গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্প
মূল স্প্যানিশ থেকে ভাষান্তর : সুরাইয়া ফারজানা হাসান
টানা বৃষ্টির তৃতীয় দিনে ওরা বাড়ির ভিতর এত বেশি কাঁকড়া নিধন করেছে যে, পেলায়োকে ওর জলমগ্ন উঠোনটা পার হয়ে ওগুলোকে সাগরে ছুড়ে দিতে হলো, কারণ সদ্যজাত শিশুটির গায়ে রাতভর তাপমাত্রা ছিল আর আর ওরা ভেবেছে এই প্লাবনের কারণেই বুঝি জ¦রটা এসেছে। গত মঙ্গলবার থেকে পৃথিবীটা যেন মুখ ভার করে আছে। আকাশ আর সাগর ধূসর-ছাইরঙা মেঘে একাকার হয়ে গিয়েছে আর সৈকতের বালু, যেগুলো মার্চের রাতে চূর্ণবিচূর্ণ আলোর মতো চিকচিক করত, সেগুলো কাদা আর পচা শামুকের থকথকে ঝোলে পরিণত হয়েছে। দুপুরবেলায় সূর্যের আলো এতই মিটমিটে হয়ে গেল যে, পেলোয়ো যখন সাগরে কাকড়াগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়ার পর বাড়ি ফিরে আসছিল, উঠোনের পিছনে কী যেন একটা নড়াচড়া করছে আর ব্যথায় কাতরাচ্ছে সেটা দেখা ওর পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ওকে খুব কাছে কাছে গিয়ে দেখতে হলো, ওটা আসলে এক থুত্থুরে বুড়ো মানুষ, যিনি কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন, অনেক চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারছেন না, তাঁর বিশাল ডানা দুটোয় বাধা পাচ্ছেন বলে।
দুঃস্বপ্নের মতো ওই ঘটনায় হকচকিয়ে গিয়ে পেলায়ো দৌড়ে গেল ওর বউ এলিসেন্দাকে খুঁজতে, যে ওদের অসুস্থ শিশুটিকে জলপট্টি দিচ্ছিল, এবং ও তাকে পিছনের উঠোনে টেনে নিয়ে এলো। ওরা দুজনেই পড়ে থাকা দেহটির দিকে নিঃশব্দে অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইল। মানুষটির পোশাক আশাক অনেকটা ন্যাকড়া কুড়ানীর মতো। তাঁর টেকো মাথার খুলিতে ক’টা মাত্র ধূসর চুল পড়ে আছে এবং মুখে দু চারটি দাঁত, আর ভিজে শপশপে পরদাদার মতো করুণ হাল দেখে মনে হবে এ বয়সে তাঁর যে রকম ঠাটবাট থাকার কথা সে রকমটি নেই। বুড়ো মানুষটির বিশাল বাজপাখির মতো নোংরা এবং অর্ধ-পালক ওঠা ডানাদুটো যেন চিরতরে কাদায় আটকে গেছে। তাঁর একদম কাছে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে খুব শীঘ্রই পেলায়ো আর এলিসেন্দা ওদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে এবং অবশেষে তাঁকে ওদের পরিচিত বলেই মনে হয়। এরপর ওরা তাঁর সাথে কথা বলার সাহস করে উঠতে পারে, আর তিনি একজন বিদেশি নাবিকের মতো অবোধ্য স্থানীয় ভাষায় গমগম কণ্ঠে কিছু একটা বলতে লাগলেন। এভাবেই ওরা ডানার বিটকেলে ঝামেলার থেকে মুক্ত হয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি সম্ভবত ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যাওয়া বিদেশি জাহাজের এক নিসঃঙ্গ নাবিক। যাইহোক, ওরা পড়শি এক সর্বজ্ঞানী মহিলাকে ডেকে আনে তাঁকে দেখানোর জন্য, যে বুড়ো মানুষটিকে এক পলক দেখেই তাঁর জীবন, মৃত্যুর সব ইতিহাস গড়গড় করে বলে দেবে এবং ওদের যদি এ সংক্রান্ত কোনো ভুল অনুমান থাকে তবে তা ধরিয়ে দেবে।
‘উনি একজন দেবদূত’, ওদের বলা হলো। ‘উনি অবশ্যই তাঁর ছোট্ট দেবশিশুটিকে নিতে পৃথিবীতে এসেছেন, কিন্তু বেচারা এতটাই বুড়িয়ে গেছেন যে, বৃষ্টিতে মুখ থুবড়ে পড়েছেন।’
এ ঘটনার পরেরদিন সকলেই জেনে গেল যে, পেলায়োর বাড়িতে এক রক্ত-মাংসের দেবদূত বন্দী আছেন। পড়শি সর্বজ্ঞানী মহিলার রায়ের বিপরীতে, যে কজন লোক মনে করে যে তিনি আসলে স্বর্গে অন্যান্য দেবদূতদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি, তাদের অবশ্য তাঁকে গদা দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে পাঠানোর মতো কলিজায় সাহস ছিল না। পেলায়ো পুরোটা বিকেল-সন্ধ্যে চৌকিদারের গদা পাশে রেখে রান্নাঘর থেকে বুড়ো মানুষটিকে চোখে চোখে রাখে, আর রাতে ঘুমোতে যাবার আগে তাঁকে কাদা থেকে টেনেহিঁচড়ে গুণা তারের তৈরি মুরগির খাঁচায় তালাবদ্ধ করে রাখে। মাঝরাতে, বৃষ্টিটা ধরে আসার সময়েও, পেলায়ো আর এলিসেন্দা কাঁকড়া মেরে যাচ্ছিল এবং কিছুক্ষণ পরেই শিশুটি জ¦র ছাড়াই খিদে নিয়ে জেগে ওঠে। তখন ওদের মনে দয়া-মায়ার উদ্রেক হয় আর ওরা স্থির করে দেবদূতটাকে খাবার পানিসহ ভেলায় রেখে তিন দিনের একটা বিহিত করে দূর সমুদ্রে তাঁকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেবে। কিন্তু ওরা ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে উঠোনে গিয়ে দেখে, মুরগির খাঁচার সামনে পাড়া-পড়শিরা ভিড় করেছে, দেবদূতকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশায় মেতে উঠেছে, তারা তাঁর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা না দেখিয়ে তাঁর দিকে এমনভাবে খাদ্যবস্তু ছুড়ে মারছে যেন, তিনি কোনো অপার্থিব কেউ নন বরং সার্কাসের জন্তু।
পাদ্রী গনসাগা সকাল সাতটার আগেই এই অদ্ভুত খবরটা শুনে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এলেন। এরই মধ্যে কিছু উৎসুক লোকজন এসে হাজির যারা ভোরের দর্শনার্থীদের মতো অতোটা ছ্যাঁচড়ামো করছে না, বরং বন্দী বুড়ো মানুষটির ভবিষ্যতে কী গতি হতে পারে তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা কল্পনা করছে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে সহজ সরল লোকটির মনে হলো-তাঁকে পৃথিবীর নগরপিতা নামে ডাকা যেতে পারে। আর অন্যান্যরা খানিকটা অনুদার হয়ে ভাবল-বুড়োকে বড়জোর পাঁচ-তারকার প্রধান সেনাপতির পদে পদোন্নতি দেয়া যেতে পারে, যাতে আগামীতে সবক’টি যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়। এদিকে কিছু আশাবাদী বিজ্ঞলোকেরা চিন্তা করে দেখল তাঁকে দিয়ে পৃথিবীতে ডালাওলা এক জ্ঞানী মানব-সংকর করলে মন্দ হয় না, যারা এই মহাবিশে^র দ্বায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু পাদ্রী গনসাগা মশায় যাজক হবার পূর্বে শক্তসমর্থ, তাগড়া কাঠুরে ছিলেন। তিনি তারের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে, কথিত দেবদূতকে তাৎক্ষণিকভাবে জেরা করবার জন্য ধর্মীয় বিষয়গুলি মনে মনে ঝালিয়ে নিয়ে লোকজনকে খাঁচার দরজাটা খুলে দিতে বললেন, যাতে খুব কাছে থেকে বেচারা বুড়ো মানুষটিকে দেখতে পারেন; যাকে তখন ছানাপোনাদের মাঝে একমনে চেয়ে থাকা একটি জবুথবু বিশালাকৃতির মুরগির মতো দেখাচ্ছে। আর তিনি এক কোণে শুয়ে আগে যারা এসেছিল, ওদের ছুড়ে দেয়া ফলের খোসা আর সকালের নাস্তার উচ্ছিষ্টের মাঝে সূর্যালোকে মেলে দেওয়া ডানাদুটো শুকিয়ে নিচ্ছিলেন। পাদ্রী মশায় মুরগির খাঁচার ভিতরে প্রবেশ করে তাঁকে লাতিন ভাষায় শুভ সকাল বললে, পৃথিবীর চোখে তুচ্ছ, আগন্তুক এই বহিরাগত বুড়ো মানুষটি তাঁর প্রতœতাত্ত্বিক চোখদুটো তুলে তাঁর নিজের ভাষায় কিছু একটা অস্ফুটস্বরে বললেন। এই এলাকার গির্জার যাজক যখন দেখলেন বুড়ো মানুষটি না জানে ঈশ^রের ভাষা, না জানে একজন সম্মানিত যাজককে কীভাবে শুভেচ্ছা জানাতে হয়, তাতে তাঁর প্রথমেই সন্দেহ হয়, সে আসলে দেবদূত সেজে থাকা একজন প্রতারক। এরপর বুড়োর খুব কাছে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন তাঁকে দেবদূত নয় বরং বড্ড বেশি মানুষ বলে মনে হচ্ছে: তাঁর গা থেকে অসহনীয় গন্ধ বের হচ্ছে, ডানার পিছন দিকে পরজীবীর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত এবং তাঁর বড় পালকগুলো পার্থিব আলো হাওয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, তাঁর কোনো কিছুই আর দেবদূতদের গরিমায় মাপা যায় না। তখন তিনি মুরগির খাঁচার বাইরে এলেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত ধর্মোপদেশ দিয়ে কৌতূহলী জনতাকে কোনো প্রকার ছলা-কলায় না ভোলার জন্য সাবধান করে দিলেন। তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, একজন অসতর্ক ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার জন্য বাৎসরিক কার্নিভালে শয়তানের কূটচাল চালার অভ্যেস আছে। তিনি যুক্তি দেখান, যদি ডানাটাই বাজপাখি আর উড়োজাহাজের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করার জন্য আবশ্যিক উপাদান না হয়ে থাকে, তবে একজন দেবদূত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটির ভূমিকা বরং আরো কম হওয়া উচিত। তৎসত্ত্বেও, প্রতিশ্রুতি দেন, অত্র অঞ্চলের বিশপকে তিনি একটি চিঠি লিখবেন, যাতে তিনি তাঁর উপরওলাকে বিষয়টি অবগত করান, যাতে তিনি আবার স্বয়ং মহামান্য পোপকে চিঠি লিখেন, ভ্যাটিকানের সর্বোচ্চ আদালতে এতদ্সংক্রান্ত একটি রায় দেওয়ার জন্য।
তাঁর বিচক্ষণতা উপস্থিত লোকজনের ঊষর হৃদয়ে স্থান পায়। বন্দী দেবদূতের খবর এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, কয়েক ঘণ্টা পরে উঠোনে বাজারের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় এবং যে ভিড়টা পেলায়ো-এলিসেন্দ্রার বাড়িটাকে তছনছ করে ফেলেছে, সে ভিড়টাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ওদের বেয়নেট কাঁধে সেনা সদস্য ডেকে আনতে হয়। বাড়ির সমস্ত ময়লা আবর্জনার জঞ্জাল ঝেটিয়ে বিদেয় করতে গিয়ে এলিসেন্দ্রার কোমরের সব হাড় যখন একসাথে মট করে ওঠে, তখন ওর মাথায় বুদ্ধি খেলে, উঠোনে বেড়া দিয়ে দেবদূত দেখতে লোকজনের মাথাপিছু পাঁচ পয়সা আদায় করা যায়।
উৎসুক জনতা এমনকি বহুদূরের সেই মার্তিনিকা থেকে এসেছে। একটি ভ্রাম্যমাণ মেলা উপস্থিত হয় উড়ন্ত দড়াবাজিকর নিয়ে, যে লোকটি ভিড়ের মধ্য দিয়ে সাঁই সাঁই করে দ্রুত একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শূন্যে যাওয়া আসা করছিল, তবে কেউই থুত্থুরে বুড়ো মানুষটির দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছিল না, কারণ তাঁর ডানাগুলো দেবদূতের মতো তো নয়ই, বরং নাক্ষত্রিক বাদুড়ের মতো দেখতে। সুস্বাস্থ্যের খোঁজে এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা, ক্যারিবীয় অঞ্চলের পঙ্গু লোকেরা: এক দরিদ্র নারী যিনি শৈশব থেকে নিজের হৃদস্পন্দন গুনে আসছে আর সেই স্পন্দন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে; এক পর্তুগিজ লোক যে আকাশের তারার হট্টগোলের কারণে ঘুমাতে পারে না; এক স্বপ্নচর ব্যক্তি, যে দিনে জেগে থাকার সময়ে যা করে, সেগুলো ভ-ুল করার জন্য রাতে ঘুমের ঘোরে জেগে উঠে দাঁড়ায়; এছাড়া অনেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব ব্যামো নিয়ে এসেছে। সর্বনাশা পৃথিবীটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে যে জাহাজডুবির অনাসৃষ্টি, সেই দৈবদুর্বিপাকের মাঝেও পেলায়ো আর এলিসেন্দা প্রচ- অবসাদ সত্ত্বেও সুখী ছিল, কারণ সপ্তাহ না ঘুরতেই ওরা ওদের সবক’টি ঘর গাদা করা অর্থ-কড়িতে ভরে ফেলেছে এবং দেবদূতের সামনে দর্শনার্থী তীর্থযাত্রীদের লম্বা সারি দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে।
দেবদূতই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর নিজের নাট্যাঙ্কে অভিনয় করেননি। তিনি তাঁর সময়টা তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত কুক্কুট নীড়ে পিলসুজের বাতি আর লোকজনের রাখা তন্ত্রমন্ত্রের মোমের আলোয় নরকতুল্য গরমে বিভ্রান্তের ন্যায় আরাম খোঁজার চেষ্টা করেছেন। শুরুতে ওরা তাঁকে সবজান্তা পড়শি মহিলার জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ মোতাবেক দেবদূতদের খাবার হিসেবে কিছু কর্পূরের স্ফটিক খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওগুলো তিনি হেলায় সরিয়ে রাখেন, ঠিক তেমনিভাবে পোপের ভোজ থেকে অনুতাপীদের আনা খাবারও দূরে ঠেলে দিয়েছেন, আর শেষমেশ তিনি কিনা খেলেন বেগুন ঘণ্ট, সেটা কি তিনি দেবদূত ব’লে নাকি বয়সের কারণে, সেটি অবশ্য কেউ কখনোই খুঁজে বের করেনি। তাঁর একমাত্র অপার্থিব গুণ বোধকরি তাঁর অসীম ধৈর্য্য। বিশেষ করে প্রথম ক’দিন, যখন মুরগিগুলো তাঁর ডানায় নাক্ষত্রিক পরজীবীদের খোঁজে ঠোকর দিত, আর বিকলাঙ্গরা পালক ধরে টানাটানি করত তাঁর ক্ষতস্থান স্পর্শ করার জন্য, এবং এমনকি খুব দয়ালু লোকেও তাঁর দিকে পাথর ছুড়ে মারত, যাতে তিনি উঠে দাঁড়ান আর তারা তাঁকে সে অবস্থায় দেখতে পায়। তারা তাঁকে একবারই উঠাতে সফল হয়, যখন তারা পশুর দেহে মার্কা মারার তপ্ত লৌহখ- দিয়ে তাঁর পাশর্^দেশ ছ্যাঁকা দেয়, কারণ তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেরকম নড়চড়বিহীন ছিলেন, তারা ভেবেছিল তিনি বুঝি মারা গেছেন। তিনি আচমকা জেগে উঠে তারস্বরে দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে থাকেন আর চোখভরা জল নিয়ে বারকয়েক ডানাদুটো ঝাপটান, যার ফলে মুরগির বিষ্ঠার ঘূর্ণিবায়ু ওঠে এবং চন্দ্রধূলি ব্যথার প্রবল বাতাস তোলে, যেগুলোকে ঠিক এই পৃথিবীর ব’লে মনে হয় না। যদিও অনেকের মনে হয়েছে, তাঁর এই প্রতিক্রিয়া ঠিক ব্যথার নয়, বরং ক্রোধ হতে পারে, তাই তখন থেকে তারা তাঁকে বিরক্ত না করার ব্যাপারে সাবধান হয়ে যায়। কারণ এদের অধিকাংশই বুঝে গেছে তাঁর নিস্ক্রিয়তার মানে এই নয় যে, এক উপদেবতা বিশ্রাম নিচ্ছেন বরং আকস্মিক বিপদের আগে তিনি থম মেরে আছেন।
পাদ্রী গনসাগা গৃহ পরিচারিকাদের সামাল দেওয়ার সূত্রটি মেনে, শেষ পর্যন্ত বন্দীর ধরন কী হবে সে রায় না আসা অব্দি জনতার ছেলেমানুষিতে রাশ টেনে ধরেন। কিন্তু রোম থেকে চিঠি আসার কোনো প্রকার ত্বরা দেখা যাচ্ছে না। ওরা সময় ক্ষেপণ করছে বন্দী ব্যক্তিটির নাভি আছে কিনা, তাঁর মুখের ভাষার সাথে সিরিয়া-দেশীয় ভাষার মিল আছে কিনা, একটি আলপিনের মাথায় বহুবার বসতে পারে কিনা, নাকি সে নিতান্তই নরওয়ের ডানাওলা কোনো লোক- এইসব মামুলি বিষয় জানতে চেয়ে। ওইসব ফালতু চিঠিপত্র চালাচালি যেন শতাব্দীর শেষ অবধি চলতেই থাকবে, যদ্দিন না একটি দৈব ঘটনা যাজকের কঠোর দুর্দশার অবসান ঘটায়।
তখনকার দিনে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ মেলার আকর্ষণ বাড়াতে অলৌকিক ঘটনার প্রদর্শনীতে এক নারীকে আনা হতো, যে অল্পবয়সে বাবা-মা’র অবাধ্য হবার কারণে মাকড়সায় পরিণত হয়েছে, তাকে দর্শনের প্রবেশাধিকার মূল্য দেবদূতটির চেয়ে শুধু কমই ছিল না, বরং লোকজন তাকে তার এই কিম্ভূতকিমাকার দশা সম্পর্কে উল্টা-পাল্টা যে কোনো ধরনের প্রশ্নই করতে পারত। এমনকি তার এই ভৌতিক অবস্থার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হবার জন্য তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবটুকুই পরখ করে দেখতে পারত। নারীটি ছিল ভয়ানক বিষাক্ত মাকড়সা, তার আকৃতি ভেড়ার মতো, আর মুখখানা যেন এক বিষণœ পরিচারিকার। যে ব্যাপারটি ছিল সবচেয়ে হৃদয়বিদারক, তা তার ওই উদ্ভট আকৃতি নয়, বরং নিজের দুর্ভাগ্য বর্ণনায় নিদারুণ পরিতাপ: অনেক আগে, সে যখন নিছকই নাবালিকা, তখন বাড়ি থেকে চুপিসারে বের হয়ে একটি নাচের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, আর পিতামাতার অনুমতি ছাড়াই সারারাত নাচানাচি করে সে যখন বনের ভিতর দিয়ে আসছিল, একটি ভয়ঙ্কর আকস্মিক বজ্রপাত আকাশটাকে চিরে দু’টুকরা করে। আর সেই চেরা অংশ থেকে চলে আসা গন্ধকের আলো ঝলকানি তাকে মাকড়সায় পরিণত করে। এখন তার একমাত্র আহার্যবস্তু বলতে কারো নিছক দয়া দেখিয়ে তার মুখে ছুড়ে দেয়া মাংসের কোপ্তা। মানবীয় সত্য এবং ভীতিপ্রদ শিক্ষা সমেত এহেন প্রদর্শনী, ওই দাম্ভিক দেবদূত, যাকে খুব কমই মর্তের কারো মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাঁর প্রদর্শনীকে ধরাশায়ী করতে বাধ্য। এছাড়া, দেবদূতের মাঝে এমন কোনো অলৌকিক কিছু অবলোকন করা যায় না, যেমনটি ঘটেছে এক অন্ধলোকের ক্ষেত্রে, যে দৃষ্টি ফিরে না পেলেও তার নতুন দাঁত গঁজিয়েছে, অথবা সেই বাতব্যাধিগ্রস্ত লোক, যে হাঁটতে পারেনি, তবে প্রায় সবক’টি লটারিতে জিতেছে, এমনকি সেই কুষ্ঠ রোগী, যার শরীরের ঘাঁয়ে সূর্যমুখী ফুলের কুঁড়ি গজিয়েছে। ওইসব সান্ত¡নামূলক অলৌকিক ঘটনা, যেগুলো অনেকাংশেই ফালতু কিসিমের, সেগুলো এরই মধ্যে দেবদূতের সুনাম বিনষ্ট করেছে, এবং মাকড়সায় পরিণত হওয়া নারীটি এসে তাঁর অবশিষ্ট মহিমাটুকু গুঁড়িয়ে দেয়। এতেই পাদ্রী গনসাগা অনিদ্রারোগ থেকে চিরতরে মুক্তি পেলেন এবং পেলায়োর উঠোনটা সেই অতীত দিনের মতো শূন্য হয়ে গেল, যখন টানা তিনদিন ঝুম বৃষ্টি পড়েছিল আর শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে কাঁকড়া হেঁটে বেড়াচ্ছিল।
বাড়ির মালিক পেলায়ো-এলিসেন্দ্রার অবশ্য বিলাপ করার কোনো কারণ ছিল না। যে পরিমাণ টাকা গচ্ছিত হয়েছে, তা দিয়ে ঝুল বারান্দাসহ এক দোতলা অট্টালিকা গড়া হয়েছে, উঁচু তারের জাল দিয়ে বাগান ঘেরা হয়েছে শীতকালে অবাধে কাঁকড়ার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে; আর জানালাগুলোতে লোহার শিক আঁটা হয়েছে, যাতে আর কোনো দেবদূত-টেবদূত সেখানে আর প্রবেশ করতে না পারে। পেলায়ো শহরের কাছাকাছি একটি খরগোশের খামার তৈরি করে চৌকিদারের কাজটা চিরদিনের জন্য ছেড়ে দেয়, আর এদিকে এলিসেন্দা ক’টা উচু হিল তোলা স্যাটিনের পাম্প-সু আর ঝলমলে রঙ বদলায় এমন রেশমী কাপড়ের জামা কিনে আনে, যেগুলো তখনকার দিনে সমাজের উঁচুতলার নারীদের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত রোববারের পোশাক ছিল। মুরগির খাঁচাটাই ছিল একমাত্র জিনিস যেটি কারো দৃষ্টিতে পড়েনি। যদিও প্রায়শ এটি কয়লা-আলকাতরার গাজন দিয়ে ধোয়া হতো আর এর ভেতরে গন্ধরস ধূপ পুড়িয়ে চোখের জল ঝরাত, তবে কাজটা করা হতো দেবদূতকে সম্মান দেখানোর জন্য নয়, বরং মুরগির বিষ্ঠার পূতিগন্ধ দূর করার জন্য, যেটি এখনও অশরীরীর মতো সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আর নতুন বাড়িটিকে পুরনো দালানের মতো কেমন গুমোট করে ফেলেছে। প্রথম যেদিন বাড়ির শিশুটি হাঁটতে শেখে, ওরা সতর্ক দৃষ্টি রাখে সে যেন ভুলক্রমেও মুরগির খাঁচার সামনে না যায়। এরপর ওদের ভয় চলে গেল এবং দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হতে লাগল, আর বাচ্চাটির দ্বিতীয় দাঁত ওঠার আগেই সে মুরগির খাঁচার ভিতরে খেলতেও চলে গেল, যেখানে লোহার তারগুলো খসে খসে পড়ছে। দেবদূত অবশ্য বাচ্চাটির ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় উদাসীন ছিলেন না, তবে তিনি কুকুরের মতো ধৈর্য্য নিয়ে ওর দুষ্টুমি আর অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাদের দুজনেরই একই সময়ে জলবসন্ত হলো। ডাক্তার সাহেব, যিনি বাচ্চাটির চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন, তিনি দেবদূতেরও হৃদস্পন্দন শোনার লোভ সামলাতে পারেননি এবং তিনি তাঁর হৃৎপি-ে এত বেশি বাঁশির মতো ঘড়ঘড়ে আওয়াজ, আর কিডনিতে খুটখুট শব্দ শুনেছেন যে, তাঁর মনে হচ্ছিল, তাঁর বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। যেটি তাঁকে সবচেয়ে অবাক করে তা হলো, তাঁর দুটো ডানা থাকার যৌক্তিকতা। ওগুলো তাঁর মানব শরীরে এত বেশি স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল যে, তিনি বুঝে উঠতেই পারছিলেন না অন্য পুরুষ মানুষদেরও কেন ডানা নেই।
রোদ-বৃষ্টিতে মুরগির খাঁচা ভেঙ্গে পড়ার কিছুদিন পর বাচ্চাটি স্কুলে যেতে শুরু করে। আর বুড়ো দেবদূত মরণাপন্ন পথ হারা লোকের মতো নিজের দেহখানা বাড়ির এখানে-সেখানে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। স্বামী-স্ত্রী তাঁকে শোবার ঘর থেকে ঝাঁটা মেরে তাড়িয়ে দিলে, তিনি পরক্ষণে নিজেকে রান্নাঘরে দেখতে পান। তাকে একই সময় এত জায়গায় দেখা গেল যে, ওদের মনে হতে লাগল বুড়ো মানুষটি বুঝি নিজের অনেকগুলি নকল সংস্করণ তৈরি করেছেন, আর রেগে-মেগে কাই হয়ে এলিসেন্দা এমন ভাবে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিল যেন ও দেবদূতে পরিপূর্ণ এক বীভৎস নরকে বসবাস করছে। তিনি প্রায় খেতে-টেতে পারতেন না আর তাঁর প্রতœতাত্ত্বিক চোখ দুটো এতোটাই ঝাপসা হয়ে গেছে যে, তিনি বাড়ির থামে থামে ধাক্কা খেতে লাগলেন। সে সময় তিনি যা ফেলে গেলেন, তা হলো তাঁর ডানার শেষ পালকটির খালি নল। পেলায়ো একটা কম্বল তাঁর দিকে ছুড়ে দেয় এবং দয়া দেখিয়ে তাঁকে বাড়ির চালার নিচে ঘুমাতে দেয়, আর তখনই ওরা খেয়াল করে তাঁর রাতভর জ¦র ছিল, আর তিনি বিকারগ্রস্ত নরওয়ের বুড়ো মানুষের মতো একই কথার দ্রুত পুনরাবৃত্তি করে প্রলাপ বকছিলেন। ক্ষণিকের তরে ওরা বিপদাশঙ্কায় কুঁকড়ে ওঠে, কারণ ওদের মনে হচ্ছিল, বুড়োটা বুঝি মরতে বসেছে আর এদিকে সর্বজ্ঞানী পড়শি মহিলাটিও ওদের বলে দেয়নি মরা দেবদূতদের নিয়ে কী করতে হয়।
তবে তিনি নিদারুণ শীতে কেবল টিকেনইনি, বরং মনে হলো বসন্তের আগমনে প্রথম রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে তাঁর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হতে শুরু করেছে। তিনি ক’দিনের জন্য উঠোনের দূরবর্তী কোণে স্থানুর হয়ে বসে রইলেন, যেখানে কেউ তাঁকে দেখতে পাবে না, এবং ডিসেম্বরের শুরুতে তাঁর ডানায় কিছু বড় বড় শক্তপোক্ত পালক জন্মাতে শুরু করে, যেন একটি কাকতাড়–য়ার পালক, যেটি দেখতে অনেকটা অন্য কোনো জরাগ্রস্ত লোকের দুর্দশার মতো। কিন্তু তিনি অবশ্যই তাঁর দেহের এই পরিবর্তনের কারণ জানতেন, কারণ তিনি অতি সতর্ক ছিলেন, কেউ যাতে সেগুলো দেখতে না পায়, কেউ যাতে সাগরের মল্লার সেই গান শুনতে না পায়, যে গান তিনি কখনো সখনো তারা ভরা আকাশের নিচে বসে গেয়ে থাকেন। এক সকালে, এলিসেন্দা দুপুরের খাবারের জন্য কিছু চাক চাক করে পেঁয়াজ কাটছিল, তখন ওর মনে হলো একটি ঝড়ো হাওয়া দূরের সাগর থেকে ঝট করে রান্নাঘরে এসে পড়ল। তখন ও জানালার কাছে গেল এবং পরম বিস্ময়ের সাথে বুড়ো দেবদূতকে উড়ে যাওয়ার প্রথম প্রচেষ্টারত অবস্থায় দেখল। এতই এলোমেলোভাবে বুড়ো কা-টি করতে যাচ্ছিল যে তাঁর আঙ্গুলের নখ সব্জি বাগানে লাঙ্গলরেখা তৈরি করেছে, এবং আলোয় ছিটকে পড়া বাতাসে বেয়াড়া পাখা ঝাপটাতে গিয়ে উঠোনের চালাঘরটা প্রায় ভেঙ্গেই ফেলছিলেন। কিন্তু তিনি উড়তে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত। এলিসেন্দা মুক্তির একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে, ওর নিজের জন্য এবং বুড়ো মানুষটির জন্যও বটে, যখন তাঁকে ও এ গাঁয়ের শেষ বাড়িটার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখল, বুড়ো শকুনের মতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে পক্ষপূট নেড়ে নেড়ে। ও তাকে দেখতেই লাগল, এমনকি যখন ও পেঁয়াজ কেটেই যাচ্ছে, ততক্ষণ ও চেয়ে রইল- যতক্ষণ না পর্যন্ত আর ওর পক্ষে তাঁকে দেখা সম্ভব নয়। কারণ তিনি তখন আর ওর জীবনের বিপত্তির কোনো কারণ নয়, বরং সাগরের দিকচক্রাবালে আঁকা একটি বিন্দুমাত্র।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্প
মূল স্প্যানিশ থেকে ভাষান্তর : সুরাইয়া ফারজানা হাসান
বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
টানা বৃষ্টির তৃতীয় দিনে ওরা বাড়ির ভিতর এত বেশি কাঁকড়া নিধন করেছে যে, পেলায়োকে ওর জলমগ্ন উঠোনটা পার হয়ে ওগুলোকে সাগরে ছুড়ে দিতে হলো, কারণ সদ্যজাত শিশুটির গায়ে রাতভর তাপমাত্রা ছিল আর আর ওরা ভেবেছে এই প্লাবনের কারণেই বুঝি জ¦রটা এসেছে। গত মঙ্গলবার থেকে পৃথিবীটা যেন মুখ ভার করে আছে। আকাশ আর সাগর ধূসর-ছাইরঙা মেঘে একাকার হয়ে গিয়েছে আর সৈকতের বালু, যেগুলো মার্চের রাতে চূর্ণবিচূর্ণ আলোর মতো চিকচিক করত, সেগুলো কাদা আর পচা শামুকের থকথকে ঝোলে পরিণত হয়েছে। দুপুরবেলায় সূর্যের আলো এতই মিটমিটে হয়ে গেল যে, পেলোয়ো যখন সাগরে কাকড়াগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়ার পর বাড়ি ফিরে আসছিল, উঠোনের পিছনে কী যেন একটা নড়াচড়া করছে আর ব্যথায় কাতরাচ্ছে সেটা দেখা ওর পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ওকে খুব কাছে কাছে গিয়ে দেখতে হলো, ওটা আসলে এক থুত্থুরে বুড়ো মানুষ, যিনি কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন, অনেক চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারছেন না, তাঁর বিশাল ডানা দুটোয় বাধা পাচ্ছেন বলে।
দুঃস্বপ্নের মতো ওই ঘটনায় হকচকিয়ে গিয়ে পেলায়ো দৌড়ে গেল ওর বউ এলিসেন্দাকে খুঁজতে, যে ওদের অসুস্থ শিশুটিকে জলপট্টি দিচ্ছিল, এবং ও তাকে পিছনের উঠোনে টেনে নিয়ে এলো। ওরা দুজনেই পড়ে থাকা দেহটির দিকে নিঃশব্দে অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইল। মানুষটির পোশাক আশাক অনেকটা ন্যাকড়া কুড়ানীর মতো। তাঁর টেকো মাথার খুলিতে ক’টা মাত্র ধূসর চুল পড়ে আছে এবং মুখে দু চারটি দাঁত, আর ভিজে শপশপে পরদাদার মতো করুণ হাল দেখে মনে হবে এ বয়সে তাঁর যে রকম ঠাটবাট থাকার কথা সে রকমটি নেই। বুড়ো মানুষটির বিশাল বাজপাখির মতো নোংরা এবং অর্ধ-পালক ওঠা ডানাদুটো যেন চিরতরে কাদায় আটকে গেছে। তাঁর একদম কাছে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে খুব শীঘ্রই পেলায়ো আর এলিসেন্দা ওদের বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে এবং অবশেষে তাঁকে ওদের পরিচিত বলেই মনে হয়। এরপর ওরা তাঁর সাথে কথা বলার সাহস করে উঠতে পারে, আর তিনি একজন বিদেশি নাবিকের মতো অবোধ্য স্থানীয় ভাষায় গমগম কণ্ঠে কিছু একটা বলতে লাগলেন। এভাবেই ওরা ডানার বিটকেলে ঝামেলার থেকে মুক্ত হয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি সম্ভবত ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যাওয়া বিদেশি জাহাজের এক নিসঃঙ্গ নাবিক। যাইহোক, ওরা পড়শি এক সর্বজ্ঞানী মহিলাকে ডেকে আনে তাঁকে দেখানোর জন্য, যে বুড়ো মানুষটিকে এক পলক দেখেই তাঁর জীবন, মৃত্যুর সব ইতিহাস গড়গড় করে বলে দেবে এবং ওদের যদি এ সংক্রান্ত কোনো ভুল অনুমান থাকে তবে তা ধরিয়ে দেবে।
‘উনি একজন দেবদূত’, ওদের বলা হলো। ‘উনি অবশ্যই তাঁর ছোট্ট দেবশিশুটিকে নিতে পৃথিবীতে এসেছেন, কিন্তু বেচারা এতটাই বুড়িয়ে গেছেন যে, বৃষ্টিতে মুখ থুবড়ে পড়েছেন।’
এ ঘটনার পরেরদিন সকলেই জেনে গেল যে, পেলায়োর বাড়িতে এক রক্ত-মাংসের দেবদূত বন্দী আছেন। পড়শি সর্বজ্ঞানী মহিলার রায়ের বিপরীতে, যে কজন লোক মনে করে যে তিনি আসলে স্বর্গে অন্যান্য দেবদূতদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি, তাদের অবশ্য তাঁকে গদা দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে পাঠানোর মতো কলিজায় সাহস ছিল না। পেলায়ো পুরোটা বিকেল-সন্ধ্যে চৌকিদারের গদা পাশে রেখে রান্নাঘর থেকে বুড়ো মানুষটিকে চোখে চোখে রাখে, আর রাতে ঘুমোতে যাবার আগে তাঁকে কাদা থেকে টেনেহিঁচড়ে গুণা তারের তৈরি মুরগির খাঁচায় তালাবদ্ধ করে রাখে। মাঝরাতে, বৃষ্টিটা ধরে আসার সময়েও, পেলায়ো আর এলিসেন্দা কাঁকড়া মেরে যাচ্ছিল এবং কিছুক্ষণ পরেই শিশুটি জ¦র ছাড়াই খিদে নিয়ে জেগে ওঠে। তখন ওদের মনে দয়া-মায়ার উদ্রেক হয় আর ওরা স্থির করে দেবদূতটাকে খাবার পানিসহ ভেলায় রেখে তিন দিনের একটা বিহিত করে দূর সমুদ্রে তাঁকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেবে। কিন্তু ওরা ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে উঠোনে গিয়ে দেখে, মুরগির খাঁচার সামনে পাড়া-পড়শিরা ভিড় করেছে, দেবদূতকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশায় মেতে উঠেছে, তারা তাঁর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা না দেখিয়ে তাঁর দিকে এমনভাবে খাদ্যবস্তু ছুড়ে মারছে যেন, তিনি কোনো অপার্থিব কেউ নন বরং সার্কাসের জন্তু।
পাদ্রী গনসাগা সকাল সাতটার আগেই এই অদ্ভুত খবরটা শুনে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এলেন। এরই মধ্যে কিছু উৎসুক লোকজন এসে হাজির যারা ভোরের দর্শনার্থীদের মতো অতোটা ছ্যাঁচড়ামো করছে না, বরং বন্দী বুড়ো মানুষটির ভবিষ্যতে কী গতি হতে পারে তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা কল্পনা করছে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে সহজ সরল লোকটির মনে হলো-তাঁকে পৃথিবীর নগরপিতা নামে ডাকা যেতে পারে। আর অন্যান্যরা খানিকটা অনুদার হয়ে ভাবল-বুড়োকে বড়জোর পাঁচ-তারকার প্রধান সেনাপতির পদে পদোন্নতি দেয়া যেতে পারে, যাতে আগামীতে সবক’টি যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়। এদিকে কিছু আশাবাদী বিজ্ঞলোকেরা চিন্তা করে দেখল তাঁকে দিয়ে পৃথিবীতে ডালাওলা এক জ্ঞানী মানব-সংকর করলে মন্দ হয় না, যারা এই মহাবিশে^র দ্বায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু পাদ্রী গনসাগা মশায় যাজক হবার পূর্বে শক্তসমর্থ, তাগড়া কাঠুরে ছিলেন। তিনি তারের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে, কথিত দেবদূতকে তাৎক্ষণিকভাবে জেরা করবার জন্য ধর্মীয় বিষয়গুলি মনে মনে ঝালিয়ে নিয়ে লোকজনকে খাঁচার দরজাটা খুলে দিতে বললেন, যাতে খুব কাছে থেকে বেচারা বুড়ো মানুষটিকে দেখতে পারেন; যাকে তখন ছানাপোনাদের মাঝে একমনে চেয়ে থাকা একটি জবুথবু বিশালাকৃতির মুরগির মতো দেখাচ্ছে। আর তিনি এক কোণে শুয়ে আগে যারা এসেছিল, ওদের ছুড়ে দেয়া ফলের খোসা আর সকালের নাস্তার উচ্ছিষ্টের মাঝে সূর্যালোকে মেলে দেওয়া ডানাদুটো শুকিয়ে নিচ্ছিলেন। পাদ্রী মশায় মুরগির খাঁচার ভিতরে প্রবেশ করে তাঁকে লাতিন ভাষায় শুভ সকাল বললে, পৃথিবীর চোখে তুচ্ছ, আগন্তুক এই বহিরাগত বুড়ো মানুষটি তাঁর প্রতœতাত্ত্বিক চোখদুটো তুলে তাঁর নিজের ভাষায় কিছু একটা অস্ফুটস্বরে বললেন। এই এলাকার গির্জার যাজক যখন দেখলেন বুড়ো মানুষটি না জানে ঈশ^রের ভাষা, না জানে একজন সম্মানিত যাজককে কীভাবে শুভেচ্ছা জানাতে হয়, তাতে তাঁর প্রথমেই সন্দেহ হয়, সে আসলে দেবদূত সেজে থাকা একজন প্রতারক। এরপর বুড়োর খুব কাছে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন তাঁকে দেবদূত নয় বরং বড্ড বেশি মানুষ বলে মনে হচ্ছে: তাঁর গা থেকে অসহনীয় গন্ধ বের হচ্ছে, ডানার পিছন দিকে পরজীবীর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত এবং তাঁর বড় পালকগুলো পার্থিব আলো হাওয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, তাঁর কোনো কিছুই আর দেবদূতদের গরিমায় মাপা যায় না। তখন তিনি মুরগির খাঁচার বাইরে এলেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত ধর্মোপদেশ দিয়ে কৌতূহলী জনতাকে কোনো প্রকার ছলা-কলায় না ভোলার জন্য সাবধান করে দিলেন। তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, একজন অসতর্ক ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার জন্য বাৎসরিক কার্নিভালে শয়তানের কূটচাল চালার অভ্যেস আছে। তিনি যুক্তি দেখান, যদি ডানাটাই বাজপাখি আর উড়োজাহাজের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করার জন্য আবশ্যিক উপাদান না হয়ে থাকে, তবে একজন দেবদূত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটির ভূমিকা বরং আরো কম হওয়া উচিত। তৎসত্ত্বেও, প্রতিশ্রুতি দেন, অত্র অঞ্চলের বিশপকে তিনি একটি চিঠি লিখবেন, যাতে তিনি তাঁর উপরওলাকে বিষয়টি অবগত করান, যাতে তিনি আবার স্বয়ং মহামান্য পোপকে চিঠি লিখেন, ভ্যাটিকানের সর্বোচ্চ আদালতে এতদ্সংক্রান্ত একটি রায় দেওয়ার জন্য।
তাঁর বিচক্ষণতা উপস্থিত লোকজনের ঊষর হৃদয়ে স্থান পায়। বন্দী দেবদূতের খবর এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, কয়েক ঘণ্টা পরে উঠোনে বাজারের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় এবং যে ভিড়টা পেলায়ো-এলিসেন্দ্রার বাড়িটাকে তছনছ করে ফেলেছে, সে ভিড়টাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ওদের বেয়নেট কাঁধে সেনা সদস্য ডেকে আনতে হয়। বাড়ির সমস্ত ময়লা আবর্জনার জঞ্জাল ঝেটিয়ে বিদেয় করতে গিয়ে এলিসেন্দ্রার কোমরের সব হাড় যখন একসাথে মট করে ওঠে, তখন ওর মাথায় বুদ্ধি খেলে, উঠোনে বেড়া দিয়ে দেবদূত দেখতে লোকজনের মাথাপিছু পাঁচ পয়সা আদায় করা যায়।
উৎসুক জনতা এমনকি বহুদূরের সেই মার্তিনিকা থেকে এসেছে। একটি ভ্রাম্যমাণ মেলা উপস্থিত হয় উড়ন্ত দড়াবাজিকর নিয়ে, যে লোকটি ভিড়ের মধ্য দিয়ে সাঁই সাঁই করে দ্রুত একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শূন্যে যাওয়া আসা করছিল, তবে কেউই থুত্থুরে বুড়ো মানুষটির দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছিল না, কারণ তাঁর ডানাগুলো দেবদূতের মতো তো নয়ই, বরং নাক্ষত্রিক বাদুড়ের মতো দেখতে। সুস্বাস্থ্যের খোঁজে এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা, ক্যারিবীয় অঞ্চলের পঙ্গু লোকেরা: এক দরিদ্র নারী যিনি শৈশব থেকে নিজের হৃদস্পন্দন গুনে আসছে আর সেই স্পন্দন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে; এক পর্তুগিজ লোক যে আকাশের তারার হট্টগোলের কারণে ঘুমাতে পারে না; এক স্বপ্নচর ব্যক্তি, যে দিনে জেগে থাকার সময়ে যা করে, সেগুলো ভ-ুল করার জন্য রাতে ঘুমের ঘোরে জেগে উঠে দাঁড়ায়; এছাড়া অনেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব ব্যামো নিয়ে এসেছে। সর্বনাশা পৃথিবীটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে যে জাহাজডুবির অনাসৃষ্টি, সেই দৈবদুর্বিপাকের মাঝেও পেলায়ো আর এলিসেন্দা প্রচ- অবসাদ সত্ত্বেও সুখী ছিল, কারণ সপ্তাহ না ঘুরতেই ওরা ওদের সবক’টি ঘর গাদা করা অর্থ-কড়িতে ভরে ফেলেছে এবং দেবদূতের সামনে দর্শনার্থী তীর্থযাত্রীদের লম্বা সারি দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে।
দেবদূতই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর নিজের নাট্যাঙ্কে অভিনয় করেননি। তিনি তাঁর সময়টা তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত কুক্কুট নীড়ে পিলসুজের বাতি আর লোকজনের রাখা তন্ত্রমন্ত্রের মোমের আলোয় নরকতুল্য গরমে বিভ্রান্তের ন্যায় আরাম খোঁজার চেষ্টা করেছেন। শুরুতে ওরা তাঁকে সবজান্তা পড়শি মহিলার জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ মোতাবেক দেবদূতদের খাবার হিসেবে কিছু কর্পূরের স্ফটিক খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওগুলো তিনি হেলায় সরিয়ে রাখেন, ঠিক তেমনিভাবে পোপের ভোজ থেকে অনুতাপীদের আনা খাবারও দূরে ঠেলে দিয়েছেন, আর শেষমেশ তিনি কিনা খেলেন বেগুন ঘণ্ট, সেটা কি তিনি দেবদূত ব’লে নাকি বয়সের কারণে, সেটি অবশ্য কেউ কখনোই খুঁজে বের করেনি। তাঁর একমাত্র অপার্থিব গুণ বোধকরি তাঁর অসীম ধৈর্য্য। বিশেষ করে প্রথম ক’দিন, যখন মুরগিগুলো তাঁর ডানায় নাক্ষত্রিক পরজীবীদের খোঁজে ঠোকর দিত, আর বিকলাঙ্গরা পালক ধরে টানাটানি করত তাঁর ক্ষতস্থান স্পর্শ করার জন্য, এবং এমনকি খুব দয়ালু লোকেও তাঁর দিকে পাথর ছুড়ে মারত, যাতে তিনি উঠে দাঁড়ান আর তারা তাঁকে সে অবস্থায় দেখতে পায়। তারা তাঁকে একবারই উঠাতে সফল হয়, যখন তারা পশুর দেহে মার্কা মারার তপ্ত লৌহখ- দিয়ে তাঁর পাশর্^দেশ ছ্যাঁকা দেয়, কারণ তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেরকম নড়চড়বিহীন ছিলেন, তারা ভেবেছিল তিনি বুঝি মারা গেছেন। তিনি আচমকা জেগে উঠে তারস্বরে দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে থাকেন আর চোখভরা জল নিয়ে বারকয়েক ডানাদুটো ঝাপটান, যার ফলে মুরগির বিষ্ঠার ঘূর্ণিবায়ু ওঠে এবং চন্দ্রধূলি ব্যথার প্রবল বাতাস তোলে, যেগুলোকে ঠিক এই পৃথিবীর ব’লে মনে হয় না। যদিও অনেকের মনে হয়েছে, তাঁর এই প্রতিক্রিয়া ঠিক ব্যথার নয়, বরং ক্রোধ হতে পারে, তাই তখন থেকে তারা তাঁকে বিরক্ত না করার ব্যাপারে সাবধান হয়ে যায়। কারণ এদের অধিকাংশই বুঝে গেছে তাঁর নিস্ক্রিয়তার মানে এই নয় যে, এক উপদেবতা বিশ্রাম নিচ্ছেন বরং আকস্মিক বিপদের আগে তিনি থম মেরে আছেন।
পাদ্রী গনসাগা গৃহ পরিচারিকাদের সামাল দেওয়ার সূত্রটি মেনে, শেষ পর্যন্ত বন্দীর ধরন কী হবে সে রায় না আসা অব্দি জনতার ছেলেমানুষিতে রাশ টেনে ধরেন। কিন্তু রোম থেকে চিঠি আসার কোনো প্রকার ত্বরা দেখা যাচ্ছে না। ওরা সময় ক্ষেপণ করছে বন্দী ব্যক্তিটির নাভি আছে কিনা, তাঁর মুখের ভাষার সাথে সিরিয়া-দেশীয় ভাষার মিল আছে কিনা, একটি আলপিনের মাথায় বহুবার বসতে পারে কিনা, নাকি সে নিতান্তই নরওয়ের ডানাওলা কোনো লোক- এইসব মামুলি বিষয় জানতে চেয়ে। ওইসব ফালতু চিঠিপত্র চালাচালি যেন শতাব্দীর শেষ অবধি চলতেই থাকবে, যদ্দিন না একটি দৈব ঘটনা যাজকের কঠোর দুর্দশার অবসান ঘটায়।
তখনকার দিনে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ মেলার আকর্ষণ বাড়াতে অলৌকিক ঘটনার প্রদর্শনীতে এক নারীকে আনা হতো, যে অল্পবয়সে বাবা-মা’র অবাধ্য হবার কারণে মাকড়সায় পরিণত হয়েছে, তাকে দর্শনের প্রবেশাধিকার মূল্য দেবদূতটির চেয়ে শুধু কমই ছিল না, বরং লোকজন তাকে তার এই কিম্ভূতকিমাকার দশা সম্পর্কে উল্টা-পাল্টা যে কোনো ধরনের প্রশ্নই করতে পারত। এমনকি তার এই ভৌতিক অবস্থার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হবার জন্য তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবটুকুই পরখ করে দেখতে পারত। নারীটি ছিল ভয়ানক বিষাক্ত মাকড়সা, তার আকৃতি ভেড়ার মতো, আর মুখখানা যেন এক বিষণœ পরিচারিকার। যে ব্যাপারটি ছিল সবচেয়ে হৃদয়বিদারক, তা তার ওই উদ্ভট আকৃতি নয়, বরং নিজের দুর্ভাগ্য বর্ণনায় নিদারুণ পরিতাপ: অনেক আগে, সে যখন নিছকই নাবালিকা, তখন বাড়ি থেকে চুপিসারে বের হয়ে একটি নাচের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, আর পিতামাতার অনুমতি ছাড়াই সারারাত নাচানাচি করে সে যখন বনের ভিতর দিয়ে আসছিল, একটি ভয়ঙ্কর আকস্মিক বজ্রপাত আকাশটাকে চিরে দু’টুকরা করে। আর সেই চেরা অংশ থেকে চলে আসা গন্ধকের আলো ঝলকানি তাকে মাকড়সায় পরিণত করে। এখন তার একমাত্র আহার্যবস্তু বলতে কারো নিছক দয়া দেখিয়ে তার মুখে ছুড়ে দেয়া মাংসের কোপ্তা। মানবীয় সত্য এবং ভীতিপ্রদ শিক্ষা সমেত এহেন প্রদর্শনী, ওই দাম্ভিক দেবদূত, যাকে খুব কমই মর্তের কারো মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাঁর প্রদর্শনীকে ধরাশায়ী করতে বাধ্য। এছাড়া, দেবদূতের মাঝে এমন কোনো অলৌকিক কিছু অবলোকন করা যায় না, যেমনটি ঘটেছে এক অন্ধলোকের ক্ষেত্রে, যে দৃষ্টি ফিরে না পেলেও তার নতুন দাঁত গঁজিয়েছে, অথবা সেই বাতব্যাধিগ্রস্ত লোক, যে হাঁটতে পারেনি, তবে প্রায় সবক’টি লটারিতে জিতেছে, এমনকি সেই কুষ্ঠ রোগী, যার শরীরের ঘাঁয়ে সূর্যমুখী ফুলের কুঁড়ি গজিয়েছে। ওইসব সান্ত¡নামূলক অলৌকিক ঘটনা, যেগুলো অনেকাংশেই ফালতু কিসিমের, সেগুলো এরই মধ্যে দেবদূতের সুনাম বিনষ্ট করেছে, এবং মাকড়সায় পরিণত হওয়া নারীটি এসে তাঁর অবশিষ্ট মহিমাটুকু গুঁড়িয়ে দেয়। এতেই পাদ্রী গনসাগা অনিদ্রারোগ থেকে চিরতরে মুক্তি পেলেন এবং পেলায়োর উঠোনটা সেই অতীত দিনের মতো শূন্য হয়ে গেল, যখন টানা তিনদিন ঝুম বৃষ্টি পড়েছিল আর শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে কাঁকড়া হেঁটে বেড়াচ্ছিল।
বাড়ির মালিক পেলায়ো-এলিসেন্দ্রার অবশ্য বিলাপ করার কোনো কারণ ছিল না। যে পরিমাণ টাকা গচ্ছিত হয়েছে, তা দিয়ে ঝুল বারান্দাসহ এক দোতলা অট্টালিকা গড়া হয়েছে, উঁচু তারের জাল দিয়ে বাগান ঘেরা হয়েছে শীতকালে অবাধে কাঁকড়ার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে; আর জানালাগুলোতে লোহার শিক আঁটা হয়েছে, যাতে আর কোনো দেবদূত-টেবদূত সেখানে আর প্রবেশ করতে না পারে। পেলায়ো শহরের কাছাকাছি একটি খরগোশের খামার তৈরি করে চৌকিদারের কাজটা চিরদিনের জন্য ছেড়ে দেয়, আর এদিকে এলিসেন্দা ক’টা উচু হিল তোলা স্যাটিনের পাম্প-সু আর ঝলমলে রঙ বদলায় এমন রেশমী কাপড়ের জামা কিনে আনে, যেগুলো তখনকার দিনে সমাজের উঁচুতলার নারীদের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত রোববারের পোশাক ছিল। মুরগির খাঁচাটাই ছিল একমাত্র জিনিস যেটি কারো দৃষ্টিতে পড়েনি। যদিও প্রায়শ এটি কয়লা-আলকাতরার গাজন দিয়ে ধোয়া হতো আর এর ভেতরে গন্ধরস ধূপ পুড়িয়ে চোখের জল ঝরাত, তবে কাজটা করা হতো দেবদূতকে সম্মান দেখানোর জন্য নয়, বরং মুরগির বিষ্ঠার পূতিগন্ধ দূর করার জন্য, যেটি এখনও অশরীরীর মতো সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আর নতুন বাড়িটিকে পুরনো দালানের মতো কেমন গুমোট করে ফেলেছে। প্রথম যেদিন বাড়ির শিশুটি হাঁটতে শেখে, ওরা সতর্ক দৃষ্টি রাখে সে যেন ভুলক্রমেও মুরগির খাঁচার সামনে না যায়। এরপর ওদের ভয় চলে গেল এবং দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হতে লাগল, আর বাচ্চাটির দ্বিতীয় দাঁত ওঠার আগেই সে মুরগির খাঁচার ভিতরে খেলতেও চলে গেল, যেখানে লোহার তারগুলো খসে খসে পড়ছে। দেবদূত অবশ্য বাচ্চাটির ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় উদাসীন ছিলেন না, তবে তিনি কুকুরের মতো ধৈর্য্য নিয়ে ওর দুষ্টুমি আর অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাদের দুজনেরই একই সময়ে জলবসন্ত হলো। ডাক্তার সাহেব, যিনি বাচ্চাটির চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন, তিনি দেবদূতেরও হৃদস্পন্দন শোনার লোভ সামলাতে পারেননি এবং তিনি তাঁর হৃৎপি-ে এত বেশি বাঁশির মতো ঘড়ঘড়ে আওয়াজ, আর কিডনিতে খুটখুট শব্দ শুনেছেন যে, তাঁর মনে হচ্ছিল, তাঁর বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। যেটি তাঁকে সবচেয়ে অবাক করে তা হলো, তাঁর দুটো ডানা থাকার যৌক্তিকতা। ওগুলো তাঁর মানব শরীরে এত বেশি স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল যে, তিনি বুঝে উঠতেই পারছিলেন না অন্য পুরুষ মানুষদেরও কেন ডানা নেই।
রোদ-বৃষ্টিতে মুরগির খাঁচা ভেঙ্গে পড়ার কিছুদিন পর বাচ্চাটি স্কুলে যেতে শুরু করে। আর বুড়ো দেবদূত মরণাপন্ন পথ হারা লোকের মতো নিজের দেহখানা বাড়ির এখানে-সেখানে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। স্বামী-স্ত্রী তাঁকে শোবার ঘর থেকে ঝাঁটা মেরে তাড়িয়ে দিলে, তিনি পরক্ষণে নিজেকে রান্নাঘরে দেখতে পান। তাকে একই সময় এত জায়গায় দেখা গেল যে, ওদের মনে হতে লাগল বুড়ো মানুষটি বুঝি নিজের অনেকগুলি নকল সংস্করণ তৈরি করেছেন, আর রেগে-মেগে কাই হয়ে এলিসেন্দা এমন ভাবে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিল যেন ও দেবদূতে পরিপূর্ণ এক বীভৎস নরকে বসবাস করছে। তিনি প্রায় খেতে-টেতে পারতেন না আর তাঁর প্রতœতাত্ত্বিক চোখ দুটো এতোটাই ঝাপসা হয়ে গেছে যে, তিনি বাড়ির থামে থামে ধাক্কা খেতে লাগলেন। সে সময় তিনি যা ফেলে গেলেন, তা হলো তাঁর ডানার শেষ পালকটির খালি নল। পেলায়ো একটা কম্বল তাঁর দিকে ছুড়ে দেয় এবং দয়া দেখিয়ে তাঁকে বাড়ির চালার নিচে ঘুমাতে দেয়, আর তখনই ওরা খেয়াল করে তাঁর রাতভর জ¦র ছিল, আর তিনি বিকারগ্রস্ত নরওয়ের বুড়ো মানুষের মতো একই কথার দ্রুত পুনরাবৃত্তি করে প্রলাপ বকছিলেন। ক্ষণিকের তরে ওরা বিপদাশঙ্কায় কুঁকড়ে ওঠে, কারণ ওদের মনে হচ্ছিল, বুড়োটা বুঝি মরতে বসেছে আর এদিকে সর্বজ্ঞানী পড়শি মহিলাটিও ওদের বলে দেয়নি মরা দেবদূতদের নিয়ে কী করতে হয়।
তবে তিনি নিদারুণ শীতে কেবল টিকেনইনি, বরং মনে হলো বসন্তের আগমনে প্রথম রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে তাঁর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হতে শুরু করেছে। তিনি ক’দিনের জন্য উঠোনের দূরবর্তী কোণে স্থানুর হয়ে বসে রইলেন, যেখানে কেউ তাঁকে দেখতে পাবে না, এবং ডিসেম্বরের শুরুতে তাঁর ডানায় কিছু বড় বড় শক্তপোক্ত পালক জন্মাতে শুরু করে, যেন একটি কাকতাড়–য়ার পালক, যেটি দেখতে অনেকটা অন্য কোনো জরাগ্রস্ত লোকের দুর্দশার মতো। কিন্তু তিনি অবশ্যই তাঁর দেহের এই পরিবর্তনের কারণ জানতেন, কারণ তিনি অতি সতর্ক ছিলেন, কেউ যাতে সেগুলো দেখতে না পায়, কেউ যাতে সাগরের মল্লার সেই গান শুনতে না পায়, যে গান তিনি কখনো সখনো তারা ভরা আকাশের নিচে বসে গেয়ে থাকেন। এক সকালে, এলিসেন্দা দুপুরের খাবারের জন্য কিছু চাক চাক করে পেঁয়াজ কাটছিল, তখন ওর মনে হলো একটি ঝড়ো হাওয়া দূরের সাগর থেকে ঝট করে রান্নাঘরে এসে পড়ল। তখন ও জানালার কাছে গেল এবং পরম বিস্ময়ের সাথে বুড়ো দেবদূতকে উড়ে যাওয়ার প্রথম প্রচেষ্টারত অবস্থায় দেখল। এতই এলোমেলোভাবে বুড়ো কা-টি করতে যাচ্ছিল যে তাঁর আঙ্গুলের নখ সব্জি বাগানে লাঙ্গলরেখা তৈরি করেছে, এবং আলোয় ছিটকে পড়া বাতাসে বেয়াড়া পাখা ঝাপটাতে গিয়ে উঠোনের চালাঘরটা প্রায় ভেঙ্গেই ফেলছিলেন। কিন্তু তিনি উড়তে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত। এলিসেন্দা মুক্তির একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে, ওর নিজের জন্য এবং বুড়ো মানুষটির জন্যও বটে, যখন তাঁকে ও এ গাঁয়ের শেষ বাড়িটার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখল, বুড়ো শকুনের মতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে পক্ষপূট নেড়ে নেড়ে। ও তাকে দেখতেই লাগল, এমনকি যখন ও পেঁয়াজ কেটেই যাচ্ছে, ততক্ষণ ও চেয়ে রইল- যতক্ষণ না পর্যন্ত আর ওর পক্ষে তাঁকে দেখা সম্ভব নয়। কারণ তিনি তখন আর ওর জীবনের বিপত্তির কোনো কারণ নয়, বরং সাগরের দিকচক্রাবালে আঁকা একটি বিন্দুমাত্র।