alt

সাময়িকী

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

নীহার মোশারফ

: বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪

কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ও বিস্ময়কর রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। জন্মের পর তিনি সংগ্রাম করতে শিখেছেন। সংগ্রাম ও ত্যাগ তাঁর পাশাপাশি থাকত। তিনি সবসময়ই উন্নত শির হয়ে ওপর থেকে নিচে পতিত হয়েছেন শক্তিধর জলপ্রপাতের মতো। রবীন্দ্রধারার পরে বাংলা সাহিত্যে তিনি অতি উচ্চমাত্রার আলাদা ধারা তৈরি করেছেন। কী কবিতা, কী গানে, কী ছন্দ-মাত্রা-অনুপ্রাসে, একটি বর্ণনামূলক কবিতা বা ছড়াকে তিনি ভাঙা-গড়ার ছকে ফেলে চির আধুনিক করেছেন। তিনি একজন প্রেমের কবি হয়েও শুধু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য সকলের কাছে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবেই অধিক পরিচিত হয়ে আছেন। তিনি একাডেমিক শিক্ষায় বেশি দূর যেতে পারেননি। অনেকের জিজ্ঞাসা, আসলে তিনি কী ডিগ্রি বা এমএ পাস করেছেন? একজন কবির একাডেমিক সনদ খুব বেশি দরকার হবে কেন? একজন কবি নিজেই তো একটি বিশ^বিদ্যালয়। শব্দের ভা-ার। বাক্য তৈরির বিশাল কারখানা। তাঁর একটি উচ্চ ডিগ্রি না থাকলেও লেখক, গবেষক, শিক্ষার্থীরা তাঁর সৃষ্টিকর্মের ওপর ডিগ্রি নিয়ে থাকেন। বাংলা সাহিত্যের প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে তিনি অত্যন্ত পড়–য়া ছিলেন। তিনি তাঁর লেখায় প্রচুর বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেছেন। যে শব্দগুচ্ছের সঙ্গে আমরা অগে কখনো পরিচিত ছিলাম না। নজরুলের গদ্য রচনায় দেখা যায় মান-অভিমানের এক সূক্ষ্ম বিষয়। নানা উপলক্ষ্যেÑ কখনোবা উপলক্ষ্য সৃষ্টি করে আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আবার কখনো প্রকাশ্যে, কখনোবা অন্তর্লগ্ন রূপে, কিন্তু সবসময়ই আনন্দিত চাঞ্চল্যে। আবার নিজেকেই তিনি বলেছেন, সত্যের তূর্যবাদক, ভগবানের হাতের বীণা।

নজরুলের জীবন রহস্যে ভরপুর। তিনি একপাশে বসে বিদ্রোহী কবিতা লিখেছেন, অন্যপাশে গেঁথেছেন প্রেমের সুর। বাংলা ভাষা বা সাহিত্যে বিদ্রোহের অপর নাম নজরুল। শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে চির উন্নত শিরে নজরুল অবিরাম লিখে গেছেন সবার জন্য। মাত্র ৪১ বছর বয়সে চিরমূক হবার আগ পর্যন্ত বহুমাত্রিক নজরুল একাধারে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সংগীতসহ শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় চূড়ান্ত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কবি চলার পথে নিয়মকানুনের বাইরে ছিলেন। কবিদের সবসময় ছকে বাধা যায় না। তাঁকে প্রেমেও বাধা যায়নি। তিনি নার্গিসকে (সৈয়দা আসার খানম) নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেও তাকে ফেলে রহস্যময় কারণে চলে গেছেন কলকাতায়। তাঁর মনের পরতে পরতে ছিল সৃষ্টি। অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তার প্রমাণ। তিনি অনেক সংগীত রচনা করেছেন।

নজরুল পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দেশের স্বার্থে যুদ্ধে গিয়েছেন। তিনি গায়ক ছিলেন। ছিলেন নায়কও। মৌলিক প্রতিভাবান এই কবি নিজস্বতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য ও বিরল এক প্রতিভা। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা সাহিত্যে যেমন বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, তেমনি উজ্জীবিত করেছে ব্রিটিশ উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামীদের। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ। তাঁর লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল পরাধীন ভারতবাসীদের। তাঁর উচ্চারিত বিদ্রোহের পঙ্ক্তিমালা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আজও অক্লান্ত। জীবন সংগ্রামে তিনি কখনো খেয়ে কখনো না-খেয়ে ছিলেন। তাতে কী? পুরো বাংলাকে তিনি যৌবনশক্তির বন্যায় ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এদিক-সেদিক। তিনি আপাদমস্তক কবি ছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মোসলেম ভারত পত্রিকায় ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রকাশের পর বাংলা সাহিত্যে ব্যাপকভাবে সাড়া পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ার পর নজরুলের সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎ নজরুলের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনের প্রভাব ফেলেছিল।

“বল বীরÑ / বল উন্নত মম শির! / শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! / বল বীরÑ / বল মহাবিশে^র মহাকাশ ফাড়ি’ /চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ^বিধাতিৃর!/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ¦লে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/ বল বীরÑ /আমি চির-উন্নত শির!”

কবি নজরুল ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ ও অনুসরণ না করেও আধুনিক বাংলা কবিতাকে আলাদা রূপ দেওয়া যায় তার প্রমাণ করেছিলেন কবি নজরুল। তিনিই রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ। তিনি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। শুধু তাই নয়, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো বিদ্রোহী সত্তার স্থৈর্য এবং মানবিক বোধের দীপ্ত উচ্চারণ লক্ষ করা যায় সাম্যবাদী, ভাঙার গান, সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে। এসব গ্রন্থে মানুষের অধিকার বোধের সঙ্গে নজরুলের শ্রেণি চেতনা যুক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে অবহেলিত নানা শ্রেণির মানুষের অধিকারের কথা। কৃষক, শ্রমিক, ধীবরদের কথা। ছাত্ররা সবসময়ই প্রতিবাদ ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে নজরুলকে প্রতীক হিসেবে সামনে রাখে। তাঁর কবিতায় অন্যায়, অসাম্য আর অবিচারের নির্মূলতা আকাক্সক্ষা করে সব শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবিক মর্যাদা প্রত্যাশা করেছিলেন। ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি বলেছেনÑ “দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার / লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!” (কৃষ্ণনগর, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩)

বা ‘সর্বহারা’ কবিতায়Ñ “ব্যথার সাঁতার-পানি-ঘেরা / চোরাবালির চর, / ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস / সেই চরে তোর ঘর? / শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা, / হাট তুলে দেয় সর্বহারা, / মেঘ-জননীর অশ্রুধারা / ঝরছে মাথার পর’, / দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি / দুলিয়ে তরু-কর।”

বাংলাদেশের সব জায়গাতেই নজরুল বিভিন্ন সভা-সমিতিতে আমন্ত্রিত হয়েছেন। এবং ভাষণ দিয়েছেন। বিশেষ করে সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর ভাষণগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্ত ভাষণে কবির দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, পরাধীনতার গ্লানি, শোষণ ও নির্যাতন, হিন্দু-মুসলমানের সংঘাত, ফতোয়াবাজ, ধর্মান্ধতা এবং আমাদের ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি তথা নজরুল মানস ও শিল্পীসত্তার একটি উজ্জ্বল পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুলের যুগটাই ছিল এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ও প্রচ- আলোড়নের যুগ। তিনি দেখেছেন ড্রেনে-ডাস্টবিনে মানুষে কুকুরে উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি। এসব তাঁকে আন্দোলিত করেছেন বলেই তিনি লিখেছেনÑ “বন্ধুগো আর বলিতে পারি না, বড় বিষজ¦ালা এই বুকে! / দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।”

কবি কখনো দমে যাননি। তিনি কারাগারে গিয়েছেন। ব্রিটিশদের প্রবল নির্যাতনে মাথা নত করেননি, অনশন চালিয়ে গেছেন। বিপ্লবী বক্তৃতা ও কবিতা লেখার সময় তাঁর সহচররা নজরুলকে দেখেছেন একজন অসীম সাহসী ও দেশপ্রেমিক হিসেবে। তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করার এক ও অবিচল প্রত্যয়ে অনড় ছিলেন। তাঁর ক্ষয় নেই। তিনি চিরঞ্জীব অনন্তকাল। বাঙালির চোখের মণি।

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

tab

সাময়িকী

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

নীহার মোশারফ

বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪

কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ও বিস্ময়কর রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। জন্মের পর তিনি সংগ্রাম করতে শিখেছেন। সংগ্রাম ও ত্যাগ তাঁর পাশাপাশি থাকত। তিনি সবসময়ই উন্নত শির হয়ে ওপর থেকে নিচে পতিত হয়েছেন শক্তিধর জলপ্রপাতের মতো। রবীন্দ্রধারার পরে বাংলা সাহিত্যে তিনি অতি উচ্চমাত্রার আলাদা ধারা তৈরি করেছেন। কী কবিতা, কী গানে, কী ছন্দ-মাত্রা-অনুপ্রাসে, একটি বর্ণনামূলক কবিতা বা ছড়াকে তিনি ভাঙা-গড়ার ছকে ফেলে চির আধুনিক করেছেন। তিনি একজন প্রেমের কবি হয়েও শুধু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য সকলের কাছে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবেই অধিক পরিচিত হয়ে আছেন। তিনি একাডেমিক শিক্ষায় বেশি দূর যেতে পারেননি। অনেকের জিজ্ঞাসা, আসলে তিনি কী ডিগ্রি বা এমএ পাস করেছেন? একজন কবির একাডেমিক সনদ খুব বেশি দরকার হবে কেন? একজন কবি নিজেই তো একটি বিশ^বিদ্যালয়। শব্দের ভা-ার। বাক্য তৈরির বিশাল কারখানা। তাঁর একটি উচ্চ ডিগ্রি না থাকলেও লেখক, গবেষক, শিক্ষার্থীরা তাঁর সৃষ্টিকর্মের ওপর ডিগ্রি নিয়ে থাকেন। বাংলা সাহিত্যের প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে তিনি অত্যন্ত পড়–য়া ছিলেন। তিনি তাঁর লেখায় প্রচুর বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেছেন। যে শব্দগুচ্ছের সঙ্গে আমরা অগে কখনো পরিচিত ছিলাম না। নজরুলের গদ্য রচনায় দেখা যায় মান-অভিমানের এক সূক্ষ্ম বিষয়। নানা উপলক্ষ্যেÑ কখনোবা উপলক্ষ্য সৃষ্টি করে আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আবার কখনো প্রকাশ্যে, কখনোবা অন্তর্লগ্ন রূপে, কিন্তু সবসময়ই আনন্দিত চাঞ্চল্যে। আবার নিজেকেই তিনি বলেছেন, সত্যের তূর্যবাদক, ভগবানের হাতের বীণা।

নজরুলের জীবন রহস্যে ভরপুর। তিনি একপাশে বসে বিদ্রোহী কবিতা লিখেছেন, অন্যপাশে গেঁথেছেন প্রেমের সুর। বাংলা ভাষা বা সাহিত্যে বিদ্রোহের অপর নাম নজরুল। শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে চির উন্নত শিরে নজরুল অবিরাম লিখে গেছেন সবার জন্য। মাত্র ৪১ বছর বয়সে চিরমূক হবার আগ পর্যন্ত বহুমাত্রিক নজরুল একাধারে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সংগীতসহ শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় চূড়ান্ত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কবি চলার পথে নিয়মকানুনের বাইরে ছিলেন। কবিদের সবসময় ছকে বাধা যায় না। তাঁকে প্রেমেও বাধা যায়নি। তিনি নার্গিসকে (সৈয়দা আসার খানম) নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেও তাকে ফেলে রহস্যময় কারণে চলে গেছেন কলকাতায়। তাঁর মনের পরতে পরতে ছিল সৃষ্টি। অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তার প্রমাণ। তিনি অনেক সংগীত রচনা করেছেন।

নজরুল পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দেশের স্বার্থে যুদ্ধে গিয়েছেন। তিনি গায়ক ছিলেন। ছিলেন নায়কও। মৌলিক প্রতিভাবান এই কবি নিজস্বতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য ও বিরল এক প্রতিভা। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা সাহিত্যে যেমন বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, তেমনি উজ্জীবিত করেছে ব্রিটিশ উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামীদের। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ। তাঁর লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল পরাধীন ভারতবাসীদের। তাঁর উচ্চারিত বিদ্রোহের পঙ্ক্তিমালা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আজও অক্লান্ত। জীবন সংগ্রামে তিনি কখনো খেয়ে কখনো না-খেয়ে ছিলেন। তাতে কী? পুরো বাংলাকে তিনি যৌবনশক্তির বন্যায় ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এদিক-সেদিক। তিনি আপাদমস্তক কবি ছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মোসলেম ভারত পত্রিকায় ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রকাশের পর বাংলা সাহিত্যে ব্যাপকভাবে সাড়া পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ার পর নজরুলের সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎ নজরুলের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনের প্রভাব ফেলেছিল।

“বল বীরÑ / বল উন্নত মম শির! / শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! / বল বীরÑ / বল মহাবিশে^র মহাকাশ ফাড়ি’ /চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ^বিধাতিৃর!/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ¦লে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/ বল বীরÑ /আমি চির-উন্নত শির!”

কবি নজরুল ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ ও অনুসরণ না করেও আধুনিক বাংলা কবিতাকে আলাদা রূপ দেওয়া যায় তার প্রমাণ করেছিলেন কবি নজরুল। তিনিই রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ। তিনি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। শুধু তাই নয়, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো বিদ্রোহী সত্তার স্থৈর্য এবং মানবিক বোধের দীপ্ত উচ্চারণ লক্ষ করা যায় সাম্যবাদী, ভাঙার গান, সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে। এসব গ্রন্থে মানুষের অধিকার বোধের সঙ্গে নজরুলের শ্রেণি চেতনা যুক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে অবহেলিত নানা শ্রেণির মানুষের অধিকারের কথা। কৃষক, শ্রমিক, ধীবরদের কথা। ছাত্ররা সবসময়ই প্রতিবাদ ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে নজরুলকে প্রতীক হিসেবে সামনে রাখে। তাঁর কবিতায় অন্যায়, অসাম্য আর অবিচারের নির্মূলতা আকাক্সক্ষা করে সব শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবিক মর্যাদা প্রত্যাশা করেছিলেন। ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি বলেছেনÑ “দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার / লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!” (কৃষ্ণনগর, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩)

বা ‘সর্বহারা’ কবিতায়Ñ “ব্যথার সাঁতার-পানি-ঘেরা / চোরাবালির চর, / ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস / সেই চরে তোর ঘর? / শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা, / হাট তুলে দেয় সর্বহারা, / মেঘ-জননীর অশ্রুধারা / ঝরছে মাথার পর’, / দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি / দুলিয়ে তরু-কর।”

বাংলাদেশের সব জায়গাতেই নজরুল বিভিন্ন সভা-সমিতিতে আমন্ত্রিত হয়েছেন। এবং ভাষণ দিয়েছেন। বিশেষ করে সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর ভাষণগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্ত ভাষণে কবির দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, পরাধীনতার গ্লানি, শোষণ ও নির্যাতন, হিন্দু-মুসলমানের সংঘাত, ফতোয়াবাজ, ধর্মান্ধতা এবং আমাদের ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি তথা নজরুল মানস ও শিল্পীসত্তার একটি উজ্জ্বল পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুলের যুগটাই ছিল এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ও প্রচ- আলোড়নের যুগ। তিনি দেখেছেন ড্রেনে-ডাস্টবিনে মানুষে কুকুরে উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি। এসব তাঁকে আন্দোলিত করেছেন বলেই তিনি লিখেছেনÑ “বন্ধুগো আর বলিতে পারি না, বড় বিষজ¦ালা এই বুকে! / দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।”

কবি কখনো দমে যাননি। তিনি কারাগারে গিয়েছেন। ব্রিটিশদের প্রবল নির্যাতনে মাথা নত করেননি, অনশন চালিয়ে গেছেন। বিপ্লবী বক্তৃতা ও কবিতা লেখার সময় তাঁর সহচররা নজরুলকে দেখেছেন একজন অসীম সাহসী ও দেশপ্রেমিক হিসেবে। তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করার এক ও অবিচল প্রত্যয়ে অনড় ছিলেন। তাঁর ক্ষয় নেই। তিনি চিরঞ্জীব অনন্তকাল। বাঙালির চোখের মণি।

back to top