alt

সাময়িকী

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

: বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

আবদুল মান্নান সৈয়দ

পৃথিবীতে পাখি কোনো সীমান্ত মানে না, কারণ তার কোনো মানচিত্র নেই, সবখানে তার অবাধ বিচরণ। আর তাই সে চিরস্বাধীন।নিরন্তর সে উড়ে বেড়াতে জানে বাঁধাহীন। অথচ মানুষ ব্যাকরণ আর মার্জিনের মধ্যে থাকে, ইচ্ছে করলেই সেই মার্জিন অতিক্রম করতে পারে না, এবং এখানেই তার সীমাবদ্ধতা। নিয়ম আর ব্যাকরণ এবং সমাজের বাঁধাধরা ঘেরাটোপের মধ্য দিয়েই তাকে চলতে হয়। তাই সে আপন বলয়ের মধ্যেই থাকে, এখানেই জীবন বাঁধা। জীবন মানেই তো একটা কঠিন ছক। সেই ছকের মধ্যেই আমাদের যাপিত জীবন আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। কেউ কি তা অতিক্রম করতে পারে, পারে না। সম্ভব নয় তার কঠিন বেড়ি খুলে ফেলার, কারণ সে সংঘবদ্ধ জীব বলেও সীমাবদ্ধ একটা ছঁকে আজীবন কলুর বলদের মতো থাকতে হয়। এবং এটাই তার ভবিতব্য।

আবদুল মান্নান সৈয়দের (১৯৪৩-২০১০) ‘ভাঙানৌকা’ (২০০৬) উপন্যাস মানুষের এই সীমাবদ্ধতার দিকেই দৃষ্টিপাত করেছে। জীবন যে কতোখানি খাঁচাবন্দি তার-ই কাহিনী বুঁনেছেন। শুনিয়েছেন সে জীবনের গল্প, যা হয়তো কারোরই কাম্য নয়। তারপরও মানুষ তা বরণ করে এবং করতেও হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগ শুধু একটা দেশই বিভাজন ছিলো না; বাস্তু হারানো মানুষের প্রিয়জন হারানোই ছিলো না; ছিলো তার শেকড় হারানোর কষ্ট। সে কষ্ট কাউকে হয়তো বলে বোঝানো যাবে না, বুকের সন্নিকটে শুধুই ধিকিধিকি জ্বলে সেই না বলা যন্ত্রণার লেলিহান আগুন। আগুনের অট্টহাসি হয়তো সবাই দেখতে পারে না, জনমদুখি মানুষই দেখে। যে দেখে তার কষ্ট তো কেউই দেখে না। মাটিহারা স্বজন হারানোর যন্ত্রণা একমাত্র তাকেই চিরকাল বয়ে বেড়াতে হয়। বয়েই যায়। নদী যেমন নিরবধি তেমনি কষ্টও ওই একেই ধারায় প্রবাহিত হয়। কোথাও থামে না, থামতে জানেও না।

‘ভাঙানৌকা’র একটা চরিত্রই কাহিনীকে পুরোদমে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সে হলো সৈয়দ মুশতাক আলী অর্থাৎ ভুলো। সে একজন রিটায়ার্ড লাইব্রেরি এ্যাসিসট্যান্ট। ছোট এই চাকুরিটা জুটিয়ে দিয়েছিলো তার এক দূরসম্পর্কের নানা জাঁদরেল এক উচ্চপদস্থ আমলা সৈয়দ শামিম আহমদ। সে অনেককাল আগের কথা। এখন তারা দুজনই বার্ধক্যে উপনীত, ভুলো যাও-বা হেঁটে-চলে বেড়াতে পারে কিন্তু শামিম আহমেদ একেবারে অক্ষম এবং কানেও কম শোনেন। বয়স তাকে স্থিরতা দিয়েছে, ভুলেছেন জীবনের যতোসব লেনদেন। তারপরও জীবনের কাছে দাঁড়িয়ে মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সময় এবং ¯্রােতের বিপরীতে না গিয়ে সামনে এগিয়ে যান আপন গতিতে।

দুজন নানা-নাতি সেই দেশভাগের সময় আল্লারাখার চর পেরিয়ে ইছামতি নদীতে নৌকা ভাসিয়ে রাতের অন্ধকারে পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসার গল্পে মেতে ওঠে। তখন অবশ্য ভুলোর বয়স কম। বশিরহাটের সাঁইপাড়া গ্রাম তাদের দুজনের মনের ভেতর চিরস্থায়ী একটা আসন গেঁড়ে বসে আছে। এমনি কলকাতার সেই পেছন জীবনের দৃশ্যাবলি ঘুরেফিরে আসে তাদের মাঝে, তখন তারা স্মৃতি মন্থনে জর্জরিত হয়, যা শয়নে-স্বপনে জাগ্রত হয়ে থাকে। যেমন-“নানা, মনে আছে, আপনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, বেকার হোস্টেলে থাকতেন আপনি, কতোবার গিয়েছি সেখানে, বেশ পরে, আপনি তখন কলেজ থেকে বেরিয়ে গেছেন, আমাকে নিয়ে গেলেন এক মিলাদ মাহফিলে। মিলাদের পরে মিষ্টি-টিষ্টি তো দিলোই সবাইকে, সে সঙ্গে রঙ্গিন একটা রুমাল প্রত্যেককে। সেই রুমাল আমি কতোদিন যে রেখে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে, নানা, কলকাতা থেকে সপ্তায়-সপ্তায় আসতেন আপনি বশিরহাটে, আপনি মাঝে-মাঝে আমাকে নিয়ে এখানে-ওখানে যেতেন, যতো বয়স বাড়ছে, নানা, ততো আমাদের সেই সাঁইপাড়া গ্রামটা যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি।”

দেশভাগের কষ্ট যতোখানি, তার চেয়ে ঢের কষ্ট আপন বলয় বা অস্তিত্ব হারানোয়। নিজের পরিবেশ, নিজের জগত থেকে ছিটকে পড়ার যে কষ্ট তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাহিনীর পরতে-পরতে। আপন সমাজ দেশ প্রকৃতি পরিবেশ থেকে একেবারে অন্যজীবনে আসাটাকে সচরাচর সবাই গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু তাই মানতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে। হয়তো মানুষ এভাবেই বাঁচে কিংবা বাঁচার অভিনয় করে যায়। মাহমুদুল হকের ‘কালোবরফ’ হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ শওকত আলীর ‘ওয়ারিশ’ বা ‘দলিল’ উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায় কঠিন জীবনের আখ্যান, যা নির্মম কষ্টের রোজনামচা। এই যন্ত্রণা মানুষের একটা জীবনকে এলোমেলো করে দেয়, সে আর কোনোক্রমে থিতু হতে পারে না। সব হারানো মানুষগুলোর বুকের ভেতরে জন্মভূমি হারানোর কষ্ট চিতার আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে প্রতিনিয়ত।

‘চল্ উদ্বাস্তু! চল্!’ নামে একটা কবিতা আছে মান্নান সৈয়দের। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এদেশে চলে আসা সাহিত্যিকদের জন্মপরিচয় লুকিয়ে রাখার দরকার নেই, সেই কবিতার বিষয়বস্তু। বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রথাবিরোধী কবি-কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-গবেষক এবং সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ, সাহিত্যের এমন একটা জায়গায় তিনি পৌঁছে গেছেন যেখান থেকে টেনে নামানোর কারো সাধ্য নেই। তার সাহিত্যরতœ সামগ্রী বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ- ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ যেমন প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘অ-তে অজগর’ নতুন সংস্করণ (ইছামতীর এপার-ওপার) তেমনি প্রথম উপন্যাস, কিন্তু তারপর তারই হাত দিয়ে প্রমত্তা নদীর মতো তরতর করে বেরিয়ে এসেছে ছোটগল্প-প্রবন্ধ আরো-আরো উপন্যাস-কবিতা... তেমনি দেশের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলো তাঁর ঝুলিতে এসে ঢুকেছে একের পর এক।

ছেচল্লিশের কলকাতা রাতারাতি কেমন পাল্টে গেলো চোখের সামনে, তখন সেখানে আর কীভাবে থাকে! একজীবনে মানুষ কতোটুকুইবা দেখতে পায়- কিন্তু ভুলো সবই দেখলো। মানুষের ভাঙাগড়া যে নদীভাঙনের চেয়ে ভয়াবহ। কিছুই আর অবশিষ্ট রাখে না শুধুই স্মৃতি ছাড়া, সেই নষ্ট স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা আরো বেশি কষ্টের, নিজেকে মূল্যহীন মনে হয়- যা আমরা মুশতাক আলী অর্থাৎ ভুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। ভাসমান মানুষের যেমন কোনো ঠিকানা নেই মুশতাক আলীরও তেমন কোনো ঠিকানা নেই। আছে শুধু বুকের মধ্যে সেই কষ্টের অস্থিরতা আর জন্মভূমি না দেখার দগদগে ক্ষত।

ভুলোর নিজের সংসার, দু’ছেলে এক মেয়ে এবং স্ত্রী। সাতক্ষীরায়একটাছোট্ট নিজের বাড়ি। যা জহির মাহমুদের ভাষায়,“প্রথম কথা, ছোট একটা বাড়ি করেছেন, বাড়ির ছোট-বড় পরের কথা, আপনি একটা বাড়ি করেছেন। আমি কিন্তু করিনি বাকরতে পারিনি। এই ভাড়াবাড়িতে থাকি, দ্বিতীয় কথা, সবাই ঢাকা শহরে থাকতে হবে, তার কোনো মানে নেই। আজকাল যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন হয়েছেযে সাতক্ষীরা ঢাকা থেকে এমন কোনো দূরেও না”।

দূরের হোক বা কাছের হোক অনেক আপনজন কাছেপিঠে থাকা সত্ত্বেও মুশতাক আলী অর্থাৎ ভুলোর মনপ্রাণ সমস্ত সময় আচ্ছন্ন থাকে সাঁইপাড়ায়। নিজেকে কোনোভাবে শাসন করতে পারে না, একটা অদৃশ্য যন্ত্রণা কুঁড়ে-কুঁড়ে নিঃশেষ করে অথবা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

ঘটনা-উপঘটনায় অনেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন মান্নান সৈয়দ। অনেক নারী-পুরুষের সম্পর্কে দেখিয়েছেন অনেক অসংগতি। বেঁচে থাকার জন্য যে কখনো কখনো ঠক-বাটপারি করতে হয়, তাও চিহ্নিত করেছেন। মানুষ কেউ ফেরেস্থা নয়, দোষে-গুণে মানুষ। নিজের বড় ছেলে যখন চাকরিসূত্রে কিছুদিন পর একটা ঝকঝকে-তকতকে পরিমার্জিত কোয়ার্টার পেলো, সেদিন মুশতাক আলী খুব খুশি হয়েছিলো।

একজন মানুষ যে কখন নিজের বলয় ছিঁড়ে জাল ছেঁড়া মাছের মতো হারিয়ে যায়, তার রূপ স্পষ্ট চিত্রায়িত হয়েছে “ভাঙানৌকা” উপন্যাসে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একজন পিতার কাছে এর চেয়ে কষ্টের আর কী বা হতে পারে!

আবদুল মান্নান সৈয়দের উপন্যাসের ভাষারীতি-প্রকাশভঙ্গি এবং রীতিকৌশল একেবারে অন্যরকম। উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে, কাহিনী বুননের দিকে তিনি যতোটুকু যতœবান,মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তদ্রƒপ।আবার ভাষাপ্রয়োগ, চরিত্রের মুখে সংলাপ দেওয়ার সময়েও যথার্থ গুরুত্ব দিতে দেখি। তারপর প্রতীক উপমা এবং রূপকের কাজও দেখা যায় গল্পের শরীরে ভরপুর।

আর্থিকভাবে অসচ্ছল দুর্বল মানুষদের বরাবরই কেউ-কেউ ভিন্ন চোখে দেখে। হয়তো এটা-ই সমাজের একরকমের বৈষম্য। সমাজের ভেতরের এই বিষয়টিকে গভীরভাবে দেখেছেন, এবং তা বিশ্লেষণ করেছেন চমৎকারভাবে মান্নান সৈয়দ। জোহরা বেগম গাড়ি নিয়ে সাতক্ষীরায় যায়, এবং রাজিয়ার মুখে সপাটে একটা চড় মারেন। এই আঘাত শুধু শারীরিক ছিলো না, মানসিকও ছিলো।

দারিদ্র্য যে কতোখানি কঠিন এবং নির্মম তারও একটা দৃশ্য এখানে তুলে ধরেছেন মান্নান সৈয়দ। বারবার পাঠক দেখতে পায় ভাগ্যাহত একজন মানুষের হাহাকার কীভাবে মান্নান সৈয়দ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। সে-সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, মানুষের চাল-চলন মানুষের আর্থিক ওঠানামা এবং সর্বোপরি তার ভেতরের আরেক মানুষকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে টেনে বের করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।

সব হারানো মানুষ নিজেকে সর্বদা নিঃস্ব ভাবে। মনে করে তার বেঁচে থাকাটাই একটা বিড়ম্বনা, একটা চরম দুর্ঘটনা। তারপরও সে হয়তো নিজেকে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে রেখে খরগোশের সঙ্গে পাল্লা দেয়। তাতে কেউ-কেউ সফলতা লাভ করে, কেউবা শুধুই জাবরকাটা ছাগল হয়ে জীবনযাপন করে। উদ্বাস্তু মানুষের যেমন কষ্টের সীমা নেই, তার ভাষা বোঝার মানসিকতাও থাকে না। সৈয়দ শামিম আহমদ এবং মুশতাক আলী ভুলো একটা বলয়ের মধ্যে শেষাবধি ঘুরপাক খায়। তাদের চোখের সামনে নিশিদিন জমে থাকে স্মৃতি, সেই স্মৃতি বড়ই মর্মবেদনার।

‘ভাঙা নৌকা’ উপন্যাসের শেষ অংকে পাঠক দেখতে পায়, তিন সন্তানের জনক হয়েও শেষবয়সে এসে প্রথম যৌবনের একটা বিয়ের কথা স্মরণ করেন মুশতাক আলী:“প্রথমবার বাঁশদায়বিয়ে করেছিলো, বিয়ের কয়েক দিন যেতে না যেতেই সে মেয়ে চলে গিয়েছিলো তাকে ছেড়ে, বাপের বাড়িতে। সে কথা আজ আর মনে নেই কারো। সে মেয়েও কোথায় কে জানে, তার সেই প্রথম বিয়ের কথা রাজিয়াও জানে না”।

কঠিন সময়ে কঠিন এক প্রশ্ন রেখে উপন্যাসটি শেষ করেন মান্নান সৈয়দ। বুকের মধ্যে হাহাকারের সঙ্গে একরাশ প্রশ্ন উঁকি দেয়। মুশতাক অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠে। মনে অনেক ক্ষোভ জমে, ভাবে-“বউ ছেলেমেয়ে কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখবে না আর, নবাবপুরের হোটেল আরজুতে উঠবে, পরে আরো শস্তায় হোটেল খুঁজে নেবে, হোটেলেই কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন”।

মানিকের উপন্যাসের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এদিক থেকে একই ধরনের অনেকটা। মান্নান সৈয়দের উপন্যাসের চরিত্রের জীবন ও জগত কিছুটা স্বতন্ত্র মনে হওয়া নিতান্ত অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ তার চোখ একজন ছিন্নমূল মানুষের চোখ। সে চোখে যা কিছু দেখেছেন তা অন্য কেউ নাও দেখতে পারেন। তার চিন্তা-চেতনা আর দশজনের সাথে মিলবে এমন কোনো কারণ নেই। এখানে তার স্বাতন্ত্র্য বা বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হতেই পারে। দেশভাগের মতো বিষয়ে আমাদের দেশের সাহিত্যিকরা কমবেশি নজর দিয়েছেন, কিন্তু তা বিশাল পাঠকের কাছে সেভাবে পৌঁছেনি। আর তা হয়নি বলেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ সাহিত্যিকের দেশভাগ নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাস আড়ালেই রয়ে গেছে। যেমন আড়ালে পড়ে আছে আবদুল মান্নান সৈয়দের উপন্যাস ‘অ-তে অজগর’। তারপর ‘ভাঙানৌকা’ উপন্যাসের কথা বিশেষভাবে বলা যেতে পারে।

উপন্যাসটি আকারে ছোট হলেও এর আঙ্গিক বা কাঠামো বিশাল। যদিও বেশ তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করা যায়। অনেক কঠিন বিষয়কে জমাট না করেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। তবে কখনো মনে হয়েছে মুশতাক আলীর মতোই একটা তাড়াহুড়ো ভাব সর্বত্র ছড়ানো। ভুলো কোথাও স্থির হতে পারেনি, কোথাওএকটা তার কেটে যাওয়ার যন্ত্রণায় বিদ্ধ। নিজেকে তবে কি খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি? এমনই প্রশ্ন পাঠকের মনে সর্বদা দেখা দেবে। সমাজ-সংসার থেকে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে রাখলেও, সর্বক্ষণ বশিরহাটের সাঁইপাড়া গ্রামটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এবং সেই স্মৃতি মন্থন করে।দেশভাগের যন্ত্রণা দেশহারা মানুষের না বলা কথা উপন্যাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলোচিত হয়েছে, সেখানে একটাই বিশ্বাস- দেশ কখনো পর হয় না। দেশ থাকে বুকের মধ্যে। দেশ হারানো মানুষের কান্না শুধু দেশহারানো মানুষই অনুধাবন করতে পারে। একটা কান্নাকে আড়াল করতে অনেক কষ্ট চেপে যেতে হয়। অনেক কষ্টের মধ্যে হয়তো সুখ আছে; কিন্তু সে সুখ চিরকালের কান্নাকে কখনো ছাপিয়ে রাখতে পারে না। বাস্তুহারামানুষের এই কান্নার গল্পই ‘ভাঙানৌকা’। জীবন এখানে একটা সামন্তরাল প্রতীকে দৃশ্যমান হয়েছে; যা কঠিনকে আরো কঠিনে পরিণত করেছে। জীবনকে একটা প্রশ্নের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। চিন্তাকে করেছে শাণিত।

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

ছবি

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ভ্রম

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

রফিক আজাদের কবিতা

ছবি

ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন

ছবি

চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে

ছবি

দেশভাগের বিপর্যয় ও ‘জলপাইহাটি’র জীবনানন্দ দাশ

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

tab

সাময়িকী

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

আবদুল মান্নান সৈয়দ

বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

পৃথিবীতে পাখি কোনো সীমান্ত মানে না, কারণ তার কোনো মানচিত্র নেই, সবখানে তার অবাধ বিচরণ। আর তাই সে চিরস্বাধীন।নিরন্তর সে উড়ে বেড়াতে জানে বাঁধাহীন। অথচ মানুষ ব্যাকরণ আর মার্জিনের মধ্যে থাকে, ইচ্ছে করলেই সেই মার্জিন অতিক্রম করতে পারে না, এবং এখানেই তার সীমাবদ্ধতা। নিয়ম আর ব্যাকরণ এবং সমাজের বাঁধাধরা ঘেরাটোপের মধ্য দিয়েই তাকে চলতে হয়। তাই সে আপন বলয়ের মধ্যেই থাকে, এখানেই জীবন বাঁধা। জীবন মানেই তো একটা কঠিন ছক। সেই ছকের মধ্যেই আমাদের যাপিত জীবন আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। কেউ কি তা অতিক্রম করতে পারে, পারে না। সম্ভব নয় তার কঠিন বেড়ি খুলে ফেলার, কারণ সে সংঘবদ্ধ জীব বলেও সীমাবদ্ধ একটা ছঁকে আজীবন কলুর বলদের মতো থাকতে হয়। এবং এটাই তার ভবিতব্য।

আবদুল মান্নান সৈয়দের (১৯৪৩-২০১০) ‘ভাঙানৌকা’ (২০০৬) উপন্যাস মানুষের এই সীমাবদ্ধতার দিকেই দৃষ্টিপাত করেছে। জীবন যে কতোখানি খাঁচাবন্দি তার-ই কাহিনী বুঁনেছেন। শুনিয়েছেন সে জীবনের গল্প, যা হয়তো কারোরই কাম্য নয়। তারপরও মানুষ তা বরণ করে এবং করতেও হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগ শুধু একটা দেশই বিভাজন ছিলো না; বাস্তু হারানো মানুষের প্রিয়জন হারানোই ছিলো না; ছিলো তার শেকড় হারানোর কষ্ট। সে কষ্ট কাউকে হয়তো বলে বোঝানো যাবে না, বুকের সন্নিকটে শুধুই ধিকিধিকি জ্বলে সেই না বলা যন্ত্রণার লেলিহান আগুন। আগুনের অট্টহাসি হয়তো সবাই দেখতে পারে না, জনমদুখি মানুষই দেখে। যে দেখে তার কষ্ট তো কেউই দেখে না। মাটিহারা স্বজন হারানোর যন্ত্রণা একমাত্র তাকেই চিরকাল বয়ে বেড়াতে হয়। বয়েই যায়। নদী যেমন নিরবধি তেমনি কষ্টও ওই একেই ধারায় প্রবাহিত হয়। কোথাও থামে না, থামতে জানেও না।

‘ভাঙানৌকা’র একটা চরিত্রই কাহিনীকে পুরোদমে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সে হলো সৈয়দ মুশতাক আলী অর্থাৎ ভুলো। সে একজন রিটায়ার্ড লাইব্রেরি এ্যাসিসট্যান্ট। ছোট এই চাকুরিটা জুটিয়ে দিয়েছিলো তার এক দূরসম্পর্কের নানা জাঁদরেল এক উচ্চপদস্থ আমলা সৈয়দ শামিম আহমদ। সে অনেককাল আগের কথা। এখন তারা দুজনই বার্ধক্যে উপনীত, ভুলো যাও-বা হেঁটে-চলে বেড়াতে পারে কিন্তু শামিম আহমেদ একেবারে অক্ষম এবং কানেও কম শোনেন। বয়স তাকে স্থিরতা দিয়েছে, ভুলেছেন জীবনের যতোসব লেনদেন। তারপরও জীবনের কাছে দাঁড়িয়ে মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সময় এবং ¯্রােতের বিপরীতে না গিয়ে সামনে এগিয়ে যান আপন গতিতে।

দুজন নানা-নাতি সেই দেশভাগের সময় আল্লারাখার চর পেরিয়ে ইছামতি নদীতে নৌকা ভাসিয়ে রাতের অন্ধকারে পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসার গল্পে মেতে ওঠে। তখন অবশ্য ভুলোর বয়স কম। বশিরহাটের সাঁইপাড়া গ্রাম তাদের দুজনের মনের ভেতর চিরস্থায়ী একটা আসন গেঁড়ে বসে আছে। এমনি কলকাতার সেই পেছন জীবনের দৃশ্যাবলি ঘুরেফিরে আসে তাদের মাঝে, তখন তারা স্মৃতি মন্থনে জর্জরিত হয়, যা শয়নে-স্বপনে জাগ্রত হয়ে থাকে। যেমন-“নানা, মনে আছে, আপনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, বেকার হোস্টেলে থাকতেন আপনি, কতোবার গিয়েছি সেখানে, বেশ পরে, আপনি তখন কলেজ থেকে বেরিয়ে গেছেন, আমাকে নিয়ে গেলেন এক মিলাদ মাহফিলে। মিলাদের পরে মিষ্টি-টিষ্টি তো দিলোই সবাইকে, সে সঙ্গে রঙ্গিন একটা রুমাল প্রত্যেককে। সেই রুমাল আমি কতোদিন যে রেখে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে, নানা, কলকাতা থেকে সপ্তায়-সপ্তায় আসতেন আপনি বশিরহাটে, আপনি মাঝে-মাঝে আমাকে নিয়ে এখানে-ওখানে যেতেন, যতো বয়স বাড়ছে, নানা, ততো আমাদের সেই সাঁইপাড়া গ্রামটা যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি।”

দেশভাগের কষ্ট যতোখানি, তার চেয়ে ঢের কষ্ট আপন বলয় বা অস্তিত্ব হারানোয়। নিজের পরিবেশ, নিজের জগত থেকে ছিটকে পড়ার যে কষ্ট তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাহিনীর পরতে-পরতে। আপন সমাজ দেশ প্রকৃতি পরিবেশ থেকে একেবারে অন্যজীবনে আসাটাকে সচরাচর সবাই গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু তাই মানতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে। হয়তো মানুষ এভাবেই বাঁচে কিংবা বাঁচার অভিনয় করে যায়। মাহমুদুল হকের ‘কালোবরফ’ হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ শওকত আলীর ‘ওয়ারিশ’ বা ‘দলিল’ উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায় কঠিন জীবনের আখ্যান, যা নির্মম কষ্টের রোজনামচা। এই যন্ত্রণা মানুষের একটা জীবনকে এলোমেলো করে দেয়, সে আর কোনোক্রমে থিতু হতে পারে না। সব হারানো মানুষগুলোর বুকের ভেতরে জন্মভূমি হারানোর কষ্ট চিতার আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে প্রতিনিয়ত।

‘চল্ উদ্বাস্তু! চল্!’ নামে একটা কবিতা আছে মান্নান সৈয়দের। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এদেশে চলে আসা সাহিত্যিকদের জন্মপরিচয় লুকিয়ে রাখার দরকার নেই, সেই কবিতার বিষয়বস্তু। বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রথাবিরোধী কবি-কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-গবেষক এবং সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ, সাহিত্যের এমন একটা জায়গায় তিনি পৌঁছে গেছেন যেখান থেকে টেনে নামানোর কারো সাধ্য নেই। তার সাহিত্যরতœ সামগ্রী বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ- ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ যেমন প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘অ-তে অজগর’ নতুন সংস্করণ (ইছামতীর এপার-ওপার) তেমনি প্রথম উপন্যাস, কিন্তু তারপর তারই হাত দিয়ে প্রমত্তা নদীর মতো তরতর করে বেরিয়ে এসেছে ছোটগল্প-প্রবন্ধ আরো-আরো উপন্যাস-কবিতা... তেমনি দেশের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলো তাঁর ঝুলিতে এসে ঢুকেছে একের পর এক।

ছেচল্লিশের কলকাতা রাতারাতি কেমন পাল্টে গেলো চোখের সামনে, তখন সেখানে আর কীভাবে থাকে! একজীবনে মানুষ কতোটুকুইবা দেখতে পায়- কিন্তু ভুলো সবই দেখলো। মানুষের ভাঙাগড়া যে নদীভাঙনের চেয়ে ভয়াবহ। কিছুই আর অবশিষ্ট রাখে না শুধুই স্মৃতি ছাড়া, সেই নষ্ট স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা আরো বেশি কষ্টের, নিজেকে মূল্যহীন মনে হয়- যা আমরা মুশতাক আলী অর্থাৎ ভুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। ভাসমান মানুষের যেমন কোনো ঠিকানা নেই মুশতাক আলীরও তেমন কোনো ঠিকানা নেই। আছে শুধু বুকের মধ্যে সেই কষ্টের অস্থিরতা আর জন্মভূমি না দেখার দগদগে ক্ষত।

ভুলোর নিজের সংসার, দু’ছেলে এক মেয়ে এবং স্ত্রী। সাতক্ষীরায়একটাছোট্ট নিজের বাড়ি। যা জহির মাহমুদের ভাষায়,“প্রথম কথা, ছোট একটা বাড়ি করেছেন, বাড়ির ছোট-বড় পরের কথা, আপনি একটা বাড়ি করেছেন। আমি কিন্তু করিনি বাকরতে পারিনি। এই ভাড়াবাড়িতে থাকি, দ্বিতীয় কথা, সবাই ঢাকা শহরে থাকতে হবে, তার কোনো মানে নেই। আজকাল যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন হয়েছেযে সাতক্ষীরা ঢাকা থেকে এমন কোনো দূরেও না”।

দূরের হোক বা কাছের হোক অনেক আপনজন কাছেপিঠে থাকা সত্ত্বেও মুশতাক আলী অর্থাৎ ভুলোর মনপ্রাণ সমস্ত সময় আচ্ছন্ন থাকে সাঁইপাড়ায়। নিজেকে কোনোভাবে শাসন করতে পারে না, একটা অদৃশ্য যন্ত্রণা কুঁড়ে-কুঁড়ে নিঃশেষ করে অথবা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

ঘটনা-উপঘটনায় অনেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন মান্নান সৈয়দ। অনেক নারী-পুরুষের সম্পর্কে দেখিয়েছেন অনেক অসংগতি। বেঁচে থাকার জন্য যে কখনো কখনো ঠক-বাটপারি করতে হয়, তাও চিহ্নিত করেছেন। মানুষ কেউ ফেরেস্থা নয়, দোষে-গুণে মানুষ। নিজের বড় ছেলে যখন চাকরিসূত্রে কিছুদিন পর একটা ঝকঝকে-তকতকে পরিমার্জিত কোয়ার্টার পেলো, সেদিন মুশতাক আলী খুব খুশি হয়েছিলো।

একজন মানুষ যে কখন নিজের বলয় ছিঁড়ে জাল ছেঁড়া মাছের মতো হারিয়ে যায়, তার রূপ স্পষ্ট চিত্রায়িত হয়েছে “ভাঙানৌকা” উপন্যাসে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একজন পিতার কাছে এর চেয়ে কষ্টের আর কী বা হতে পারে!

আবদুল মান্নান সৈয়দের উপন্যাসের ভাষারীতি-প্রকাশভঙ্গি এবং রীতিকৌশল একেবারে অন্যরকম। উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে, কাহিনী বুননের দিকে তিনি যতোটুকু যতœবান,মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তদ্রƒপ।আবার ভাষাপ্রয়োগ, চরিত্রের মুখে সংলাপ দেওয়ার সময়েও যথার্থ গুরুত্ব দিতে দেখি। তারপর প্রতীক উপমা এবং রূপকের কাজও দেখা যায় গল্পের শরীরে ভরপুর।

আর্থিকভাবে অসচ্ছল দুর্বল মানুষদের বরাবরই কেউ-কেউ ভিন্ন চোখে দেখে। হয়তো এটা-ই সমাজের একরকমের বৈষম্য। সমাজের ভেতরের এই বিষয়টিকে গভীরভাবে দেখেছেন, এবং তা বিশ্লেষণ করেছেন চমৎকারভাবে মান্নান সৈয়দ। জোহরা বেগম গাড়ি নিয়ে সাতক্ষীরায় যায়, এবং রাজিয়ার মুখে সপাটে একটা চড় মারেন। এই আঘাত শুধু শারীরিক ছিলো না, মানসিকও ছিলো।

দারিদ্র্য যে কতোখানি কঠিন এবং নির্মম তারও একটা দৃশ্য এখানে তুলে ধরেছেন মান্নান সৈয়দ। বারবার পাঠক দেখতে পায় ভাগ্যাহত একজন মানুষের হাহাকার কীভাবে মান্নান সৈয়দ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। সে-সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, মানুষের চাল-চলন মানুষের আর্থিক ওঠানামা এবং সর্বোপরি তার ভেতরের আরেক মানুষকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে টেনে বের করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।

সব হারানো মানুষ নিজেকে সর্বদা নিঃস্ব ভাবে। মনে করে তার বেঁচে থাকাটাই একটা বিড়ম্বনা, একটা চরম দুর্ঘটনা। তারপরও সে হয়তো নিজেকে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে রেখে খরগোশের সঙ্গে পাল্লা দেয়। তাতে কেউ-কেউ সফলতা লাভ করে, কেউবা শুধুই জাবরকাটা ছাগল হয়ে জীবনযাপন করে। উদ্বাস্তু মানুষের যেমন কষ্টের সীমা নেই, তার ভাষা বোঝার মানসিকতাও থাকে না। সৈয়দ শামিম আহমদ এবং মুশতাক আলী ভুলো একটা বলয়ের মধ্যে শেষাবধি ঘুরপাক খায়। তাদের চোখের সামনে নিশিদিন জমে থাকে স্মৃতি, সেই স্মৃতি বড়ই মর্মবেদনার।

‘ভাঙা নৌকা’ উপন্যাসের শেষ অংকে পাঠক দেখতে পায়, তিন সন্তানের জনক হয়েও শেষবয়সে এসে প্রথম যৌবনের একটা বিয়ের কথা স্মরণ করেন মুশতাক আলী:“প্রথমবার বাঁশদায়বিয়ে করেছিলো, বিয়ের কয়েক দিন যেতে না যেতেই সে মেয়ে চলে গিয়েছিলো তাকে ছেড়ে, বাপের বাড়িতে। সে কথা আজ আর মনে নেই কারো। সে মেয়েও কোথায় কে জানে, তার সেই প্রথম বিয়ের কথা রাজিয়াও জানে না”।

কঠিন সময়ে কঠিন এক প্রশ্ন রেখে উপন্যাসটি শেষ করেন মান্নান সৈয়দ। বুকের মধ্যে হাহাকারের সঙ্গে একরাশ প্রশ্ন উঁকি দেয়। মুশতাক অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠে। মনে অনেক ক্ষোভ জমে, ভাবে-“বউ ছেলেমেয়ে কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখবে না আর, নবাবপুরের হোটেল আরজুতে উঠবে, পরে আরো শস্তায় হোটেল খুঁজে নেবে, হোটেলেই কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন”।

মানিকের উপন্যাসের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এদিক থেকে একই ধরনের অনেকটা। মান্নান সৈয়দের উপন্যাসের চরিত্রের জীবন ও জগত কিছুটা স্বতন্ত্র মনে হওয়া নিতান্ত অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ তার চোখ একজন ছিন্নমূল মানুষের চোখ। সে চোখে যা কিছু দেখেছেন তা অন্য কেউ নাও দেখতে পারেন। তার চিন্তা-চেতনা আর দশজনের সাথে মিলবে এমন কোনো কারণ নেই। এখানে তার স্বাতন্ত্র্য বা বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হতেই পারে। দেশভাগের মতো বিষয়ে আমাদের দেশের সাহিত্যিকরা কমবেশি নজর দিয়েছেন, কিন্তু তা বিশাল পাঠকের কাছে সেভাবে পৌঁছেনি। আর তা হয়নি বলেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ সাহিত্যিকের দেশভাগ নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাস আড়ালেই রয়ে গেছে। যেমন আড়ালে পড়ে আছে আবদুল মান্নান সৈয়দের উপন্যাস ‘অ-তে অজগর’। তারপর ‘ভাঙানৌকা’ উপন্যাসের কথা বিশেষভাবে বলা যেতে পারে।

উপন্যাসটি আকারে ছোট হলেও এর আঙ্গিক বা কাঠামো বিশাল। যদিও বেশ তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করা যায়। অনেক কঠিন বিষয়কে জমাট না করেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। তবে কখনো মনে হয়েছে মুশতাক আলীর মতোই একটা তাড়াহুড়ো ভাব সর্বত্র ছড়ানো। ভুলো কোথাও স্থির হতে পারেনি, কোথাওএকটা তার কেটে যাওয়ার যন্ত্রণায় বিদ্ধ। নিজেকে তবে কি খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি? এমনই প্রশ্ন পাঠকের মনে সর্বদা দেখা দেবে। সমাজ-সংসার থেকে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে রাখলেও, সর্বক্ষণ বশিরহাটের সাঁইপাড়া গ্রামটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এবং সেই স্মৃতি মন্থন করে।দেশভাগের যন্ত্রণা দেশহারা মানুষের না বলা কথা উপন্যাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলোচিত হয়েছে, সেখানে একটাই বিশ্বাস- দেশ কখনো পর হয় না। দেশ থাকে বুকের মধ্যে। দেশ হারানো মানুষের কান্না শুধু দেশহারানো মানুষই অনুধাবন করতে পারে। একটা কান্নাকে আড়াল করতে অনেক কষ্ট চেপে যেতে হয়। অনেক কষ্টের মধ্যে হয়তো সুখ আছে; কিন্তু সে সুখ চিরকালের কান্নাকে কখনো ছাপিয়ে রাখতে পারে না। বাস্তুহারামানুষের এই কান্নার গল্পই ‘ভাঙানৌকা’। জীবন এখানে একটা সামন্তরাল প্রতীকে দৃশ্যমান হয়েছে; যা কঠিনকে আরো কঠিনে পরিণত করেছে। জীবনকে একটা প্রশ্নের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। চিন্তাকে করেছে শাণিত।

back to top