ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৩
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
হেনেরআলিফে বাগানের একদিক
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দলের সবার ক্লান্তি ও একঘেয়েমি ভাব লক্ষ্য করে বকরিম বলল- এখন তোমাদের নিয়ে যাব এক সুন্দর বাগানে, যা দেখে তোমাদের সব ক্লান্তি মুছে যাবে। বাগানে বসার সুন্দর জায়গা আছে, তোমরা সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পার। পরে আস্তে ধীরে বাগান ঘুরে দেখতে পার।
নুড়ি-বিছানো রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলাম সবাই- দু’পাশে পপলার, পাইন আর কমলা গাছের সারি। গাছের এ সারি যোগ দিল বিশাল, চমৎকার এক বাগানে, ঢুকতেই চোখে পড়ল নাম, হেনেরআলিফে। যথারীতি এর এক বর্ণনা দিয়ে শুরু করল বকরিম।
এ বাগানটির স্প্যানিস নাম হেনেরআলিফে। ইংরেজি বানান অনুসরণ করে অনেকে বলে জেনারেল-লাইফ, যা ভুল। আলহাম্বরা-র মূল দেয়ালের বাইরে এর অবস্থান। বারো শত বছর আগের বাগান, মূল নকশা রক্ষা করে বাগানের অনেক সংস্কার করা হয়েছে; অনেক গাছ নতুন করে লাগানো। এখানে উৎপাদিত শাক-সবজি ও ফল-মূল দিয়ে অতীতে পুরো আলহাম্বরা এলাকা- যার আরেক নাম মদিনাত আলহাম্বরা-এর কয়েক হাজার বাসিন্দার চাহিদা পূরণ হয়ে যেত।
হেনেরআলিফে-র প্রাসাদগুলি সাদামাটা। এর নকশায় সহজ-সরলতা আনা হয়েছে আলহাম্বরা-র জাঁকজমকপূর্ণ ব্যস্ত জীবন থেকে সুলতানদের সাময়িক মুক্তি দেয়ার জন্য। হৃদয়-মন জুড়ানোর জন্য সাথে আরো রয়েছে মনোরম বাগান, মাঝে মাঝে ফোয়ারা ও জলাশয়।
বকরিমের বর্ণনা চলল, সাথে চলল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সবার ধীরে ধীরে ওপরে ওঠা। রাস্তাটির দু’পাশে সারি সারি সাইপ্রেস গাছ, নাম তাই সাইপ্রেস ওয়াক, সেটি ধরে এগোতেই পৌঁছলাম এক বিরাট চত্বরে, যা পাইন ও কমলা গাছ দিয়ে ঘেরা। এক পাশে রয়েছে এক পুরনো ফোয়ারা। পায়ে হাঁটার রাস্তাগুলি গ্রানাদার ঐতিহ্য অনুসারে নুড়ি-পাথরের মোজাইকে আচ্ছাদিত- গ্রানাদার দু’টি নদীর নুড়ি-পাথর- দারো নদীর সাদা পাথর, হেনিল নদীর কাল পাথর। বসার জন্য মাটি ও সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত অনেকগুলি ধাপ করা হয়েছে। স্টেজের দৃশ্যপট হিসেবে কাজ করছে সাইপ্রেস গাছের সারি। প্রকৃতি ও স্থাপত্যের এ এক মেলবন্ধন। চত্বরটির নাম হেনেরআলিফে থিয়েটার, যা একটি ওপেন-এয়ার কনসার্ট এরেনা- গ্রানাদার সঙ্গীত ও নাচ উৎসবের ভেন্যু হিসেবে ১৯৫৩ সালে এটি উন্মুক্ত হয়। এরপর ২০০২ সালে শুরু হওয়া লোরকা ও গ্রানাদা উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে এখানে প্রতি বছর। তাছাড়াও মাঝে মধ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে। গত বছরই এখানে অনুষ্ঠিত হলো বব ডিলানের কনসার্ট।
এই বিশাল, সুন্দর বাগান দেখে নাবিল ও নাতাশা এতই খুশি, বলল, এখানেই সারা দিন থাকব, অন্য কোথায়ও যাব না। বললাম, আমরা এখানে দেখতে এসেছি পুরো আলহাম্বরা, যার মূল আকর্ষণ বলা যায় নাসরীয় প্রাসাদ। এটি দেখা শেষ হয়েছে, এ বাগানটি দেখা শেষ করে আমরা দেখব আলহাম্বরা-র তৃতীয় অংশ, আলকাযাবা। হেনেরআলিফে বাগানটি রিল্যাক্স করার জায়গা। বকরিম ওদেরকে আশ্বাস দিল, আলকাযাবা শেষ করে তোমরা আবার ফেরার পথে এই বাগানে আসবে, তখন যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারবে। দু’জনেই খুব খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল।
সবাই আবার চলা শুরু করলাম। ছোট ছোট কয়েকটি আঙিনা পার হয়ে এবার আসলাম এক বড় চত্বরে, পেথিও দে আছেকিয়া-তে, যা ৪৮ মিটার লম্বা ও ১২ মিটার চওড়া এক সুন্দর বাগান। তার মাঝখানে বয়ে চলেছে এক সুন্দর জলপ্রণালি, তার দুপাশের ফুল গাছে রঙবেরঙের ফুল, যার উপর ঝরে পড়ছে ফোয়ারার জল। এর দু’দিকে রয়েছে অনেকগুলি আচ্ছাদিত প্যাভিলিয়ন এবং আরেক প্রান্তে রয়েছে দোতলা সাদা প্রাসাদ- সুলতানদের গ্রীষ্মকালীন বিশ্রামস্থল।
হেনেরআলিফে-র সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এটি- এখানে এসে বকরিম একটু থেমে বলল- এর নীচে পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে অনেক ফলবাগিচা, তোমরা পরে আস্তে ধীরে দেখতে পারো, সেখানে বিশ্রাম নিতে পার। এখন আমরা এ উদ্যান থেকে বিদায় নিয়ে যাই আলকাছাবা দুর্গে।
বকরিম-কে অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। সে যথারীতি শুরু করল এর ইতিহাস বর্ণনা।
সবার শেষে আলকাছাবা দেখতে আসলাম, কিন্তু আলহাম্বরা-য় সবার আগে তা বানানো, যার আরেক নাম কালাত আলহাম্বরা, বা লাল দুর্গ। মুসলিম শাসকরা ১৩শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এক সামরিক দুর্গ হিসেবে এটি নির্মাণ করেন। আলহাম্বরা-র পশ্চিম পাশে অবস্থিত এ দুর্গটি ত্রিভুজ আকৃতির, মাঝখানের জায়গায় ছিল সৈন্যদের আবাসিক ভবন ও আনুষঙ্গিক স্থাপনা। আলকাছাবা-র পুরোটিই দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত- দেয়ালের সাথে আছে বিভিন্ন টাওয়ার। আলকাছাবা-র সর্বোচ্চ টাওয়ার উত্তর-পূর্বের থরে দেল ওমেনাহে, যার বিশেষ অবস্থানের কারণে এটি কমান্ড পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এর ডান পাশেই রয়েছে টাওয়ার থরে কেব্রাডা, যার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রয়েছে বিশাল এক ফাটল। দক্ষিণ-পশ্চিমের টাওয়ার থরে দে লা সুলতানা, যার নিচে শোভা পাচ্ছে সুন্দর উদ্যান হার্দিন দেল আদার্বে।
আলকাছাবা-র প্রবেশ পথের কাছেই হার্দিন দেল আদার্বে বাগানটি ছড়িয়ে আছে। গ্রানাদার এক সুন্দর দৃশ্য দেখার জন্য এর চেয়ে ভাল স্থান আর হয় না। এ বাগানটির পশ্চিম পাশে এক লুকঅউট পয়েন্ট রয়েছে। সেখান থেকে এক দেয়াল শুরু হয়ে চলে গেছে ভারমিলিয়ন টাওয়ার পর্যন্ত। দেয়ালের উপর খোদিত মেক্সিকোর কবি ফ্রানসিসকো দ্য আাইকাছা-র একটি বিখ্যাত কবিতা:
Give him alms, woman,
There is nothing in this life
Like the pain of being
Blind in Granada.3
এ কবিতা নিয়ে একটি গল্প আছে। মেক্সিকোর কবি ফ্রানসিসকো দে আইকাছা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একবার গ্রানাদা বেড়াতে আসেন। একদিন আলহাম্বরা ভ্রমণকালে এক অন্ধ লোক তাঁদের কাছে ভিক্ষা চায়। তখন কবি তাঁর স্ত্রীকে বলেন: হে নারী, তাকে ভিক্ষা দাও। কারণ গ্রানাদায় অন্ধ হওয়ার চেয়ে বড় কোনো দুঃখ এ জীবনে নাই।
আলকাছাবা-র পশ্চিমের শীর্ষবিন্দুতে রয়েছে ২৭ মিটার উঁচু এক বড় টাওয়ার, থরে দে লা ভেলা। টাওয়ারটির ওপর থেকে বিস্তৃত এলাকা পর্যবেক্ষণ করা যায়, অন্যদিকে এটি দেখা যায় গ্রানাদার বিশাল এলাকা থেকে। এখানকার ঘন্টাগুলি মূল স্থাপনায় ছিল না, ক্যাথলিক রাজন্যবর্গ কাস্তিল থেকে এনে এগুলি বসান।
এর উপরে বিশাল বর্গাকার বুরুজ, একসাথে এখানে শোভা পাচ্ছে ৪টি পতাকা। নাবিল জিজ্ঞেস করল, একটি দেশের ৪টি পতাকা কেন? বকরিম ব্যাখ্যা করল, গ্রানাদার আছে চার পরিচয়, তাই তাদের তুলে ধরা হয়েছে চার পতাকায়- ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর নীল পতাকা, আন্দালুসিয়ার সবুজ ও সাদা, স্পেনের লাল ও হলুদ, আর গ্রানাদার লাল ও সবুজ। নাতাশা বলে উঠল,অস্টিনে আমাদের স্টেট ক্যাপিটল ভবনে ঢুকতেই তার মেঝেতে রয়েছে ৬টি পতাকার ছবি- ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের টেক্সাসের পতাকা। বকরিম ‘ওয়াও’ বলে মুচকি হাসল শুধু, তবে ৬টি পতাকার বর্ণনা শুনতে চাইল না। সুদূর টেক্সাসের পতাকার ইতিহাস শোনার সময় তার হাতে নেই। নাবিল ও নাতাশা ছবি তুলতে চায় না, বলে, কিপ ইন মেমোরি। এবার কিন্তু বলল, চার পতাকার সাথে আমাদের ছবি তুলে দাও। বকরিম বলল, নিচে থেকে সব পতাকা ভাল আসবে না। আমরা এখন টাওয়ারটির ওপরে উঠব, তখন পতাকার সামনে, কাছে থেকে ছবি তুলতে পারবে।
অনেকগুলি সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে আমরা থরে দে লা ভেলা-র বুরুজে পৌঁছে দেখি, এটি লোকে লোকারণ্য। সবাই এত উঁচু থেকে সবদিকের দৃশ্য দেখছে, ছবি তুলছে। আমরাও কোনো রকমে জায়গা করে নিয়ে সবদিক দেখতে লাগলাম। আগে দেখেছি নিচে থেকে ওপরে, এখন দেখছি ওপর থেকে নিচে। গতকাল আলবাইসিন এলাকার সান নিকোলাস লুকআউট পয়েন্ট থেকে দেখেছি সূর্যাস্তের আলহাম্বরা-কে, আর আজ দেখছি আলহাম্বরা-র টাওয়ার থেকে দুপুরের সান নিকোলাস লুকআউট পয়েন্ট ও আলবাইসিন-কে। দেখতে পাচ্ছি সান নিকোলাস লুকআউট পয়েন্ট ও তার জনারণ্য, তারা দেখছে আলহাম্বরা-কে, কেউ কেউ হাত নাড়াচ্ছে, এদিক থেকে আলহাম্বরার অনেকে সাড়াও দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা জাহাজে দাঁড়িয়ে বন্দরে অপেক্ষমাণ জনতাকে দেখছি, তারা যেমন দেখছে জাহাজের যাত্রীদের। এরপর আমরা বিপরীত দিকে তাকালাম, সেখানে সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা দীপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে সিয়েরা নেভাদা, অন্যদিকে গ্রানাদা, মাঝখানে আলহাম্বরা- নিসর্গ, নগর ও স্থাপত্যের এত মহিমান্বিত সহাবস্থান সচরাচর দেখা যায় না। ছবি তুললাম সিয়েরা নেভাদা-র, তার কোলে আলহাম্বরা ও আমরা সবাই- বকরিমের সাথে পুরো গ্রুপ। আর নাবিল ও নাতাশার চার পতাকার সামনে ছবি তোলা তো রয়েছেই।
এরপর বকরিম করুণ সুরে ঘোষণা করল, সবকিছুর শেষ আছে। আমাদেরও দেখা শেষ- আলকাছাবা, সেই সাথে আলহাম্বরা, এবার বিদায় নেবার পালা। সবাই একে একে বিদায় নিল। আমরা চারজন বকরিমের সাথে ছবি তুললাম, তাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে, আলিঙ্গন করে বিদায় নিলাম। সত্যিই একজন ভালো গাইড বকরিম, যার ইতিহাস জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতা অসাধারণ।
আলহাম্বরা দেখতে দেখতে গ্রুপের অনেকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। আমাদের গ্রুপের ১২ জন ৫টি দেশ থেকে এসেছে আলহাম্বরা দেখতে- তবে সবার উদ্দেশ্য ভিন্ন। যুক্তরাজ্যের জেনি-র উদ্দেশ্য ইতিহাসের এক বিশিষ্ট নিদর্শন দেখা-স্পেনের আরো অনেক ঐতিহাসিক জিনিস দেখবে- আলহাম্বরা তার একটি। মিশরের বরকাত শুধুমাত্র আলহাম্বরা দেখার জন্যই এসেছে স্পেনে, কারণ এটি এক বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহ্য। ভারতের মিশ্র বলল, স্পেনের এক বিরাট স্থাপত্য আলহাম্বরা। এটি দেখা ছাড়া স্পেন ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থাকবে। বাকিদের চিন্তা-ভাবনাও এসবের সমান্তরালে। সবাই জিজ্ঞেস করল, তোমরা কেন আলহাম্বরা দেখতে এসেছ? নাবিল ও নাতাশা বলল, জাস্ট ফর ফান। ফারজানা বলল, দেখার জন্য এক সুন্দর জিনিস আলহাম্বরা। আমি বললাম, দেখতে এসেছি মূলত লোরকাকে, সাথে প্রেক্ষাপটের আলহাম্বরা, সিয়েরা নেভাদা ও গ্রানাদাকে। লোরকা, আলহাম্বরা, সিয়েরা নেভাদা ও গ্রানাদা- এখানে একসাথে মিশে আছে, এদের আলাদা করা কঠিন। দুয়েকজন একমত হলো, বাকিরা রহস্যপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল।
আলকাছাবা থেকে ফেরার পথে পড়ল প্লাজা দে লস আলহিবেস। ক্যাথলিকদের গ্রানাদা জয়ের পরে নির্মিত হয়েছে এই প্লাজা, যার একদিকে আছে আলকাছাবা-র দেয়াল ও টাওয়ার, আর বিপরীত দিকে আছে পুয়ের্টা দেল ভিনো, নাসিরীয় প্রাসাদ ও পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদ। প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতা-কনকারসো দে কানতে হনদো-এর ভেনু হিসেবে প্লাছা দে লস আলহিবেস বিখ্যাত হয়ে আছে, যা এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২২ সালের ১৩ ও ১৪ জুন। এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এবং তাঁর সুরকার বন্ধু মানুয়েল দে ফাইয়া। আন্দালুসিয়ার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির স্বীকৃতি, ফ্লেমেনকো সঙ্গীতের প্রচার এবং প্রকৃত ফ্লেমেনকো সঙ্গীতের অবনতি রোধ- এ ছিল প্রতিযোগিতার লক্ষ্য। আন্দালুসিয়ার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পরিচ্ছদ- স্ট্র হ্যাট, ঢোলা স্কার্ট, নকশা-করা শাল, চামড়ার বুট- ইত্যাদিতে শোভিত হয়ে ফ্লেমেনকো সঙ্গীতশিল্পীরা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতা ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এরপর ফ্লেমেনকোর বিকাশ ঘটে সারা স্পেনে। লোরকা-র জীবনেও ফ্লেমেনকো প্রতিযোগিতার প্রভাব সুগভীর। তাঁর সুবিখ্যাত রোমান্সেরো হিতানো (জিপসি লোকগাখা)-র মাল-মশলা সংগ্রহ ও অনুপ্রেরণার জন্য জিপসি জনগোষ্ঠী ও ফ্লেমেনকো শিল্পীদের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল বিশেষভাবে ফলদায়ী। কাব্যটি তিনি লিখেছেন ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ সালের মাঝে, আর তা প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে।
আলহাম্বরা ঘিরে আবর্তিত গ্রানাদার ইতিহাস, সৌন্দর্য ও রহস্য, তাই লোরকা একে বলেছেন গ্রানাদার ‘নান্দনিক অক্ষ’। আলহাম্বরা ছিল লোরকার খুব প্রিয়। কুয়েস্তা দে গোমেরেছ সড়ক ধরে তিনি আলহাম্বরা-র গাছ-গাছালি ভরা এলাকায় প্রবেশ করতেন। এর প্রবেশ পথ, লা পুয়ের্তা দে লাস গ্রানাদাস (দি গেট অফ দি পমগ্রানেটস), যা মূল গেটের স্থলে পঞ্চম চার্লস-র সময়ে আলহাম্বরা-র প্রধান প্রবেশ পথ হিসেবে নির্মিত হয়। রোমান স্থাপত্যে তৈরি এ গেটের চূড়ায় রয়েছে রাজকীয় প্রতীক, তার ওপরে তিনটি ডালিম ফল বসানো। ১১ বছর বয়সে গ্রানাদা আসার পর থেকেই আলহাম্বরা-র এই বাগানে নিয়মিত ঘুরে বেড়াতেন লোরকা, কখনো একাকী, কখনোবা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এখানে এসে পৃথিবীর সব কিছুকে ভুলে থাকা যায়। লোরকাও হয়ত পৃথিবীর ব্যস্ততা থেকে বের হতে, গভীরভাবে ভাবতে আলহাম্বরা-র বাগানে প্রায়ই আসতেন। তিনি বলেন : ‘ভাবুক ও বিষণœ ব্যক্তি গ্রানাদা যায় পুরোপুরি একাকী হতে... আলহাম্বরার দেয়ালে জাফরানি, গভীর ধূসর ও গোলাপি অগ্নূৎসবের কাছে...’।৪
আলহাম্বরা সাথে আমাদের একদিনের দেখা, মনে হয় কত যুগের পরিচয়। তার জন্য মনে তৈরি হলো এক গভীর অনুভূতি। যতই দুরে যাচ্ছি ফিরে ফিরে দেখছি আলহাম্বরা-কে, এক মায়াভরা হৃদয়ে। এভাবেই কি ১৪৯২ সালে আলহাম্বরা-কে দেখছিলেন বুয়াবদিল, শেষ মুর সুলতান, যখন চিরদিনের জন্য আলহাম্বরা ও গ্রানাদা ছেড়ে যাচ্ছিলেন?
Ref:
3. Instituto Mediterraneo Sol: www.inmsol.com
4. Lorca, by Leslie Stainton, page: 148, publisher: FARRAR STRAUS GIROUX, New York
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৩
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
হেনেরআলিফে বাগানের একদিক
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দলের সবার ক্লান্তি ও একঘেয়েমি ভাব লক্ষ্য করে বকরিম বলল- এখন তোমাদের নিয়ে যাব এক সুন্দর বাগানে, যা দেখে তোমাদের সব ক্লান্তি মুছে যাবে। বাগানে বসার সুন্দর জায়গা আছে, তোমরা সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পার। পরে আস্তে ধীরে বাগান ঘুরে দেখতে পার।
নুড়ি-বিছানো রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলাম সবাই- দু’পাশে পপলার, পাইন আর কমলা গাছের সারি। গাছের এ সারি যোগ দিল বিশাল, চমৎকার এক বাগানে, ঢুকতেই চোখে পড়ল নাম, হেনেরআলিফে। যথারীতি এর এক বর্ণনা দিয়ে শুরু করল বকরিম।
এ বাগানটির স্প্যানিস নাম হেনেরআলিফে। ইংরেজি বানান অনুসরণ করে অনেকে বলে জেনারেল-লাইফ, যা ভুল। আলহাম্বরা-র মূল দেয়ালের বাইরে এর অবস্থান। বারো শত বছর আগের বাগান, মূল নকশা রক্ষা করে বাগানের অনেক সংস্কার করা হয়েছে; অনেক গাছ নতুন করে লাগানো। এখানে উৎপাদিত শাক-সবজি ও ফল-মূল দিয়ে অতীতে পুরো আলহাম্বরা এলাকা- যার আরেক নাম মদিনাত আলহাম্বরা-এর কয়েক হাজার বাসিন্দার চাহিদা পূরণ হয়ে যেত।
হেনেরআলিফে-র প্রাসাদগুলি সাদামাটা। এর নকশায় সহজ-সরলতা আনা হয়েছে আলহাম্বরা-র জাঁকজমকপূর্ণ ব্যস্ত জীবন থেকে সুলতানদের সাময়িক মুক্তি দেয়ার জন্য। হৃদয়-মন জুড়ানোর জন্য সাথে আরো রয়েছে মনোরম বাগান, মাঝে মাঝে ফোয়ারা ও জলাশয়।
বকরিমের বর্ণনা চলল, সাথে চলল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সবার ধীরে ধীরে ওপরে ওঠা। রাস্তাটির দু’পাশে সারি সারি সাইপ্রেস গাছ, নাম তাই সাইপ্রেস ওয়াক, সেটি ধরে এগোতেই পৌঁছলাম এক বিরাট চত্বরে, যা পাইন ও কমলা গাছ দিয়ে ঘেরা। এক পাশে রয়েছে এক পুরনো ফোয়ারা। পায়ে হাঁটার রাস্তাগুলি গ্রানাদার ঐতিহ্য অনুসারে নুড়ি-পাথরের মোজাইকে আচ্ছাদিত- গ্রানাদার দু’টি নদীর নুড়ি-পাথর- দারো নদীর সাদা পাথর, হেনিল নদীর কাল পাথর। বসার জন্য মাটি ও সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত অনেকগুলি ধাপ করা হয়েছে। স্টেজের দৃশ্যপট হিসেবে কাজ করছে সাইপ্রেস গাছের সারি। প্রকৃতি ও স্থাপত্যের এ এক মেলবন্ধন। চত্বরটির নাম হেনেরআলিফে থিয়েটার, যা একটি ওপেন-এয়ার কনসার্ট এরেনা- গ্রানাদার সঙ্গীত ও নাচ উৎসবের ভেন্যু হিসেবে ১৯৫৩ সালে এটি উন্মুক্ত হয়। এরপর ২০০২ সালে শুরু হওয়া লোরকা ও গ্রানাদা উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে এখানে প্রতি বছর। তাছাড়াও মাঝে মধ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে। গত বছরই এখানে অনুষ্ঠিত হলো বব ডিলানের কনসার্ট।
এই বিশাল, সুন্দর বাগান দেখে নাবিল ও নাতাশা এতই খুশি, বলল, এখানেই সারা দিন থাকব, অন্য কোথায়ও যাব না। বললাম, আমরা এখানে দেখতে এসেছি পুরো আলহাম্বরা, যার মূল আকর্ষণ বলা যায় নাসরীয় প্রাসাদ। এটি দেখা শেষ হয়েছে, এ বাগানটি দেখা শেষ করে আমরা দেখব আলহাম্বরা-র তৃতীয় অংশ, আলকাযাবা। হেনেরআলিফে বাগানটি রিল্যাক্স করার জায়গা। বকরিম ওদেরকে আশ্বাস দিল, আলকাযাবা শেষ করে তোমরা আবার ফেরার পথে এই বাগানে আসবে, তখন যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারবে। দু’জনেই খুব খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল।
সবাই আবার চলা শুরু করলাম। ছোট ছোট কয়েকটি আঙিনা পার হয়ে এবার আসলাম এক বড় চত্বরে, পেথিও দে আছেকিয়া-তে, যা ৪৮ মিটার লম্বা ও ১২ মিটার চওড়া এক সুন্দর বাগান। তার মাঝখানে বয়ে চলেছে এক সুন্দর জলপ্রণালি, তার দুপাশের ফুল গাছে রঙবেরঙের ফুল, যার উপর ঝরে পড়ছে ফোয়ারার জল। এর দু’দিকে রয়েছে অনেকগুলি আচ্ছাদিত প্যাভিলিয়ন এবং আরেক প্রান্তে রয়েছে দোতলা সাদা প্রাসাদ- সুলতানদের গ্রীষ্মকালীন বিশ্রামস্থল।
হেনেরআলিফে-র সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এটি- এখানে এসে বকরিম একটু থেমে বলল- এর নীচে পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে অনেক ফলবাগিচা, তোমরা পরে আস্তে ধীরে দেখতে পারো, সেখানে বিশ্রাম নিতে পার। এখন আমরা এ উদ্যান থেকে বিদায় নিয়ে যাই আলকাছাবা দুর্গে।
বকরিম-কে অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। সে যথারীতি শুরু করল এর ইতিহাস বর্ণনা।
সবার শেষে আলকাছাবা দেখতে আসলাম, কিন্তু আলহাম্বরা-য় সবার আগে তা বানানো, যার আরেক নাম কালাত আলহাম্বরা, বা লাল দুর্গ। মুসলিম শাসকরা ১৩শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এক সামরিক দুর্গ হিসেবে এটি নির্মাণ করেন। আলহাম্বরা-র পশ্চিম পাশে অবস্থিত এ দুর্গটি ত্রিভুজ আকৃতির, মাঝখানের জায়গায় ছিল সৈন্যদের আবাসিক ভবন ও আনুষঙ্গিক স্থাপনা। আলকাছাবা-র পুরোটিই দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত- দেয়ালের সাথে আছে বিভিন্ন টাওয়ার। আলকাছাবা-র সর্বোচ্চ টাওয়ার উত্তর-পূর্বের থরে দেল ওমেনাহে, যার বিশেষ অবস্থানের কারণে এটি কমান্ড পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এর ডান পাশেই রয়েছে টাওয়ার থরে কেব্রাডা, যার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রয়েছে বিশাল এক ফাটল। দক্ষিণ-পশ্চিমের টাওয়ার থরে দে লা সুলতানা, যার নিচে শোভা পাচ্ছে সুন্দর উদ্যান হার্দিন দেল আদার্বে।
আলকাছাবা-র প্রবেশ পথের কাছেই হার্দিন দেল আদার্বে বাগানটি ছড়িয়ে আছে। গ্রানাদার এক সুন্দর দৃশ্য দেখার জন্য এর চেয়ে ভাল স্থান আর হয় না। এ বাগানটির পশ্চিম পাশে এক লুকঅউট পয়েন্ট রয়েছে। সেখান থেকে এক দেয়াল শুরু হয়ে চলে গেছে ভারমিলিয়ন টাওয়ার পর্যন্ত। দেয়ালের উপর খোদিত মেক্সিকোর কবি ফ্রানসিসকো দ্য আাইকাছা-র একটি বিখ্যাত কবিতা:
Give him alms, woman,
There is nothing in this life
Like the pain of being
Blind in Granada.3
এ কবিতা নিয়ে একটি গল্প আছে। মেক্সিকোর কবি ফ্রানসিসকো দে আইকাছা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একবার গ্রানাদা বেড়াতে আসেন। একদিন আলহাম্বরা ভ্রমণকালে এক অন্ধ লোক তাঁদের কাছে ভিক্ষা চায়। তখন কবি তাঁর স্ত্রীকে বলেন: হে নারী, তাকে ভিক্ষা দাও। কারণ গ্রানাদায় অন্ধ হওয়ার চেয়ে বড় কোনো দুঃখ এ জীবনে নাই।
আলকাছাবা-র পশ্চিমের শীর্ষবিন্দুতে রয়েছে ২৭ মিটার উঁচু এক বড় টাওয়ার, থরে দে লা ভেলা। টাওয়ারটির ওপর থেকে বিস্তৃত এলাকা পর্যবেক্ষণ করা যায়, অন্যদিকে এটি দেখা যায় গ্রানাদার বিশাল এলাকা থেকে। এখানকার ঘন্টাগুলি মূল স্থাপনায় ছিল না, ক্যাথলিক রাজন্যবর্গ কাস্তিল থেকে এনে এগুলি বসান।
এর উপরে বিশাল বর্গাকার বুরুজ, একসাথে এখানে শোভা পাচ্ছে ৪টি পতাকা। নাবিল জিজ্ঞেস করল, একটি দেশের ৪টি পতাকা কেন? বকরিম ব্যাখ্যা করল, গ্রানাদার আছে চার পরিচয়, তাই তাদের তুলে ধরা হয়েছে চার পতাকায়- ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর নীল পতাকা, আন্দালুসিয়ার সবুজ ও সাদা, স্পেনের লাল ও হলুদ, আর গ্রানাদার লাল ও সবুজ। নাতাশা বলে উঠল,অস্টিনে আমাদের স্টেট ক্যাপিটল ভবনে ঢুকতেই তার মেঝেতে রয়েছে ৬টি পতাকার ছবি- ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের টেক্সাসের পতাকা। বকরিম ‘ওয়াও’ বলে মুচকি হাসল শুধু, তবে ৬টি পতাকার বর্ণনা শুনতে চাইল না। সুদূর টেক্সাসের পতাকার ইতিহাস শোনার সময় তার হাতে নেই। নাবিল ও নাতাশা ছবি তুলতে চায় না, বলে, কিপ ইন মেমোরি। এবার কিন্তু বলল, চার পতাকার সাথে আমাদের ছবি তুলে দাও। বকরিম বলল, নিচে থেকে সব পতাকা ভাল আসবে না। আমরা এখন টাওয়ারটির ওপরে উঠব, তখন পতাকার সামনে, কাছে থেকে ছবি তুলতে পারবে।
অনেকগুলি সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে আমরা থরে দে লা ভেলা-র বুরুজে পৌঁছে দেখি, এটি লোকে লোকারণ্য। সবাই এত উঁচু থেকে সবদিকের দৃশ্য দেখছে, ছবি তুলছে। আমরাও কোনো রকমে জায়গা করে নিয়ে সবদিক দেখতে লাগলাম। আগে দেখেছি নিচে থেকে ওপরে, এখন দেখছি ওপর থেকে নিচে। গতকাল আলবাইসিন এলাকার সান নিকোলাস লুকআউট পয়েন্ট থেকে দেখেছি সূর্যাস্তের আলহাম্বরা-কে, আর আজ দেখছি আলহাম্বরা-র টাওয়ার থেকে দুপুরের সান নিকোলাস লুকআউট পয়েন্ট ও আলবাইসিন-কে। দেখতে পাচ্ছি সান নিকোলাস লুকআউট পয়েন্ট ও তার জনারণ্য, তারা দেখছে আলহাম্বরা-কে, কেউ কেউ হাত নাড়াচ্ছে, এদিক থেকে আলহাম্বরার অনেকে সাড়াও দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা জাহাজে দাঁড়িয়ে বন্দরে অপেক্ষমাণ জনতাকে দেখছি, তারা যেমন দেখছে জাহাজের যাত্রীদের। এরপর আমরা বিপরীত দিকে তাকালাম, সেখানে সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা দীপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে সিয়েরা নেভাদা, অন্যদিকে গ্রানাদা, মাঝখানে আলহাম্বরা- নিসর্গ, নগর ও স্থাপত্যের এত মহিমান্বিত সহাবস্থান সচরাচর দেখা যায় না। ছবি তুললাম সিয়েরা নেভাদা-র, তার কোলে আলহাম্বরা ও আমরা সবাই- বকরিমের সাথে পুরো গ্রুপ। আর নাবিল ও নাতাশার চার পতাকার সামনে ছবি তোলা তো রয়েছেই।
এরপর বকরিম করুণ সুরে ঘোষণা করল, সবকিছুর শেষ আছে। আমাদেরও দেখা শেষ- আলকাছাবা, সেই সাথে আলহাম্বরা, এবার বিদায় নেবার পালা। সবাই একে একে বিদায় নিল। আমরা চারজন বকরিমের সাথে ছবি তুললাম, তাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে, আলিঙ্গন করে বিদায় নিলাম। সত্যিই একজন ভালো গাইড বকরিম, যার ইতিহাস জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতা অসাধারণ।
আলহাম্বরা দেখতে দেখতে গ্রুপের অনেকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। আমাদের গ্রুপের ১২ জন ৫টি দেশ থেকে এসেছে আলহাম্বরা দেখতে- তবে সবার উদ্দেশ্য ভিন্ন। যুক্তরাজ্যের জেনি-র উদ্দেশ্য ইতিহাসের এক বিশিষ্ট নিদর্শন দেখা-স্পেনের আরো অনেক ঐতিহাসিক জিনিস দেখবে- আলহাম্বরা তার একটি। মিশরের বরকাত শুধুমাত্র আলহাম্বরা দেখার জন্যই এসেছে স্পেনে, কারণ এটি এক বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহ্য। ভারতের মিশ্র বলল, স্পেনের এক বিরাট স্থাপত্য আলহাম্বরা। এটি দেখা ছাড়া স্পেন ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থাকবে। বাকিদের চিন্তা-ভাবনাও এসবের সমান্তরালে। সবাই জিজ্ঞেস করল, তোমরা কেন আলহাম্বরা দেখতে এসেছ? নাবিল ও নাতাশা বলল, জাস্ট ফর ফান। ফারজানা বলল, দেখার জন্য এক সুন্দর জিনিস আলহাম্বরা। আমি বললাম, দেখতে এসেছি মূলত লোরকাকে, সাথে প্রেক্ষাপটের আলহাম্বরা, সিয়েরা নেভাদা ও গ্রানাদাকে। লোরকা, আলহাম্বরা, সিয়েরা নেভাদা ও গ্রানাদা- এখানে একসাথে মিশে আছে, এদের আলাদা করা কঠিন। দুয়েকজন একমত হলো, বাকিরা রহস্যপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল।
আলকাছাবা থেকে ফেরার পথে পড়ল প্লাজা দে লস আলহিবেস। ক্যাথলিকদের গ্রানাদা জয়ের পরে নির্মিত হয়েছে এই প্লাজা, যার একদিকে আছে আলকাছাবা-র দেয়াল ও টাওয়ার, আর বিপরীত দিকে আছে পুয়ের্টা দেল ভিনো, নাসিরীয় প্রাসাদ ও পঞ্চম কার্লোস প্রাসাদ। প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতা-কনকারসো দে কানতে হনদো-এর ভেনু হিসেবে প্লাছা দে লস আলহিবেস বিখ্যাত হয়ে আছে, যা এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২২ সালের ১৩ ও ১৪ জুন। এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এবং তাঁর সুরকার বন্ধু মানুয়েল দে ফাইয়া। আন্দালুসিয়ার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির স্বীকৃতি, ফ্লেমেনকো সঙ্গীতের প্রচার এবং প্রকৃত ফ্লেমেনকো সঙ্গীতের অবনতি রোধ- এ ছিল প্রতিযোগিতার লক্ষ্য। আন্দালুসিয়ার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পরিচ্ছদ- স্ট্র হ্যাট, ঢোলা স্কার্ট, নকশা-করা শাল, চামড়ার বুট- ইত্যাদিতে শোভিত হয়ে ফ্লেমেনকো সঙ্গীতশিল্পীরা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লেমেনকো সঙ্গীত প্রতিযোগিতা ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এরপর ফ্লেমেনকোর বিকাশ ঘটে সারা স্পেনে। লোরকা-র জীবনেও ফ্লেমেনকো প্রতিযোগিতার প্রভাব সুগভীর। তাঁর সুবিখ্যাত রোমান্সেরো হিতানো (জিপসি লোকগাখা)-র মাল-মশলা সংগ্রহ ও অনুপ্রেরণার জন্য জিপসি জনগোষ্ঠী ও ফ্লেমেনকো শিল্পীদের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল বিশেষভাবে ফলদায়ী। কাব্যটি তিনি লিখেছেন ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ সালের মাঝে, আর তা প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে।
আলহাম্বরা ঘিরে আবর্তিত গ্রানাদার ইতিহাস, সৌন্দর্য ও রহস্য, তাই লোরকা একে বলেছেন গ্রানাদার ‘নান্দনিক অক্ষ’। আলহাম্বরা ছিল লোরকার খুব প্রিয়। কুয়েস্তা দে গোমেরেছ সড়ক ধরে তিনি আলহাম্বরা-র গাছ-গাছালি ভরা এলাকায় প্রবেশ করতেন। এর প্রবেশ পথ, লা পুয়ের্তা দে লাস গ্রানাদাস (দি গেট অফ দি পমগ্রানেটস), যা মূল গেটের স্থলে পঞ্চম চার্লস-র সময়ে আলহাম্বরা-র প্রধান প্রবেশ পথ হিসেবে নির্মিত হয়। রোমান স্থাপত্যে তৈরি এ গেটের চূড়ায় রয়েছে রাজকীয় প্রতীক, তার ওপরে তিনটি ডালিম ফল বসানো। ১১ বছর বয়সে গ্রানাদা আসার পর থেকেই আলহাম্বরা-র এই বাগানে নিয়মিত ঘুরে বেড়াতেন লোরকা, কখনো একাকী, কখনোবা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এখানে এসে পৃথিবীর সব কিছুকে ভুলে থাকা যায়। লোরকাও হয়ত পৃথিবীর ব্যস্ততা থেকে বের হতে, গভীরভাবে ভাবতে আলহাম্বরা-র বাগানে প্রায়ই আসতেন। তিনি বলেন : ‘ভাবুক ও বিষণœ ব্যক্তি গ্রানাদা যায় পুরোপুরি একাকী হতে... আলহাম্বরার দেয়ালে জাফরানি, গভীর ধূসর ও গোলাপি অগ্নূৎসবের কাছে...’।৪
আলহাম্বরা সাথে আমাদের একদিনের দেখা, মনে হয় কত যুগের পরিচয়। তার জন্য মনে তৈরি হলো এক গভীর অনুভূতি। যতই দুরে যাচ্ছি ফিরে ফিরে দেখছি আলহাম্বরা-কে, এক মায়াভরা হৃদয়ে। এভাবেই কি ১৪৯২ সালে আলহাম্বরা-কে দেখছিলেন বুয়াবদিল, শেষ মুর সুলতান, যখন চিরদিনের জন্য আলহাম্বরা ও গ্রানাদা ছেড়ে যাচ্ছিলেন?
Ref:
3. Instituto Mediterraneo Sol: www.inmsol.com
4. Lorca, by Leslie Stainton, page: 148, publisher: FARRAR STRAUS GIROUX, New York