alt

শিশিরস্নাত পদাবলি

: বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

আজীবন রাখতে চাই হৃদয়মাঝারে
হাসান হাফিজ
হেমন্তে ফুটেছো তুমি টুকটুকে লালজবা,

একা একা ফুটে উঠলে নিঃসঙ্গ সকালে

মিহিরোদ তোমার পরাগে এসে চুমু খায়

ভালোবেসে কোনো শান্তি নিমজ্জন পাওয়ার আশায়

জীবনের সঞ্জীবনী দূরে ঠেলে মরে যেতে চায়

এমন রহস্যঢেউ কোথায় পেয়েছে বলো এলোচুল

ভালোবাসা আসলে মরণসন্ধি নাকি ভুল

প্রশ্ন জাগে দূরায়ত বাসনার অলক্ষ্য আড়ালে

লালজবা, কেন তাকে এতটা প্রশ্রয় তুমি দিলে

ভালোবাসা পান করে বুঁদ হলো আকাশনীলিমে

এত গাঢ় পিপাসার্ত কখনো ছিলে না জানি,

কোথা থেকে এল এই তৃষার বারিধি

যাতে শুধু ডুবে যাওয়া আছে, পরিত্রাণ নেই

একদিন আয়ুমাত্র, তারই মধ্যে এত সুর আরাধনা

হেমন্ত, তোমাকে হৃদয়ে পুরে রাখতে চাই আজীবন সোনা।

তোমাকেই সমর্পণ করেছি পুষ্পবালিকা তোমাকেই
আবদুর রাজ্জাক
তোমার অশ্রুবিন্দু মুছে দিয়ে বলেছি, যাও ভেসে যাও শিশিরে,

যতটুকু বলার ছিলো বলেছি, এবার তোমার পালা-

বলো! যাবে কী যাবে না

তোমার দীর্ঘশ্বাসের অনন্তপ্রবাহ বাতাসে, আয়ুবৃক্ষে, অন্তরীক্ষে,

তোমার প্রতি- আমার স্মৃতিভ্রষ্ট ভালোবাসার

একবিন্দু পরিমাণও কমে না।

তুমি শেফালি ফুলের স্বপ্ন নিয়ে এসে বললে- দেখো-

বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে, তবুও তোমার পাথর ভাঙা অব্যাহত রয়েছে!

ছলোছলো মেঘ পাহাড় ছুঁয়ে সমুদ্র যাত্রায়...

তোমার বুকে বিঁধে থাকা বিষকাঁটা আর কিছু মিশ্র ভালোবাসা

আমাকে বারবার ব্যথিত করে।

তুমি আমাকে নিয়ে যতটুকু ভাবো, আমি কী তোমাকে নিয়ে

ততটুকু ভেবেছি কখনো!

যা কিছু আমার তার সবকিছু তোমার, এই হেমন্ত, শিউলি-সোনালি

রৌদ্রের হাসি শুধু তোমাকেই বলেছি।

একদিন ভোর ভোর শিশিরে পা ভিজিয়ে এসেই বললে- চলো,

কাছের আলপথ ধরে খানিকটা হেঁটে আসি।

হেমন্তের পদাবলি
খোরশেদ বাহার

সাদা বক ডানা মেলে ঘরে ফেরে

কুয়াশা জাঁপটে ধরে আছে কচুরির ফুল

মায়াবী এক সন্ধ্যা নেমেছে চোখের কোণে

হলুদ হলুদ বর্ণচ্ছটায় সোনালি ধানের মাঠ

ধবল জোছনায় সে মাঠে দুধের নহর বয়

চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে এক মনে।

শূন্য মাঠে যুদ্ধ চলে কিশোরে মূষিকে

সুড়ঙ্গ পথের মুখে পাকা ধানের চিক্কণ সুর

কিশোরের মনে নূপুর হয়ে বাজে

সোঁদা মটির গন্ধ শরীরে বাসা বাঁধে তার

উদোম কিশোরী দাঁড়িয়ে পাশে তামাটে এলোচুলে

ঝরাপাতার মচমচ শব্দে যুগল ঘরে ফেরে।

মিহি সুতায় বোনা কুয়াশার চাদর রাত্রির শরীরে

কুপিবাতির চারি ধারে জীবনের রংধনু খেলা করে

অদম্য এক জন্মের ক্ষুধায় জ্বলছে উনুন

সিদ্ধ ধানের মোহনীয় গন্ধ পাড়াময় ঘূর্ণি তোলে

ভাপ আর ঘামের গন্ধে মাখা পৌঢ় শরীর

নেশা জাগানিয়া রাত্রির সুবাসময় দ্বিপ্রহর।

হেমন্তের এমন রাতে কলের গান ভেসে আসে

জোছনার গান জীবনের গান জননীর গান

শঙ্কার গান বর্গীর গান হায়নার গান

দুর্যোগময় ঘনঘটায় জেগে আছে সচকিত কোটি চোখ

দুর্বার কণ্ঠের বলিষ্ঠ উচ্চারণ এ আমার বাংলাদেশ

এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না জনাব।

ঋতুচক্র
মাসুদ খান
যে-কোনো চক্রকে বৃত্তাকার বলে জানি।

তবে ঋতুচক্র বৃত্তাকার নয়,

অনেকটা বৃত্ত আর পৃথুল উপবৃত্তের মাঝামাঝি মনে হয়।

তা না হলে কেন জাগে প্রবল উৎকেন্দ্রিকতা,

আমাদের দেহে আর মনে

কেন্দ্র একটিই, ভিন্ন তার দুই উপকেন্দ্র, আর

তাতেই কি অদম্য ও অনিবার্য হয়ে ওঠে এ উৎকেন্দ্রিকতা

দুই ভিন্ন ভুবনে বিরাজ করে দুই ভিন্ন বিন্দু-

এক বিন্দু যদি থাকে উত্তর জগতে, তবে অপরটি নিশ্চিত দক্ষিণে।

তুমি থাকো প্রতিপদ স্থানাঙ্কে আমার।

তাই আমাদের দেশে যখন হেমন্ত হয়ে ওঠে যথারীতি হেঁয়ালিপ্রবণ...

তোমাদের দেশে এক ঝলমলে মধুমাস মত্ত তখন উচ্ছল প্রগলভতায়।

আমাদের এলাকায় যখন সহিংস শীতকাল,

তোমাদের অঞ্চলে তখন এক অহিংস শরৎ।

কাটে কি তবু আজও
খালেদ হামিদী
আমাকে উন্মূল কে তুমি হতে কও,

আত্মজের ভবিতব্য দেখে নাও

হঠাৎ অজানায় অননুভূত আগে

অমন মহাত্রাসে বিয়োগবোধে কেঁপে

সংকুচিত হই অতীব জেরবার!

‘দেশের সারমেয় ঠাকুর বিভুঁইয়ে’

দেখেই পুনরায় না হতে নতশির

ফেরার ঘটনার পুনরাবৃত্তির

অদরকারে তাই অগ্রহায়ণের

ক্ষেতের দিকে যাই। কিন্তু ধেয়ে আসে

বাস্তুহারাদের পাত্র ভিক্ষার!

তথাপি নির্লোভ মধ্যবিত্তের

আর কী আছে বল আত্মরক্ষার

ওদের চোখে পানি, শিশির পায়ে মোর।

কাটে কি আজও খুব হেমন্তের ঘোর!

লাঠি ও হেমন্ত সমাচার
জিললুর রহমান
লাঠি হাতে নিয়ে হাঁটা কতো শত দিন-

বলেছে কতো না লোক “বোকা অর্বাচীন,

চল্লিশ না পেরোতেই ভর করো লাঠি,

আশির কোঠায় দেখো কী দুর্দান্ত হাঁটি”

এখন চোখের সামনে সোমত্ত তরুণ

লাঠি নিয়ে হেঁটে চলে চেহারা করুণ

আমি জানি এ তো নয় সারা জীবনের

আমি জানি শেষ আছে সব হেমন্তের

হেলে পড়া হেমন্ত
মাহফুজ আল-হোসেন
ভূকম্পনে টলে যাওয়া শক্তপোক্ত অট্টালিকার মতোই

শিশিরের নামতা গুনে অলক্ষ্যেই হেলে পড়েছে হেমন্ত।

হঠকারী শরৎ হঠাৎ হয়েছে ফেরার বিনা পরোয়ানায়,

বুদ্বুদে জমে থাকা দুঃখগুলো পানপাত্রে নিমজ্জমান-

বিপন্ন বিশ্বাসের পতিত জমিতে বাঁচবে কি প্রণয়ীধান

রোদের অরণ্যে আগন্তুক বাতাস এসে ফিসফাস বলে:

ম্লান এই দিনে পাতার হলদে বুক জুড়ে থাক অনুতাপ;

কালের ঘণ্টাধ্বনির ভেতর দিয়ে ভেসে আসে বিলাপ-

নিজেরই দীর্ঘ ছায়া দেখে থমকে যায় বিষণœ বিকেল।

তবু সন্ধ্যার আঙিনায় মৃদু লালচে আলো ঝরে পড়লে

অমোঘ আশ্বাসের মতো ঘাসের ওপরে দোলে সম্ভাবনা-

হেমন্ত কি অগত্যা মৃদু শৈত্যের প্রহেলিকায় ঢুকে পড়ে

ফুটিয়ে তুলবে মনোসিজ গোপন উষ্ণতার প্রথম বীজ

নিজের ভিতরে হাঁটি
চয়ন শায়েরী
নিবিড় হতে না পারা আক্ষেপের স্বরে

নিজের ভিতরে হাঁটি- মাথার উপরে কালপুরুষের হাঁটা দেখি- অঘ্রানের রাতে;

আর্দ্রার মুখের মৃত্যুময়ী বিমর্ষতা আছর করেছে কালপুরুষটাকেও-

কত বিলিয়ন বছর একত্রে হেঁটে গেছে ওরা- মাথার উপরে প্যারালাল ভবিষ্যত থেমে আছে;

অ্যালার্ম দিতেছে মোবাইল ঘড়ি

আরও যান্ত্রিক হতে, সময়ফুরায়ে গেছে আমাদের, ফিরে যেতে হবে-

তবু রোবটের হাতে কফি খেতে চেয়েছিল মন- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গহিনে ভ্রমণ এখনও বাকি;

ইটারনিটির পথে হেঁটে হেঁয়ালির কুয়াশার ঘ্রাণ নিই- শেয়ালের প্রহরের ঘ্রাণ

ফিরে-আসে- গোপনে ভ্রমণ করে কবিতার হালটের পথে;

কোনো-এক প্যারালাল পৃথিবীতে হেঁটে যাচ্ছি যেন, টের পাই অলৌকিক আনন্দের ভারে অন্ধকারে- কালপুরুষের পেছনে লুব্ধক সেও লেগে আছে- অনেক হেঁটেছি গন্তব্যের অন্ধকারে পৌঁছে যেতে;

নিয়তি মুচকি হাসে;

মনের জমিন
রকিবুল হাসান
মন পুড়ে যাচ্ছে, যাক। আকাশ নতুন ছবি আঁকে

তোমার দুই চোখের সোনালি আলোয়।

হয়তো পুরনো কালে ছিল না পুরনো

দূরের পথিক

আমিই এসেছিলাম ভুলপথে ভুলের পথিক

গল্পের পাতারা খসে-খসে যাচ্ছে, যাক

জীবনও তো খসে যাচ্ছে, যাক।

কার শোকে জেগে আছো আঙুলে জড়িয়ে স্বরলিপি

জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে, যাক।

মন যাচ্ছে পুড়ে

পাতারাও যাচ্ছে ঝরে

যাক, সব পুড়ে যাক, সব ঝরে যাক

ৃকেবলি ভরে উঠুক মনের জমিনে লাল ফুল।

শূন্য মানুষ
মাসুদার রহমান
মুথাঘাস থানকুনি... মাটির নিবিড় কাছে

ঝুঁকে থাকা গ্রাম

তারপর ছড়ানো শস্যখেত, পুঁতে রাখা কঞ্চিতে

একাকী

একটি পাখি বসেছিল, আর একটি এসে

তার পাশে বসে আছে- হয়েছে দু’জন

তুমিও বারান্দায় বসে সমস্ত সকাল একা, তোমার ভাবনা

খোলা হাওয়ার প্রান্তর

শূন্যতা অগ্রহণীয়- তারপরও কোথাও আর আমি নেই

প্রকৃতি তা সহ্য করে না বলে, তোমার মনের পাশে

নতুন আর একজন এসে বসে আছে

আর যে শূন্য গণিতের; সেও এক সাঁওতাল গ্রামের

পাশে বসে, চোখের সামনে তার

বিরাম চিহ্নের মতো পাখিরা উড়ছে, হেমন্তের রোদমাখা

ধু ধু চরাচর

মাটির ভেতর ঘুমিয়ে থাকা শব্দ
শাহেদ কায়েস
হেমন্ত আসে না, জেগে ওঠে- যেন মাটির গভীরে অন্ধকারে বহুদিন সুপ্ত এক বীজ হঠাৎ আলোর মুখ দেখে। বাতাসে ঘামের গন্ধ, মাটির কপালে জমে বিন্দু-বিন্দু শিশির।

হেমন্তের সূর্য কাঁধে রাখে হাত, ক্লান্ত শরীরকে বলে- এখন বিশ্রামের সময়। তবু বিশ্রামের মাঝেও জেগে থাকে কিষানের মন, যেখানে মানুষ নিজেকে চিনে ফেলে ফসলের গন্ধে, ঘামে, ছায়ায়, শিশিরে।

শ্রম আর গান চলে একসাথে- কণ্ঠে বাউল সুর, চোখে অদেখা জগৎ; যে গান সময়ের আত্মজীবনী। হেমন্ত- মানুষের ভেতর জমে থাকা প্রেমের অঙ্কুরোদ্গম।

তোমাদের হেমন্তদিনে
শেলী নাজ
যে বাজারে মাংস বিক্রি হয় আমি সেইখানে

বেচতে এসেছি এক পঙ্ক্তি কবিতার মন

তোমাদের হেমন্তদিনে

নাকি সে হৃদয় আজ যার স্বর সহ¯্র বল্লমে

নিভে গেছে, তবু তার মরণবিথিকা ফুঁসছে আহ্লাদে

যেনবা মরার আগে অপচয়মূলক এ জীবনের মণি

কবিতার কিংখাবে ঢেকে রাখা যায়, বিমর্ষ ক্ষমায়

এই ঋতু পরিচয়হীন নগরে কোথায় অঘ্রান

প্রতি বারই হাটবার, প্রতিটি থলের মধ্যে

লুকোনো বিষাদ, সোনার মূর্তির চোখে ভাঙ্গা অভিলাষ

তারা জাদুকর, দেখি বিকিনির মধ্যে ভাটফুল,

দেখি বালিকার জঙ্ঘা ঘিরে নাচছে উত্তাল সমুদ্র,

সারাদিন শেষে না বিকোনো চকচকে মন নিয়ে ঘরে ফিরি

পরদিন হাটে আবার তাকে বেচতে আসব বলে

তোমাদের হেমন্তদিনে!

হেমন্তচ্ছবি
মুমির সরকার
কার্তিকের শেষবেলার নুয়ে পড়া আলোয়

উত্তরের পাহাড় চুমে আসা হিমেল হাওয়ায়

ধান উঠে যাওয়া খড়-পোড়া গন্ধ-ধোঁয়ায়

তোমার মুখচ্ছবি ঝাপসা হয়ে আসে!

শূকরপালে দুরন্ত গতিতে উঠে আসা ধুলোয়

কিন্নরী এক অন্ধকার,

গুল্মকাঁটার ঝোপঝাড় পেরিয়ে

আশ্রয় খুঁজে লয় উপবনে;

বাঁজা ডোবা-খাল-অপয়া দুই ঢালে।

খেলাশেষ উঠে আসা

ডানপিটে কিশোরদল,

দলছুট সামন্ত মোরগের তীক্ষè আর্তনাদে

সড়ক-যেতে-যেতেও বুঝিবা খোঁজে,

দু’চোখ আলো-জ্বলা বুনোশিয়ালরে।

চকিত ভেসে আসা

পাঁচমিশালি ডালফোঁড়ন আর

শিউলি-হেনা-বকুল-গন্ধরাজ সুবাসে

নিভু-নিভু আগুনে তেলসুঁজ পিদিম,

দাওয়া ছাড়িয়ে-

হিমরাত নিয়ে আসে, বিস্তীর্ণ জনপদে।

অতঃপর নিত্যকার ঘরকন্নার ক্ষুধা-প্রার্থনা-কামপ্রেম-ক্লান্তি:

হেমন্তচ্ছবি-

শিষ দিয়ে ফের ফিরে আসে। নবান্ন-বিস্ময়ে!

বিভোল হেমন্তে
মুশাররাত
আমরা শুভ শীতের জন্য অপেক্ষায় থাকবো না আর

জীবনে যখন সঙ্গী নিরন্তর হাহাকার

হেমন্তের কুয়াশা কিছু ভাসিয়ে নেয় না বিষাদ

ফোটায় না শিউলি অমর

মদির গন্ধে স্থবির হয় না

তোমার আমার বা আমাদের

মহুয়া সময়, মাতালে বিভোর।

হেমন্তচরিত
মঈনুল হাসান
মানুষ ও হেমন্তে

আমি কোনো পার্থক্য দেখি না,

সংযোগ যেখানে সুবিনীত

বিচ্ছেদ কোনো সুস্বপ্ন নয়।

হেমন্তের মন বড্ড ঋতুমতী

সময়ের দেহে কাঁচিকাটা করে

থরে থরে শুধু বিভক্তি আনে

আর আনে মওসুমি সোনালি পয়গাম।

রুখো বা সিক্ত সময়, নিষিক্ত হলে

অবশেষে সাহসী বীর্যে হেসে ওঠে

পরিণত ফসলসম্ভার।

মানুষ ও হেমন্তকে

আমি কখনও পৃথক করি না,

এমন হেমন্ত ভারে মানুষও ঋতুবতী হয়

লাঙলের বদলে তখন লিঙ্গের চাষ চলে

মানুষেরাও হয় হেমন্তবতী।

কার্তিকের রাতে
সঞ্জয় দেওয়ান
অদূরে ভায়োলিনের করুণ সুর

আঁচলভর্তি মেলানকলি নিয়ে ঘুমোতে যাই

কার্তিকের কালশিটে রাতে।

ঘুম ভাঙে ধান ভানার শব্দে

কিংবা ঢেঁকির তালে

রিক্ত মনে বিষণœতার ভোর

ভোরের দরোজায় টোকা দেয় অরুণিমা।

গঙ্গাফড়িং ওড়ে আনমনে

ধান কাটার গল্পে মশগুল ক্ষয়িষ্ণু রাত

পাকা ধানের গন্ধে বিলোল।

ঝরাপাতার শব্দে শিহরিত হই

উত্তরের হাওয়ায় অরুণিমার উষ্ণতা খুঁজি।

হেমন্ত যাপন
চামেলী বসু
সে সকল খোলা চিঠি নিয়ে ফিরে গেছে কোজাগরী রাত

কেবল তোমার চোখের অনুশাসনে জমে আছে অবোধ্য অক্ষর!

একান্ত বিরূপ সুখে পুড়ে

অথবা দীর্ঘ পথের মতো শুয়ে থেকে

ক্লান্তবেলায়-

তুমি

উত্তপ্ত পৃথিবীর বারুদগন্ধ ভুলে

এসো এই হিমহিম কার্তিকের ভাপ ওঠা ভোরে

তোমার শরীর থেকে শুষে নেই কুয়াশার ঘ্রাণ।

যেখানে হেমন্তের অলস মাঠে রচিত হয় নিয়ত ফসলের সোনালি কবর!

নবান্নের দিনগুলি
সাঈদ বারী
ধানের গন্ধে ভরে গেছে মাঠ-

ওই যে অগ্রহায়ণের রোদে কাঁপে মেঠো বাতাস,

গাঙপারের ছেলেটা

বাজায়

বাঁশের বাঁশি,

তার সুরে ওঠে উঠোনজুড়ে পাকা ধানের হাসি।

পুকুরপাড়ে হাঁসেরা ডানা ঝাড়ে,

চুলে গাঁদা ফুল গুঁজে

বউটি হাঁটে নরম হাওয়ায়,

চুলার আগুনে ভাজা হয় নতুন চালের খই।

আকাশে ধোঁয়া-ধরা বিকেল নামে ধীরে,

হেমন্তের সোনালি পর্দা টানে গোধূলি,

শিশিরে ভেজা ঘাসে পায়ের ছাপ পড়ে থাকে-

যেন মাটির বুকেও লেখা কোনো প্রেমপত্র।

ফসলের গন্ধে মিশে থাকে প্রার্থনা,

এই ভূমি,

এই মানুষ,

এই আনন্দ-

সবই তো এক ভাষার,

এক হৃদয়ের উপাসনা।

হেমের অন্তে
আমেনা তাওসিরাত
ভালোবেসে আমরা শাবকের ভাষায় কথা বলেছিলাম। পয়মন্ত প্রেমিকার মতো হেমন্তকে দূরে ঠেলে সদ্বংশের মেয়ে শীতকালকে প্রণয়ের পাত্র ভেবে পান করতে চেয়েছিলাম।

অন্নলোভাতুর হেমন্ত, অর্যমার প্রখর তাপে ভস্মীভূত করে দিতে চেয়েছিল শস্যের প্রহসন। উপকূলীয় কাঁকড়ার মতো স্নাত বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে আমরা পতনোন্মুখ পাতাদের আয়ুষ্কাল পড়ছিলাম। প্রথম ঋতুমতী হবার কদর্যতা আর বেড়ে যাওয়া পোশাকের ভারে ওরাও ভয়ার্ত আর বিমর্ষ ছিল।

বিমূর্ত নারীরা সব বুয়ী রাজবংশীয় শাহজাদীদের অগম্য পুরীতে ফিরে গিয়েছিলেন। সিংহের প্রহরায় ছেড়ে দিয়ে প্রকা- এক ধাতব ফটক। পার্সেপোলিসের আকেমেনীয় ধ্বংসাবশেষে শাহেনশাহেরা হয়তো সেইসব মহার্ঘ্যই শিলালিপিতে খোদাই করেছিলেন।

আকাশের সঙ্গে গায়ে গায়ে দাঁড়ানো হিমঝুরিদের কাফকার আঁকা গ্রামীণ পথের শিশুদের মতো প্রশান্ত আর ঘন মনে হচ্ছিল, যেন মর্মভেদী গন্ধ নিয়ে সারারাত ফুটে ঝরে যাবার আগে বুকের ওপর দু’হাত বেঁধে একে অন্যকে দেখে নেবে। যেন ছাতিমের ছাতায় আমাদের শৈশবের বিবরণসমূহ প্রগাঢ় আর শ্বেতময়। উপধা, শঠতা, গোত্রপিতাদের কপটতা আর জহরের জ্বরে তখনও আচ্ছন্ন হইনি। ঈষৎ হিমের পাশে দাঁড়িয়ে যজ্ঞের আগুন কামনার দিনও সে ছিল না। দুপুরচ-ীর অপাঙ্গ ফুলেরা তা জানে আর ভাবতে বসে- মৃত মায়েদের মেয়েদের শৈশব কবে হেমের অন্তে কবরখানার দিকে চলে গেছে।

ছবি

বুভুক্ষা শিল্পী ও একথালা ভাত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কয়েকটি নির্ঘণ্ট

ছবি

নূরুল হকের অপ্রকাশিত কবিতা

ছবি

বিষাদমাখা সুন্দরের ডাকহরকরা

ছবি

শিল্পের স্বাধীনতা মানেই মানুষের স্বাধীনতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বনানীর ঢালু রাস্তা বেয়ে

দিলারা হাফিজ-এর কবিতা

ছবি

বাংলা কবিতার উদ্ভাসিত স্বর

ছবি

শরীরী অশরীরী

ছবি

বিষণ্ণতার কবি আবুল হাসান

ছবি

উত্তরাধুনিক সাহিত্যের সুলুক সন্ধান

দূরের পথ বাতিঘর

কচুরিপানা

অল্প-স্বল্প : মিথ্যা-সত্য

মানুষ চাই

বাঘ

বিষাদমন্ত্রী

বুকের রেহেলে

নবান্ন

জলের নক্ষত্র

সততাও লুপ্ত হচ্ছে লুপ্তবংশে

ছবি

বিলেতে বাঙালির শিল্পসাহিত্যের প্রতিনিধি

ছবি

বিপন্ন সময়ের জীবনশিল্পী

ছবি

লাল ফুলের খোঁপা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

জনপ্রিয় সাহিত্যের জাদুকর

ছবি

দেশ ভাগের আর্তনাদ

ছবি

অনুবাদকের দায় : বিশ্বস্ততা নাকি সরলতা?

কার্তিকের স্নান

আমি- শেষ

ছবি

মহিবুল আলমের কবিতায় নদী ও নারী

ছবি

কবি মাহমুদ কামাল ও নিমগ্ন আত্মার সাধক

ছবি

স্পর্শ

ছবি

নুরুন্নাহার মুন্নির গল্প

tab

শিশিরস্নাত পদাবলি

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

আজীবন রাখতে চাই হৃদয়মাঝারে
হাসান হাফিজ
হেমন্তে ফুটেছো তুমি টুকটুকে লালজবা,

একা একা ফুটে উঠলে নিঃসঙ্গ সকালে

মিহিরোদ তোমার পরাগে এসে চুমু খায়

ভালোবেসে কোনো শান্তি নিমজ্জন পাওয়ার আশায়

জীবনের সঞ্জীবনী দূরে ঠেলে মরে যেতে চায়

এমন রহস্যঢেউ কোথায় পেয়েছে বলো এলোচুল

ভালোবাসা আসলে মরণসন্ধি নাকি ভুল

প্রশ্ন জাগে দূরায়ত বাসনার অলক্ষ্য আড়ালে

লালজবা, কেন তাকে এতটা প্রশ্রয় তুমি দিলে

ভালোবাসা পান করে বুঁদ হলো আকাশনীলিমে

এত গাঢ় পিপাসার্ত কখনো ছিলে না জানি,

কোথা থেকে এল এই তৃষার বারিধি

যাতে শুধু ডুবে যাওয়া আছে, পরিত্রাণ নেই

একদিন আয়ুমাত্র, তারই মধ্যে এত সুর আরাধনা

হেমন্ত, তোমাকে হৃদয়ে পুরে রাখতে চাই আজীবন সোনা।

তোমাকেই সমর্পণ করেছি পুষ্পবালিকা তোমাকেই
আবদুর রাজ্জাক
তোমার অশ্রুবিন্দু মুছে দিয়ে বলেছি, যাও ভেসে যাও শিশিরে,

যতটুকু বলার ছিলো বলেছি, এবার তোমার পালা-

বলো! যাবে কী যাবে না

তোমার দীর্ঘশ্বাসের অনন্তপ্রবাহ বাতাসে, আয়ুবৃক্ষে, অন্তরীক্ষে,

তোমার প্রতি- আমার স্মৃতিভ্রষ্ট ভালোবাসার

একবিন্দু পরিমাণও কমে না।

তুমি শেফালি ফুলের স্বপ্ন নিয়ে এসে বললে- দেখো-

বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে, তবুও তোমার পাথর ভাঙা অব্যাহত রয়েছে!

ছলোছলো মেঘ পাহাড় ছুঁয়ে সমুদ্র যাত্রায়...

তোমার বুকে বিঁধে থাকা বিষকাঁটা আর কিছু মিশ্র ভালোবাসা

আমাকে বারবার ব্যথিত করে।

তুমি আমাকে নিয়ে যতটুকু ভাবো, আমি কী তোমাকে নিয়ে

ততটুকু ভেবেছি কখনো!

যা কিছু আমার তার সবকিছু তোমার, এই হেমন্ত, শিউলি-সোনালি

রৌদ্রের হাসি শুধু তোমাকেই বলেছি।

একদিন ভোর ভোর শিশিরে পা ভিজিয়ে এসেই বললে- চলো,

কাছের আলপথ ধরে খানিকটা হেঁটে আসি।

হেমন্তের পদাবলি
খোরশেদ বাহার

সাদা বক ডানা মেলে ঘরে ফেরে

কুয়াশা জাঁপটে ধরে আছে কচুরির ফুল

মায়াবী এক সন্ধ্যা নেমেছে চোখের কোণে

হলুদ হলুদ বর্ণচ্ছটায় সোনালি ধানের মাঠ

ধবল জোছনায় সে মাঠে দুধের নহর বয়

চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে এক মনে।

শূন্য মাঠে যুদ্ধ চলে কিশোরে মূষিকে

সুড়ঙ্গ পথের মুখে পাকা ধানের চিক্কণ সুর

কিশোরের মনে নূপুর হয়ে বাজে

সোঁদা মটির গন্ধ শরীরে বাসা বাঁধে তার

উদোম কিশোরী দাঁড়িয়ে পাশে তামাটে এলোচুলে

ঝরাপাতার মচমচ শব্দে যুগল ঘরে ফেরে।

মিহি সুতায় বোনা কুয়াশার চাদর রাত্রির শরীরে

কুপিবাতির চারি ধারে জীবনের রংধনু খেলা করে

অদম্য এক জন্মের ক্ষুধায় জ্বলছে উনুন

সিদ্ধ ধানের মোহনীয় গন্ধ পাড়াময় ঘূর্ণি তোলে

ভাপ আর ঘামের গন্ধে মাখা পৌঢ় শরীর

নেশা জাগানিয়া রাত্রির সুবাসময় দ্বিপ্রহর।

হেমন্তের এমন রাতে কলের গান ভেসে আসে

জোছনার গান জীবনের গান জননীর গান

শঙ্কার গান বর্গীর গান হায়নার গান

দুর্যোগময় ঘনঘটায় জেগে আছে সচকিত কোটি চোখ

দুর্বার কণ্ঠের বলিষ্ঠ উচ্চারণ এ আমার বাংলাদেশ

এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না জনাব।

ঋতুচক্র
মাসুদ খান
যে-কোনো চক্রকে বৃত্তাকার বলে জানি।

তবে ঋতুচক্র বৃত্তাকার নয়,

অনেকটা বৃত্ত আর পৃথুল উপবৃত্তের মাঝামাঝি মনে হয়।

তা না হলে কেন জাগে প্রবল উৎকেন্দ্রিকতা,

আমাদের দেহে আর মনে

কেন্দ্র একটিই, ভিন্ন তার দুই উপকেন্দ্র, আর

তাতেই কি অদম্য ও অনিবার্য হয়ে ওঠে এ উৎকেন্দ্রিকতা

দুই ভিন্ন ভুবনে বিরাজ করে দুই ভিন্ন বিন্দু-

এক বিন্দু যদি থাকে উত্তর জগতে, তবে অপরটি নিশ্চিত দক্ষিণে।

তুমি থাকো প্রতিপদ স্থানাঙ্কে আমার।

তাই আমাদের দেশে যখন হেমন্ত হয়ে ওঠে যথারীতি হেঁয়ালিপ্রবণ...

তোমাদের দেশে এক ঝলমলে মধুমাস মত্ত তখন উচ্ছল প্রগলভতায়।

আমাদের এলাকায় যখন সহিংস শীতকাল,

তোমাদের অঞ্চলে তখন এক অহিংস শরৎ।

কাটে কি তবু আজও
খালেদ হামিদী
আমাকে উন্মূল কে তুমি হতে কও,

আত্মজের ভবিতব্য দেখে নাও

হঠাৎ অজানায় অননুভূত আগে

অমন মহাত্রাসে বিয়োগবোধে কেঁপে

সংকুচিত হই অতীব জেরবার!

‘দেশের সারমেয় ঠাকুর বিভুঁইয়ে’

দেখেই পুনরায় না হতে নতশির

ফেরার ঘটনার পুনরাবৃত্তির

অদরকারে তাই অগ্রহায়ণের

ক্ষেতের দিকে যাই। কিন্তু ধেয়ে আসে

বাস্তুহারাদের পাত্র ভিক্ষার!

তথাপি নির্লোভ মধ্যবিত্তের

আর কী আছে বল আত্মরক্ষার

ওদের চোখে পানি, শিশির পায়ে মোর।

কাটে কি আজও খুব হেমন্তের ঘোর!

লাঠি ও হেমন্ত সমাচার
জিললুর রহমান
লাঠি হাতে নিয়ে হাঁটা কতো শত দিন-

বলেছে কতো না লোক “বোকা অর্বাচীন,

চল্লিশ না পেরোতেই ভর করো লাঠি,

আশির কোঠায় দেখো কী দুর্দান্ত হাঁটি”

এখন চোখের সামনে সোমত্ত তরুণ

লাঠি নিয়ে হেঁটে চলে চেহারা করুণ

আমি জানি এ তো নয় সারা জীবনের

আমি জানি শেষ আছে সব হেমন্তের

হেলে পড়া হেমন্ত
মাহফুজ আল-হোসেন
ভূকম্পনে টলে যাওয়া শক্তপোক্ত অট্টালিকার মতোই

শিশিরের নামতা গুনে অলক্ষ্যেই হেলে পড়েছে হেমন্ত।

হঠকারী শরৎ হঠাৎ হয়েছে ফেরার বিনা পরোয়ানায়,

বুদ্বুদে জমে থাকা দুঃখগুলো পানপাত্রে নিমজ্জমান-

বিপন্ন বিশ্বাসের পতিত জমিতে বাঁচবে কি প্রণয়ীধান

রোদের অরণ্যে আগন্তুক বাতাস এসে ফিসফাস বলে:

ম্লান এই দিনে পাতার হলদে বুক জুড়ে থাক অনুতাপ;

কালের ঘণ্টাধ্বনির ভেতর দিয়ে ভেসে আসে বিলাপ-

নিজেরই দীর্ঘ ছায়া দেখে থমকে যায় বিষণœ বিকেল।

তবু সন্ধ্যার আঙিনায় মৃদু লালচে আলো ঝরে পড়লে

অমোঘ আশ্বাসের মতো ঘাসের ওপরে দোলে সম্ভাবনা-

হেমন্ত কি অগত্যা মৃদু শৈত্যের প্রহেলিকায় ঢুকে পড়ে

ফুটিয়ে তুলবে মনোসিজ গোপন উষ্ণতার প্রথম বীজ

নিজের ভিতরে হাঁটি
চয়ন শায়েরী
নিবিড় হতে না পারা আক্ষেপের স্বরে

নিজের ভিতরে হাঁটি- মাথার উপরে কালপুরুষের হাঁটা দেখি- অঘ্রানের রাতে;

আর্দ্রার মুখের মৃত্যুময়ী বিমর্ষতা আছর করেছে কালপুরুষটাকেও-

কত বিলিয়ন বছর একত্রে হেঁটে গেছে ওরা- মাথার উপরে প্যারালাল ভবিষ্যত থেমে আছে;

অ্যালার্ম দিতেছে মোবাইল ঘড়ি

আরও যান্ত্রিক হতে, সময়ফুরায়ে গেছে আমাদের, ফিরে যেতে হবে-

তবু রোবটের হাতে কফি খেতে চেয়েছিল মন- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গহিনে ভ্রমণ এখনও বাকি;

ইটারনিটির পথে হেঁটে হেঁয়ালির কুয়াশার ঘ্রাণ নিই- শেয়ালের প্রহরের ঘ্রাণ

ফিরে-আসে- গোপনে ভ্রমণ করে কবিতার হালটের পথে;

কোনো-এক প্যারালাল পৃথিবীতে হেঁটে যাচ্ছি যেন, টের পাই অলৌকিক আনন্দের ভারে অন্ধকারে- কালপুরুষের পেছনে লুব্ধক সেও লেগে আছে- অনেক হেঁটেছি গন্তব্যের অন্ধকারে পৌঁছে যেতে;

নিয়তি মুচকি হাসে;

মনের জমিন
রকিবুল হাসান
মন পুড়ে যাচ্ছে, যাক। আকাশ নতুন ছবি আঁকে

তোমার দুই চোখের সোনালি আলোয়।

হয়তো পুরনো কালে ছিল না পুরনো

দূরের পথিক

আমিই এসেছিলাম ভুলপথে ভুলের পথিক

গল্পের পাতারা খসে-খসে যাচ্ছে, যাক

জীবনও তো খসে যাচ্ছে, যাক।

কার শোকে জেগে আছো আঙুলে জড়িয়ে স্বরলিপি

জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে, যাক।

মন যাচ্ছে পুড়ে

পাতারাও যাচ্ছে ঝরে

যাক, সব পুড়ে যাক, সব ঝরে যাক

ৃকেবলি ভরে উঠুক মনের জমিনে লাল ফুল।

শূন্য মানুষ
মাসুদার রহমান
মুথাঘাস থানকুনি... মাটির নিবিড় কাছে

ঝুঁকে থাকা গ্রাম

তারপর ছড়ানো শস্যখেত, পুঁতে রাখা কঞ্চিতে

একাকী

একটি পাখি বসেছিল, আর একটি এসে

তার পাশে বসে আছে- হয়েছে দু’জন

তুমিও বারান্দায় বসে সমস্ত সকাল একা, তোমার ভাবনা

খোলা হাওয়ার প্রান্তর

শূন্যতা অগ্রহণীয়- তারপরও কোথাও আর আমি নেই

প্রকৃতি তা সহ্য করে না বলে, তোমার মনের পাশে

নতুন আর একজন এসে বসে আছে

আর যে শূন্য গণিতের; সেও এক সাঁওতাল গ্রামের

পাশে বসে, চোখের সামনে তার

বিরাম চিহ্নের মতো পাখিরা উড়ছে, হেমন্তের রোদমাখা

ধু ধু চরাচর

মাটির ভেতর ঘুমিয়ে থাকা শব্দ
শাহেদ কায়েস
হেমন্ত আসে না, জেগে ওঠে- যেন মাটির গভীরে অন্ধকারে বহুদিন সুপ্ত এক বীজ হঠাৎ আলোর মুখ দেখে। বাতাসে ঘামের গন্ধ, মাটির কপালে জমে বিন্দু-বিন্দু শিশির।

হেমন্তের সূর্য কাঁধে রাখে হাত, ক্লান্ত শরীরকে বলে- এখন বিশ্রামের সময়। তবু বিশ্রামের মাঝেও জেগে থাকে কিষানের মন, যেখানে মানুষ নিজেকে চিনে ফেলে ফসলের গন্ধে, ঘামে, ছায়ায়, শিশিরে।

শ্রম আর গান চলে একসাথে- কণ্ঠে বাউল সুর, চোখে অদেখা জগৎ; যে গান সময়ের আত্মজীবনী। হেমন্ত- মানুষের ভেতর জমে থাকা প্রেমের অঙ্কুরোদ্গম।

তোমাদের হেমন্তদিনে
শেলী নাজ
যে বাজারে মাংস বিক্রি হয় আমি সেইখানে

বেচতে এসেছি এক পঙ্ক্তি কবিতার মন

তোমাদের হেমন্তদিনে

নাকি সে হৃদয় আজ যার স্বর সহ¯্র বল্লমে

নিভে গেছে, তবু তার মরণবিথিকা ফুঁসছে আহ্লাদে

যেনবা মরার আগে অপচয়মূলক এ জীবনের মণি

কবিতার কিংখাবে ঢেকে রাখা যায়, বিমর্ষ ক্ষমায়

এই ঋতু পরিচয়হীন নগরে কোথায় অঘ্রান

প্রতি বারই হাটবার, প্রতিটি থলের মধ্যে

লুকোনো বিষাদ, সোনার মূর্তির চোখে ভাঙ্গা অভিলাষ

তারা জাদুকর, দেখি বিকিনির মধ্যে ভাটফুল,

দেখি বালিকার জঙ্ঘা ঘিরে নাচছে উত্তাল সমুদ্র,

সারাদিন শেষে না বিকোনো চকচকে মন নিয়ে ঘরে ফিরি

পরদিন হাটে আবার তাকে বেচতে আসব বলে

তোমাদের হেমন্তদিনে!

হেমন্তচ্ছবি
মুমির সরকার
কার্তিকের শেষবেলার নুয়ে পড়া আলোয়

উত্তরের পাহাড় চুমে আসা হিমেল হাওয়ায়

ধান উঠে যাওয়া খড়-পোড়া গন্ধ-ধোঁয়ায়

তোমার মুখচ্ছবি ঝাপসা হয়ে আসে!

শূকরপালে দুরন্ত গতিতে উঠে আসা ধুলোয়

কিন্নরী এক অন্ধকার,

গুল্মকাঁটার ঝোপঝাড় পেরিয়ে

আশ্রয় খুঁজে লয় উপবনে;

বাঁজা ডোবা-খাল-অপয়া দুই ঢালে।

খেলাশেষ উঠে আসা

ডানপিটে কিশোরদল,

দলছুট সামন্ত মোরগের তীক্ষè আর্তনাদে

সড়ক-যেতে-যেতেও বুঝিবা খোঁজে,

দু’চোখ আলো-জ্বলা বুনোশিয়ালরে।

চকিত ভেসে আসা

পাঁচমিশালি ডালফোঁড়ন আর

শিউলি-হেনা-বকুল-গন্ধরাজ সুবাসে

নিভু-নিভু আগুনে তেলসুঁজ পিদিম,

দাওয়া ছাড়িয়ে-

হিমরাত নিয়ে আসে, বিস্তীর্ণ জনপদে।

অতঃপর নিত্যকার ঘরকন্নার ক্ষুধা-প্রার্থনা-কামপ্রেম-ক্লান্তি:

হেমন্তচ্ছবি-

শিষ দিয়ে ফের ফিরে আসে। নবান্ন-বিস্ময়ে!

বিভোল হেমন্তে
মুশাররাত
আমরা শুভ শীতের জন্য অপেক্ষায় থাকবো না আর

জীবনে যখন সঙ্গী নিরন্তর হাহাকার

হেমন্তের কুয়াশা কিছু ভাসিয়ে নেয় না বিষাদ

ফোটায় না শিউলি অমর

মদির গন্ধে স্থবির হয় না

তোমার আমার বা আমাদের

মহুয়া সময়, মাতালে বিভোর।

হেমন্তচরিত
মঈনুল হাসান
মানুষ ও হেমন্তে

আমি কোনো পার্থক্য দেখি না,

সংযোগ যেখানে সুবিনীত

বিচ্ছেদ কোনো সুস্বপ্ন নয়।

হেমন্তের মন বড্ড ঋতুমতী

সময়ের দেহে কাঁচিকাটা করে

থরে থরে শুধু বিভক্তি আনে

আর আনে মওসুমি সোনালি পয়গাম।

রুখো বা সিক্ত সময়, নিষিক্ত হলে

অবশেষে সাহসী বীর্যে হেসে ওঠে

পরিণত ফসলসম্ভার।

মানুষ ও হেমন্তকে

আমি কখনও পৃথক করি না,

এমন হেমন্ত ভারে মানুষও ঋতুবতী হয়

লাঙলের বদলে তখন লিঙ্গের চাষ চলে

মানুষেরাও হয় হেমন্তবতী।

কার্তিকের রাতে
সঞ্জয় দেওয়ান
অদূরে ভায়োলিনের করুণ সুর

আঁচলভর্তি মেলানকলি নিয়ে ঘুমোতে যাই

কার্তিকের কালশিটে রাতে।

ঘুম ভাঙে ধান ভানার শব্দে

কিংবা ঢেঁকির তালে

রিক্ত মনে বিষণœতার ভোর

ভোরের দরোজায় টোকা দেয় অরুণিমা।

গঙ্গাফড়িং ওড়ে আনমনে

ধান কাটার গল্পে মশগুল ক্ষয়িষ্ণু রাত

পাকা ধানের গন্ধে বিলোল।

ঝরাপাতার শব্দে শিহরিত হই

উত্তরের হাওয়ায় অরুণিমার উষ্ণতা খুঁজি।

হেমন্ত যাপন
চামেলী বসু
সে সকল খোলা চিঠি নিয়ে ফিরে গেছে কোজাগরী রাত

কেবল তোমার চোখের অনুশাসনে জমে আছে অবোধ্য অক্ষর!

একান্ত বিরূপ সুখে পুড়ে

অথবা দীর্ঘ পথের মতো শুয়ে থেকে

ক্লান্তবেলায়-

তুমি

উত্তপ্ত পৃথিবীর বারুদগন্ধ ভুলে

এসো এই হিমহিম কার্তিকের ভাপ ওঠা ভোরে

তোমার শরীর থেকে শুষে নেই কুয়াশার ঘ্রাণ।

যেখানে হেমন্তের অলস মাঠে রচিত হয় নিয়ত ফসলের সোনালি কবর!

নবান্নের দিনগুলি
সাঈদ বারী
ধানের গন্ধে ভরে গেছে মাঠ-

ওই যে অগ্রহায়ণের রোদে কাঁপে মেঠো বাতাস,

গাঙপারের ছেলেটা

বাজায়

বাঁশের বাঁশি,

তার সুরে ওঠে উঠোনজুড়ে পাকা ধানের হাসি।

পুকুরপাড়ে হাঁসেরা ডানা ঝাড়ে,

চুলে গাঁদা ফুল গুঁজে

বউটি হাঁটে নরম হাওয়ায়,

চুলার আগুনে ভাজা হয় নতুন চালের খই।

আকাশে ধোঁয়া-ধরা বিকেল নামে ধীরে,

হেমন্তের সোনালি পর্দা টানে গোধূলি,

শিশিরে ভেজা ঘাসে পায়ের ছাপ পড়ে থাকে-

যেন মাটির বুকেও লেখা কোনো প্রেমপত্র।

ফসলের গন্ধে মিশে থাকে প্রার্থনা,

এই ভূমি,

এই মানুষ,

এই আনন্দ-

সবই তো এক ভাষার,

এক হৃদয়ের উপাসনা।

হেমের অন্তে
আমেনা তাওসিরাত
ভালোবেসে আমরা শাবকের ভাষায় কথা বলেছিলাম। পয়মন্ত প্রেমিকার মতো হেমন্তকে দূরে ঠেলে সদ্বংশের মেয়ে শীতকালকে প্রণয়ের পাত্র ভেবে পান করতে চেয়েছিলাম।

অন্নলোভাতুর হেমন্ত, অর্যমার প্রখর তাপে ভস্মীভূত করে দিতে চেয়েছিল শস্যের প্রহসন। উপকূলীয় কাঁকড়ার মতো স্নাত বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে আমরা পতনোন্মুখ পাতাদের আয়ুষ্কাল পড়ছিলাম। প্রথম ঋতুমতী হবার কদর্যতা আর বেড়ে যাওয়া পোশাকের ভারে ওরাও ভয়ার্ত আর বিমর্ষ ছিল।

বিমূর্ত নারীরা সব বুয়ী রাজবংশীয় শাহজাদীদের অগম্য পুরীতে ফিরে গিয়েছিলেন। সিংহের প্রহরায় ছেড়ে দিয়ে প্রকা- এক ধাতব ফটক। পার্সেপোলিসের আকেমেনীয় ধ্বংসাবশেষে শাহেনশাহেরা হয়তো সেইসব মহার্ঘ্যই শিলালিপিতে খোদাই করেছিলেন।

আকাশের সঙ্গে গায়ে গায়ে দাঁড়ানো হিমঝুরিদের কাফকার আঁকা গ্রামীণ পথের শিশুদের মতো প্রশান্ত আর ঘন মনে হচ্ছিল, যেন মর্মভেদী গন্ধ নিয়ে সারারাত ফুটে ঝরে যাবার আগে বুকের ওপর দু’হাত বেঁধে একে অন্যকে দেখে নেবে। যেন ছাতিমের ছাতায় আমাদের শৈশবের বিবরণসমূহ প্রগাঢ় আর শ্বেতময়। উপধা, শঠতা, গোত্রপিতাদের কপটতা আর জহরের জ্বরে তখনও আচ্ছন্ন হইনি। ঈষৎ হিমের পাশে দাঁড়িয়ে যজ্ঞের আগুন কামনার দিনও সে ছিল না। দুপুরচ-ীর অপাঙ্গ ফুলেরা তা জানে আর ভাবতে বসে- মৃত মায়েদের মেয়েদের শৈশব কবে হেমের অন্তে কবরখানার দিকে চলে গেছে।

back to top