রামতারণ সান্যাল
নেহাল আহমেদ
রামতারণ সান্যালের একটি নাটকের দৃশ্য
সময়টা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। দিকে দিকে তখন দেশাত্মবোধের ধ্বনি। থিয়েটার, সিনেমা, গান এই ধরনের বিনোদনমূলক প্রচারেও ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসার ছোঁয়া। বিপ্লবীরা চাইছিলেন বিনোদন মাধ্যমেও দেশাত্মবোধকে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু থিয়েটার তখন ছিল কেবলমাত্র গুটি কয়েক মানুষের বিনোদনের মাধ্যম।
১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ রঙ্গালয়প্রতিষ্ঠিত হল। এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে থিয়েটারের দরজা খুলে গেল সর্বসাধারণের জন্য। শুরুর দিকে থিয়েটার কেবলমাত্র নাটক সম্বলিত ছিল। ধীরে ধীরে সেখানে যোগ হলো গান। থিয়েটারের গায়ে লাগলো মুক্তির পালক। এই সময় বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল দেশাত্মবোধক থিয়েটারের গান।
বাংলা নাট্যজগতের ইতিহাসে রাজবাড়ী জেলার এক কৃতি সন্তান রামতারণ সান্যাল-এর নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার খালকুলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই মহৎ শিল্পী ছিলেন বাংলা থিয়েটারের প্রথম যুগের অন্যতম প্রবর্তক, সংগীত পরিচালক এবং নাট্যসেবক। তাঁর পিতা ছিলেন বৈকুণ্ঠতারণ সান্যাল।
১৮৭৬ সালের ৪ঠা মার্চ কলকাতার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে যখন “সতী কি কলঙ্কিনী” গীতিনাট্য মঞ্চস্থ হয়, তখন আকস্মিকভাবে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করে নাট্যকার, অভিনেতা ও সংগীত পরিচালকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেন। সেই দলে ছিলেন রামতারণ সান্যালও।
এই ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায় “অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৮৭৬”-এর প্রথম প্রয়োগ হিসেবে। আর এর ফলেই রামতারণ সান্যাল হয়ে ওঠেন এই কুখ্যাত আইনে গ্রেপ্তার প্রথম নাট্যকর্মী।
এই আইন ছিল ব্রিটিশ শাসনের এক নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ—যার উদ্দেশ্য ছিল নাটক ও থিয়েটারের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী ও ব্রিটিশবিরোধী চেতনা দমন করা। এর মধ্য দিয়েই ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে, নাটক কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি হতে পারে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবাদের হাতিয়ার।
রামতারণ সান্যাল ছিলেন বাংলা অপেরার প্রথম সংগীত পরিচালক বা “অপেরা মাস্টার”। তিনি নাট্যজগতে সুরারোপ করেছিলেন “আদর্শ সতী” নাটকে। তাঁর সময়ের আগে বাংলা সংগীত মূলত কবিগান, আখড়াই, তরজা, পাঁচালী প্রভৃতি ধারায় সীমাবদ্ধ ছিল, যা প্রধানত অভিজাত সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে সংগীত ও নাটক তখনও পুরোপুরি পৌঁছায়নি।
এছাড়া, তখনকার নাট্যজগৎ প্রায় সম্পূর্ণরূপে পুরুষনির্ভর ছিল—নারী চরিত্রেও পুরুষরাই অভিনয় করতেন। অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেও নাট্যকর্মীরা যে অনমনীয় আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, রামতারণ সান্যাল ছিলেন সেই ত্যাগ-তপস্যার যুগেরই প্রতীক—যিনি শিল্পকে জীবনের সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।
১৮৭২ সালে ন্যাশনাল থিয়েটারের সূচনার মাধ্যমে প্রথমবার সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয় নাট্যমঞ্চ। সেখান থেকেই রামতারণ সান্যালদের উদ্যোগে বাংলা নাটক জনপ্রিয়তার পথে যাত্রা শুরু করে। টিকিট কেটে নাটক দেখার যে সংস্কৃতি আজও বিদ্যমান, তার সূচনা ঘটে তখনই।
রামতারণ সান্যালের কর্মজীবন আধুনিক বাংলা নাট্যসংস্কৃতির ভিত রচনা করে গেছে।
তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম—গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ নাট্যকার তাঁর পথ অনুসরণ করে থিয়েটারকে সামাজিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলেন।
আজও যখন বাংলা থিয়েটার বা নাট্যসংগীতের ইতিহাস রচিত হয়, রামতারণ সান্যালের নাম সর্বাগ্রে উঠে আসে—একজন সৃষ্টিশীল বিদ্রোহী হিসেবে, যিনি শিল্পের স্বাধীনতার জন্য নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি।
রামতারণ সান্যাল ছিলেন সেই প্রজন্মের শিল্পী, যাঁরা কলম, গান ও নাটকের মাধ্যমে স্বাধীনতার চেতনা প্রচার করেছিলেন।
তাঁর জীবন প্রমাণ করে—নাটক কেবল বিনোদন নয়, এটি সমাজজাগরণের এক বিপ্লবী হাতিয়ার।
তাই আজও তাঁর নাম উচ্চারিত হয় গর্বভরে—
“শিল্পের স্বাধীনতা মানেই মানুষের স্বাধীনতা।”
তথ্যসূত্র:
১। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত — নাটকের ইতিবৃত্ত
২। Sushil Mukhopadhyaya — The Story of the Calcutta Theatres (1753–1980)
৩। C. Capwell — Musical Life in Nineteenth-Century Calcutta (JSTOR)
৪ বাংলা উইকিপিডিয়া — “রামতারণ সান্যাল”
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
রামতারণ সান্যাল
নেহাল আহমেদ
রামতারণ সান্যালের একটি নাটকের দৃশ্য
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
সময়টা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। দিকে দিকে তখন দেশাত্মবোধের ধ্বনি। থিয়েটার, সিনেমা, গান এই ধরনের বিনোদনমূলক প্রচারেও ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসার ছোঁয়া। বিপ্লবীরা চাইছিলেন বিনোদন মাধ্যমেও দেশাত্মবোধকে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু থিয়েটার তখন ছিল কেবলমাত্র গুটি কয়েক মানুষের বিনোদনের মাধ্যম।
১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ রঙ্গালয়প্রতিষ্ঠিত হল। এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে থিয়েটারের দরজা খুলে গেল সর্বসাধারণের জন্য। শুরুর দিকে থিয়েটার কেবলমাত্র নাটক সম্বলিত ছিল। ধীরে ধীরে সেখানে যোগ হলো গান। থিয়েটারের গায়ে লাগলো মুক্তির পালক। এই সময় বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল দেশাত্মবোধক থিয়েটারের গান।
বাংলা নাট্যজগতের ইতিহাসে রাজবাড়ী জেলার এক কৃতি সন্তান রামতারণ সান্যাল-এর নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার খালকুলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই মহৎ শিল্পী ছিলেন বাংলা থিয়েটারের প্রথম যুগের অন্যতম প্রবর্তক, সংগীত পরিচালক এবং নাট্যসেবক। তাঁর পিতা ছিলেন বৈকুণ্ঠতারণ সান্যাল।
১৮৭৬ সালের ৪ঠা মার্চ কলকাতার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে যখন “সতী কি কলঙ্কিনী” গীতিনাট্য মঞ্চস্থ হয়, তখন আকস্মিকভাবে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করে নাট্যকার, অভিনেতা ও সংগীত পরিচালকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেন। সেই দলে ছিলেন রামতারণ সান্যালও।
এই ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায় “অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৮৭৬”-এর প্রথম প্রয়োগ হিসেবে। আর এর ফলেই রামতারণ সান্যাল হয়ে ওঠেন এই কুখ্যাত আইনে গ্রেপ্তার প্রথম নাট্যকর্মী।
এই আইন ছিল ব্রিটিশ শাসনের এক নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ—যার উদ্দেশ্য ছিল নাটক ও থিয়েটারের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী ও ব্রিটিশবিরোধী চেতনা দমন করা। এর মধ্য দিয়েই ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে, নাটক কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি হতে পারে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবাদের হাতিয়ার।
রামতারণ সান্যাল ছিলেন বাংলা অপেরার প্রথম সংগীত পরিচালক বা “অপেরা মাস্টার”। তিনি নাট্যজগতে সুরারোপ করেছিলেন “আদর্শ সতী” নাটকে। তাঁর সময়ের আগে বাংলা সংগীত মূলত কবিগান, আখড়াই, তরজা, পাঁচালী প্রভৃতি ধারায় সীমাবদ্ধ ছিল, যা প্রধানত অভিজাত সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে সংগীত ও নাটক তখনও পুরোপুরি পৌঁছায়নি।
এছাড়া, তখনকার নাট্যজগৎ প্রায় সম্পূর্ণরূপে পুরুষনির্ভর ছিল—নারী চরিত্রেও পুরুষরাই অভিনয় করতেন। অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেও নাট্যকর্মীরা যে অনমনীয় আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, রামতারণ সান্যাল ছিলেন সেই ত্যাগ-তপস্যার যুগেরই প্রতীক—যিনি শিল্পকে জীবনের সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।
১৮৭২ সালে ন্যাশনাল থিয়েটারের সূচনার মাধ্যমে প্রথমবার সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয় নাট্যমঞ্চ। সেখান থেকেই রামতারণ সান্যালদের উদ্যোগে বাংলা নাটক জনপ্রিয়তার পথে যাত্রা শুরু করে। টিকিট কেটে নাটক দেখার যে সংস্কৃতি আজও বিদ্যমান, তার সূচনা ঘটে তখনই।
রামতারণ সান্যালের কর্মজীবন আধুনিক বাংলা নাট্যসংস্কৃতির ভিত রচনা করে গেছে।
তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম—গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ নাট্যকার তাঁর পথ অনুসরণ করে থিয়েটারকে সামাজিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলেন।
আজও যখন বাংলা থিয়েটার বা নাট্যসংগীতের ইতিহাস রচিত হয়, রামতারণ সান্যালের নাম সর্বাগ্রে উঠে আসে—একজন সৃষ্টিশীল বিদ্রোহী হিসেবে, যিনি শিল্পের স্বাধীনতার জন্য নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি।
রামতারণ সান্যাল ছিলেন সেই প্রজন্মের শিল্পী, যাঁরা কলম, গান ও নাটকের মাধ্যমে স্বাধীনতার চেতনা প্রচার করেছিলেন।
তাঁর জীবন প্রমাণ করে—নাটক কেবল বিনোদন নয়, এটি সমাজজাগরণের এক বিপ্লবী হাতিয়ার।
তাই আজও তাঁর নাম উচ্চারিত হয় গর্বভরে—
“শিল্পের স্বাধীনতা মানেই মানুষের স্বাধীনতা।”
তথ্যসূত্র:
১। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত — নাটকের ইতিবৃত্ত
২। Sushil Mukhopadhyaya — The Story of the Calcutta Theatres (1753–1980)
৩। C. Capwell — Musical Life in Nineteenth-Century Calcutta (JSTOR)
৪ বাংলা উইকিপিডিয়া — “রামতারণ সান্যাল”