ওসামা অ্যালোমার
ফজল হাসান
সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ওসামা অ্যালোমার একাধারে একজন খুদে গল্প লেখক, কবি এবং প্রাবন্ধিক। তবে আরবি সাহিত্যের ঐতিহ্য আল-কিসসা আল-কাসিরা জিদ্দান১ (খুবই সংক্ষিপ্ত গল্প) বা খুদে গল্প লেখায় তিনি ইতোমধ্যে পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন। জগত বিখ্যাত সাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং আর্তুর র্যবোঁর অল্প কথার গল্প তাঁকে খুদে গল্প লেখায় প্রভাবিত করেছে। কেননা তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ‘খুদে গল্প হলো বন্দুক থেকে ছোড়া বুলেট, যা তীব্র গতিসম্পন্ন।’
ইতোমধ্যে ওসামা অ্যালোমার আরব বিশ্বের সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমা দেশের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, পাঠকের কাছে একজন খুদে গল্প লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতির বিষয় নিয়ে অস্পষ্ট মন্তব্য করে ছোট, বুদ্ধিদীপ্ত এবং তীক্ষè লেখায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর খুদে গল্পগুলো কাব্যিক এবং হাস্যরসাত্মক, যা ‘দাঁত এবং কামড়’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব গল্পে কল্পনা কখনো খেয়াল-খুশিতে পরিণত হয় না। তাঁর জাদুকরী কল্পনাপ্রবণ সব গল্পই গভীরভাবে অনুভব করা দার্শনিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত। উল্লেখ্য, তাঁর গল্পগুলো একটি মাত্র বাক্য থেকে কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে বেশিরভাগ গল্পের দৈর্ঘ্য এক বা একাধিক অনুচ্ছেদ, যা কয়েক লাইন দীর্ঘ।
ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্প সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকার বিজয়ী বিশ্বনন্দিত অনুগল্প লেখিকা লিডিয়া ডেভিস বিখ্যাত মার্কিন ম্যাগাজিন নিউ ইয়র্কার-এ (১৬ ডিসেম্বর ২০১৩) একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি অ্যালোমারের খুদে গল্পের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘তিনি (অ্যালোমার) জাদুকরী কল্পনাশক্তির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে গভীর, নৈতিক এবং রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়গুলো অল্প কথায় তুলে ধরেন।’
এছাড়া ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্প সম্পর্কে মন্তব্য করে শিকাগো রিভিউ অব বুকস-এর সমালোচক রাবেয়া সেলিম বলেছেন, ‘অ্যালোমারের চতুর নীতিবান গল্প এবং ধারালো রাজনৈতিক উপমাগুলো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তায় পরিপূর্ণ।’ শুধু তাই নয়, বরং তিনি অ্যালোমারকে এমন লেখকদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের পাঠকদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত, যাদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রানৎস কাফকা, অস্কার ওয়াইল্ড এবং কার্ল ওভে ক্নাউসগার্ড।
ওসামা অ্যালোমারের আরবি ভাষায় একটি কবিতার বই এবং তিনটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেই তিনটি গল্পগ্রন্থ থেকে গল্প নিয়ে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান (২০১৪) এবং দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (২০১৭)। আরবি থেকে উভয় গ্রন্থের গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সি. জে. কলিন্স এবং লেখক নিজে। উল্লেখ্য, ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান গ্রন্থে রয়েছে ৫১টি গল্প এবং দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ গ্রন্থে ১৬২টি গল্প সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
ওসামা অ্যালোমারের ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান গ্রন্থের গল্পগুলো অদ্ভুত, যেখানে প্রায়ই হাস্যকর উপহাসমূলক উপমার উপস্থিতি দেখা যায়। লেখক অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিস্ময়কর চিত্র ও সংযত ভাষা ব্যবহার করে ভালো ও মন্দ বিষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। বলা হয়, ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান গ্রন্থটি লেখককে ইংরেজি ভাষার পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন হেনরি রিস, ‘সিটি অফ অ্যাসাইলাম’২-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি, যিনি ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান বই সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ গ্রন্থে উপকথার মতো চরিত্র রয়েছে, কিন্তু তা উপকথা নয়। এর মধ্যে রসিকতার মতো বুদ্ধিদীপ্ততা রয়েছে, কিন্তু কোনো রসিকতা নয়। গল্পগুলো আমাদের বিভিন্ন সমস্যার গভীরে আঘাত করে, যেগুলো আমরা অত্যন্ত জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।’
অন্যদিকে ওসামা অ্যালোমার ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর দ্বিতীয় খুদে গল্প সংকলন ‘দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’-এ অনেকগুলো বিষয়কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। প্রাণি বা জন্তু-জানোয়ার (যেমন সাপ, নেকড়ে, ভেড়া), প্রাকৃতিক জিনিস (যেমন জলাশয়, হ্রদ, রংধনু, গাছ), মানুষের তৈরি জিনিসপত্র (যেমন ট্রাক, তলোয়ার, শূন্য)- সবই এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গল্পের চরিত্র। এ গ্রন্থের সব গল্পই আকাক্সিক্ষত এবং সেগুলো পরিকল্পনা করে, আশা করে, বিনাশ করে, এমনকি ব্যর্থ হয়। অসাধারণ গল্পগুলো বাস্তবতাকে জীবন্ত করে তোলে এবং আমাদের বাস্তবতাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করে। অ্যালোমারের চাতুরি যুক্ত নৈতিক উপকথা এবং তীক্ষè রাজনৈতিক রূপক নির্ভর গল্প পড়লে পাঠক সবসময় নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে এবং আরও একটু বেশি প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ গল্প গ্রন্থের অনেক গল্প সিরিয়ান যুদ্ধের আগে লেখা হয়েছিল, তবে কিছু গল্প এমন সময়ে লেখা হয়েছিল যখন তিনি সিরিয়া ছেড়ে যাননি। পরিতাপের সেই সময়ে কোনো গল্প কখন লেখা হয়েছিল, তার কোনো দিন-তারিখ জানা যায় না।
পরিশেষে বলতে হয়, ওসামা অ্যালোমারের ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান এবং দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ গ্রন্থ দুটিতে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে সংঘটিত সহিংসতার চিত্র ফুটে উঠেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর অন্ধকার ছায়া ফেলে এবং গল্পগুলো প্রতিরোধ, সংগ্রাম, এবং মাঝে মধ্যে বেঁচে থাকার প্রত্যাশার সঙ্গে মিশে আছে। নিঃসন্দেহে ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্পগুলো সিরিয়ায় ছড়িয়ে থাকা মৃত্যুর বিচলিত বাস্তবতার চিত্র বাংলাভাষী পাঠকদের চোখ খুলে দিবে।
ওসামা অ্যালোমারের জন্ম সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে, ১৯৬৮ সালে। তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এবং লেখক হবার স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০০৮ সালে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। জীবিকার তাগিদে তিনি প্রথম আট বছর নিউ ইয়র্কের ট্যাক্সি চালক ছিলেন। কিন্তু সেই সময় কাজের মাঝে ফুরসৎ পেলেই কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসতেন। অবশেষে তিনি ২০১৭ সালে পিটসবার্গের ‘সিটি অব অ্যাসাইলাম’ সংস্থায় ‘রাইটার-ইন-রেসিডেন্সি’ লাভ করেন, যা তাঁকে মানসিক শান্তি ফিরে পেতে এবং নিশ্চিন্তে লেখালেখির জন্য বাসস্থান দিয়েছে।
ওসামা অ্যালোমার মাত্র ১৩ বছর বয়সে লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম রচনা ছিল বসন্তকালের বর্ণনা। তিনি লেখাটি তাঁর বাবাকে দেখান। বাবা ছিলেন একজন দার্শনিকের অধ্যাপক। তিনি লেখাটি পড়ে লেখকের নাম জানতে চেয়েছিলেন। বালক ওসামা যখন বাবাকে বললেন যে, লেখাটি তারই। তখন তাঁর বাবা তাঁকে মিথ্যা বলতে বারণ করেছিলেন।
যাহোক, বাবার এবং স্কুলের শিক্ষকদের প্রশংসা ওসামা অ্যালোমারকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। শৈশবেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর মধ্যে লেখালেখির প্রতিভা রয়েছে। তাই তিনি আরও বেশি পরিমাণে লেখা শুরু করেন। যখন তাঁর বয়স ১৫ বা ১৬ বছর, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একজন লেখক হিসেবে তাঁর ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ হবে, অন্য কিছুই নয়। সেই সময় থেকে তিনি জানতেন, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদ নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান সরকার ব্যক্তিগত মত প্রকাশের ওপর কঠোর নীতি আরোপ করেছিল। তখন বাক-স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না।
কিন্তু ওসামা অ্যালোমার কিশোর বয়সেই লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলেন যে, অধিকাংশ মানুষ এই স্বাধীনতার অভাব নিয়ে কোনো ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করছে না কিংবা অন্তত নিজেদের মৌলিক অধিকারের জন্য দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল না। তারা কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেত না। তিনি আরও জানতেন যে, শেষ পর্যন্ত তিনি আমেরিকায় চলে যাবেন। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থন এবং সরকারবিরোধী হওয়ার কারণে তিনি সিরিয়ায় টিকে থাকতে পারবেন না। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, যদি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখক হিসেবে তাঁর নাম প্রতিষ্ঠা করেন, তবে তাঁর জন্য আরও ভালো হবে। সেই অস্থির সময়ে তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করছিলেন এবং সিরিয়ার সংবাদপত্রে ছোটগল্প প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন।
একসময় ওসামা অ্যালোমার গার্মেন্টস কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন, কিন্তু অল্প সময়ের পরে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরো সময় লেখার জন্য ব্যয় করেন। সেসময় তিনি শিল্পী এবং চিন্তাবিদদের নিয়ে গঠিত এক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সংগঠনের সদস্যরা প্রতি মাসে দামেস্কের বিশিষ্ট নারীবাদী লেখক সাহার আবু হার্বের অ্যাপার্টমেন্টে মিলিত হতেন। সেটি ছিল দামাস্কাস স্প্রিং-এর সময়ে উদ্ভূত অনুরূপ জমায়েতগুলোর মধ্যে একটি, যা আরবি ভাষায় ‘মুনতাদায়াত’ হিসেবে পরিচিত। যখন আসাদ বিরোধীদলীয় চিন্তাবিদদের ওপর অত্যাচার শুরু করার কারণে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে শেষ হয় প্রকাশ্য জমায়েত। কিন্তু তারপরও আবু হার্বের দল গোপনে একত্রিত হতে থাকে।
ওসামা অ্যালোমার ত্রিশের কোঠায় পৌঁছানোর আগেই একজন রাশভারি লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আরবি ভাষায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলন (ও ম্যান) প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ (ম্যান সেইড দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড) প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। আরবি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর অন্য দুটি গল্প গ্রন্থ হলো ‘টাঙ টাই’ (২০০৩) এবং ‘অল রাইটস্ নট রিজার্ভড্’ (২০০৮)।
কয়েক বছর আগে ওসামা অ্যালোমারের ইংরেজিতে অনূদিত দুটি খুদে গল্প গ্রন্থ রয়েছে: ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান (২০১৪) এবং ‘দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (২০১৭)। এ দুটি গ্রন্থের গল্পগুলো আরবিতে প্রকাশিত গল্পের অনুবাদ। তিনি ২০০৭ সালে মিশরের ‘নাজলা মুহাররম শর্ট স্টোরি’ প্রতিযোগিতায় শিরোপা লাভ করেন। আরবি ভাষায় লেখা তাঁর সাহিত্য আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে (যেমন লেবানন, জর্ডান ও মিশর) প্রকাশিত হয়েছে এবং বিবিসি আরবি বিভাগে প্রচারিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর খুদে গল্প দ্য নিউ ইয়র্কার, ওয়ার্ডস্ উইদাউট বর্ডার্স, প্যারিস রিভিউ এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে, যেমন নুন, কঞ্জাংশন, দ্য কফিন ফ্যাক্টরি, দ্য আউটলেট (ইলেকট্রিক লিটারেচার-এর ব্লগ) এবং লিটারেরি রিভিউ প্রকাশিত হয়। তিনি সিরিয়ার যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে উপন্যাস (প্রাথমিক নাম দ্য ওম্ব) এবং দ্য বুক অব মেডিটেশনস শিরোনামে আরেকটি গ্রন্থ লিখছেন। দ্বিতীয় গ্রন্থের বিষয়বস্তু প্রেম, ঘৃণা, গণতন্ত্র, স্বৈরশাসন, মাতৃত্ব, মুক্তি, সাফল্য এবং ব্যর্থতার মতো মানব অভিজ্ঞতা।
এ কথা সত্যি যে, ওসামা অ্যালোমারের সাহিত্যকর্ম সিরিয়ার বাইরে, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার পাঠকদের, প্রশংসা অর্জন করেছে এবং তাঁকে সমসাময়িক খুদে গল্প লেখক হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।
ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্প সম্পর্কে প্রশংসা ও মন্তব্য-
অ্যালোমারের গল্পগুলোতে কল্পনা কখনই নিছক হাস্য-তামাশায় পরিণত হয় না। তাঁর জাদুকরী কল্পনার সৃষ্টি সবগুলো গল্পই তাঁর গভীরভাবে অনুভূত দার্শনিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য অনুপ্রাণিত, যা তাঁর খুদে গল্পগুলোতে হৃদয়-ছোঁয়া তাড়নার উদ্ভব হয়। -লিডিয়া ডেভিস, দ্য নিউ ইয়র্কার
যদি কাফকা নতুনভাবে ঈশপের রূপকথা লেখেন, তবে তা এই চিন্তাশীল সাহিত্যিকের (অ্যালোমারের) খুদে গল্প এবং উক্তির সংকলনের মতো হতে পারে। -লিঙ্কন মিচেল, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
অ্যালোমারের চতুর নীতিবান গল্প এবং ধারালো রাজনৈতিক উপমাগুলো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তায় পরিপূর্ণ। -রাবিয়া সেলিম, শিকাগো রিভিউ অব বুকস
অ্যালোমারের সাহিত্যকর্ম সেই শক্তির কথা বলে, যা শব্দের মধ্যে থাকতে পারে, যখন সেগুলো শৈলী দ্বারা অথবা প্রয়োজনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকে... এই ধারায় একজন শিক্ষক। -ব্র্যাডলি ব্যাবেন্দির, নিউ রিপাবলিক
নির্বাসনে সিরীয় লেখকের গল্পগুলো মানুষের ‘বিরোধিতা, জটিলতা, পাগলামি’-র বিরোধিতা করে। -সামা মোহাম্মদ এবং তারিক আদেলি, সিরিয়া ডাইরেক্ট
দার্শনিক এবং উপসর্গ-মূলক খুবই সংক্ষিপ্ত গল্পগুলো মানব ব্যর্থতাকে তীক্ষè অন্তর্দৃষ্টির সাথে বিশ্লেষণ করে। (...) অ্যালোমারের লেখায় আশার আলো দেখায় এবং এই সংকীর্ণ গ্রন্থটি (ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান) সহানুভূতি ও গভীরতায় পরিপূর্ণ। -পাবলিশার্স উইকলি (যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন)
ওসামা অ্যালোমারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি-
‘একজন লেখক হিসেবে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করার এবং স্বাধীন পরিবেশের আশায় আমি সেই কিশোর বয়স থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসতে চেয়েছিলাম। স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া আমি একজন লেখক এবং শিল্পী হিসেবে কিছুই করতে পারি না। আমার জন্য স্বাধীনতা হলো বায়ু কিংবা পানির মতো। আমি স্বাধীনতা ছাড়া লিখতে পারি না।’
‘একজন লেখক হিসেবে আমার অস্ত্র হলো আমার কলম। আমি সিরিয়ার সাধারণ মানুষ সম্পর্কে আরও সচেতনতা তৈরি করতে চাই। আমার কাছে স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
‘আমি সিরিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে একটি উপন্যাস লিখছি, যা আমার খুব সংক্ষিপ্ত গল্প থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। আমাকে সরাসরি আমার সমস্ত অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে। আমার পক্ষে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ যুদ্ধ আমার আত্মার এবং আমার রক্তের সঙ্গে মিশে যাওয়া একটা কিছু।’
‘যখন আপনার কাছে পৌঁছানোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, তখন আপনি অবলীলায় শক্তিশালী হয়ে যাবেন এবং স্বাভাবিকভাবে ধৈর্যশীল হয়ে উঠবেন। যদি আপনার কোনো লক্ষ্য না থাকে, তাহলে আপনার জীবন হবে বিপন্ন। তখন আপনি আপন সত্তা হারাবেন এবং আপনার আত্মা হারিয়ে যাবে।’
‘জীবন সহজ নয়। জীবন অত্যন্ত কঠিন। আমাদের শক্তিশালী হতে হবে। তা নাহলে জীবন আমাদের নষ্ট করে দেবে।’
ওসামা অ্যালোমার
ফজল হাসান
বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ওসামা অ্যালোমার একাধারে একজন খুদে গল্প লেখক, কবি এবং প্রাবন্ধিক। তবে আরবি সাহিত্যের ঐতিহ্য আল-কিসসা আল-কাসিরা জিদ্দান১ (খুবই সংক্ষিপ্ত গল্প) বা খুদে গল্প লেখায় তিনি ইতোমধ্যে পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন। জগত বিখ্যাত সাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং আর্তুর র্যবোঁর অল্প কথার গল্প তাঁকে খুদে গল্প লেখায় প্রভাবিত করেছে। কেননা তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ‘খুদে গল্প হলো বন্দুক থেকে ছোড়া বুলেট, যা তীব্র গতিসম্পন্ন।’
ইতোমধ্যে ওসামা অ্যালোমার আরব বিশ্বের সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমা দেশের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, পাঠকের কাছে একজন খুদে গল্প লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতির বিষয় নিয়ে অস্পষ্ট মন্তব্য করে ছোট, বুদ্ধিদীপ্ত এবং তীক্ষè লেখায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর খুদে গল্পগুলো কাব্যিক এবং হাস্যরসাত্মক, যা ‘দাঁত এবং কামড়’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব গল্পে কল্পনা কখনো খেয়াল-খুশিতে পরিণত হয় না। তাঁর জাদুকরী কল্পনাপ্রবণ সব গল্পই গভীরভাবে অনুভব করা দার্শনিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত। উল্লেখ্য, তাঁর গল্পগুলো একটি মাত্র বাক্য থেকে কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে বেশিরভাগ গল্পের দৈর্ঘ্য এক বা একাধিক অনুচ্ছেদ, যা কয়েক লাইন দীর্ঘ।
ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্প সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকার বিজয়ী বিশ্বনন্দিত অনুগল্প লেখিকা লিডিয়া ডেভিস বিখ্যাত মার্কিন ম্যাগাজিন নিউ ইয়র্কার-এ (১৬ ডিসেম্বর ২০১৩) একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি অ্যালোমারের খুদে গল্পের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘তিনি (অ্যালোমার) জাদুকরী কল্পনাশক্তির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে গভীর, নৈতিক এবং রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়গুলো অল্প কথায় তুলে ধরেন।’
এছাড়া ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্প সম্পর্কে মন্তব্য করে শিকাগো রিভিউ অব বুকস-এর সমালোচক রাবেয়া সেলিম বলেছেন, ‘অ্যালোমারের চতুর নীতিবান গল্প এবং ধারালো রাজনৈতিক উপমাগুলো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তায় পরিপূর্ণ।’ শুধু তাই নয়, বরং তিনি অ্যালোমারকে এমন লেখকদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের পাঠকদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত, যাদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রানৎস কাফকা, অস্কার ওয়াইল্ড এবং কার্ল ওভে ক্নাউসগার্ড।
ওসামা অ্যালোমারের আরবি ভাষায় একটি কবিতার বই এবং তিনটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেই তিনটি গল্পগ্রন্থ থেকে গল্প নিয়ে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান (২০১৪) এবং দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (২০১৭)। আরবি থেকে উভয় গ্রন্থের গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সি. জে. কলিন্স এবং লেখক নিজে। উল্লেখ্য, ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান গ্রন্থে রয়েছে ৫১টি গল্প এবং দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ গ্রন্থে ১৬২টি গল্প সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
ওসামা অ্যালোমারের ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান গ্রন্থের গল্পগুলো অদ্ভুত, যেখানে প্রায়ই হাস্যকর উপহাসমূলক উপমার উপস্থিতি দেখা যায়। লেখক অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিস্ময়কর চিত্র ও সংযত ভাষা ব্যবহার করে ভালো ও মন্দ বিষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। বলা হয়, ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান গ্রন্থটি লেখককে ইংরেজি ভাষার পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন হেনরি রিস, ‘সিটি অফ অ্যাসাইলাম’২-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি, যিনি ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান বই সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ গ্রন্থে উপকথার মতো চরিত্র রয়েছে, কিন্তু তা উপকথা নয়। এর মধ্যে রসিকতার মতো বুদ্ধিদীপ্ততা রয়েছে, কিন্তু কোনো রসিকতা নয়। গল্পগুলো আমাদের বিভিন্ন সমস্যার গভীরে আঘাত করে, যেগুলো আমরা অত্যন্ত জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।’
অন্যদিকে ওসামা অ্যালোমার ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর দ্বিতীয় খুদে গল্প সংকলন ‘দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’-এ অনেকগুলো বিষয়কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। প্রাণি বা জন্তু-জানোয়ার (যেমন সাপ, নেকড়ে, ভেড়া), প্রাকৃতিক জিনিস (যেমন জলাশয়, হ্রদ, রংধনু, গাছ), মানুষের তৈরি জিনিসপত্র (যেমন ট্রাক, তলোয়ার, শূন্য)- সবই এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গল্পের চরিত্র। এ গ্রন্থের সব গল্পই আকাক্সিক্ষত এবং সেগুলো পরিকল্পনা করে, আশা করে, বিনাশ করে, এমনকি ব্যর্থ হয়। অসাধারণ গল্পগুলো বাস্তবতাকে জীবন্ত করে তোলে এবং আমাদের বাস্তবতাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করে। অ্যালোমারের চাতুরি যুক্ত নৈতিক উপকথা এবং তীক্ষè রাজনৈতিক রূপক নির্ভর গল্প পড়লে পাঠক সবসময় নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে এবং আরও একটু বেশি প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ গল্প গ্রন্থের অনেক গল্প সিরিয়ান যুদ্ধের আগে লেখা হয়েছিল, তবে কিছু গল্প এমন সময়ে লেখা হয়েছিল যখন তিনি সিরিয়া ছেড়ে যাননি। পরিতাপের সেই সময়ে কোনো গল্প কখন লেখা হয়েছিল, তার কোনো দিন-তারিখ জানা যায় না।
পরিশেষে বলতে হয়, ওসামা অ্যালোমারের ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান এবং দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ গ্রন্থ দুটিতে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে সংঘটিত সহিংসতার চিত্র ফুটে উঠেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর অন্ধকার ছায়া ফেলে এবং গল্পগুলো প্রতিরোধ, সংগ্রাম, এবং মাঝে মধ্যে বেঁচে থাকার প্রত্যাশার সঙ্গে মিশে আছে। নিঃসন্দেহে ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্পগুলো সিরিয়ায় ছড়িয়ে থাকা মৃত্যুর বিচলিত বাস্তবতার চিত্র বাংলাভাষী পাঠকদের চোখ খুলে দিবে।
ওসামা অ্যালোমারের জন্ম সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে, ১৯৬৮ সালে। তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এবং লেখক হবার স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০০৮ সালে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। জীবিকার তাগিদে তিনি প্রথম আট বছর নিউ ইয়র্কের ট্যাক্সি চালক ছিলেন। কিন্তু সেই সময় কাজের মাঝে ফুরসৎ পেলেই কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসতেন। অবশেষে তিনি ২০১৭ সালে পিটসবার্গের ‘সিটি অব অ্যাসাইলাম’ সংস্থায় ‘রাইটার-ইন-রেসিডেন্সি’ লাভ করেন, যা তাঁকে মানসিক শান্তি ফিরে পেতে এবং নিশ্চিন্তে লেখালেখির জন্য বাসস্থান দিয়েছে।
ওসামা অ্যালোমার মাত্র ১৩ বছর বয়সে লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম রচনা ছিল বসন্তকালের বর্ণনা। তিনি লেখাটি তাঁর বাবাকে দেখান। বাবা ছিলেন একজন দার্শনিকের অধ্যাপক। তিনি লেখাটি পড়ে লেখকের নাম জানতে চেয়েছিলেন। বালক ওসামা যখন বাবাকে বললেন যে, লেখাটি তারই। তখন তাঁর বাবা তাঁকে মিথ্যা বলতে বারণ করেছিলেন।
যাহোক, বাবার এবং স্কুলের শিক্ষকদের প্রশংসা ওসামা অ্যালোমারকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। শৈশবেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর মধ্যে লেখালেখির প্রতিভা রয়েছে। তাই তিনি আরও বেশি পরিমাণে লেখা শুরু করেন। যখন তাঁর বয়স ১৫ বা ১৬ বছর, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একজন লেখক হিসেবে তাঁর ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ হবে, অন্য কিছুই নয়। সেই সময় থেকে তিনি জানতেন, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদ নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান সরকার ব্যক্তিগত মত প্রকাশের ওপর কঠোর নীতি আরোপ করেছিল। তখন বাক-স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না।
কিন্তু ওসামা অ্যালোমার কিশোর বয়সেই লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলেন যে, অধিকাংশ মানুষ এই স্বাধীনতার অভাব নিয়ে কোনো ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করছে না কিংবা অন্তত নিজেদের মৌলিক অধিকারের জন্য দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল না। তারা কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেত না। তিনি আরও জানতেন যে, শেষ পর্যন্ত তিনি আমেরিকায় চলে যাবেন। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থন এবং সরকারবিরোধী হওয়ার কারণে তিনি সিরিয়ায় টিকে থাকতে পারবেন না। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, যদি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখক হিসেবে তাঁর নাম প্রতিষ্ঠা করেন, তবে তাঁর জন্য আরও ভালো হবে। সেই অস্থির সময়ে তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করছিলেন এবং সিরিয়ার সংবাদপত্রে ছোটগল্প প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন।
একসময় ওসামা অ্যালোমার গার্মেন্টস কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন, কিন্তু অল্প সময়ের পরে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরো সময় লেখার জন্য ব্যয় করেন। সেসময় তিনি শিল্পী এবং চিন্তাবিদদের নিয়ে গঠিত এক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সংগঠনের সদস্যরা প্রতি মাসে দামেস্কের বিশিষ্ট নারীবাদী লেখক সাহার আবু হার্বের অ্যাপার্টমেন্টে মিলিত হতেন। সেটি ছিল দামাস্কাস স্প্রিং-এর সময়ে উদ্ভূত অনুরূপ জমায়েতগুলোর মধ্যে একটি, যা আরবি ভাষায় ‘মুনতাদায়াত’ হিসেবে পরিচিত। যখন আসাদ বিরোধীদলীয় চিন্তাবিদদের ওপর অত্যাচার শুরু করার কারণে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে শেষ হয় প্রকাশ্য জমায়েত। কিন্তু তারপরও আবু হার্বের দল গোপনে একত্রিত হতে থাকে।
ওসামা অ্যালোমার ত্রিশের কোঠায় পৌঁছানোর আগেই একজন রাশভারি লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আরবি ভাষায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলন (ও ম্যান) প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ (ম্যান সেইড দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড) প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। আরবি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর অন্য দুটি গল্প গ্রন্থ হলো ‘টাঙ টাই’ (২০০৩) এবং ‘অল রাইটস্ নট রিজার্ভড্’ (২০০৮)।
কয়েক বছর আগে ওসামা অ্যালোমারের ইংরেজিতে অনূদিত দুটি খুদে গল্প গ্রন্থ রয়েছে: ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান (২০১৪) এবং ‘দ্য টিথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (২০১৭)। এ দুটি গ্রন্থের গল্পগুলো আরবিতে প্রকাশিত গল্পের অনুবাদ। তিনি ২০০৭ সালে মিশরের ‘নাজলা মুহাররম শর্ট স্টোরি’ প্রতিযোগিতায় শিরোপা লাভ করেন। আরবি ভাষায় লেখা তাঁর সাহিত্য আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে (যেমন লেবানন, জর্ডান ও মিশর) প্রকাশিত হয়েছে এবং বিবিসি আরবি বিভাগে প্রচারিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর খুদে গল্প দ্য নিউ ইয়র্কার, ওয়ার্ডস্ উইদাউট বর্ডার্স, প্যারিস রিভিউ এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে, যেমন নুন, কঞ্জাংশন, দ্য কফিন ফ্যাক্টরি, দ্য আউটলেট (ইলেকট্রিক লিটারেচার-এর ব্লগ) এবং লিটারেরি রিভিউ প্রকাশিত হয়। তিনি সিরিয়ার যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে উপন্যাস (প্রাথমিক নাম দ্য ওম্ব) এবং দ্য বুক অব মেডিটেশনস শিরোনামে আরেকটি গ্রন্থ লিখছেন। দ্বিতীয় গ্রন্থের বিষয়বস্তু প্রেম, ঘৃণা, গণতন্ত্র, স্বৈরশাসন, মাতৃত্ব, মুক্তি, সাফল্য এবং ব্যর্থতার মতো মানব অভিজ্ঞতা।
এ কথা সত্যি যে, ওসামা অ্যালোমারের সাহিত্যকর্ম সিরিয়ার বাইরে, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার পাঠকদের, প্রশংসা অর্জন করেছে এবং তাঁকে সমসাময়িক খুদে গল্প লেখক হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।
ওসামা অ্যালোমারের খুদে গল্প সম্পর্কে প্রশংসা ও মন্তব্য-
অ্যালোমারের গল্পগুলোতে কল্পনা কখনই নিছক হাস্য-তামাশায় পরিণত হয় না। তাঁর জাদুকরী কল্পনার সৃষ্টি সবগুলো গল্পই তাঁর গভীরভাবে অনুভূত দার্শনিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য অনুপ্রাণিত, যা তাঁর খুদে গল্পগুলোতে হৃদয়-ছোঁয়া তাড়নার উদ্ভব হয়। -লিডিয়া ডেভিস, দ্য নিউ ইয়র্কার
যদি কাফকা নতুনভাবে ঈশপের রূপকথা লেখেন, তবে তা এই চিন্তাশীল সাহিত্যিকের (অ্যালোমারের) খুদে গল্প এবং উক্তির সংকলনের মতো হতে পারে। -লিঙ্কন মিচেল, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
অ্যালোমারের চতুর নীতিবান গল্প এবং ধারালো রাজনৈতিক উপমাগুলো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তায় পরিপূর্ণ। -রাবিয়া সেলিম, শিকাগো রিভিউ অব বুকস
অ্যালোমারের সাহিত্যকর্ম সেই শক্তির কথা বলে, যা শব্দের মধ্যে থাকতে পারে, যখন সেগুলো শৈলী দ্বারা অথবা প্রয়োজনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকে... এই ধারায় একজন শিক্ষক। -ব্র্যাডলি ব্যাবেন্দির, নিউ রিপাবলিক
নির্বাসনে সিরীয় লেখকের গল্পগুলো মানুষের ‘বিরোধিতা, জটিলতা, পাগলামি’-র বিরোধিতা করে। -সামা মোহাম্মদ এবং তারিক আদেলি, সিরিয়া ডাইরেক্ট
দার্শনিক এবং উপসর্গ-মূলক খুবই সংক্ষিপ্ত গল্পগুলো মানব ব্যর্থতাকে তীক্ষè অন্তর্দৃষ্টির সাথে বিশ্লেষণ করে। (...) অ্যালোমারের লেখায় আশার আলো দেখায় এবং এই সংকীর্ণ গ্রন্থটি (ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান) সহানুভূতি ও গভীরতায় পরিপূর্ণ। -পাবলিশার্স উইকলি (যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন)
ওসামা অ্যালোমারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি-
‘একজন লেখক হিসেবে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করার এবং স্বাধীন পরিবেশের আশায় আমি সেই কিশোর বয়স থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসতে চেয়েছিলাম। স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া আমি একজন লেখক এবং শিল্পী হিসেবে কিছুই করতে পারি না। আমার জন্য স্বাধীনতা হলো বায়ু কিংবা পানির মতো। আমি স্বাধীনতা ছাড়া লিখতে পারি না।’
‘একজন লেখক হিসেবে আমার অস্ত্র হলো আমার কলম। আমি সিরিয়ার সাধারণ মানুষ সম্পর্কে আরও সচেতনতা তৈরি করতে চাই। আমার কাছে স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
‘আমি সিরিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে একটি উপন্যাস লিখছি, যা আমার খুব সংক্ষিপ্ত গল্প থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। আমাকে সরাসরি আমার সমস্ত অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে। আমার পক্ষে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ যুদ্ধ আমার আত্মার এবং আমার রক্তের সঙ্গে মিশে যাওয়া একটা কিছু।’
‘যখন আপনার কাছে পৌঁছানোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, তখন আপনি অবলীলায় শক্তিশালী হয়ে যাবেন এবং স্বাভাবিকভাবে ধৈর্যশীল হয়ে উঠবেন। যদি আপনার কোনো লক্ষ্য না থাকে, তাহলে আপনার জীবন হবে বিপন্ন। তখন আপনি আপন সত্তা হারাবেন এবং আপনার আত্মা হারিয়ে যাবে।’
‘জীবন সহজ নয়। জীবন অত্যন্ত কঠিন। আমাদের শক্তিশালী হতে হবে। তা নাহলে জীবন আমাদের নষ্ট করে দেবে।’