alt

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৯

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

: বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

গতকাল নববর্ষের প্রথম দিনটি কাটে নিসর্গের প্রশস্ত ও প্রশান্ত এক কোলে- পার্কে মারিয়া লুইজা-তে। প্রকৃতির মাঝে নিশ্চয়ই হারিয়ে গিয়েছিলাম, সেজন্যই হয়তো এ পার্কের ভেতরের একটি অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্য চোখে পড়েনি। অবশ্য সেটি পুরোপুরি বলা যায় না। আগে সবাই তা দেখেছি জাহাজ থেকে, আর আমি ঘোড়ার গাড়িতে চড়েও দেখেছি। তবে এবার আরো কাছ থেকে ভালো করে দেখার পালা।

নাবিল বলল, ‘এগুলি একবার দেখেছি, আবার কেন দেখব?’। বললাম, ‘সিনেমার লং শট, ক্লোজ আপ বিষয়ে তুমি জান। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম। এসব জায়গাগুলি আগে দেখেছি লং শটে, এবার দেখব ক্লোজ আপে। একটি জিনিসকে ভালভাবে দেখতে হলে এ দুটি শটেই দেখা দরকার।’

আলাপ হচ্ছিল ‘প্লাসা দে এসপানিয়া’ নিয়ে,স্পেনের সবচেয়ে সুন্দর প্লাজাটি এই সেভিয়াতেই- একে ভালো করে দেখার দিন আজ। এ স্থাপত্যটি ১৯২৯ সালের আইবেরীয়-আমেরিকান এক্সপোজিশনের জন্য নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল- স্পেনের পুরনো উপনিবেশগুলির সাথে অতীতের তিক্ততা মুছে বন্ধুত্বের এক নব অধ্যায় রচনা করা। এর অর্ধবৃত্তাকার নকশার প্রতীকী অর্থ- স্পেনের উপনিবেশগুলির সবাইকে বরণ। শেষ ভবনটির পাশেই গুয়াদিলকিবির নদী- নিউ ওয়ার্ল্ডে যাত্রার সূচনা বিন্দু- এখানেই রচিত হবে বন্ধুত্বের বন্ধন।

‘প্লাসা দে এসপানিয়া’-র স্থপতি এনিবেল গনজালেস এর মনুমেন্টটি দাঁড়িয়ে আছে প্লাজার প্রধান প্রবেশ পথে। সেভিয়ার এ মহান স্থপতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা প্লাজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এনিবেল গনজালেস এখানে মিশ্রিত করেছেন বিভিন্ন স্থাপত্য- নব্য মুডেহার১, স্পেনীয় রেনেসাঁ ও বারোক রেনেসাঁ।

দুটি টাওয়ারের মাঝে লাল ইটের সুরম্য ভবন, সজ্জিত টালি, ফোয়ারা, মনুমেন্ট, খাল, সেতু নিয়ে ৫০ হাজার বর্গমিটারের অনিন্দ্যসুন্দর এক স্থাপনা প্লাসা দে এসপানিয়া। প্রকৃতি ও স্থাপত্যের এ মিলনকেন্দ্রে মানুষ, ঘোড়ার গাড়ি ও সাইকেলের ভিড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ।

একটি সুদৃশ্য সেতু পার হয়ে ভবনের ভেতরে গেলাম। ভবনে যাবার জন্য আছে এরকম৪টি সেতু স্পেনের পুরনো ৪টি রাজ্যের প্রতীক। ঘুরে ঘুরে দেখলাম বহু চত্বর ও বেঞ্চ-আন্দালুসিয়ার ঐতিহ্যবাহী আছুলেহোস টালি দিয়ে সজ্জিত। স্পেনীয় ভাষার বর্ণানুক্রম হিসেবে প্রদেশগুলোর নাম এসেছে। প্রথম বর্ণ দিয়ে শুরু প্রদেশের নাম ‘অষধাধ’,‘আলাভা’ দিয়ে প্রথম চত্বর ও বেঞ্চ-রঙিন টালি দিয়ে সজ্জিত নাম ও মানচিত্র, সাথে তার ইতিহাসের ফ্রেসকো। শেষ বর্ণের প্রদেশের নাম-‘তধৎধমড়ুধ’,‘ছারাগোছা’-এর চত্বর ও বেঞ্চ দিয়ে নকশার সিরিজ শেষ হয়েছে। নাতাশা ও নাবিল একে একে গণনা করল, মোট ৪৮টি চত্বর ও বেঞ্চ- স্পেনের ৪৮টি প্রদেশের নাম,মানচিত্র ও ইতিহাসের ছবি দিয়ে সজ্জিত। দেখলাম অনেকে তাদের প্রদেশের চত্বরে যেয়ে বসছে,গল্প করছে, ছবি তুলছে।

নাবিল ও নাতাশার দৃষ্টি কেড়ে নিল প্লাজার পরিধি জুড়ে ৫১৫ মিটার দীর্ঘ বাকানো এক খাল ও তার ওপরের ব্রিজ, সাথে খালে ভেসে বেড়ানো গন্ডোলা২। মনে হল ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানালের রিয়ালতো ব্রিজের কাছে কোন এক গন্ডোলা দেখছি। এরপর রাজহাঁসের মতো ভেসে ভেসে আসল আরো কটি রঙিন গন্ডোলা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে টিকিট কেটে সবাই উঠলাম এক গন্ডোলায়, আর নিজ হাতে দাঁড় টেনে তা চালাতে লাগলাম চারজনই। এর ওপরে ভাসতে ভাসতে মনে পড়ে গেল- নিজ জেলা চাঁটগার কর্ণফুলী নদীর ওপরে সাম্পানে আমার ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি। সাম্পানে উঠতেই নাকে ভেসে আসত আলকাতরার গন্ধ। মনে পড়ে কী সুন্দর সাম্পানের গঠন! সবচেয়ে মুগ্ধ করতো মাঝির দুহাত দিয়ে দুদিকের দাঁড় টেনে নৌকা চালানো- তা তৈরি করত এক শব্দ-কেঁ কোঁরত- কী অপূর্ব এক শব্দ মূর্ছনা। স্মৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতেই আমাদের ট্রিপ শেষ হয়ে আসল। গন্ডোলা থেকে নেমে পড়লাম।

বাকানো ব্রিজের সাথে ‘প্লাসা দে এস্পানিয়া’-র এক পোর্টিকোর অংশ- দুদিন আগেই দেখেছিলামলরেন্স অফ অ্যারাবিয়া মুভির এ লোকেশনটি। তার সামনে আসতেই দেখি এক জটলা, সাথে নাচ-গানের শব্দসঙ্গীত। নাতাশা বলে উঠল, ‘ফ্লেমেনকো’। এ নাচ-গানের সাথে তাদের পরিচয় হয়েছিল গ্রানাদা-য়। তারা বুঝতে পেরেছে স্পেনে তার স্থান।

ফ্লেমেনকোতে মেতে আছে একদল তরুণ-তরুণী। দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, একজন এসে হেসে পরিচয় দিল, নাম, ভিয়েগাস, এদের দলপতি। বললেন, ‘যে নাচছে, সে আমার মেয়ে, নাওমি।’ আমি বললাম, ‘দেখলাম, ফ্লেমেনকো তোমাদের খুব প্রিয়।’ উনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। এখানে মেয়েরা বড় হতেই স্বপ্ন দেখে ফ্লেমেনকো নৃত্যশিল্পী হবার। আমাদের আন্দালুসিয়ার সত্তায় মিশে আছে ফ্লেমেনকো, লা করিদা, তাপাস।’ নাবিল জিজ্ঞেস করল, ‘লা করিদা’ কী?’ মেনহিভার বললেন, ‘যাকে তোমরা বল, বুল ফাইটিং। তোমাকে স্পেনের সংস্কৃতি স্পেনীয় ভাষায় বলতে হবে।’

বললাম, ‘গ্রানাদা-য় জিপসিদের পাড়া সেক্রোমন্তে যেয়ে ফ্লেমেনকো নাচ দেখেছি’। ভিয়েগাস একটু হেসে বললেন, ‘আমাদের এখানে সেরকম আছে থ্রিয়ানা- ফ্লেমেনকো শিল্পীদের পাড়া’। বললাম, ‘দুদিন আগে তা দেখেছি, অবশ্য রিভার ক্রুজ থেকে।’ তিনি বললেন, ‘সময় পেলে জায়গাটি ঘুরে দেখবে। আমাদের গর্ব, ফ্লেমেনকো-র জন্ম এই সেভিয়াতে।’ নাতাশা বলল, ‘আমরা গ্রানাদা-য় শুনেছি সেখানেই ফ্লেমেনকোর জন্ম। কোনটি ঠিক?’ মেনহিভার একটু হেসে, খানিক থেমে বললেন, ‘ইতিহাস তো সমর্থন করে সেভিয়া-র দাবীকে।’

সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর এক জায়গা হল প্লাসা দে এসপানিয়া। তবুও আমাদের চলে যেতে হল, কারণ সেভিয়া-র আরো কিছু দেখতে হবে।

প্রথমেই আসে আলকাছার। সেভিয়ার মাঝখানে আলকাছার দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের বহু ছাপ গায়ে মেখে। এ যেন সমুদ্রের তলদেশ, যেখানে বিভিন্ন যুগের পলিস্তর একটির ওপরে আরেকটি জমা হয়েছে, কোনোটিই হারিয়ে যায়নি। ইতিহাস তো মুছে ফেলা যায় না, সে যে কোনোভাবে তার চিহ্ন রেখে যায়।এই আলকাছার দুর্গ একই সাথে ধারণ করেছে কয়েকটি সভ্যতার দশ শতাব্দীর ইতিহাস ও স্থাপত্য। ক্ষমতা ও রাজত্ব পরিবর্তনের সাথে সাথে আলকাছার এর হতে থাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন।

আলকাছারের সদর দরজাটি অলংকৃত করা হয়েছে চিনেমাটির এক সিংহ দিয়ে- তাই এর নাম পুয়ের্থা দেল লেয়ন, অর্থাৎ, সিংহ ফটক। এর সামনেই আমাদের তরুণ গাইড জোয়েল রোহো অপেক্ষা করছিল তাঁর কমলা-সবুজ ছাতা নিয়ে। স্মিত হেসে স্বাগত জানাল আমাদের গ্রুপের ১০ জনকে। সবার সাথে পরিচিত হয়ে জোয়েল শুরু করল‘আলকাছার’-এর ইতিহাস বর্ণনা।

‘আলকাছার’ শুরুতে ছিল এক রোমান বসতি, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে যার নাম ছিল হিসপালিস। পরে এখানে এক রোমান দুর্গ নির্মাণ করা হয়। ৪১৫ সালে ভিজিগথরা রোমানদের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে স্পেনে প্রবেশ করে। ৫ম শতাব্দীর শেষের দিকে ভিজিগথরা স্পেনে প্রভাবশালী হয়ে উঠে। তখন রোমান দুর্গটিকে তারা অধিকার করে। আফ্রিকা থেকে আসা মুররা ৭১১ থেকে ৭১৯ সালের মধ্যে ভিজিগথদের পরাজিত করে সেভিয়াসহ স্পেনের দক্ষিণাঞ্চল অধিকার করে নেয়। কর্ডোভার খলিফা তৃতীয় আবদ-আল রহমান ৯১৩ সালে মূল রোমান দুর্গটিকে পরিণত করেন মুর দুর্গ-রাজপ্রাসাদে। কাস্তিলের রাজা তৃতীয় ফার্দিনান্দ ১২৪৮ সালে সেভিয়া অধিকার করেন, আলকাছারহয়ে যায় কাস্তিলের রাজার রাজভবন। তাঁর ছেলে দশম আলফানসো ১২৫২ থেকে ১২৮৪ পর্যন্ত কাস্তিলের রাজা ছিলেন। এসময় তিনি এখানে যোগ করেন এক গথিক রাজপ্রাসাদ।

এরমধ্যে ১২৩৮ সালে গ্রানাদা-য় আলহাম্বরা-র নির্মাণ কাজ শুরু করেন নাসিরীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ ইবনে আল আমর। আলহাম্বরা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে ১৪শ’ শতাব্দীতে একাদশ আলফনসো এবং প্রথম পেদরো ‘আলকাছার’-এর পুনর্নির্মাণ করেন, যার ভিত্তিমুডেহার স্থাপত্য।১‘আলকাছার’-কে ধরা হয় স্পেনে মুডেহার স্থাপত্যের সেরা নিদর্শন।’

এতটুকু বলে জোয়েলে-র অনুযোগ, ‘ইতিহাস শুনতে কেউ পছন্দ করে না। তবে ইতিহাসের উল্লেখ ছাড়া ‘আলকাছার’ এর বর্ণনা সঠিক হবে না। কারণ, ইতিহাসের সাথে সাথে এর আকার, আকৃতি, নকশা সবই বদলে গেছে। যা হোক, বাকি ইতিহাস তোমাদের বলব ‘আলকাছার’-এর ভেতরে যেয়ে।’

‘পুয়ের্থা দেল লেয়ন’দিয়ে প্রবেশ করলাম ‘পাথিও দেল ইয়েসে’নামক এক সুন্দর চত্বরে। এখানে দেখি আলমোহাদ শিল্পীদের সুনিপুণ কাজ- স্টাকো- যা মূলত আস্তর-এর কারুকাজ।

আরো কটি কক্ষ পার হয়ে ঢুকলাম প্রথম পেদ্রোর প্রাসাদে, যা মুডেহার স্থাপত্যে তিনি নির্মাণ করেছেন ১৩৬০ সালে। এখানে একটি সুন্দর চত্বরের সামনে আমাদের নিয়ে জোয়েল জানাল, ‘এটি হচ্ছে আলকাছার-এর সবচেয়ে সুন্দর আঙিনা-‘পাথিও দে লাস দনসেয়াস’। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম বিরাট বারান্দার চারপাশে স্টাকো-র কারুকাজে করা সুন্দর খিলান, মাঝখানে জলাশয়, পাশে বাগান।

নাতাশা বলল, ‘আমার কাছে এটি দেখে মনে হয় আলহাম্বরা-র পাথিও দে লস আরাইয়ানিস।’ জোয়েল খুশি হয়ে বলল, ‘তুমি ভালই দেখেছ। একটু পরে আমি কারণ বলছি।’

এরপর খুবই জাকজমকপূর্ণ এক প্রাসাদ-কক্ষে নিয়ে এসে জোয়েল বলল, ‘এর নাম সালোন দে লস এমবাহেদোরেস- এটি পুরো আলকাছার-এর সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে বড় কক্ষ, যা ছিল রাজাদের সম্বর্ধনা ও অভ্যর্থনার কেন্দ্র।’ মুগ্ধ হয়ে দেখলাম এর গম্বুজ আকৃতির সিলিংটি, যাতে সন্নিবেশ করা হয়েছে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা বহু কাঠ, যা মিলে যেন তৈরি হয়েছে এক আকাশ।

এরকম স্থাপত্য মনে হয় এর আগে কোথাও দেখেছি। তা ভাবতে ভাবতেই নাবিল বলে উঠল, ‘এটি দেখতে আলহাম্বরার সালা দে কমারেস এর মতো লাগে।’ হ্যাঁ, এখন মনে পড়ল, এ দুটি স্থাপত্যে বেশ মিল আছে।

নাবিল ও নাতাশাকে জোয়েল বলল, ‘তোমরা দুজনেই সঠিকভাবে দেখেছ। আলকাছার প্রাসাদের এ দুটি অংশ-‘পাথিও দে লাস দনসেয়াস’ও ‘সালোন দে লস এমবাহেদোরেস’- আলহাম্বরার স্পষ্ট ছাপ ধারণ করে আছে। কারণ, এ দুটি নির্মাণ করার সময় প্রথম পেদ্রো সাহায্য চেয়ে চিঠি দেন গ্রানাদা-র আমিরের কাছে। তিনি সেসব কারিগরদের পাঠান যারা আলহাম্বরা-র নির্মাণে অংশ নিয়েছিল। তাই তাদের কাজে ফুটে ওঠে আলহাম্বরার নকশার প্রভাব।’

প্রাসাদের আরো কয়েকটি অংশ দেখানোর পর জোয়েল আমাদের নিয়ে যায় আলকাছার এর বিশাল বাগানে। সবচেয়ে পুরনো আলকোবা বোয়র- মুরদের তৈরি রঙিন টালি আবৃত এক প্যাভিলিয়ন, যার চারপাশে সুন্দর বাগান। এ বাগান যেহেতু সেভিয়ায়, এখানে তো কমলা গাছ থাকবেই। তা অবশ্য আছে, এবং অজ¯্র সংখ্যায়।

কমলা ফুলের মিষ্টি গন্ধে হাঁটতে হাঁটতে প্যাভিলিয়নের সামনে আমরা জড়ো হলাম। এখানেই শেষ হবে আমাদের ট্যুর। জোয়েল বলল, ‘বিদায়ের আগে তোমাদের এক মজার কথা বলি। মার্মালেড তৈরির জন্য সেভিয়ার কমলার বেশ চাহিদা আছে ব্রিটেনে। ২০ শতকে সেভিয়ায় একটি প্রথা ছিল, যা আবার চালু করা হয়েছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বছরের এক বিশেষ সময় আলকাছার আসেন। এখানকার বাগান থেকে বাছাইকৃত কমলার এক ব্যাগ তাঁর হাতে তুলে দেন সেভিয়ার মেয়র। পরে তা পাঠানো হয় ব্রিটিশ রাজপরিবারে, সেভিয়ার উপহার হিসেবে, যা দিয়ে তৈরি করা হয় মার্মালেড।’ এটুকু বলে জোয়েল প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কে কে সেভিয়ার কমলার স্বাদ নিয়েছ?’ এর মধ্যে একমাত্র হাত উঠল আমার- দলের বাকি ৯ জন ছিল নীরব।

সেভিয়ায় আমাদের শেষ গন্তব্য-সেভিয়া ক্যাথেড্রাল। আলকাছার এর পাশেই এই বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল। কাজেই হেঁটে যেতে বেশি সময় লাগল না। এখন পড়ন্ত বেলায় ভিড়ও বেশ কম। পুয়ের্থা দেল লাগারথো গেটে যেতেই দেখা হলো গাইড গেভারা সোসার সাথে। দলে আমরা মোট ৮ জন গেভারাকে অনুসরণ করে ক্যাথেড্রালের ভেতরে ঢুকলাম।

কয়েকটি স্থান পার হয়ে গেভারা আমাদের নিয়ে আসল প্রধান বেদীর সামনে- ৮০ ফুট লম্বা স্বর্ণের এক ঝলমলে দেয়াল, যা বহু ভাস্কর্য দিয়ে আবৃত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম বেদী, রিথাবলো মেয়র, যা শেষ করতে ১৪৮১ থেকে ১৫৬৪ পর্যন্ত তিন প্রজন্মের কারুশিল্পীরা কাজ করেছে। ৪৪ টি দৃশ্যে যিশু ও মেরীর কাহিনি বর্ণনা করেছে এখানে- বাম থেকে ডানে, নীচে থেকে ওপরে। এর সিলিং ভরে আছে সূক্ষ কারুকাজে- যেখানে খিলানগুলো পরস্পরের ওপর খচিত।

বিশাল ক্যাথেড্রালে আরো বহু কিছু দেখলাম, সবকিছুই অনন্য সুন্দর। এরপর গেভারা আমাদের নিয়ে আসল এমন এক জায়গায় যা দেখার জন্য অনেকের গভীর আগ্রহ!

এ হলো‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস’-এর সমাধিস্তম্ভ। স্পেনের প্রাচীন চার রাজ্য- কাস্তিয়া, আরাগন, লেয়ন, নাভারা- তাদের রাজারা বহন করছেন কলম্বাসের দেহাবশেষ।

গেভারা শুরু করল তার বর্ণনা, ‘কীভাবে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের দেহাবশেষ সেভিয়াতে এলো, সে এক বড় ইতিহাস। অনেকে বলে, কলম্বাস জীবিত থাকতে যত ভ্রমণ করেছেন, মৃত্যুর পর করেছেন আরো বেশি। তিনি ১৫০৬ সালে মারা যান স্পেনের উত্তর-পশ্চিমের ভায়াদলিথ শহরে, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরে তাঁর মরদেহ সেভিয়ার এক মঠে নিয়ে আসা হয়। পরে কলম্বাস-র ইচ্ছে অনুসারে তাঁকে আবার সমাহিত করা ক্যারিবিয়ান দ্বীপ ডোমিনিকান রিপাবলিক-এর এক সমাধিতে। এরপর তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় কিউবায়। ১৯০২ সালে স্পেন থেকে কিউবা স্বাধীন হয়ে গেলে কলম্বাস-র দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় বর্তমানের অবস্থান, সেভিয়া ক্যাথেড্রাল-এ। কলম্বাস অনেক ভ্রমণ করেছেন, জীবনে, এবং মৃত্যতেও।’

এরপর আসলাম ‘পাথিও দে লস নারানহোস’, অর্থাৎ কমলা বাগানের চত্বরে। চারদিকে বহু কমলা গাছ ছাড়াও পাম গাছ, সাইপ্রেস, মাঝে ভিসিগতদের একটি বেসিন ও ফোয়ারা একে সুশোভিত করে রেখেছে। এখানে এস অনুভব করলাম এক প্রশান্তি। মুসলিম আমলে এটি ছিল পাশের মসজিদের অজু করার স্থান। দুটিই এখন হয়ে গেছে ইতিহাস।

সবশেষে আসলাম পাশের হিরালদা টাওয়ার এ, যা আগে ছিল মসজিদের এক মিনার, এখন হয়ে গেছে গির্জার বেল টাওয়ার। এ যেন সেভিয়া-র ইতিহাসের পরিবর্তন একই সাথে ধরে রেখেছে। এর ভিত্তিতে আছে প্রাচীন রোম থেকে কেটে আনা পাথর, মাঝখানে মুরদের কারুকাজ করা হলদে-সোনালি রঙের ইটের টাওয়ার, এবং ওপরের অংশ- ক্যাথলিকদের ১৫৫০ সালে গড়া চূড়ায় আছে ৪০০০ পাউন্ড ওজনের এক দেবী মূর্তি, ‘এল হিরালদিও’, যা বাতাসের দিক নির্দেশ করে।

আমরা এখান থেকে বের হতেই বেজে উঠল ‘হিরালদা টাওয়ার’-এর ঘণ্টাধ্বনি, যেন ধ্বনিত হচ্ছে আমাদের বিদায়ের বার্তা- শুধু ‘হিরালদা টাওয়ার’ থেকে নয়, সেভিয়া থেকেও।

হিরালডা টাওয়ারের কথাই যেন বলেছেন লোরকা তাঁর এ কবিতায়:

বুরুজচুড়োয়,

হলদে বুরুজচুড়োয়,

ঘণ্টা বাজছে।

হাওয়ার মধ্যে,

হলদে হাওয়ার মধ্যে

ঘণ্টার আওয়াজ ছড়িয়ে যাচ্ছে চতুর্ধারে।

যেন ছুরির ঝলসানো কিঙ্কিণী,

দূরান্তে ফুটিয়ে তুলছে ক্ষত।৩

এখান থেকে ফিরে যেতে নাতাশা বলল, ‘সেভিয়া হলো কমলা বাগানের, যে রকম গ্রানাদা ডালিমের’। নাবিল বলল, ‘সেভিয়া হরেঅ কলম্বাসের, যে রকম গ্রানাদা লোরকার’। দুজনের কথাই ঠিক। সেভিয়ার আইকন হয়ে উঠেছে কমলা ও কলম্বাস, যে রকম গ্রানাদা-র আইকন ডালিম ও লোরকা। ক্রমশ...

Ref:

মুদেহার স্থাপত্য হচ্ছে ইসলামী ও খ্রিস্টান শৈলীর মিশ্রণে স্পেনে বিকশিত এক স্থাপত্য শৈলী। গথিক স্থাপত্য শৈলীতে জোর দেয়া হয় উচ্চতা ও আলোর ওপর, তার বৈশিষ্ট্য হলো সুঁচালো খিলান।

গন্ডোলা: ঐতিহ্যবাহী, সরু ও লম্বা একটি নৌকা। দাঁড়িয়ে একজনকে তা চালাতে হয় দাঁড় টেনে। এটি ভেনিসে খুবই জনপ্রিয়।

Bla elipse de un grito, অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবি

বুভুক্ষা শিল্পী ও একথালা ভাত

ছবি

কয়েকটি নির্ঘণ্ট

ছবি

নূরুল হকের অপ্রকাশিত কবিতা

ছবি

বিষাদমাখা সুন্দরের ডাকহরকরা

শিশিরস্নাত পদাবলি

ছবি

শিল্পের স্বাধীনতা মানেই মানুষের স্বাধীনতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বনানীর ঢালু রাস্তা বেয়ে

দিলারা হাফিজ-এর কবিতা

ছবি

বাংলা কবিতার উদ্ভাসিত স্বর

ছবি

শরীরী অশরীরী

ছবি

বিষণ্ণতার কবি আবুল হাসান

ছবি

উত্তরাধুনিক সাহিত্যের সুলুক সন্ধান

দূরের পথ বাতিঘর

কচুরিপানা

অল্প-স্বল্প : মিথ্যা-সত্য

মানুষ চাই

বাঘ

বিষাদমন্ত্রী

বুকের রেহেলে

নবান্ন

জলের নক্ষত্র

সততাও লুপ্ত হচ্ছে লুপ্তবংশে

ছবি

বিলেতে বাঙালির শিল্পসাহিত্যের প্রতিনিধি

ছবি

বিপন্ন সময়ের জীবনশিল্পী

ছবি

লাল ফুলের খোঁপা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

জনপ্রিয় সাহিত্যের জাদুকর

ছবি

দেশ ভাগের আর্তনাদ

ছবি

অনুবাদকের দায় : বিশ্বস্ততা নাকি সরলতা?

কার্তিকের স্নান

আমি- শেষ

ছবি

মহিবুল আলমের কবিতায় নদী ও নারী

ছবি

কবি মাহমুদ কামাল ও নিমগ্ন আত্মার সাধক

ছবি

স্পর্শ

ছবি

নুরুন্নাহার মুন্নির গল্প

tab

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৯

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

গতকাল নববর্ষের প্রথম দিনটি কাটে নিসর্গের প্রশস্ত ও প্রশান্ত এক কোলে- পার্কে মারিয়া লুইজা-তে। প্রকৃতির মাঝে নিশ্চয়ই হারিয়ে গিয়েছিলাম, সেজন্যই হয়তো এ পার্কের ভেতরের একটি অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্য চোখে পড়েনি। অবশ্য সেটি পুরোপুরি বলা যায় না। আগে সবাই তা দেখেছি জাহাজ থেকে, আর আমি ঘোড়ার গাড়িতে চড়েও দেখেছি। তবে এবার আরো কাছ থেকে ভালো করে দেখার পালা।

নাবিল বলল, ‘এগুলি একবার দেখেছি, আবার কেন দেখব?’। বললাম, ‘সিনেমার লং শট, ক্লোজ আপ বিষয়ে তুমি জান। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম। এসব জায়গাগুলি আগে দেখেছি লং শটে, এবার দেখব ক্লোজ আপে। একটি জিনিসকে ভালভাবে দেখতে হলে এ দুটি শটেই দেখা দরকার।’

আলাপ হচ্ছিল ‘প্লাসা দে এসপানিয়া’ নিয়ে,স্পেনের সবচেয়ে সুন্দর প্লাজাটি এই সেভিয়াতেই- একে ভালো করে দেখার দিন আজ। এ স্থাপত্যটি ১৯২৯ সালের আইবেরীয়-আমেরিকান এক্সপোজিশনের জন্য নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল- স্পেনের পুরনো উপনিবেশগুলির সাথে অতীতের তিক্ততা মুছে বন্ধুত্বের এক নব অধ্যায় রচনা করা। এর অর্ধবৃত্তাকার নকশার প্রতীকী অর্থ- স্পেনের উপনিবেশগুলির সবাইকে বরণ। শেষ ভবনটির পাশেই গুয়াদিলকিবির নদী- নিউ ওয়ার্ল্ডে যাত্রার সূচনা বিন্দু- এখানেই রচিত হবে বন্ধুত্বের বন্ধন।

‘প্লাসা দে এসপানিয়া’-র স্থপতি এনিবেল গনজালেস এর মনুমেন্টটি দাঁড়িয়ে আছে প্লাজার প্রধান প্রবেশ পথে। সেভিয়ার এ মহান স্থপতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা প্লাজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এনিবেল গনজালেস এখানে মিশ্রিত করেছেন বিভিন্ন স্থাপত্য- নব্য মুডেহার১, স্পেনীয় রেনেসাঁ ও বারোক রেনেসাঁ।

দুটি টাওয়ারের মাঝে লাল ইটের সুরম্য ভবন, সজ্জিত টালি, ফোয়ারা, মনুমেন্ট, খাল, সেতু নিয়ে ৫০ হাজার বর্গমিটারের অনিন্দ্যসুন্দর এক স্থাপনা প্লাসা দে এসপানিয়া। প্রকৃতি ও স্থাপত্যের এ মিলনকেন্দ্রে মানুষ, ঘোড়ার গাড়ি ও সাইকেলের ভিড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ।

একটি সুদৃশ্য সেতু পার হয়ে ভবনের ভেতরে গেলাম। ভবনে যাবার জন্য আছে এরকম৪টি সেতু স্পেনের পুরনো ৪টি রাজ্যের প্রতীক। ঘুরে ঘুরে দেখলাম বহু চত্বর ও বেঞ্চ-আন্দালুসিয়ার ঐতিহ্যবাহী আছুলেহোস টালি দিয়ে সজ্জিত। স্পেনীয় ভাষার বর্ণানুক্রম হিসেবে প্রদেশগুলোর নাম এসেছে। প্রথম বর্ণ দিয়ে শুরু প্রদেশের নাম ‘অষধাধ’,‘আলাভা’ দিয়ে প্রথম চত্বর ও বেঞ্চ-রঙিন টালি দিয়ে সজ্জিত নাম ও মানচিত্র, সাথে তার ইতিহাসের ফ্রেসকো। শেষ বর্ণের প্রদেশের নাম-‘তধৎধমড়ুধ’,‘ছারাগোছা’-এর চত্বর ও বেঞ্চ দিয়ে নকশার সিরিজ শেষ হয়েছে। নাতাশা ও নাবিল একে একে গণনা করল, মোট ৪৮টি চত্বর ও বেঞ্চ- স্পেনের ৪৮টি প্রদেশের নাম,মানচিত্র ও ইতিহাসের ছবি দিয়ে সজ্জিত। দেখলাম অনেকে তাদের প্রদেশের চত্বরে যেয়ে বসছে,গল্প করছে, ছবি তুলছে।

নাবিল ও নাতাশার দৃষ্টি কেড়ে নিল প্লাজার পরিধি জুড়ে ৫১৫ মিটার দীর্ঘ বাকানো এক খাল ও তার ওপরের ব্রিজ, সাথে খালে ভেসে বেড়ানো গন্ডোলা২। মনে হল ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানালের রিয়ালতো ব্রিজের কাছে কোন এক গন্ডোলা দেখছি। এরপর রাজহাঁসের মতো ভেসে ভেসে আসল আরো কটি রঙিন গন্ডোলা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে টিকিট কেটে সবাই উঠলাম এক গন্ডোলায়, আর নিজ হাতে দাঁড় টেনে তা চালাতে লাগলাম চারজনই। এর ওপরে ভাসতে ভাসতে মনে পড়ে গেল- নিজ জেলা চাঁটগার কর্ণফুলী নদীর ওপরে সাম্পানে আমার ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি। সাম্পানে উঠতেই নাকে ভেসে আসত আলকাতরার গন্ধ। মনে পড়ে কী সুন্দর সাম্পানের গঠন! সবচেয়ে মুগ্ধ করতো মাঝির দুহাত দিয়ে দুদিকের দাঁড় টেনে নৌকা চালানো- তা তৈরি করত এক শব্দ-কেঁ কোঁরত- কী অপূর্ব এক শব্দ মূর্ছনা। স্মৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতেই আমাদের ট্রিপ শেষ হয়ে আসল। গন্ডোলা থেকে নেমে পড়লাম।

বাকানো ব্রিজের সাথে ‘প্লাসা দে এস্পানিয়া’-র এক পোর্টিকোর অংশ- দুদিন আগেই দেখেছিলামলরেন্স অফ অ্যারাবিয়া মুভির এ লোকেশনটি। তার সামনে আসতেই দেখি এক জটলা, সাথে নাচ-গানের শব্দসঙ্গীত। নাতাশা বলে উঠল, ‘ফ্লেমেনকো’। এ নাচ-গানের সাথে তাদের পরিচয় হয়েছিল গ্রানাদা-য়। তারা বুঝতে পেরেছে স্পেনে তার স্থান।

ফ্লেমেনকোতে মেতে আছে একদল তরুণ-তরুণী। দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, একজন এসে হেসে পরিচয় দিল, নাম, ভিয়েগাস, এদের দলপতি। বললেন, ‘যে নাচছে, সে আমার মেয়ে, নাওমি।’ আমি বললাম, ‘দেখলাম, ফ্লেমেনকো তোমাদের খুব প্রিয়।’ উনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। এখানে মেয়েরা বড় হতেই স্বপ্ন দেখে ফ্লেমেনকো নৃত্যশিল্পী হবার। আমাদের আন্দালুসিয়ার সত্তায় মিশে আছে ফ্লেমেনকো, লা করিদা, তাপাস।’ নাবিল জিজ্ঞেস করল, ‘লা করিদা’ কী?’ মেনহিভার বললেন, ‘যাকে তোমরা বল, বুল ফাইটিং। তোমাকে স্পেনের সংস্কৃতি স্পেনীয় ভাষায় বলতে হবে।’

বললাম, ‘গ্রানাদা-য় জিপসিদের পাড়া সেক্রোমন্তে যেয়ে ফ্লেমেনকো নাচ দেখেছি’। ভিয়েগাস একটু হেসে বললেন, ‘আমাদের এখানে সেরকম আছে থ্রিয়ানা- ফ্লেমেনকো শিল্পীদের পাড়া’। বললাম, ‘দুদিন আগে তা দেখেছি, অবশ্য রিভার ক্রুজ থেকে।’ তিনি বললেন, ‘সময় পেলে জায়গাটি ঘুরে দেখবে। আমাদের গর্ব, ফ্লেমেনকো-র জন্ম এই সেভিয়াতে।’ নাতাশা বলল, ‘আমরা গ্রানাদা-য় শুনেছি সেখানেই ফ্লেমেনকোর জন্ম। কোনটি ঠিক?’ মেনহিভার একটু হেসে, খানিক থেমে বললেন, ‘ইতিহাস তো সমর্থন করে সেভিয়া-র দাবীকে।’

সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর এক জায়গা হল প্লাসা দে এসপানিয়া। তবুও আমাদের চলে যেতে হল, কারণ সেভিয়া-র আরো কিছু দেখতে হবে।

প্রথমেই আসে আলকাছার। সেভিয়ার মাঝখানে আলকাছার দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের বহু ছাপ গায়ে মেখে। এ যেন সমুদ্রের তলদেশ, যেখানে বিভিন্ন যুগের পলিস্তর একটির ওপরে আরেকটি জমা হয়েছে, কোনোটিই হারিয়ে যায়নি। ইতিহাস তো মুছে ফেলা যায় না, সে যে কোনোভাবে তার চিহ্ন রেখে যায়।এই আলকাছার দুর্গ একই সাথে ধারণ করেছে কয়েকটি সভ্যতার দশ শতাব্দীর ইতিহাস ও স্থাপত্য। ক্ষমতা ও রাজত্ব পরিবর্তনের সাথে সাথে আলকাছার এর হতে থাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন।

আলকাছারের সদর দরজাটি অলংকৃত করা হয়েছে চিনেমাটির এক সিংহ দিয়ে- তাই এর নাম পুয়ের্থা দেল লেয়ন, অর্থাৎ, সিংহ ফটক। এর সামনেই আমাদের তরুণ গাইড জোয়েল রোহো অপেক্ষা করছিল তাঁর কমলা-সবুজ ছাতা নিয়ে। স্মিত হেসে স্বাগত জানাল আমাদের গ্রুপের ১০ জনকে। সবার সাথে পরিচিত হয়ে জোয়েল শুরু করল‘আলকাছার’-এর ইতিহাস বর্ণনা।

‘আলকাছার’ শুরুতে ছিল এক রোমান বসতি, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে যার নাম ছিল হিসপালিস। পরে এখানে এক রোমান দুর্গ নির্মাণ করা হয়। ৪১৫ সালে ভিজিগথরা রোমানদের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে স্পেনে প্রবেশ করে। ৫ম শতাব্দীর শেষের দিকে ভিজিগথরা স্পেনে প্রভাবশালী হয়ে উঠে। তখন রোমান দুর্গটিকে তারা অধিকার করে। আফ্রিকা থেকে আসা মুররা ৭১১ থেকে ৭১৯ সালের মধ্যে ভিজিগথদের পরাজিত করে সেভিয়াসহ স্পেনের দক্ষিণাঞ্চল অধিকার করে নেয়। কর্ডোভার খলিফা তৃতীয় আবদ-আল রহমান ৯১৩ সালে মূল রোমান দুর্গটিকে পরিণত করেন মুর দুর্গ-রাজপ্রাসাদে। কাস্তিলের রাজা তৃতীয় ফার্দিনান্দ ১২৪৮ সালে সেভিয়া অধিকার করেন, আলকাছারহয়ে যায় কাস্তিলের রাজার রাজভবন। তাঁর ছেলে দশম আলফানসো ১২৫২ থেকে ১২৮৪ পর্যন্ত কাস্তিলের রাজা ছিলেন। এসময় তিনি এখানে যোগ করেন এক গথিক রাজপ্রাসাদ।

এরমধ্যে ১২৩৮ সালে গ্রানাদা-য় আলহাম্বরা-র নির্মাণ কাজ শুরু করেন নাসিরীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ ইবনে আল আমর। আলহাম্বরা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে ১৪শ’ শতাব্দীতে একাদশ আলফনসো এবং প্রথম পেদরো ‘আলকাছার’-এর পুনর্নির্মাণ করেন, যার ভিত্তিমুডেহার স্থাপত্য।১‘আলকাছার’-কে ধরা হয় স্পেনে মুডেহার স্থাপত্যের সেরা নিদর্শন।’

এতটুকু বলে জোয়েলে-র অনুযোগ, ‘ইতিহাস শুনতে কেউ পছন্দ করে না। তবে ইতিহাসের উল্লেখ ছাড়া ‘আলকাছার’ এর বর্ণনা সঠিক হবে না। কারণ, ইতিহাসের সাথে সাথে এর আকার, আকৃতি, নকশা সবই বদলে গেছে। যা হোক, বাকি ইতিহাস তোমাদের বলব ‘আলকাছার’-এর ভেতরে যেয়ে।’

‘পুয়ের্থা দেল লেয়ন’দিয়ে প্রবেশ করলাম ‘পাথিও দেল ইয়েসে’নামক এক সুন্দর চত্বরে। এখানে দেখি আলমোহাদ শিল্পীদের সুনিপুণ কাজ- স্টাকো- যা মূলত আস্তর-এর কারুকাজ।

আরো কটি কক্ষ পার হয়ে ঢুকলাম প্রথম পেদ্রোর প্রাসাদে, যা মুডেহার স্থাপত্যে তিনি নির্মাণ করেছেন ১৩৬০ সালে। এখানে একটি সুন্দর চত্বরের সামনে আমাদের নিয়ে জোয়েল জানাল, ‘এটি হচ্ছে আলকাছার-এর সবচেয়ে সুন্দর আঙিনা-‘পাথিও দে লাস দনসেয়াস’। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম বিরাট বারান্দার চারপাশে স্টাকো-র কারুকাজে করা সুন্দর খিলান, মাঝখানে জলাশয়, পাশে বাগান।

নাতাশা বলল, ‘আমার কাছে এটি দেখে মনে হয় আলহাম্বরা-র পাথিও দে লস আরাইয়ানিস।’ জোয়েল খুশি হয়ে বলল, ‘তুমি ভালই দেখেছ। একটু পরে আমি কারণ বলছি।’

এরপর খুবই জাকজমকপূর্ণ এক প্রাসাদ-কক্ষে নিয়ে এসে জোয়েল বলল, ‘এর নাম সালোন দে লস এমবাহেদোরেস- এটি পুরো আলকাছার-এর সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে বড় কক্ষ, যা ছিল রাজাদের সম্বর্ধনা ও অভ্যর্থনার কেন্দ্র।’ মুগ্ধ হয়ে দেখলাম এর গম্বুজ আকৃতির সিলিংটি, যাতে সন্নিবেশ করা হয়েছে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা বহু কাঠ, যা মিলে যেন তৈরি হয়েছে এক আকাশ।

এরকম স্থাপত্য মনে হয় এর আগে কোথাও দেখেছি। তা ভাবতে ভাবতেই নাবিল বলে উঠল, ‘এটি দেখতে আলহাম্বরার সালা দে কমারেস এর মতো লাগে।’ হ্যাঁ, এখন মনে পড়ল, এ দুটি স্থাপত্যে বেশ মিল আছে।

নাবিল ও নাতাশাকে জোয়েল বলল, ‘তোমরা দুজনেই সঠিকভাবে দেখেছ। আলকাছার প্রাসাদের এ দুটি অংশ-‘পাথিও দে লাস দনসেয়াস’ও ‘সালোন দে লস এমবাহেদোরেস’- আলহাম্বরার স্পষ্ট ছাপ ধারণ করে আছে। কারণ, এ দুটি নির্মাণ করার সময় প্রথম পেদ্রো সাহায্য চেয়ে চিঠি দেন গ্রানাদা-র আমিরের কাছে। তিনি সেসব কারিগরদের পাঠান যারা আলহাম্বরা-র নির্মাণে অংশ নিয়েছিল। তাই তাদের কাজে ফুটে ওঠে আলহাম্বরার নকশার প্রভাব।’

প্রাসাদের আরো কয়েকটি অংশ দেখানোর পর জোয়েল আমাদের নিয়ে যায় আলকাছার এর বিশাল বাগানে। সবচেয়ে পুরনো আলকোবা বোয়র- মুরদের তৈরি রঙিন টালি আবৃত এক প্যাভিলিয়ন, যার চারপাশে সুন্দর বাগান। এ বাগান যেহেতু সেভিয়ায়, এখানে তো কমলা গাছ থাকবেই। তা অবশ্য আছে, এবং অজ¯্র সংখ্যায়।

কমলা ফুলের মিষ্টি গন্ধে হাঁটতে হাঁটতে প্যাভিলিয়নের সামনে আমরা জড়ো হলাম। এখানেই শেষ হবে আমাদের ট্যুর। জোয়েল বলল, ‘বিদায়ের আগে তোমাদের এক মজার কথা বলি। মার্মালেড তৈরির জন্য সেভিয়ার কমলার বেশ চাহিদা আছে ব্রিটেনে। ২০ শতকে সেভিয়ায় একটি প্রথা ছিল, যা আবার চালু করা হয়েছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বছরের এক বিশেষ সময় আলকাছার আসেন। এখানকার বাগান থেকে বাছাইকৃত কমলার এক ব্যাগ তাঁর হাতে তুলে দেন সেভিয়ার মেয়র। পরে তা পাঠানো হয় ব্রিটিশ রাজপরিবারে, সেভিয়ার উপহার হিসেবে, যা দিয়ে তৈরি করা হয় মার্মালেড।’ এটুকু বলে জোয়েল প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কে কে সেভিয়ার কমলার স্বাদ নিয়েছ?’ এর মধ্যে একমাত্র হাত উঠল আমার- দলের বাকি ৯ জন ছিল নীরব।

সেভিয়ায় আমাদের শেষ গন্তব্য-সেভিয়া ক্যাথেড্রাল। আলকাছার এর পাশেই এই বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল। কাজেই হেঁটে যেতে বেশি সময় লাগল না। এখন পড়ন্ত বেলায় ভিড়ও বেশ কম। পুয়ের্থা দেল লাগারথো গেটে যেতেই দেখা হলো গাইড গেভারা সোসার সাথে। দলে আমরা মোট ৮ জন গেভারাকে অনুসরণ করে ক্যাথেড্রালের ভেতরে ঢুকলাম।

কয়েকটি স্থান পার হয়ে গেভারা আমাদের নিয়ে আসল প্রধান বেদীর সামনে- ৮০ ফুট লম্বা স্বর্ণের এক ঝলমলে দেয়াল, যা বহু ভাস্কর্য দিয়ে আবৃত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম বেদী, রিথাবলো মেয়র, যা শেষ করতে ১৪৮১ থেকে ১৫৬৪ পর্যন্ত তিন প্রজন্মের কারুশিল্পীরা কাজ করেছে। ৪৪ টি দৃশ্যে যিশু ও মেরীর কাহিনি বর্ণনা করেছে এখানে- বাম থেকে ডানে, নীচে থেকে ওপরে। এর সিলিং ভরে আছে সূক্ষ কারুকাজে- যেখানে খিলানগুলো পরস্পরের ওপর খচিত।

বিশাল ক্যাথেড্রালে আরো বহু কিছু দেখলাম, সবকিছুই অনন্য সুন্দর। এরপর গেভারা আমাদের নিয়ে আসল এমন এক জায়গায় যা দেখার জন্য অনেকের গভীর আগ্রহ!

এ হলো‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস’-এর সমাধিস্তম্ভ। স্পেনের প্রাচীন চার রাজ্য- কাস্তিয়া, আরাগন, লেয়ন, নাভারা- তাদের রাজারা বহন করছেন কলম্বাসের দেহাবশেষ।

গেভারা শুরু করল তার বর্ণনা, ‘কীভাবে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের দেহাবশেষ সেভিয়াতে এলো, সে এক বড় ইতিহাস। অনেকে বলে, কলম্বাস জীবিত থাকতে যত ভ্রমণ করেছেন, মৃত্যুর পর করেছেন আরো বেশি। তিনি ১৫০৬ সালে মারা যান স্পেনের উত্তর-পশ্চিমের ভায়াদলিথ শহরে, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরে তাঁর মরদেহ সেভিয়ার এক মঠে নিয়ে আসা হয়। পরে কলম্বাস-র ইচ্ছে অনুসারে তাঁকে আবার সমাহিত করা ক্যারিবিয়ান দ্বীপ ডোমিনিকান রিপাবলিক-এর এক সমাধিতে। এরপর তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় কিউবায়। ১৯০২ সালে স্পেন থেকে কিউবা স্বাধীন হয়ে গেলে কলম্বাস-র দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় বর্তমানের অবস্থান, সেভিয়া ক্যাথেড্রাল-এ। কলম্বাস অনেক ভ্রমণ করেছেন, জীবনে, এবং মৃত্যতেও।’

এরপর আসলাম ‘পাথিও দে লস নারানহোস’, অর্থাৎ কমলা বাগানের চত্বরে। চারদিকে বহু কমলা গাছ ছাড়াও পাম গাছ, সাইপ্রেস, মাঝে ভিসিগতদের একটি বেসিন ও ফোয়ারা একে সুশোভিত করে রেখেছে। এখানে এস অনুভব করলাম এক প্রশান্তি। মুসলিম আমলে এটি ছিল পাশের মসজিদের অজু করার স্থান। দুটিই এখন হয়ে গেছে ইতিহাস।

সবশেষে আসলাম পাশের হিরালদা টাওয়ার এ, যা আগে ছিল মসজিদের এক মিনার, এখন হয়ে গেছে গির্জার বেল টাওয়ার। এ যেন সেভিয়া-র ইতিহাসের পরিবর্তন একই সাথে ধরে রেখেছে। এর ভিত্তিতে আছে প্রাচীন রোম থেকে কেটে আনা পাথর, মাঝখানে মুরদের কারুকাজ করা হলদে-সোনালি রঙের ইটের টাওয়ার, এবং ওপরের অংশ- ক্যাথলিকদের ১৫৫০ সালে গড়া চূড়ায় আছে ৪০০০ পাউন্ড ওজনের এক দেবী মূর্তি, ‘এল হিরালদিও’, যা বাতাসের দিক নির্দেশ করে।

আমরা এখান থেকে বের হতেই বেজে উঠল ‘হিরালদা টাওয়ার’-এর ঘণ্টাধ্বনি, যেন ধ্বনিত হচ্ছে আমাদের বিদায়ের বার্তা- শুধু ‘হিরালদা টাওয়ার’ থেকে নয়, সেভিয়া থেকেও।

হিরালডা টাওয়ারের কথাই যেন বলেছেন লোরকা তাঁর এ কবিতায়:

বুরুজচুড়োয়,

হলদে বুরুজচুড়োয়,

ঘণ্টা বাজছে।

হাওয়ার মধ্যে,

হলদে হাওয়ার মধ্যে

ঘণ্টার আওয়াজ ছড়িয়ে যাচ্ছে চতুর্ধারে।

যেন ছুরির ঝলসানো কিঙ্কিণী,

দূরান্তে ফুটিয়ে তুলছে ক্ষত।৩

এখান থেকে ফিরে যেতে নাতাশা বলল, ‘সেভিয়া হলো কমলা বাগানের, যে রকম গ্রানাদা ডালিমের’। নাবিল বলল, ‘সেভিয়া হরেঅ কলম্বাসের, যে রকম গ্রানাদা লোরকার’। দুজনের কথাই ঠিক। সেভিয়ার আইকন হয়ে উঠেছে কমলা ও কলম্বাস, যে রকম গ্রানাদা-র আইকন ডালিম ও লোরকা। ক্রমশ...

Ref:

মুদেহার স্থাপত্য হচ্ছে ইসলামী ও খ্রিস্টান শৈলীর মিশ্রণে স্পেনে বিকশিত এক স্থাপত্য শৈলী। গথিক স্থাপত্য শৈলীতে জোর দেয়া হয় উচ্চতা ও আলোর ওপর, তার বৈশিষ্ট্য হলো সুঁচালো খিলান।

গন্ডোলা: ঐতিহ্যবাহী, সরু ও লম্বা একটি নৌকা। দাঁড়িয়ে একজনকে তা চালাতে হয় দাঁড় টেনে। এটি ভেনিসে খুবই জনপ্রিয়।

Bla elipse de un grito, অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

back to top