রুমা আক্তার
মহান মুক্তিযুদ্ধ দুধে-ভাতে থাকা বাঙালির জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রলয় ব্যতীত যেমন নতুন সৃজন অসম্ভব তেমনি স্বাধীনতা ব্যতীত যাপিত জীবন কল্পনাতীত। স্বাধীনতা হচ্ছে বহুল কাক্সিক্ষত এবং অমূল্য একটি শব্দ। যার বীজ ব্যক্তি জীবনের সমগ্রতায় সদাক্রিয়াশীল। বহুকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্নমাত্রিক ব্যঞ্জনাবোধ, বোধিসম্পন্ন শৈল্পিক প্রয়াস থেকেই আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) সৃজন করেন তাঁর নন্দিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র। তাঁর অস্তিত্বের সমগ্রতা তিনি উৎসর্গ করেছেন শিল্পসৃষ্টি এবং শিল্পবোধের উন্নয়নে। তিনি অবলোকন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে বাঙালির মনে জন্ম নিয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনার। তাঁর অলাতচক্র উপন্যাসে মানুষের এ কল্পনার যৌক্তিক-অযৌক্তিক দিক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যক্তি, রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের অবস্থানকে বিচক্ষণতার সাথে রূপায়ণ করেছেন। একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে দানিয়েল এবং তায়েবার ব্যক্তিগত প্রেমের সাতকাহন উপন্যাসটিকে ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করেছে।
ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, গণবুদ্ধিজীবী, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসী, বিশিষ্ট চিন্তাবীদ, কবি, প্রাবন্ধিক, প্রথাবিরোধী লেখক, কালের কণ্ঠস্বর, বাংলাদেশ লেখক শিবির সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন আহমদ ছফা। স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি, স্পষ্টবাদিতা, বোহেমিয়ান জীবন যাপনের জন্য তাঁকে বুদ্ধিজীবী মহলে অনেক কটূক্তির স্বীকার হতে হয়েছে। তিনি বরাবরই মেকী সভ্যতা, প্রচলিত প্রথা, মুখোশ পরিহিত সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতা করেছেন। এ সুস্পষ্ট প্রভাব প্রতীয়মান হয়েছে তাঁর সাহিত্যগাথায়। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর রচনাবলিকে গুপ্ত ধনের খনি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি হচ্ছে: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), ওল্কার (১৯৭৫), অলাতচক্র (১৯৯৩), গাভী বৃত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ^রী (১৯৯৬), যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮)। তাঁর প্রতিটি রচনায় ভাষিক সৌন্দর্য বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর মধ্যে এক অপূর্ব অভিনবত্ব বিরাজ করে। তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানসিক উৎকর্ষসাধনে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি একটি শুভকর সমাজব্যবস্থার সপ্ন দেখতেন। তাঁর ব্যক্তিগত দর্শন এবং রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার এবং বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ এবং সলিমুল্লাহ খান।
আহমদ ছফা আপাদমস্তক একজন খাঁটি সাহিতিক। তিনি নিজে একজন বুদ্ধিজীবী হয়েও বুদ্ধিজীবীদের নগ্ন রূপকে উন্মোচন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। যাকে সগোত্র বিরোধিতা বলা যায়। শুধু তাই নয়, তিনি একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকও বটে। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবির সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তাঁর একটি বিখ্যাত বাণী হচ্ছেÑ “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।”
মুক্তিযুদ্ধের একজন মসী সৈনিক আহমদ ছফা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আহমদ ছফার কবি মানসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ও আলোড়িত করেছে। যার পরিস্ফুটন হিসেবে লক্ষ্য করা যায় অলাতচক্র উপন্যাসটি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু লেখকের অভিলাষ পূর্ণ হয় নাই। মনের বেদনা নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে উদ্বেলিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন তাঁর লেখনি শক্তির মাধ্যমে।
আহমদ ছফার অলাতচক্র উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এ উপন্যাসের নামকরণ করেছেন আহমদ ছফা একটি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায়। অলাতচক্র অর্থ জ¦লন্ত অঙ্গার বা চক্রের মতো আগুনের রেখা। এ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক নিপুণ পত্রিকায় ইদ সংখ্যায় ১৯৮৫ সালে। পরবর্তীতে মুক্তধারা থেকে পরিমার্জিতরূপে উপন্যাসটি গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। বাংলা কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা চিত্রিত হয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। স্বাধীনতা হীনতায় একটি জাতি যেমন বেঁচে থাকতে পারে না, তদ্রুপভাবে সেই জাতির সাহিত্যে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। আহমদ ছফা তাঁর অলাতচক্র উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের বাইরে ঘটে যাওয়া আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকে প্রতিভাত করেছেন।
একটি যুদ্ধ বা সংঘাত মানবজীবনে তিক্তাই দান করে। যা প্রাপ্তি ঘটে তার থেকে বহুগুণ হারিয়ে যায়। এ উপন্যাসের কাহিনি দানিয়েলের জবানিতে এগিয়েছে। এখানে দানিয়েল মূলত লেখকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় পাঠক সম্মুখে তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লেখক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি অবলোকন করেছেন কতলকাতায় আশ্রয়রত প্রায় এক কোটি শরণার্থী। যাদের মধ্যে ৮০ লক্ষ হিন্দু এবং ২০ লক্ষ মুসলিম। সেই শরণার্থীদের মানবেতর জীবন সংগ্রাম, ট্রেনিং ক্যাম্পে যুবকদের সংগ্রাম, মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা লেখকের আত্মাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে।
আহমদ ছফা তাঁর যাপিত জীবনে বাংলাদেশ ও ভারতে, মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন অল্পতে তুষ্ট থাকা সহজ-সরল বাঙালি তার স্বাধিকার অর্জনের জন্য নিজের জীবনকে কীভাবে বিসর্জন দিয়েছে অকাতরে। অন্যপ্রান্তে তিনি ক্ষমতালোভী বিভীষণদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ক্যাম্পগুলোতে হাজার হাজার তরুণ রাত কাটাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে, অসুখ-বিসুখে কাতরাচ্ছে আবার একটু সুস্থ হয়ে নিজের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার লড়াইয়ে নেমেছে। অন্যদিকে সুযোগ সন্ধানী ধন-কুবের ব্যাংকের স্বর্ণ-গয়না চুরি করে ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে জামাই আদরে দিন যাপন করছেন। তাদের খাবার-দাবার এবং ফূর্তি কোনটির কমতি নেই। শুধু তাই নয়, কলকাতার নাইট ক্লাবেও তারা দুহাতে টাকা-পয়সা উড়াচ্ছে। অথচ দেশের ক্রান্তিলগ্নে তাদের হাল ধরার কথা ছিলো। একদিকে ট্রেনিং ক্যাম্পের দুরাবস্থা অন্যদিকে তাদের এই আনন্দ আয়োজন ঔপন্যাসিকের বোধকে গভীরভাবে অভিঘাত করেছে।
যুদ্ধের পরিবেশে নির্মিত তাঁর এ উপন্যাসের চরিত্রগুলো রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মহলের পরিচিত ব্যক্তি। এ উপন্যাসে তিনি বাংলাদেশের ভবিষৎ গতিপ্রকৃতির গোপন রহস্য, চরিত্রগুলোর মধ্যে নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে মূর্তায়ন করেছেন। দেশে থাকতে কবি যাদের শ্রদ্ধা করতেন, কলকাতায় এসে তাদের আচরণ দেখে তিনি কিংকতব্যবিমূঢ় হয়েছেন। বাংলাদেশে তিনি যাদেরকে স্যার বলে অভিহিত করেছেন, কলকাতায় গিয়ে তাদের উন্মোচিত স্বরূপ দেখে শালা বলে অভিহিত করেছেন।
অলাতচক্র উপন্যাসে দেখা যায়Ñ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রত্যেকটা হিন্দু পরিবারের রয়েছে করুণ কাহিনি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে অনেকেই পড়েছেন অস্তিত্বের সংকটে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন নরেশদা। নরেশদা খুব আরামপ্রিয় একজন মানুষ। কিন্তু জীবন সংগ্রাম তাকে এতটাই নড়বড়ে করে দিয়েছে যে, রৌদ্র-বৃষ্টি উপেক্ষা করে চাকরির অন্বেষণ করেন দিনের পর দিন। তাইতো সব্রুত বাবু তাকে স্কুলে চাকরি দেওয়ার কথা বললে, তিনি ঝড়-বাদল মাথায় নিয়ে শেয়ালদার রেলগাড়ির ভিড় উপেক্ষা করে মধ্যগ্রামে পৌঁছান। তারা নিজেদের ভিটে-মাটি শুধু ছেড়ে আসেননি, ছেড়ে এসেছেন তাদের বাবা-মা, ভাইবোনকে। দেশের মাটিতে তাদের সমাহিত করে নিজের জীবনকে নিয়ে কোনো মতে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বাংলাবাজারের রামু। দানিয়েলকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদেছেন রামু।
লেখক তাঁর উপন্যাসে ৭ই মার্চের ভাষণের কথাও উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ লক্ষ লক্ষ জনতা একত্রিত হয়েছিলেন। জনতার চোখে-মুখে ছিলো স্বপ্ন, উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং শত্রু হঠানোর দৃঢ় প্রত্যয়। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কণ্ঠ, লক্ষ লক্ষ মানুষকে একত্রিত করার অসাধারণ শক্তি এবং মানসিক দৃঢ়তা লেখককে অভিভূত করেছে। লেখক যখন কলকাতায় এসে স্মৃতিচারণ করেছেন, তখন তাঁর খুব আফসোস হয়েছে। কারণ ঔপন্যাসিক একজন জয় বাংলার মানুষ। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে তাঁকে বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। নানা হতাশা বেদনার মধ্যে ঔপন্যাসিকের বিশ^াস বাংলাদেশ একদিন শত্রুমুক্ত হবে। স্বাধীন দেশে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে তিনি স্বাধীনতার সাধ উপভোগ করবেন।
অলাতচক্র উপন্যাসে লেখক মাওলানা ভাসানী, খন্দকার মুশতাক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গ থিয়েটার রোডে কিছু মাস্তান বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে লুটপাট করে। মাঝেমাঝেই সালাম এবং খুরশিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়। সালামের চোখে বঙ্গবন্ধু একজন সম্মানিত, উচ্চমার্গের এবং একজন উদার মনের মানুষ। তার ভাষ্য বঙ্গবন্ধু যদি জানতে পারতেন যে, তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে মাস্তানি করা হচ্ছে তবে তিনি মাস্তানদের উচিত শিক্ষা দিতেন। কিন্তু খুরশিদের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে সলাপরামর্শ করেই বঙ্গবন্ধু তাদের হাতে ধরা দিতেন। লেখক সালাম এবং খুরশিদ কারো পক্ষ না নিয়ে, নিজের ভাষ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভিতরে এমন এক সম্মোহনী শক্তি রয়েছে, যার দ্বারা তিনি সকল মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছেন। মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে লেখক বলেছেন, তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। খন্দকার মুশতাক সম্পর্কে লেখকের অভিব্যক্তি বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে তিনি নাকি পাকিস্তান এবং আমেরিকার দোসর। তিনি ভারতের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিদেশ মন্ত্রী। তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী হিসেবে আর পেছন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ছুরিকাঘাত করেছেন পাকিস্তান ও আমেরিকার সাথে আপোস করার চেষ্টার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার নামে তিনি মূলত পালাতে চেয়েছেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমেদ তার পরিকল্পনা বুঝতে পেরে তার যাওয়া বাতিল করে দিয়েছেন। লেখক তাজউদ্দীন আহমেদকে একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে অ্যাখায়িত করেছেন। কারণ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর মমত্ববোধ।
দেশের বাইরে ও ভিতরে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে চলছে নানা চক্রান্ত। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে আন্তর্জাতিক চক্র। ফলে, আওয়ামী লীগের ভিতরে অনেক উপদল গঠিত হয়েছে। ভারত সরকারের সহযোগিতায় যেমন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে তেমনি উপদলও গঠিত হয়েছে। ভারত সরকারের অভিপ্রায় সবগুলো উপদলকে তারা হাত করে রাখবে। তাদের মধ্যে অনেকেই চায়, তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে সরিয়ে দিতে। দলীয় কোন্দল সৃষ্টি করার জন্য এটা ছিলো একটি অন্যতম ফাঁদ আমেরিকা ও পাকিস্তানের গুপ্তচরদের। কারণ বাঙালির ভিতরে যদি বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে তাহলে তারা তাদের পোড়ামাটি নীতিতে অটল থাকতে পারবে এবং বাঙালিও তাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে, শোষণের দ্বার চিরদিনের জন্য অব্যাহত রাখতে পারবে।
লেখক পাঠক সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের স্বার্থ কতটুকু। ভারত একটি জনবহুল রাষ্ট্র। তার মধ্যে প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এক কোটি ভিতরে ৮০ লক্ষ শরণার্থী হিন্দু। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এ অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ে মানসিক চাপে রয়েছেন। কারণ, পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে এ ৮০ লক্ষ হিন্দুকে ফেরত নিতে চাইবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমান্ত বিরোধও চলছে। তাইতো ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে, এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। কারণ, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুকে বলে শরর্ণাথীদের তিনি দেশে ফেরাতে পারবেন। এখানেই ভারত সরকারের সার্থকতা ছিলো।
এ উপন্যাসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তায়েবা নামের মেয়েটি। তায়েবা তার পরিবারকে নিয়ে ঢাকায় গেন্ডারিয়ার বাসায় থাকতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনের সাথে ও যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় আসাদ হত্যার দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিলেন। তার সাথে লেখকের ৪ বছরের একটি মানসিক সম্পর্ক ছিলো। লেখক ছিলেন একজন অকৃতদার। অথাৎ তায়েবার ভালোবাসার শৃঙ্খলা ছিন্ন করে, তিনি অন্য কোনো নারীকে নিয়ে নীড় বাঁধতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লেখক তায়েবাকে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে খুঁজেছেন। অনেক খোঁজাখুজির পর কলকাতার পিজি হাসপাতালে তাকে পাওয়া গিয়েছে। সে পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা নিগৃহীত হয়ে এবং লিউক্যামিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডা. মাহতির অনুরোধে। তায়েবা প্রবল ব্যক্তিত্ব এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন নারী এবং স্বাধীনতা ছিলো তার অন্তঃপ্রাণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি জীবনযুদ্ধে একজন পরাজিত সৈনিক। কেননা, তার খুব ইচ্ছে ছিলো মৃত্যুর পূর্বে দুচোখ ভরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যাবেন। তাইতো তার মন কম্পাসের কাঁটার মতো স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে থাকতো। শেষ পর্যন্ত তাকে মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে হয়েছে।
একটি যুদ্ধ বা সংঘাত কখনো সুখময় হতে পারে না। সংঘাত সর্বদাই ব্যক্তিকে রিক্ত ও নিস্ব করে দেয়, যা পরিলক্ষিত হয়েছে অলাতচক্র উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়।
রুমা আক্তার
বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
মহান মুক্তিযুদ্ধ দুধে-ভাতে থাকা বাঙালির জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রলয় ব্যতীত যেমন নতুন সৃজন অসম্ভব তেমনি স্বাধীনতা ব্যতীত যাপিত জীবন কল্পনাতীত। স্বাধীনতা হচ্ছে বহুল কাক্সিক্ষত এবং অমূল্য একটি শব্দ। যার বীজ ব্যক্তি জীবনের সমগ্রতায় সদাক্রিয়াশীল। বহুকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্নমাত্রিক ব্যঞ্জনাবোধ, বোধিসম্পন্ন শৈল্পিক প্রয়াস থেকেই আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) সৃজন করেন তাঁর নন্দিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র। তাঁর অস্তিত্বের সমগ্রতা তিনি উৎসর্গ করেছেন শিল্পসৃষ্টি এবং শিল্পবোধের উন্নয়নে। তিনি অবলোকন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে বাঙালির মনে জন্ম নিয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনার। তাঁর অলাতচক্র উপন্যাসে মানুষের এ কল্পনার যৌক্তিক-অযৌক্তিক দিক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যক্তি, রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের অবস্থানকে বিচক্ষণতার সাথে রূপায়ণ করেছেন। একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে দানিয়েল এবং তায়েবার ব্যক্তিগত প্রেমের সাতকাহন উপন্যাসটিকে ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করেছে।
ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, গণবুদ্ধিজীবী, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসী, বিশিষ্ট চিন্তাবীদ, কবি, প্রাবন্ধিক, প্রথাবিরোধী লেখক, কালের কণ্ঠস্বর, বাংলাদেশ লেখক শিবির সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন আহমদ ছফা। স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি, স্পষ্টবাদিতা, বোহেমিয়ান জীবন যাপনের জন্য তাঁকে বুদ্ধিজীবী মহলে অনেক কটূক্তির স্বীকার হতে হয়েছে। তিনি বরাবরই মেকী সভ্যতা, প্রচলিত প্রথা, মুখোশ পরিহিত সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতা করেছেন। এ সুস্পষ্ট প্রভাব প্রতীয়মান হয়েছে তাঁর সাহিত্যগাথায়। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর রচনাবলিকে গুপ্ত ধনের খনি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি হচ্ছে: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), ওল্কার (১৯৭৫), অলাতচক্র (১৯৯৩), গাভী বৃত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ^রী (১৯৯৬), যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮)। তাঁর প্রতিটি রচনায় ভাষিক সৌন্দর্য বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর মধ্যে এক অপূর্ব অভিনবত্ব বিরাজ করে। তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানসিক উৎকর্ষসাধনে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি একটি শুভকর সমাজব্যবস্থার সপ্ন দেখতেন। তাঁর ব্যক্তিগত দর্শন এবং রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার এবং বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ এবং সলিমুল্লাহ খান।
আহমদ ছফা আপাদমস্তক একজন খাঁটি সাহিতিক। তিনি নিজে একজন বুদ্ধিজীবী হয়েও বুদ্ধিজীবীদের নগ্ন রূপকে উন্মোচন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। যাকে সগোত্র বিরোধিতা বলা যায়। শুধু তাই নয়, তিনি একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকও বটে। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবির সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তাঁর একটি বিখ্যাত বাণী হচ্ছেÑ “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।”
মুক্তিযুদ্ধের একজন মসী সৈনিক আহমদ ছফা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আহমদ ছফার কবি মানসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ও আলোড়িত করেছে। যার পরিস্ফুটন হিসেবে লক্ষ্য করা যায় অলাতচক্র উপন্যাসটি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু লেখকের অভিলাষ পূর্ণ হয় নাই। মনের বেদনা নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে উদ্বেলিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন তাঁর লেখনি শক্তির মাধ্যমে।
আহমদ ছফার অলাতচক্র উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এ উপন্যাসের নামকরণ করেছেন আহমদ ছফা একটি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায়। অলাতচক্র অর্থ জ¦লন্ত অঙ্গার বা চক্রের মতো আগুনের রেখা। এ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক নিপুণ পত্রিকায় ইদ সংখ্যায় ১৯৮৫ সালে। পরবর্তীতে মুক্তধারা থেকে পরিমার্জিতরূপে উপন্যাসটি গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। বাংলা কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা চিত্রিত হয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। স্বাধীনতা হীনতায় একটি জাতি যেমন বেঁচে থাকতে পারে না, তদ্রুপভাবে সেই জাতির সাহিত্যে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। আহমদ ছফা তাঁর অলাতচক্র উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের বাইরে ঘটে যাওয়া আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকে প্রতিভাত করেছেন।
একটি যুদ্ধ বা সংঘাত মানবজীবনে তিক্তাই দান করে। যা প্রাপ্তি ঘটে তার থেকে বহুগুণ হারিয়ে যায়। এ উপন্যাসের কাহিনি দানিয়েলের জবানিতে এগিয়েছে। এখানে দানিয়েল মূলত লেখকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় পাঠক সম্মুখে তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লেখক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি অবলোকন করেছেন কতলকাতায় আশ্রয়রত প্রায় এক কোটি শরণার্থী। যাদের মধ্যে ৮০ লক্ষ হিন্দু এবং ২০ লক্ষ মুসলিম। সেই শরণার্থীদের মানবেতর জীবন সংগ্রাম, ট্রেনিং ক্যাম্পে যুবকদের সংগ্রাম, মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা লেখকের আত্মাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে।
আহমদ ছফা তাঁর যাপিত জীবনে বাংলাদেশ ও ভারতে, মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন অল্পতে তুষ্ট থাকা সহজ-সরল বাঙালি তার স্বাধিকার অর্জনের জন্য নিজের জীবনকে কীভাবে বিসর্জন দিয়েছে অকাতরে। অন্যপ্রান্তে তিনি ক্ষমতালোভী বিভীষণদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ক্যাম্পগুলোতে হাজার হাজার তরুণ রাত কাটাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে, অসুখ-বিসুখে কাতরাচ্ছে আবার একটু সুস্থ হয়ে নিজের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার লড়াইয়ে নেমেছে। অন্যদিকে সুযোগ সন্ধানী ধন-কুবের ব্যাংকের স্বর্ণ-গয়না চুরি করে ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে জামাই আদরে দিন যাপন করছেন। তাদের খাবার-দাবার এবং ফূর্তি কোনটির কমতি নেই। শুধু তাই নয়, কলকাতার নাইট ক্লাবেও তারা দুহাতে টাকা-পয়সা উড়াচ্ছে। অথচ দেশের ক্রান্তিলগ্নে তাদের হাল ধরার কথা ছিলো। একদিকে ট্রেনিং ক্যাম্পের দুরাবস্থা অন্যদিকে তাদের এই আনন্দ আয়োজন ঔপন্যাসিকের বোধকে গভীরভাবে অভিঘাত করেছে।
যুদ্ধের পরিবেশে নির্মিত তাঁর এ উপন্যাসের চরিত্রগুলো রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মহলের পরিচিত ব্যক্তি। এ উপন্যাসে তিনি বাংলাদেশের ভবিষৎ গতিপ্রকৃতির গোপন রহস্য, চরিত্রগুলোর মধ্যে নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে মূর্তায়ন করেছেন। দেশে থাকতে কবি যাদের শ্রদ্ধা করতেন, কলকাতায় এসে তাদের আচরণ দেখে তিনি কিংকতব্যবিমূঢ় হয়েছেন। বাংলাদেশে তিনি যাদেরকে স্যার বলে অভিহিত করেছেন, কলকাতায় গিয়ে তাদের উন্মোচিত স্বরূপ দেখে শালা বলে অভিহিত করেছেন।
অলাতচক্র উপন্যাসে দেখা যায়Ñ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রত্যেকটা হিন্দু পরিবারের রয়েছে করুণ কাহিনি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে অনেকেই পড়েছেন অস্তিত্বের সংকটে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন নরেশদা। নরেশদা খুব আরামপ্রিয় একজন মানুষ। কিন্তু জীবন সংগ্রাম তাকে এতটাই নড়বড়ে করে দিয়েছে যে, রৌদ্র-বৃষ্টি উপেক্ষা করে চাকরির অন্বেষণ করেন দিনের পর দিন। তাইতো সব্রুত বাবু তাকে স্কুলে চাকরি দেওয়ার কথা বললে, তিনি ঝড়-বাদল মাথায় নিয়ে শেয়ালদার রেলগাড়ির ভিড় উপেক্ষা করে মধ্যগ্রামে পৌঁছান। তারা নিজেদের ভিটে-মাটি শুধু ছেড়ে আসেননি, ছেড়ে এসেছেন তাদের বাবা-মা, ভাইবোনকে। দেশের মাটিতে তাদের সমাহিত করে নিজের জীবনকে নিয়ে কোনো মতে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বাংলাবাজারের রামু। দানিয়েলকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদেছেন রামু।
লেখক তাঁর উপন্যাসে ৭ই মার্চের ভাষণের কথাও উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ লক্ষ লক্ষ জনতা একত্রিত হয়েছিলেন। জনতার চোখে-মুখে ছিলো স্বপ্ন, উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং শত্রু হঠানোর দৃঢ় প্রত্যয়। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কণ্ঠ, লক্ষ লক্ষ মানুষকে একত্রিত করার অসাধারণ শক্তি এবং মানসিক দৃঢ়তা লেখককে অভিভূত করেছে। লেখক যখন কলকাতায় এসে স্মৃতিচারণ করেছেন, তখন তাঁর খুব আফসোস হয়েছে। কারণ ঔপন্যাসিক একজন জয় বাংলার মানুষ। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে তাঁকে বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। নানা হতাশা বেদনার মধ্যে ঔপন্যাসিকের বিশ^াস বাংলাদেশ একদিন শত্রুমুক্ত হবে। স্বাধীন দেশে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে তিনি স্বাধীনতার সাধ উপভোগ করবেন।
অলাতচক্র উপন্যাসে লেখক মাওলানা ভাসানী, খন্দকার মুশতাক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গ থিয়েটার রোডে কিছু মাস্তান বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে লুটপাট করে। মাঝেমাঝেই সালাম এবং খুরশিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়। সালামের চোখে বঙ্গবন্ধু একজন সম্মানিত, উচ্চমার্গের এবং একজন উদার মনের মানুষ। তার ভাষ্য বঙ্গবন্ধু যদি জানতে পারতেন যে, তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে মাস্তানি করা হচ্ছে তবে তিনি মাস্তানদের উচিত শিক্ষা দিতেন। কিন্তু খুরশিদের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে সলাপরামর্শ করেই বঙ্গবন্ধু তাদের হাতে ধরা দিতেন। লেখক সালাম এবং খুরশিদ কারো পক্ষ না নিয়ে, নিজের ভাষ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভিতরে এমন এক সম্মোহনী শক্তি রয়েছে, যার দ্বারা তিনি সকল মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছেন। মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে লেখক বলেছেন, তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। খন্দকার মুশতাক সম্পর্কে লেখকের অভিব্যক্তি বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে তিনি নাকি পাকিস্তান এবং আমেরিকার দোসর। তিনি ভারতের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিদেশ মন্ত্রী। তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী হিসেবে আর পেছন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ছুরিকাঘাত করেছেন পাকিস্তান ও আমেরিকার সাথে আপোস করার চেষ্টার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার নামে তিনি মূলত পালাতে চেয়েছেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমেদ তার পরিকল্পনা বুঝতে পেরে তার যাওয়া বাতিল করে দিয়েছেন। লেখক তাজউদ্দীন আহমেদকে একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে অ্যাখায়িত করেছেন। কারণ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর মমত্ববোধ।
দেশের বাইরে ও ভিতরে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে চলছে নানা চক্রান্ত। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে আন্তর্জাতিক চক্র। ফলে, আওয়ামী লীগের ভিতরে অনেক উপদল গঠিত হয়েছে। ভারত সরকারের সহযোগিতায় যেমন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে তেমনি উপদলও গঠিত হয়েছে। ভারত সরকারের অভিপ্রায় সবগুলো উপদলকে তারা হাত করে রাখবে। তাদের মধ্যে অনেকেই চায়, তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে সরিয়ে দিতে। দলীয় কোন্দল সৃষ্টি করার জন্য এটা ছিলো একটি অন্যতম ফাঁদ আমেরিকা ও পাকিস্তানের গুপ্তচরদের। কারণ বাঙালির ভিতরে যদি বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে তাহলে তারা তাদের পোড়ামাটি নীতিতে অটল থাকতে পারবে এবং বাঙালিও তাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে, শোষণের দ্বার চিরদিনের জন্য অব্যাহত রাখতে পারবে।
লেখক পাঠক সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের স্বার্থ কতটুকু। ভারত একটি জনবহুল রাষ্ট্র। তার মধ্যে প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এক কোটি ভিতরে ৮০ লক্ষ শরণার্থী হিন্দু। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এ অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ে মানসিক চাপে রয়েছেন। কারণ, পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে এ ৮০ লক্ষ হিন্দুকে ফেরত নিতে চাইবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমান্ত বিরোধও চলছে। তাইতো ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে, এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। কারণ, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুকে বলে শরর্ণাথীদের তিনি দেশে ফেরাতে পারবেন। এখানেই ভারত সরকারের সার্থকতা ছিলো।
এ উপন্যাসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তায়েবা নামের মেয়েটি। তায়েবা তার পরিবারকে নিয়ে ঢাকায় গেন্ডারিয়ার বাসায় থাকতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনের সাথে ও যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় আসাদ হত্যার দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিলেন। তার সাথে লেখকের ৪ বছরের একটি মানসিক সম্পর্ক ছিলো। লেখক ছিলেন একজন অকৃতদার। অথাৎ তায়েবার ভালোবাসার শৃঙ্খলা ছিন্ন করে, তিনি অন্য কোনো নারীকে নিয়ে নীড় বাঁধতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লেখক তায়েবাকে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে খুঁজেছেন। অনেক খোঁজাখুজির পর কলকাতার পিজি হাসপাতালে তাকে পাওয়া গিয়েছে। সে পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা নিগৃহীত হয়ে এবং লিউক্যামিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডা. মাহতির অনুরোধে। তায়েবা প্রবল ব্যক্তিত্ব এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন নারী এবং স্বাধীনতা ছিলো তার অন্তঃপ্রাণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি জীবনযুদ্ধে একজন পরাজিত সৈনিক। কেননা, তার খুব ইচ্ছে ছিলো মৃত্যুর পূর্বে দুচোখ ভরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যাবেন। তাইতো তার মন কম্পাসের কাঁটার মতো স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে থাকতো। শেষ পর্যন্ত তাকে মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে হয়েছে।
একটি যুদ্ধ বা সংঘাত কখনো সুখময় হতে পারে না। সংঘাত সর্বদাই ব্যক্তিকে রিক্ত ও নিস্ব করে দেয়, যা পরিলক্ষিত হয়েছে অলাতচক্র উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়।