্যকলাপ, খদ্দের কর্তৃক পতিতাকে বঞ্চনা, সোবহান কর্তৃক পতিতাকে নিজের অর্জিত অর্থ দান করা, চা-দোকানী কর্তৃক সোবহানের লাশ গোসলবাবদ বাড়তি আয় নিয়ে মস্করা করা ইত্যাদি প্রসঙ্গও। ‘ধূসরযাত্রা’র আখ্যান, লোকেশন, পাত্র-পাত্রী, তাদের আচার-আচরণ ও নির্মাণশৈলী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে প্রবর্তিত ইতালীয় নব্য-বাস্তবতাবাদীয়’ চলচ্চিত্র ধারার সাথে তুলনীয়।

বক্তব্য: ‘ধূসরযাত্রা’য় সোবহান নামে এক বিপত্নীক নিঃসঙ্গ ও পেশাদার মুর্দা লাশের গোসল প্রদানকারীর স্মৃতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়তি নির্দিষ্ট বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে যে, ২৫ বছর ধরে যে সোবহান অগণিত লাশের গোসল করিয়েছে, মৃত্যুর পর তারই লাশ বিনা গোসলেই দাফন করা হয়। কারণ, সোবহান ছোঁয়াচে রোগ করোনায় মৃতদের লাশ গোসল করাতো। তাই মৃত্যুর ভয়ে তার লাশের গোসল করানো হয়নি।

দৃশ্যমাত্রা: চলচ্চিত্রের বাহন ক্যামেরা। ক্যামেরার মাধ্যমে ‘শট’ বা দৃশ্যখ- ধারণ করে ‘সিকোয়েন্স’বা দৃশ্যপরম্পরা সৃষ্টি হয়। ৪৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ড সময়ের ‘ধূসরযাত্রা’র আঙ্গিক গঠিত হয়েছে এরকম অসংখ্য ‘শট’ ও ‘সিকোয়েন্স’ নিয়ে। এসবই পরিচালকের মনন-বুনন-সৃজনে বাস্তবতার ব্যাঞ্চনায় সুস্পষ্ট। এখানে কিছু দৃশ্যের প্রসঙ্গ আলোকপাত করা হলো।

(১) ছবির শুরুটিই চমৎকার বিভিন্ন শটে রূপায়িত। করুণ সুরের মূর্ছনা। তারপর শুরু হয় সকালের বিভিন্ন দৃশ্য, প্রকৃতি, নদী, নৌকা, লঞ্চ, লঞ্চের চলাচল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ। এরপর মূল চরিত্র সোবহানের ওপর ক্যামেরা ফোকাস করে। সোবহান ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে চারদিকে তাকায়, পুতুল দেখে, এভাবেই পরিচালক সোবহানকে বাস্তব সম্মতভাবে দৃশ্যময় করে তোলে।

(২) লাশ গোসলদান শেষে গ্রিলের দোকানের পাশ দিয়ে সোবহানের আসার সময় বিভিন্ন শটে আগুনের বিচ্ছুরিত ছটার দৃশ্য তার মানসিক অবস্থার পরিচায়ক। এতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

(৩) সোবহান কর্তৃক লাশ গোসল করানো, সারি সারি সাজানো লাশ, এম্বুলেন্সের চলাচলের দৃশ্যগুলোও বাস্তব সম্মতভাবে চিত্রায়িত।

(৪) মসজিদ কমিটির সভাপতির বাসা, সোবহান ও ইমাম সাহেবের কথোপকথন, রক্ষিতার রূপসজ্জার দৃশ্যগুলোও গভীর অর্থবোধক।

(৫) ছবির শেষ সিকোয়েন্সটি ক্যামেরার বিভিন্ন এঙ্গেল ও শট উদ্ভাসিত। সোবহানের মৃত্যু, শেষ যাত্রার শেষ আয়োজনে পুতুল ও পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দৃশ্য, এম্বুলেন্সের যাত্রা, নদীর বহমান স্রোতে, চলমান লঞ্চ, জীবন ও মৃত্যুর ব্যঞ্জনায় সিক্ত।

‘ধূসরযাত্রা’র এরকম আরো বহু দৃশ্য রয়েছে যা পরিচালকের পরিকল্পিত সৃজন নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহন করে।

ধ্বনিমাত্রা: শব্দ বা ধ্বনি চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাস্তবতার কারণেই এর প্রয়োগ ঘটে থাকে। ‘ধূসরযাত্রা’র আঙ্গিক ও কাঠামোজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শব্দ বা ধ্বনির প্রয়োগ। এই ধ্বনি ব্যবহৃত হয়েছে কখনো সংলাপে, কখনো গান বা সংগীত, কখনো কান্নায় বা বাঁশিতে বা কাশিতে কখনো পরিপাশির্^কতার স্বাভাবিকতার আবহে। চলচ্চিত্রের মূল প্রতিপাদ্য অনুসারে রয়েছে বাঁশির করুণ সুর। পরিবেশ অনুযায়ী নদীতে চলন্ত জাহাজের শব্দ, সিটি, মৃতের বাড়িতে নারীর কান্নার সুর, কোরআন পাঠের শব্দ, সোবহান-ইমাম-করিম সাহেব, দোকানদার-খদ্দেরদের সংলাপ, কথোপকথন পতিতার খিস্তিখেউড়। ছবির শেষ দৃশ্যে রয়েছে পানিতে পড়া ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ। অন্যদিকে পরিবেশ অনুযায়ী রয়েছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, এম্বুলেন্সের শব্দ এবং সোবহানের কাশির শব্দও। ধ্বনি ব্যঞ্জনার সংযুক্ত হয়েছে দু’টি গানও। একটি রবীন্দ্র সংগীত ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ এবং লোকগান ‘বন্ধু রঙ্গিলা, রঙ্গিলারে, আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলারে?’ গান দুটোর ব্যবহার দৃশ্য কাব্যের বাস্তবতার সাথে পরিবেশ প্রতিবেশের সাথে, চরিত্রের পারিপাশির্^ক অবস্থার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

অন্যান্য:‘ধূসরযাত্রা’ চলচ্চিত্রের আরেকটি সম্পদ হলো লোকজ উপাদানের ব্যবহার। যেমন পুতুলের ব্যবহার। এটি সোবহানের ২৫ বছর আগে মৃত স্ত্রীর প্রতীক। বিভিন্ন ব্যবস্থায় সোবহান পুতুলের সাথে একা একাই কথা বলেছে এমনকি মৃত্যুর পর যদি আবার জীবিত হয় তবে দু’জন একত্রে বসে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখার ইচ্ছেও ব্যক্ত করেছে। তার মৃত্যুর সময় এবং পরেও ক্যামেরার পুতুলটিকে ফোকাস করা হয়েছে। চিত্রে পুতুল হয়ে উঠেছে জীবন্ত মানবী। লোকজ সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে পুতুলের ব্যবহার চিত্রের ব্যঞ্জনাকে মূর্ত করেছে।

এছাড়া লোকজ উপাদান হিসেবে গান, বাঁশি, মৃতের বাড়িতে কান্না, কোরান পাঠ, হাঁড়িপাতিল, বালতি, আগরবাতি, নৌকার ব্যবহারও দৃষ্ট হয়। অন্যদিকে আধুনিক যানবাহন লঞ্চ, এম্বুলেন্সের ব্যবহার, ছোঁয়াচে মরণব্যাধি ‘করোনা’র প্রকোপ পরিচালকের সচেতনতার পরিচায়ক।

‘ধূসরযাত্রা’ বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনি চিত্রের ইতিহাসে নবতর সংযোজন। এ ধরনের কাহিনি নিয়ে ইতোপূর্বে আর কোনো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে কিনা জানা নেই। এর আখ্যান গড়ে উঠেছে পেশাদার লাশ গোসল প্রদানকারী সোবহানের কার্যক্রম ও বিনা গোসলে তারই লাশ দাফন-কাফন নিয়ে

সম্পাদনামাত্রা: ‘ধূসরযাত্রা’ একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র। পরিচালক ও সম্পাদককে এই চিন্তা মাথায় রেখে অত্যন্ত সুকৌশলে সম্পাদনার কাজটি করতে হয়েছে। ছবির দৃশ্যরূপ, ধ্বনির মাত্রা, পরিবেশ-প্রতিবেশ, চরিত্রের আচার-আচরণ মানসিক অবস্থা, ঘটনার গুরুত্ব এসব মনে রেখে সম্পাদনার প্রয়োগ ঘঠেছে এই চিত্রে। ছবির শুরুতে নির্মাতা বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছেন সম্ভাব্য ঘটনার। আবার শেষ দৃশ্যেও প্রায়ই অনুরূপ দৃশ্যের সংযোজন ঘটে: নদী বহমান, লঞ্চ চলমান, প্রকৃতি ও সজীব, পুতুলটিও যথাস্থানে। শুধু নেই মুর্দা গোসল প্রদানকারী সোবহান। বিনা গোসলে তার লাশ নিয়ে চলে যাচ্ছে এম্বুলেন্স। ‘ধূসরযাত্রা’র এই আয়োজনটি বিভিন্ন শট ও শব্দের মিশ্রণে সুসম্পাদনার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আবেগময় পরিবেশের। কবির ভাষায় এ যেন ‘আমাকে কিছু কান্নার কুসুম দাও’। ছবিতে চিল ওড়ার দৃশ্য, কুকুরের দৃশ্য, করিম সাহেবের বাড়িতে রক্ষিতার প্রসাধনের দৃশ্য, রাস্তার পুলিশের আচরণ, সোবহানের লাশ গোসল করানোর দৃশ্য, পুতুলের সাথে কথা বলার দৃশ্য দোকানে ঝুলন্ত কলার দৃশ্য ইত্যাদির সংযোজন ‘ধূসরযাত্রা’র ব্যঞ্জনার মাত্রাকে করেছে সমৃদ্ধ।

উপসংহার:বিষয়বস্তু ও নির্মাণ কুশলতায় ‘ধূসরযাত্রা’ একটি সার্থক চলচ্চিত্র। এর প্রতিটি শট উচ্চারিত হয়েছে আত্মার ক্রন্দন। ‘ধূসরযাত্রা’ দৃশ্যে, শব্দে, বিষয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রায় উচ্চরিত হবে আশা করি।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

অনুপম হায়াৎ

‘ধূসরযাত্রা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০২৩

মঞ্চ-নাট্য সংস্কৃতির কীর্তিমান শিল্পী-সংগঠক-নির্দেশক চাকলাদার মোস্তফা আল মাস্উদ (মাস্উদ সুমন)। তিনি ২০০০ সাল থেকে মঞ্চের সাথে জড়িত। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘কঞ্জুস’, ‘হ্যামলেট’, ‘তপসী ও তরঙ্গিণী, ‘রথযাত্রা’, ‘শিল্পী’, ‘মাঝরাতের মানুষেরা’, ‘লীলাবতী আখ্যান’ ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ ‘প্রভূতি’। আর নির্দেশিত নাটকের মধ্যে রয়েছে পথনাটক সংবাদনাট্য: ‘ঐশী’। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচিত্র বিভাগের সহকারী পরিচালক (চলচ্চিত্র) পদে কর্মরত। তিনি নিয়মিতভাবে ভিডিওচিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। ‘ধূসরযাত্রা’ (২০২২) তাঁর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র।

‘ধূসরযাত্রা’র মাধ্যমে সুমনের নবঅভিযাত্রা শুরু হয়েছে। সমকালীন বাংলাদেশ তথ্য বিশ্বের আলোচিত ঘটনা মরণব্যাধি মহামারী ছোঁয়াচে রোগ করোনা। পরিচালক মাসউদ সুমন সেই ছোঁয়াচে রোগের পটভূমিকায় ‘ধূসরযাত্রা’র কাহিনি বেছে নিয়েছেন। তাঁর এই নির্মাণ যেমন দৃপ্ত সাহসের তেমন একজন সচেতন মানবতাবাদীরও পরিচায়ক। এই চিত্রের মাধ্যমে তিনি বাস্তবতাকে স্পর্শ করেছেন।

আখ্যান : ‘ধূসরযাত্রা’ বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনি চিত্রের ইতিহাসে নবতর সংযোজন। এ ধরনের কাহিনি নিয়ে ইতোপূর্বে আর কোনো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে কিনা জানা নেই। এর আখ্যান গড়ে উঠেছে পেশাদার লাশ গোসল প্রদানকারী সোবহানের কার্যক্রম ও বিনা গোসলে তারই লাশ দাফন-কাফন নিয়ে। ২৫ বছর আগে সোবহানের স্ত্রী ছোঁয়াচে রোগে মারা গেলে বিনা গোসলেই তার স্ত্রীর লাশ কবরস্থ করা হয়। সেই স্মৃতিকে মনে রেখে সোবহান মুর্দা লাশের গোসল দেয়। ২০২০-২১ সালে মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যায় তাদেরও সে গোসল প্রদানের কাজ নেয়। এক সময় সোবহানও মারা যায়। কিন্তু ছোঁয়াচে রোগের ভয়ে তার লাশও বিনা গোসলে দাফন করা হয়। সেই আখ্যানের সাথে যোগ হয়েছে মসজিদের ইমাম সাহেবের সমবেদনা ও অসহায়ত্ব, মসজিদ কমিটির সভাপতির কর্তৃত্ববাদী কার্যকলাপ, খদ্দের কর্তৃক পতিতাকে বঞ্চনা, সোবহান কর্তৃক পতিতাকে নিজের অর্জিত অর্থ দান করা, চা-দোকানী কর্তৃক সোবহানের লাশ গোসলবাবদ বাড়তি আয় নিয়ে মস্করা করা ইত্যাদি প্রসঙ্গও। ‘ধূসরযাত্রা’র আখ্যান, লোকেশন, পাত্র-পাত্রী, তাদের আচার-আচরণ ও নির্মাণশৈলী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে প্রবর্তিত ইতালীয় নব্য-বাস্তবতাবাদীয়’ চলচ্চিত্র ধারার সাথে তুলনীয়।

বক্তব্য: ‘ধূসরযাত্রা’য় সোবহান নামে এক বিপত্নীক নিঃসঙ্গ ও পেশাদার মুর্দা লাশের গোসল প্রদানকারীর স্মৃতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়তি নির্দিষ্ট বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে যে, ২৫ বছর ধরে যে সোবহান অগণিত লাশের গোসল করিয়েছে, মৃত্যুর পর তারই লাশ বিনা গোসলেই দাফন করা হয়। কারণ, সোবহান ছোঁয়াচে রোগ করোনায় মৃতদের লাশ গোসল করাতো। তাই মৃত্যুর ভয়ে তার লাশের গোসল করানো হয়নি।

দৃশ্যমাত্রা: চলচ্চিত্রের বাহন ক্যামেরা। ক্যামেরার মাধ্যমে ‘শট’ বা দৃশ্যখ- ধারণ করে ‘সিকোয়েন্স’বা দৃশ্যপরম্পরা সৃষ্টি হয়। ৪৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ড সময়ের ‘ধূসরযাত্রা’র আঙ্গিক গঠিত হয়েছে এরকম অসংখ্য ‘শট’ ও ‘সিকোয়েন্স’ নিয়ে। এসবই পরিচালকের মনন-বুনন-সৃজনে বাস্তবতার ব্যাঞ্চনায় সুস্পষ্ট। এখানে কিছু দৃশ্যের প্রসঙ্গ আলোকপাত করা হলো।

(১) ছবির শুরুটিই চমৎকার বিভিন্ন শটে রূপায়িত। করুণ সুরের মূর্ছনা। তারপর শুরু হয় সকালের বিভিন্ন দৃশ্য, প্রকৃতি, নদী, নৌকা, লঞ্চ, লঞ্চের চলাচল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ। এরপর মূল চরিত্র সোবহানের ওপর ক্যামেরা ফোকাস করে। সোবহান ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে চারদিকে তাকায়, পুতুল দেখে, এভাবেই পরিচালক সোবহানকে বাস্তব সম্মতভাবে দৃশ্যময় করে তোলে।

(২) লাশ গোসলদান শেষে গ্রিলের দোকানের পাশ দিয়ে সোবহানের আসার সময় বিভিন্ন শটে আগুনের বিচ্ছুরিত ছটার দৃশ্য তার মানসিক অবস্থার পরিচায়ক। এতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

(৩) সোবহান কর্তৃক লাশ গোসল করানো, সারি সারি সাজানো লাশ, এম্বুলেন্সের চলাচলের দৃশ্যগুলোও বাস্তব সম্মতভাবে চিত্রায়িত।

(৪) মসজিদ কমিটির সভাপতির বাসা, সোবহান ও ইমাম সাহেবের কথোপকথন, রক্ষিতার রূপসজ্জার দৃশ্যগুলোও গভীর অর্থবোধক।

(৫) ছবির শেষ সিকোয়েন্সটি ক্যামেরার বিভিন্ন এঙ্গেল ও শট উদ্ভাসিত। সোবহানের মৃত্যু, শেষ যাত্রার শেষ আয়োজনে পুতুল ও পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দৃশ্য, এম্বুলেন্সের যাত্রা, নদীর বহমান স্রোতে, চলমান লঞ্চ, জীবন ও মৃত্যুর ব্যঞ্জনায় সিক্ত।

‘ধূসরযাত্রা’র এরকম আরো বহু দৃশ্য রয়েছে যা পরিচালকের পরিকল্পিত সৃজন নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহন করে।

ধ্বনিমাত্রা: শব্দ বা ধ্বনি চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাস্তবতার কারণেই এর প্রয়োগ ঘটে থাকে। ‘ধূসরযাত্রা’র আঙ্গিক ও কাঠামোজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শব্দ বা ধ্বনির প্রয়োগ। এই ধ্বনি ব্যবহৃত হয়েছে কখনো সংলাপে, কখনো গান বা সংগীত, কখনো কান্নায় বা বাঁশিতে বা কাশিতে কখনো পরিপাশির্^কতার স্বাভাবিকতার আবহে। চলচ্চিত্রের মূল প্রতিপাদ্য অনুসারে রয়েছে বাঁশির করুণ সুর। পরিবেশ অনুযায়ী নদীতে চলন্ত জাহাজের শব্দ, সিটি, মৃতের বাড়িতে নারীর কান্নার সুর, কোরআন পাঠের শব্দ, সোবহান-ইমাম-করিম সাহেব, দোকানদার-খদ্দেরদের সংলাপ, কথোপকথন পতিতার খিস্তিখেউড়। ছবির শেষ দৃশ্যে রয়েছে পানিতে পড়া ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ। অন্যদিকে পরিবেশ অনুযায়ী রয়েছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, এম্বুলেন্সের শব্দ এবং সোবহানের কাশির শব্দও। ধ্বনি ব্যঞ্জনার সংযুক্ত হয়েছে দু’টি গানও। একটি রবীন্দ্র সংগীত ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ এবং লোকগান ‘বন্ধু রঙ্গিলা, রঙ্গিলারে, আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলারে?’ গান দুটোর ব্যবহার দৃশ্য কাব্যের বাস্তবতার সাথে পরিবেশ প্রতিবেশের সাথে, চরিত্রের পারিপাশির্^ক অবস্থার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

অন্যান্য:‘ধূসরযাত্রা’ চলচ্চিত্রের আরেকটি সম্পদ হলো লোকজ উপাদানের ব্যবহার। যেমন পুতুলের ব্যবহার। এটি সোবহানের ২৫ বছর আগে মৃত স্ত্রীর প্রতীক। বিভিন্ন ব্যবস্থায় সোবহান পুতুলের সাথে একা একাই কথা বলেছে এমনকি মৃত্যুর পর যদি আবার জীবিত হয় তবে দু’জন একত্রে বসে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখার ইচ্ছেও ব্যক্ত করেছে। তার মৃত্যুর সময় এবং পরেও ক্যামেরার পুতুলটিকে ফোকাস করা হয়েছে। চিত্রে পুতুল হয়ে উঠেছে জীবন্ত মানবী। লোকজ সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে পুতুলের ব্যবহার চিত্রের ব্যঞ্জনাকে মূর্ত করেছে।

এছাড়া লোকজ উপাদান হিসেবে গান, বাঁশি, মৃতের বাড়িতে কান্না, কোরান পাঠ, হাঁড়িপাতিল, বালতি, আগরবাতি, নৌকার ব্যবহারও দৃষ্ট হয়। অন্যদিকে আধুনিক যানবাহন লঞ্চ, এম্বুলেন্সের ব্যবহার, ছোঁয়াচে মরণব্যাধি ‘করোনা’র প্রকোপ পরিচালকের সচেতনতার পরিচায়ক।

‘ধূসরযাত্রা’ বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনি চিত্রের ইতিহাসে নবতর সংযোজন। এ ধরনের কাহিনি নিয়ে ইতোপূর্বে আর কোনো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে কিনা জানা নেই। এর আখ্যান গড়ে উঠেছে পেশাদার লাশ গোসল প্রদানকারী সোবহানের কার্যক্রম ও বিনা গোসলে তারই লাশ দাফন-কাফন নিয়ে

সম্পাদনামাত্রা: ‘ধূসরযাত্রা’ একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র। পরিচালক ও সম্পাদককে এই চিন্তা মাথায় রেখে অত্যন্ত সুকৌশলে সম্পাদনার কাজটি করতে হয়েছে। ছবির দৃশ্যরূপ, ধ্বনির মাত্রা, পরিবেশ-প্রতিবেশ, চরিত্রের আচার-আচরণ মানসিক অবস্থা, ঘটনার গুরুত্ব এসব মনে রেখে সম্পাদনার প্রয়োগ ঘঠেছে এই চিত্রে। ছবির শুরুতে নির্মাতা বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছেন সম্ভাব্য ঘটনার। আবার শেষ দৃশ্যেও প্রায়ই অনুরূপ দৃশ্যের সংযোজন ঘটে: নদী বহমান, লঞ্চ চলমান, প্রকৃতি ও সজীব, পুতুলটিও যথাস্থানে। শুধু নেই মুর্দা গোসল প্রদানকারী সোবহান। বিনা গোসলে তার লাশ নিয়ে চলে যাচ্ছে এম্বুলেন্স। ‘ধূসরযাত্রা’র এই আয়োজনটি বিভিন্ন শট ও শব্দের মিশ্রণে সুসম্পাদনার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আবেগময় পরিবেশের। কবির ভাষায় এ যেন ‘আমাকে কিছু কান্নার কুসুম দাও’। ছবিতে চিল ওড়ার দৃশ্য, কুকুরের দৃশ্য, করিম সাহেবের বাড়িতে রক্ষিতার প্রসাধনের দৃশ্য, রাস্তার পুলিশের আচরণ, সোবহানের লাশ গোসল করানোর দৃশ্য, পুতুলের সাথে কথা বলার দৃশ্য দোকানে ঝুলন্ত কলার দৃশ্য ইত্যাদির সংযোজন ‘ধূসরযাত্রা’র ব্যঞ্জনার মাত্রাকে করেছে সমৃদ্ধ।

উপসংহার:বিষয়বস্তু ও নির্মাণ কুশলতায় ‘ধূসরযাত্রা’ একটি সার্থক চলচ্চিত্র। এর প্রতিটি শট উচ্চারিত হয়েছে আত্মার ক্রন্দন। ‘ধূসরযাত্রা’ দৃশ্যে, শব্দে, বিষয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রায় উচ্চরিত হবে আশা করি।

back to top