alt

সাময়িকী

স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

অনুপম হাসান

: বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

মৃত্যু মানবজীবনের শুধু নয়, সকল জীবেরই অনিবার্য পরিণতি। কেউই এই মৃত্যুকে এড়াতে পারে না; একদিন সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হয় অথবা হবেই। অতএব জীবন নামের ‘পথের শেষ কোথায়’ কথাটির উত্তর তা জানার ব্যাকুলতা মানুষের ভিতর থাকলেও জীবনমাত্রই জানে, মৃত্যুই তার শেষ গন্তব্য। তার মানে আমাদের জীবন ঘিরে সর্বদাই থাকে মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ। সেই উত্তাপে কেউ অধিক ব্যথিত-চিন্তিত-উদ্বিগ্ন হয়, কেউ সেটা হয় না। যারা উদ্বিগ্ন হয়, তারাই জানতে চায় ‘পথের শেষ কোথায়’ কিংবা এর শেষটা কীভাবে সংঘটিত হবে। এটাই জীবের এবং জীবনের বাস্তবতা।

মামুন হুসাইনের ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, তবে রচনাটিকে একটি দীর্ঘ গল্প বলা হলেও অন্যায় হবে না। রচনাটি উপন্যাসিকা (নভেলেট) নাকি গল্প সে আলোচনা কিংবা বিতর্কের পরিবর্তে আমরা লেখকের নামটিকে গ্রহণ করেই মূল পাঠের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাই। ‘স্বরচিত আত্মার পরিবত্রাণ’ গল্প জুড়ে একজন মানুষের মৃত্যু রচনার যে প্রকল্প অথবা আত্মহত্যা করবার জন্য তার যে আয়োজন, তা নিয়ে অন্তহীন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের গভীরে লেখক মামুন হুসাইন নিমগ্ন হয়েছেন। একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, কিংবা আত্মহত্যা করার পেছনে তার কী কী কারণ থাকে, আত্মহত্যা করাটা আদৌ জরুরি কিনা অথবা আত্মহত্যা না করে সে পারতো কিনা- এ জাতীয় বিবিধ প্রশ্নের সমাধান খুঁজেছেন মামুন হুসাইন ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকায়। একজন ব্যক্তির সুইসাইড বা আত্মহত্যা করার প্রবণতা প্রসঙ্গে গল্পে উঠে এসেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন বালকের সাথে তার মায়ের স্নেহ-মমতার সম্পর্ক নিয়ে বিবিধ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো যে, মামুন হুসাইনের প্রায় সব গল্পেই কোথাও না কোথাও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ থাকেই। তাঁর কোনো গল্পই মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে হত্যাকা- নারকীয় বীভৎস বাস্তবতা দেশে সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে তিনি কখনোই এড়িয়ে যান না। কোনো না কোনোভাবে তিনি গল্পের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ নিয়েই আসেন; যা মামুনের গল্পের বিশেষ বিশেষত্ব হিসেবে গণ্য করা হলে ভুল হবে না।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ কিংবা জীবন ‘পথের শেষ কোথায়’ অত্যন্ত গভীরার্থবহ এবং বহুস্তরীয় বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কথাটির মাধ্যমে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং সামাজিক বাস্তবতার সংমিশ্রণ রয়েছে, যা পরিণামে অসীম সম্ভাবনা তৈরি করে কাহিনীর বাঁকে বাঁকে। অতএব আলোচনার শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের গানটি দেখে নেয়া যেতে পারে:

পথের শেষ কোথায় কী আছে শেষে!

এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে।

ঢেউ উঠে পড়ে কাঁদার, সম্মুখে ঘন আঁধার

পার আছে গো পার আছে- পার আছে কোন দেশে।

আজ ভাবি মনে মনে মরীচিকা অন্বষণে হায়

বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই, নেই। মনে ভয় লাগে সেই-

হাল ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে।

গানের কথাগুলো বিবেচনায় রেখে ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকার ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, এখানে রবীন্দ্র-অনুরাগী সংগীত-শিল্পী আলী আকবর কেন আত্মহননের পথ বেছে নিলেন, লেখক সে কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন গল্পের পরতে পরতে।

এ আলোচনার শিরোনামে উত্থাপিত প্রশ্নটি হচ্ছে ‘পথের শেষ কোথায়’ সুগভীর আত্মিক পরিণামের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পথের শেষ কোথায়’ গান অথবা কবিতাটির সাথে আলী আকবরের মনের সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠেছিল বিষয়টি খতিয়ে দেখলে এবং তিনি কেন আত্মহত্যার মতো এক চরম ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা বুঝতে হলে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে :

প্রথমত, ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি নিঃসন্দেহে বিষাদপূর্ণ এবং জীবনের পরিণাম বিষয়ক বেদনাবহ গান। গানটি অনিবার্যভাবেই জীবনের অর্থ, মৃত্যু এবং অস্তিত্বের মতো গভীর প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি করে আমাদেরকে। গানটিতে বর্ণিত হয়েছে জীবনপথের অনিশ্চয়তা এবং মৃত্যুর অনিবার্যতা সম্পর্কে ধোঁয়াশাপূর্ণ বক্তব্য। ‘পথের শেষ কোথায়’ কোনো একক ব্যক্তির মনের গভীরে প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যখন সে কোনো মানসিক সংকটের মধ্যে থাকে অথবা ব্যক্তিগত সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে না পায়।

দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রানুরাগী শিল্পী আলী আকবরের জীবনযাত্রা এবং মানসিক অবস্থাও এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলী আকবর যদিও সমকালীন আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, তবুও রবীন্দ্রানুরাগী মানুষ হিসেবে তিনি সম্ভবত বিশ শতকের রাবীন্দ্রিক বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন নি। যা তার মানসিক সমস্যার একটা কারণ বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে সমকালীন (একুশ শতকের) আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা মানুষকে একাকিত্ববোধ, অর্থহীনতা এবং হতাশা প্রবলতর করে তুলেছে। বরং বলা ভালো যে, বিশ শতকের তুলনায় সমকালে মানসিক চাপ ব্যক্তির জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

তৃতীয়ত, ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি কিংবা রবীন্দ্রনাথের সমগ্র শিল্পকর্মের অভ্যন্তরে জীবন-মৃত্যু বিষয়ক যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান তা রবীন্দ্রানুরাগী শিল্পী আলী আকবরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ক্রমাগতভাবে শাণিত করে তুলেছে এবং সমাধান খুঁজে পেতে তাকে ব্যাকুল করে তুলেছে। হয়তো তার জীবনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলশ্রুতিতে তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবন-মৃত্যুর সংঘাতকে নিজের জীবনের সাথে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সম্পর্কিত করে নিয়েছিলেন; যা এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।

চতুর্থত, একথা পূর্বেই বলা হয়েছে, আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা মানুষকে একাকিত্ববোধ এবং অর্থহীনতা থেকে মুক্ত করতে পারে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব সুযোগ-সুবিধা ব্যক্তির জীবনে মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। রবীন্দ্রানুরাগী শিল্পী আলী আকবর হয়তো সমকালীন আধুনিকতা জনিত প্রবল মানসিক চাপের শিকার হয়েছিলেন; যার যথার্থ ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

গল্পটি একজন ব্যক্তির আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে যতটা সাদামাটা হতে পারত, তা হয় নি; কেননা গল্পের ভাষায় মামুন হুসাইন সাদামাটা কিংবা জটিল বাস্তবতাকেই কাব্যিক প্রকৌশলে জটিলতর রূপ দিয়েছেন।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ গল্পে একজন আলী আকবর, যিনি সংগীত-সাধক তিনি মূলত আত্মহত্যা করেছেন; রবীন্দ্র সংগীত-প্রিয় একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করেছেন- তার আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় লেখক মামুন হুসাইন পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেছেন। একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করে কিংবা আত্মহত্যা করবে, আত্মহত্যার উদ্দেশ্য কী এবং কেন কোনো একজন ব্যক্তি তার জীবনের সমাপ্তি চায় কিংবা জাগতিক সব ধরনের মায়া-মমতা শেষ হয়ে যায়; এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি আদৌ খুঁজে পাওয়া সম্ভব? তারপরও কথাকার মামুন হুসাইন তাঁর সাইকোলজি বিদ্যার সহায়তা নিয়ে ব্যক্তির জীবনকে শেষ করে দেয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকা যথাসম্ভব কারণসমূহকে খুঁজে বের করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন গল্পে। একজন ব্যক্তির কীভাবে জীবনের প্রতি মায়া-মমতা শেষ হয়ে যায় এবং শেষ হওয়ার প্রক্রিয়া কী এবং কীভাবে তিনি আত্মহত্যার পথে হাঁটতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন করেন- এসব বিষয়ের বিশদ আলোচনা নিয়েই ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকার পথপরিক্রমা সামনে এগিয়ে গেছে।

মামুন হুসাইন গল্পের শিরোনামের মাধ্যমেই আলী আকবরের আত্মহত্যার ঘটনাকে বা তার অস্তিত্বকে ধ্বংস করার বিষয়টিকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন; যা পরিণামে ব্যক্তি মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বকে বোঝায়, পরিণামে যা নিজেই গল্পের মূল চরিত্র হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রসংগীত-সাধক আলী আকবর চরিত্রটি হয়তো নিজের তৈরি করা ব্যক্তিত্বের বোঝা বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল কিংবা ব্যক্তিজীবনকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়াটাও তার পক্ষে একসময় তার জন্য কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। অথবা তার চারপাশের পরিবেশ ক্রমাগতভাবে এতটাই নির্মম বা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে- যা তার আত্মা সহ্য করতে সক্ষম হয় নি। বেঁচে থাকা মানুষগুলো সর্বদাই সহনশীল হয়ে থাকে বলেই তারা বেঁচে থাকতে পারে; অন্যথায় তারাও বেঁচে থাকার মতো কোনো অবলম্বন পেত না। মানুষের এই সহনশীলতা না থাকলে সব মানুষই হয়তো আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠত কিংবা বেঁচে থাকার উদ্যম হারিয়ে ফেলত। ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার কিংবা নিজের ভার বা বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভয়ানক এক লড়াই করার মধ্য দিয়ে নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একথা সত্য যে, এ লড়াইটা সবাই সমানভাবে করতে পারে না, যে পারে একমাত্র সেই পৃথিবী থেকে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করার মতো সাহস দেখাতে পারে।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকায় একজন আলী আকবর যিনি সঙ্গীত-সাধক, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের সংগীতে মগ্ন থেকে যিনি যথেষ্ট উচ্চতায় কিংবা যশ-খ্যাতি লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথে নিবেদিত বা রবীন্দ্রানুরাগী হওয়ার পরও কেন আলী আকবর আত্মহত্যা করেছেন, সে বিষয়ে মামুন হুসাইন সুতীক্ষè বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেছেন তার আত্মহত্যা করার কারণ কী হতে পারে! এসব বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের প্রকৃতি কিংবা তার মনের প্রকৃত অবস্থা কী আদৌ জানা সম্ভব! আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি- হয়তো সম্ভব, হয়তো না। পাঠক হিসেবে ‘স্বরাচিত আত্মার পরিত্রাণ’ থেকে তা জানার চেষ্টা করতে পারি মাত্র মামুন হুসাইনের কাব্যিক ভাষার মায়াটানে।

আলী আকবর নিজেকে কখনো মিথ্যে ভেবেছিলেন কিংবা সচেতনভাবে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন? আত্মহত্যার এরকম একটি নোটস দিয়েই মামুন তাঁর গল্প শুরু করেছেন। তারপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে তার আত্মহননের গল্পের পেছনের ইতিকথা জানতে নানা জনের নানা প্রকল্প, বিবিধ উপায়- তিনি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। মানুষ স্বীয় চেষ্টায় কেন নিজের মৃত্যুকে আহ্বান করে- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়েছেন লেখক নিজে এবং পাঠকও পরিশ্রান্ত হয়ে ভেবেছেন হয়তো সেটা কোনভাবেই জানা সম্ভব না। লেখক ও পাঠক পরিণামে ক্লান্ত হয়েও সত্যিকার অর্থে স্বেচ্ছামৃত্যুর কোনো কারণ অথবা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আদৌ আবিষ্কার করা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সংশায়পন্ন হয়েছেন। স্বেচ্ছামৃত্যু প্রকল্পের কারণ খুঁজে না পাওয়া লেখক মামুন হুসাইনের সীমাবদ্ধতা নয়, কেননা মানবজীবন এতটাই বৈচিত্র্যময় যে, ব্যক্তি-জীবনের সেই অস্তিত্ব স্বেচ্ছায় ধ্বংস করে দেয়ার ব্যাপারকে খুব সহজে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট বা কোনো যৌক্তিক উপসংহারে উপনীত সম্ভব হয় না। মামুন হুসাইন মনোরোগবিদ হয়েও সেটা পারেন নি, তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই চেষ্টা প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি বা খামতি ছিল এমন কথা বলার সুযোগ নেই। গল্পে লেখক মূলত একজন রবীন্দ্রসংগীত-প্রিয় মানুষের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার কারণ উদ্ঘাটনে সচেষ্ট হয়েছেন এবং নিপুণ শিল্পিত ভাষায় রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পীর সুইসাইড নোটসের প্রতিভাষ্য নির্মাণ করেছেন।

জীবন শেষ করার আগে কেউ কেউ কিছু নোটস লেখে- কেন লেখে, কী লেখে- তার সবটাই হয়তো বিশ্লেষণ করা জীবিত মানুষের পক্ষে সম্ভব না; তারপরও মামুন গল্পে বিবিধ উপায় ও প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখেছেন। স্বেচ্ছামৃত্যু অথবা আত্মহত্যাকে মামুন হুসাইন ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রশ্নটা এখানেই সুইসাইড করলেই কি আত্মার পরিত্রাণ ঘটে? যারা স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে তাদের আত্মার কি পরিত্রাণ ঘটে না? এরকম নানাবিধ প্রশ্ন গল্পের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতেই পারে. যার কোনো স্বাভাবিক উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা খোঁজার চেষ্টা করতে পারি মাত্র গল্পের কাহিনী থেকে; সেটাও পরিণামে অনেকাংশে ব্যর্থ চেষ্টা বলে মনে হয়, কারণ অস্তিত্বের বা আত্মার এই হারিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। বরং তখন মনে হয়, স্বীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সুইসাইড করা বা নোটস লেখা একটা বিকল্প উপায় মাত্র! সত্যিকার অর্থে কোনো যৌক্তিক কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে তা গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায়, সুইসাইড নোটস মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। প্রসঙ্গত বলা দরকার, দীর্ঘ এ গল্পে মামুন হুসাইন নানা প্রক্রিয়ায় সুইসাইড কিংবা স্বরচিত মৃত্যুর (আত্মহত্যা) ব্যাখ্যা বা যুক্তিগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন মাত্র। লেখকের ব্যাখ্যার সাথে পাঠক পুরোপুরি একমত হবেন কিনা সে ব্যাপারে সুনিশ্চিত কোনো বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই। প্রসঙ্গত একথা সত্য যে মামুন ব্যক্তির স্বরচিত আত্মহত্যা প্রকল্পের কারণ উদ্ঘাটন করার সময় একজন মানসিক চিকিৎসক হিসেবে ব্যক্তি মানুষের সুইসাইডের যত রকমের কারণ থাকতে পারে, সেগুলো ব্যাখ্যার পাশাপাশি যুক্তিপূর্ণ সমাধানও খুঁজেছেন গল্পের কাহিনীতে।

মামুন হুসাইনের ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ গল্পটি আধুনিক মানুষের আত্মপরিচয় সন্ধানের গভীরতর দ্যোতনাবাহী। একথা সত্য, সমকালীন বাস্তবতায় আমরা প্রায়ই নিজেদেরকে একটা নির্দিষ্ট চরিত্র বা বলয়ের মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলি। এর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে- সামাজিক চাপ, পরিবারের প্রত্যাশা, কর্মজীবনের চাপ প্রভৃতি আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট ভূমিকায় অভিনয় করতে বাধ্য করে- আমরা সেটা করতে থাকি। অন্তত যারা জীবিত থাকে, তাদেরকে সেটা করতেই হয়। গল্পটিতে এ ধরনের পারিবারিক কিংবা সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে নিজের আসল সত্তা খুঁজে পাওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কথাকার মামুন হুসাইন।

একজন রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পী আলী আকবরকে এভাবেও দেখার সুযোগ রয়েছে যে, তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি এতটাই আসক্ত ছিলেন, তার জীবনের অন্যান্য দিক গৌণ হয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এই আসক্তিই হয়তো তার আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে থাকতে পারে। কেননা রবীন্দ্রনাথের গানগুলো বিশেষত রবীন্দ্র-শিল্পকর্ম প্রায়শই জীবন-মৃত্যু, ভালোবাসা, হতাশা, একাকিত্বের মতো বিষয়গুলোকে আরও গভীরতর এক ব্যঞ্জনায় ব্যক্তিক আত্মিক সন্ধানের পথে টেনে নিয়ে যায়। গল্পের আলী আকবর গানগুলোর মধ্যে কিংবা রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্মের মধ্যে হয়তো নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছেন, পরবর্তীতে তার নিজের জীবনের সাথে তুলনা করে হতাশ হয়ে পড়েছেন। রবীন্দ্রসংগীত-সাধক হিসেবে হয়তো চরিত্রটি সমাজে নিজেকে একা মনে করেছেন এবং রবীন্দ্রসংগীতেই তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। রবীন্দ্রানুরাগী হিসেবে তার অভ্যন্তরে যে একাকিত্ব ক্রমশ বেড়ে উঠেছে হয়তো সেটাই একসময় তার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে- যা তাকে পরিণামে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছে। চরিত্রটির মানসিক অবস্থা কেমন ছিল? সে কীভাবে রবীন্দ্রসংগীতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, রবীন্দ্রনাথের সাথে সম্পর্কটি তার জীবনের অন্যান্য দিককে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? সে বিষয়গুলোও ভেবে দেখা দরকার এবং বিবেচনায় নিয়ে চরিত্রটি কেন আত্মহত্যা করেছে- সেটি খুঁজে বের করার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন মামুন হুসাইন। রবীন্দ্রসংগীত কি আলী আকবরের আত্মহত্যার একমাত্র কারণ, নাকি অন্য কোনো কারণও ছিল? এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, ব্যক্তিজীবনের সাথে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবকিছুই একসাথে জড়িয়ে থাকে; ফলে আমরা এককথায় এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।

সংগীত-শিল্পী আলী আকবর তার অনুভূতিকে সঙ্গীতের মাধ্যমে এতটাই একাত্ম হয়ে প্রকাশ করতেন যে, বাস্তব কিংবা জাগতিক জীবনে তার সাথে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রসংগীতের জগতে নিমগ্ন থাকার কারণে তিনি হয়তো পরিবার-সমাজ এমনকি বন্ধু-বান্ধবমহল থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শবাদ এবং রোমান্টিসিজম তাকে বাস্তব জীবনের কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে দেয় নি; কিংবা রোমান্টিক জগৎ থেকে নেমে এসে সাধারণ জীবনের সাথে তিনি মিশে যেতে পারেন নি। ফলে এমন ভাবা যায় যে, আলী আকবরের আত্মহত্যার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে; এর মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটির কথা বলা যেতে পারে- যা তার অস্তিত্ব ধ্বংসের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে তার ব্যক্তিগত জীবনের অন্যান্য ঘটনা, মানসিক অবস্থা, সামাজিক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ শিরোনামটি ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের খোঁজ এবং মুক্তির আকাক্সক্ষার নির্ণায়ক। ব্যক্তি যখন নিজের আত্মাকে স্বকীয় চিন্তার দ্বারা বোঝার চেষ্টা করে এবং তার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে চায়- তখন সে এই পথের শেষ কোথায়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। জীবন পথের শেষ তো আসলে মৃত্যুই; কেউ কেউ হয়তো এরকম সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে পারে। জীবনপথের শেষ কোথায় আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের একটি প্রতিফলন হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের মধ্যে ঈশ্বরকেও খুঁজতে চাইতে পারে কিংবা মোক্ষের পথে অগ্রসর হয়ে এগিয়ে যেতে চাইতে পারে। অথবা ব্যক্তিমানুষ সামাজিক চাপ, প্রত্যাশা এবং সীমাবদ্ধতার কারণে নিজেকে বন্দি মনে করতে পারে এবং মুক্তির পথ খুঁজতে পারে। সেই মুক্তির সহজতম পথ হিসেবে ‘সুইসাইড’ বা আত্মহত্যাকেও গ্রহণ করতে পারে কোনো কোনো ব্যক্তিমানুষ।এ গল্পে মামুন হুসাইন ব্যক্তিমানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা বিষয়ক একটি অনন্য বিশ্লেষণমূলক প্রকল্প নির্মাণ করেছেন।

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

ছবি

শাঁকচুন্নি

ছবি

মেঘনাদবধ, এক নতুন দৃশ্যভাষা

ছবি

নতুন কবিতার সন্ধানে

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতা

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

tab

সাময়িকী

স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

অনুপম হাসান

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

মৃত্যু মানবজীবনের শুধু নয়, সকল জীবেরই অনিবার্য পরিণতি। কেউই এই মৃত্যুকে এড়াতে পারে না; একদিন সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হয় অথবা হবেই। অতএব জীবন নামের ‘পথের শেষ কোথায়’ কথাটির উত্তর তা জানার ব্যাকুলতা মানুষের ভিতর থাকলেও জীবনমাত্রই জানে, মৃত্যুই তার শেষ গন্তব্য। তার মানে আমাদের জীবন ঘিরে সর্বদাই থাকে মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ। সেই উত্তাপে কেউ অধিক ব্যথিত-চিন্তিত-উদ্বিগ্ন হয়, কেউ সেটা হয় না। যারা উদ্বিগ্ন হয়, তারাই জানতে চায় ‘পথের শেষ কোথায়’ কিংবা এর শেষটা কীভাবে সংঘটিত হবে। এটাই জীবের এবং জীবনের বাস্তবতা।

মামুন হুসাইনের ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, তবে রচনাটিকে একটি দীর্ঘ গল্প বলা হলেও অন্যায় হবে না। রচনাটি উপন্যাসিকা (নভেলেট) নাকি গল্প সে আলোচনা কিংবা বিতর্কের পরিবর্তে আমরা লেখকের নামটিকে গ্রহণ করেই মূল পাঠের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাই। ‘স্বরচিত আত্মার পরিবত্রাণ’ গল্প জুড়ে একজন মানুষের মৃত্যু রচনার যে প্রকল্প অথবা আত্মহত্যা করবার জন্য তার যে আয়োজন, তা নিয়ে অন্তহীন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের গভীরে লেখক মামুন হুসাইন নিমগ্ন হয়েছেন। একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, কিংবা আত্মহত্যা করার পেছনে তার কী কী কারণ থাকে, আত্মহত্যা করাটা আদৌ জরুরি কিনা অথবা আত্মহত্যা না করে সে পারতো কিনা- এ জাতীয় বিবিধ প্রশ্নের সমাধান খুঁজেছেন মামুন হুসাইন ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকায়। একজন ব্যক্তির সুইসাইড বা আত্মহত্যা করার প্রবণতা প্রসঙ্গে গল্পে উঠে এসেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন বালকের সাথে তার মায়ের স্নেহ-মমতার সম্পর্ক নিয়ে বিবিধ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো যে, মামুন হুসাইনের প্রায় সব গল্পেই কোথাও না কোথাও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ থাকেই। তাঁর কোনো গল্পই মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে হত্যাকা- নারকীয় বীভৎস বাস্তবতা দেশে সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে তিনি কখনোই এড়িয়ে যান না। কোনো না কোনোভাবে তিনি গল্পের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ নিয়েই আসেন; যা মামুনের গল্পের বিশেষ বিশেষত্ব হিসেবে গণ্য করা হলে ভুল হবে না।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ কিংবা জীবন ‘পথের শেষ কোথায়’ অত্যন্ত গভীরার্থবহ এবং বহুস্তরীয় বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কথাটির মাধ্যমে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং সামাজিক বাস্তবতার সংমিশ্রণ রয়েছে, যা পরিণামে অসীম সম্ভাবনা তৈরি করে কাহিনীর বাঁকে বাঁকে। অতএব আলোচনার শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের গানটি দেখে নেয়া যেতে পারে:

পথের শেষ কোথায় কী আছে শেষে!

এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে।

ঢেউ উঠে পড়ে কাঁদার, সম্মুখে ঘন আঁধার

পার আছে গো পার আছে- পার আছে কোন দেশে।

আজ ভাবি মনে মনে মরীচিকা অন্বষণে হায়

বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই, নেই। মনে ভয় লাগে সেই-

হাল ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে।

গানের কথাগুলো বিবেচনায় রেখে ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকার ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, এখানে রবীন্দ্র-অনুরাগী সংগীত-শিল্পী আলী আকবর কেন আত্মহননের পথ বেছে নিলেন, লেখক সে কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন গল্পের পরতে পরতে।

এ আলোচনার শিরোনামে উত্থাপিত প্রশ্নটি হচ্ছে ‘পথের শেষ কোথায়’ সুগভীর আত্মিক পরিণামের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পথের শেষ কোথায়’ গান অথবা কবিতাটির সাথে আলী আকবরের মনের সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠেছিল বিষয়টি খতিয়ে দেখলে এবং তিনি কেন আত্মহত্যার মতো এক চরম ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা বুঝতে হলে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে :

প্রথমত, ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি নিঃসন্দেহে বিষাদপূর্ণ এবং জীবনের পরিণাম বিষয়ক বেদনাবহ গান। গানটি অনিবার্যভাবেই জীবনের অর্থ, মৃত্যু এবং অস্তিত্বের মতো গভীর প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি করে আমাদেরকে। গানটিতে বর্ণিত হয়েছে জীবনপথের অনিশ্চয়তা এবং মৃত্যুর অনিবার্যতা সম্পর্কে ধোঁয়াশাপূর্ণ বক্তব্য। ‘পথের শেষ কোথায়’ কোনো একক ব্যক্তির মনের গভীরে প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যখন সে কোনো মানসিক সংকটের মধ্যে থাকে অথবা ব্যক্তিগত সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে না পায়।

দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রানুরাগী শিল্পী আলী আকবরের জীবনযাত্রা এবং মানসিক অবস্থাও এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলী আকবর যদিও সমকালীন আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, তবুও রবীন্দ্রানুরাগী মানুষ হিসেবে তিনি সম্ভবত বিশ শতকের রাবীন্দ্রিক বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন নি। যা তার মানসিক সমস্যার একটা কারণ বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে সমকালীন (একুশ শতকের) আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা মানুষকে একাকিত্ববোধ, অর্থহীনতা এবং হতাশা প্রবলতর করে তুলেছে। বরং বলা ভালো যে, বিশ শতকের তুলনায় সমকালে মানসিক চাপ ব্যক্তির জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

তৃতীয়ত, ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি কিংবা রবীন্দ্রনাথের সমগ্র শিল্পকর্মের অভ্যন্তরে জীবন-মৃত্যু বিষয়ক যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান তা রবীন্দ্রানুরাগী শিল্পী আলী আকবরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ক্রমাগতভাবে শাণিত করে তুলেছে এবং সমাধান খুঁজে পেতে তাকে ব্যাকুল করে তুলেছে। হয়তো তার জীবনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলশ্রুতিতে তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবন-মৃত্যুর সংঘাতকে নিজের জীবনের সাথে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সম্পর্কিত করে নিয়েছিলেন; যা এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।

চতুর্থত, একথা পূর্বেই বলা হয়েছে, আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা মানুষকে একাকিত্ববোধ এবং অর্থহীনতা থেকে মুক্ত করতে পারে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব সুযোগ-সুবিধা ব্যক্তির জীবনে মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। রবীন্দ্রানুরাগী শিল্পী আলী আকবর হয়তো সমকালীন আধুনিকতা জনিত প্রবল মানসিক চাপের শিকার হয়েছিলেন; যার যথার্থ ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

গল্পটি একজন ব্যক্তির আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে যতটা সাদামাটা হতে পারত, তা হয় নি; কেননা গল্পের ভাষায় মামুন হুসাইন সাদামাটা কিংবা জটিল বাস্তবতাকেই কাব্যিক প্রকৌশলে জটিলতর রূপ দিয়েছেন।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ গল্পে একজন আলী আকবর, যিনি সংগীত-সাধক তিনি মূলত আত্মহত্যা করেছেন; রবীন্দ্র সংগীত-প্রিয় একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করেছেন- তার আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় লেখক মামুন হুসাইন পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেছেন। একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করে কিংবা আত্মহত্যা করবে, আত্মহত্যার উদ্দেশ্য কী এবং কেন কোনো একজন ব্যক্তি তার জীবনের সমাপ্তি চায় কিংবা জাগতিক সব ধরনের মায়া-মমতা শেষ হয়ে যায়; এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি আদৌ খুঁজে পাওয়া সম্ভব? তারপরও কথাকার মামুন হুসাইন তাঁর সাইকোলজি বিদ্যার সহায়তা নিয়ে ব্যক্তির জীবনকে শেষ করে দেয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকা যথাসম্ভব কারণসমূহকে খুঁজে বের করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন গল্পে। একজন ব্যক্তির কীভাবে জীবনের প্রতি মায়া-মমতা শেষ হয়ে যায় এবং শেষ হওয়ার প্রক্রিয়া কী এবং কীভাবে তিনি আত্মহত্যার পথে হাঁটতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন করেন- এসব বিষয়ের বিশদ আলোচনা নিয়েই ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকার পথপরিক্রমা সামনে এগিয়ে গেছে।

মামুন হুসাইন গল্পের শিরোনামের মাধ্যমেই আলী আকবরের আত্মহত্যার ঘটনাকে বা তার অস্তিত্বকে ধ্বংস করার বিষয়টিকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন; যা পরিণামে ব্যক্তি মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বকে বোঝায়, পরিণামে যা নিজেই গল্পের মূল চরিত্র হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রসংগীত-সাধক আলী আকবর চরিত্রটি হয়তো নিজের তৈরি করা ব্যক্তিত্বের বোঝা বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল কিংবা ব্যক্তিজীবনকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়াটাও তার পক্ষে একসময় তার জন্য কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। অথবা তার চারপাশের পরিবেশ ক্রমাগতভাবে এতটাই নির্মম বা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে- যা তার আত্মা সহ্য করতে সক্ষম হয় নি। বেঁচে থাকা মানুষগুলো সর্বদাই সহনশীল হয়ে থাকে বলেই তারা বেঁচে থাকতে পারে; অন্যথায় তারাও বেঁচে থাকার মতো কোনো অবলম্বন পেত না। মানুষের এই সহনশীলতা না থাকলে সব মানুষই হয়তো আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠত কিংবা বেঁচে থাকার উদ্যম হারিয়ে ফেলত। ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার কিংবা নিজের ভার বা বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভয়ানক এক লড়াই করার মধ্য দিয়ে নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একথা সত্য যে, এ লড়াইটা সবাই সমানভাবে করতে পারে না, যে পারে একমাত্র সেই পৃথিবী থেকে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করার মতো সাহস দেখাতে পারে।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ উপন্যাসিকায় একজন আলী আকবর যিনি সঙ্গীত-সাধক, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের সংগীতে মগ্ন থেকে যিনি যথেষ্ট উচ্চতায় কিংবা যশ-খ্যাতি লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথে নিবেদিত বা রবীন্দ্রানুরাগী হওয়ার পরও কেন আলী আকবর আত্মহত্যা করেছেন, সে বিষয়ে মামুন হুসাইন সুতীক্ষè বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেছেন তার আত্মহত্যা করার কারণ কী হতে পারে! এসব বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের প্রকৃতি কিংবা তার মনের প্রকৃত অবস্থা কী আদৌ জানা সম্ভব! আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি- হয়তো সম্ভব, হয়তো না। পাঠক হিসেবে ‘স্বরাচিত আত্মার পরিত্রাণ’ থেকে তা জানার চেষ্টা করতে পারি মাত্র মামুন হুসাইনের কাব্যিক ভাষার মায়াটানে।

আলী আকবর নিজেকে কখনো মিথ্যে ভেবেছিলেন কিংবা সচেতনভাবে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন? আত্মহত্যার এরকম একটি নোটস দিয়েই মামুন তাঁর গল্প শুরু করেছেন। তারপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে তার আত্মহননের গল্পের পেছনের ইতিকথা জানতে নানা জনের নানা প্রকল্প, বিবিধ উপায়- তিনি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। মানুষ স্বীয় চেষ্টায় কেন নিজের মৃত্যুকে আহ্বান করে- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়েছেন লেখক নিজে এবং পাঠকও পরিশ্রান্ত হয়ে ভেবেছেন হয়তো সেটা কোনভাবেই জানা সম্ভব না। লেখক ও পাঠক পরিণামে ক্লান্ত হয়েও সত্যিকার অর্থে স্বেচ্ছামৃত্যুর কোনো কারণ অথবা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আদৌ আবিষ্কার করা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সংশায়পন্ন হয়েছেন। স্বেচ্ছামৃত্যু প্রকল্পের কারণ খুঁজে না পাওয়া লেখক মামুন হুসাইনের সীমাবদ্ধতা নয়, কেননা মানবজীবন এতটাই বৈচিত্র্যময় যে, ব্যক্তি-জীবনের সেই অস্তিত্ব স্বেচ্ছায় ধ্বংস করে দেয়ার ব্যাপারকে খুব সহজে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট বা কোনো যৌক্তিক উপসংহারে উপনীত সম্ভব হয় না। মামুন হুসাইন মনোরোগবিদ হয়েও সেটা পারেন নি, তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই চেষ্টা প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি বা খামতি ছিল এমন কথা বলার সুযোগ নেই। গল্পে লেখক মূলত একজন রবীন্দ্রসংগীত-প্রিয় মানুষের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার কারণ উদ্ঘাটনে সচেষ্ট হয়েছেন এবং নিপুণ শিল্পিত ভাষায় রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পীর সুইসাইড নোটসের প্রতিভাষ্য নির্মাণ করেছেন।

জীবন শেষ করার আগে কেউ কেউ কিছু নোটস লেখে- কেন লেখে, কী লেখে- তার সবটাই হয়তো বিশ্লেষণ করা জীবিত মানুষের পক্ষে সম্ভব না; তারপরও মামুন গল্পে বিবিধ উপায় ও প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখেছেন। স্বেচ্ছামৃত্যু অথবা আত্মহত্যাকে মামুন হুসাইন ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রশ্নটা এখানেই সুইসাইড করলেই কি আত্মার পরিত্রাণ ঘটে? যারা স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে তাদের আত্মার কি পরিত্রাণ ঘটে না? এরকম নানাবিধ প্রশ্ন গল্পের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতেই পারে. যার কোনো স্বাভাবিক উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা খোঁজার চেষ্টা করতে পারি মাত্র গল্পের কাহিনী থেকে; সেটাও পরিণামে অনেকাংশে ব্যর্থ চেষ্টা বলে মনে হয়, কারণ অস্তিত্বের বা আত্মার এই হারিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। বরং তখন মনে হয়, স্বীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সুইসাইড করা বা নোটস লেখা একটা বিকল্প উপায় মাত্র! সত্যিকার অর্থে কোনো যৌক্তিক কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে তা গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। অতএব সিদ্ধান্ত করা যায়, সুইসাইড নোটস মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। প্রসঙ্গত বলা দরকার, দীর্ঘ এ গল্পে মামুন হুসাইন নানা প্রক্রিয়ায় সুইসাইড কিংবা স্বরচিত মৃত্যুর (আত্মহত্যা) ব্যাখ্যা বা যুক্তিগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন মাত্র। লেখকের ব্যাখ্যার সাথে পাঠক পুরোপুরি একমত হবেন কিনা সে ব্যাপারে সুনিশ্চিত কোনো বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই। প্রসঙ্গত একথা সত্য যে মামুন ব্যক্তির স্বরচিত আত্মহত্যা প্রকল্পের কারণ উদ্ঘাটন করার সময় একজন মানসিক চিকিৎসক হিসেবে ব্যক্তি মানুষের সুইসাইডের যত রকমের কারণ থাকতে পারে, সেগুলো ব্যাখ্যার পাশাপাশি যুক্তিপূর্ণ সমাধানও খুঁজেছেন গল্পের কাহিনীতে।

মামুন হুসাইনের ‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ গল্পটি আধুনিক মানুষের আত্মপরিচয় সন্ধানের গভীরতর দ্যোতনাবাহী। একথা সত্য, সমকালীন বাস্তবতায় আমরা প্রায়ই নিজেদেরকে একটা নির্দিষ্ট চরিত্র বা বলয়ের মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলি। এর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে- সামাজিক চাপ, পরিবারের প্রত্যাশা, কর্মজীবনের চাপ প্রভৃতি আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট ভূমিকায় অভিনয় করতে বাধ্য করে- আমরা সেটা করতে থাকি। অন্তত যারা জীবিত থাকে, তাদেরকে সেটা করতেই হয়। গল্পটিতে এ ধরনের পারিবারিক কিংবা সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে নিজের আসল সত্তা খুঁজে পাওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কথাকার মামুন হুসাইন।

একজন রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পী আলী আকবরকে এভাবেও দেখার সুযোগ রয়েছে যে, তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি এতটাই আসক্ত ছিলেন, তার জীবনের অন্যান্য দিক গৌণ হয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এই আসক্তিই হয়তো তার আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে থাকতে পারে। কেননা রবীন্দ্রনাথের গানগুলো বিশেষত রবীন্দ্র-শিল্পকর্ম প্রায়শই জীবন-মৃত্যু, ভালোবাসা, হতাশা, একাকিত্বের মতো বিষয়গুলোকে আরও গভীরতর এক ব্যঞ্জনায় ব্যক্তিক আত্মিক সন্ধানের পথে টেনে নিয়ে যায়। গল্পের আলী আকবর গানগুলোর মধ্যে কিংবা রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্মের মধ্যে হয়তো নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছেন, পরবর্তীতে তার নিজের জীবনের সাথে তুলনা করে হতাশ হয়ে পড়েছেন। রবীন্দ্রসংগীত-সাধক হিসেবে হয়তো চরিত্রটি সমাজে নিজেকে একা মনে করেছেন এবং রবীন্দ্রসংগীতেই তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। রবীন্দ্রানুরাগী হিসেবে তার অভ্যন্তরে যে একাকিত্ব ক্রমশ বেড়ে উঠেছে হয়তো সেটাই একসময় তার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে- যা তাকে পরিণামে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছে। চরিত্রটির মানসিক অবস্থা কেমন ছিল? সে কীভাবে রবীন্দ্রসংগীতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, রবীন্দ্রনাথের সাথে সম্পর্কটি তার জীবনের অন্যান্য দিককে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? সে বিষয়গুলোও ভেবে দেখা দরকার এবং বিবেচনায় নিয়ে চরিত্রটি কেন আত্মহত্যা করেছে- সেটি খুঁজে বের করার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন মামুন হুসাইন। রবীন্দ্রসংগীত কি আলী আকবরের আত্মহত্যার একমাত্র কারণ, নাকি অন্য কোনো কারণও ছিল? এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, ব্যক্তিজীবনের সাথে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবকিছুই একসাথে জড়িয়ে থাকে; ফলে আমরা এককথায় এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।

সংগীত-শিল্পী আলী আকবর তার অনুভূতিকে সঙ্গীতের মাধ্যমে এতটাই একাত্ম হয়ে প্রকাশ করতেন যে, বাস্তব কিংবা জাগতিক জীবনে তার সাথে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রসংগীতের জগতে নিমগ্ন থাকার কারণে তিনি হয়তো পরিবার-সমাজ এমনকি বন্ধু-বান্ধবমহল থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শবাদ এবং রোমান্টিসিজম তাকে বাস্তব জীবনের কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে দেয় নি; কিংবা রোমান্টিক জগৎ থেকে নেমে এসে সাধারণ জীবনের সাথে তিনি মিশে যেতে পারেন নি। ফলে এমন ভাবা যায় যে, আলী আকবরের আত্মহত্যার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে; এর মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটির কথা বলা যেতে পারে- যা তার অস্তিত্ব ধ্বংসের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে তার ব্যক্তিগত জীবনের অন্যান্য ঘটনা, মানসিক অবস্থা, সামাজিক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।

‘স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ’ শিরোনামটি ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের খোঁজ এবং মুক্তির আকাক্সক্ষার নির্ণায়ক। ব্যক্তি যখন নিজের আত্মাকে স্বকীয় চিন্তার দ্বারা বোঝার চেষ্টা করে এবং তার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে চায়- তখন সে এই পথের শেষ কোথায়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। জীবন পথের শেষ তো আসলে মৃত্যুই; কেউ কেউ হয়তো এরকম সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে পারে। জীবনপথের শেষ কোথায় আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের একটি প্রতিফলন হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের মধ্যে ঈশ্বরকেও খুঁজতে চাইতে পারে কিংবা মোক্ষের পথে অগ্রসর হয়ে এগিয়ে যেতে চাইতে পারে। অথবা ব্যক্তিমানুষ সামাজিক চাপ, প্রত্যাশা এবং সীমাবদ্ধতার কারণে নিজেকে বন্দি মনে করতে পারে এবং মুক্তির পথ খুঁজতে পারে। সেই মুক্তির সহজতম পথ হিসেবে ‘সুইসাইড’ বা আত্মহত্যাকেও গ্রহণ করতে পারে কোনো কোনো ব্যক্তিমানুষ।এ গল্পে মামুন হুসাইন ব্যক্তিমানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা বিষয়ক একটি অনন্য বিশ্লেষণমূলক প্রকল্প নির্মাণ করেছেন।

back to top