alt

সাময়িকী

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

নূর-ই আলম সিদ্দিকী

: বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫

সপ্তম-অষ্টম শতকের বাংলা সাহিত্যের মহিলা কবি কুক্করী পা। তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে ১৬ শতকের মাঝখানে আবির্ভূত হন কবি চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬৫০)। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চন্দ্রাবতী প্রথম সার্থক মহিলা কবি। ১৫-১৬ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী কিশোরগঞ্জ জেলায় জন্ম তাঁর। বাবা সে সময়ের বিখ্যাত ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাস। সপ্তদশ শতকের লোকো কবি চন্দ্রাবতী পালাকার ও রামায়ণ রচিয়তা হিসেবে সমধিক খ্যাত। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র কাহিনির মধ্যে মিশে আছে সমাজ প্রতিবেশ এবং কবির প্রাতিস্বিক কাব্যভাবনা, ও প্রেম-বিরহ উপাখ্যান। শিল্পী মাত্রই ব্যক্তি চেতনায় অনুভূত সামাজিক ঘটনাবলি নিজের সৃষ্টিতে প্রকাশ করেন। সে আলোয়, ‘ময়মনসিংহের গীতিকাগুলো বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সংযোজন।’১

মধ্যযুগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীকে মনে করা হতো গৃহপণ্য। সময় প্রবাহে এ অন্ধকার সময়ে প্রতিভাবান কবি চন্দ্রাবতীর আগমনে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৯১৩ সনে কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬) ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তারপর থেকে চন্দ্রাবতী নামটি কিংবদন্তি হয়ে যায়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রবতী’র ‘রামায়ণ’ প্রকাশ করেন। ভাটি বাংলার মানুষের জীবন জীবিকা সুখ-দুঃখ নিয়ে চন্দ্রাবতী রচনা করেন রামায়ণ, দস্যু কেনারামের পালা, ও মলুয়া লোকগাথা। ১৩২০ বঙ্গাব্দে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় ফাল্গুন সংখ্যায় চন্দ্রকুমার দে চন্দ্রাবতী সম্পর্কে বলেন, ‘বনে অনেক সময় এমন ফুল ফোটে, রাজোদ্যানেও তাহার তুলনা মেলে না, সে বনফুলের সৌন্দর্য কেহ উপলব্ধি করিতে, কিংবা সে-সৌরভ কেহই ভোগও করিতে পারে না, বনে ফুল বনে ফুটে, বনে শুকায়। চন্দ্রাবতী এইরূপ একটি বনফুল, ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে, একসময় এই সুরভী কুসুম ফুটিয়া ছিল।’২

একশো বছর আগে ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহের কাজে হাত দেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় চার খ-ে এই গীতিকা সম্পাদিত হয়। ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ ছিল এ ক্রমধারার প্রথম খ-। এই গীতিকার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব গারো পাহাড়ের অববাহিকায় অবস্থিত ভাটি অঞ্চলের সংগ্রাম মুখর মানুষ। হাওড়-বাঁওর ও নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-পরিণয়, বিরহ-বেদনা ও দ্রোহের গাথাভিত্তিক পালা। উল্লেখ্য সে সময়ের গ্রাম্য কবিরা সীমাহীন মমতা আর সৃষ্টি কুশলতায় মানুষের যাপিত জীবনের বর্ণিল-বিবর্ণ জীবনবাস্তবতাকে গীতিকার ক্যানভাসে রূপদান করেন। তাঁদের রচিত পালায় সমাজের শিষ্ট মানুষের উপস্থিতি নেই। সঙ্গত কারণে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্র জনদের কাছে এ প্রান্তিক মানুষের জীবন চর্চার বাস্তবরূপায়ণ অবজ্ঞার শিকার হয়।

সাহিত্যগুণসম্পন্ন পালাগুলো মূল্যায়ন ও বিচার করে বিরূপ সমালোচকদের প্রতি ইঙ্গিত করে ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, ‘তাঁহারা হয়তো বড় তালমানের সন্ধান জানিতেন না। কিন্তু তাহাদের হৃদয় অফুরন্ত কারুণ্য ও কবিত্বের উৎসস্বরূপ ছিল। যাঁহারা লিখিয়াছিলেন তাঁহাদের অশ্রু ফুরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু এই সকল কাহিনীর শ্রোতাদের অশ্রু কখনও ফুরাইবে বলিয়া মনে হয় না ‘৩ গীতিকার পালাগুলোর মধ্যে জান্তবজীবন বোধের অনিবার্য আকুতির প্রতি গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খ-ে লেখেন, ‘ময়মনসিংহ-গীতিকা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য। ইহাদের মধ্যে মানুষের হৃদয়ানুভূতি,মানুষের সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য এই তিন উপাদানের সমন্বয়ে এক সজীব ব্যাঞ্জনাময় কবিত্ব-স্বর্ণ রচিত হয়েছে।’

মধ্য যুগে সাহিত্যের উপাদান ছিল পুরাণ ও ধর্মাশ্রিত। একটু মনোনিবেশ করলে ময়মনসিংহ গীতিকার পালার কাহিনিতে পুরাণের ব্যবহার সামান্যই দৃশ্যমান হয়। অথচ প্রতিটি পালায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ব্রাত্যজনের প্রেম-প্রণয়,বিচ্ছেদ-কাতরতার রোমান্টিক প্রতিবেশের অভিযোজন অসামান্য। গীতের ভেতরে প্রেমের যে পিয়াসী অভিনিবেশ তা একেবারে সাম্প্রতিক। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেন, ‘সংগৃহীত পালাগানের মধ্যে যেগুলিতে বাস্তব প্রেম-প্রণয়ের কথা বলা হয়েছে, কাব্যের দিক থেকে সেগুলি উৎকৃষ্ট যেমন- মহুয়া, মলুয়া প্রভৃতি। শুধু প্রেমের জন্য জাঁতিপাতি বিলিয়ে দেওয়া, উচ্চবর্ণ কর্তৃক নিম্ন-বর্ণের কন্যাকে প্রেয়সীরূপে গ্রহণ করে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া, এমনকি বেদিয়ার সাথে ব্রাহ্মণ পুত্রের বিবাহ হিন্দু মুসলমানের মধ্যেও প্রেমের চিত্রাংকন প্রভৃতি ঘটনা অশিক্ষিত কবিরা বিস্ময়কর নিপুণতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন।’

ড.দীনেশ চন্দ্র সেন সংগৃহীত পালাসমূহের সম্পাদিত সংকলনের নাম ময়মনসিংহ গীতিকা। যেখানে দ্বিজ কানাই, দ্বিজ ঈশান, নয়নচাঁদ ঘোষ ও মনসুর বয়াতিসহ ভিন্ন দশজন পালাগান রচিয়তার পালা স্থান পেয়েছে। এ দশজনের একজন হলেন চন্দ্রাবতী। আর তাঁকে ষোড়শ শতকের বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি বলে বিদ্বজ্জনেরা অভিমত দিয়েছেন। মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা ও দেওয়ান-ভাবনা এই তিনটি পালার রচয়িতা চন্দ্রাবতী। ‘নয়নচাঁদ ঘোষ চন্দ্রাবতীর জীবন কথা নিয়ে ময়মনসিংহ গীতিকার চন্দ্রাবতী কাব্য’৪ রচনা করেন। ব্যক্তিজীবনে প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে চন্দ্রাবতী আজীবন কৌমার্য থাকতে মনস্থির করেন। পদ্মপুরাণের কবি বাবা দ্বিজ বংশীদাস কন্যার মনোভাব জেনে তাকে রামায়ণ লিখতে পরামর্শ দেন-। চন্দ্রাবতীর কথায়-

‘অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে

শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।’

পিতার আদেশে অনুগত হয়ে চন্দ্রাবতী তিন খ-ে রামায়ণ রচনা করেন। নিজের রচিত অসমাপ্ত রামায়ণে চন্দ্রাবতীর কৃতিত্ব হলো তাঁর কাব্যে আদিকবি ‘বাল্মীকি’ কিংবা পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি ‘কৃত্তিবাস ওঝার’ কোনো প্রভাবে পড়েনি। তিন খ-ে মোট উনিশটি অধ্যায়ে রচিত কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ কাহিনি। উল্লেখ্য চন্দ্রাবতী তাঁর ‘রামায়ণে’ কবি বাল্মীকি কিংবা কৃত্তিবাসের রামায়ণের আঙ্গিক গঠন কৌশলকেও আমলে নেননি। আবার চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে, রামচরিত্রের বদলে সীতা চরিত্রটিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রেখে চিত্রিত করেছেন। ফলে সীতার দুঃখের কাহিনি বর্ণনায় নারীর প্রতি পুরুষের অবজ্ঞার দিকটি স্পষ্ট করে এঁকেছেন। ‘পুরুষতান্ত্রিক প্রাধান্যের কাছে নারীরা কীভাবে উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত হয়, কীভাবে তাকে দুঃখের সাগরে নিক্ষেপ করা হয়- সেই ঘটনা তথা কাহিনী উঠে এসেছে চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ‘নারী চোখে নারীর বয়ানে।’৫

রামায়ণ রচনায় কবি চন্দ্রাবতীর কৃতিত্ব চূঁড়া স্পর্শ করেছে। কেননা তাঁর মানস উপলব্ধি পুরাণের পুরুষ চরিত্রের চাতুরি ও ধড়িবাজ ব্যক্তিত্বকে সজোরে আঘাত করেছে। কাব্যের বর্ণনাতেও কবি চন্দ্রাবতী মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। নিজ পুত্রদের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত রামচন্দ্র গর্ভাবস্থায় সীতাকে বনবাসে পাঠায়। রাজ ধর্ম রক্ষার জন্য সীতাকে পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেয়। ফলে নারীর মর্যাদা লাঞ্ছিত ও লুণ্ঠিত হয়। বিষয়টিকে চন্দ্রাবতী আধুনিক কবিদের মতোই স্পষ্ট করে ফুটিয়েছেন কাব্যিক বুননে। রামায়ণে রামচন্দ্র চরিত্রের স্বরূপকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিনি লেখেন-

‘পুড়িবে অযোধ্যা পুরী গো কিছুদিন পরে,

লক্ষ্মীশূন্য হইয়া গো রাজ্য যাবে ছারখারে।

পরের কথা কানে লইলে গো নিজের সর্বনাশ,

চন্দ্রাবতী কহে রামের গো বুদ্ধি হইল নাশ।’

মধ্যযুগের পুরুষ কবিদের পাশে নারী কবি কর্তৃক পুরুষকে এমনভাবে বিদ্ধ করার প্রত্যক্ষ প্রয়াস বড় শ্লাঘার বিষয়। এ মহাকাব্যে শুধু কাহিনি বিন্যাস ও চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণ ঘটেনি, বরং কাব্য কাঠামো নিবিড়ঘন করতে চন্দ্রাবতী পয়ার ও পাঁচালী ছন্দ ব্যবহার করেছেন। একইসঙ্গে বারোমাস্যায় প্রয়োগ করেছেন মঙ্গলকাব্যের মাধুরী। ঠিক এখানেই কবি চন্দ্রাবতীর অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সার্বিক বিচার প্রেক্ষাপটে চন্দ্রাবতী ভাবিকালের দ্যুতি ছড়ানো তেজোদীপ্ত প্রথম কবি। যাঁর কাব্যিক নিবেদন তাই প্রেরণার বাতিঘর এখন তখন ও সর্বক্ষণ।

তথ্যসূত্র :

১.আজিজুল হক, সৈয়দ, ময়মনসিংহ গীতিকা জীবনধর্ম ও কাব্যমূল্য, পৃষ্ঠা: ০১,অবসর প্রকাশন, ঢাকা, ২০২০

২. আহম্মেদ ফাহিম ম-ল, মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর ট্র্যাজিক জীবন, পৃষ্ঠা: ১৪ জাবি, ঢাকা, ২০২০

৩. দত্ত প্রদীপ, শতবর্ষের আলোয় চন্দ্রাবতী, ঢাকা, ২০২৪

৪. পুরকাইত শ্রীনিখিলেশ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন পর্যায়), পৃষ্ঠা: ৩৮০, প্রগতি প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৬৭

৫. অধিকারী সুজয়, মহিলা কবির চন্দ্রাবতীর রামায়ণ, পৃষ্ঠা: ১৫১, প্রতিধ্বনি জার্নাল, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৮

ছবি

ভাঙা ছাদ

ছবি

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

ছবি

বংশধারা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আবুবকর সিদ্দিকের ছোট গল্পে রাজনীতি

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের তুলনামূলক বিচার

ছবি

সমকালীন কাব্যভাষায় কবি শহীদ কাদরী

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

ছবি

‘কবিতার যুবরাজ’ কবি আবুল হাসান

ছবি

মানুষ, প্রকৃতি ও সুলতানের স্বকীয় অভিযাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

কল্পগল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

tab

সাময়িকী

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

নূর-ই আলম সিদ্দিকী

বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫

সপ্তম-অষ্টম শতকের বাংলা সাহিত্যের মহিলা কবি কুক্করী পা। তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে ১৬ শতকের মাঝখানে আবির্ভূত হন কবি চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬৫০)। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চন্দ্রাবতী প্রথম সার্থক মহিলা কবি। ১৫-১৬ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী কিশোরগঞ্জ জেলায় জন্ম তাঁর। বাবা সে সময়ের বিখ্যাত ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাস। সপ্তদশ শতকের লোকো কবি চন্দ্রাবতী পালাকার ও রামায়ণ রচিয়তা হিসেবে সমধিক খ্যাত। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র কাহিনির মধ্যে মিশে আছে সমাজ প্রতিবেশ এবং কবির প্রাতিস্বিক কাব্যভাবনা, ও প্রেম-বিরহ উপাখ্যান। শিল্পী মাত্রই ব্যক্তি চেতনায় অনুভূত সামাজিক ঘটনাবলি নিজের সৃষ্টিতে প্রকাশ করেন। সে আলোয়, ‘ময়মনসিংহের গীতিকাগুলো বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সংযোজন।’১

মধ্যযুগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীকে মনে করা হতো গৃহপণ্য। সময় প্রবাহে এ অন্ধকার সময়ে প্রতিভাবান কবি চন্দ্রাবতীর আগমনে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৯১৩ সনে কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬) ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তারপর থেকে চন্দ্রাবতী নামটি কিংবদন্তি হয়ে যায়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রবতী’র ‘রামায়ণ’ প্রকাশ করেন। ভাটি বাংলার মানুষের জীবন জীবিকা সুখ-দুঃখ নিয়ে চন্দ্রাবতী রচনা করেন রামায়ণ, দস্যু কেনারামের পালা, ও মলুয়া লোকগাথা। ১৩২০ বঙ্গাব্দে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় ফাল্গুন সংখ্যায় চন্দ্রকুমার দে চন্দ্রাবতী সম্পর্কে বলেন, ‘বনে অনেক সময় এমন ফুল ফোটে, রাজোদ্যানেও তাহার তুলনা মেলে না, সে বনফুলের সৌন্দর্য কেহ উপলব্ধি করিতে, কিংবা সে-সৌরভ কেহই ভোগও করিতে পারে না, বনে ফুল বনে ফুটে, বনে শুকায়। চন্দ্রাবতী এইরূপ একটি বনফুল, ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে, একসময় এই সুরভী কুসুম ফুটিয়া ছিল।’২

একশো বছর আগে ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহের কাজে হাত দেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় চার খ-ে এই গীতিকা সম্পাদিত হয়। ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ ছিল এ ক্রমধারার প্রথম খ-। এই গীতিকার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব গারো পাহাড়ের অববাহিকায় অবস্থিত ভাটি অঞ্চলের সংগ্রাম মুখর মানুষ। হাওড়-বাঁওর ও নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-পরিণয়, বিরহ-বেদনা ও দ্রোহের গাথাভিত্তিক পালা। উল্লেখ্য সে সময়ের গ্রাম্য কবিরা সীমাহীন মমতা আর সৃষ্টি কুশলতায় মানুষের যাপিত জীবনের বর্ণিল-বিবর্ণ জীবনবাস্তবতাকে গীতিকার ক্যানভাসে রূপদান করেন। তাঁদের রচিত পালায় সমাজের শিষ্ট মানুষের উপস্থিতি নেই। সঙ্গত কারণে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্র জনদের কাছে এ প্রান্তিক মানুষের জীবন চর্চার বাস্তবরূপায়ণ অবজ্ঞার শিকার হয়।

সাহিত্যগুণসম্পন্ন পালাগুলো মূল্যায়ন ও বিচার করে বিরূপ সমালোচকদের প্রতি ইঙ্গিত করে ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, ‘তাঁহারা হয়তো বড় তালমানের সন্ধান জানিতেন না। কিন্তু তাহাদের হৃদয় অফুরন্ত কারুণ্য ও কবিত্বের উৎসস্বরূপ ছিল। যাঁহারা লিখিয়াছিলেন তাঁহাদের অশ্রু ফুরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু এই সকল কাহিনীর শ্রোতাদের অশ্রু কখনও ফুরাইবে বলিয়া মনে হয় না ‘৩ গীতিকার পালাগুলোর মধ্যে জান্তবজীবন বোধের অনিবার্য আকুতির প্রতি গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খ-ে লেখেন, ‘ময়মনসিংহ-গীতিকা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য। ইহাদের মধ্যে মানুষের হৃদয়ানুভূতি,মানুষের সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য এই তিন উপাদানের সমন্বয়ে এক সজীব ব্যাঞ্জনাময় কবিত্ব-স্বর্ণ রচিত হয়েছে।’

মধ্য যুগে সাহিত্যের উপাদান ছিল পুরাণ ও ধর্মাশ্রিত। একটু মনোনিবেশ করলে ময়মনসিংহ গীতিকার পালার কাহিনিতে পুরাণের ব্যবহার সামান্যই দৃশ্যমান হয়। অথচ প্রতিটি পালায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ব্রাত্যজনের প্রেম-প্রণয়,বিচ্ছেদ-কাতরতার রোমান্টিক প্রতিবেশের অভিযোজন অসামান্য। গীতের ভেতরে প্রেমের যে পিয়াসী অভিনিবেশ তা একেবারে সাম্প্রতিক। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেন, ‘সংগৃহীত পালাগানের মধ্যে যেগুলিতে বাস্তব প্রেম-প্রণয়ের কথা বলা হয়েছে, কাব্যের দিক থেকে সেগুলি উৎকৃষ্ট যেমন- মহুয়া, মলুয়া প্রভৃতি। শুধু প্রেমের জন্য জাঁতিপাতি বিলিয়ে দেওয়া, উচ্চবর্ণ কর্তৃক নিম্ন-বর্ণের কন্যাকে প্রেয়সীরূপে গ্রহণ করে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া, এমনকি বেদিয়ার সাথে ব্রাহ্মণ পুত্রের বিবাহ হিন্দু মুসলমানের মধ্যেও প্রেমের চিত্রাংকন প্রভৃতি ঘটনা অশিক্ষিত কবিরা বিস্ময়কর নিপুণতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন।’

ড.দীনেশ চন্দ্র সেন সংগৃহীত পালাসমূহের সম্পাদিত সংকলনের নাম ময়মনসিংহ গীতিকা। যেখানে দ্বিজ কানাই, দ্বিজ ঈশান, নয়নচাঁদ ঘোষ ও মনসুর বয়াতিসহ ভিন্ন দশজন পালাগান রচিয়তার পালা স্থান পেয়েছে। এ দশজনের একজন হলেন চন্দ্রাবতী। আর তাঁকে ষোড়শ শতকের বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি বলে বিদ্বজ্জনেরা অভিমত দিয়েছেন। মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা ও দেওয়ান-ভাবনা এই তিনটি পালার রচয়িতা চন্দ্রাবতী। ‘নয়নচাঁদ ঘোষ চন্দ্রাবতীর জীবন কথা নিয়ে ময়মনসিংহ গীতিকার চন্দ্রাবতী কাব্য’৪ রচনা করেন। ব্যক্তিজীবনে প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে চন্দ্রাবতী আজীবন কৌমার্য থাকতে মনস্থির করেন। পদ্মপুরাণের কবি বাবা দ্বিজ বংশীদাস কন্যার মনোভাব জেনে তাকে রামায়ণ লিখতে পরামর্শ দেন-। চন্দ্রাবতীর কথায়-

‘অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে

শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।’

পিতার আদেশে অনুগত হয়ে চন্দ্রাবতী তিন খ-ে রামায়ণ রচনা করেন। নিজের রচিত অসমাপ্ত রামায়ণে চন্দ্রাবতীর কৃতিত্ব হলো তাঁর কাব্যে আদিকবি ‘বাল্মীকি’ কিংবা পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি ‘কৃত্তিবাস ওঝার’ কোনো প্রভাবে পড়েনি। তিন খ-ে মোট উনিশটি অধ্যায়ে রচিত কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ কাহিনি। উল্লেখ্য চন্দ্রাবতী তাঁর ‘রামায়ণে’ কবি বাল্মীকি কিংবা কৃত্তিবাসের রামায়ণের আঙ্গিক গঠন কৌশলকেও আমলে নেননি। আবার চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে, রামচরিত্রের বদলে সীতা চরিত্রটিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রেখে চিত্রিত করেছেন। ফলে সীতার দুঃখের কাহিনি বর্ণনায় নারীর প্রতি পুরুষের অবজ্ঞার দিকটি স্পষ্ট করে এঁকেছেন। ‘পুরুষতান্ত্রিক প্রাধান্যের কাছে নারীরা কীভাবে উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত হয়, কীভাবে তাকে দুঃখের সাগরে নিক্ষেপ করা হয়- সেই ঘটনা তথা কাহিনী উঠে এসেছে চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ‘নারী চোখে নারীর বয়ানে।’৫

রামায়ণ রচনায় কবি চন্দ্রাবতীর কৃতিত্ব চূঁড়া স্পর্শ করেছে। কেননা তাঁর মানস উপলব্ধি পুরাণের পুরুষ চরিত্রের চাতুরি ও ধড়িবাজ ব্যক্তিত্বকে সজোরে আঘাত করেছে। কাব্যের বর্ণনাতেও কবি চন্দ্রাবতী মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। নিজ পুত্রদের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত রামচন্দ্র গর্ভাবস্থায় সীতাকে বনবাসে পাঠায়। রাজ ধর্ম রক্ষার জন্য সীতাকে পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেয়। ফলে নারীর মর্যাদা লাঞ্ছিত ও লুণ্ঠিত হয়। বিষয়টিকে চন্দ্রাবতী আধুনিক কবিদের মতোই স্পষ্ট করে ফুটিয়েছেন কাব্যিক বুননে। রামায়ণে রামচন্দ্র চরিত্রের স্বরূপকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিনি লেখেন-

‘পুড়িবে অযোধ্যা পুরী গো কিছুদিন পরে,

লক্ষ্মীশূন্য হইয়া গো রাজ্য যাবে ছারখারে।

পরের কথা কানে লইলে গো নিজের সর্বনাশ,

চন্দ্রাবতী কহে রামের গো বুদ্ধি হইল নাশ।’

মধ্যযুগের পুরুষ কবিদের পাশে নারী কবি কর্তৃক পুরুষকে এমনভাবে বিদ্ধ করার প্রত্যক্ষ প্রয়াস বড় শ্লাঘার বিষয়। এ মহাকাব্যে শুধু কাহিনি বিন্যাস ও চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণ ঘটেনি, বরং কাব্য কাঠামো নিবিড়ঘন করতে চন্দ্রাবতী পয়ার ও পাঁচালী ছন্দ ব্যবহার করেছেন। একইসঙ্গে বারোমাস্যায় প্রয়োগ করেছেন মঙ্গলকাব্যের মাধুরী। ঠিক এখানেই কবি চন্দ্রাবতীর অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সার্বিক বিচার প্রেক্ষাপটে চন্দ্রাবতী ভাবিকালের দ্যুতি ছড়ানো তেজোদীপ্ত প্রথম কবি। যাঁর কাব্যিক নিবেদন তাই প্রেরণার বাতিঘর এখন তখন ও সর্বক্ষণ।

তথ্যসূত্র :

১.আজিজুল হক, সৈয়দ, ময়মনসিংহ গীতিকা জীবনধর্ম ও কাব্যমূল্য, পৃষ্ঠা: ০১,অবসর প্রকাশন, ঢাকা, ২০২০

২. আহম্মেদ ফাহিম ম-ল, মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর ট্র্যাজিক জীবন, পৃষ্ঠা: ১৪ জাবি, ঢাকা, ২০২০

৩. দত্ত প্রদীপ, শতবর্ষের আলোয় চন্দ্রাবতী, ঢাকা, ২০২৪

৪. পুরকাইত শ্রীনিখিলেশ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন পর্যায়), পৃষ্ঠা: ৩৮০, প্রগতি প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৬৭

৫. অধিকারী সুজয়, মহিলা কবির চন্দ্রাবতীর রামায়ণ, পৃষ্ঠা: ১৫১, প্রতিধ্বনি জার্নাল, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৮

back to top