নূরে জান্নাত
জারুল সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। শরীর শীতল করা হাওয়া বইছে। নড়ছে গাছেদের পাতা। রেললাইন ও কৃষ্ণচূড়া শোকের বিলাপ গাইছে। সে বিলাপে নেই সুর নেই শব্দ। আছে আক্ষেপ! ফয়সাল সাহেবের মাথার মধ্যে বাইকের হর্ন ট্রেনের হুইসেল আর নাকভর্তি ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ কেমন অস্বাভাবিক করে তুলছে তাকে। খুব চেষ্টা করছে নিজেকে নিজের দিকে ফেরাতে কিন্তু পারছে না। ফাৎ করে নিশ্বাস ছেড়ে উনি আবিষ্কৃত হন অফিসের কেবিনে। কাচের জানালা। একটু দূরেই কুড়িল বিশ্বরোড ঘেঁষে রেললাইনের সাথে ফুটে আছে ভয়ানক রক্তচূড়া! ফয়সাল সাহেব অবাক হন! কৃষ্ণচূড়াকে তিনি রক্তচূড়া কেন বললেন! উনার খুব ইচ্ছে করে রেললাইনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছেদের কাছে যেতে। ফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে দেখতে। কী সুখে ফুটে থাকে ফুল?কী মোহে সেখানে ছুটে যায় মানুষ? কেনইবা অবচেতনে তৈরি হয় শোক?জানতে ইচ্ছে করে!পুরো অফিস সুনসান। এরকম আগে দেখেননি। কাচের জানালা থেকে সরে এসে ডেস্কে আবার বসেন। ঘড়িতে ১১টা ৫৯। বাইরে দিনের আলো। মোবাইলে ১২টা বাজতেই পিএম-এর জায়গায় এএম দেখে ফয়সাল সাহেব কেমন একটা হয়ে যান। ব্যাগটা নিয়ে বাইরে বের হতে নিলেই অনেকগুলো ইলিশ মাছ সামনেরুপালি ঝলক দিতে দিতে ঝুলতে থাকে এবং একটি আর্ট করা রঙিন ক্যামেরাও ফ্ল্যাশ অন ফ্ল্যাশ অফ করতে থাকে।উড়তে থাকে নানান রকম ছবি। যার মধ্যে লক্ষ্মীপুর-হ লেখা একটি বাইকের নাম্বার প্লেটের ছবি বেশি চক চক করছে! ফয়সাল সাহেব আতংকিত হয়ে চোখ চেপে ধরেন নিজের দু’হাতে।
কানে ভেসে আসে...
স্যার... ও স্যার... স্যার...
ডেস্কের টেবিল থেকে মাথা তোলেন- সামনেই দাঁড়িয়ে অফিসের পিয়ন আনু। তার হাতে সুসজ্জিত মিষ্টি সেই ক্যামেরাটা। সে আবার বলে...
স্যার... আইজ বাড়ি যাইবেন না?
আনুর মুখ ও শরীর থেকে টাটকা রক্তের গন্ধ আসতে থাকে। সে যতো কথা বলে গন্ধটা ততো প্রকট হতে থাকে। ফয়সাল সাহেব আনুকে একটু দূরে সরে দাঁড়াতে বলেন। আনু আবার জিজ্ঞেস করে...
স্যার,বাড়ি যাইবেন না?
ফয়সাল সাহেব বিরক্ত হয়ে উত্তর দেন-
যাবো বৈকি। একটু কাজ ছিল। কাজ করতে করতে কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝিনি।
আনুর চোখ মুখ কেমন যেন বিকৃত হতে শুরু করে! আনুর পেছেনেই লালটুকটুকে শাড়ি পরা কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ফয়সাল সাহেব ভয় পেয়ে যান। ব্যাগ থেকে পানি বের করে কয়েক ঢোক গিলে ফেলার পর থুথু করে ফেলে দেন। পানি ইলিশ মাছের আশটের মতো গন্ধ। মুখ থেকে ছুড়ে ফেলা পানিগুলো একবার ইলিশ মাছের রুপালি আঁশ হয়ে যাচ্ছে আবার কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি আবার নানান রকম ছবি- অনেকগুলো ছবির মধ্যে ট্রেনে কাটা পড়া একটি তরুণের ছবি ভাসছে আর ছবিটি একাই কাঁদছে। ছবি কাঁদছে? আসলেই?
ফয়সাল সাহেব জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। ঠক ঠক করে কাঁপছেন উনি। আনু এগিয়ে আসে। ফয়সাল সাহেব পিছিয়ে যেতে থাকেন আর আনুকে আগাতে বারণ করেন।
আনু বলতেই থাকে...
স্যারগো... আপনে এমন করত্যাছেন কেন? আমি আনু! এই অফিসের পিয়ন। আপনেদের বিশ্বস্ত পিয়ন। স্যার আমি... আনু।
আর এই যে লাল শাড়ি পরা এডো আমার বউ। নতুন বউ। হাতের ক্যামেড়াডো রেললাইনের পাশে খুইট্যা পাছি,একখান ছবি তুইল্যা দেন না স্যার, দেন না। কাঁপা হাতে ফয়সাল সাহেব ক্যামেরাটা নেন। ছবি ক্লিক করার জন্য লেন্সের দিকে তাকালে অদ্ভুত সব চলমান দৃশ্য দেখতে পান। আনুর বউ একটি বাড়িতে কাজ করছে,হঠাৎ সেখান থেকে ছুটে বের হয়ে চলে আসে আনুর অফিসে। ফয়সাল সাহেব লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে বাস্তবে আনু ও তার স্ত্রীকে দেখে আবার লেন্সে চোখ রাখেন। আনুর স্ত্রী যে বাড়িতে কাজ করত সে সেখানেই আছে। আনুর আগের পক্ষের ছেলের বয়সী বাড়ির মালিকের ছেলে নিয়মিত আনুর স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে। ফয়সাল সাহেব মায়া নিয়ে আনুর স্ত্রীর দিকে তাকান। আনু মাথা নিচু করে সব বলতে থাকে। শেষে বলে- তাই বাধ্য হোইয়া ওরে আমার কাছে নিয়া আইলাম স্যার। দেখল্যাম অফিস যেহেতু ৩দিন ছুটি আছে ওরে এইহানেই নিয়া আসি। অফিস খুললি বড়ো স্যারেরে কয়া স্টোর রুমে ওরে নিয়া থাকার ব্যবস্থা করমু। আনু এবং তার স্ত্রী হেসে পোজ দিচ্ছে ছবি তোলার জন্য! খানিক বাদেই আনুর নতুন বউ এক থাল গরম ভাত,ভাজা ইলিশ মাছ ও শুকনো মরিচ,এক ফালি লেবু,পাতের কোনায় এক চিমটি লবণসহ প্লেট এগিয়ে দেয় ফয়সাল সাহেবের কাছে। আস্তে আস্তে বলে-
আনুর মুহে আপ্নের কতা হুনছি স্যার। আপ্নের পুরা গুষ্টি ধোইর?্যা ইলিশ পাগলা এডোও হুনছি। তাই আইজ আংগোর ইলিশ ভাত রান্ধিছি। খাইয়া যান। না কোইরেন না।
ফয়সাল সাহেব চারপাশে তাকিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক দেখতে পান- প্লেটে ভাজা ইলিশের দিকে তাকিয়ে ভাত খেতে বসে যান। গরম ভাতের সাথে ইলিশ ভাজা,সাথে শুকনো মরিচ ভাজাতে কামড়,অসম্ভব স্বাদ। এমন স্বাদ দুনিয়ায় আর কিছুই হতে পারে না। ফয়সাল সাহেব নিজের হাত এবং মুখ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ভাতের বদলে শুকনো মরিচে কামড় দিতে দিতে পাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন রক্তাক্ত কাচা ইলিশ দুইভাগ করা, বীভৎসভাবে থ্যাঁতলানো। ফয়সাল সাহেব তুমুল বেগে বমি করতে থাকেন। আনু আর আনুর নতুন বউয়ের মুখের আকৃতি বিকৃত হতে হতে বিস্ফোরকের মতো বিষ্ফোরিত হয়ে যায় তাদের গোটা শরীর। ছড়ানো ছিটানো রক্ত আর টুকরো হওয়া ইলিশ মাছ এসে পড়ে ফয়সাল সাহেবের আশেপাশে।
আনুর কণ্ঠ বাজতে থাকে...
এই মাছ কই পাওয়া যায়... মিয়া বেড়ি বাজারে মহাসড়কের পাশেই! তার পর অট্টহাসি...
ফয়সাল সাহেবের বাইক পড়ে আছে একদিকে।আরেক দিকে ইলিশ মাছের টুকরো হওয়া শরীর। ছোপ ছোপ রক্ত- যা ফয়সাল সাহেবের বাইকে এক্সিডেন্টে তারই পড়ে থাকা নিথর দেহের।
লক্ষ্মীপুর-রামগতি মহাসড়কে মিয়ার বেড়ি বাজারের পাশে পড়ে আছেন তিনি।স্ত্রী সন্তানের জন্য টাটকা ইলিশ মাছ কিনেছিলেন। ছুটিটা আনন্দে উপভোগ করবে আর ইলিস বিলাসে মাতবে ভেবে অফিস শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। মৃত্যুতে মেতে উঠবে জীবন এটা ভাবেননি। স্ত্রীর কাছে ফয়সাল সাহেবের মৃত্যুর সংবাদ পৌছাতেই তিনি পাগলিনীর মতো বিলাপ করতে আরম্ভ করেন।
মৃত্যুর এতোগুলো দিন বাদে ফয়সাল সাহেব এই কৃষ্ণচূড়ার দিনে আবার ফিরে এসেছেন। কুড়িল রেললাইনে মরে যাওয়া ফটোগ্রাফার ইসতিয়াকের মৃত্যুর সংবাদে। ফয়সাল সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে তার সাথে এটিই ঘটছে। যেখানেই রাস্তা সংক্রান্ত, এক্সিডেন্ট বা অকালমৃত্যু হয় কীভাবে কীভাবে যেন ফয়সাল সাহেব সেখানে নিজেকে খুঁজে পান, এসে যান এবং দেখতে থাকেন সব কিছু।
অফিসের আনু, তার বউ যে বাড়িতে কাজ করতো সেই বাড়ির ছোট ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দিলে তাদের গাড়ি চাপা দিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়! হয়ত এজন্যেই এভাবে দেখতে পেয়েছিলেন আনুও তার স্ত্রীকে।
ইসতিকারের সুসজ্জিত ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন ফয়সাল সাহেব। ক্যামেরায় ভেসে ওঠে পড়ে থাকা বাইকের নাম্বার প্লেটের ছবি- যেখানে লেখা- লক্ষীপুর-হ!
ফয়সাল সাহেবের মাথার মধ্যে এলোমেলো হতে থাকে। ভাসতে থাকে আনু ও তার স্ত্রীর মুখ,অফিস ডেস্ক, কুড়িল বিশ্বরোড, কৃষ্ণচূড়া, ট্রেনের হুইসেল আর ইলিশ মাছের গন্ধ! এমন কেন হচ্ছে?
কেন? হাসফাস করতে করতে কারো কান্নার আওয়াজ শুনে খেয়াল করে দেখেন- ফয়সাল সাহেব একটি ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবির মধ্যে আছেন। তারই ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে সেই ছবি, যার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে উনার প্রিয়তমা স্ত্রী!
নূরে জান্নাত
বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জারুল সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। শরীর শীতল করা হাওয়া বইছে। নড়ছে গাছেদের পাতা। রেললাইন ও কৃষ্ণচূড়া শোকের বিলাপ গাইছে। সে বিলাপে নেই সুর নেই শব্দ। আছে আক্ষেপ! ফয়সাল সাহেবের মাথার মধ্যে বাইকের হর্ন ট্রেনের হুইসেল আর নাকভর্তি ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ কেমন অস্বাভাবিক করে তুলছে তাকে। খুব চেষ্টা করছে নিজেকে নিজের দিকে ফেরাতে কিন্তু পারছে না। ফাৎ করে নিশ্বাস ছেড়ে উনি আবিষ্কৃত হন অফিসের কেবিনে। কাচের জানালা। একটু দূরেই কুড়িল বিশ্বরোড ঘেঁষে রেললাইনের সাথে ফুটে আছে ভয়ানক রক্তচূড়া! ফয়সাল সাহেব অবাক হন! কৃষ্ণচূড়াকে তিনি রক্তচূড়া কেন বললেন! উনার খুব ইচ্ছে করে রেললাইনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছেদের কাছে যেতে। ফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে দেখতে। কী সুখে ফুটে থাকে ফুল?কী মোহে সেখানে ছুটে যায় মানুষ? কেনইবা অবচেতনে তৈরি হয় শোক?জানতে ইচ্ছে করে!পুরো অফিস সুনসান। এরকম আগে দেখেননি। কাচের জানালা থেকে সরে এসে ডেস্কে আবার বসেন। ঘড়িতে ১১টা ৫৯। বাইরে দিনের আলো। মোবাইলে ১২টা বাজতেই পিএম-এর জায়গায় এএম দেখে ফয়সাল সাহেব কেমন একটা হয়ে যান। ব্যাগটা নিয়ে বাইরে বের হতে নিলেই অনেকগুলো ইলিশ মাছ সামনেরুপালি ঝলক দিতে দিতে ঝুলতে থাকে এবং একটি আর্ট করা রঙিন ক্যামেরাও ফ্ল্যাশ অন ফ্ল্যাশ অফ করতে থাকে।উড়তে থাকে নানান রকম ছবি। যার মধ্যে লক্ষ্মীপুর-হ লেখা একটি বাইকের নাম্বার প্লেটের ছবি বেশি চক চক করছে! ফয়সাল সাহেব আতংকিত হয়ে চোখ চেপে ধরেন নিজের দু’হাতে।
কানে ভেসে আসে...
স্যার... ও স্যার... স্যার...
ডেস্কের টেবিল থেকে মাথা তোলেন- সামনেই দাঁড়িয়ে অফিসের পিয়ন আনু। তার হাতে সুসজ্জিত মিষ্টি সেই ক্যামেরাটা। সে আবার বলে...
স্যার... আইজ বাড়ি যাইবেন না?
আনুর মুখ ও শরীর থেকে টাটকা রক্তের গন্ধ আসতে থাকে। সে যতো কথা বলে গন্ধটা ততো প্রকট হতে থাকে। ফয়সাল সাহেব আনুকে একটু দূরে সরে দাঁড়াতে বলেন। আনু আবার জিজ্ঞেস করে...
স্যার,বাড়ি যাইবেন না?
ফয়সাল সাহেব বিরক্ত হয়ে উত্তর দেন-
যাবো বৈকি। একটু কাজ ছিল। কাজ করতে করতে কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝিনি।
আনুর চোখ মুখ কেমন যেন বিকৃত হতে শুরু করে! আনুর পেছেনেই লালটুকটুকে শাড়ি পরা কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ফয়সাল সাহেব ভয় পেয়ে যান। ব্যাগ থেকে পানি বের করে কয়েক ঢোক গিলে ফেলার পর থুথু করে ফেলে দেন। পানি ইলিশ মাছের আশটের মতো গন্ধ। মুখ থেকে ছুড়ে ফেলা পানিগুলো একবার ইলিশ মাছের রুপালি আঁশ হয়ে যাচ্ছে আবার কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি আবার নানান রকম ছবি- অনেকগুলো ছবির মধ্যে ট্রেনে কাটা পড়া একটি তরুণের ছবি ভাসছে আর ছবিটি একাই কাঁদছে। ছবি কাঁদছে? আসলেই?
ফয়সাল সাহেব জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। ঠক ঠক করে কাঁপছেন উনি। আনু এগিয়ে আসে। ফয়সাল সাহেব পিছিয়ে যেতে থাকেন আর আনুকে আগাতে বারণ করেন।
আনু বলতেই থাকে...
স্যারগো... আপনে এমন করত্যাছেন কেন? আমি আনু! এই অফিসের পিয়ন। আপনেদের বিশ্বস্ত পিয়ন। স্যার আমি... আনু।
আর এই যে লাল শাড়ি পরা এডো আমার বউ। নতুন বউ। হাতের ক্যামেড়াডো রেললাইনের পাশে খুইট্যা পাছি,একখান ছবি তুইল্যা দেন না স্যার, দেন না। কাঁপা হাতে ফয়সাল সাহেব ক্যামেরাটা নেন। ছবি ক্লিক করার জন্য লেন্সের দিকে তাকালে অদ্ভুত সব চলমান দৃশ্য দেখতে পান। আনুর বউ একটি বাড়িতে কাজ করছে,হঠাৎ সেখান থেকে ছুটে বের হয়ে চলে আসে আনুর অফিসে। ফয়সাল সাহেব লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে বাস্তবে আনু ও তার স্ত্রীকে দেখে আবার লেন্সে চোখ রাখেন। আনুর স্ত্রী যে বাড়িতে কাজ করত সে সেখানেই আছে। আনুর আগের পক্ষের ছেলের বয়সী বাড়ির মালিকের ছেলে নিয়মিত আনুর স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে। ফয়সাল সাহেব মায়া নিয়ে আনুর স্ত্রীর দিকে তাকান। আনু মাথা নিচু করে সব বলতে থাকে। শেষে বলে- তাই বাধ্য হোইয়া ওরে আমার কাছে নিয়া আইলাম স্যার। দেখল্যাম অফিস যেহেতু ৩দিন ছুটি আছে ওরে এইহানেই নিয়া আসি। অফিস খুললি বড়ো স্যারেরে কয়া স্টোর রুমে ওরে নিয়া থাকার ব্যবস্থা করমু। আনু এবং তার স্ত্রী হেসে পোজ দিচ্ছে ছবি তোলার জন্য! খানিক বাদেই আনুর নতুন বউ এক থাল গরম ভাত,ভাজা ইলিশ মাছ ও শুকনো মরিচ,এক ফালি লেবু,পাতের কোনায় এক চিমটি লবণসহ প্লেট এগিয়ে দেয় ফয়সাল সাহেবের কাছে। আস্তে আস্তে বলে-
আনুর মুহে আপ্নের কতা হুনছি স্যার। আপ্নের পুরা গুষ্টি ধোইর?্যা ইলিশ পাগলা এডোও হুনছি। তাই আইজ আংগোর ইলিশ ভাত রান্ধিছি। খাইয়া যান। না কোইরেন না।
ফয়সাল সাহেব চারপাশে তাকিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক দেখতে পান- প্লেটে ভাজা ইলিশের দিকে তাকিয়ে ভাত খেতে বসে যান। গরম ভাতের সাথে ইলিশ ভাজা,সাথে শুকনো মরিচ ভাজাতে কামড়,অসম্ভব স্বাদ। এমন স্বাদ দুনিয়ায় আর কিছুই হতে পারে না। ফয়সাল সাহেব নিজের হাত এবং মুখ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ভাতের বদলে শুকনো মরিচে কামড় দিতে দিতে পাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন রক্তাক্ত কাচা ইলিশ দুইভাগ করা, বীভৎসভাবে থ্যাঁতলানো। ফয়সাল সাহেব তুমুল বেগে বমি করতে থাকেন। আনু আর আনুর নতুন বউয়ের মুখের আকৃতি বিকৃত হতে হতে বিস্ফোরকের মতো বিষ্ফোরিত হয়ে যায় তাদের গোটা শরীর। ছড়ানো ছিটানো রক্ত আর টুকরো হওয়া ইলিশ মাছ এসে পড়ে ফয়সাল সাহেবের আশেপাশে।
আনুর কণ্ঠ বাজতে থাকে...
এই মাছ কই পাওয়া যায়... মিয়া বেড়ি বাজারে মহাসড়কের পাশেই! তার পর অট্টহাসি...
ফয়সাল সাহেবের বাইক পড়ে আছে একদিকে।আরেক দিকে ইলিশ মাছের টুকরো হওয়া শরীর। ছোপ ছোপ রক্ত- যা ফয়সাল সাহেবের বাইকে এক্সিডেন্টে তারই পড়ে থাকা নিথর দেহের।
লক্ষ্মীপুর-রামগতি মহাসড়কে মিয়ার বেড়ি বাজারের পাশে পড়ে আছেন তিনি।স্ত্রী সন্তানের জন্য টাটকা ইলিশ মাছ কিনেছিলেন। ছুটিটা আনন্দে উপভোগ করবে আর ইলিস বিলাসে মাতবে ভেবে অফিস শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। মৃত্যুতে মেতে উঠবে জীবন এটা ভাবেননি। স্ত্রীর কাছে ফয়সাল সাহেবের মৃত্যুর সংবাদ পৌছাতেই তিনি পাগলিনীর মতো বিলাপ করতে আরম্ভ করেন।
মৃত্যুর এতোগুলো দিন বাদে ফয়সাল সাহেব এই কৃষ্ণচূড়ার দিনে আবার ফিরে এসেছেন। কুড়িল রেললাইনে মরে যাওয়া ফটোগ্রাফার ইসতিয়াকের মৃত্যুর সংবাদে। ফয়সাল সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে তার সাথে এটিই ঘটছে। যেখানেই রাস্তা সংক্রান্ত, এক্সিডেন্ট বা অকালমৃত্যু হয় কীভাবে কীভাবে যেন ফয়সাল সাহেব সেখানে নিজেকে খুঁজে পান, এসে যান এবং দেখতে থাকেন সব কিছু।
অফিসের আনু, তার বউ যে বাড়িতে কাজ করতো সেই বাড়ির ছোট ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দিলে তাদের গাড়ি চাপা দিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়! হয়ত এজন্যেই এভাবে দেখতে পেয়েছিলেন আনুও তার স্ত্রীকে।
ইসতিকারের সুসজ্জিত ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন ফয়সাল সাহেব। ক্যামেরায় ভেসে ওঠে পড়ে থাকা বাইকের নাম্বার প্লেটের ছবি- যেখানে লেখা- লক্ষীপুর-হ!
ফয়সাল সাহেবের মাথার মধ্যে এলোমেলো হতে থাকে। ভাসতে থাকে আনু ও তার স্ত্রীর মুখ,অফিস ডেস্ক, কুড়িল বিশ্বরোড, কৃষ্ণচূড়া, ট্রেনের হুইসেল আর ইলিশ মাছের গন্ধ! এমন কেন হচ্ছে?
কেন? হাসফাস করতে করতে কারো কান্নার আওয়াজ শুনে খেয়াল করে দেখেন- ফয়সাল সাহেব একটি ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবির মধ্যে আছেন। তারই ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে সেই ছবি, যার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে উনার প্রিয়তমা স্ত্রী!