alt

সাময়িকী

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

মনিরুস সালেহীন

: বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বাসা থেকে বেরোনোর সময়ই সিদ্ধান্তটি নিই। কার্যকারণহীন একটা সিদ্ধান্ত। একটু পর একটা ট্রেন জার্নি শুরু করবো। প্রায় ঘণ্টা পাঁচেকের জার্নি। সিদ্ধান্ত নিলাম এই জার্নির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি কথাও বলবো না আজ। যাকে বলে মৌনব্রত, সেটাই পালন করব।

ট্রেনের কামরায় নিজের নির্দিষ্ট সিটের কাছে গিয়ে দেখি সেখানে অন্য একজন বসে আছেন। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বা তারচে’ কমবয়সী এক মহিলা। সুশ্রী, হাসিখুশি, সুন্দরীই বলা যায়। এক পলক দেখলেহই বোঝা যায় হাসলে মেয়েটির গালে টোল পড়ে। তার পাশে সামান্য একটু বেশি বয়সী আরেকজন।

আমার মৌনব্রতের বারোটা তাহলে শুরুতেই বাজল! আমি ভাবি। কারণ নির্দিষ্ট সিটে যখন অন্য কেউ বসে থাকে তখন তাকে ‘এক্সকিউজ মি, ওটা আমার সিট’ বলে সিটের বর্তমান দখলদারকে তা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানানোই দুরস্ত। আর দখলদার ত্যাদর হলে বলবেন তার সিটের নম্বরও এটা এবং এরপর পরস্পরের টিকেট পরীক্ষা করে ফয়সালা হবে কার আসন কোনটা। মোদ্দা কথা, এক্ষুনি আমাকে মৌনব্রত ভাঙতে হবে।

কিন্তু এতো সহজে আমি হাল ছাড়ছি না।

আমি সিটের পাশে দাঁড়াই। ধীরেসুস্থে ব্যাকপ্যাকটা মাথার উপরের লাগেজ চেম্বারে রাখি। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বের করি। মহিলা দু’জনই আমাকে লক্ষ করে। সামনে এবং পেছনে বেশ কটা সিট খালি পড়ে আছে। নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি ওগুলোর কোনো একটায় বসব।

আমি মোবাইল থেকে ই-টিকেট বের করি এবং নিশ্চিত হই আমার সিটটাতেই বসে আছেন তিনি। আমি কিছু না বলে দখলদার যাত্রীর সামনে মোবাইলটা মেলে ধরি। তিনি যেন কিছু বুঝতে পারছেন না। আমাকে কথা না বলিয়ে ছাড়বেন না মনে হয়। আমি আঙুলের ইশারায় বুঝিয়ে দেই যে, তিনি যে আসনে বসে আছেন সেটি আমার। তিনি কপাল কুঁচকান। তারপর বলেন, “আমাদের দুটো সিট। আমার তো মনে হয় এটা আমাদেরই সিট।” তিনিও তার মোবাইলে টিকেট বের করেছেন। তাতে ২৬ ও ২৮ নম্বরের দুটো সিট। আমার সিট নম্বর ২৭। আমি আবারও কিছু না বলে ইশারায় দেখাই সিটের উপর আমার সিটের নম্বরটা দেখাই।

মহিলার মনে হয় কপাল কুঁচকানোর অভ্যাস আছে। তিনি আবার কপাল কুঁচকালেন।

তিনি এবার আমাকে বলেন, “ভাই বুঝতে পারছি। আমার ২৮ নম্বর সিটটা খালিই আছে। আপনি ওখানে বসুন না।”

তার কণ্ঠে যথেষ্ট পরিমাণ অনুরোধ থাকলে আমি হয়তো তাই করতাম। কিন্তু যে ভঙ্গিতে খানিকটা কর্তৃত্ব মিশিয়ে তিনি কথাটা বললেন তা আমার ভালো লাগে না। আমি মুখে কিছু না বলে বুঝিয়ে দেই যে আমি আমার জন্য নির্ধারিত সিটেই বসবো।

মহিলা মনে হয় ভাবতে শুরু করেছেন যে, আমি একজন বাকপ্রতিবন্ধি। আর কে না জানে বাকপ্রতিবন্ধিরা কিছুটা ত্যাড়া হয়। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে আমার জন্য সিটটা ছেড়ে দিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসেন।

একজন মহিলার সাথে এ ধরনের রুড আচরণ সাধারণত আমি করি না, বরং নিজের শিভালরি প্রদর্শন করতেই পছন্দ করি। কিন্তু আজ যে আমার কী হলো! প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মৌনব্রত এখনো আমি ধরে রাখতে পারছি এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি- এটা ভেবেই আমি আনন্দিত বোধ করি।

কয়েক দিন কিয়ারা, মানে আমার গার্ল ফ্রেন্ড, আমি ওকে আমার জিএফ ভাবি কিন্তু সে আমাকে তার বয়ফ্রেন্ড না জাস্ট ফ্রেন্ড ভাবে, সেটা আমার ঠিক জানা নেই, তো সেই কিয়ারা বলেছে আমার ব্যক্তিত্বের বিকাশ এখনো পুরোপুরি হয়নি বলে তার মনে হয়। কথাটা আমার যথেষ্ট কঠিন মনে হয়। ফিজিক্স টিচারের দিকে গবেট ছাত্রের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সে তখন ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিল যে এক পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মধ্যে যখন ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে তখন তার মধ্যে একটা নিজস্বতা তৈরি হয় আর তখন তাকে অন্য দশজন থেকে আলাদা করে চেনা যায়।

এরপর আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না।

তার কথায়, বলা বাহুল্য, আমি কিঞ্চিৎ আহত বোধ করেছি। আমার ভার মুখ দেখে সে তার সেই বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বলেছিল, “শোন দীপু, এটা কিন্তু সত্যি। সে সব ছেলেরা নিজেদের সিদ্ধান্তে ঠিক থাকতে পারে না, অর্থাৎ ঠেলায় আসে ধাক্কায় যায় টাইপ যারা, তারা কিন্তু বন্ধু হিসেবেও তেমন নির্ভরযোগ্য হওয়ার কথা না।” বলেই সে আমার কাঁধে হাত রেখেছিল একটু।

এই যে বললাম না, কিয়ারা আমাকে বিএফ নাকি জাস্ট আ ফ্রেন্ড ভাবে তা তার কথায়, শব্দের ব্যবহারে আমি তা বোঝার চেষ্টা করি। যতই হালকাভাবে সে কিছু বলুক, আমার মনে হয় আমি এখনো নির্ভরযোগ্য একজন বন্ধুই হয়ে উঠতে পারিনি।

কিয়ারার সাথে আমার সম্পর্কের ধরন নিয়ে আমার সন্দেহ থাকলেও এটা ঠিক যে আমি ওকে প্রচ- পছন্দ করি। আই লাইক হার। ভেরি ভেরি মাচ। আমার উপস্থিতিতে ওর মায়াবী চোখে যে আনন্দ যে মুগ্ধতা খেলে, কিংবা, খেলে বলে আমি মনে করি, তা দেখলে মনে হয় কিয়ারা বোধহয় আমাকে ভালই বাসে। ওকে নিয়ে আমার লেখা কবিতায় ও লাভ রিয়েক্ট দেয়, ওয়াও বলে। আমি পুলকিত বোধ করি। আমি যে কবিতা ওকে নিয়ে লিখি তা প্রেমিকই লেখে প্রেমিকার জন্য।

ইন ফ্যাক্ট আমি এখন কিয়ারার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ও ছোট এক মফস্বল শহরের বড় ক্যাডার অফিসার। আমি পাঁচ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি মাথায় নিয়ে যাচ্ছি ওর সাথে দেখা করতে। মাত্র ঘণ্টা দুয়েক থাকা হবে। ফিরতি ট্রেনেই ফিরতে হবে আমাকে।

ওর ওখানে এই প্রথম যাচ্ছি। একদিন হুট করে চলে আসব তোমার কাছে- বলেছিলাম একদিন। কিয়ারা অবাক হয়ে বলেছে, “কী বলছো, আসবে মানে! এই ছোট্ট শহরে কোনো হোটেল নেই, ডাকবাংলো যেটা আছে সেটার অবস্থা শুনেছি ভালো নয়।”

“আমি আসবো। হোটেল বা থাকার জন্য অন্য জায়গার দরকার হবে না। আমি বিকেলের ট্রেনেই ফিরবো।”

“তার মানে তুমি এত লম্বা জার্নি করে মাত্র দু’ঘণ্টার জন্য এখানে আসবে?” কিয়ারা চ্যাটে সারপ্রাইজ ইমোজি দিয়ে জিগ্যেস করে।

“দু’ঘণ্টা মানে ১২০ মিনিট, ৭২০০ সেকেন্ড। তুমি কি জানো জাগ্রত অবস্থায় প্রতি মিনিটে কতবার তোমার চোখে পাতা নড়ে?”

আবারও বিস্ময়সূচক ইমোজি দেয় কিয়ারা।

“প্রতি মিনিটে ৮৫০ থেকে এক হাজারেরও বেশি বার। তার মানে দু’ঘণ্টা মোটেই কম সময় না”, আমি একটা স্মাইলি দিয়ে জানাই।

“আমার চোখের পাতার নড়া দেখার জন্য তাহলে তুমি সত্যিই আসছ?” আবার হাসির ইমোজি।

আমি আবার একটা স্মাইলি দিয়েছি। কিয়ারা যা বোঝার বুঝুক। আমার নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকা নিয়ে কিয়ারার সংশয় আছে। জগতের কোনো কিছু সংশয় কখনো নিরসন হয়নি, হওয়া উচিত না।

আমি যে যাচ্ছি তা কিয়ারাকে জানাইনি, ওকে সারপ্রাইজ দেব।

ঘুম থেকে জাগার পর ঘণ্টা পাঁচেক কেটে গেছে। আমার মৌনব্রত এখনো অনাঘ্রাত।

পাশের সিটে যে ভদ্রলোক বসেছেন তিনি আগের দুই মহিলার আত্মীয় মনে হয়। কিছুক্ষণ আগে তারা পরোটা ভাজি দিয়ে নাস্তা করেছেন। কফির অর্ডার দিয়েছেন। আমি শুরু থেকে সোশ্যাবল ব্যবহার করলে নিশ্চয়ই আমাকেও কফির অফার দিতেন। মৌনব্রতের অসুবিধাও কম না। অবশ্য আমি নিজেই কফির অর্ডার দিতে পারি। কিন্তু মুখ না খুলে তা করতে আমাকে আবারো সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে হবে। আপাতত সেদিকে যাইনি।

আমার পাশের ভদ্রলোক তার হাত ব্যাগ হাতড়ে কিছু একটা বের করছেন সন্তর্পণে। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে কি না। আমি আড়চোখে দেখতে থাকি। তিনি কিছু একটা মুখে পুরেছেন। পান চিবুচ্ছেন। জর্দার সুরভি আমার নাকে আসছে। ভদ্রলোক পান খাচ্ছেন বলে মনে হয় খুবই বিব্রত বোধ করছেন। এমন সতর্কতা নিয়ে কখনো কাউকে পান খেতে দেখিনি।

আমার বর্তমান মৌনব্রতের মতো মনে হয় তিনিও মৌনী পানখোর।

মধ্যবয়সী এক অন্ধ ভিখারির কণ্ঠ শুনি। কামরার আইল দিয়ে যেতে যেতে বলছে, ‘ও সার, আমার খিদা লাগছে, কিছু খামু, ও সার আমারে কিছু দেইন, ও সার, ও সাররা ঘুমায়া পড়ছুইননি, ও সার আমার তো ঘুম আহে না খিদার লাইগ্যা, আমারে কিছু দেইন।’

না, স্টাইল আছে ফকির বেটার। নিজস্বতা আছে। কিয়ারাও আমার মধ্যে এমন নিজস্বতা খোঁজে মনে হয়!

অনেকগুলো স্টেশন পার হয়েছে ট্রেনটা কোথাও না থেমে। আমি জানালায় চোখ দিয়ে সবুজ বাংলা দেখি। একটা বাড়ির পুকুর ঘাটে দেখি রঙিন জামা পরা এক কিশোরীকে। চকিত দেখায় কেন যেন মনে হলো ও অপেক্ষা করছে কারোর জন্য। আবার চোখ ফেরাই ট্রেনের কামরার যাত্রীদের দিকে। কারোর সাথে কথা না বললে কত কিছু যে দেখা যায় অভীষ্ট মনোযোগ দিয়ে।

ভার্সিটির এক ইয়ার সিনিয়র ফারুক ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। ফারুক ভাই একটানা সাত দিনের মৌনব্রত পালন করেছিলেন। জেদ করে লক্ষ্যে পৌঁছার একটা রেকর্ডই করে ফেলেছিলেন তিনি।

‘তুই বড্ড বেশি কথা বলিস, বেশি কথা বলিস বলেই কাজের কাজ কিছু পারিস না, কথা কম বলে নিজের কাজটা করলে তোর মতো ছাত্রের থার্ড ক্লাস পাওয়ার আশংকা থাকতো না’- বন্ধুদের সামনে ভগ্নিপতির এমন চাছাছোলা মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে ফারুক ভাই তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি পরবর্তী সাত দিন কোনো কথা বলবেন না কারোর সাথে। শেষ পর্যন্ত তিনি তা-ই করেছিলেন। গলায় ঝুলিয়েছিলেন একটা প্ল্যাকার্ড- ‘আমি মৌনব্রত পালন করছি,দয়া করে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।’ এই সাতদিন তিনি ঘরের দরোজা বন্ধ করে পড়াশোনা করেছেন, কখনো ঘর থেকে বের হয়েছেন বাসার পাশের মুদি দোকান থেকে সিগারেট কেনার জন্য। তখন ব্যবহার করেছেন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে না কুলালে স্লিপে লিখে কাজ সেরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা অবাক করা রেজাল্ট করেছিলেন তিনি।

ফারুক ভাইয়ের মতো কিছু একটা করতে পারলে কিয়ারাকে বোঝানো যেত আমার ব্যক্তিত্ব কতটুকু বিকশিত হয়েছে। এই যে আজ ওর ঘণ্টা দুয়েকের সঙ্গ’র জন্য পাঁচ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি করে ওর কাছে যাচ্ছি তাতে কি আমার সম্পর্কে ওর মনোভাব কিছুটা চেঞ্জ হবে?- আমি ভাবি।

এসি কামরাটা এতোক্ষণ চুপচাপ ছিল। একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে অনেক লোক ঢুকে গেল। কামরাটা কোলাহল মুখরিত হয়ে উঠেছে। নতুন যাত্রীদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো তারা জেলাশহরে যাচ্ছে কোনো রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে। নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে কথা বলছে।

সিটে বসা কোনো একজন যাত্রী বোধহয় নতুন যাত্রীদের কাউকে মনে করিয়ে দিয়েছিল এটা এসি ক্লাস। তাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে সেই লোক। উত্তপ্ত কণ্ঠে বলেছে, “রাহুইন আফনের এসি ক্লাস। বাইশ মাস জেল খাটছি বিনা দোষে। এসি মারা লোকরা হাসিনারে খেদায় নাই, আমরাই খেদাইছি।” তার সঙ্গী সাথীরাও সরব হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী লোকটা পিন দিয়ে চুপসানো বেলুনের মতো চুপসে যায়। একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠছে দেখেই অন্য সিটে বসা একজন যাত্রী উত্তপ্ত যুবকের দিকে তাকিয়ে যথেষ্ট দরদ দিয়ে বলেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে। আসলেই আপনারা অনেক স্যাক্রিফাইস করেছেন, করছেন। দল বেঁধে সবাই কোথায় যাচ্ছেন? কোনো মিটিং আছে, না?”

ওই যুবক ও তার সঙ্গীরা আলাপ জুড়ে দিয়েছে ভদ্রলোকের সঙ্গে।

আমি আবার ফিরে আসি নিজের জগতে। ওই যুবকটিকে আমার হিংসা হয়। কথায় কি তেজ আর ঝাঁঝ! ও যদি হয় চৈত্রের কাঠফাটা রোদে পড়ে থাকা তাঁতানো কাঠের টুকরো, যেখানে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ঘষলেই আগুন জ্বলবে, আমি শীতে ঝরে পড়া নেতানো পাতা। কিয়ারা ঠিক পছন্দ করতো ওই রকম তেজি পুরুষ।

নাহ, নিজেকে ছোট ভাবার রোগে পেয়ে বসেছে আমাকে। আমার হাই স্কুলের আখতার স্যারের কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, অ্যাই, তুই কুমা কিসের?

চলে এসেছি কিয়ারার স্টেশনে। আমাকে দেখে ও কী রকম সারপ্রাইজড হবে- ভেবে আমি অন্য রকম পুলক বোধ করি। অদ্ভুত,আজ একবারও ও নক করেনি। কল দিলে অবশ্য আমারই অসুবিধা হতো। আমার মৌনব্রত। আচ্ছা, যদি গিয়ে দেখি ও স্টেশনে নেই? চলে গেছে কোনো ট্যুরে? আগে একটু জানালেই বোধহয় ভালো হতো- ভাবতে ভাবতে আমি স্টেশন থেকে অটো নিয়ে এগোই কিয়ারার অফিসের দিকে। পণ করেছি কিয়ারার সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত মুখ খুলবো না। মুখ না খুলে কীভাবে কিয়ারার অফিসে গেলাম সে এক মহা বিতং!

কিয়ারা অফিসেই আছে। দরোজা বন্ধ। তার চেম্বারের সামনে দাঁড়ানো অফিস সহকারীকে একটা কাগজে নাম লিখে বোঝাই ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছি। সে জানায় ম্যাডাম জরুরি কথা বলছেন ঢাকা থেকে আসা তার গেস্টের সাথে। ইশারায় বোঝাই ম্যাডামকে স্লিপটা পৌঁছাতে।

পিয়ন ভেতরে যায় আর সাথে সাথেই আমাকে দরোজা খুলে ভেতরে যেতে বলে।

কিয়ারা আমাকে দেখেই বলে, “হোয়াট আ সারপ্রাইজ!”

কিন্তু যে উচ্ছ্বাস আমি আশা করেছিলাম কিয়ারার মধ্যে, সেটা দেখি না। সচেতন সংযত কিয়ারা।

কিয়ারার পাশের চেয়ার বসে আছে আমার বয়সী এক সুদর্শন যুবক। সে আমাকে দেখে মনে হয় ভ্রু কুঞ্চিত করে।

আমি মুখ খোলার আগেই কিয়ারা আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় সুবেশসধারী যুবকের সাথে, “আমার ইউনির ক্লাসমেট দীপু। আর দীপু, এ হচ্ছে শাওন। আমার ফিয়াঁসে। তোমাদের বোধহয় বলিনি ওর কথা। ও কাল এসেছে।”

এ অবস্থায় একজন বাকপ্রতিবন্ধি মানুষ কী করতো আমি জানি না। হয়তো অদ্ভুত ভাষায় হাত পা নাড়িয়ে কিছু বলতো। আমার একবার মনে হয় আমিও তেমন কিছু করি। স্থির দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকি কিয়ারার দিকে। তার সেই চেনা চোখের দিকে। আকাশে ওড়া এক খ- কালো মেঘ যেন ঊর্ধ্বমুখী টানেল হয়ে নেমে এসেছে ঘরের ভেতর। আর আমি ঢুকে গেছি সেই টানেলের ভেতর। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। নিজেকে বের করে আনি সেই টানেল থেকে। পর্দানশিন নারীর কাছে পরপুরুষের মতো নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হয়।

সারপ্রাইজ দিতে এসে এতো বড় সারপ্রাইজ পাবো তা আমার কল্পনাতেও ছিল না।

ইংরেজিতে যাকে বলে, আই কালেক্ট মাইসেলফ। এক টুকরো হাসি আনি মুখে। শাওনের দিকে হাত বাড়াই, হাতের মুঠোয় তার হাত নিয়ে যতেœ লালিত নিজের মৌনতা ভাঙি, বলি, “বাহ, চমৎকার।”

আমার জীবনানন্দ পড়া কিয়ারা নিশ্চয়ই তখন মনে মনে বলেছে, “ধরা যাক দু’য়েকটা ইঁদুর এবার।”

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

পথকবিতা: লোকবাংলার সাধারণ কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

ক্ষমতার ভাষার বিপরীতে মাতৃভাষার সাধনা

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

tab

সাময়িকী

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

মনিরুস সালেহীন

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

বাসা থেকে বেরোনোর সময়ই সিদ্ধান্তটি নিই। কার্যকারণহীন একটা সিদ্ধান্ত। একটু পর একটা ট্রেন জার্নি শুরু করবো। প্রায় ঘণ্টা পাঁচেকের জার্নি। সিদ্ধান্ত নিলাম এই জার্নির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি কথাও বলবো না আজ। যাকে বলে মৌনব্রত, সেটাই পালন করব।

ট্রেনের কামরায় নিজের নির্দিষ্ট সিটের কাছে গিয়ে দেখি সেখানে অন্য একজন বসে আছেন। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বা তারচে’ কমবয়সী এক মহিলা। সুশ্রী, হাসিখুশি, সুন্দরীই বলা যায়। এক পলক দেখলেহই বোঝা যায় হাসলে মেয়েটির গালে টোল পড়ে। তার পাশে সামান্য একটু বেশি বয়সী আরেকজন।

আমার মৌনব্রতের বারোটা তাহলে শুরুতেই বাজল! আমি ভাবি। কারণ নির্দিষ্ট সিটে যখন অন্য কেউ বসে থাকে তখন তাকে ‘এক্সকিউজ মি, ওটা আমার সিট’ বলে সিটের বর্তমান দখলদারকে তা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানানোই দুরস্ত। আর দখলদার ত্যাদর হলে বলবেন তার সিটের নম্বরও এটা এবং এরপর পরস্পরের টিকেট পরীক্ষা করে ফয়সালা হবে কার আসন কোনটা। মোদ্দা কথা, এক্ষুনি আমাকে মৌনব্রত ভাঙতে হবে।

কিন্তু এতো সহজে আমি হাল ছাড়ছি না।

আমি সিটের পাশে দাঁড়াই। ধীরেসুস্থে ব্যাকপ্যাকটা মাথার উপরের লাগেজ চেম্বারে রাখি। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বের করি। মহিলা দু’জনই আমাকে লক্ষ করে। সামনে এবং পেছনে বেশ কটা সিট খালি পড়ে আছে। নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি ওগুলোর কোনো একটায় বসব।

আমি মোবাইল থেকে ই-টিকেট বের করি এবং নিশ্চিত হই আমার সিটটাতেই বসে আছেন তিনি। আমি কিছু না বলে দখলদার যাত্রীর সামনে মোবাইলটা মেলে ধরি। তিনি যেন কিছু বুঝতে পারছেন না। আমাকে কথা না বলিয়ে ছাড়বেন না মনে হয়। আমি আঙুলের ইশারায় বুঝিয়ে দেই যে, তিনি যে আসনে বসে আছেন সেটি আমার। তিনি কপাল কুঁচকান। তারপর বলেন, “আমাদের দুটো সিট। আমার তো মনে হয় এটা আমাদেরই সিট।” তিনিও তার মোবাইলে টিকেট বের করেছেন। তাতে ২৬ ও ২৮ নম্বরের দুটো সিট। আমার সিট নম্বর ২৭। আমি আবারও কিছু না বলে ইশারায় দেখাই সিটের উপর আমার সিটের নম্বরটা দেখাই।

মহিলার মনে হয় কপাল কুঁচকানোর অভ্যাস আছে। তিনি আবার কপাল কুঁচকালেন।

তিনি এবার আমাকে বলেন, “ভাই বুঝতে পারছি। আমার ২৮ নম্বর সিটটা খালিই আছে। আপনি ওখানে বসুন না।”

তার কণ্ঠে যথেষ্ট পরিমাণ অনুরোধ থাকলে আমি হয়তো তাই করতাম। কিন্তু যে ভঙ্গিতে খানিকটা কর্তৃত্ব মিশিয়ে তিনি কথাটা বললেন তা আমার ভালো লাগে না। আমি মুখে কিছু না বলে বুঝিয়ে দেই যে আমি আমার জন্য নির্ধারিত সিটেই বসবো।

মহিলা মনে হয় ভাবতে শুরু করেছেন যে, আমি একজন বাকপ্রতিবন্ধি। আর কে না জানে বাকপ্রতিবন্ধিরা কিছুটা ত্যাড়া হয়। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে আমার জন্য সিটটা ছেড়ে দিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসেন।

একজন মহিলার সাথে এ ধরনের রুড আচরণ সাধারণত আমি করি না, বরং নিজের শিভালরি প্রদর্শন করতেই পছন্দ করি। কিন্তু আজ যে আমার কী হলো! প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মৌনব্রত এখনো আমি ধরে রাখতে পারছি এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি- এটা ভেবেই আমি আনন্দিত বোধ করি।

কয়েক দিন কিয়ারা, মানে আমার গার্ল ফ্রেন্ড, আমি ওকে আমার জিএফ ভাবি কিন্তু সে আমাকে তার বয়ফ্রেন্ড না জাস্ট ফ্রেন্ড ভাবে, সেটা আমার ঠিক জানা নেই, তো সেই কিয়ারা বলেছে আমার ব্যক্তিত্বের বিকাশ এখনো পুরোপুরি হয়নি বলে তার মনে হয়। কথাটা আমার যথেষ্ট কঠিন মনে হয়। ফিজিক্স টিচারের দিকে গবেট ছাত্রের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সে তখন ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিল যে এক পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মধ্যে যখন ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে তখন তার মধ্যে একটা নিজস্বতা তৈরি হয় আর তখন তাকে অন্য দশজন থেকে আলাদা করে চেনা যায়।

এরপর আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না।

তার কথায়, বলা বাহুল্য, আমি কিঞ্চিৎ আহত বোধ করেছি। আমার ভার মুখ দেখে সে তার সেই বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বলেছিল, “শোন দীপু, এটা কিন্তু সত্যি। সে সব ছেলেরা নিজেদের সিদ্ধান্তে ঠিক থাকতে পারে না, অর্থাৎ ঠেলায় আসে ধাক্কায় যায় টাইপ যারা, তারা কিন্তু বন্ধু হিসেবেও তেমন নির্ভরযোগ্য হওয়ার কথা না।” বলেই সে আমার কাঁধে হাত রেখেছিল একটু।

এই যে বললাম না, কিয়ারা আমাকে বিএফ নাকি জাস্ট আ ফ্রেন্ড ভাবে তা তার কথায়, শব্দের ব্যবহারে আমি তা বোঝার চেষ্টা করি। যতই হালকাভাবে সে কিছু বলুক, আমার মনে হয় আমি এখনো নির্ভরযোগ্য একজন বন্ধুই হয়ে উঠতে পারিনি।

কিয়ারার সাথে আমার সম্পর্কের ধরন নিয়ে আমার সন্দেহ থাকলেও এটা ঠিক যে আমি ওকে প্রচ- পছন্দ করি। আই লাইক হার। ভেরি ভেরি মাচ। আমার উপস্থিতিতে ওর মায়াবী চোখে যে আনন্দ যে মুগ্ধতা খেলে, কিংবা, খেলে বলে আমি মনে করি, তা দেখলে মনে হয় কিয়ারা বোধহয় আমাকে ভালই বাসে। ওকে নিয়ে আমার লেখা কবিতায় ও লাভ রিয়েক্ট দেয়, ওয়াও বলে। আমি পুলকিত বোধ করি। আমি যে কবিতা ওকে নিয়ে লিখি তা প্রেমিকই লেখে প্রেমিকার জন্য।

ইন ফ্যাক্ট আমি এখন কিয়ারার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ও ছোট এক মফস্বল শহরের বড় ক্যাডার অফিসার। আমি পাঁচ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি মাথায় নিয়ে যাচ্ছি ওর সাথে দেখা করতে। মাত্র ঘণ্টা দুয়েক থাকা হবে। ফিরতি ট্রেনেই ফিরতে হবে আমাকে।

ওর ওখানে এই প্রথম যাচ্ছি। একদিন হুট করে চলে আসব তোমার কাছে- বলেছিলাম একদিন। কিয়ারা অবাক হয়ে বলেছে, “কী বলছো, আসবে মানে! এই ছোট্ট শহরে কোনো হোটেল নেই, ডাকবাংলো যেটা আছে সেটার অবস্থা শুনেছি ভালো নয়।”

“আমি আসবো। হোটেল বা থাকার জন্য অন্য জায়গার দরকার হবে না। আমি বিকেলের ট্রেনেই ফিরবো।”

“তার মানে তুমি এত লম্বা জার্নি করে মাত্র দু’ঘণ্টার জন্য এখানে আসবে?” কিয়ারা চ্যাটে সারপ্রাইজ ইমোজি দিয়ে জিগ্যেস করে।

“দু’ঘণ্টা মানে ১২০ মিনিট, ৭২০০ সেকেন্ড। তুমি কি জানো জাগ্রত অবস্থায় প্রতি মিনিটে কতবার তোমার চোখে পাতা নড়ে?”

আবারও বিস্ময়সূচক ইমোজি দেয় কিয়ারা।

“প্রতি মিনিটে ৮৫০ থেকে এক হাজারেরও বেশি বার। তার মানে দু’ঘণ্টা মোটেই কম সময় না”, আমি একটা স্মাইলি দিয়ে জানাই।

“আমার চোখের পাতার নড়া দেখার জন্য তাহলে তুমি সত্যিই আসছ?” আবার হাসির ইমোজি।

আমি আবার একটা স্মাইলি দিয়েছি। কিয়ারা যা বোঝার বুঝুক। আমার নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকা নিয়ে কিয়ারার সংশয় আছে। জগতের কোনো কিছু সংশয় কখনো নিরসন হয়নি, হওয়া উচিত না।

আমি যে যাচ্ছি তা কিয়ারাকে জানাইনি, ওকে সারপ্রাইজ দেব।

ঘুম থেকে জাগার পর ঘণ্টা পাঁচেক কেটে গেছে। আমার মৌনব্রত এখনো অনাঘ্রাত।

পাশের সিটে যে ভদ্রলোক বসেছেন তিনি আগের দুই মহিলার আত্মীয় মনে হয়। কিছুক্ষণ আগে তারা পরোটা ভাজি দিয়ে নাস্তা করেছেন। কফির অর্ডার দিয়েছেন। আমি শুরু থেকে সোশ্যাবল ব্যবহার করলে নিশ্চয়ই আমাকেও কফির অফার দিতেন। মৌনব্রতের অসুবিধাও কম না। অবশ্য আমি নিজেই কফির অর্ডার দিতে পারি। কিন্তু মুখ না খুলে তা করতে আমাকে আবারো সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে হবে। আপাতত সেদিকে যাইনি।

আমার পাশের ভদ্রলোক তার হাত ব্যাগ হাতড়ে কিছু একটা বের করছেন সন্তর্পণে। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে কি না। আমি আড়চোখে দেখতে থাকি। তিনি কিছু একটা মুখে পুরেছেন। পান চিবুচ্ছেন। জর্দার সুরভি আমার নাকে আসছে। ভদ্রলোক পান খাচ্ছেন বলে মনে হয় খুবই বিব্রত বোধ করছেন। এমন সতর্কতা নিয়ে কখনো কাউকে পান খেতে দেখিনি।

আমার বর্তমান মৌনব্রতের মতো মনে হয় তিনিও মৌনী পানখোর।

মধ্যবয়সী এক অন্ধ ভিখারির কণ্ঠ শুনি। কামরার আইল দিয়ে যেতে যেতে বলছে, ‘ও সার, আমার খিদা লাগছে, কিছু খামু, ও সার আমারে কিছু দেইন, ও সার, ও সাররা ঘুমায়া পড়ছুইননি, ও সার আমার তো ঘুম আহে না খিদার লাইগ্যা, আমারে কিছু দেইন।’

না, স্টাইল আছে ফকির বেটার। নিজস্বতা আছে। কিয়ারাও আমার মধ্যে এমন নিজস্বতা খোঁজে মনে হয়!

অনেকগুলো স্টেশন পার হয়েছে ট্রেনটা কোথাও না থেমে। আমি জানালায় চোখ দিয়ে সবুজ বাংলা দেখি। একটা বাড়ির পুকুর ঘাটে দেখি রঙিন জামা পরা এক কিশোরীকে। চকিত দেখায় কেন যেন মনে হলো ও অপেক্ষা করছে কারোর জন্য। আবার চোখ ফেরাই ট্রেনের কামরার যাত্রীদের দিকে। কারোর সাথে কথা না বললে কত কিছু যে দেখা যায় অভীষ্ট মনোযোগ দিয়ে।

ভার্সিটির এক ইয়ার সিনিয়র ফারুক ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। ফারুক ভাই একটানা সাত দিনের মৌনব্রত পালন করেছিলেন। জেদ করে লক্ষ্যে পৌঁছার একটা রেকর্ডই করে ফেলেছিলেন তিনি।

‘তুই বড্ড বেশি কথা বলিস, বেশি কথা বলিস বলেই কাজের কাজ কিছু পারিস না, কথা কম বলে নিজের কাজটা করলে তোর মতো ছাত্রের থার্ড ক্লাস পাওয়ার আশংকা থাকতো না’- বন্ধুদের সামনে ভগ্নিপতির এমন চাছাছোলা মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে ফারুক ভাই তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি পরবর্তী সাত দিন কোনো কথা বলবেন না কারোর সাথে। শেষ পর্যন্ত তিনি তা-ই করেছিলেন। গলায় ঝুলিয়েছিলেন একটা প্ল্যাকার্ড- ‘আমি মৌনব্রত পালন করছি,দয়া করে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।’ এই সাতদিন তিনি ঘরের দরোজা বন্ধ করে পড়াশোনা করেছেন, কখনো ঘর থেকে বের হয়েছেন বাসার পাশের মুদি দোকান থেকে সিগারেট কেনার জন্য। তখন ব্যবহার করেছেন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে না কুলালে স্লিপে লিখে কাজ সেরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা অবাক করা রেজাল্ট করেছিলেন তিনি।

ফারুক ভাইয়ের মতো কিছু একটা করতে পারলে কিয়ারাকে বোঝানো যেত আমার ব্যক্তিত্ব কতটুকু বিকশিত হয়েছে। এই যে আজ ওর ঘণ্টা দুয়েকের সঙ্গ’র জন্য পাঁচ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি করে ওর কাছে যাচ্ছি তাতে কি আমার সম্পর্কে ওর মনোভাব কিছুটা চেঞ্জ হবে?- আমি ভাবি।

এসি কামরাটা এতোক্ষণ চুপচাপ ছিল। একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে অনেক লোক ঢুকে গেল। কামরাটা কোলাহল মুখরিত হয়ে উঠেছে। নতুন যাত্রীদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো তারা জেলাশহরে যাচ্ছে কোনো রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে। নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে কথা বলছে।

সিটে বসা কোনো একজন যাত্রী বোধহয় নতুন যাত্রীদের কাউকে মনে করিয়ে দিয়েছিল এটা এসি ক্লাস। তাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে সেই লোক। উত্তপ্ত কণ্ঠে বলেছে, “রাহুইন আফনের এসি ক্লাস। বাইশ মাস জেল খাটছি বিনা দোষে। এসি মারা লোকরা হাসিনারে খেদায় নাই, আমরাই খেদাইছি।” তার সঙ্গী সাথীরাও সরব হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী লোকটা পিন দিয়ে চুপসানো বেলুনের মতো চুপসে যায়। একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠছে দেখেই অন্য সিটে বসা একজন যাত্রী উত্তপ্ত যুবকের দিকে তাকিয়ে যথেষ্ট দরদ দিয়ে বলেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে। আসলেই আপনারা অনেক স্যাক্রিফাইস করেছেন, করছেন। দল বেঁধে সবাই কোথায় যাচ্ছেন? কোনো মিটিং আছে, না?”

ওই যুবক ও তার সঙ্গীরা আলাপ জুড়ে দিয়েছে ভদ্রলোকের সঙ্গে।

আমি আবার ফিরে আসি নিজের জগতে। ওই যুবকটিকে আমার হিংসা হয়। কথায় কি তেজ আর ঝাঁঝ! ও যদি হয় চৈত্রের কাঠফাটা রোদে পড়ে থাকা তাঁতানো কাঠের টুকরো, যেখানে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ঘষলেই আগুন জ্বলবে, আমি শীতে ঝরে পড়া নেতানো পাতা। কিয়ারা ঠিক পছন্দ করতো ওই রকম তেজি পুরুষ।

নাহ, নিজেকে ছোট ভাবার রোগে পেয়ে বসেছে আমাকে। আমার হাই স্কুলের আখতার স্যারের কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, অ্যাই, তুই কুমা কিসের?

চলে এসেছি কিয়ারার স্টেশনে। আমাকে দেখে ও কী রকম সারপ্রাইজড হবে- ভেবে আমি অন্য রকম পুলক বোধ করি। অদ্ভুত,আজ একবারও ও নক করেনি। কল দিলে অবশ্য আমারই অসুবিধা হতো। আমার মৌনব্রত। আচ্ছা, যদি গিয়ে দেখি ও স্টেশনে নেই? চলে গেছে কোনো ট্যুরে? আগে একটু জানালেই বোধহয় ভালো হতো- ভাবতে ভাবতে আমি স্টেশন থেকে অটো নিয়ে এগোই কিয়ারার অফিসের দিকে। পণ করেছি কিয়ারার সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত মুখ খুলবো না। মুখ না খুলে কীভাবে কিয়ারার অফিসে গেলাম সে এক মহা বিতং!

কিয়ারা অফিসেই আছে। দরোজা বন্ধ। তার চেম্বারের সামনে দাঁড়ানো অফিস সহকারীকে একটা কাগজে নাম লিখে বোঝাই ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছি। সে জানায় ম্যাডাম জরুরি কথা বলছেন ঢাকা থেকে আসা তার গেস্টের সাথে। ইশারায় বোঝাই ম্যাডামকে স্লিপটা পৌঁছাতে।

পিয়ন ভেতরে যায় আর সাথে সাথেই আমাকে দরোজা খুলে ভেতরে যেতে বলে।

কিয়ারা আমাকে দেখেই বলে, “হোয়াট আ সারপ্রাইজ!”

কিন্তু যে উচ্ছ্বাস আমি আশা করেছিলাম কিয়ারার মধ্যে, সেটা দেখি না। সচেতন সংযত কিয়ারা।

কিয়ারার পাশের চেয়ার বসে আছে আমার বয়সী এক সুদর্শন যুবক। সে আমাকে দেখে মনে হয় ভ্রু কুঞ্চিত করে।

আমি মুখ খোলার আগেই কিয়ারা আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় সুবেশসধারী যুবকের সাথে, “আমার ইউনির ক্লাসমেট দীপু। আর দীপু, এ হচ্ছে শাওন। আমার ফিয়াঁসে। তোমাদের বোধহয় বলিনি ওর কথা। ও কাল এসেছে।”

এ অবস্থায় একজন বাকপ্রতিবন্ধি মানুষ কী করতো আমি জানি না। হয়তো অদ্ভুত ভাষায় হাত পা নাড়িয়ে কিছু বলতো। আমার একবার মনে হয় আমিও তেমন কিছু করি। স্থির দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকি কিয়ারার দিকে। তার সেই চেনা চোখের দিকে। আকাশে ওড়া এক খ- কালো মেঘ যেন ঊর্ধ্বমুখী টানেল হয়ে নেমে এসেছে ঘরের ভেতর। আর আমি ঢুকে গেছি সেই টানেলের ভেতর। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। নিজেকে বের করে আনি সেই টানেল থেকে। পর্দানশিন নারীর কাছে পরপুরুষের মতো নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হয়।

সারপ্রাইজ দিতে এসে এতো বড় সারপ্রাইজ পাবো তা আমার কল্পনাতেও ছিল না।

ইংরেজিতে যাকে বলে, আই কালেক্ট মাইসেলফ। এক টুকরো হাসি আনি মুখে। শাওনের দিকে হাত বাড়াই, হাতের মুঠোয় তার হাত নিয়ে যতেœ লালিত নিজের মৌনতা ভাঙি, বলি, “বাহ, চমৎকার।”

আমার জীবনানন্দ পড়া কিয়ারা নিশ্চয়ই তখন মনে মনে বলেছে, “ধরা যাক দু’য়েকটা ইঁদুর এবার।”

back to top