নেহাল আহমেদ
শীতের রাত। কুয়াশা ঢাকা ভোরের রাত্রে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। শুধু একটি চায়ের দোকান খোলা আছে। টিমটিমে কেরোসিনের কুপিটা ঘন কুয়াশা ভেদ করে অনুজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। এখনো ভোর হয়নি, চারটা বাজে। হঠাৎ ঝকঝক শব্দে ট্রেনটা দাড়িঁয়ে পড়ে স্টিশনে। পরের ট্রেনটা আসলে এটা ছাড়বে। আমি অন্য ট্রেনের অপেক্ষায়। কাধেঁ ব্যাগটা ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। হাটঁতে হাটঁতে চায়ের দোকানটার ভিতরে ঢুকে পড়ি। চায়ের অর্ডার দিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে সিগারেটে আগুন জ¦ালাতে দেখি উজিয়ে এক ভদ্র মহিলার সাথে এক ভদ্রলোক দোকানে প্রবেশ করছে।
পোশাক আশাকে ভিনদেশী মনে হলো। সাহস হলো না পরিচয় জিজ্ঞেস করতে। ভদ্রলোকটিই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো- জনাব এই রাতে গ্রামে যাওয়ার কোনো বাহন পাওয়া যাবে? বললাম, ভোরের আগে কিছু পাবেন না। কোন গ্রামে যাবেন? ভোর হতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।
ভদ্রলোক বলল, তা হলে তো এখানে বসতে হয়। বসতে পারি? চা চলবে? আমি চায়ের কথা বলেছি আপনার লাগলে বলছি দুজনে খাবেন তো? চিনি চলবে?
আমার চিনি চলবে, ভদ্র মহিলা চিনি খান না।
চাওয়ালাকে বললাম, ভাই, আরো দুটো চা দেন, একটায় চিনি দিবেন না। সেই চিনিটা আমার টার সাথে যুক্ত করে দিবেন। ভদ্রলোক মনে হয় মজা পেলো। বলল, এই বয়সে চিনি কম খাওয়া ভালো। এনিওয়ে আমি নিখিলেশ আর ইনি হচ্ছেন আমার স্ত্রী শ্রাবণী।
বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো, শ্রাবণী নামটা শুনে।
সেই কবেকার কথা! তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। আমাদের পাড়ায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই বেশি। ছোট্টবেলায় বেশ নাদুস নুদুস ছিলাম। ছোট বড় সবাই গাল টিপে দিতো। তখন আমরা গোল্লাছুট, পলান টুকু বউছি খেলতাম। বেশি মজার ছিলো বিয়ে বিয়ে খেলা। কলাপাতার ঘর, মাটি দিয়ে পোলাও, ফল দিয়ে নানান ধরনের মিথ্যা খাবার তৈরি করতাম। মেয়েরা ওড়না পেচিঁয়ে বৌ সাজত, রঙ্গিন কাগজ দিয়ে লিপিস্টিক, পুইঁশাকের পাকা ফল দিয়ে আলতা সাজাতো। বেশির ভাগ সময়ে আমাকে বর সাজতে হতো। বিয়ের পর খাওয়াদাওয়া শেষে সন্ধ্যার একটু আগে যে যার বাড়ি দে ছুট। মাগরিবের আজানের আগেই ঘরে ফিরতে হবে।
কী মশাই, কিছু ভাবছেন? আপনার নামটা তো জানা হলো না। আমার উত্তর দেবার আগেই ভদ্র মহিলা বলে বসলো, ও হচ্ছে অমিত। আমাদের পাড়ায় সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে।
আমাকে চিনতে পারছিস না। পুঁজার ছুটিতে গ্রামে এলাম। চিনবার কথা নয়। বল তো, কত বছর হবে? প্রায় ২০ বছর। তোর কিন্তু তেমন পরিবর্তন হয়নি।
মহিলার গলায় কী যেন আছে। কথা বলায় মনে হলো সাগরের তরঙ্গের মতোসপ্তসুরের রিনিঝিনি শব্দ। আমার মোহগ্রস্ততা না কাটতেই আবার বললো, নিখিলেশ অমিত হচ্ছে আমার প্রথম স্বামী। অমিতের বৌ হওয়ার জন্য আমরা সব মেয়েরা প্রতিযোগিতা করতাম। কী রে অমিত আমাকে চিনতে পারছিস? পৃথিবীতে যে কত বিস্ময় আছে! আমি যেন মুহূর্তে পাথর হয়ে গেলাম! এই কি আমার পুতুল খেলার সাথী! শ্রাবণী কত সুন্দর হয়েছে! ঠিক যেন প্রতিমা! ঈশ্বর নিজ হাতে বানিয়েছে!
আমাদের পাড়ার পলান পাল সবচেয়ে ভাল প্রতিমা তৈরি করে। পলান পালের প্রতিমা দেখে চোখ ফেরানো যেত না। মনে হচ্ছে শ্রাবণীকে পলান পাল তৈরি করেছে। কোনো রকম ধাতস্থ হয়ে বললাম, তুই শ্রাবণী? গ্রীবাটা অদ্ভুতভাবে বাঁকিয়ে বললো, হা মহাশয় আমি শ্রাবণী। তোর ছোট্টবেলার খেলার সাথী।
শ্রাবণীর স্বামীর চেহারা হঠাৎ করে লাল হয়ে উঠলো। তার পর হো হো করে হেসে বললো, হা ঈশ্বর ছোট্টবেলার কত কিছু মিস করেছি। বিদেশে বেড়ে ওঠার কারণে গ্রামের কোনো স্বাদই পাইনি। আপনি খুব ভাগ্যবান অমিত বাবু!
মনে মনে বললাম, হ্যাঁ, সত্যি আমি ভাগ্যবান! ছোট্টবেলায় বাবা মারা যায়। কত কষ্টে মা আমাকে মানুষ করেছে। তার জন্য এ দ্বারে ও দ্বারে কত জায়গায় ঘুরেছি। আসলে বিপদে পড়লে মানুষ বড় একা হয়ে যায়। এখনো একাকিত্বই বয়ে বেড়াচ্ছি।
- কিছু ভাবছেন অমিত বাবু?
- হ্যাঁ, পৃথিবীতে কত আশ্চর্য রকম ঘটনা ঘটে। এই যে আপনার সাথে দেখা হলো।
- কোথায় যাচ্ছেন?
- কাজের সন্ধানে। দেখি শহরে কোনো কাজটাজ পাই কিনা।
শ্রাবণী এগিয়ে এলো। বিশ বছর পর গ্রামে আসছি। আর তুই গ্রামের বাইরে যাচ্ছিস। না না, তা হবে না। পুরো গ্রাম আমাকে নিয়ে ঘুরতে হবে।আমরা যে কয়দিন থাকবো তোকে থাকতে হবে। না বললে চলবে না। নিখিলেশ এসে বলল, ঠিকই তো বলেছে শ্রাবণী। আপনার কোথাও যাওয়া হবে না। কাজের একটা ব্যবস্থা সে হয়ে যাবে। দূর থেকে অন্য ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এসে পড়বে।
মাথার মধ্যে কে যেন আমাকে তাড়া দিচ্ছে! কে যেন বলছে, তোমাকে যে যেতেই হবে! কে যেন বলছে কাজ না করলে খাবে কী? কাল মহালয়া। মহলয়ায় আমি আর শ্রাবণী ভোরে বীরেন কাকুর মন্ত্রপাঠ শুনতাম। মাঝে মাঝে শ্রাবণীকে দেখে চমকে উঠতাম! প্রতিমার কোনো ছায়া ওর চেহারার মধ্যে কাজ করে। সেই প্রতিমাকে এত বছর পর পেয়েও আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। সবার জীবনে বোধন আসে না। বিসর্জনটাই স্থায়ী হয়ে যায়। ট্রেনের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে! কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটছে আমার মধ্যে! আমার চোখটা যেন পাথর হয়ে যাচ্ছে।
নেহাল আহমেদ
বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
শীতের রাত। কুয়াশা ঢাকা ভোরের রাত্রে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। শুধু একটি চায়ের দোকান খোলা আছে। টিমটিমে কেরোসিনের কুপিটা ঘন কুয়াশা ভেদ করে অনুজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। এখনো ভোর হয়নি, চারটা বাজে। হঠাৎ ঝকঝক শব্দে ট্রেনটা দাড়িঁয়ে পড়ে স্টিশনে। পরের ট্রেনটা আসলে এটা ছাড়বে। আমি অন্য ট্রেনের অপেক্ষায়। কাধেঁ ব্যাগটা ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। হাটঁতে হাটঁতে চায়ের দোকানটার ভিতরে ঢুকে পড়ি। চায়ের অর্ডার দিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে সিগারেটে আগুন জ¦ালাতে দেখি উজিয়ে এক ভদ্র মহিলার সাথে এক ভদ্রলোক দোকানে প্রবেশ করছে।
পোশাক আশাকে ভিনদেশী মনে হলো। সাহস হলো না পরিচয় জিজ্ঞেস করতে। ভদ্রলোকটিই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো- জনাব এই রাতে গ্রামে যাওয়ার কোনো বাহন পাওয়া যাবে? বললাম, ভোরের আগে কিছু পাবেন না। কোন গ্রামে যাবেন? ভোর হতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।
ভদ্রলোক বলল, তা হলে তো এখানে বসতে হয়। বসতে পারি? চা চলবে? আমি চায়ের কথা বলেছি আপনার লাগলে বলছি দুজনে খাবেন তো? চিনি চলবে?
আমার চিনি চলবে, ভদ্র মহিলা চিনি খান না।
চাওয়ালাকে বললাম, ভাই, আরো দুটো চা দেন, একটায় চিনি দিবেন না। সেই চিনিটা আমার টার সাথে যুক্ত করে দিবেন। ভদ্রলোক মনে হয় মজা পেলো। বলল, এই বয়সে চিনি কম খাওয়া ভালো। এনিওয়ে আমি নিখিলেশ আর ইনি হচ্ছেন আমার স্ত্রী শ্রাবণী।
বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো, শ্রাবণী নামটা শুনে।
সেই কবেকার কথা! তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। আমাদের পাড়ায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই বেশি। ছোট্টবেলায় বেশ নাদুস নুদুস ছিলাম। ছোট বড় সবাই গাল টিপে দিতো। তখন আমরা গোল্লাছুট, পলান টুকু বউছি খেলতাম। বেশি মজার ছিলো বিয়ে বিয়ে খেলা। কলাপাতার ঘর, মাটি দিয়ে পোলাও, ফল দিয়ে নানান ধরনের মিথ্যা খাবার তৈরি করতাম। মেয়েরা ওড়না পেচিঁয়ে বৌ সাজত, রঙ্গিন কাগজ দিয়ে লিপিস্টিক, পুইঁশাকের পাকা ফল দিয়ে আলতা সাজাতো। বেশির ভাগ সময়ে আমাকে বর সাজতে হতো। বিয়ের পর খাওয়াদাওয়া শেষে সন্ধ্যার একটু আগে যে যার বাড়ি দে ছুট। মাগরিবের আজানের আগেই ঘরে ফিরতে হবে।
কী মশাই, কিছু ভাবছেন? আপনার নামটা তো জানা হলো না। আমার উত্তর দেবার আগেই ভদ্র মহিলা বলে বসলো, ও হচ্ছে অমিত। আমাদের পাড়ায় সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে।
আমাকে চিনতে পারছিস না। পুঁজার ছুটিতে গ্রামে এলাম। চিনবার কথা নয়। বল তো, কত বছর হবে? প্রায় ২০ বছর। তোর কিন্তু তেমন পরিবর্তন হয়নি।
মহিলার গলায় কী যেন আছে। কথা বলায় মনে হলো সাগরের তরঙ্গের মতোসপ্তসুরের রিনিঝিনি শব্দ। আমার মোহগ্রস্ততা না কাটতেই আবার বললো, নিখিলেশ অমিত হচ্ছে আমার প্রথম স্বামী। অমিতের বৌ হওয়ার জন্য আমরা সব মেয়েরা প্রতিযোগিতা করতাম। কী রে অমিত আমাকে চিনতে পারছিস? পৃথিবীতে যে কত বিস্ময় আছে! আমি যেন মুহূর্তে পাথর হয়ে গেলাম! এই কি আমার পুতুল খেলার সাথী! শ্রাবণী কত সুন্দর হয়েছে! ঠিক যেন প্রতিমা! ঈশ্বর নিজ হাতে বানিয়েছে!
আমাদের পাড়ার পলান পাল সবচেয়ে ভাল প্রতিমা তৈরি করে। পলান পালের প্রতিমা দেখে চোখ ফেরানো যেত না। মনে হচ্ছে শ্রাবণীকে পলান পাল তৈরি করেছে। কোনো রকম ধাতস্থ হয়ে বললাম, তুই শ্রাবণী? গ্রীবাটা অদ্ভুতভাবে বাঁকিয়ে বললো, হা মহাশয় আমি শ্রাবণী। তোর ছোট্টবেলার খেলার সাথী।
শ্রাবণীর স্বামীর চেহারা হঠাৎ করে লাল হয়ে উঠলো। তার পর হো হো করে হেসে বললো, হা ঈশ্বর ছোট্টবেলার কত কিছু মিস করেছি। বিদেশে বেড়ে ওঠার কারণে গ্রামের কোনো স্বাদই পাইনি। আপনি খুব ভাগ্যবান অমিত বাবু!
মনে মনে বললাম, হ্যাঁ, সত্যি আমি ভাগ্যবান! ছোট্টবেলায় বাবা মারা যায়। কত কষ্টে মা আমাকে মানুষ করেছে। তার জন্য এ দ্বারে ও দ্বারে কত জায়গায় ঘুরেছি। আসলে বিপদে পড়লে মানুষ বড় একা হয়ে যায়। এখনো একাকিত্বই বয়ে বেড়াচ্ছি।
- কিছু ভাবছেন অমিত বাবু?
- হ্যাঁ, পৃথিবীতে কত আশ্চর্য রকম ঘটনা ঘটে। এই যে আপনার সাথে দেখা হলো।
- কোথায় যাচ্ছেন?
- কাজের সন্ধানে। দেখি শহরে কোনো কাজটাজ পাই কিনা।
শ্রাবণী এগিয়ে এলো। বিশ বছর পর গ্রামে আসছি। আর তুই গ্রামের বাইরে যাচ্ছিস। না না, তা হবে না। পুরো গ্রাম আমাকে নিয়ে ঘুরতে হবে।আমরা যে কয়দিন থাকবো তোকে থাকতে হবে। না বললে চলবে না। নিখিলেশ এসে বলল, ঠিকই তো বলেছে শ্রাবণী। আপনার কোথাও যাওয়া হবে না। কাজের একটা ব্যবস্থা সে হয়ে যাবে। দূর থেকে অন্য ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এসে পড়বে।
মাথার মধ্যে কে যেন আমাকে তাড়া দিচ্ছে! কে যেন বলছে, তোমাকে যে যেতেই হবে! কে যেন বলছে কাজ না করলে খাবে কী? কাল মহালয়া। মহলয়ায় আমি আর শ্রাবণী ভোরে বীরেন কাকুর মন্ত্রপাঠ শুনতাম। মাঝে মাঝে শ্রাবণীকে দেখে চমকে উঠতাম! প্রতিমার কোনো ছায়া ওর চেহারার মধ্যে কাজ করে। সেই প্রতিমাকে এত বছর পর পেয়েও আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। সবার জীবনে বোধন আসে না। বিসর্জনটাই স্থায়ী হয়ে যায়। ট্রেনের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে! কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটছে আমার মধ্যে! আমার চোখটা যেন পাথর হয়ে যাচ্ছে।