alt

সাময়িকী

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

শফিকুল ইসলাম শান্ত

: শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫

‘মোহ কাঠের নৌকা’ উপন্যাসটি মূলত জীবন সংগ্রামের এক নিখুঁত চিত্রায়ন। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমাদের সমাজের নানা স্তরের মানুষের হতাশা, সংগ্রাম ও স্বপ্নকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত তরুণের চোখ দিয়ে আমাদের সমাজের বাস্তবতা ও তার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব তুলে ধরে, যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে।

উপন্যাসের সূচনা ও প্রেক্ষাপট : উপন্যাসের শুরুতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক আসামির ফাঁসি কার্যকরের খবর তুলে ধরা হয়েছে। একসময় যার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করেছিল এই উপন্যাসের মূল চরিত্র রবীন। কিন্তু টেলিভিশনের স্ক্রলে ফাঁসি কার্যকরের ব্রেকিং দেখামাত্রই রবীনের মনে প্রশ্ন জাগে- একজন জলজ্যান্ত মানুষকে ফাঁসি? ন্যায়বিচারের নামে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া কতটা ন্যায়সংগত?

এই মুহূর্তেই লেখক দস্তয়েভস্কির দর্শনের সঙ্গে রবীনের দ্বন্দ্বকে মিলিয়ে দেন। দস্তয়েভস্কি তার ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট বইয়ে বলেন, যখন কাউকে হত্যার দায়ে অপর কাউকে মৃত্যুদ- বা ফাঁসি দেওয়া হয়, সেটা ন্যায় বিচার হয় না। কারণ, যে ব্যক্তিকে তুমি ন্যায় বিচারের নামে ফাঁসি দিচ্ছো, তাকে বেশি শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কেননা যাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে হয়তো জানতো না যে তাকে মেরে ফেলা হবে। তার মৃত্যুটা আকস্মিক, কষ্টটা ছিল কম। কিন্তু যাকে তুমি ফাঁসি দিচ্ছো তাকে প্রতি মুহূর্তে একবার করে মেরে ফেলছো। প্রিয় খাবার খেতে দিল সে ভাবছে, এই বুঝি ঝুলিয়ে দিল। পরিবারের সাথে দেখা করার সুযোগ দিলে ভাবছে, আজই বোধহয় শেষ। এভাবে প্রতিটি মুহূর্তে সে একবার করে মরে যায়। ফলে, তুমি ন্যায় বিচার করছো না বরং বেশি শাস্তি দিচ্ছো। এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব গোটা উপন্যাসজুড়েই রবীনের চরিত্রের গভীরতা ও তার বেঁচে থাকার লড়াইকে আরও বাস্তব করে তোলে।

রবীনের জীবনযুদ্ধ ও সমাজ বাস্তবতা : রবীন ঢাকার একটি অখ্যাত অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক। যেখানে বেতন হয় অনিয়মিত। ফলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই তার জন্য এক সংগ্রাম। নিজের খাবারের টাকা জোগাড় করতেও তাকে ধার করতে হয়। হাত পাততে হয় বাসার দারোয়ান বজলুর কাছেও। এমন দীর্ঘমেয়াদী অভাব তার মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রভাবিত করে। যার প্রমাণ পাওয়া যায়- আড়ংয়ে শপিং সেন্টারে গিয়ে। বান্ধবী রুবির স্বাভাবিক কেনাকাটা দেখেও সে ভাবে—এগুলো বাহুল্য, এত টাকা খরচের প্রয়োজন কী? লেখক এখানে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন, কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট একজন মানুষের চিন্তাভাবনা ও আত্মবিশ্বাসকে সংকীর্ণ করে দেয়। অর্থাৎ মুক্ত চিন্তার জন্য অর্থনৈতিক মুক্তিও জরুরি। গ্রাম থেকে উঠে আসা রবীনের জন্য শহুরে জীবনটা কখনোই আপন হয়ে ওঠেনি। আবার গ্রামেও তার আর জায়গা নেই। ফলে, সে এক পরগাছার মতো টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়। রবীন অন্তর্মুখী, ফলে সহকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো হলেও, তারা যখন ভালো সুযোগ পেয়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন রবীনের কথা কেউ ভাবে না। এমনকি গ্রামে ফিরলে একসময়ের পরিচিত মানুষরাও তাকে গুরুত্ব দেয় না। অর্থ ও ক্ষমতা কীভাবে মানুষের সামাজিক অবস্থান বদলায়, সেটিরও দারুণ চিত্রায়ন করেছেন লেখক।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও নিঃসঙ্গতা : রবীনের সত্যিকারের কেউ থেকে থাকলে সেটা তার পরিবার। কিন্তু নিজের দৈন্যদশা ঢাকতে পরিবারের কাছ থেকেও দূরত্ব বজায় রাখে সে। বাবা-মা তার বিয়ের জন্য উদ্বিগ্ন। কিন্তু রবীন নির্লিপ্ত। শেষে রুবির পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে অনেক ভেবেচিন্তে রাজি হয় সে। রুবি একজন ব্যাংকার, বাবাকে হারিয়ে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে। এই জায়গায় লেখক মধ্যবিত্ত জীবনের দুটি ভিন্ন বাস্তবতা দেখিয়েছেন- একজন সংগ্রামের পর উঠে দাঁড়াতে পেরেছে, আরেকজন এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। রবীনের জীবনে এক আশার আলো হয়ে আসে রুবি। ঠিক যেন বৈশাখের প্রথম বৃষ্টি। কিন্তু বৈশাখের বৃষ্টির সঙ্গে থাকে কালবৈশাখীর ঝড়ও। উপন্যাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক অপ্রত্যাশিত ফোনকল তেমনি রবীনের জীবনের মোড় বদলে দেয়। যা পাঠককে হতবাক করবে।

ভাষা ও চরিত্রায়ণ : লেখকের ভাষা সরল, সংলাপগুলো প্রাণবন্ত, আর আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে চরিত্রগুলো বাস্তব মনে হয়। বিশেষ করে রবীন, রুবি, রুবির মা ও জলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দারুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গল্পের বর্ণনা এতটাই জীবন্ত যে, পাঠক রবীনের জীবন সংগ্রামে নিজেদেরই দেখতে পাবেন।

বইটির শক্তিশালী দিক : বাস্তবসম্মত চরিত্রায়ন- রবীন, রুবি এবং অন্যান্য চরিত্রগুলো জীবন্ত ও বাস্তব মনে হয়। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জীবনের টানাপোড়েনের গভীর চিত্রায়ন- লেখক দারুণভাবে দেখিয়েছেন, কীভাবে আর্থিক সংকট ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব ফেলে। সংবেদনশীল উপস্থাপনা- ফাঁসি কার্যকর হওয়ার প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে নিঃসঙ্গতা, হতাশা ও বেঁচে থাকার লড়াই, সবই সংবেদনশীলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভাষার স্বতঃস্ফূর্ততা ও উপন্যাসের গাঁথুনি- লেখক সহজ ভাষায় গভীর জীবন দর্শন তুলে ধরেছেন।

আরও উন্নত করা যেত : গল্পের গতি কিছু জায়গায় ধীর- কিছু অংশে ঘটনাপ্রবাহ ধীর মনে হতে পারে। কিছু বর্ণনায় ধারাবাহিকতার অভাব- কিছু ক্ষেত্রে বর্ণনা আরেকটু সাবলীল করা যেত। রবীনের হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি- যদিও এটি বাস্তবসম্মত, তবে কিছু পাঠকের কাছে এটি অতিরিক্ত নেতিবাচক মনে হতে পারে।

শেষ কথা : ‘মোহ কাঠের নৌকা’ শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির গল্প নয়, এটি আমাদের সমাজের অসংখ্য মধ্যবিত্ত সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে নিজেদের টিকিয়ে রাখার লড়াই করছেন, অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত, সম্পর্কের দোলাচলে দিশেহারা- তাদের সবার গল্পই এতে আছে। যারা সাংবাদিকতা করছেন, যারা নিজের ভাগ্য বদলাতে চান, কিন্তু প্রতিনিয়ত বাস্তবতার কঠিন দেয়ালে আঘাত খাচ্ছেন- তাদের জন্য এই উপন্যাস এক আবেগময় আয়না হয়ে উঠবে। পড়ুন, আর নিজেকেই খুঁজে নিন ‘মোহ কাঠের নৌকা’-তে।

মোহ কাঠের নৌকা॥ প্রকাশক বাংলানামা॥ অমর একুশে বইমেলা ২০২৫॥ মুদ্রিত মূল্য ৪৫০টাকা॥ প্রচ্ছদ কমল ঠাকুর

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

শাঁকচুন্নি

ছবি

মেঘনাদবধ, এক নতুন দৃশ্যভাষা

ছবি

নতুন কবিতার সন্ধানে

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতা

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

tab

সাময়িকী

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

শফিকুল ইসলাম শান্ত

শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫

‘মোহ কাঠের নৌকা’ উপন্যাসটি মূলত জীবন সংগ্রামের এক নিখুঁত চিত্রায়ন। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমাদের সমাজের নানা স্তরের মানুষের হতাশা, সংগ্রাম ও স্বপ্নকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত তরুণের চোখ দিয়ে আমাদের সমাজের বাস্তবতা ও তার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব তুলে ধরে, যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে।

উপন্যাসের সূচনা ও প্রেক্ষাপট : উপন্যাসের শুরুতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক আসামির ফাঁসি কার্যকরের খবর তুলে ধরা হয়েছে। একসময় যার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করেছিল এই উপন্যাসের মূল চরিত্র রবীন। কিন্তু টেলিভিশনের স্ক্রলে ফাঁসি কার্যকরের ব্রেকিং দেখামাত্রই রবীনের মনে প্রশ্ন জাগে- একজন জলজ্যান্ত মানুষকে ফাঁসি? ন্যায়বিচারের নামে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া কতটা ন্যায়সংগত?

এই মুহূর্তেই লেখক দস্তয়েভস্কির দর্শনের সঙ্গে রবীনের দ্বন্দ্বকে মিলিয়ে দেন। দস্তয়েভস্কি তার ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট বইয়ে বলেন, যখন কাউকে হত্যার দায়ে অপর কাউকে মৃত্যুদ- বা ফাঁসি দেওয়া হয়, সেটা ন্যায় বিচার হয় না। কারণ, যে ব্যক্তিকে তুমি ন্যায় বিচারের নামে ফাঁসি দিচ্ছো, তাকে বেশি শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কেননা যাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে হয়তো জানতো না যে তাকে মেরে ফেলা হবে। তার মৃত্যুটা আকস্মিক, কষ্টটা ছিল কম। কিন্তু যাকে তুমি ফাঁসি দিচ্ছো তাকে প্রতি মুহূর্তে একবার করে মেরে ফেলছো। প্রিয় খাবার খেতে দিল সে ভাবছে, এই বুঝি ঝুলিয়ে দিল। পরিবারের সাথে দেখা করার সুযোগ দিলে ভাবছে, আজই বোধহয় শেষ। এভাবে প্রতিটি মুহূর্তে সে একবার করে মরে যায়। ফলে, তুমি ন্যায় বিচার করছো না বরং বেশি শাস্তি দিচ্ছো। এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব গোটা উপন্যাসজুড়েই রবীনের চরিত্রের গভীরতা ও তার বেঁচে থাকার লড়াইকে আরও বাস্তব করে তোলে।

রবীনের জীবনযুদ্ধ ও সমাজ বাস্তবতা : রবীন ঢাকার একটি অখ্যাত অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক। যেখানে বেতন হয় অনিয়মিত। ফলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই তার জন্য এক সংগ্রাম। নিজের খাবারের টাকা জোগাড় করতেও তাকে ধার করতে হয়। হাত পাততে হয় বাসার দারোয়ান বজলুর কাছেও। এমন দীর্ঘমেয়াদী অভাব তার মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রভাবিত করে। যার প্রমাণ পাওয়া যায়- আড়ংয়ে শপিং সেন্টারে গিয়ে। বান্ধবী রুবির স্বাভাবিক কেনাকাটা দেখেও সে ভাবে—এগুলো বাহুল্য, এত টাকা খরচের প্রয়োজন কী? লেখক এখানে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন, কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট একজন মানুষের চিন্তাভাবনা ও আত্মবিশ্বাসকে সংকীর্ণ করে দেয়। অর্থাৎ মুক্ত চিন্তার জন্য অর্থনৈতিক মুক্তিও জরুরি। গ্রাম থেকে উঠে আসা রবীনের জন্য শহুরে জীবনটা কখনোই আপন হয়ে ওঠেনি। আবার গ্রামেও তার আর জায়গা নেই। ফলে, সে এক পরগাছার মতো টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়। রবীন অন্তর্মুখী, ফলে সহকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো হলেও, তারা যখন ভালো সুযোগ পেয়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন রবীনের কথা কেউ ভাবে না। এমনকি গ্রামে ফিরলে একসময়ের পরিচিত মানুষরাও তাকে গুরুত্ব দেয় না। অর্থ ও ক্ষমতা কীভাবে মানুষের সামাজিক অবস্থান বদলায়, সেটিরও দারুণ চিত্রায়ন করেছেন লেখক।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও নিঃসঙ্গতা : রবীনের সত্যিকারের কেউ থেকে থাকলে সেটা তার পরিবার। কিন্তু নিজের দৈন্যদশা ঢাকতে পরিবারের কাছ থেকেও দূরত্ব বজায় রাখে সে। বাবা-মা তার বিয়ের জন্য উদ্বিগ্ন। কিন্তু রবীন নির্লিপ্ত। শেষে রুবির পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে অনেক ভেবেচিন্তে রাজি হয় সে। রুবি একজন ব্যাংকার, বাবাকে হারিয়ে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে। এই জায়গায় লেখক মধ্যবিত্ত জীবনের দুটি ভিন্ন বাস্তবতা দেখিয়েছেন- একজন সংগ্রামের পর উঠে দাঁড়াতে পেরেছে, আরেকজন এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। রবীনের জীবনে এক আশার আলো হয়ে আসে রুবি। ঠিক যেন বৈশাখের প্রথম বৃষ্টি। কিন্তু বৈশাখের বৃষ্টির সঙ্গে থাকে কালবৈশাখীর ঝড়ও। উপন্যাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক অপ্রত্যাশিত ফোনকল তেমনি রবীনের জীবনের মোড় বদলে দেয়। যা পাঠককে হতবাক করবে।

ভাষা ও চরিত্রায়ণ : লেখকের ভাষা সরল, সংলাপগুলো প্রাণবন্ত, আর আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে চরিত্রগুলো বাস্তব মনে হয়। বিশেষ করে রবীন, রুবি, রুবির মা ও জলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দারুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গল্পের বর্ণনা এতটাই জীবন্ত যে, পাঠক রবীনের জীবন সংগ্রামে নিজেদেরই দেখতে পাবেন।

বইটির শক্তিশালী দিক : বাস্তবসম্মত চরিত্রায়ন- রবীন, রুবি এবং অন্যান্য চরিত্রগুলো জীবন্ত ও বাস্তব মনে হয়। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জীবনের টানাপোড়েনের গভীর চিত্রায়ন- লেখক দারুণভাবে দেখিয়েছেন, কীভাবে আর্থিক সংকট ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব ফেলে। সংবেদনশীল উপস্থাপনা- ফাঁসি কার্যকর হওয়ার প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে নিঃসঙ্গতা, হতাশা ও বেঁচে থাকার লড়াই, সবই সংবেদনশীলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভাষার স্বতঃস্ফূর্ততা ও উপন্যাসের গাঁথুনি- লেখক সহজ ভাষায় গভীর জীবন দর্শন তুলে ধরেছেন।

আরও উন্নত করা যেত : গল্পের গতি কিছু জায়গায় ধীর- কিছু অংশে ঘটনাপ্রবাহ ধীর মনে হতে পারে। কিছু বর্ণনায় ধারাবাহিকতার অভাব- কিছু ক্ষেত্রে বর্ণনা আরেকটু সাবলীল করা যেত। রবীনের হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি- যদিও এটি বাস্তবসম্মত, তবে কিছু পাঠকের কাছে এটি অতিরিক্ত নেতিবাচক মনে হতে পারে।

শেষ কথা : ‘মোহ কাঠের নৌকা’ শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির গল্প নয়, এটি আমাদের সমাজের অসংখ্য মধ্যবিত্ত সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে নিজেদের টিকিয়ে রাখার লড়াই করছেন, অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত, সম্পর্কের দোলাচলে দিশেহারা- তাদের সবার গল্পই এতে আছে। যারা সাংবাদিকতা করছেন, যারা নিজের ভাগ্য বদলাতে চান, কিন্তু প্রতিনিয়ত বাস্তবতার কঠিন দেয়ালে আঘাত খাচ্ছেন- তাদের জন্য এই উপন্যাস এক আবেগময় আয়না হয়ে উঠবে। পড়ুন, আর নিজেকেই খুঁজে নিন ‘মোহ কাঠের নৌকা’-তে।

মোহ কাঠের নৌকা॥ প্রকাশক বাংলানামা॥ অমর একুশে বইমেলা ২০২৫॥ মুদ্রিত মূল্য ৪৫০টাকা॥ প্রচ্ছদ কমল ঠাকুর

back to top