দিলারা হাফিজের কবিতা
ওবায়েদ আকাশ
কবি দিলারা হাফিজকে কবিতার মহত্ত্বম যাত্রায় সঙ্গে না নেবার কোনো সুযোগ নেই। তাঁকে বাদ দিয়ে এ-সময়ের কবিতা পথ চলতে হোঁচট খেতে খেতে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসতে বাধ্য। কেননা তাঁর রয়েছে কবিতার প্রতি প্রগাঢ় প্রেম। কবিতা কখনো প্রেমকে উপেক্ষা করে না। সৃষ্টির শেষ কথাই হচ্ছে প্রেম। প্রেম আছে বলেই ভাললাগা আছে, প্রেম আছে বলেই নতুন সৃষ্টিরা মহত্ত্বের মর্যাদা পায়।
দিলারা হাফিজের প্রতি কবিতার আর কবিতার প্রতি দিলারার এই পারস্পরিক দায়বোধ আমাদেরকে আনন্দিত করে, সমৃদ্ধ করে। যে কারণে দিলারার কবিতা পাঠে আমরা অভিভূত হই। খুঁজে পাই সময়ের বার্তা, প্রবাহিত হতে দেখি কাল প্রবাহের ¯িœগ্ধ সমিরণ। একই নিরিখে তিনি উপস্থাপন করেন দেশপ্রেম ও পরিপাশের্^র জিজ্ঞাসা। সত্তর বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি সংসারের চেয়ে কবিতাকেই দিয়েছেন অধিক। এবং সংসারকেও করে তুলেছেন কবিতা যাপনের এক অভিজাত গৃহ। মর্ম ও কর্মসঙ্গী হিসেবে কাছে পেয়েছিলেন ষাটের দশকের বলিষ্ঠউচ্চারণ কবি রফিক আজাদকে। তাঁর স্পর্শে এসে উভয় কবির জীবনে যেন ফুটল শতদল। চার হাতে আগলে রেখেছেন কবিতাসহ তাঁদের গদ্যভাষার স্বতঃস্ফূর্ততাকেও।
কবি দিলারা হাফিজ, যে কবির কাব্যভাষার সাবলীলতা ও অসামান্য আলোকায়ন পাঠকমাত্র আলোকিত করে। শিল্পের অন্যতম শক্তিই হলো তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তা। সহজিয়া, মরমীয়া বোধে গড়ে-ওঠা বাঙালির চিরকালের ভাললাগায় গেঁথে আছে সহজাত শিল্পবোধের রসাস্বাদনের আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই বাঙালি পাঠককে কাছে টানা যায়। বিপুল পাঠকের বিশ^াস, দিলারা হাফিজ এভাবেই তাদের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। যে কারণে তাঁর কবিতা একবার পাঠ করলে, তাঁর নতুন বইটির জন্য আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। পাঠকের এই আকাক্সক্ষা দিলারাকে শেখায় তাঁর নিজেকেই অতিক্রম করতে; আরো নতুন কিছু আরো নতুন নতুন প্রয়াসে ডুবে যেতে। এবং আমরা দেখি, দিলারার কবিতার বৈচিত্র্যই তাঁর কবিতার অন্যতম শক্তি। এই যে ভার্সাটাইল চিন্তাবিন্যাস, এটাই তাঁকে সাফল্যের স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি হরহর করে কবিতা বলে যেতে পারেন, সময়ের ক্ষত ও গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাগুলো অনায়াসে শিল্পম-িত করে তুলতে পারেন। এজন্য তাঁকে লোক দেখানো পরিশ্রম করতে হয় না। কবিতা লেখার অলৌকিক শক্তি নিয়েই তিনি জন্মেছেন, সেই ঐশ^রিক ঋণই তিনি শোধ করে চলেছেন পাঠকের প্রতি।
এসময়ের তরুণতর থেকে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত কবিরাও একবার দিলারা হাফিজের কবিতার অন্দরে ডুব দিয়ে মণিমুক্তার স্পর্শ পান। একথা কতটা কষ্টিপাথরে প্রমাণিত সে চেষ্টায় না গিয়ে আমরা বরং দেখি কেন তাঁর নির্বাচিত কবিতার বইটি পাঁচ বছরে পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। মানুষকে যেমন স্পর্শ করেছে তাঁর কবিতা, তেমনি তিনিও মানুষের মনকে, তাদের সুখদুঃখ, সাফল্য, ব্যর্থতাকে স্পর্শ করতে পেরেছেন। শুধু কবিতা কেন, তাঁর বিচরণ বাংলা গদ্যের বিস্তৃত পরিসরেও। সেক্ষেত্রে তাঁর গদ্যের পাঠকও নিতান্ত কম নয়। কবিতা সম্পর্কিত তাঁর পা-িত্যকে কেউ উপেক্ষা করতে পারেনি। কেননা, তিনি কবিতাকে এতটাই আপন করে নিয়েছেন যে, তাঁর আগাপাশতলাকে তিনি শুরুতেই আত্মস্থ করে নিয়েছেন। এবং কবিতার ক্রমবিকশিত ধারাটি থেকে যেন বিচ্যুত হয়ে যান, সেদিকেও নিরিখ করে থাকেন। ফলে বলতে হয়, দিলারা হফিজ এ সময়ের কবি। সমকালীন কবি।
অনেক আগে থেকে লিখতে শুরু করলেও গ্রন্থাকারে আবির্ভূত দিলারা হাফিজ ১৯৮২ সালে। তিনি ঠিক “ভালবাসার কবিতা” নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, প্রেম দিলারা হাফিজের জীবনের এক অনিবার্য বিশ^াস। তা যেমন কবিতার প্রতি, আবার মানুষের প্রতিও অকৃত্রিম। যেখান থেকে বাদ দেবার সুযোগ নেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধকেও। তাঁর জীবনের সে ভালবাসাও স্বর্গ স্পর্শ করেছে কবি রফিক আজাদের হাত ধরে। এরপর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক’, ‘কে নেবে দায়’, ‘খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান’, ‘অবিনশ^র আয়না’, ‘স্তনের অহংকার’, ‘মনোকষ্ট হচ্ছে, ¯œান করো’, ‘মাতাল হাইকু’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘নারী-সংহিতা’ প্রভৃতি গ্রন্থ। আর এসকল গ্রন্থ মিলেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘কবিতা সমগ্র’ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির অমর একুশে বইমেলায়।
এরকম কয়েকশো পাতার গায়েই
লিখে দিতে পারি তোমার অব্যক্ত নাম,
যদিবা স্বীকার করো তুমি
আমাকেই শুধু,
[তোমার অব্যক্ত নাম, ভালবাসার কবিতা, কবিতা সমগ্র]
আসলে কবিতা পাঠেই আনন্দ। আবার কবিতা উচ্চারিত হয় সময়ের প্রয়োজনে। এবং কবিতার লুকানো সৌন্দর্য ও আনন্দগুলো অনুভব করা যায় কবিতাবগাহনেই। যেভাবে এই কবিতায় ভালবাসার তীব্র আবেগ আমাদের মনকে প্ররোচিত করে। কবিতার বক্তব্যগুলো এমনভাবে উপস্থাপিত হয়, যা পাঠক-হৃদয়কে পরিমাপ করার মতো একটা অবলোকনও তাতে লুকিয়ে থাকে। তীব্র আবেগ থেকেই কবি তাঁর প্রিয়জনের নামটি কয়েকশো পাতায় লিখে দিতে কার্পণ্য করেন না। এ গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা প্রেমের। এছাড়া আধুনিক মানুষের মনের নানান হাল জুড়ে বসেছে কবিতাগুলোতে।
যুগে যুগে বিপ্লব ও সাহসী মানুষের প্রয়োজন এই সমাজ, দেশ ও সভ্যতার সুষম বিকাশকে অব্যাহত রাখতেই। দিলারা হাফিজের শিল্পচেতনা এই সমাজের জীর্ণতাকে ভেঙে নতুন কিছু নির্মাণের প্রতি নিবেদিত। আর এজন্য দরকার বিপ্লবের। বিপ্লবই সব কিছুকে ভাংচুর করে মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য তিনি একজন সাহসী পুরুষের প্রার্থনা করেন। তিনি হবেন এমনই সাহসী যিনি বিপ্লবের ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারেন।
আমি একজন সাহসী পুরুষ চাই
যে পুরুষ নিদ্রাহীন
যে পুরুষ-কণ্ঠে সমূহ আবেগে উচ্চারিত হয়
বিপ্লবের ধ্বনিÑ
জীবনের উদ্দাম অভয় বাণী;
আমি সেরকম একজন সাহসী পুরুষ চাই।
[সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা, পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক, কবিতা সমগ্র]
একই কবিতায় বলেন, “যে পুরুষ-পাঞ্জা শুধু কবিতা লেখে না/যে হাত গেরিলা যুদ্ধ জানে;/যে পুরুষ-যোদ্ধা উন্মুখ দেশের জন্যে/প্রাণপন যুদ্ধ করে পঙ্গু হতে রাজি,/অনাহারে স্বাধীনতা কামড়ে খায়Ñ” কী যে অসামান্য আর সাহসী কবির চাওয়া। তাঁর ভালবাসা দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতি। যে কারণে তাঁর সাহসী পুরুষকে শুধু কবিতা লিখলেই হবে না। তাকে যুদ্ধ করতেও জানতে হবে। দেশের জন্য তাঁর গেরিলা যুদ্ধের কৌশল দেখে কবি অভিভূত হতে চান।
কবির আরো কিছু কবিতাংশ আমরা একসঙ্গে পাঠ করতে পারি।
১
পুত্রের হাত ধরে আমি অলৌকিক ছাদে উঠি
মাথায় তার ঝরতে থাকে ক্রান্তিকালের শিশির
জলের মধ্যে সচকিত হয়ে ওঠে শে^তকায়
প্রবাল হৃদয়;
....
ছলকে উঠে মাতা-পুত্রের একটিই আকাশ
এবং একটিই অবিনশ^র চাঁদ
[মাতা-পুত্রের একটিই আকাশ, কে নেবে দায়, কবিতা সমগ্র]
২
চারপাশে দৃষ্টিহীন ঘৃণার জল,
সারাদিন নিন্দিত নন্দিত শত্রুর দল
অপার শূন্যতায় ছুঁড়ে দেয় অভিশপ্ত বল;
অবিচারে পরাভূত যখন পুষ্পের জাগরণ
প্রাগ-চেতনার ভূমি ডুবে যায় ধীরে
কুৎসিতের প্লাবনে...
[মাটির মমতা, খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান, কবিতা সমগ্র]
৩
প্রিয় মাতা ও ভগ্নীগণ,
আহা, এই সখিজনমের কথা কীভাবে বোঝাই,
আপনারা সকলেই জানেন,
আপনাদের মতো আমারও অসমতল বুকে
একজোড়া উদাসীন পর্বত আছে দেখতে রোদের
স্তনের মতো ঠিক, তবে বয়সের কারণে
সেই আরণ্যক দীপ্তি আর যে অবশিষ্ট নেই,
তা আপনারাও ভাল জানেন-
[স্তনের অহংকার, স্তনের অহংকার, কবিতা সমগ্র]
এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় পূর্বোল্লিখিত তাঁর কবিতার বৈচিত্র্যের কথা। এখানে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ থেকে যে তিনটি উপদাহরণ দেয়া হয়েছে, প্রতিটি কবিতায় একটি থেকে আর একটি কবিতার উপস্থাপন ও বিন্যাসের ভিন্নতা পাঠককে চিন্তার বৈচিত্র্য দিবে। একইভাবে বিষয়ের স্বাতন্ত্র্য, দৃশ্যচিত্রের নতুনত্ব কবিকে আলাদা করে চেনাবে। বিশেষ করে তাঁর ‘স্তনের অহংকার’ কবিতায় সমতল বুকের উপর রোদের স্তনের মতো যে একজোড়া উদাসীন পর্বতের মেটাফর ব্যবহার করেছেন, এরকম নতুনত্ব খুব কমই চোখে পড়ে। তাঁর কবিতার সাধারণ পাঠেও বোঝা যায়, তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় তিনি কবিতার কুমারীত্বকে অক্ষুণœ রেখেছেন। তাঁর কবিতার এই মৌলিকত্ব আমাদের বাংলা কবিতায় এক সমৃদ্ধ সংযোজন সন্দেহ নেই।
প্রেমিক এই কবি প্রেম সম্পর্কে আবার উচ্চারণ করেন: “প্রেমের বয়স জোর বড় জোর এক দু’দশক / বাকী সময় ফোটে না ফুল জবা কিংবা রক্ত অশোক;” [দাম্পত্য প্রেমের সংজ্ঞা, নারী সংহিতা, কবিতা সমগ্র]
এই কবিতায় তিনি বিবাহ পরবর্তী প্রেমকে নিগূঢ় মূল্যে উপস্থাপন করেছেন। প্রেম কি শুধু বিয়ের আগেই হয়? কিংবা বিয়ের পরের যে প্রেম তা কি বিবাহপূর্ব প্রেমের আবেদন পায়, পাঠক বোধ করি এরকমই জিজ্ঞাসা করবেন কবিকে। সেখানে কবি কিন্তু প্রেমকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে দিয়েছেন। সকল কিছুকে তুচ্ছ করে মায়াই যে দাম্পত্য প্রেমের টিকে থাকার মজবুত অনুষঙ্গ তা প্রতিটি মানুষের বেলায় সত্য। আর কবির শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে, তিনি সবচেয়ে নির্মোহ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেন এবং তা উচ্চারণ করেন অবলীলায়।
দিলারা হাফিজ সময়ের অগ্রসর ও নিরীক্ষাধর্মী কবি। কবিতায় তাঁর নিরীক্ষা শাশ^ত বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতাকে কখনো অস্বীকার করে না। যাকে বলে মেইনস্ট্রিম, তিনি বাঙালির হৃদয়কে স্পর্শ করতে বাংলা কবিতার সেই মেইনস্ট্রিমে বসে আছেন। তিনি অত্যন্ত সচেতন ও দূর সন্ধানী কবি। তাঁর কবিতার দৃশ্যচিত্র, চিত্রকল্প, উপমা ও মেটাফর নতুন নতুন চিন্তায় ব্যস্ত রাখে পাঠককে। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দই সুনির্বাচিত, অনিবার্য। তাই তিনি পাঠকের কাছে কবিতার এক সক্ষম দ্রষ্টা; যার দৃষ্টিজুড়ে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি। এবং এটিই তাঁর কবিতার সামগ্রিকতা।
দিলারা হাফিজের কবিতা
ওবায়েদ আকাশ
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
কবি দিলারা হাফিজকে কবিতার মহত্ত্বম যাত্রায় সঙ্গে না নেবার কোনো সুযোগ নেই। তাঁকে বাদ দিয়ে এ-সময়ের কবিতা পথ চলতে হোঁচট খেতে খেতে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসতে বাধ্য। কেননা তাঁর রয়েছে কবিতার প্রতি প্রগাঢ় প্রেম। কবিতা কখনো প্রেমকে উপেক্ষা করে না। সৃষ্টির শেষ কথাই হচ্ছে প্রেম। প্রেম আছে বলেই ভাললাগা আছে, প্রেম আছে বলেই নতুন সৃষ্টিরা মহত্ত্বের মর্যাদা পায়।
দিলারা হাফিজের প্রতি কবিতার আর কবিতার প্রতি দিলারার এই পারস্পরিক দায়বোধ আমাদেরকে আনন্দিত করে, সমৃদ্ধ করে। যে কারণে দিলারার কবিতা পাঠে আমরা অভিভূত হই। খুঁজে পাই সময়ের বার্তা, প্রবাহিত হতে দেখি কাল প্রবাহের ¯িœগ্ধ সমিরণ। একই নিরিখে তিনি উপস্থাপন করেন দেশপ্রেম ও পরিপাশের্^র জিজ্ঞাসা। সত্তর বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি সংসারের চেয়ে কবিতাকেই দিয়েছেন অধিক। এবং সংসারকেও করে তুলেছেন কবিতা যাপনের এক অভিজাত গৃহ। মর্ম ও কর্মসঙ্গী হিসেবে কাছে পেয়েছিলেন ষাটের দশকের বলিষ্ঠউচ্চারণ কবি রফিক আজাদকে। তাঁর স্পর্শে এসে উভয় কবির জীবনে যেন ফুটল শতদল। চার হাতে আগলে রেখেছেন কবিতাসহ তাঁদের গদ্যভাষার স্বতঃস্ফূর্ততাকেও।
কবি দিলারা হাফিজ, যে কবির কাব্যভাষার সাবলীলতা ও অসামান্য আলোকায়ন পাঠকমাত্র আলোকিত করে। শিল্পের অন্যতম শক্তিই হলো তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তা। সহজিয়া, মরমীয়া বোধে গড়ে-ওঠা বাঙালির চিরকালের ভাললাগায় গেঁথে আছে সহজাত শিল্পবোধের রসাস্বাদনের আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই বাঙালি পাঠককে কাছে টানা যায়। বিপুল পাঠকের বিশ^াস, দিলারা হাফিজ এভাবেই তাদের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। যে কারণে তাঁর কবিতা একবার পাঠ করলে, তাঁর নতুন বইটির জন্য আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। পাঠকের এই আকাক্সক্ষা দিলারাকে শেখায় তাঁর নিজেকেই অতিক্রম করতে; আরো নতুন কিছু আরো নতুন নতুন প্রয়াসে ডুবে যেতে। এবং আমরা দেখি, দিলারার কবিতার বৈচিত্র্যই তাঁর কবিতার অন্যতম শক্তি। এই যে ভার্সাটাইল চিন্তাবিন্যাস, এটাই তাঁকে সাফল্যের স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি হরহর করে কবিতা বলে যেতে পারেন, সময়ের ক্ষত ও গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাগুলো অনায়াসে শিল্পম-িত করে তুলতে পারেন। এজন্য তাঁকে লোক দেখানো পরিশ্রম করতে হয় না। কবিতা লেখার অলৌকিক শক্তি নিয়েই তিনি জন্মেছেন, সেই ঐশ^রিক ঋণই তিনি শোধ করে চলেছেন পাঠকের প্রতি।
এসময়ের তরুণতর থেকে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত কবিরাও একবার দিলারা হাফিজের কবিতার অন্দরে ডুব দিয়ে মণিমুক্তার স্পর্শ পান। একথা কতটা কষ্টিপাথরে প্রমাণিত সে চেষ্টায় না গিয়ে আমরা বরং দেখি কেন তাঁর নির্বাচিত কবিতার বইটি পাঁচ বছরে পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। মানুষকে যেমন স্পর্শ করেছে তাঁর কবিতা, তেমনি তিনিও মানুষের মনকে, তাদের সুখদুঃখ, সাফল্য, ব্যর্থতাকে স্পর্শ করতে পেরেছেন। শুধু কবিতা কেন, তাঁর বিচরণ বাংলা গদ্যের বিস্তৃত পরিসরেও। সেক্ষেত্রে তাঁর গদ্যের পাঠকও নিতান্ত কম নয়। কবিতা সম্পর্কিত তাঁর পা-িত্যকে কেউ উপেক্ষা করতে পারেনি। কেননা, তিনি কবিতাকে এতটাই আপন করে নিয়েছেন যে, তাঁর আগাপাশতলাকে তিনি শুরুতেই আত্মস্থ করে নিয়েছেন। এবং কবিতার ক্রমবিকশিত ধারাটি থেকে যেন বিচ্যুত হয়ে যান, সেদিকেও নিরিখ করে থাকেন। ফলে বলতে হয়, দিলারা হফিজ এ সময়ের কবি। সমকালীন কবি।
অনেক আগে থেকে লিখতে শুরু করলেও গ্রন্থাকারে আবির্ভূত দিলারা হাফিজ ১৯৮২ সালে। তিনি ঠিক “ভালবাসার কবিতা” নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, প্রেম দিলারা হাফিজের জীবনের এক অনিবার্য বিশ^াস। তা যেমন কবিতার প্রতি, আবার মানুষের প্রতিও অকৃত্রিম। যেখান থেকে বাদ দেবার সুযোগ নেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধকেও। তাঁর জীবনের সে ভালবাসাও স্বর্গ স্পর্শ করেছে কবি রফিক আজাদের হাত ধরে। এরপর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক’, ‘কে নেবে দায়’, ‘খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান’, ‘অবিনশ^র আয়না’, ‘স্তনের অহংকার’, ‘মনোকষ্ট হচ্ছে, ¯œান করো’, ‘মাতাল হাইকু’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘নারী-সংহিতা’ প্রভৃতি গ্রন্থ। আর এসকল গ্রন্থ মিলেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘কবিতা সমগ্র’ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির অমর একুশে বইমেলায়।
এরকম কয়েকশো পাতার গায়েই
লিখে দিতে পারি তোমার অব্যক্ত নাম,
যদিবা স্বীকার করো তুমি
আমাকেই শুধু,
[তোমার অব্যক্ত নাম, ভালবাসার কবিতা, কবিতা সমগ্র]
আসলে কবিতা পাঠেই আনন্দ। আবার কবিতা উচ্চারিত হয় সময়ের প্রয়োজনে। এবং কবিতার লুকানো সৌন্দর্য ও আনন্দগুলো অনুভব করা যায় কবিতাবগাহনেই। যেভাবে এই কবিতায় ভালবাসার তীব্র আবেগ আমাদের মনকে প্ররোচিত করে। কবিতার বক্তব্যগুলো এমনভাবে উপস্থাপিত হয়, যা পাঠক-হৃদয়কে পরিমাপ করার মতো একটা অবলোকনও তাতে লুকিয়ে থাকে। তীব্র আবেগ থেকেই কবি তাঁর প্রিয়জনের নামটি কয়েকশো পাতায় লিখে দিতে কার্পণ্য করেন না। এ গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা প্রেমের। এছাড়া আধুনিক মানুষের মনের নানান হাল জুড়ে বসেছে কবিতাগুলোতে।
যুগে যুগে বিপ্লব ও সাহসী মানুষের প্রয়োজন এই সমাজ, দেশ ও সভ্যতার সুষম বিকাশকে অব্যাহত রাখতেই। দিলারা হাফিজের শিল্পচেতনা এই সমাজের জীর্ণতাকে ভেঙে নতুন কিছু নির্মাণের প্রতি নিবেদিত। আর এজন্য দরকার বিপ্লবের। বিপ্লবই সব কিছুকে ভাংচুর করে মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য তিনি একজন সাহসী পুরুষের প্রার্থনা করেন। তিনি হবেন এমনই সাহসী যিনি বিপ্লবের ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারেন।
আমি একজন সাহসী পুরুষ চাই
যে পুরুষ নিদ্রাহীন
যে পুরুষ-কণ্ঠে সমূহ আবেগে উচ্চারিত হয়
বিপ্লবের ধ্বনিÑ
জীবনের উদ্দাম অভয় বাণী;
আমি সেরকম একজন সাহসী পুরুষ চাই।
[সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা, পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক, কবিতা সমগ্র]
একই কবিতায় বলেন, “যে পুরুষ-পাঞ্জা শুধু কবিতা লেখে না/যে হাত গেরিলা যুদ্ধ জানে;/যে পুরুষ-যোদ্ধা উন্মুখ দেশের জন্যে/প্রাণপন যুদ্ধ করে পঙ্গু হতে রাজি,/অনাহারে স্বাধীনতা কামড়ে খায়Ñ” কী যে অসামান্য আর সাহসী কবির চাওয়া। তাঁর ভালবাসা দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতি। যে কারণে তাঁর সাহসী পুরুষকে শুধু কবিতা লিখলেই হবে না। তাকে যুদ্ধ করতেও জানতে হবে। দেশের জন্য তাঁর গেরিলা যুদ্ধের কৌশল দেখে কবি অভিভূত হতে চান।
কবির আরো কিছু কবিতাংশ আমরা একসঙ্গে পাঠ করতে পারি।
১
পুত্রের হাত ধরে আমি অলৌকিক ছাদে উঠি
মাথায় তার ঝরতে থাকে ক্রান্তিকালের শিশির
জলের মধ্যে সচকিত হয়ে ওঠে শে^তকায়
প্রবাল হৃদয়;
....
ছলকে উঠে মাতা-পুত্রের একটিই আকাশ
এবং একটিই অবিনশ^র চাঁদ
[মাতা-পুত্রের একটিই আকাশ, কে নেবে দায়, কবিতা সমগ্র]
২
চারপাশে দৃষ্টিহীন ঘৃণার জল,
সারাদিন নিন্দিত নন্দিত শত্রুর দল
অপার শূন্যতায় ছুঁড়ে দেয় অভিশপ্ত বল;
অবিচারে পরাভূত যখন পুষ্পের জাগরণ
প্রাগ-চেতনার ভূমি ডুবে যায় ধীরে
কুৎসিতের প্লাবনে...
[মাটির মমতা, খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান, কবিতা সমগ্র]
৩
প্রিয় মাতা ও ভগ্নীগণ,
আহা, এই সখিজনমের কথা কীভাবে বোঝাই,
আপনারা সকলেই জানেন,
আপনাদের মতো আমারও অসমতল বুকে
একজোড়া উদাসীন পর্বত আছে দেখতে রোদের
স্তনের মতো ঠিক, তবে বয়সের কারণে
সেই আরণ্যক দীপ্তি আর যে অবশিষ্ট নেই,
তা আপনারাও ভাল জানেন-
[স্তনের অহংকার, স্তনের অহংকার, কবিতা সমগ্র]
এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় পূর্বোল্লিখিত তাঁর কবিতার বৈচিত্র্যের কথা। এখানে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ থেকে যে তিনটি উপদাহরণ দেয়া হয়েছে, প্রতিটি কবিতায় একটি থেকে আর একটি কবিতার উপস্থাপন ও বিন্যাসের ভিন্নতা পাঠককে চিন্তার বৈচিত্র্য দিবে। একইভাবে বিষয়ের স্বাতন্ত্র্য, দৃশ্যচিত্রের নতুনত্ব কবিকে আলাদা করে চেনাবে। বিশেষ করে তাঁর ‘স্তনের অহংকার’ কবিতায় সমতল বুকের উপর রোদের স্তনের মতো যে একজোড়া উদাসীন পর্বতের মেটাফর ব্যবহার করেছেন, এরকম নতুনত্ব খুব কমই চোখে পড়ে। তাঁর কবিতার সাধারণ পাঠেও বোঝা যায়, তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় তিনি কবিতার কুমারীত্বকে অক্ষুণœ রেখেছেন। তাঁর কবিতার এই মৌলিকত্ব আমাদের বাংলা কবিতায় এক সমৃদ্ধ সংযোজন সন্দেহ নেই।
প্রেমিক এই কবি প্রেম সম্পর্কে আবার উচ্চারণ করেন: “প্রেমের বয়স জোর বড় জোর এক দু’দশক / বাকী সময় ফোটে না ফুল জবা কিংবা রক্ত অশোক;” [দাম্পত্য প্রেমের সংজ্ঞা, নারী সংহিতা, কবিতা সমগ্র]
এই কবিতায় তিনি বিবাহ পরবর্তী প্রেমকে নিগূঢ় মূল্যে উপস্থাপন করেছেন। প্রেম কি শুধু বিয়ের আগেই হয়? কিংবা বিয়ের পরের যে প্রেম তা কি বিবাহপূর্ব প্রেমের আবেদন পায়, পাঠক বোধ করি এরকমই জিজ্ঞাসা করবেন কবিকে। সেখানে কবি কিন্তু প্রেমকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে দিয়েছেন। সকল কিছুকে তুচ্ছ করে মায়াই যে দাম্পত্য প্রেমের টিকে থাকার মজবুত অনুষঙ্গ তা প্রতিটি মানুষের বেলায় সত্য। আর কবির শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে, তিনি সবচেয়ে নির্মোহ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেন এবং তা উচ্চারণ করেন অবলীলায়।
দিলারা হাফিজ সময়ের অগ্রসর ও নিরীক্ষাধর্মী কবি। কবিতায় তাঁর নিরীক্ষা শাশ^ত বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতাকে কখনো অস্বীকার করে না। যাকে বলে মেইনস্ট্রিম, তিনি বাঙালির হৃদয়কে স্পর্শ করতে বাংলা কবিতার সেই মেইনস্ট্রিমে বসে আছেন। তিনি অত্যন্ত সচেতন ও দূর সন্ধানী কবি। তাঁর কবিতার দৃশ্যচিত্র, চিত্রকল্প, উপমা ও মেটাফর নতুন নতুন চিন্তায় ব্যস্ত রাখে পাঠককে। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দই সুনির্বাচিত, অনিবার্য। তাই তিনি পাঠকের কাছে কবিতার এক সক্ষম দ্রষ্টা; যার দৃষ্টিজুড়ে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি। এবং এটিই তাঁর কবিতার সামগ্রিকতা।