alt

সাময়িকী

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

খোরশেদ বাহার

: বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

স্থপতি রবিউল হুসাইন, সমাজ সংসারের আর দশজন মানুষের মতো অবয়বের একজন মানুষ কিংবা একটু ব্যতিক্রম অথবা নিতান্ত স্বাতন্ত্র্যে ভরা অন্য একজন, তাঁর পরিপূর্ণ বিশ্লেষণের অক্ষম আয়োজন নিয়েই কিছু বলবার প্রয়াস এখানে। তিনি শুধুই স্থপতি নন কিংবা ছিলেন না শুধু একজন কবি, একজন সংগঠক, চিত্র বিশ্লেষক কিংবা চলচ্চিত্রের সমালোচক, তিনি ছিলেন আপদমস্তক প্রচলিত গতিধারার বাইরে একেবারেই আপনধারার একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তাঁর পরিচয় শুধু তিনি নিজেই, অন্য কোনো অবয়বে কিংবা অন্য কোনো মাপকাঠিতেই তাঁর পরিমাপ হয়তোবা সম্পূর্ণ হবে না। কোনো স্মৃতি রোমন্থনেই, তিনি হয়তো পরিস্ফুটিত হবেন না নির্দিষ্ট কোনো ভাবধারার প্রতিবিম্বে। অস্পষ্ট কোনো ছায়া স্পষ্টতারও অধিকরূপে সারাক্ষণ থেকে যাবে ক্যামেরার লেন্সের বাইরে। ছবি আঁকার ক্যানভাসে যতটুকু জায়গা আছে তাঁর চৌহদ্দি অতিক্রম করে একটু ভিন্নতা, ভিন্ন রূপেই ঠাঁই করে নেবে অন্য কোথাও। এই যে পরিষ্ফুটনবিহীন আঙ্গিক যা সারাক্ষণ থেকে যায় দৃষ্টির অন্তরালে, যা মূল্যায়নের মানদণ্ডের অতীত। তাঁকে গোচরে আনবার শক্তিশালী বিচক্ষণতা আমার নেই, সুতরাং আজ এই বর্ণানাতে কখনই সম্পূর্ণ হবেন না স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন।

জগৎ সংসারের এই জটিল ফ্রেমের গোলকধাঁধায় মানুষ যখন ক্রমশ আপন অস্তিত্বের সন্নিকটে আপনার হয়ে খাবি খাচ্ছি প্রতিনিয়ত, ঠিক সেই ফ্রেমের কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন রবিউল হুসাইন। তিনি ছিলেন আমাদের রবিদা, কারও রবিউল ভাই, পরিবারের মিয়া ভাই। এই সব নিজস্বতা তাঁকে তাঁর কেন্দ্রবিন্দুতে আকৃষ্ট করে রাখেনি। তিনি স্থির ছিলেন তাঁর বিশ্বাসে, কর্মচেতনায় আর দায়িত্ববোধের কঠিন ঘেরাটোপে। এর সবটাই ছিল তাঁর আপন স্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত, একান্ত নিজস্ব গতি ধারায় বহতা নদীর ধীর প্রবাহের মতো। রাতের স্নিগ্ধতা, দিনের খরতাপ, উদাস প্রকৃতি ব্যস্ততম নগরীর দূষিত প্রবাহ, কোনো কিছুই তাঁকে বিশ্বাসের বলয় থেকে ছিন্ন করতে পারেনি এতটুকুন। শত প্রতিকূলতা আর বৈরী ভাবাপন্ন চারিপাশে তিনি ছড়িয়ে রেখেছিলেন আপনার মাধুর্য আপন মহিমায়, সারল্য ভরা ভাবনায় সারাক্ষণ।

মানুষকে কাছে টানবার কিংবা কাছে ধরে রাখবার এক অদ্ভুত কৌশল করায়ত্ত করেছিলেন তিনি। শত প্রতিকূলতা ছাপিয়ে নিজের ভালোলাগার সুগন্ধি ছড়িয়েছেন আপনার চারপাশে। সাবলীল ভাবধারায় স্বচ্ছতার সপ্রশংস প্রকাশ একেবারেই ব্যক্তিগত কায়দায় চর্চা করেছেন, সম্পূর্ণ নিজস্ব মহিমায়। সুতরাং কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বয়সের বিভেদ রবিদা থোরাই কেয়ার করতেন। বাহ্যিক অবয়ব কখনোই তাঁর মুখ্য বিষয় ছিল না। ছেলে মেয়ে বিভেদও অনেক ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল না তাঁর মস্তিষ্কের চেতনার জগতে। নিজের খুব কাছে থেকেই নিজের মতো করে সবাইকে গ্রহণ করবার এক মনোজাগতিক সমৃদ্ধি তাঁর ছিল। আপন বলয়ের চারপাশের মানুষকে বয়স বুদ্ধি আর লিঙ্গ নির্বিচারে সারাক্ষণ আপনার ভেবেছেন। আর ভেবেছেন শুধু নয় মিশে গেছেন সবার সাথে প্রবল আগ্রহে। স্থান কাল পাত্রের সমৃদ্ধি জ্ঞানও ছিল তাঁর দখলে। সেই দখলীস্বত্ব দিয়ে সবাইকে শাসন করেছেন আপন গ্রাহ্যতায়।

পরিবারের মিয়াভাই রবিউল হুসাইন আপন গুণেই পরিবারের সকলের কাছে এক ভিন্নমাত্রার মানুষ। তিনি সবাইকে নিজগুণে আপনার চেয়েও আপন ভেবেছেন। সবার প্রয়োজনকে ছাপিয়ে তিনি অতি প্রয়োজনীয় আবশ্যিক কিছু এমন নয়, তবে ভিন্ন কিছু একান্তই ভিন্নতর। পরিবারিক মিলনমেলায় তিনি একেবারে শুদ্ধাচারী এক অভিনব বিমূর্ত প্রতীক। সবার চাহনীতে, চঞ্চলতায়, আর শ্রদ্ধায় তিনি ছিলেন স্বাপ্নিক এক কাব্যিক মিয়াভাই। বাংলাদেশের হাজার হাজার নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের ঘরে এমনতরো দৃশ্য বিরল। শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন সত্যিই বেমানান। হাজার উপমায় তিনি একটি নন একেবারে নির্দিষ্ট একটি স্থানে। মধ্যবিত্তের চরিত্র বিশ্লেষণের ধারায় এমনতরো মিয়াভাইরা সাধারণতই পরিণত অচরণে সর্বদা সিদ্ধহস্ত। জ্ঞান ধ্যান আবেগ শিষ্টাচার কিংবা আকাক্সক্ষায় পারিবারিক এক মুকুটহীন সম্রাটের মতোই আসীন থাকতে চান পারিবারিক সিংহাসনে। কিন্তু চিরচঞ্চল, উচ্ছল, বন্ধুবৎসল এই মানুষটি স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীতে সারাক্ষণ এবং শেষ নিশ্বাসের মুহূর্তেও প্রাণপ্রিয় মিয়াভাইয়ের ভূমিকায় সদর্ভে বিচরণ করেছেন সবার অন্তরাত্মায়। এ কেবল একজন মানুষ রবিউল হুসাইনের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

জীবন ঘনিষ্ঠ রসবোধ। হঠাৎ করেই অন্তরাত্মায় উচ্চারিত হয় আহা। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জাগ্রত বোধগুলি জীবনের মোহনায় প্রায়শই বাক গড়িয়ে চলে যায় অন্যধারায় কিংবা লুটিয়ে পড়ে ধুলায়। কে তাকে শৃঙ্খলিত করে নিজস্ব গণ্ডিতে? রবিদা অতি সযতনে তা কুড়িয়ে নিজের মাঝে ঠাঁই করে দিতেন, ধরে রাখতেন ততক্ষণ যতক্ষণ তাঁর যথাযথ প্রায়োগিক দিকগুলি খুঁজে না পাওয়া যায়। শুধুমাত্র জীবনের কলাগুলিতে নয়, কৌশলগুলিতেও তিনি ছিলেন এমনই ভিন্ন মাত্রিক। চলতে পথে যা কিছু উচ্ছিষ্ট কিংবা অপাংক্তেয় রূপ-রস বিবর্জিত তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি এমন সব তুচ্ছ জিনিসও। সযত্নে তুলে এনেছেন আপন হাতের তালুতে। আর তাকে প্রাণের আবেশে আকৃষ্ট করে তুলেছেন নিজের চারপাশে, সে এক ভিন্ন রকম সৌন্দর্য।

নিজস্বতা তাঁর অবয়ব জুড়ে খেলা করত সর্বদা। কথনে, চলনে কিংবা বলনে, ভাবের বিনিময়ে সারাক্ষণ তিনি ছিলেন আপন মহিমায় অবিচল স্থির অথচ সমৃদ্ধ। পালকহীন পাখির মতো নিভৃতচারী আর ভারি তরলের মতো নিজস্ব ব্যাপ্তিতে স্থির।

কবি রবিউল হুসাইনের সাথে আমার পরিচয় কবিতার পথ ধরে। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে ছিল সে পথের পরিভ্রমণ। পুরোধা ছিলেন আরেক দিকপাল কবি বেলাল চৌধুরী। এঁদের সাথে চলতে চলতে অনেক মহাজনের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাদের অনেকেই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। উল্লেখ্য বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, সাযযাদ কাদির, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। বেলাল ভাই একদিন পড়ন্ত বিকেলে আমাকে সাথে নিয়ে শহীদুল্লাহ এন্ড এ্যাসোসিয়েটস-এর নাহার গার্ডেনে গিয়েছিলেন ২০০৪ সালের এপ্রিলে। খুব কাছে থেকে দেখছিলাম সেদিন রবিদাকে। বেলাল ভাই তাঁকে রবিদা সম্বোধন করতেন, সেই থেকেই তিনি আমার এবং আমাদের অনেকের রবিদা। নিমেষে মানুষকে কাছে টানবার এবং সময় বয়স পেশা সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে মৌলিক এক সাধারণ সত্তার টানে যে নিবিড় সম্পর্কের বন্ধন এত দৃঢ় হতে পারে এবং চিরস্থায়ী অটুট হতে পারে এ তার এক বিরল উদাহরণ। যত সময় এগিয়েছে তার চেয়ে অধিক হয়েছি এ মানুষটির সাথে। ব্যক্তি জীবনে সার্বিক মাত্রায় ঘনিষ্ঠ সারল্য আর অসীম অন্তিম উদারতাই তাঁর মানবিক গুণাবলীর মূলধন। সেই মূলধনের লভ্যাংশই আমাদের প্রতি তাঁর অনাবিল ভালোবাসা।

কর্মচঞ্চল দিনের শেষ ক্ষণে অফিসের কাজের পাট চুকিয়ে অথবা সেগুনবাগিচা কচি-কাঁচার আসরের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টেনে তিনি সোজা চলে আসতেন আমার অফিসে। একসাথে সময় উজাড় করেছি কতো। তাঁর পত্রিকা পড়বার ঢং ছিল বড়ই বিচিত্র। কোনোকিছুকেই ছেড়ে দিতেন না। প্রথম পাতার প্রথম কলাম থেকে শেষ পাতার শেষ কলাম কিছুকেই উপেক্ষা করতেন না তিনি। এতো মনোযোগী পাঠক এবং বিষয়বস্তুর নিখুঁত সামলোচনা করবার ধীশক্তি আমি চাক্ষুষ আর কারো মধ্যে লক্ষ করিনি।

ব্যক্তি রবিদার কথা, প্রতিদিনের ছোটখাট অভিজ্ঞান এতোকিছু তুলে ধরবার স্থান এটি নয়, তবুও কোনটা ছেড়ে কোনটাকে তুলে ধরব- এ সংশয় আমাকে সীমিত করছে। আমি সত্যি আর এগুতে পারছি না। কবি রবিউল হুসাইন স্থপতি রবিউল হুসাইন সম্পর্কে অনেকেই অনেকভাবে তাঁকে উপস্থাপন করেছেন। আমি যথাসম্ভব সবার লেখাগুলোতেই মনোনিবেশ করবার চেষ্টা করেছি। তাঁদের আলোচনা কিংবা লেখাগুলোকে নিজের দেখা রবিদার সাথে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি। সবাই তাদের আবেগ অনুভূতি দিয়ে একটি মাত্রা তৈরি করেছেন। খুব কম চোখে পড়েছে রবিদার সম্পর্কে ভিন্নতর এক চারিত্রিক মাত্রার উপস্থাপন। বিশাল সে চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে একটু পরিষ্ফুটিত করতে না পারলে তাঁর মনোজাগতিক অবয়ব হয়ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

প্রচারবিমুখতা এবং তীক্ষ্ণ প্রসারিত দৃষ্টি দুই-ই বড় লক্ষণীয় ছিল রবিদার জীবনে। আজন্ম ভিন্ন ধারায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। প্রায়শই কৌতুক করে বলতেন “চলেন কোথাও গিয়ে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখে আসি।” মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অহেতুক লৌকিকতা কিংবা প্রাণহীন অপ্রাসঙ্গিক আপন প্রকাশ দূর থেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। অথচ তাঁর অন্ধকার ভ্রুকুটি কখনোই অপর পক্ষকে স্পর্শ করত না। সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের এযুগের নিজের মূল্যমানকে সর্বদা সমুন্নত রেখেছেন। নিজের উপর অর্পিত সমস্ত দায়িত্ববোধকে নিরলসভাবে পালন করেছেন, বাহুল্য বিবর্জিতভাবে। সম্ভাবনার দুয়ারে কড়া নেড়েছেন অতি যতনে বিচক্ষণতা আর ধৈর্যের সাথে। অসীম ধৈর্য আর আত্মবিশ্বাসের অপর নাম মানুষ রবিউল হুসাইন। সুস্পষ্ট লক্ষ্য করেছি কী মেধা আর শ্রম দিয়ে ‘চিত্রা প্রকাশনী’র মতো একটি ছোট কিন্তু ভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠানকে তিনি তিলে তিলে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন আজকের এই সমৃদ্ধ অবস্থানে। প্রকাশনা জগতের আর দশটি প্রতিষ্ঠান থেকে তার মৌলিক অবস্থানকে পেশাধর্মী করে তুলবার আপ্রাণ সহযোগিতা তাঁর ছিল। তিনি আর বেলাল ভাই ছিলেন ‘চিত্রা প্রকাশনী’র জন্মের কারিগর।

কবিতা নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল অনেক। তুমি মার্কা কবিতাকে সদম্ভে বর্জন করেছেন তিনি। স্থাপত্যকলা আর কবিতাকে মিলেমিশে একত্রে ঠাঁই করে দেবার প্রয়াস ছিল তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। নন্দন শৈলীতে আর মানবীয়বোধের প্রকাশে ভরপুর। সেই সাথে মনুষ্য সমাজের সচেতনতা, অগ্রগণ্য। জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা শিল্পগুণসমৃদ্ধ হৃদয়গ্রাহী এক রচনা সম্ভার। মহত্তম অনুভবের শাব্দিক শৈলীর এক নিগূঢ়তম উচ্চারণ, স্বপ্ন আর আশার ঠাসা বুনন, মানুষের আত্মপলব্ধির এক সার্বিক ক্যানভাস। তাঁর ছোটগল্পগুলিও জীবনের কথা বলে। প্রাত্যহিক জীবনের বৈরী প্রতিবেশ আর তা উত্তরণের কথাও উঁকি দেয়, তাঁর বিভিন্ন ছোটগল্পে। রবিদা দেশের মাটি আর মানুষের কথাগুলো নিজের করে সাজিয়েছেন সকলের জন্য বড় মমতা মাখা উপলব্ধি দিয়ে, জীবনঘনিষ্ঠ করে, উপমায়, প্রতীকে আর চিত্রকল্পে। এ ছিলো তাঁর বিশেষ পারঙ্গমতা। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং স্বতন্ত্র থেকে উজ্জীবিত সব তাঁর লেখা: কী গল্প, কী কবিতা, কী শিশু-সাহিত্য, কী উপন্যাস!

সফল স্থপতি এই কবি মানবিক মূল্যবোধে ছিলেন সর্বদা সমুজ্জ্বল। আপন জীবনঘনিষ্ঠতায় বিমুখ এই মানুষটি, কী এক অদ্ভুত গুণাবলীতে ছিলেন যতটুকু সর্বজন জীবনঘনিষ্ঠ, তেমনি ততটুকুই আপনবিমুখ। নিজস্ব কথনে কখনোই রঞ্জিত করেননি চারপাশ। চারপাশের কাউকেই বিমুখ করেননি নূন্যতম সঙ্গসুখের সুখানুভূতি থেকে। মগজে মননে সর্বদা ফুটিয়ে রাখতেন চিত্রকলাকে। পেইন্টিং তাঁর ভালো লাগার আর একটি ক্ষেত্র। স্থপত্য, চিত্রকলা, আর শব্দ নিয়ে খেলবার এক অসামান্য সাহস তাঁর কলমে মূর্ত হয়ে উঠেছে কাব্যের ঝলকানিতে। কোনটি ছেড়ে কোনটির আলাদা সত্তা কল্পনা করা বেশ দুরূহ। সবকিছু নিয়ে এক টেবিলে একসময়ে একটু মনোনিবেশ করলে বেশ বোঝা যায় তাঁর সৃষ্টির সব কিছুই এক সূত্রে গাঁথা আর সেই গাঁথুনির ভিত্তিই মানুষ রবিউল হুসাইন- মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ নিভৃতচারী, একাকিত্বের দোসর, প্রচার বিমুখ, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক একজন রবিদা।

তাঁর বিশ্বাসের সূত্র ধরেই বলতে ইচ্ছে করে,

“অবস্থান নয়, প্রস্থানেই বাড়ে

দিগন্ত মৃত্যু আর মানুষের মন

(কর্পূরের ডানাঅলা বরফের পাখি)

তাঁর প্রস্থানে আমরা যেন প্রসারিত হই তাঁরই মতো বিস্তৃত দিগন্তরেখা অবধি। সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকি সকল মানুষের মনে। যে মনে সর্বদা সতত জাগ্রত থাকবেন একজন কবি ও স্থপতি সর্বোপরি মানুষ রবিউল হুসাইন।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

খোরশেদ বাহার

বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

স্থপতি রবিউল হুসাইন, সমাজ সংসারের আর দশজন মানুষের মতো অবয়বের একজন মানুষ কিংবা একটু ব্যতিক্রম অথবা নিতান্ত স্বাতন্ত্র্যে ভরা অন্য একজন, তাঁর পরিপূর্ণ বিশ্লেষণের অক্ষম আয়োজন নিয়েই কিছু বলবার প্রয়াস এখানে। তিনি শুধুই স্থপতি নন কিংবা ছিলেন না শুধু একজন কবি, একজন সংগঠক, চিত্র বিশ্লেষক কিংবা চলচ্চিত্রের সমালোচক, তিনি ছিলেন আপদমস্তক প্রচলিত গতিধারার বাইরে একেবারেই আপনধারার একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তাঁর পরিচয় শুধু তিনি নিজেই, অন্য কোনো অবয়বে কিংবা অন্য কোনো মাপকাঠিতেই তাঁর পরিমাপ হয়তোবা সম্পূর্ণ হবে না। কোনো স্মৃতি রোমন্থনেই, তিনি হয়তো পরিস্ফুটিত হবেন না নির্দিষ্ট কোনো ভাবধারার প্রতিবিম্বে। অস্পষ্ট কোনো ছায়া স্পষ্টতারও অধিকরূপে সারাক্ষণ থেকে যাবে ক্যামেরার লেন্সের বাইরে। ছবি আঁকার ক্যানভাসে যতটুকু জায়গা আছে তাঁর চৌহদ্দি অতিক্রম করে একটু ভিন্নতা, ভিন্ন রূপেই ঠাঁই করে নেবে অন্য কোথাও। এই যে পরিষ্ফুটনবিহীন আঙ্গিক যা সারাক্ষণ থেকে যায় দৃষ্টির অন্তরালে, যা মূল্যায়নের মানদণ্ডের অতীত। তাঁকে গোচরে আনবার শক্তিশালী বিচক্ষণতা আমার নেই, সুতরাং আজ এই বর্ণানাতে কখনই সম্পূর্ণ হবেন না স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন।

জগৎ সংসারের এই জটিল ফ্রেমের গোলকধাঁধায় মানুষ যখন ক্রমশ আপন অস্তিত্বের সন্নিকটে আপনার হয়ে খাবি খাচ্ছি প্রতিনিয়ত, ঠিক সেই ফ্রেমের কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন রবিউল হুসাইন। তিনি ছিলেন আমাদের রবিদা, কারও রবিউল ভাই, পরিবারের মিয়া ভাই। এই সব নিজস্বতা তাঁকে তাঁর কেন্দ্রবিন্দুতে আকৃষ্ট করে রাখেনি। তিনি স্থির ছিলেন তাঁর বিশ্বাসে, কর্মচেতনায় আর দায়িত্ববোধের কঠিন ঘেরাটোপে। এর সবটাই ছিল তাঁর আপন স্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত, একান্ত নিজস্ব গতি ধারায় বহতা নদীর ধীর প্রবাহের মতো। রাতের স্নিগ্ধতা, দিনের খরতাপ, উদাস প্রকৃতি ব্যস্ততম নগরীর দূষিত প্রবাহ, কোনো কিছুই তাঁকে বিশ্বাসের বলয় থেকে ছিন্ন করতে পারেনি এতটুকুন। শত প্রতিকূলতা আর বৈরী ভাবাপন্ন চারিপাশে তিনি ছড়িয়ে রেখেছিলেন আপনার মাধুর্য আপন মহিমায়, সারল্য ভরা ভাবনায় সারাক্ষণ।

মানুষকে কাছে টানবার কিংবা কাছে ধরে রাখবার এক অদ্ভুত কৌশল করায়ত্ত করেছিলেন তিনি। শত প্রতিকূলতা ছাপিয়ে নিজের ভালোলাগার সুগন্ধি ছড়িয়েছেন আপনার চারপাশে। সাবলীল ভাবধারায় স্বচ্ছতার সপ্রশংস প্রকাশ একেবারেই ব্যক্তিগত কায়দায় চর্চা করেছেন, সম্পূর্ণ নিজস্ব মহিমায়। সুতরাং কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বয়সের বিভেদ রবিদা থোরাই কেয়ার করতেন। বাহ্যিক অবয়ব কখনোই তাঁর মুখ্য বিষয় ছিল না। ছেলে মেয়ে বিভেদও অনেক ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল না তাঁর মস্তিষ্কের চেতনার জগতে। নিজের খুব কাছে থেকেই নিজের মতো করে সবাইকে গ্রহণ করবার এক মনোজাগতিক সমৃদ্ধি তাঁর ছিল। আপন বলয়ের চারপাশের মানুষকে বয়স বুদ্ধি আর লিঙ্গ নির্বিচারে সারাক্ষণ আপনার ভেবেছেন। আর ভেবেছেন শুধু নয় মিশে গেছেন সবার সাথে প্রবল আগ্রহে। স্থান কাল পাত্রের সমৃদ্ধি জ্ঞানও ছিল তাঁর দখলে। সেই দখলীস্বত্ব দিয়ে সবাইকে শাসন করেছেন আপন গ্রাহ্যতায়।

পরিবারের মিয়াভাই রবিউল হুসাইন আপন গুণেই পরিবারের সকলের কাছে এক ভিন্নমাত্রার মানুষ। তিনি সবাইকে নিজগুণে আপনার চেয়েও আপন ভেবেছেন। সবার প্রয়োজনকে ছাপিয়ে তিনি অতি প্রয়োজনীয় আবশ্যিক কিছু এমন নয়, তবে ভিন্ন কিছু একান্তই ভিন্নতর। পরিবারিক মিলনমেলায় তিনি একেবারে শুদ্ধাচারী এক অভিনব বিমূর্ত প্রতীক। সবার চাহনীতে, চঞ্চলতায়, আর শ্রদ্ধায় তিনি ছিলেন স্বাপ্নিক এক কাব্যিক মিয়াভাই। বাংলাদেশের হাজার হাজার নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের ঘরে এমনতরো দৃশ্য বিরল। শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন সত্যিই বেমানান। হাজার উপমায় তিনি একটি নন একেবারে নির্দিষ্ট একটি স্থানে। মধ্যবিত্তের চরিত্র বিশ্লেষণের ধারায় এমনতরো মিয়াভাইরা সাধারণতই পরিণত অচরণে সর্বদা সিদ্ধহস্ত। জ্ঞান ধ্যান আবেগ শিষ্টাচার কিংবা আকাক্সক্ষায় পারিবারিক এক মুকুটহীন সম্রাটের মতোই আসীন থাকতে চান পারিবারিক সিংহাসনে। কিন্তু চিরচঞ্চল, উচ্ছল, বন্ধুবৎসল এই মানুষটি স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীতে সারাক্ষণ এবং শেষ নিশ্বাসের মুহূর্তেও প্রাণপ্রিয় মিয়াভাইয়ের ভূমিকায় সদর্ভে বিচরণ করেছেন সবার অন্তরাত্মায়। এ কেবল একজন মানুষ রবিউল হুসাইনের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

জীবন ঘনিষ্ঠ রসবোধ। হঠাৎ করেই অন্তরাত্মায় উচ্চারিত হয় আহা। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জাগ্রত বোধগুলি জীবনের মোহনায় প্রায়শই বাক গড়িয়ে চলে যায় অন্যধারায় কিংবা লুটিয়ে পড়ে ধুলায়। কে তাকে শৃঙ্খলিত করে নিজস্ব গণ্ডিতে? রবিদা অতি সযতনে তা কুড়িয়ে নিজের মাঝে ঠাঁই করে দিতেন, ধরে রাখতেন ততক্ষণ যতক্ষণ তাঁর যথাযথ প্রায়োগিক দিকগুলি খুঁজে না পাওয়া যায়। শুধুমাত্র জীবনের কলাগুলিতে নয়, কৌশলগুলিতেও তিনি ছিলেন এমনই ভিন্ন মাত্রিক। চলতে পথে যা কিছু উচ্ছিষ্ট কিংবা অপাংক্তেয় রূপ-রস বিবর্জিত তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি এমন সব তুচ্ছ জিনিসও। সযত্নে তুলে এনেছেন আপন হাতের তালুতে। আর তাকে প্রাণের আবেশে আকৃষ্ট করে তুলেছেন নিজের চারপাশে, সে এক ভিন্ন রকম সৌন্দর্য।

নিজস্বতা তাঁর অবয়ব জুড়ে খেলা করত সর্বদা। কথনে, চলনে কিংবা বলনে, ভাবের বিনিময়ে সারাক্ষণ তিনি ছিলেন আপন মহিমায় অবিচল স্থির অথচ সমৃদ্ধ। পালকহীন পাখির মতো নিভৃতচারী আর ভারি তরলের মতো নিজস্ব ব্যাপ্তিতে স্থির।

কবি রবিউল হুসাইনের সাথে আমার পরিচয় কবিতার পথ ধরে। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে ছিল সে পথের পরিভ্রমণ। পুরোধা ছিলেন আরেক দিকপাল কবি বেলাল চৌধুরী। এঁদের সাথে চলতে চলতে অনেক মহাজনের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাদের অনেকেই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। উল্লেখ্য বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, সাযযাদ কাদির, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। বেলাল ভাই একদিন পড়ন্ত বিকেলে আমাকে সাথে নিয়ে শহীদুল্লাহ এন্ড এ্যাসোসিয়েটস-এর নাহার গার্ডেনে গিয়েছিলেন ২০০৪ সালের এপ্রিলে। খুব কাছে থেকে দেখছিলাম সেদিন রবিদাকে। বেলাল ভাই তাঁকে রবিদা সম্বোধন করতেন, সেই থেকেই তিনি আমার এবং আমাদের অনেকের রবিদা। নিমেষে মানুষকে কাছে টানবার এবং সময় বয়স পেশা সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে মৌলিক এক সাধারণ সত্তার টানে যে নিবিড় সম্পর্কের বন্ধন এত দৃঢ় হতে পারে এবং চিরস্থায়ী অটুট হতে পারে এ তার এক বিরল উদাহরণ। যত সময় এগিয়েছে তার চেয়ে অধিক হয়েছি এ মানুষটির সাথে। ব্যক্তি জীবনে সার্বিক মাত্রায় ঘনিষ্ঠ সারল্য আর অসীম অন্তিম উদারতাই তাঁর মানবিক গুণাবলীর মূলধন। সেই মূলধনের লভ্যাংশই আমাদের প্রতি তাঁর অনাবিল ভালোবাসা।

কর্মচঞ্চল দিনের শেষ ক্ষণে অফিসের কাজের পাট চুকিয়ে অথবা সেগুনবাগিচা কচি-কাঁচার আসরের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টেনে তিনি সোজা চলে আসতেন আমার অফিসে। একসাথে সময় উজাড় করেছি কতো। তাঁর পত্রিকা পড়বার ঢং ছিল বড়ই বিচিত্র। কোনোকিছুকেই ছেড়ে দিতেন না। প্রথম পাতার প্রথম কলাম থেকে শেষ পাতার শেষ কলাম কিছুকেই উপেক্ষা করতেন না তিনি। এতো মনোযোগী পাঠক এবং বিষয়বস্তুর নিখুঁত সামলোচনা করবার ধীশক্তি আমি চাক্ষুষ আর কারো মধ্যে লক্ষ করিনি।

ব্যক্তি রবিদার কথা, প্রতিদিনের ছোটখাট অভিজ্ঞান এতোকিছু তুলে ধরবার স্থান এটি নয়, তবুও কোনটা ছেড়ে কোনটাকে তুলে ধরব- এ সংশয় আমাকে সীমিত করছে। আমি সত্যি আর এগুতে পারছি না। কবি রবিউল হুসাইন স্থপতি রবিউল হুসাইন সম্পর্কে অনেকেই অনেকভাবে তাঁকে উপস্থাপন করেছেন। আমি যথাসম্ভব সবার লেখাগুলোতেই মনোনিবেশ করবার চেষ্টা করেছি। তাঁদের আলোচনা কিংবা লেখাগুলোকে নিজের দেখা রবিদার সাথে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি। সবাই তাদের আবেগ অনুভূতি দিয়ে একটি মাত্রা তৈরি করেছেন। খুব কম চোখে পড়েছে রবিদার সম্পর্কে ভিন্নতর এক চারিত্রিক মাত্রার উপস্থাপন। বিশাল সে চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে একটু পরিষ্ফুটিত করতে না পারলে তাঁর মনোজাগতিক অবয়ব হয়ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

প্রচারবিমুখতা এবং তীক্ষ্ণ প্রসারিত দৃষ্টি দুই-ই বড় লক্ষণীয় ছিল রবিদার জীবনে। আজন্ম ভিন্ন ধারায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। প্রায়শই কৌতুক করে বলতেন “চলেন কোথাও গিয়ে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখে আসি।” মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অহেতুক লৌকিকতা কিংবা প্রাণহীন অপ্রাসঙ্গিক আপন প্রকাশ দূর থেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। অথচ তাঁর অন্ধকার ভ্রুকুটি কখনোই অপর পক্ষকে স্পর্শ করত না। সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের এযুগের নিজের মূল্যমানকে সর্বদা সমুন্নত রেখেছেন। নিজের উপর অর্পিত সমস্ত দায়িত্ববোধকে নিরলসভাবে পালন করেছেন, বাহুল্য বিবর্জিতভাবে। সম্ভাবনার দুয়ারে কড়া নেড়েছেন অতি যতনে বিচক্ষণতা আর ধৈর্যের সাথে। অসীম ধৈর্য আর আত্মবিশ্বাসের অপর নাম মানুষ রবিউল হুসাইন। সুস্পষ্ট লক্ষ্য করেছি কী মেধা আর শ্রম দিয়ে ‘চিত্রা প্রকাশনী’র মতো একটি ছোট কিন্তু ভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠানকে তিনি তিলে তিলে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন আজকের এই সমৃদ্ধ অবস্থানে। প্রকাশনা জগতের আর দশটি প্রতিষ্ঠান থেকে তার মৌলিক অবস্থানকে পেশাধর্মী করে তুলবার আপ্রাণ সহযোগিতা তাঁর ছিল। তিনি আর বেলাল ভাই ছিলেন ‘চিত্রা প্রকাশনী’র জন্মের কারিগর।

কবিতা নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল অনেক। তুমি মার্কা কবিতাকে সদম্ভে বর্জন করেছেন তিনি। স্থাপত্যকলা আর কবিতাকে মিলেমিশে একত্রে ঠাঁই করে দেবার প্রয়াস ছিল তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। নন্দন শৈলীতে আর মানবীয়বোধের প্রকাশে ভরপুর। সেই সাথে মনুষ্য সমাজের সচেতনতা, অগ্রগণ্য। জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা শিল্পগুণসমৃদ্ধ হৃদয়গ্রাহী এক রচনা সম্ভার। মহত্তম অনুভবের শাব্দিক শৈলীর এক নিগূঢ়তম উচ্চারণ, স্বপ্ন আর আশার ঠাসা বুনন, মানুষের আত্মপলব্ধির এক সার্বিক ক্যানভাস। তাঁর ছোটগল্পগুলিও জীবনের কথা বলে। প্রাত্যহিক জীবনের বৈরী প্রতিবেশ আর তা উত্তরণের কথাও উঁকি দেয়, তাঁর বিভিন্ন ছোটগল্পে। রবিদা দেশের মাটি আর মানুষের কথাগুলো নিজের করে সাজিয়েছেন সকলের জন্য বড় মমতা মাখা উপলব্ধি দিয়ে, জীবনঘনিষ্ঠ করে, উপমায়, প্রতীকে আর চিত্রকল্পে। এ ছিলো তাঁর বিশেষ পারঙ্গমতা। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং স্বতন্ত্র থেকে উজ্জীবিত সব তাঁর লেখা: কী গল্প, কী কবিতা, কী শিশু-সাহিত্য, কী উপন্যাস!

সফল স্থপতি এই কবি মানবিক মূল্যবোধে ছিলেন সর্বদা সমুজ্জ্বল। আপন জীবনঘনিষ্ঠতায় বিমুখ এই মানুষটি, কী এক অদ্ভুত গুণাবলীতে ছিলেন যতটুকু সর্বজন জীবনঘনিষ্ঠ, তেমনি ততটুকুই আপনবিমুখ। নিজস্ব কথনে কখনোই রঞ্জিত করেননি চারপাশ। চারপাশের কাউকেই বিমুখ করেননি নূন্যতম সঙ্গসুখের সুখানুভূতি থেকে। মগজে মননে সর্বদা ফুটিয়ে রাখতেন চিত্রকলাকে। পেইন্টিং তাঁর ভালো লাগার আর একটি ক্ষেত্র। স্থপত্য, চিত্রকলা, আর শব্দ নিয়ে খেলবার এক অসামান্য সাহস তাঁর কলমে মূর্ত হয়ে উঠেছে কাব্যের ঝলকানিতে। কোনটি ছেড়ে কোনটির আলাদা সত্তা কল্পনা করা বেশ দুরূহ। সবকিছু নিয়ে এক টেবিলে একসময়ে একটু মনোনিবেশ করলে বেশ বোঝা যায় তাঁর সৃষ্টির সব কিছুই এক সূত্রে গাঁথা আর সেই গাঁথুনির ভিত্তিই মানুষ রবিউল হুসাইন- মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ নিভৃতচারী, একাকিত্বের দোসর, প্রচার বিমুখ, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক একজন রবিদা।

তাঁর বিশ্বাসের সূত্র ধরেই বলতে ইচ্ছে করে,

“অবস্থান নয়, প্রস্থানেই বাড়ে

দিগন্ত মৃত্যু আর মানুষের মন

(কর্পূরের ডানাঅলা বরফের পাখি)

তাঁর প্রস্থানে আমরা যেন প্রসারিত হই তাঁরই মতো বিস্তৃত দিগন্তরেখা অবধি। সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকি সকল মানুষের মনে। যে মনে সর্বদা সতত জাগ্রত থাকবেন একজন কবি ও স্থপতি সর্বোপরি মানুষ রবিউল হুসাইন।

back to top