পারভীন সুলতানা
তার ঢেঙ্গা, হাড্ডিসর্বস্ব অতিরিক্ত ফর্সা অবয়ব লোকজনের মধ্যে উৎসুক্যের অবতারণা করলেও তা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হওয়ার কথা নয়। এর চেয়েও ভালোবিষয়বস্তু দেখারঅভাব নাই চারপাশে। এক ন্যাংটা পাগলকে ইট নিয়ে তাড়া করছে নিষ্ঠুর কিশোরের দল, সোহরাওয়ার্দীর সবুজে পাশাপাশি বসে প্রকাশ্যে চুমু খাচ্ছে প্রেমিক যুগল কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় ‘গেল গেল রব...’ সারাক্ষণ একটা না একটা হুজ্জুত লেগেই থাকে দেখবার জন্য। তবুও ফর্সা গাত্র বর্ণ,কাঁধের কাছে লাফিয়ে নামা সোনালি চুল সব মিলিয়ে একটা যিশুইয়ো ফ্লেবার তার নাকে মুখে তাপ ছড়াতে থাকলে ওর দিকে মনোযোগ দিতে হয় বৈকি! এখানে অনেকে তাকে না চিনলেও সে হলো সেই বিখ্যাত ‘বুভুক্ষা শিল্পী’; যার ঈশ্বরের নাম ফ্রানৎস কাফকা।
অতঃপর বুভুক্ষার শিল্পী ‘অনশন শিল্পী’র সম্মানে ভূষিত হয়। তাঁর মৃত্যুর প্রাক্কালেও সে যে একজন উপবাসী কালাকার ছিল বিষয়টার চাক্ষুষ সাক্ষী থাকে নামিদামি সার্কাস কোম্পানির তত্ত্বাবধায়ক স্বয়ং। যদিও বুভুক্ষার শিল্পী মৃত্যুর আগে জানিয়ে যায়, তার উপবাস ছাড়া আর কোনো কাজ করার দক্ষতা ছিল না।
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বুভুক্ষা শিল্পীর মুক্তি ঘটে। আর সে মৃত্যু গৌরবেরও বটে!
তার খাঁচার পাশেই ছিল বাঘের খাঁচা। ব্যাপারটা শিল্পীকে ঈর্ষান্বিত না করে বরং অস্তিত্ব রক্ষাকারী হিসেবে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে রাখতে বাধ্য করতো; কারণ একদার আলোচিত ও আকর্ষণীয় ক্ষুধা শিল্পীর প্রতি লোকজনের অনীহা তৈরি হওয়ায় কেউ আর তাকে দেখার আগ্রহ বোধ করতো না। বুভুক্ষাশিল্পীকে পাশ কাটিয়ে যেতে হতো বাঘের খাঁচার কাছে। অনাগ্রহ সত্ত্বেও বয়স্কদের কেউ কেউ স্মৃতির টানে কিছুটা সময় হলেও বুভুক্ষা শিল্পীর খাঁচার সামনে দাঁড়াতো।
যাক গে, শেষ পর্যন্ত এ অবস্থার সুরাহা হয় শিল্পীর মহান মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। গল্প শেষে বুভুক্ষা শিল্পীকে কাহিনির কফিনে পেরেক মেরে মৃত্যু সমাপ্ত করলে বুভুক্ষা শিল্পী মুক্তিঅর্জন করে। স্বাধীনতার আনন্দে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়ে পড়ে সে। নানাদেশ ঘুরে গৌরবময় একশো বছর বয়সেতার গন্তব্য ঠিক করেরয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেশে।বাঘ বিষয়ক অভিজ্ঞতা ও দুর্বলতা তাকে এ ভ্রমণেপ্ররোচিত করে বৈকি!
এই নতুন দেশে এসে শিল্পীর বেশভালো লাগে। কারণ হলো, এখানে সে দেখে সার্কাস বা যাদুঘর ছাড়াওমানুষের ভিড় হট্টগোলের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মানুষই। দরিদ্রফুচকাওয়ালাকে ঘিরে মানুষ, ভাঙা মুড়ির টিনের মতো বাসে গিজগিজানো মানুষকে হেঁকে ডেকে যে তুলছে সে-ও হতদরিদ্র মানুষই... অন্তত এখানে কাউকে বুভুক্ষা শিল্পীর অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে না।
বুভুক্ষু শিল্পী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটা সবুজ বৃক্ষেরনিচে দাঁড়ায়। এমন দৃশ্যপট দেখায় অনভ্যস্ত সে, এখানের সবকিছুতেই জীবনের গন্ধ পায়। জীবন যাপনের এইসব অচেনা দৃশ্যে সব মনোযোগ ঢেলে দেয় শিল্পী।এই মগ্নতাকে ছিঁড়ে তার দিকে আচমকাই এগিয়ে আসে এক যুবক। এসে সোৎসাহে বুভুক্ষা শিল্পীর মুখোমুখি দাঁড়ায়- আরে আপনি কাফকার সৃষ্ট সেই বিখ্যাত বুভুক্ষার শিল্পী না! আমার ভুল না হলে আপনিই সেই চরিত্র! বলেই যুবকটি কোনো ভণিতা না করে বলে- ভাইরে, দিনের পর দিন না খায়া থাকার যাদুটা আমারে শিখায়া দেন না!কত দিন ভাত না খায়া আছি, আর পারি না! যুবকটি কাছের বেঞ্চে ধপাস করে বসে পড়ে- আমার নাম তোফাজ্জল, দেখলেদীনহীন লাগলেও রীতিমতো একটা অনার্স ডিগ্রি কব্জা করছি। বই পড়তে খুব ভালোবাসি। দেখেন না, কাফকার মতো বিশ্ববিখ্যাত লেখকের সৃষ্ট চরিত্রকেও চিনতে ভুল করি নাই! শিল্পীর চোখ পড়ে যুবকটির গলার ঝুলন্ত তাবিজের দিকে। ওর সারা অবয়ব জুড়ে প্রগাঢ় ক্ষুধার আগুন জ্বলছে...। যে আগুন ছিলো তার নিত্য সহচর। শিল্পী এবার কথা না বলে পারে না- আপনি কেন উপবাস থাকার কসরত শিখতে চান...! ওদের কথপোকথনের ভেতর হঠাৎ তিন/ চারজন যুবক নাকগলিয়ে ঢুকে পড়ে- তোফাজ্জল তোমারে কহন থাইকাখুঁজতেছি! তুমি না ভাত খাইতে চায়ছিলা? চলো, আমাদের সাথে,তুমারে ভাত খাওয়ায়া আনি! তোফাজ্জলের নিভে আসা চোখের মনি জ্বলে ওঠে- চলেন তাইলে, তারপর বুভুক্ষা শিল্পীর দিকে তাকিয়ে একটা চেপ্টা স্মিত হাসি তৈরির চেষ্টা করে- ভাই, আপনে আছেন তো ক্যাম্পাসে? দেখা হইবো তাইলে। তোফাজ্জল দলটার সাথে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায়। বুভুক্ষা শিল্পী যে কী না এ পৃথিবীর কোনো কিছুতে তাড়িত হয় না তার বুকটাও কেমন ধ্বক করে ওঠে।ভাবে, এ যুবক তো তার চেয়েও বেশি বুভুক্ষু!তবে শিল্পী খুব বেশিক্ষণ এ বোধ নিয়ে মগ্ন থাকতে পারে না পার্কের মাঝখানে একদল ছেলে গিটারে নতুন জীবনের সুর তুলেছে...।
বইয়ের পাতা থেকে বের হয়ে মানুষের সাথেস্বাধীন ভাবে জীবন আস্বাদনের সুযোগ পেয়ে শিল্পী যথেষ্ট আনন্দ ও স্বচ্ছন্দ অনুভব করে। শতবর্ষ পার হয়ে গেলেও নিজের সৃষ্টিকর্তাকে মনে পড়ে। আসলেই কী তাঁর এমন এক চরিত্র সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল! স্মৃতি চারণের পদ রেখা ধরে লোকটা স্মৃতি কাতর না হয়ে পারে না।
এক সময় মানুষ এমন দশকও অতিবাহিত করেছে, যখন পেশাদার উপবাসকারি বলে জনৈক বুভুক্ষা শিল্পী বিশেষ প্রশংসা,করতালি আর বাহবা কুড়িয়েছিল! ঘনিয়ে আসা মায়াবী বিকেলে,দীর্ঘ অলস অবসরে অতীতের যাপিত জীবনের স্মৃতি মস্তিষ্কের খাঁজে নোঙর করে সে। আসলেই যে লোকটা উপবাসকারী ছিল তার অকাট্য যুক্তি প্রমাণের জন্য দিন-রাত তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাহারা দেয়া হতো। উপবাসের কঠোরতা ও ধারাবাহিকতা সম্পর্কে লোকজনের মধ্যে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। দর্শনার্থীরারীতিমতো টিকেট কেটে ভিড়ভাট্টা ঠেলে তাকে দেখতে আসতো। ওর কালো আঁটো প্যান্ট পরা বিবর্ণমুখ দেখে উৎসাহী জনতা উল্লাসে ফেটে পড়তো আর বিরতিহীনকরতালিতে মুখর হতো জাদুঘর প্রাঙ্গণ। ঠিক এ সময়টাতে ওর শুকনো ঠোঁট দুটো চকিতে ফাঁক হয়েই আবার জোড়া লেগে যেতো। এই মুখর উল্লাস, এই করতালি স্যালাইনের মতোবিকল্পখাদ্য যোগাতো ওকে। সে ঠোঁটের আড়ালেঅস্পষ্ট হাসিটাকে খুব সাবধানে গিলেনিতো; যাতে কেউ টের না পায়। যেনসন্দেহ প্রবণ হয়ে এই মুখরতা ও করতালিকে না জাদুঘরে নিষিদ্ধ করে দেয়!
প্রায়ই রাতের পাহারাদারদের কর্তব্যে ঢেলেমি দেখা যেত।তারা ইচ্ছে করে এক কোণে জমায়েত হয়ে মনোযোগ দিয়ে তাস পেটাতো যাতে এ সুযোগে বুভুক্ষার শিল্পী চট করে কিছু খেয়ে নিতে পারে। ওদের ধারণা ছিল নিশ্চয় ও ওর গোপন ভা-ারে চালাকি করে কিছু না কিছু খাবার লুকিয়ে রাখে। এতে প্রচ- অপমানিত ও বিরক্ত বোধ করতো সে। এদের সন্দেহ কত অন্যায় ও ভুল, সেটা প্রমাণ করার জন্য শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান করতো বুভুক্ষা শিল্পী।যদিও এতে কোনো লাভ হতো না বরং পাহারাদারগুলো অবাক হয়ে ভাবতো মুখভর্তি খাবার নিয়েও কী নিপুণচালাকিতে ও গান গাইছে! কিন্তু এ তেজ দেখানোও বেশিদিন টিকলো না। টানা আর বিরতিহীন এ আশ্চর্য উপবাস প্রদর্শনী জনগনকে একঘেয়ে আর উৎসাহ বিমুখ করে তোলে। এতদিনের নন্দিত বুভুক্ষা শিল্পী দেখলো যে আনন্দসন্ধানীরা তাকে পুরোপুরি বর্জন করে তার সামনে দিয়েই ছুটছে অন্য কোনো জনপ্রিয় আনন্দের দিকে।তার দিকে এরা তাকিয়েও দেখছে না।
যাদুঘরের ম্যানেজার অবশ্য পুরানো উৎসাহটা অন্য কোথাও টিকে আছে কিনা তা যাঁচাই করার জন্য তাকে নিয়ে শেষবারের মতো অর্ধ ইউরোপচক্কর দিয়ে এলো,কিন্তু গোপন চুক্তির ফলে সবাই পেশাদার উপবাস সম্পর্কে চরম বিতৃষ্ণা বোধ করে।এরপর তার ঠাঁই হয় এক বড় সার্কাস কোম্পানিতে। তাকে রাখা হয় জন্তুজানোয়ারের খাঁচার পাশে। জানোয়ারগুলো দেখতে যেতে হলে বুভুক্ষা শিল্পীকে পাশ না কাটিয়ে যাবার উপায় ছিল না।ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোনো কোনো দিন কিছু পিতা হয়তো বাচ্চাদের নিয়ে বুভুক্ষা শিল্পীর খাঁচার সামনে আঙ্গুল তুলে তাকে দেখাতেন আর স্মৃতিচারণে তার কথা বলতেন। তাতেও শেষরক্ষা হতো না। বাচ্চাগুলো শিল্পীর প্রতি নির্মোহ দৃষ্টি দিতে দিতে ছুটতো বাঘ,সিংহ বা অন্যপ্রাণির খাঁচার দিকে। লোকজন এক সময় ভুলেই যায় ওর কথা। তবে শেষাবধি সেবুভুক্ষা শিল্পীর খেতাব নিয়ে মর্যাদার(!) সাথেই মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পুরনো দিনের স্মৃতিরোমন্থনেহাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরি চত্বরে এসে দাঁড়ায় সে। ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা দেখে, কৌতূহলী চোখে পাঠাগারের টানা বারান্দা ও কক্ষগুলোর দিকে তাকায়। সিরিয়াস কিছু ছেলে মেয়ে উপাসনালয়ে ঢোকার মতো ভাবসাব নিয়ে ভেতরে ঢুকছে।লাইব্রেরির বারান্দার এক কোণে জটলা করছে একটা দল,কী নিয়ে যেন তারা খুব তর্ক করছে।টুকরো কথার ফাঁকফোকর ঠেলেলাইব্রেরি থেকে বের হওয়া দুজন যুবক-যুবতী শিল্পীরদৃষ্টি আকর্ষণ করে।শ্যামাঙ্গী যুবতীটি শাড়ি পরা খাঁটি বঙ্গ ললনা। তার সাথের সঙ্গীটি সুদর্শন,চশমা পরা,বুদ্ধি দীপ্ত চোখ।তরুণী বুভুক্ষা শিল্পীরফর্সা দীর্ঘ অবয়বেরদিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রচ- উৎসাহে ফেটে পড়ে- আরে এতো দেখছি কাফকার সেইবিখ্যাত বুভুক্ষা শিল্পী! ওর সাথের যুককটিরহাতেবই। বেশ প-িতি একটা ভাব ওর নাকে-মুখে। মেয়েটা দীর্ঘাঙ্গী, পরিপাটি করে শাড়ি পরেছে। খোলা চুল। দেখতেও ভারি মিষ্টি। শিল্পী আবারওদের দিকেমুগ্ধ চোখে তাকায়।এরাও দেখা যাচ্ছে সেই ভাত খেতে চলে যাওয়া যুবকের মতো তাকে চিনতে পেরেছে! বুভুক্ষা শিল্পী ছেলেটার হাতের বইগুলোরদিকে তাকিয়েবিস্মিত হয়ে যায়। উপরের বইটার প্রচ্ছদে তাঁর সৃষ্টিকর্তার ছবি,ছবিটার নিচে ইংরেজিতে লেখা ফ্রানৎস কাফকা! ওরা এবার শিল্পীর দিকে এগিয়ে আসে। মেয়েটা প্রত্যয়ী গলায়বলে- আপনাকেআমি ঠিক চিনে ফেলেছি,নিশ্চিত আপনিকাফকার সেই বিখ্যাত চরিত্র ‘অনশন শিল্পী’!আমার নাম আয়েশা। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ি। ও মাইনুল ইসলাম। সঙ্গীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মেয়েটা। তারপরএক মিনিট বলে ওর ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে- আমাদের তিনজনের একটা সেল্ফি হয়ে যাক,কাফকার বিখ্যাত চরিত্র বলে কথা! বুভুক্ষা শিল্পী একটু জড়তা বোধ করে। এইসবের সাথে তার খুব একটা পরিচিতি নেই। যাদুঘরে মাঝে মাঝে অনেকে তার সাথেক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলায় উৎসাহী ছিল বৈকি। হাতের মোবাইলক্যামেরায় ছবি তোলাটা সম্ভবত এ যুগে খুব জনপ্রিয়। বুভুক্ষা শিল্পীলক্ষ করেচারকোণা ফোনে একটু আগেতোলা ছবিটির স্ক্রিনটা মিলিয়ে গেলেও সে ছবির কোথাও সে নেই।গল্পের চরিত্ররা তো আর রক্ত মাংসের মানুষ নয়!ওদের ছায়া ও ছবি বাস্তবেরচিত হবার নয়।তবে এ নিয়ে কোনো কথা বলে না বুভুক্ষা শিল্পী। ওরা দুজন খুব উৎসাহ নিয়ে শিল্পীর সাথে কথা বলে। ওরা হাঁটতে হাঁটতেটিএসসির ভেতর ঢোকে। শিল্পীকে নিয়ে বারান্দায় বসে।আয়েশা শাড়ির আঁচল কোলে রেখে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে শিল্পীর উদ্দেশ্যে বলে- একটা ভালোইনফরমেশন দিই, শুনে মন ভালো হয়ে যাবে আপনার। রাতের পাহারাদাররা আপনাকে যখন খাওয়ার সুযোগ তৈরির জন্য খেলায় মগ্ন হওয়ার ভান করতো তখন আপনি অপমানিত হতেন।তাদের ভুল ভাঙ্গাতে জোরে জোরে গান করতেন...। বুভুক্ষা শিল্পী মাথা নাড়ে- হ্যাঁ,এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল আমার! আয়েশা বলে সেটা ঠিক, তবে ওরা তো ছিল পাহারাদার, আর মহাত্মা গান্ধী যখন৪৫-এর মন্বন্তরে জেলের ভেতর থেকেঅনশন শুরু করেছিলেন;তখন তৎকালীন ভারতবর্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী উইনস্টনচার্চিলের ধারণাও কিন্তু এরকমই ছিল... চার্চিলের বদ্ধমূল ধারণা ছিল গান্ধীজি গোপনে খাবার খাচ্ছিলেন।
অনশনরত গান্ধীজির অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে যায় যে,দায়িত্বরত ডাক্তার জানান ‘নাড়ির গতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ছে... প্রায় ধরাই যাচ্ছে না। ইংরেজ প্রভুরা ধরেই নিয়েছিল গান্ধীজি মারা যাচ্ছে...।ভাইসরয় ইতোমধ্যে শোকবার্তা লিখে ফেলে। তাঁর চিতা ভস্মবিসর্জনেরবিষয়ে এবং পতাকা অর্ধনমিত করা হবে কী হবে না এ পরিকল্পনাও করে ফেলা হয়। তবে গান্ধীজিধকল কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেউইনস্টনচার্চিল গান্ধীর অনশনের সত্যতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেনতিনি ফিল্ড মার্শাল স্মার্টসকেলিখেন যে তারঁ (চার্চিলের) ধারণা- “গত এক সপ্তাহ ধরে আমি যা খেয়েছি,গান্ধী তার থেকে অনেক ভালো খাবার খাচ্ছিলো”...। গান্ধীর মতো ব্যক্তিকে যখন অনশনের বিষয়ে সন্দেহ করা হয় সেখানে, আপনাকে ঘিরে পাহারাদারদেরসন্দেহ তো অমূলক কিছু নয়।কাজেই এ নিয়ে আপনি দুঃখিত বা অপমানিত বোধ করা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেনশিল্পী কিছু বলে না শুধু স্মিত হাসে। সন্ধ্যার দিকে আয়েশারা চলে যাবার পর বুভুক্ষু শিল্পী ক্যাম্পাসেই হাঁটে।
কী নিবিড় সবুজ এই জায়গাটা! রয়েল বেঙ্গল টাইগারখ্যাত এ দেশটাতো ভারি সুন্দর!বুভুক্ষাশিল্পী মুগ্ধ না হয়ে পারে না।হাঁটতে হাঁটতেএকটি ছাত্রনিবাসের কাছে চলে আসে শিল্পী; হঠাৎ দুপুরে দেখা ভাত খেতে চাওয়া যুবকটি দিকে চোখ পড়ে তার। যে তার কাছে না খেয়ে থাকার কসরত শিখতে চেয়েছিলো! যুবকটিকে হলের ভেতরে ঢুকতে দেখে। শিল্পী সোৎসাহে তাকে ডাকে,সম্ভবত ওর ডাক শুনতে পায় না ও। শিল্পীর কৌতূহল জাগে, আনোয়ার কি ভাত খেয়েছিলো? হেেলর অন্ধকারাচ্ছন রাত সেখানে যেতে প্ররোচিত করে তাকে।... এবং নীরব অন্ধকারের এক কোণে দাঁড়িয়ে সে সব কিছু দেখে। একটি ইলেকট্রিক ডিভাইসচুরির দায়ে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে ছেলেটাকে নির্মভাবে পেটানোর পর অবশ্যওকে ক্যান্টিনে নিয়ে ভাত খেতে দেয়া হয়।অভুক্ত থাকার যাদু শিখতে চাওয়া যুবকটি এতো মার খেয়েও ভাতের থালা দেখেআপ্লুত হয়ে পড়ে। পরম মমতায় থালাটা সে টেনে নেয়... ভীত, ক্ষুধার্থ হাতে ভাতের গ্রাস তোলে মুখে।এরপর যা ঘটে তাকাফকার কাল্পনিকচরিত্রকেও কাঁপিয়ে দেয়। হামলাকারীরা ওর চোখের সামনে জার্মান নাৎসি সেনা হয়ে ওঠে...। যুবকটিঅমানুষিক প্রহারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এরপর বুভুক্ষা শিল্পী আর দাঁড়ায় না।
সিদ্ধান্ত নেয়,আর রক্ত-মাংসের মানুষের পৃথিবীতে একদ- নয়।আবার স্বেচ্ছায় সে বইয়ে মলাট বন্দি হয় কাফকার বিখ্যাত অনশন শিল্পীর চরিত্রে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
পারভীন সুলতানা
বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
তার ঢেঙ্গা, হাড্ডিসর্বস্ব অতিরিক্ত ফর্সা অবয়ব লোকজনের মধ্যে উৎসুক্যের অবতারণা করলেও তা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হওয়ার কথা নয়। এর চেয়েও ভালোবিষয়বস্তু দেখারঅভাব নাই চারপাশে। এক ন্যাংটা পাগলকে ইট নিয়ে তাড়া করছে নিষ্ঠুর কিশোরের দল, সোহরাওয়ার্দীর সবুজে পাশাপাশি বসে প্রকাশ্যে চুমু খাচ্ছে প্রেমিক যুগল কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় ‘গেল গেল রব...’ সারাক্ষণ একটা না একটা হুজ্জুত লেগেই থাকে দেখবার জন্য। তবুও ফর্সা গাত্র বর্ণ,কাঁধের কাছে লাফিয়ে নামা সোনালি চুল সব মিলিয়ে একটা যিশুইয়ো ফ্লেবার তার নাকে মুখে তাপ ছড়াতে থাকলে ওর দিকে মনোযোগ দিতে হয় বৈকি! এখানে অনেকে তাকে না চিনলেও সে হলো সেই বিখ্যাত ‘বুভুক্ষা শিল্পী’; যার ঈশ্বরের নাম ফ্রানৎস কাফকা।
অতঃপর বুভুক্ষার শিল্পী ‘অনশন শিল্পী’র সম্মানে ভূষিত হয়। তাঁর মৃত্যুর প্রাক্কালেও সে যে একজন উপবাসী কালাকার ছিল বিষয়টার চাক্ষুষ সাক্ষী থাকে নামিদামি সার্কাস কোম্পানির তত্ত্বাবধায়ক স্বয়ং। যদিও বুভুক্ষার শিল্পী মৃত্যুর আগে জানিয়ে যায়, তার উপবাস ছাড়া আর কোনো কাজ করার দক্ষতা ছিল না।
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বুভুক্ষা শিল্পীর মুক্তি ঘটে। আর সে মৃত্যু গৌরবেরও বটে!
তার খাঁচার পাশেই ছিল বাঘের খাঁচা। ব্যাপারটা শিল্পীকে ঈর্ষান্বিত না করে বরং অস্তিত্ব রক্ষাকারী হিসেবে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে রাখতে বাধ্য করতো; কারণ একদার আলোচিত ও আকর্ষণীয় ক্ষুধা শিল্পীর প্রতি লোকজনের অনীহা তৈরি হওয়ায় কেউ আর তাকে দেখার আগ্রহ বোধ করতো না। বুভুক্ষাশিল্পীকে পাশ কাটিয়ে যেতে হতো বাঘের খাঁচার কাছে। অনাগ্রহ সত্ত্বেও বয়স্কদের কেউ কেউ স্মৃতির টানে কিছুটা সময় হলেও বুভুক্ষা শিল্পীর খাঁচার সামনে দাঁড়াতো।
যাক গে, শেষ পর্যন্ত এ অবস্থার সুরাহা হয় শিল্পীর মহান মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। গল্প শেষে বুভুক্ষা শিল্পীকে কাহিনির কফিনে পেরেক মেরে মৃত্যু সমাপ্ত করলে বুভুক্ষা শিল্পী মুক্তিঅর্জন করে। স্বাধীনতার আনন্দে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়ে পড়ে সে। নানাদেশ ঘুরে গৌরবময় একশো বছর বয়সেতার গন্তব্য ঠিক করেরয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেশে।বাঘ বিষয়ক অভিজ্ঞতা ও দুর্বলতা তাকে এ ভ্রমণেপ্ররোচিত করে বৈকি!
এই নতুন দেশে এসে শিল্পীর বেশভালো লাগে। কারণ হলো, এখানে সে দেখে সার্কাস বা যাদুঘর ছাড়াওমানুষের ভিড় হট্টগোলের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মানুষই। দরিদ্রফুচকাওয়ালাকে ঘিরে মানুষ, ভাঙা মুড়ির টিনের মতো বাসে গিজগিজানো মানুষকে হেঁকে ডেকে যে তুলছে সে-ও হতদরিদ্র মানুষই... অন্তত এখানে কাউকে বুভুক্ষা শিল্পীর অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে না।
বুভুক্ষু শিল্পী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটা সবুজ বৃক্ষেরনিচে দাঁড়ায়। এমন দৃশ্যপট দেখায় অনভ্যস্ত সে, এখানের সবকিছুতেই জীবনের গন্ধ পায়। জীবন যাপনের এইসব অচেনা দৃশ্যে সব মনোযোগ ঢেলে দেয় শিল্পী।এই মগ্নতাকে ছিঁড়ে তার দিকে আচমকাই এগিয়ে আসে এক যুবক। এসে সোৎসাহে বুভুক্ষা শিল্পীর মুখোমুখি দাঁড়ায়- আরে আপনি কাফকার সৃষ্ট সেই বিখ্যাত বুভুক্ষার শিল্পী না! আমার ভুল না হলে আপনিই সেই চরিত্র! বলেই যুবকটি কোনো ভণিতা না করে বলে- ভাইরে, দিনের পর দিন না খায়া থাকার যাদুটা আমারে শিখায়া দেন না!কত দিন ভাত না খায়া আছি, আর পারি না! যুবকটি কাছের বেঞ্চে ধপাস করে বসে পড়ে- আমার নাম তোফাজ্জল, দেখলেদীনহীন লাগলেও রীতিমতো একটা অনার্স ডিগ্রি কব্জা করছি। বই পড়তে খুব ভালোবাসি। দেখেন না, কাফকার মতো বিশ্ববিখ্যাত লেখকের সৃষ্ট চরিত্রকেও চিনতে ভুল করি নাই! শিল্পীর চোখ পড়ে যুবকটির গলার ঝুলন্ত তাবিজের দিকে। ওর সারা অবয়ব জুড়ে প্রগাঢ় ক্ষুধার আগুন জ্বলছে...। যে আগুন ছিলো তার নিত্য সহচর। শিল্পী এবার কথা না বলে পারে না- আপনি কেন উপবাস থাকার কসরত শিখতে চান...! ওদের কথপোকথনের ভেতর হঠাৎ তিন/ চারজন যুবক নাকগলিয়ে ঢুকে পড়ে- তোফাজ্জল তোমারে কহন থাইকাখুঁজতেছি! তুমি না ভাত খাইতে চায়ছিলা? চলো, আমাদের সাথে,তুমারে ভাত খাওয়ায়া আনি! তোফাজ্জলের নিভে আসা চোখের মনি জ্বলে ওঠে- চলেন তাইলে, তারপর বুভুক্ষা শিল্পীর দিকে তাকিয়ে একটা চেপ্টা স্মিত হাসি তৈরির চেষ্টা করে- ভাই, আপনে আছেন তো ক্যাম্পাসে? দেখা হইবো তাইলে। তোফাজ্জল দলটার সাথে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায়। বুভুক্ষা শিল্পী যে কী না এ পৃথিবীর কোনো কিছুতে তাড়িত হয় না তার বুকটাও কেমন ধ্বক করে ওঠে।ভাবে, এ যুবক তো তার চেয়েও বেশি বুভুক্ষু!তবে শিল্পী খুব বেশিক্ষণ এ বোধ নিয়ে মগ্ন থাকতে পারে না পার্কের মাঝখানে একদল ছেলে গিটারে নতুন জীবনের সুর তুলেছে...।
বইয়ের পাতা থেকে বের হয়ে মানুষের সাথেস্বাধীন ভাবে জীবন আস্বাদনের সুযোগ পেয়ে শিল্পী যথেষ্ট আনন্দ ও স্বচ্ছন্দ অনুভব করে। শতবর্ষ পার হয়ে গেলেও নিজের সৃষ্টিকর্তাকে মনে পড়ে। আসলেই কী তাঁর এমন এক চরিত্র সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল! স্মৃতি চারণের পদ রেখা ধরে লোকটা স্মৃতি কাতর না হয়ে পারে না।
এক সময় মানুষ এমন দশকও অতিবাহিত করেছে, যখন পেশাদার উপবাসকারি বলে জনৈক বুভুক্ষা শিল্পী বিশেষ প্রশংসা,করতালি আর বাহবা কুড়িয়েছিল! ঘনিয়ে আসা মায়াবী বিকেলে,দীর্ঘ অলস অবসরে অতীতের যাপিত জীবনের স্মৃতি মস্তিষ্কের খাঁজে নোঙর করে সে। আসলেই যে লোকটা উপবাসকারী ছিল তার অকাট্য যুক্তি প্রমাণের জন্য দিন-রাত তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাহারা দেয়া হতো। উপবাসের কঠোরতা ও ধারাবাহিকতা সম্পর্কে লোকজনের মধ্যে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। দর্শনার্থীরারীতিমতো টিকেট কেটে ভিড়ভাট্টা ঠেলে তাকে দেখতে আসতো। ওর কালো আঁটো প্যান্ট পরা বিবর্ণমুখ দেখে উৎসাহী জনতা উল্লাসে ফেটে পড়তো আর বিরতিহীনকরতালিতে মুখর হতো জাদুঘর প্রাঙ্গণ। ঠিক এ সময়টাতে ওর শুকনো ঠোঁট দুটো চকিতে ফাঁক হয়েই আবার জোড়া লেগে যেতো। এই মুখর উল্লাস, এই করতালি স্যালাইনের মতোবিকল্পখাদ্য যোগাতো ওকে। সে ঠোঁটের আড়ালেঅস্পষ্ট হাসিটাকে খুব সাবধানে গিলেনিতো; যাতে কেউ টের না পায়। যেনসন্দেহ প্রবণ হয়ে এই মুখরতা ও করতালিকে না জাদুঘরে নিষিদ্ধ করে দেয়!
প্রায়ই রাতের পাহারাদারদের কর্তব্যে ঢেলেমি দেখা যেত।তারা ইচ্ছে করে এক কোণে জমায়েত হয়ে মনোযোগ দিয়ে তাস পেটাতো যাতে এ সুযোগে বুভুক্ষার শিল্পী চট করে কিছু খেয়ে নিতে পারে। ওদের ধারণা ছিল নিশ্চয় ও ওর গোপন ভা-ারে চালাকি করে কিছু না কিছু খাবার লুকিয়ে রাখে। এতে প্রচ- অপমানিত ও বিরক্ত বোধ করতো সে। এদের সন্দেহ কত অন্যায় ও ভুল, সেটা প্রমাণ করার জন্য শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান করতো বুভুক্ষা শিল্পী।যদিও এতে কোনো লাভ হতো না বরং পাহারাদারগুলো অবাক হয়ে ভাবতো মুখভর্তি খাবার নিয়েও কী নিপুণচালাকিতে ও গান গাইছে! কিন্তু এ তেজ দেখানোও বেশিদিন টিকলো না। টানা আর বিরতিহীন এ আশ্চর্য উপবাস প্রদর্শনী জনগনকে একঘেয়ে আর উৎসাহ বিমুখ করে তোলে। এতদিনের নন্দিত বুভুক্ষা শিল্পী দেখলো যে আনন্দসন্ধানীরা তাকে পুরোপুরি বর্জন করে তার সামনে দিয়েই ছুটছে অন্য কোনো জনপ্রিয় আনন্দের দিকে।তার দিকে এরা তাকিয়েও দেখছে না।
যাদুঘরের ম্যানেজার অবশ্য পুরানো উৎসাহটা অন্য কোথাও টিকে আছে কিনা তা যাঁচাই করার জন্য তাকে নিয়ে শেষবারের মতো অর্ধ ইউরোপচক্কর দিয়ে এলো,কিন্তু গোপন চুক্তির ফলে সবাই পেশাদার উপবাস সম্পর্কে চরম বিতৃষ্ণা বোধ করে।এরপর তার ঠাঁই হয় এক বড় সার্কাস কোম্পানিতে। তাকে রাখা হয় জন্তুজানোয়ারের খাঁচার পাশে। জানোয়ারগুলো দেখতে যেতে হলে বুভুক্ষা শিল্পীকে পাশ না কাটিয়ে যাবার উপায় ছিল না।ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোনো কোনো দিন কিছু পিতা হয়তো বাচ্চাদের নিয়ে বুভুক্ষা শিল্পীর খাঁচার সামনে আঙ্গুল তুলে তাকে দেখাতেন আর স্মৃতিচারণে তার কথা বলতেন। তাতেও শেষরক্ষা হতো না। বাচ্চাগুলো শিল্পীর প্রতি নির্মোহ দৃষ্টি দিতে দিতে ছুটতো বাঘ,সিংহ বা অন্যপ্রাণির খাঁচার দিকে। লোকজন এক সময় ভুলেই যায় ওর কথা। তবে শেষাবধি সেবুভুক্ষা শিল্পীর খেতাব নিয়ে মর্যাদার(!) সাথেই মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পুরনো দিনের স্মৃতিরোমন্থনেহাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরি চত্বরে এসে দাঁড়ায় সে। ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা দেখে, কৌতূহলী চোখে পাঠাগারের টানা বারান্দা ও কক্ষগুলোর দিকে তাকায়। সিরিয়াস কিছু ছেলে মেয়ে উপাসনালয়ে ঢোকার মতো ভাবসাব নিয়ে ভেতরে ঢুকছে।লাইব্রেরির বারান্দার এক কোণে জটলা করছে একটা দল,কী নিয়ে যেন তারা খুব তর্ক করছে।টুকরো কথার ফাঁকফোকর ঠেলেলাইব্রেরি থেকে বের হওয়া দুজন যুবক-যুবতী শিল্পীরদৃষ্টি আকর্ষণ করে।শ্যামাঙ্গী যুবতীটি শাড়ি পরা খাঁটি বঙ্গ ললনা। তার সাথের সঙ্গীটি সুদর্শন,চশমা পরা,বুদ্ধি দীপ্ত চোখ।তরুণী বুভুক্ষা শিল্পীরফর্সা দীর্ঘ অবয়বেরদিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রচ- উৎসাহে ফেটে পড়ে- আরে এতো দেখছি কাফকার সেইবিখ্যাত বুভুক্ষা শিল্পী! ওর সাথের যুককটিরহাতেবই। বেশ প-িতি একটা ভাব ওর নাকে-মুখে। মেয়েটা দীর্ঘাঙ্গী, পরিপাটি করে শাড়ি পরেছে। খোলা চুল। দেখতেও ভারি মিষ্টি। শিল্পী আবারওদের দিকেমুগ্ধ চোখে তাকায়।এরাও দেখা যাচ্ছে সেই ভাত খেতে চলে যাওয়া যুবকের মতো তাকে চিনতে পেরেছে! বুভুক্ষা শিল্পী ছেলেটার হাতের বইগুলোরদিকে তাকিয়েবিস্মিত হয়ে যায়। উপরের বইটার প্রচ্ছদে তাঁর সৃষ্টিকর্তার ছবি,ছবিটার নিচে ইংরেজিতে লেখা ফ্রানৎস কাফকা! ওরা এবার শিল্পীর দিকে এগিয়ে আসে। মেয়েটা প্রত্যয়ী গলায়বলে- আপনাকেআমি ঠিক চিনে ফেলেছি,নিশ্চিত আপনিকাফকার সেই বিখ্যাত চরিত্র ‘অনশন শিল্পী’!আমার নাম আয়েশা। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ি। ও মাইনুল ইসলাম। সঙ্গীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মেয়েটা। তারপরএক মিনিট বলে ওর ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে- আমাদের তিনজনের একটা সেল্ফি হয়ে যাক,কাফকার বিখ্যাত চরিত্র বলে কথা! বুভুক্ষা শিল্পী একটু জড়তা বোধ করে। এইসবের সাথে তার খুব একটা পরিচিতি নেই। যাদুঘরে মাঝে মাঝে অনেকে তার সাথেক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলায় উৎসাহী ছিল বৈকি। হাতের মোবাইলক্যামেরায় ছবি তোলাটা সম্ভবত এ যুগে খুব জনপ্রিয়। বুভুক্ষা শিল্পীলক্ষ করেচারকোণা ফোনে একটু আগেতোলা ছবিটির স্ক্রিনটা মিলিয়ে গেলেও সে ছবির কোথাও সে নেই।গল্পের চরিত্ররা তো আর রক্ত মাংসের মানুষ নয়!ওদের ছায়া ও ছবি বাস্তবেরচিত হবার নয়।তবে এ নিয়ে কোনো কথা বলে না বুভুক্ষা শিল্পী। ওরা দুজন খুব উৎসাহ নিয়ে শিল্পীর সাথে কথা বলে। ওরা হাঁটতে হাঁটতেটিএসসির ভেতর ঢোকে। শিল্পীকে নিয়ে বারান্দায় বসে।আয়েশা শাড়ির আঁচল কোলে রেখে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে শিল্পীর উদ্দেশ্যে বলে- একটা ভালোইনফরমেশন দিই, শুনে মন ভালো হয়ে যাবে আপনার। রাতের পাহারাদাররা আপনাকে যখন খাওয়ার সুযোগ তৈরির জন্য খেলায় মগ্ন হওয়ার ভান করতো তখন আপনি অপমানিত হতেন।তাদের ভুল ভাঙ্গাতে জোরে জোরে গান করতেন...। বুভুক্ষা শিল্পী মাথা নাড়ে- হ্যাঁ,এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল আমার! আয়েশা বলে সেটা ঠিক, তবে ওরা তো ছিল পাহারাদার, আর মহাত্মা গান্ধী যখন৪৫-এর মন্বন্তরে জেলের ভেতর থেকেঅনশন শুরু করেছিলেন;তখন তৎকালীন ভারতবর্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী উইনস্টনচার্চিলের ধারণাও কিন্তু এরকমই ছিল... চার্চিলের বদ্ধমূল ধারণা ছিল গান্ধীজি গোপনে খাবার খাচ্ছিলেন।
অনশনরত গান্ধীজির অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে যায় যে,দায়িত্বরত ডাক্তার জানান ‘নাড়ির গতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ছে... প্রায় ধরাই যাচ্ছে না। ইংরেজ প্রভুরা ধরেই নিয়েছিল গান্ধীজি মারা যাচ্ছে...।ভাইসরয় ইতোমধ্যে শোকবার্তা লিখে ফেলে। তাঁর চিতা ভস্মবিসর্জনেরবিষয়ে এবং পতাকা অর্ধনমিত করা হবে কী হবে না এ পরিকল্পনাও করে ফেলা হয়। তবে গান্ধীজিধকল কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেউইনস্টনচার্চিল গান্ধীর অনশনের সত্যতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেনতিনি ফিল্ড মার্শাল স্মার্টসকেলিখেন যে তারঁ (চার্চিলের) ধারণা- “গত এক সপ্তাহ ধরে আমি যা খেয়েছি,গান্ধী তার থেকে অনেক ভালো খাবার খাচ্ছিলো”...। গান্ধীর মতো ব্যক্তিকে যখন অনশনের বিষয়ে সন্দেহ করা হয় সেখানে, আপনাকে ঘিরে পাহারাদারদেরসন্দেহ তো অমূলক কিছু নয়।কাজেই এ নিয়ে আপনি দুঃখিত বা অপমানিত বোধ করা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেনশিল্পী কিছু বলে না শুধু স্মিত হাসে। সন্ধ্যার দিকে আয়েশারা চলে যাবার পর বুভুক্ষু শিল্পী ক্যাম্পাসেই হাঁটে।
কী নিবিড় সবুজ এই জায়গাটা! রয়েল বেঙ্গল টাইগারখ্যাত এ দেশটাতো ভারি সুন্দর!বুভুক্ষাশিল্পী মুগ্ধ না হয়ে পারে না।হাঁটতে হাঁটতেএকটি ছাত্রনিবাসের কাছে চলে আসে শিল্পী; হঠাৎ দুপুরে দেখা ভাত খেতে চাওয়া যুবকটি দিকে চোখ পড়ে তার। যে তার কাছে না খেয়ে থাকার কসরত শিখতে চেয়েছিলো! যুবকটিকে হলের ভেতরে ঢুকতে দেখে। শিল্পী সোৎসাহে তাকে ডাকে,সম্ভবত ওর ডাক শুনতে পায় না ও। শিল্পীর কৌতূহল জাগে, আনোয়ার কি ভাত খেয়েছিলো? হেেলর অন্ধকারাচ্ছন রাত সেখানে যেতে প্ররোচিত করে তাকে।... এবং নীরব অন্ধকারের এক কোণে দাঁড়িয়ে সে সব কিছু দেখে। একটি ইলেকট্রিক ডিভাইসচুরির দায়ে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে ছেলেটাকে নির্মভাবে পেটানোর পর অবশ্যওকে ক্যান্টিনে নিয়ে ভাত খেতে দেয়া হয়।অভুক্ত থাকার যাদু শিখতে চাওয়া যুবকটি এতো মার খেয়েও ভাতের থালা দেখেআপ্লুত হয়ে পড়ে। পরম মমতায় থালাটা সে টেনে নেয়... ভীত, ক্ষুধার্থ হাতে ভাতের গ্রাস তোলে মুখে।এরপর যা ঘটে তাকাফকার কাল্পনিকচরিত্রকেও কাঁপিয়ে দেয়। হামলাকারীরা ওর চোখের সামনে জার্মান নাৎসি সেনা হয়ে ওঠে...। যুবকটিঅমানুষিক প্রহারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এরপর বুভুক্ষা শিল্পী আর দাঁড়ায় না।
সিদ্ধান্ত নেয়,আর রক্ত-মাংসের মানুষের পৃথিবীতে একদ- নয়।আবার স্বেচ্ছায় সে বইয়ে মলাট বন্দি হয় কাফকার বিখ্যাত অনশন শিল্পীর চরিত্রে।