alt

সাময়িকী

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

মনজুর শামস

: বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

আমজাদ হোসেন। বর্ষিয়ান বাম রাজনীতিক। মাঙ্গলিক ভাবনা আর সমাজ বিশ্লেষক বহু গ্রন্থ প্রণেতা। অনুসন্ধানী সাংবাদিক। এক সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো এখনো অনেক গবেষকের সহায়ক উপচার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পথ দেখিয়েছিল সাপ্তাহিক বিচিত্রাই। ২০২৪ সালে ৮২ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছে তার অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’। ২৩টি ভাষা-উপভাষার ১৮৬টি ভিন্ন ভাষার কবিতায় সজ্জিত গ্রন্থটি আগ্রহী পাঠকের জন্য খুলে দিয়েছে গভীর মনন চর্চার এক বিরল সুযোগ।

ভাষা-উপভাষাা ২৩টি হলেও দেশের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এক ইংরেজি ভাষা থেকেই তিনি অনুবাদ করেছেন চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, চিলি, জাপান, ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, নিকারাগুয়া, ম্যাক্সিকো, লেবানন, কঙ্গো, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিস্তিন, ইরান, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি ইত্যাদি দেশের কবিতা। আমজাদ হোসেন এই কাব্যগ্রন্থে যে ২৩টি ভাষা-উপভাষার কবিতা অনুবাদ করেছেন তা হচ্ছে : ১) সংস্কৃত, ২) পালি, ৩) প্রাকৃত, ৪) মৈথিলী (এটি একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, ভারতের বিহার এবং নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় তেরাই এলাকায় এ ভাষা প্রচলিত), ৫) অবধি বা আওয়াধী (দেবনাগরী লিপিতে লিখিত এ ভাষা ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অবোধ অঞ্চল এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের ভাষাতত্ত্ব জরিপ পরিচালনাকারী জর্জ আব্রাহাম এটিকে পূরবী হিন্দি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছিলেন।), ৬) অসমিয়া, ৭) ব্রজভাষা বা দেহাতি জবান (এটি একটি পশ্চিমা হিন্দুস্থানি ভাষা, যা হিন্দি ভাষার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১৯ শতকে হিন্দুস্থানের খারিবলিতে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন হয়।). ৮) খড়ীবোলী (পৃষ্ঠা ৬৪-তে ‘শ্রীধর পাঠক’ কবিতাটি খড়ীবোলী ভাষা থেকে অনূদিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত ভাষাটি খড়ি বোলি হবে, যা খড়ি, দেহলবী ও কৌরবী নামেও প্রচলিত একটি মর্যাদাপূর্ণ হিন্দুস্থানি উপভাষা। এই উপভাষা থেকেই হিন্দি ও উর্দু ভাষার উৎপত্তি।), ৯) হিন্দি, ১০) নেপালি, ১১) চর্যাপদ, ১২) বড়– চ-ীদাস, ১৩) ব্রজভাষা ও পূর্বীবোলী (মিশ্রণ) [পূর্বীবোলী নামে কোনো ভাষা বা উপভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।) ১৪) পূর্বী হিন্দি (কোসলী ভাষা) ব্রজভাষা ও অবধি মিশ্রণ [কোসলী ভাষা : এটি মূলত সম্বলপুরী ভাষা। সম্বলপুরী ভারতের পশ্চিম ওড়িশায় প্রচলিত একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। পশ্চিমা ওড়িয়া নামে এটি পরিচিত। এ ছাড়া সম্প্রতি এটি কোসলী (কোসলি. কোশল ও কোশলি) নামে জনপ্রিয়; কিন্তু নামটি বিতর্কিত শব্দ হিসেবে পরিচিত, যা প্রাচীন কোশল রাজ্যের নামের সঙ্গে সংঘর্ষে আকৃষ্ট করে, যার বিস্তৃত অঞ্চল বর্তমানের সম্বলপুর।), ১৫) হিন্দি ও রাজস্থানি মিশ্রিত, ১৬) উর্দু, ১৭) মারাঠি, ১৮) গুজরাটি. ১৯) মিশ্র রাজস্থানি ও ব্রজভাষা, ২০) ইংরেজি, ২১) আরবি, ফারসি ও ব্রজভাষার মিশ্রণ, ২২) ওড়িয়া এবং ২৩) হিন্দুস্থানি।

আমজাদ হোসেনের অনুবাদ সাবলীল। ভাষায় কোনো আড়ষ্টতা পাঠ-অনিহ করে তোলে না। তবে কোনো কোনো কবিতায় বা কাব্য উদ্ধৃতিতে সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সেসব অসঙ্গতির ব্যাপারেও অবশ্য অনুবাদক তার ভূমিকায় অকাট্য যুক্তি তুলে ধরেছেন : ‘খাতা অনুসরণ করা হয়েছে, তাই প্রণালিবদ্ধভাবে গোছানো সম্ভব হয়নি, আমি যা পড়ি তার উদ্ধৃতি রাখি, কখনও কিছু, যদি অন্য ভাষা হয়, অনুবাদও করে রাখি- এখানে তাই প্রতিফলিত হয়েছে।’

কোন খাতা? এই খাতাই হচ্ছে ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটির আকর। দুটি খাতা। আর এই খাতা দুটির আবিষ্কার অনেকটা চর্যাপদ আবিষ্কারের মতোই রোমাঞ্চকর। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যেমন নেপালের রাজ দরবারের রয়াল লাইব্রেরিতে পুঁথি সংগ্রহে গিয়ে ১৯০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দালিলিক আবিষ্কার করেছিলেন বাংলা ভাষায় লেখা চর্যাচর্যবিনিশ্চয় পুঁথি, কিছুটা সে-রকমই রোমাঞ্চকর এই খাতা আবিষ্কার।

অনুবাদক আমজাদ হোসেনের ভূমিকা থেকেই জেনে নেয়া যাক সেই পুলক জাগানিয়া পা-ুলিপি খাতা আবিষ্কারের ঘটনাটি : ‘‘অনুবাদ করা যে খাতাটার কথা আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম তা গোচরে এনে দিল আমার ভ্রাতুষ্পুত্র পিপুল। ... আমি সে খাতা পেয়ে নিজেও অবাক। নানা কবিতার অনুবাদ। এগুলো ছাপার জন্য করা হয়নি। ‘বিদেশী কবিতা’ নামে একটি খাতাও পাওয়া গেল- যা অনুবাদ করা হয়েছিল প্রকাশের জন্য- তখন আমি কলেজে পড়ি।’’

এক মলাটে এতো ভাষার, এতো দেশের, এতো মহান কবির কবিতার এমন দুর্লভ অনুবাদ-সঞ্চিতির গরিমা বেশ কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে মুদ্রণ প্রমাদ এবং যতিচিহ্ন বিভ্রাট। সামান্য এসব ত্রুটি সত্ত্বেও ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’ বাংলা কাব্যপ্রেমীদের এক অনাবিল পাঠানন্দের শুলুক সন্ধান দেবে। বইটিতে মানবসভ্যতার সর্বপ্রাচীন হিসেবে গণ্য মেসোপটেমীয় মহাকাব্য গিলগামেশ; হোমর রচিত সুপ্রাচীন ওডিসি ও ইলিয়ড থেকে অনুবাদ যেমন আছে, তেমনি আছে ঋগে¦দ-মহাভারত-রামায়ণ থেকে বালী¥কি-কালিদাস-বাণভট্ট থেকে; জন মিল্টন, গ্যোতে. ভার্জিল, নেরুদা, মায়াকোভস্কি, মাহমুদ দারবিশ থেকে যেমন আছে তেমনি আছে রুমি-হাফিজ-গালিব-বাহাদুর শাহ জাফর- মহাকবি ইকবাল থেকেও। আর অবশ্যই আছে কার্ল মার্কস-মাও সেতুং-হো চি মিনের কবিতার অনুবাদ। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন নামহীন কবির কবিতাও রয়েছে।

বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন বলেই বোধ করি যেসব কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন, সেসবের মর্মে ঢুকেই তা করেছেন। ১৯৪২ সালে যশোরে জন্ম নেয়া আমজাদ হোসেন মেট্রিকুলেশন করেন যশোর জিলা স্কুল থেকে। এরপর যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ (সরকারি) থেকে আইএ বাংলা সম্মানসহ স্তাতক ডিগ্রি আর্জন করেন। অনার্স পরীক্ষা দেন যশোর সেন্ট্রাল জেল এবং রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে থাকা অবস্থায়। কলেজে পড়ার সময়েই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের শুরুর দিকে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টিতে। তিনি প্রথমবার জেলে যান ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান রক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়ে। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে পালি ভাষা ও সাহিত্য, মহাকবি কালিদাস ও ন্ট্যকার ভবভূতি, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, শকুন্তলা, মহাকবি ইকবাল, উর্দু ভাষা ও সাহিত্য। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত প্রন্থ : বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি (১৯৯৫), বাঙালির ঐতিহ্য বাঙালির ভবিষ্যৎ (১৯৯৫), বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল (১৯৯৬), বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা (১৯৯৭, ২০২৪), উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতি (২০০০), বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস (২০০২), নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন (২০০২), বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস, ১ম ও ২য় খ- ( ২০০৩), বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১ম খ- (২০২৩) ও ২য় খ- (২০২৪)।

তার অনুবাদ যে কী প্রাঞ্জল ও সাবলীল বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থ থেকে ‘বর্ণনা’ কবিতাটিই তা বলে দেয়- ‘পশ্চিমসমুদ্রে ¯œানে নামলো রাত্রি/কারণ চক্রবাক মিথুনের/ বিরহ অসহ্য তার কাছে।/পদ্ম মুখ উঁচু করলো।/বনে বনে পাখিদের ঘুম ভেঙে গেল/পাতা থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতো/...’। ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মেরে মিলনেওয়ালে কবিতা পড়ে তো মনেই হয়নি এটি অনুবাদ কবিতা পড়লাম : ‘ওই আমার দুঃখের ঘরের দরজা খুলে গেল/আমার অতিথিরা সবাই এসে গেছে/সন্ধ্যাও এসে গেছে তার আপন পথে/মনোকষ্টের জন্য পাটি পেতে দেওয়ার জন্য/ওই যে রাতও এসে গেছে/...’।

ইংরেজি সাহিত্যের কিছু ক্লাসিক কবিতাও অনুবাদ করেছেন আমজাদ হোসেন। এসবের অন্যতম জন মিল্টনের ‘স্বর্গ উদ্যানে আদম’ কবিতাটি।

ফিলিস্তিনের বিখ্যাত কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতা অনুবাদ করেছেন তিনি হৃদয়ের টানে। মাহমুদ দারবিশের ‘একজন মানুষের প্রতি’ কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলো সে প্রমাণই দেয় : ‘শিকল দিয়ে মুখ বন্ধ করা হলো/তাকে বাঁধা হলো এক পাথরের সাথে/এরপর তারা বললো, তুই একজন খুনি।/তার মুখের খাদ্য কেড়ে নেওয়া হলো/পোশাক আর পরিচয়পত্রও/তাকে ছুড়ে ফেলা হলো মৃত্যুকূপে/এরপর তারা বললো, তুই বেটা একটা ছিঁচকে।...’।

এই বইটিকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছে শেষ ভাগের টীকা-টিপ্পনী। উৎসাহী পাঠকের কৌতূহল মেটানোর পাশাপাশি তা তাদের জ্ঞানের পরিধিও বাড়াবে নিঃসন্দেহে।

বর্ষিয়ান রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’ অনুবাদগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জনান্তিক। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। ২৯৫ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য ৬০০ টাকা।

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

পথকবিতা: লোকবাংলার সাধারণ কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

ক্ষমতার ভাষার বিপরীতে মাতৃভাষার সাধনা

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

tab

সাময়িকী

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

মনজুর শামস

বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

আমজাদ হোসেন। বর্ষিয়ান বাম রাজনীতিক। মাঙ্গলিক ভাবনা আর সমাজ বিশ্লেষক বহু গ্রন্থ প্রণেতা। অনুসন্ধানী সাংবাদিক। এক সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো এখনো অনেক গবেষকের সহায়ক উপচার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পথ দেখিয়েছিল সাপ্তাহিক বিচিত্রাই। ২০২৪ সালে ৮২ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছে তার অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’। ২৩টি ভাষা-উপভাষার ১৮৬টি ভিন্ন ভাষার কবিতায় সজ্জিত গ্রন্থটি আগ্রহী পাঠকের জন্য খুলে দিয়েছে গভীর মনন চর্চার এক বিরল সুযোগ।

ভাষা-উপভাষাা ২৩টি হলেও দেশের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এক ইংরেজি ভাষা থেকেই তিনি অনুবাদ করেছেন চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, চিলি, জাপান, ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, নিকারাগুয়া, ম্যাক্সিকো, লেবানন, কঙ্গো, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিস্তিন, ইরান, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি ইত্যাদি দেশের কবিতা। আমজাদ হোসেন এই কাব্যগ্রন্থে যে ২৩টি ভাষা-উপভাষার কবিতা অনুবাদ করেছেন তা হচ্ছে : ১) সংস্কৃত, ২) পালি, ৩) প্রাকৃত, ৪) মৈথিলী (এটি একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, ভারতের বিহার এবং নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় তেরাই এলাকায় এ ভাষা প্রচলিত), ৫) অবধি বা আওয়াধী (দেবনাগরী লিপিতে লিখিত এ ভাষা ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অবোধ অঞ্চল এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের ভাষাতত্ত্ব জরিপ পরিচালনাকারী জর্জ আব্রাহাম এটিকে পূরবী হিন্দি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছিলেন।), ৬) অসমিয়া, ৭) ব্রজভাষা বা দেহাতি জবান (এটি একটি পশ্চিমা হিন্দুস্থানি ভাষা, যা হিন্দি ভাষার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১৯ শতকে হিন্দুস্থানের খারিবলিতে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন হয়।). ৮) খড়ীবোলী (পৃষ্ঠা ৬৪-তে ‘শ্রীধর পাঠক’ কবিতাটি খড়ীবোলী ভাষা থেকে অনূদিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত ভাষাটি খড়ি বোলি হবে, যা খড়ি, দেহলবী ও কৌরবী নামেও প্রচলিত একটি মর্যাদাপূর্ণ হিন্দুস্থানি উপভাষা। এই উপভাষা থেকেই হিন্দি ও উর্দু ভাষার উৎপত্তি।), ৯) হিন্দি, ১০) নেপালি, ১১) চর্যাপদ, ১২) বড়– চ-ীদাস, ১৩) ব্রজভাষা ও পূর্বীবোলী (মিশ্রণ) [পূর্বীবোলী নামে কোনো ভাষা বা উপভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।) ১৪) পূর্বী হিন্দি (কোসলী ভাষা) ব্রজভাষা ও অবধি মিশ্রণ [কোসলী ভাষা : এটি মূলত সম্বলপুরী ভাষা। সম্বলপুরী ভারতের পশ্চিম ওড়িশায় প্রচলিত একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। পশ্চিমা ওড়িয়া নামে এটি পরিচিত। এ ছাড়া সম্প্রতি এটি কোসলী (কোসলি. কোশল ও কোশলি) নামে জনপ্রিয়; কিন্তু নামটি বিতর্কিত শব্দ হিসেবে পরিচিত, যা প্রাচীন কোশল রাজ্যের নামের সঙ্গে সংঘর্ষে আকৃষ্ট করে, যার বিস্তৃত অঞ্চল বর্তমানের সম্বলপুর।), ১৫) হিন্দি ও রাজস্থানি মিশ্রিত, ১৬) উর্দু, ১৭) মারাঠি, ১৮) গুজরাটি. ১৯) মিশ্র রাজস্থানি ও ব্রজভাষা, ২০) ইংরেজি, ২১) আরবি, ফারসি ও ব্রজভাষার মিশ্রণ, ২২) ওড়িয়া এবং ২৩) হিন্দুস্থানি।

আমজাদ হোসেনের অনুবাদ সাবলীল। ভাষায় কোনো আড়ষ্টতা পাঠ-অনিহ করে তোলে না। তবে কোনো কোনো কবিতায় বা কাব্য উদ্ধৃতিতে সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সেসব অসঙ্গতির ব্যাপারেও অবশ্য অনুবাদক তার ভূমিকায় অকাট্য যুক্তি তুলে ধরেছেন : ‘খাতা অনুসরণ করা হয়েছে, তাই প্রণালিবদ্ধভাবে গোছানো সম্ভব হয়নি, আমি যা পড়ি তার উদ্ধৃতি রাখি, কখনও কিছু, যদি অন্য ভাষা হয়, অনুবাদও করে রাখি- এখানে তাই প্রতিফলিত হয়েছে।’

কোন খাতা? এই খাতাই হচ্ছে ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটির আকর। দুটি খাতা। আর এই খাতা দুটির আবিষ্কার অনেকটা চর্যাপদ আবিষ্কারের মতোই রোমাঞ্চকর। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যেমন নেপালের রাজ দরবারের রয়াল লাইব্রেরিতে পুঁথি সংগ্রহে গিয়ে ১৯০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দালিলিক আবিষ্কার করেছিলেন বাংলা ভাষায় লেখা চর্যাচর্যবিনিশ্চয় পুঁথি, কিছুটা সে-রকমই রোমাঞ্চকর এই খাতা আবিষ্কার।

অনুবাদক আমজাদ হোসেনের ভূমিকা থেকেই জেনে নেয়া যাক সেই পুলক জাগানিয়া পা-ুলিপি খাতা আবিষ্কারের ঘটনাটি : ‘‘অনুবাদ করা যে খাতাটার কথা আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম তা গোচরে এনে দিল আমার ভ্রাতুষ্পুত্র পিপুল। ... আমি সে খাতা পেয়ে নিজেও অবাক। নানা কবিতার অনুবাদ। এগুলো ছাপার জন্য করা হয়নি। ‘বিদেশী কবিতা’ নামে একটি খাতাও পাওয়া গেল- যা অনুবাদ করা হয়েছিল প্রকাশের জন্য- তখন আমি কলেজে পড়ি।’’

এক মলাটে এতো ভাষার, এতো দেশের, এতো মহান কবির কবিতার এমন দুর্লভ অনুবাদ-সঞ্চিতির গরিমা বেশ কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে মুদ্রণ প্রমাদ এবং যতিচিহ্ন বিভ্রাট। সামান্য এসব ত্রুটি সত্ত্বেও ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’ বাংলা কাব্যপ্রেমীদের এক অনাবিল পাঠানন্দের শুলুক সন্ধান দেবে। বইটিতে মানবসভ্যতার সর্বপ্রাচীন হিসেবে গণ্য মেসোপটেমীয় মহাকাব্য গিলগামেশ; হোমর রচিত সুপ্রাচীন ওডিসি ও ইলিয়ড থেকে অনুবাদ যেমন আছে, তেমনি আছে ঋগে¦দ-মহাভারত-রামায়ণ থেকে বালী¥কি-কালিদাস-বাণভট্ট থেকে; জন মিল্টন, গ্যোতে. ভার্জিল, নেরুদা, মায়াকোভস্কি, মাহমুদ দারবিশ থেকে যেমন আছে তেমনি আছে রুমি-হাফিজ-গালিব-বাহাদুর শাহ জাফর- মহাকবি ইকবাল থেকেও। আর অবশ্যই আছে কার্ল মার্কস-মাও সেতুং-হো চি মিনের কবিতার অনুবাদ। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন নামহীন কবির কবিতাও রয়েছে।

বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন বলেই বোধ করি যেসব কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন, সেসবের মর্মে ঢুকেই তা করেছেন। ১৯৪২ সালে যশোরে জন্ম নেয়া আমজাদ হোসেন মেট্রিকুলেশন করেন যশোর জিলা স্কুল থেকে। এরপর যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ (সরকারি) থেকে আইএ বাংলা সম্মানসহ স্তাতক ডিগ্রি আর্জন করেন। অনার্স পরীক্ষা দেন যশোর সেন্ট্রাল জেল এবং রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে থাকা অবস্থায়। কলেজে পড়ার সময়েই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের শুরুর দিকে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টিতে। তিনি প্রথমবার জেলে যান ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান রক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়ে। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে পালি ভাষা ও সাহিত্য, মহাকবি কালিদাস ও ন্ট্যকার ভবভূতি, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, শকুন্তলা, মহাকবি ইকবাল, উর্দু ভাষা ও সাহিত্য। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত প্রন্থ : বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি (১৯৯৫), বাঙালির ঐতিহ্য বাঙালির ভবিষ্যৎ (১৯৯৫), বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল (১৯৯৬), বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা (১৯৯৭, ২০২৪), উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতি (২০০০), বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস (২০০২), নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন (২০০২), বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস, ১ম ও ২য় খ- ( ২০০৩), বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১ম খ- (২০২৩) ও ২য় খ- (২০২৪)।

তার অনুবাদ যে কী প্রাঞ্জল ও সাবলীল বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থ থেকে ‘বর্ণনা’ কবিতাটিই তা বলে দেয়- ‘পশ্চিমসমুদ্রে ¯œানে নামলো রাত্রি/কারণ চক্রবাক মিথুনের/ বিরহ অসহ্য তার কাছে।/পদ্ম মুখ উঁচু করলো।/বনে বনে পাখিদের ঘুম ভেঙে গেল/পাতা থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতো/...’। ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মেরে মিলনেওয়ালে কবিতা পড়ে তো মনেই হয়নি এটি অনুবাদ কবিতা পড়লাম : ‘ওই আমার দুঃখের ঘরের দরজা খুলে গেল/আমার অতিথিরা সবাই এসে গেছে/সন্ধ্যাও এসে গেছে তার আপন পথে/মনোকষ্টের জন্য পাটি পেতে দেওয়ার জন্য/ওই যে রাতও এসে গেছে/...’।

ইংরেজি সাহিত্যের কিছু ক্লাসিক কবিতাও অনুবাদ করেছেন আমজাদ হোসেন। এসবের অন্যতম জন মিল্টনের ‘স্বর্গ উদ্যানে আদম’ কবিতাটি।

ফিলিস্তিনের বিখ্যাত কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতা অনুবাদ করেছেন তিনি হৃদয়ের টানে। মাহমুদ দারবিশের ‘একজন মানুষের প্রতি’ কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলো সে প্রমাণই দেয় : ‘শিকল দিয়ে মুখ বন্ধ করা হলো/তাকে বাঁধা হলো এক পাথরের সাথে/এরপর তারা বললো, তুই একজন খুনি।/তার মুখের খাদ্য কেড়ে নেওয়া হলো/পোশাক আর পরিচয়পত্রও/তাকে ছুড়ে ফেলা হলো মৃত্যুকূপে/এরপর তারা বললো, তুই বেটা একটা ছিঁচকে।...’।

এই বইটিকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছে শেষ ভাগের টীকা-টিপ্পনী। উৎসাহী পাঠকের কৌতূহল মেটানোর পাশাপাশি তা তাদের জ্ঞানের পরিধিও বাড়াবে নিঃসন্দেহে।

বর্ষিয়ান রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’ অনুবাদগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জনান্তিক। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। ২৯৫ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য ৬০০ টাকা।

back to top