alt

সাময়িকী

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

আলী সিদ্দিকী

: বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও একজন গুরুত্বপূর্ণ কেনিয়ান সাহিত্যিক এবং তাত্ত্বিক, যিনি ঔপনিবেশিক শাসন এবং তার প্রভাব নিয়ে সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধু সাহিত্য নয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁর কাজ আফ্রিকান সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগুগি শুধু সাহিত্যিক নন, তিনি সমাজ পরিবর্তনের একজন প্রগতিশীল কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় একটি সুস্পষ্ট বার্তা হলো সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন। নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্য শুধুমাত্র কেনিয়া নয়, বরং গোটা আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। তাঁর রচনাগুলো উপনিবেশবাদ, ভাষার শক্তি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে। তাঁর লেখাগুলি আজও আফ্রিকান সাহিত্য এবং সমাজ পরিবর্তনের একটি অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে কেনিয়ার কামিরিথু গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন কৃষক এবং নগুগি বড় হয়েছেন একটি বহুবিবাহ পরিবারে। নগুগির শৈশবকাল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। মাউ মাউ বিদ্রোহ চলাকালে তাঁর পরিবার অত্যন্ত কষ্টকর সময় পার করে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন মিশনারি স্কুলে এবং পরে কিকুয়ুপ্রদেশের অ্যালায়ন্স হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি উগান্ডার মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে নগুগি ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সরকারের চাপের মুখে নগুগি ১৯৮২ সালে কেনিয়া ছেড়েপ্রবাসে যান। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।

তাঁর প্রধান সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে উপন্যাস: ‘উইপ নট, চাইল্ড’, ‘দ্য রিভার বিটুইন’, ‘পেটালস অব ব্লাড’, ‘উইজার্ড অব দ্য ক্রো’ প্রভৃতি। নাটক: ‘দ্য ব্ল্যাক হারমিট’ ও ‘আই উইল ম্যারি হোয়েন আই ওয়ান্ট’। প্রবন্ধ ও সমালোচনামূলক রচনা: ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’। এতে ভাষা, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা, যেখানে তিনি আফ্রিকান ভাষায় লেখার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, “একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ভাষায় নিহিত। যখন একটি জাতিকে তার নিজস্ব ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তখন তা তাদের সাংস্কৃতিক মৃত্যুর সূচনা করে। এখানে নগুগি ভাষাকে একটি সাংস্কৃতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা ঔপনিবেশিক শাসনের হাতিয়ার এবং প্রতিরোধের মাধ্যম উভয়ই। নগুগি ঔপনিবেশিক শিক্ষার মাধ্যমে আফ্রিকানদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ধ্বংস করার চেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন।‘মুভিং দ্য সেন্টার’-এবৈশ্বিক সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্য শুধুমাত্র কেনিয়া নয়, বরং গোটা আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। তাঁর রচনাগুলো উপনিবেশবাদ, ভাষার শক্তি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে। তাঁর লেখাগুলি আজও আফ্রিকান সাহিত্য এবং সমাজ পরিবর্তনের একটি অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। ঔপনিবেশিক শাসন শুধু আর্থিক বা রাজনৈতিক ক্ষতি করেনি, বরং সাংস্কৃতিক নিপীড়নও এনেছিল। “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড” বইয়ে নগুগি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক ভাষা স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিচিতি ধ্বংস করেছে। তিনি গিকুয়ু ভাষায় সাহিত্য রচনার মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।“দ্য রিভার বিটুইন”-এ তিনি ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি দেখায় কীভাবে খ্রিস্টধর্ম এবং পশ্চিমা শিক্ষা স্থানীয় গিকুয়ু সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে।

কেনিয়ার ঔপনিবেশিক শাসনকালে কৃষিজীবী সমাজের ওপর ভূমি হারানো এবং শ্রম শোষণ ছিল একটি প্রধান সমস্যা। নগুগি তার উপন্যাস “উইপ নট, চাইল্ড” এবং “আ গ্রেইন অফ হোয়েট”-এ এই সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেছেন। কেনিয়ার মাউ মাউ আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এই কাজগুলো দেখায় কীভাবে ভূমি দখল এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে এনেছিল। নগুগি পুঁজিবাদী এবং নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। “পেটালস অফ ব্লাড”উপন্যাসে তিনিদেখিয়েছেন কীভাবে স্বাধীন কেনিয়ায় ধনী এবং ক্ষমতাবান শ্রেণি শ্রমজীবী এবং দরিদ্র জনগণের শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এই উপন্যাসে তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করেননি, বরং আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অসাম্য এবং বৈষম্যের ওপর আলোকপাত করেছেন।

নগুগি তাঁর লেখায় ঔপনিবেশিকতার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর প্রথমদিকের উপন্যাসগুলোতে ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আফ্রিকান সমাজে বিভাজন এবং ঐতিহ্য ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে স্বাধীনতার পরেও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শোষণ অব্যাহত থাকে। এটি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নতুন ধরনের শোষণের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নগুগি শুধু সাহিত্যিক নন, তিনি সমাজ পরিবর্তনের একজন প্রগতিশীল কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় একটি সুস্পষ্ট বার্তা হলো সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন।

নগুগির লেখায় একটি বড় বিষয় হলো ভাষা। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড”-এ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি ভাষার মাধ্যমে আফ্রিকার সংস্কৃতি এবং মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাঁর ভবিষ্যৎ সাহিত্যকর্ম কিকুইউ ভাষায় লিখবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের একটি পদক্ষেপ নয়, এটি আফ্রিকান ভাষার মূল্য এবং তার শক্তিকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার একটি প্রচেষ্টা।

নগুগি লেখালেখিতে শুধু উপন্যাস-প্রবন্ধে সীমাবদ্ধ থাকেননি; তিনি নাটককেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর নাটকে শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষকদের সংগ্রাম নিয়ে রচিত, যেখানে জমি হারানোর এবং কর্পোরেট শোষণের গল্প বলা হয়েছে। এই নাটকের কারণে নগুগিকে কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু এটি তাঁকে দমাতে পারেনি; বরং তিনি আরও গভীরভাবে সক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত হন। কেনিয়ার স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নগুগির লেখায় গভীর প্রভাব ফেলে। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের রাজনৈতিক নেতারা ঔপনিবেশিক শক্তির মতোই শোষণের ধারা অব্যাহত রাখে।

নগুগি ঔপনিবেশিকতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। “আ গ্রেইন অফ হোয়েট” এবং “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড”-এ তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসন মানুষকে আত্মপরিচয় এবং ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড”(১৯৮৬) একটি প্রভাবশালী সমালোচনামূলক কাজ, যেখানে তিনি উপনিবেশবাদ কীভাবে ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করেছে তা ব্যাখ্যা করেন। তাঁর কাজ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং ভাষার মাধ্যমে ঔপনিবেশিকদের চাপিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক মানদ-কে চ্যালেঞ্জ করেছে।

নগুগি পুঁজিবাদী এবং নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। “ পেটালস অব ব্লাড” উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে স্বাধীন কেনিয়ায় ধনী এবং ক্ষমতাবান শ্রেণি শ্রমজীবী এবং দরিদ্র জনগণের শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এই উপন্যাসে তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করেননি, বরং আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অসাম্য এবং বৈষম্যের ওপর আলোকপাত করেছেন।

নগুগির লেখায় নারীর ভূমিকাও গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁর উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলো কখনো শোষণের শিকার, আবার কখনো প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। “ডেভিল অন দ্য ক্রস”-এ নারী চরিত্র ওয়ারিঙ্গা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক। নগুগির সাহিত্য শুধু বৃহত্তর আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যা নয়, বরং পরিবারের ভেতরের টানাপোড়েন, নারীর ভূমিকা, এবং সামাজিক পরিবর্তনেরও চিত্র তুলে ধরে। উইপ নট, চাইল্ড- উপন্যাসে পরিবারগুলোর সংগ্রাম এবং সামাজিক পরিবর্তনের চাপ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। “পেটালস অব ব্লাড”-এ নারী চরিত্রগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগুগি তাঁর সাহিত্যকর্মে কখনো কখনো জাদুবাস্তবতা এবং ব্যঙ্গ ব্যবহার করেছেন। “ওয়াইজার্ড অব দ্য ক্রো”-এ তিনি আধুনিক একনায়কতন্ত্র, বিশ্বায়ন এবং দুর্নীতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে আলোচনা করেছেন।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও একজন অত্যন্তপ্রভাবশালী সাহিত্যিক, যিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতা, ভাষার গুরুত্ব, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। তবে, তাঁর কাজের প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাও রয়েছে।

নগুগি ঔপনিবেশিক ভাষার পরিবর্তে কিকুইউ ভাষায় লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা ভাষার গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ নিয়ে তাঁর বক্তব্যকে শক্তিশালী করেছিল। অনেকেই মনে করেন যে কিকুইউ ভাষায় লেখার মাধ্যমে তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক পাঠকবৃন্দ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। তাঁর কিকুইউ ভাষার সাহিত্যকর্ম অনুবাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনেক সময় মূল রচনার ভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় না। সমালোচকদের মতে, ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজি ব্যবহার করেও তিনি তাঁর বার্তা আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দিতে পারতেন।নগুগির সাহিত্য স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক, যা তাঁর লেখায় গভীরতা এবং প্রাসঙ্গিকতা যোগ করে।

তাঁর কাজ অনেক সময় অতিমাত্রায় রাজনৈতিক বলে সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, সাহিত্য কখনো কখনো কেবল শিল্পের জন্যও হতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক বার্তা এতটা সরাসরি না থাকলেও চলে। তাঁর লেখাগুলি মাঝে মাঝে তাত্ত্বিক এবং আদর্শিক হয়ে ওঠে, যা পাঠকদের কাছে কঠিন বা অতিরিক্ত গুরুগম্ভীর মনে হতে পারে। নগুগির উপন্যাস, বিশেষ করে “ পেটালস অব ব্লাড” এবং “ওয়াইজার্ড অব দ্য ক্রো”জটিল কাঠামো এবং একাধিক চরিত্রের গল্প নিয়ে আবর্তিত। এসব উপন্যাসে প্লট কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ এবং জটিল বলে সমালোচিত হয়েছে। পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাঁর কাজ মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে যখন তিনি চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চেষ্টা করেন।

নগুগি তাঁর সাহিত্যকর্মে নারীর শোষণ এবং সংগ্রামের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। যদিও তাঁর লেখায় নারী চরিত্রগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে সমালোচকদের মতে, নগুগি অনেক সময় নারীদের শুধু শোষণের প্রতীক হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। কিছু সমালোচক মনে করেন, তাঁর নারী চরিত্রগুলোর বিকাশ যথেষ্ট গভীর হয়নি এবং তারা মূলত পুরুষ কেন্দ্রিক গল্পের সহায়ক চরিত্র হিসেবে রয়ে গেছে।

নগুগি রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে প্রবাসে বসবাস করতে বাধ্য হন। সমালোচকদের মতে, প্রবাসে থাকার ফলে তাঁর পরবর্তী লেখাগুলোতে কেনিয়ার বাস্তবতাকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিছু সমালোচক মনে করেন, দূরত্বের কারণে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কখনো কখনো বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

নগুগি তাঁর সাহিত্যকর্মে ঔপনিবেশিকতা, পুঁজিবাদ, এবং নব্য-ঔপনিবেশিকতাকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর সাহিত্য অনেক সময় একমুখী বা একপেশে হয়ে পড়ে, যেখানে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি বা সমাধানের দিকটি অনুপস্থিত। তাঁর কাজ কখনো কখনো আদর্শিক প্রচারণার মতো মনে হতে পারে, যা সাহিত্যকর্মের শিল্পমানকে প্রভাবিত করে।

নগুগির নাটক, যেমন “ঘমধধযরশধ ঘফববহফধ (আই উইল ম্যারি হোয়েন আই ওয়ান্ট)”, অত্যন্ত শক্তিশালী বার্তা বহন করে। সমালোচকরা মনে করেন, নগুগির নাটক অনেক সময় খুব সরাসরি এবং অতিমাত্রায় বার্তাধর্মী হয়ে ওঠে, যা নাটকের স্বাভাবিক বহমানতাকে বাধাগ্রস্ত করে। তাঁর নাটকের সমাপ্তি প্রায়ই খুব অনুমানযোগ্য বলে সমালোচিত হয়েছে।

সাহিত্য গবেষকগণ আফ্রিকান সাহিত্যে নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্যকর্মেরপ্রভাব ও গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেছেন।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্যকর্ম তাঁর সময় এবং সমাজের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, তাঁর কাজের সমালোচনা থেকে বোঝা যায় যে, সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ভার কখনো কখনো তাঁর সৃজনশীলতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। তাঁর কাজের ভাষাগত এবং আদর্শিক অবস্থান বিতর্কের জন্ম দিলেও, তিনি যে আফ্রিকান সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে একটি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, তা অস্বীকার করা যায় না। তাঁর সাহিত্য মানুষের চিন্তা এবং সমাজের কাঠামো পরিবর্তনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। নগুগি অনেক আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার মনোনীত করা হয়েছে।

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

tab

সাময়িকী

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

আলী সিদ্দিকী

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও একজন গুরুত্বপূর্ণ কেনিয়ান সাহিত্যিক এবং তাত্ত্বিক, যিনি ঔপনিবেশিক শাসন এবং তার প্রভাব নিয়ে সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধু সাহিত্য নয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁর কাজ আফ্রিকান সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগুগি শুধু সাহিত্যিক নন, তিনি সমাজ পরিবর্তনের একজন প্রগতিশীল কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় একটি সুস্পষ্ট বার্তা হলো সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন। নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্য শুধুমাত্র কেনিয়া নয়, বরং গোটা আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। তাঁর রচনাগুলো উপনিবেশবাদ, ভাষার শক্তি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে। তাঁর লেখাগুলি আজও আফ্রিকান সাহিত্য এবং সমাজ পরিবর্তনের একটি অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে কেনিয়ার কামিরিথু গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন কৃষক এবং নগুগি বড় হয়েছেন একটি বহুবিবাহ পরিবারে। নগুগির শৈশবকাল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। মাউ মাউ বিদ্রোহ চলাকালে তাঁর পরিবার অত্যন্ত কষ্টকর সময় পার করে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন মিশনারি স্কুলে এবং পরে কিকুয়ুপ্রদেশের অ্যালায়ন্স হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি উগান্ডার মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে নগুগি ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সরকারের চাপের মুখে নগুগি ১৯৮২ সালে কেনিয়া ছেড়েপ্রবাসে যান। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।

তাঁর প্রধান সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে উপন্যাস: ‘উইপ নট, চাইল্ড’, ‘দ্য রিভার বিটুইন’, ‘পেটালস অব ব্লাড’, ‘উইজার্ড অব দ্য ক্রো’ প্রভৃতি। নাটক: ‘দ্য ব্ল্যাক হারমিট’ ও ‘আই উইল ম্যারি হোয়েন আই ওয়ান্ট’। প্রবন্ধ ও সমালোচনামূলক রচনা: ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’। এতে ভাষা, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা, যেখানে তিনি আফ্রিকান ভাষায় লেখার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, “একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ভাষায় নিহিত। যখন একটি জাতিকে তার নিজস্ব ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তখন তা তাদের সাংস্কৃতিক মৃত্যুর সূচনা করে। এখানে নগুগি ভাষাকে একটি সাংস্কৃতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা ঔপনিবেশিক শাসনের হাতিয়ার এবং প্রতিরোধের মাধ্যম উভয়ই। নগুগি ঔপনিবেশিক শিক্ষার মাধ্যমে আফ্রিকানদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ধ্বংস করার চেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন।‘মুভিং দ্য সেন্টার’-এবৈশ্বিক সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্য শুধুমাত্র কেনিয়া নয়, বরং গোটা আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। তাঁর রচনাগুলো উপনিবেশবাদ, ভাষার শক্তি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে। তাঁর লেখাগুলি আজও আফ্রিকান সাহিত্য এবং সমাজ পরিবর্তনের একটি অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। ঔপনিবেশিক শাসন শুধু আর্থিক বা রাজনৈতিক ক্ষতি করেনি, বরং সাংস্কৃতিক নিপীড়নও এনেছিল। “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড” বইয়ে নগুগি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক ভাষা স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিচিতি ধ্বংস করেছে। তিনি গিকুয়ু ভাষায় সাহিত্য রচনার মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।“দ্য রিভার বিটুইন”-এ তিনি ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি দেখায় কীভাবে খ্রিস্টধর্ম এবং পশ্চিমা শিক্ষা স্থানীয় গিকুয়ু সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে।

কেনিয়ার ঔপনিবেশিক শাসনকালে কৃষিজীবী সমাজের ওপর ভূমি হারানো এবং শ্রম শোষণ ছিল একটি প্রধান সমস্যা। নগুগি তার উপন্যাস “উইপ নট, চাইল্ড” এবং “আ গ্রেইন অফ হোয়েট”-এ এই সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেছেন। কেনিয়ার মাউ মাউ আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এই কাজগুলো দেখায় কীভাবে ভূমি দখল এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে এনেছিল। নগুগি পুঁজিবাদী এবং নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। “পেটালস অফ ব্লাড”উপন্যাসে তিনিদেখিয়েছেন কীভাবে স্বাধীন কেনিয়ায় ধনী এবং ক্ষমতাবান শ্রেণি শ্রমজীবী এবং দরিদ্র জনগণের শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এই উপন্যাসে তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করেননি, বরং আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অসাম্য এবং বৈষম্যের ওপর আলোকপাত করেছেন।

নগুগি তাঁর লেখায় ঔপনিবেশিকতার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর প্রথমদিকের উপন্যাসগুলোতে ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আফ্রিকান সমাজে বিভাজন এবং ঐতিহ্য ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে স্বাধীনতার পরেও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শোষণ অব্যাহত থাকে। এটি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নতুন ধরনের শোষণের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নগুগি শুধু সাহিত্যিক নন, তিনি সমাজ পরিবর্তনের একজন প্রগতিশীল কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় একটি সুস্পষ্ট বার্তা হলো সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন।

নগুগির লেখায় একটি বড় বিষয় হলো ভাষা। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড”-এ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি ভাষার মাধ্যমে আফ্রিকার সংস্কৃতি এবং মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাঁর ভবিষ্যৎ সাহিত্যকর্ম কিকুইউ ভাষায় লিখবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের একটি পদক্ষেপ নয়, এটি আফ্রিকান ভাষার মূল্য এবং তার শক্তিকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার একটি প্রচেষ্টা।

নগুগি লেখালেখিতে শুধু উপন্যাস-প্রবন্ধে সীমাবদ্ধ থাকেননি; তিনি নাটককেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর নাটকে শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষকদের সংগ্রাম নিয়ে রচিত, যেখানে জমি হারানোর এবং কর্পোরেট শোষণের গল্প বলা হয়েছে। এই নাটকের কারণে নগুগিকে কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু এটি তাঁকে দমাতে পারেনি; বরং তিনি আরও গভীরভাবে সক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত হন। কেনিয়ার স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নগুগির লেখায় গভীর প্রভাব ফেলে। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের রাজনৈতিক নেতারা ঔপনিবেশিক শক্তির মতোই শোষণের ধারা অব্যাহত রাখে।

নগুগি ঔপনিবেশিকতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। “আ গ্রেইন অফ হোয়েট” এবং “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড”-এ তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসন মানুষকে আত্মপরিচয় এবং ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। “ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড”(১৯৮৬) একটি প্রভাবশালী সমালোচনামূলক কাজ, যেখানে তিনি উপনিবেশবাদ কীভাবে ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করেছে তা ব্যাখ্যা করেন। তাঁর কাজ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং ভাষার মাধ্যমে ঔপনিবেশিকদের চাপিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক মানদ-কে চ্যালেঞ্জ করেছে।

নগুগি পুঁজিবাদী এবং নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। “ পেটালস অব ব্লাড” উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে স্বাধীন কেনিয়ায় ধনী এবং ক্ষমতাবান শ্রেণি শ্রমজীবী এবং দরিদ্র জনগণের শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এই উপন্যাসে তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করেননি, বরং আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অসাম্য এবং বৈষম্যের ওপর আলোকপাত করেছেন।

নগুগির লেখায় নারীর ভূমিকাও গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁর উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলো কখনো শোষণের শিকার, আবার কখনো প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। “ডেভিল অন দ্য ক্রস”-এ নারী চরিত্র ওয়ারিঙ্গা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক। নগুগির সাহিত্য শুধু বৃহত্তর আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যা নয়, বরং পরিবারের ভেতরের টানাপোড়েন, নারীর ভূমিকা, এবং সামাজিক পরিবর্তনেরও চিত্র তুলে ধরে। উইপ নট, চাইল্ড- উপন্যাসে পরিবারগুলোর সংগ্রাম এবং সামাজিক পরিবর্তনের চাপ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। “পেটালস অব ব্লাড”-এ নারী চরিত্রগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগুগি তাঁর সাহিত্যকর্মে কখনো কখনো জাদুবাস্তবতা এবং ব্যঙ্গ ব্যবহার করেছেন। “ওয়াইজার্ড অব দ্য ক্রো”-এ তিনি আধুনিক একনায়কতন্ত্র, বিশ্বায়ন এবং দুর্নীতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে আলোচনা করেছেন।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও একজন অত্যন্তপ্রভাবশালী সাহিত্যিক, যিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতা, ভাষার গুরুত্ব, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। তবে, তাঁর কাজের প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাও রয়েছে।

নগুগি ঔপনিবেশিক ভাষার পরিবর্তে কিকুইউ ভাষায় লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা ভাষার গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ নিয়ে তাঁর বক্তব্যকে শক্তিশালী করেছিল। অনেকেই মনে করেন যে কিকুইউ ভাষায় লেখার মাধ্যমে তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক পাঠকবৃন্দ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। তাঁর কিকুইউ ভাষার সাহিত্যকর্ম অনুবাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনেক সময় মূল রচনার ভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় না। সমালোচকদের মতে, ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজি ব্যবহার করেও তিনি তাঁর বার্তা আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দিতে পারতেন।নগুগির সাহিত্য স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক, যা তাঁর লেখায় গভীরতা এবং প্রাসঙ্গিকতা যোগ করে।

তাঁর কাজ অনেক সময় অতিমাত্রায় রাজনৈতিক বলে সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, সাহিত্য কখনো কখনো কেবল শিল্পের জন্যও হতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক বার্তা এতটা সরাসরি না থাকলেও চলে। তাঁর লেখাগুলি মাঝে মাঝে তাত্ত্বিক এবং আদর্শিক হয়ে ওঠে, যা পাঠকদের কাছে কঠিন বা অতিরিক্ত গুরুগম্ভীর মনে হতে পারে। নগুগির উপন্যাস, বিশেষ করে “ পেটালস অব ব্লাড” এবং “ওয়াইজার্ড অব দ্য ক্রো”জটিল কাঠামো এবং একাধিক চরিত্রের গল্প নিয়ে আবর্তিত। এসব উপন্যাসে প্লট কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ এবং জটিল বলে সমালোচিত হয়েছে। পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাঁর কাজ মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে যখন তিনি চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চেষ্টা করেন।

নগুগি তাঁর সাহিত্যকর্মে নারীর শোষণ এবং সংগ্রামের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। যদিও তাঁর লেখায় নারী চরিত্রগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে সমালোচকদের মতে, নগুগি অনেক সময় নারীদের শুধু শোষণের প্রতীক হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। কিছু সমালোচক মনে করেন, তাঁর নারী চরিত্রগুলোর বিকাশ যথেষ্ট গভীর হয়নি এবং তারা মূলত পুরুষ কেন্দ্রিক গল্পের সহায়ক চরিত্র হিসেবে রয়ে গেছে।

নগুগি রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে প্রবাসে বসবাস করতে বাধ্য হন। সমালোচকদের মতে, প্রবাসে থাকার ফলে তাঁর পরবর্তী লেখাগুলোতে কেনিয়ার বাস্তবতাকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিছু সমালোচক মনে করেন, দূরত্বের কারণে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কখনো কখনো বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

নগুগি তাঁর সাহিত্যকর্মে ঔপনিবেশিকতা, পুঁজিবাদ, এবং নব্য-ঔপনিবেশিকতাকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর সাহিত্য অনেক সময় একমুখী বা একপেশে হয়ে পড়ে, যেখানে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি বা সমাধানের দিকটি অনুপস্থিত। তাঁর কাজ কখনো কখনো আদর্শিক প্রচারণার মতো মনে হতে পারে, যা সাহিত্যকর্মের শিল্পমানকে প্রভাবিত করে।

নগুগির নাটক, যেমন “ঘমধধযরশধ ঘফববহফধ (আই উইল ম্যারি হোয়েন আই ওয়ান্ট)”, অত্যন্ত শক্তিশালী বার্তা বহন করে। সমালোচকরা মনে করেন, নগুগির নাটক অনেক সময় খুব সরাসরি এবং অতিমাত্রায় বার্তাধর্মী হয়ে ওঠে, যা নাটকের স্বাভাবিক বহমানতাকে বাধাগ্রস্ত করে। তাঁর নাটকের সমাপ্তি প্রায়ই খুব অনুমানযোগ্য বলে সমালোচিত হয়েছে।

সাহিত্য গবেষকগণ আফ্রিকান সাহিত্যে নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্যকর্মেরপ্রভাব ও গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেছেন।

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ওর সাহিত্যকর্ম তাঁর সময় এবং সমাজের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, তাঁর কাজের সমালোচনা থেকে বোঝা যায় যে, সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ভার কখনো কখনো তাঁর সৃজনশীলতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। তাঁর কাজের ভাষাগত এবং আদর্শিক অবস্থান বিতর্কের জন্ম দিলেও, তিনি যে আফ্রিকান সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে একটি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, তা অস্বীকার করা যায় না। তাঁর সাহিত্য মানুষের চিন্তা এবং সমাজের কাঠামো পরিবর্তনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। নগুগি অনেক আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার মনোনীত করা হয়েছে।

back to top