alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : সাত

শিকিবু

আবুল কাসেম

: বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

এগারো

প্রচলিত নিয়মানুযায়ী কিয়োটোর সর্বপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিন্টু শ্রাইনে মুরাসাকি এবং নোবুতাকার বিয়ের আসর বসেছে। বরকনের পারিবারিক সদস্যরাই শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন। এটি হেইয়ানকিউতে একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে শুধু বর-কনের পারিবারিক লোকজনই উপস্থিত থাকেন।

মুরাসাকি ধবধবে সাদা কিমোনো পরিধান করেছেন। সাদা রঙ পবিত্রতার প্রতীক। পাত্রও তাই পরেছেন। বিয়ের কনের মাথায় রয়েছে সুনো কাকুশি। পাত্রের পোশাকের বাহাদুরি এখানেও আছে। নোবুতাকা সকল নিয়মের ঊর্ধ্বে বিলাসী জীবনযাপন করেন।

শিন্টু ধর্মযাজক বেদির ডানদিকে দাঁড়িয়েছেন। বাম দিকে দাঁড়িয়েছে মিকো বা তাঁর সহকারী। বরকনে কক্ষের মাঝখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন। তাদের পরিবারের নিকটতম সদস্যরা দাঁড়িয়েছেন মদ এবং ফলমূল রাখা একটি টেবিলের পেছনে। ধর্মযাজক পবিত্র কামি দেবতাকে উদ্দেশ্য করে শ্রাইন ও উপস্থিত সকলের জন্য পবিত্রতার ধর্মীয় আচার (রিচুয়াল) শুরু করলেন। প্রথমে সদাশয় পবিত্র আধ্যাত্মিক দেবতা কামিকে স্মরণ করলেন। তারপর বর-কনেকে চালের তৈরি সাদা মদ দিয়ে সান সান কু-ডো অনুষ্ঠানের আহ্বান জানালেন। সান সান কু-ডো কথাটির অর্থ তিন তিন নয় বার। তা তিন তিন কাপ মদ্য গ্রহণে শপথের মর্মকে ব্যক্ত করে। প্রথমে সবচেয়ে ছোট কাপ পানি বর নোবুতাকাকে পবিত্র করে। পরে কনে মুরাসাকিকে বর তা বাড়িয়ে দেন। দ্বিতীয় পবিত্রাচার কন্যাকে নিয়ে শুরু হয় এবং বরকে দিতে হয় শেষ। তৃতীয় শেষটি শুরু হয় বরের কাছ থেকে এবং শেষ হয় কনের কাছে। প্রতিবারই তিন চুমুক পান করতে হয় উভয়কে। শপথটা বরকেই করতে হয়।

প্রকাশিত এই বর্তমান উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

শিন্টু বিয়ের প্রধান ব্যাপারই হচ্ছে মদ্য পানের এই পবিত্রাচার। মনে করা হয় ব্যাপারটা প্রতীকী। আনন্দবেদনাকে দাম্পত্য জীবনে ভাগাভাগি করে নেয়ার দায়-দায়িত্ব রয়েছে তার মূলে। কেউ কেউ মনে করেন সান সান হচ্ছে জনমের পর জনমে উচ্চারিত সেই শব্দ; যার রূপ এবং উচ্চারণ অভিন্ন কিন্তু অর্থ বিভিন্ন।

এক সময় উভয় পরিবারের সদস্যরা প্রথাগত ‘কাম্পাই’ অনুসরণে চালের তৈরি মদ্য পান করেন। আনন্দ করেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে পুরোহিত জাপানের চিরসবুজ সাকাকী উৎসর্গ করতে বলেন। বর-কনে বেদিতে তা অর্পণ করেন। মুরাসাকি এবং নোবুতাকার বাবা আলতো পদ নিক্ষেপে বেদির দিকে এগিয়ে গেলেন।

কামি পবিত্রতার দেবতা হলেও বিবাহের দেবতা ও দেবি ইঝানগি এবং ইঝানামি। বর-কনেকে তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে হয় দাম্পত্য জীবনে সুখ সমৃদ্ধি এবং সন্তান লাভের জন্য। বর-কনে তাই করলেন। পুরোহিতের নেতৃত্বে অন্য সবাই তাঁদের সঙ্গে যোগদান করলেন।

বিয়ের পর হেইয়ান কিয়োর অভিজাত মানুষদের রীতি মেনে বর নোবুতাকা তার নিজের বাড়ি এবং মুরাসাকি বাপের বাড়ি টেরামাচি লেনে চলে গেলেন।

প্রভাবশালী ফুজিওয়ারা গোত্রের লোকজন একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর তা হলো সন্তানের জন্মদান। সে সন্তান সম্রাটের দরবারে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্ভাব্য উচ্চপদ লাভ করে পরিবার ও গোত্রের মুখ উজ্জ্বল করবে। হেইয়ান সমাজটাই সম্রাটের দরবারের পদ-পদবির আভিজাত্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই ধারণা থেকে কেউ কেউ বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতারও যায় না, এমনকি বিয়ের স্থায়ীত্বের কথাও ভাবে না, পুরুষদের জন্য সন্তানটাই বড় কথা।

তবে মুরাসাকির বাবা তামেতোকি একটা বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। বর-কনের বন্ধু, তার বন্ধু-বান্ধব এবং সম্রাটের দরবারের লোকজন এতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন। সামুরাই সেনাপতি এবং শিন্টু শ্রাইন ও বৌদ্ধকেয়াং এর পুরোহিতরাও আমন্ত্রিত হয়েছেন এতে।

তামেতোকি শুধু গর্ভনরই নন, উঁচুস্তরের একজন অভিজাত মানুষ এবং জনপ্রিয় কবিও। তাই তাঁর আয়োজনে আভিজাত্য এবং নান্দনিকতার স্পর্শ সুস্পষ্ট। আমন্ত্রিত অতিথিরা বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং অভিজাত সমাজের প্রতিভূ। তাঁদের আদর আপ্যায়নে তা মাথায় রেখে তিনি যাবতীয় রুচিসম্মত আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। বসার আসন থেকে খাবার টেবিল পর্যন্ত আভিজাত্যের সঙ্গে নতুনত্বের ছাপ।

জাপান সাম্রাজ্যে এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত অনুষ্ঠানাদিতে আহার্য গ্রহণ করা হতো মেঝেতে পদ্ম আসনে বসে। হেইয়ান সাম্রাজ্যে প্রথম টেবিলে খাবার পরিবেশন রীতি চালু হয় এবং পায়াওয়ালা টেবিল শুধু রাজকীয় অভিজাতদের পরিম-লে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রত্যেক অতিথির জন্য একটি করে বসার আসন এবং খাবার টেবিল। নক্সাদার টেবিল ক্লথ এবং ইকেবানায় গৌরবদীপ্ত সাজসজ্জা। ওপরে শামিয়ানা বড় বড় ছাতার আদলে মেলে ধরা আছে।

ইঝোমি আসেননি তার বাবা এসেছেন। মন খারাপ তবু স্বাভাবিক থেকে হাসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না। মাঝে মধ্যেই আনমনা হয়ে পড়ছেন।

আকাঝোমি ইমন এসেছেন। মুরাসাকিকে বললেন, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। পোশাকটা অদ্ভুত মানিয়েছে।

তা শুনে মুরাসাকি হাসলেন। মুরাসাকির বড় বোনটা পাশেই ছিলেন। বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ ইমন। ইমন তাঁর সমবয়সী। টেরামাচি লেনেই এরা বড় হয়েছেন। ইমন আয়োজনের প্রশংসা করলেন।

ইমনের সঙ্গে তার স্বামী এসেছেন। বসেছেন মুরাসাকির বড় বোনের স্বামীর পাশে। তাদের জানা শোনা আছে। দুজনকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছে।

সম্রাটের দরবার থেকে আসা অতিথিদের সম্মান এবং গুরুত্ব বেশি। তামেতোকি তাদেরকে বেশি সময় দিচ্ছেন। অন্যেরা আয়োজনের প্রভূত প্রশংসা করলেও, তাঁরা যথারীতি গাম্ভীর্য ধারণ করে আছেন এবং নিজেদের মধ্যে দরবার সম্পর্কিত বিয়ষাদি নিয়ে কথা বলছেন। বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানেও যেন এরা অফিস করছেন।

নোবুতাকা জামাই হয়ে বসে নেই। সম্রাটের উৎসব-অনুষ্ঠান বিভাগের আমলা। তিনি তাঁর মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে খুশি করার কাজে ব্যস্ত আছেন। মন্ত্রী ভদ্রলোক। বললেন, নোবুতাকা অন্যরা তো দেখছে, আজকে তোমার দিন। দিনটাকে অন্যভাবে উপভোগ কর। তামেতোকি তো আছেই।

নোবুতাকা বললেন, আপনাকে পেয়ে কী যে আনন্দ হচ্ছে, তা বুঝাতে পারব না। এ আনন্দটা ধরে রাখার সুযোগ দিন, সান।

আচ্ছা, আচ্ছা। তোমার আনন্দেই আমার আনন্দ। তোমার শ্বশুরের রুচিবোধ আর আয়োজন দেখে সত্যিই আমি অভিভূত। সবকিছুতেই শিল্পের স্পর্শ।

কবি মানুষ তিনি। জাপানের ফুল, চদ্রালোক, বরফ-সফেদ পাহাড় চূড়া- এসব সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা লেখেন। সবচেয়ে বড় কথা চীনা সংস্কৃতিটা তাদের পরিবারে আত্মস্ত হয়ে আছে।

সর্বত্র তার প্রভাবই তো দেখছি। বললেন মন্ত্রী।

প্রতিটি টেবিলে খাবার পরিবেশন করা আছে, রাজকীয়ভোজ, রাজভোগ, ‘প্রথা পাঁচ’ অনুসরণ করে মেনু বা পদ নির্বাচন করা হয়েছে। খাবার আছে পাঁচ রঙের, কালো, সাদা, লাল, হলুদ এবং সবুজ। রান্না পদ্ধতি পাঁচ রকমের : কাঁচা খাবার, গ্রিল্ড, সেদ্ধ, ভাপানো এবং ভাজি। স্বাদগন্ধও পাঁচরকম : মিষ্টি, ঝাল, লবণাক্ত, টক এবং তেতো।

নোবুনোরি বসেছে তার বন্ধুদের নিয়ে। অভিজাত হেইয়ানকিউর সন্তান এরা। ক্লাসিক্যাল চায়নিজে কথা বলে। ওদের আভিজাত্য-শিষ্ঠাচার এরকমই। তার বন্ধুরা সবাই বিস্মিত পরিবেশিত খাবারের রঙ দেখে এবং খাবারের গন্ধ পেয়ে। খুব লোভ হচ্ছে কিন্তু কেউ খাচ্ছে না। খাবার দাবারের একটা শৃঙ্খলা আছে। সবাই একসঙ্গে শুরু করবে। তার আগে আয়োজক (হোস্ট) একটা সংক্ষিপ্ত ভোজবক্তৃতা দেবেন।

শিন্টুশ্রাইন এবং বৌদ্ধ প্যাগোডা থেকে আমন্ত্রিত পুরোহিত শ্রমন ভান্তেরা টেবিল চেয়ারে বসেননি। তাঁরা তাঁদের প্রথা অনুসরণ করে কিয়দ-দূরে ছাতাছাদ শামিয়ানার নিচে পদ্ম-আসন করে গালিচার ওপর মেঝেতে আয়েশ করে বসেছেন। খাবার দেখে এবং গন্ধ পেয়ে শুধু অবাকই না, বড় লোভাতুর হয়ে পড়েছেন। কিন্তু সংযম অবলম্বন ছাড়া কিছুই করার নেই।

সম্রাটের দরবার থেকে আসা আমলা-অমাত্যদের ভাব প্রতিক্রিয়া বুঝা যাচ্ছে না, বোধহয় অবস্থা বুঝে, ভক্ষণ ও স্বাদ গ্রহণ করে পরস্পরের প্রতি মন্তব্য ছুড়ে দেবেন- যা তারা সবসময়ই করেন।

খাদ্য ও পানপাত্রে যা রাখা হয়েছে, তার সম্পর্কে দুয়েক কথা বলা যেতে পারে। চীনামাটির দৃষ্টিনন্দন প্লেট ও বাটিগুলোয় থরে থরে সাজিয়ে ইকেবানা ধাঁচে রাখা হয়েছে খাবারগুলো। রঙ এবং পরিমাণের মধ্যে, এমনকি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পদের মধ্যেও একটা ভারসাম্য ও সাঞ্জস্যপূর্ণ শিল্পকলার চারুচর্চা আছে।

খাদ্যগুলোর মধ্যে আছে শোশি। কাঁচা মাছের স্লুইচ। সামুদ্রিক মাছ। তবে তা গাঁজিয়ে তোলা ভাতের মধ্যে সংরক্ষিত। অবশ্য এই শোশির একটা আদিরূপ আছে। তাকে বলা হয় ‘সাশিমি’। তা ভাতছাড়া কাঁচামাছ, কাঁচা গো বা শূকরের মাংস (গাইউ সাশি), কাঁচা মুরগি (টোরিঝাশি), এমনকি ঘোড়ার (বাসাশি) কাঁচা মাংস দিয়েও তৈরি এবং পরিবেশিত হয়। আজকের মেনুতেও তা অন্তর্ভুক্ত আছে।

সুকেমোনো পিকলেস প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে খুবই জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী খাবার। বেশ কয়েকটা উপাদান দিয়ে তৈরি বলে তাতে খাদ্যগুণ প্রচুর এবং নানা রঙের ঔজ্জ্বল্যে চিত্তহারী। তাতে নানা সবজি, ডিম্বগাছা এবং রঙিন সব পাঁচ রকমের ফলমূল ব্যবহার করা হয়।

সুকিইয়াকি হচ্ছে গোমাংস শবজি ও তোকু সংযুক্ত খাবার। এই খাবার দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল, প্রিয় সম্রাজ্ঞীর এক অনুরোধে সম্রাট তা নিষিদ্ধ করে দেন। দীর্ঘকাল পর এই খাবারের গন্ধে নিয়মমানা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একজন আমলা এদিক-সেদিক তাকিয়ে টপ করে একটি মাংসের টুকরা মুখে পরে নিল। সম্রাটের দরবারের লোক বলে কেউ দেখেও দেখল না।

এই খাবার পুরোহিত-ভান্তেদের এলাকায় এখনো নিষিদ্ধ। কিন্তু লোভনীয় গন্ধটা মনে হয় তাদেরকে বড় পীড়া দিচ্ছে।

তেমপুরা দেয়া আছে সকলের জন্য। বাটার্ড ময়দা, দুধ ও ডিমের তৈরি রুটি, ভাজিমাছ, পিসুড বা শাকসবজিজাত এই খাবারটা তৈরিতে বরফশীতল এবং উত্তপ্ত তৈলের ব্যবহার মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে। আর আছে মিছো সুপ। এ সুপ বিখ্যাত সবার কাছে।

সবশেষে আছে কাইশি (ডেজার্ট) যাতে আছে চীনা কেক এবং কাটা ফলমূল, বাদাম ও আরো নানা দ্রব্যাদি।

তামেতোকি মদের বদলে নতুন জনপ্রিয় তেতো সবুজ চা দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করতে চেয়েছেন।

তামেতোকি আনুষ্ঠানিকভাবে সামান্য কিছু কথা বলে নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নে আমন্ত্রণ জানালেন।

সুস্বাদু খাবারের স্বাদ গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত সবাই। প্রশংসাই করলেন। তামেতোকি জাপানি রীতিতে সবাইকে বিনম্রভাবে মাথানত করে বিদায় জানালেন।

নতুন জামাই প্রথা মোতাবেক থেকে যাবেন শ্বশুরবাড়িতে। দু’চার দিন থাকবেন। প্রাচ্যে ঘরজামাইয়ের নিয়ম থাকলেও হেইয়ান কিয়োর আভিজাত্যে তা নেই। বর নিজের বাড়িতেই থাকেন, মাঝেমধ্যে স্ত্রীর কাছে শ্বশুরবাড়িতে আসেন।

এদিকে বিকেলে সম্রাটের দরবারে সাহিত্য পাঠের আসর বসেছে। যথারীতি পাঁচ স্ত্রী উপস্থিত আছেন, প্রিন্স মিচিনাগা, তার মা এবং স্ত্রী উপস্থিত হয়েছেন। অন্যান্য প্রিন্স এবং দরবারি লোকজন আগে থেকেই আছেন।

সম্রাটের সভাকবি ফুজিওয়ারা নো কিন্তু অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। প্রস্তুতি চলছে। এ সময় নোবুতাকা নতুন স্ত্রীকে নিয়ে দরবারে উপস্থিত হলেন। পাঁচ স্ত্রী এবং সম্রাট ইচিজো তাদেরকে বিয়ের অভিনন্দন জানালেন। মুরাসাকি এ দরবারের সঙ্গে পরিচিত। তামেতোকির মেয়ে বলে সম্রাটসহ অনেকেই তাকে চেনেন। কবিদের মধ্যে ইমন আছেন। সেই শোনাগন আছেন। ইঝোমি শিকিবু থাকবেন না বলে ইমন এবং সম্রাজ্ঞী শোশি অখুশি। সম্রাজ্ঞী শোশি সেই শোনাগনের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে নিজের দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলেন।

এ সময় ইমনকে অবাক করে দিয়ে ইঝোমি দরবার হলে ঢুকলেন। ইমন উচ্ছ্বসিত। সম্রাজ্ঞী শোশির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বারো.

ইমনের উৎসুক্যও কম নয়। ইঝোমির আসার কথা ছিল না। তবু কেন এল? আগে এলে সম্রাজ্ঞী শোশির সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো, ওয়াকা কবিতা নিয়ে কথা হতো। কোন কোন কবিতা পাঠ করা হবে সম্রাজ্ঞী এবং ইমন তা ঠিক করে দিতেন। সম্রাজ্ঞী শোশির বাবা মিচিনাগা কবিতার সমঝদার। সম্রাটের ওপর এখন একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে আছেন। তাঁর পছন্দেরও ওয়াকা থাকতে পারে। সমন্বয়টা নেই। এজন্য আফসোস হচ্ছে। সম্রাট, সম্রাজ্ঞী এবং মিচিনাগাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কবিতা পাঠ করতে হবে। অন্যের কবিতা নয়, নিয়ম অনুযায়ী নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে শোনাতে হয়।

অন্যান্য প্রিন্সদের মতো প্রিন্স তামেতাকাও উপস্থিত আছেন। হঠাৎ করেই ইমনের তা চোখে পড়ল। ভাবলেন, তাহলে কি প্রিন্সের ইচ্ছেতেই ইঝোমি আসরে এসেছে? এটাই হবে।

ইঝোমির বাবা এখন উৎসব-অনুষ্ঠান বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা। দায়িত্ব হিসাবেই অনুষ্ঠানে আছেন। মেয়েকে দেখে তার ভালো লাগেনি। ভাবলেন, হায়! কিছুদিন আগে হলেও তার কাছে মেয়ের কবিতা পাঠ তার জন্য ছিল গৌরবের, গর্বের। অথচ আজ, এখানে মেয়ের উপস্থিতিটাই তিনি সহ্য করতে পারছেন না। প্রিন্স তামেতাকাকে দেখেও তাঁর রাগ হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই।

সম্রাটের সভাকবি ফুজিওয়ারা নো কিন্তু সম্রাটের অনুমতি নিয়ে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান শুরু করতে গেলেন। সম্রাট বললেন, আজকে হঠাৎই আগাম বৃষ্টি হানা দিয়েছে। কিয়োটো ঝুম বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন। কবিদের কাছে আমি বৃষ্টির কবিতা শুনতে চাই।

আনুগত্যের হাসি হেসে সভাকবি বললেন, হ্যাঁ, আজকে বৃষ্টির ওয়াকা শুনব আমরা। মহামান্য সম্রাট আমাদের মনের কথাই বলে দিয়েছেন।

সমঝদার সম্রাট বললেন, সব কবিতা বৃষ্টিনির্ভর হওয়ার দরকার নেই। তবে বৃষ্টির কবিতা থাকবে।

আসরে ফুজিওয়ারা মিচিনাগাকে কথা বলতেই হয়। বললেন, মহামান্য সম্রাটের শুধু সাহিত্য প্রীতি না কোন সময়ে কোন কবিতা শুনতে হয়, তাও ভালো জানা আছে। এখন বৃষ্টিমধুর বিকেল। বৃষ্টির কবিতাই তো মধুর লাগবে। আমি সম্রাটের রুচির প্রশংসা করি।

সভাকবি এবারে মিচিনাগার প্রতি অনুগত দৃষ্টিতে তাকালেন। তার অর্থ মহাশয় সুযোগ দিন এবার শুরু করি। প্রিন্সদের অনেকে এবং শোশি ছাড়া সকল সম্রাজ্ঞী মিচিনাগার ওপর বিরক্ত।তার ভাতিজি সম্রাজ্ঞী তেইশি অসম্ভব ক্ষিপ্ত। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেন না, তাকে সবাই ভয় করেন।

সভাকবি প্রথমে চিকেজ তাচিবানাকে কবিতা পাঠের জন্য আহ্বান জানালেন। ওয়াকা কবি তাচিবানা কবিতার একটু ভূমিকা দিয়ে বললেন, বৃষ্টি এসে গেছে। তার আগে প্রেমিক প্রেমিকাকে ফেলে চলে যেতে চাচ্ছিল। বৃষ্টি নামায় আর যেতে পারেনি। তখন প্রেমিকা বলছে :

‘যেতে যদি নাই পারো

চিরদিনের জন্য থাকো

এই বরষায় অনেক কথা

গল্পপ্রাচীন জমে থাকা

ভেজা হৃদয় অরণ্য।’

সম্রাট বাহ বাহ বলে হাতে তালি বাজালেন। অন্যরা তাকে অনুসরণ করলেন।

সভাকবি বললেন, চমৎকার ওয়াকা। আমাদের একটা নিয়ম আছে। নতুন আগত কোনো কবি তার কবিতা পাঠ করতে পারে। নোবুতাকা মুরাসাকিকে জিজ্ঞেস না করেই সভাকবিকে বললেন, তাকাকু কবিতা পাঠ করবে।

সম্রাট বললেন, অবশ্যই নববধূর কবিতা শুনবো। আমার মতো নববধূরও সৌভাগ্য আজকে বৃষ্টি হচ্ছে। বলে অর্থবহ হাসি হাসলেন। অন্যরা হাত তালি দিয়ে দিলেন এবং মিটি মিটি হাসলেন।

সভাকবি তামেতোকির মেয়ে হিসেবে তাকাকুকে আগে থেকেই চেনেন। তবে তাকাকু কবিতা লেখে তা তার জানা নেই। সম্রাট উৎসাহী না হলে হয়ত নোবুতাতাকে বিকল মনোরম হতে হত। সভাকবি সুযোগই দিতেন না।

তবে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন তাকাকু। ভাগ্য ভালো তার মুখস্ত শক্তি অসাধারণ। স্বামীকে বিব্রত অবস্থায় না ফেলে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি কবিতার খাতা আনিনি। আমার জানা ছিল না এরকম একটি মহান আসরে কবিতা পড়তে হবে। মহামান্য সম্রাটের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে উৎসাহিত করেছেন। এ উৎসাহকে আমি আশীর্বাদ বলে মাথা পেতে নিয়েছি।

এত গুছিয়ে কথা বলার জন্য সবাই অবাক হলেন। সম্রাট বাহবা দিয়ে দিলেন। এখানে এখনো কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু হয়ে দাঁড়ায়নি, তাই নবাগত বলে সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তাকে স্বাগত জানালেন।

মুরাসাকি কবিতা নিয়ে কোনো কথা না বলে সরাসরি কবিতা পাঠে চলে গেলেন :

‘বজ্রপাতের বানচিরিক

মেঘের গর্জন সাথে

ঝুম বৃষ্টি আসবে বলে

চাচ্ছো চলে যেতে

অবশেষে থামলে তুমি

বৃষ্টি এলো নেমে।’

সম্রাট এবারে দু’হাত ওপরে তুলে বাহ বাহ বলে তালি বাজালেন। ইমন ছাড়া সবাই অবাক। কারণ তাকে তিনি আগে থেকেই চেনেন। ইঝোমিও জানেন মুরাসাকির কবিতা লেখার হাত আছে।

আকাঝুমি ইমনের কবিতা পাঠ নির্ভর করছে ইঝোমির কবিতা পাঠের ওপর। ইঝোমি কোনো পাগলামো না করলে তিনি কবিতা পাঠ নাও করতে পারেন।

সভাকবি ইঝোমি শিকিবুর নাম ঘোষণা করলেন। ইঝোমির সময়টা ভালো যাচ্ছে না। স্বামী নাখোশ, বাবা ক্ষিপ্ত, প্রেমিক তামেতাকার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। বিরহে মন ভীষণ খারাপ। এখানে আসলে তিনি সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের কবিতা শুনাতে আসেননি, অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রেমিক প্রিন্স তামেতাকাকে কঠিন কবিতা শোনাতে এসেছেন। সম্রাটের কথায় এখানে বসেই তাকে বৃষ্টির কবিতা লিখতে হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে। বললেন, আমি দুটি ওয়াকা পাঠ করব। একটি বৃষ্টির অন্যটি বিরহের। বৃষ্টির কবিতাটি এখানে বসে লেখা।

সম্রাট বললেন, তাই হোক। বৃষ্টির সঙ্গে বিরহের সম্পর্ক রয়েছে।

প্রথম কবিতা :

‘সম্ভবত: ভাবছো তুমি

গ্রীষ্মের আগাম বৃষ্টি

বৃষ্টি নয় তা

তোমার জন্য অশ্রু আমার

যা তোমারই সৃষ্টি।’

সম্রাট বললেন, অদ্ভুত অসাধারণ। দ্বিতীয়টি শুনি।

ইঝোমি পাঠ করলেন :

‘তারা বলে মৃত আজ রাতে

ফিরে আসবে, ফিরে আসবেই

অথচ তুমি আমার পাশে নেই

তা হলে আমার বাসস্থান

সত্যিই কী অশরীরীর বাড়ি!’

সম্রাট কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এই ওয়াকার মর্ম বুঝতে চাইলেন। বুঝলেন কিনা স্পষ্ট বুঝা গেল না, পরে তালি বাজিয়ে দিলেন এবং বাহবার ভঙ্গিতে সম্রাজ্ঞী শোশির দিকে তাকালেন।

সম্রাট বুঝুন বা না বুঝুন একজন ভালো বুঝেছেন। তিনি প্রিন্স তামেতাকা। প্রিয়া ইঝোমির জন্য খুব মায়া হলো তার। মনে হলো অযথাই তিনি তার মনে কষ্ট দিয়েছেন। বড় কষ্ট হচ্ছে তার। মুশকিল হলো তিনি কবিতা লিখতে পারেন না, না হয় একটি সুন্দর কবিতা লিখে ক্ষমা চেয়ে নিতেন। তার উপলব্ধি হলো, প্রতিভাবানেরা একটু জেদিই হয়। এতগুণী তার হৃদয় রাণী, ভাবতেই বুক বুঝি ভরে যায়। কবি ইঝোমির প্রেমিক হয়ে কৃতার্থ বোধ করলেন তিনি।

আরেকজনের বুকও গর্বে ভরে উঠেছে। তিনি বালিকা সম্রাজ্ঞী শোশি। ইঝোমি আসবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আজকে বুঝতে পারলেন সত্যিই এক প্রতিভাময়ী কবি তার লেডি ইন ওয়েটিং। তারপরও তার মনে প্রশ্ন সম্রাজ্ঞী তেইশি ঈর্ষার আগুনে পুড়ছে তো?

আসলেই সবার প্রশংসা এবং সম্রাটের মন্তব্যে সম্রাজ্ঞী তেইশি অন্তরে দারুণ চোট পেয়েছেন। তিনি সেই শোনাগনের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, যেন সেই শোনাগন সাহিত্যের একটি আছারে সম্রাজ্ঞী শোশির সকল দর্পচূর্ণ কবে দিতে পারেন।

সেই শোনাগণের আসলে ভালো প্রস্তুতি নেই। তিনি ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়েছেন। নিজের নাম এ দরবারে এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে, অন্য কেউ তাকে টেক্কা দিতে পারে ভাবতেই পারেননি। কবিতার খাতা নয়, নিবন্ধ প্রবন্ধ আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় লেখা সম্রাজ্ঞী তেইশির প্রশংসায় ভরা ডায়েরি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। বর্ষা বা বৃষ্টির কোনো কবিতা বা নিবন্ধ নেই তাতে। বড় চিন্তিত তিনি।

সভাকবি কিছু বলতে যাবেন তখনই সম্রাট বললেন, আজ আর নয়। তোমাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে জরুরি কাজে যেতে চাই। আমি ভাবছি তোমাদের সকলের কবিতা নিয়ে আমি একটি সংকলন করব। ক্রমশ...

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : সাত

শিকিবু

আবুল কাসেম

বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

এগারো

প্রচলিত নিয়মানুযায়ী কিয়োটোর সর্বপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিন্টু শ্রাইনে মুরাসাকি এবং নোবুতাকার বিয়ের আসর বসেছে। বরকনের পারিবারিক সদস্যরাই শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন। এটি হেইয়ানকিউতে একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে শুধু বর-কনের পারিবারিক লোকজনই উপস্থিত থাকেন।

মুরাসাকি ধবধবে সাদা কিমোনো পরিধান করেছেন। সাদা রঙ পবিত্রতার প্রতীক। পাত্রও তাই পরেছেন। বিয়ের কনের মাথায় রয়েছে সুনো কাকুশি। পাত্রের পোশাকের বাহাদুরি এখানেও আছে। নোবুতাকা সকল নিয়মের ঊর্ধ্বে বিলাসী জীবনযাপন করেন।

শিন্টু ধর্মযাজক বেদির ডানদিকে দাঁড়িয়েছেন। বাম দিকে দাঁড়িয়েছে মিকো বা তাঁর সহকারী। বরকনে কক্ষের মাঝখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন। তাদের পরিবারের নিকটতম সদস্যরা দাঁড়িয়েছেন মদ এবং ফলমূল রাখা একটি টেবিলের পেছনে। ধর্মযাজক পবিত্র কামি দেবতাকে উদ্দেশ্য করে শ্রাইন ও উপস্থিত সকলের জন্য পবিত্রতার ধর্মীয় আচার (রিচুয়াল) শুরু করলেন। প্রথমে সদাশয় পবিত্র আধ্যাত্মিক দেবতা কামিকে স্মরণ করলেন। তারপর বর-কনেকে চালের তৈরি সাদা মদ দিয়ে সান সান কু-ডো অনুষ্ঠানের আহ্বান জানালেন। সান সান কু-ডো কথাটির অর্থ তিন তিন নয় বার। তা তিন তিন কাপ মদ্য গ্রহণে শপথের মর্মকে ব্যক্ত করে। প্রথমে সবচেয়ে ছোট কাপ পানি বর নোবুতাকাকে পবিত্র করে। পরে কনে মুরাসাকিকে বর তা বাড়িয়ে দেন। দ্বিতীয় পবিত্রাচার কন্যাকে নিয়ে শুরু হয় এবং বরকে দিতে হয় শেষ। তৃতীয় শেষটি শুরু হয় বরের কাছ থেকে এবং শেষ হয় কনের কাছে। প্রতিবারই তিন চুমুক পান করতে হয় উভয়কে। শপথটা বরকেই করতে হয়।

প্রকাশিত এই বর্তমান উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

শিন্টু বিয়ের প্রধান ব্যাপারই হচ্ছে মদ্য পানের এই পবিত্রাচার। মনে করা হয় ব্যাপারটা প্রতীকী। আনন্দবেদনাকে দাম্পত্য জীবনে ভাগাভাগি করে নেয়ার দায়-দায়িত্ব রয়েছে তার মূলে। কেউ কেউ মনে করেন সান সান হচ্ছে জনমের পর জনমে উচ্চারিত সেই শব্দ; যার রূপ এবং উচ্চারণ অভিন্ন কিন্তু অর্থ বিভিন্ন।

এক সময় উভয় পরিবারের সদস্যরা প্রথাগত ‘কাম্পাই’ অনুসরণে চালের তৈরি মদ্য পান করেন। আনন্দ করেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে পুরোহিত জাপানের চিরসবুজ সাকাকী উৎসর্গ করতে বলেন। বর-কনে বেদিতে তা অর্পণ করেন। মুরাসাকি এবং নোবুতাকার বাবা আলতো পদ নিক্ষেপে বেদির দিকে এগিয়ে গেলেন।

কামি পবিত্রতার দেবতা হলেও বিবাহের দেবতা ও দেবি ইঝানগি এবং ইঝানামি। বর-কনেকে তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে হয় দাম্পত্য জীবনে সুখ সমৃদ্ধি এবং সন্তান লাভের জন্য। বর-কনে তাই করলেন। পুরোহিতের নেতৃত্বে অন্য সবাই তাঁদের সঙ্গে যোগদান করলেন।

বিয়ের পর হেইয়ান কিয়োর অভিজাত মানুষদের রীতি মেনে বর নোবুতাকা তার নিজের বাড়ি এবং মুরাসাকি বাপের বাড়ি টেরামাচি লেনে চলে গেলেন।

প্রভাবশালী ফুজিওয়ারা গোত্রের লোকজন একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর তা হলো সন্তানের জন্মদান। সে সন্তান সম্রাটের দরবারে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্ভাব্য উচ্চপদ লাভ করে পরিবার ও গোত্রের মুখ উজ্জ্বল করবে। হেইয়ান সমাজটাই সম্রাটের দরবারের পদ-পদবির আভিজাত্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই ধারণা থেকে কেউ কেউ বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতারও যায় না, এমনকি বিয়ের স্থায়ীত্বের কথাও ভাবে না, পুরুষদের জন্য সন্তানটাই বড় কথা।

তবে মুরাসাকির বাবা তামেতোকি একটা বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। বর-কনের বন্ধু, তার বন্ধু-বান্ধব এবং সম্রাটের দরবারের লোকজন এতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন। সামুরাই সেনাপতি এবং শিন্টু শ্রাইন ও বৌদ্ধকেয়াং এর পুরোহিতরাও আমন্ত্রিত হয়েছেন এতে।

তামেতোকি শুধু গর্ভনরই নন, উঁচুস্তরের একজন অভিজাত মানুষ এবং জনপ্রিয় কবিও। তাই তাঁর আয়োজনে আভিজাত্য এবং নান্দনিকতার স্পর্শ সুস্পষ্ট। আমন্ত্রিত অতিথিরা বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং অভিজাত সমাজের প্রতিভূ। তাঁদের আদর আপ্যায়নে তা মাথায় রেখে তিনি যাবতীয় রুচিসম্মত আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। বসার আসন থেকে খাবার টেবিল পর্যন্ত আভিজাত্যের সঙ্গে নতুনত্বের ছাপ।

জাপান সাম্রাজ্যে এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত অনুষ্ঠানাদিতে আহার্য গ্রহণ করা হতো মেঝেতে পদ্ম আসনে বসে। হেইয়ান সাম্রাজ্যে প্রথম টেবিলে খাবার পরিবেশন রীতি চালু হয় এবং পায়াওয়ালা টেবিল শুধু রাজকীয় অভিজাতদের পরিম-লে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রত্যেক অতিথির জন্য একটি করে বসার আসন এবং খাবার টেবিল। নক্সাদার টেবিল ক্লথ এবং ইকেবানায় গৌরবদীপ্ত সাজসজ্জা। ওপরে শামিয়ানা বড় বড় ছাতার আদলে মেলে ধরা আছে।

ইঝোমি আসেননি তার বাবা এসেছেন। মন খারাপ তবু স্বাভাবিক থেকে হাসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না। মাঝে মধ্যেই আনমনা হয়ে পড়ছেন।

আকাঝোমি ইমন এসেছেন। মুরাসাকিকে বললেন, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। পোশাকটা অদ্ভুত মানিয়েছে।

তা শুনে মুরাসাকি হাসলেন। মুরাসাকির বড় বোনটা পাশেই ছিলেন। বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ ইমন। ইমন তাঁর সমবয়সী। টেরামাচি লেনেই এরা বড় হয়েছেন। ইমন আয়োজনের প্রশংসা করলেন।

ইমনের সঙ্গে তার স্বামী এসেছেন। বসেছেন মুরাসাকির বড় বোনের স্বামীর পাশে। তাদের জানা শোনা আছে। দুজনকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছে।

সম্রাটের দরবার থেকে আসা অতিথিদের সম্মান এবং গুরুত্ব বেশি। তামেতোকি তাদেরকে বেশি সময় দিচ্ছেন। অন্যেরা আয়োজনের প্রভূত প্রশংসা করলেও, তাঁরা যথারীতি গাম্ভীর্য ধারণ করে আছেন এবং নিজেদের মধ্যে দরবার সম্পর্কিত বিয়ষাদি নিয়ে কথা বলছেন। বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানেও যেন এরা অফিস করছেন।

নোবুতাকা জামাই হয়ে বসে নেই। সম্রাটের উৎসব-অনুষ্ঠান বিভাগের আমলা। তিনি তাঁর মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে খুশি করার কাজে ব্যস্ত আছেন। মন্ত্রী ভদ্রলোক। বললেন, নোবুতাকা অন্যরা তো দেখছে, আজকে তোমার দিন। দিনটাকে অন্যভাবে উপভোগ কর। তামেতোকি তো আছেই।

নোবুতাকা বললেন, আপনাকে পেয়ে কী যে আনন্দ হচ্ছে, তা বুঝাতে পারব না। এ আনন্দটা ধরে রাখার সুযোগ দিন, সান।

আচ্ছা, আচ্ছা। তোমার আনন্দেই আমার আনন্দ। তোমার শ্বশুরের রুচিবোধ আর আয়োজন দেখে সত্যিই আমি অভিভূত। সবকিছুতেই শিল্পের স্পর্শ।

কবি মানুষ তিনি। জাপানের ফুল, চদ্রালোক, বরফ-সফেদ পাহাড় চূড়া- এসব সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা লেখেন। সবচেয়ে বড় কথা চীনা সংস্কৃতিটা তাদের পরিবারে আত্মস্ত হয়ে আছে।

সর্বত্র তার প্রভাবই তো দেখছি। বললেন মন্ত্রী।

প্রতিটি টেবিলে খাবার পরিবেশন করা আছে, রাজকীয়ভোজ, রাজভোগ, ‘প্রথা পাঁচ’ অনুসরণ করে মেনু বা পদ নির্বাচন করা হয়েছে। খাবার আছে পাঁচ রঙের, কালো, সাদা, লাল, হলুদ এবং সবুজ। রান্না পদ্ধতি পাঁচ রকমের : কাঁচা খাবার, গ্রিল্ড, সেদ্ধ, ভাপানো এবং ভাজি। স্বাদগন্ধও পাঁচরকম : মিষ্টি, ঝাল, লবণাক্ত, টক এবং তেতো।

নোবুনোরি বসেছে তার বন্ধুদের নিয়ে। অভিজাত হেইয়ানকিউর সন্তান এরা। ক্লাসিক্যাল চায়নিজে কথা বলে। ওদের আভিজাত্য-শিষ্ঠাচার এরকমই। তার বন্ধুরা সবাই বিস্মিত পরিবেশিত খাবারের রঙ দেখে এবং খাবারের গন্ধ পেয়ে। খুব লোভ হচ্ছে কিন্তু কেউ খাচ্ছে না। খাবার দাবারের একটা শৃঙ্খলা আছে। সবাই একসঙ্গে শুরু করবে। তার আগে আয়োজক (হোস্ট) একটা সংক্ষিপ্ত ভোজবক্তৃতা দেবেন।

শিন্টুশ্রাইন এবং বৌদ্ধ প্যাগোডা থেকে আমন্ত্রিত পুরোহিত শ্রমন ভান্তেরা টেবিল চেয়ারে বসেননি। তাঁরা তাঁদের প্রথা অনুসরণ করে কিয়দ-দূরে ছাতাছাদ শামিয়ানার নিচে পদ্ম-আসন করে গালিচার ওপর মেঝেতে আয়েশ করে বসেছেন। খাবার দেখে এবং গন্ধ পেয়ে শুধু অবাকই না, বড় লোভাতুর হয়ে পড়েছেন। কিন্তু সংযম অবলম্বন ছাড়া কিছুই করার নেই।

সম্রাটের দরবার থেকে আসা আমলা-অমাত্যদের ভাব প্রতিক্রিয়া বুঝা যাচ্ছে না, বোধহয় অবস্থা বুঝে, ভক্ষণ ও স্বাদ গ্রহণ করে পরস্পরের প্রতি মন্তব্য ছুড়ে দেবেন- যা তারা সবসময়ই করেন।

খাদ্য ও পানপাত্রে যা রাখা হয়েছে, তার সম্পর্কে দুয়েক কথা বলা যেতে পারে। চীনামাটির দৃষ্টিনন্দন প্লেট ও বাটিগুলোয় থরে থরে সাজিয়ে ইকেবানা ধাঁচে রাখা হয়েছে খাবারগুলো। রঙ এবং পরিমাণের মধ্যে, এমনকি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পদের মধ্যেও একটা ভারসাম্য ও সাঞ্জস্যপূর্ণ শিল্পকলার চারুচর্চা আছে।

খাদ্যগুলোর মধ্যে আছে শোশি। কাঁচা মাছের স্লুইচ। সামুদ্রিক মাছ। তবে তা গাঁজিয়ে তোলা ভাতের মধ্যে সংরক্ষিত। অবশ্য এই শোশির একটা আদিরূপ আছে। তাকে বলা হয় ‘সাশিমি’। তা ভাতছাড়া কাঁচামাছ, কাঁচা গো বা শূকরের মাংস (গাইউ সাশি), কাঁচা মুরগি (টোরিঝাশি), এমনকি ঘোড়ার (বাসাশি) কাঁচা মাংস দিয়েও তৈরি এবং পরিবেশিত হয়। আজকের মেনুতেও তা অন্তর্ভুক্ত আছে।

সুকেমোনো পিকলেস প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে খুবই জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী খাবার। বেশ কয়েকটা উপাদান দিয়ে তৈরি বলে তাতে খাদ্যগুণ প্রচুর এবং নানা রঙের ঔজ্জ্বল্যে চিত্তহারী। তাতে নানা সবজি, ডিম্বগাছা এবং রঙিন সব পাঁচ রকমের ফলমূল ব্যবহার করা হয়।

সুকিইয়াকি হচ্ছে গোমাংস শবজি ও তোকু সংযুক্ত খাবার। এই খাবার দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল, প্রিয় সম্রাজ্ঞীর এক অনুরোধে সম্রাট তা নিষিদ্ধ করে দেন। দীর্ঘকাল পর এই খাবারের গন্ধে নিয়মমানা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একজন আমলা এদিক-সেদিক তাকিয়ে টপ করে একটি মাংসের টুকরা মুখে পরে নিল। সম্রাটের দরবারের লোক বলে কেউ দেখেও দেখল না।

এই খাবার পুরোহিত-ভান্তেদের এলাকায় এখনো নিষিদ্ধ। কিন্তু লোভনীয় গন্ধটা মনে হয় তাদেরকে বড় পীড়া দিচ্ছে।

তেমপুরা দেয়া আছে সকলের জন্য। বাটার্ড ময়দা, দুধ ও ডিমের তৈরি রুটি, ভাজিমাছ, পিসুড বা শাকসবজিজাত এই খাবারটা তৈরিতে বরফশীতল এবং উত্তপ্ত তৈলের ব্যবহার মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে। আর আছে মিছো সুপ। এ সুপ বিখ্যাত সবার কাছে।

সবশেষে আছে কাইশি (ডেজার্ট) যাতে আছে চীনা কেক এবং কাটা ফলমূল, বাদাম ও আরো নানা দ্রব্যাদি।

তামেতোকি মদের বদলে নতুন জনপ্রিয় তেতো সবুজ চা দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করতে চেয়েছেন।

তামেতোকি আনুষ্ঠানিকভাবে সামান্য কিছু কথা বলে নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নে আমন্ত্রণ জানালেন।

সুস্বাদু খাবারের স্বাদ গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত সবাই। প্রশংসাই করলেন। তামেতোকি জাপানি রীতিতে সবাইকে বিনম্রভাবে মাথানত করে বিদায় জানালেন।

নতুন জামাই প্রথা মোতাবেক থেকে যাবেন শ্বশুরবাড়িতে। দু’চার দিন থাকবেন। প্রাচ্যে ঘরজামাইয়ের নিয়ম থাকলেও হেইয়ান কিয়োর আভিজাত্যে তা নেই। বর নিজের বাড়িতেই থাকেন, মাঝেমধ্যে স্ত্রীর কাছে শ্বশুরবাড়িতে আসেন।

এদিকে বিকেলে সম্রাটের দরবারে সাহিত্য পাঠের আসর বসেছে। যথারীতি পাঁচ স্ত্রী উপস্থিত আছেন, প্রিন্স মিচিনাগা, তার মা এবং স্ত্রী উপস্থিত হয়েছেন। অন্যান্য প্রিন্স এবং দরবারি লোকজন আগে থেকেই আছেন।

সম্রাটের সভাকবি ফুজিওয়ারা নো কিন্তু অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। প্রস্তুতি চলছে। এ সময় নোবুতাকা নতুন স্ত্রীকে নিয়ে দরবারে উপস্থিত হলেন। পাঁচ স্ত্রী এবং সম্রাট ইচিজো তাদেরকে বিয়ের অভিনন্দন জানালেন। মুরাসাকি এ দরবারের সঙ্গে পরিচিত। তামেতোকির মেয়ে বলে সম্রাটসহ অনেকেই তাকে চেনেন। কবিদের মধ্যে ইমন আছেন। সেই শোনাগন আছেন। ইঝোমি শিকিবু থাকবেন না বলে ইমন এবং সম্রাজ্ঞী শোশি অখুশি। সম্রাজ্ঞী শোশি সেই শোনাগনের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে নিজের দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলেন।

এ সময় ইমনকে অবাক করে দিয়ে ইঝোমি দরবার হলে ঢুকলেন। ইমন উচ্ছ্বসিত। সম্রাজ্ঞী শোশির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বারো.

ইমনের উৎসুক্যও কম নয়। ইঝোমির আসার কথা ছিল না। তবু কেন এল? আগে এলে সম্রাজ্ঞী শোশির সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো, ওয়াকা কবিতা নিয়ে কথা হতো। কোন কোন কবিতা পাঠ করা হবে সম্রাজ্ঞী এবং ইমন তা ঠিক করে দিতেন। সম্রাজ্ঞী শোশির বাবা মিচিনাগা কবিতার সমঝদার। সম্রাটের ওপর এখন একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে আছেন। তাঁর পছন্দেরও ওয়াকা থাকতে পারে। সমন্বয়টা নেই। এজন্য আফসোস হচ্ছে। সম্রাট, সম্রাজ্ঞী এবং মিচিনাগাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কবিতা পাঠ করতে হবে। অন্যের কবিতা নয়, নিয়ম অনুযায়ী নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে শোনাতে হয়।

অন্যান্য প্রিন্সদের মতো প্রিন্স তামেতাকাও উপস্থিত আছেন। হঠাৎ করেই ইমনের তা চোখে পড়ল। ভাবলেন, তাহলে কি প্রিন্সের ইচ্ছেতেই ইঝোমি আসরে এসেছে? এটাই হবে।

ইঝোমির বাবা এখন উৎসব-অনুষ্ঠান বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা। দায়িত্ব হিসাবেই অনুষ্ঠানে আছেন। মেয়েকে দেখে তার ভালো লাগেনি। ভাবলেন, হায়! কিছুদিন আগে হলেও তার কাছে মেয়ের কবিতা পাঠ তার জন্য ছিল গৌরবের, গর্বের। অথচ আজ, এখানে মেয়ের উপস্থিতিটাই তিনি সহ্য করতে পারছেন না। প্রিন্স তামেতাকাকে দেখেও তাঁর রাগ হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই।

সম্রাটের সভাকবি ফুজিওয়ারা নো কিন্তু সম্রাটের অনুমতি নিয়ে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান শুরু করতে গেলেন। সম্রাট বললেন, আজকে হঠাৎই আগাম বৃষ্টি হানা দিয়েছে। কিয়োটো ঝুম বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন। কবিদের কাছে আমি বৃষ্টির কবিতা শুনতে চাই।

আনুগত্যের হাসি হেসে সভাকবি বললেন, হ্যাঁ, আজকে বৃষ্টির ওয়াকা শুনব আমরা। মহামান্য সম্রাট আমাদের মনের কথাই বলে দিয়েছেন।

সমঝদার সম্রাট বললেন, সব কবিতা বৃষ্টিনির্ভর হওয়ার দরকার নেই। তবে বৃষ্টির কবিতা থাকবে।

আসরে ফুজিওয়ারা মিচিনাগাকে কথা বলতেই হয়। বললেন, মহামান্য সম্রাটের শুধু সাহিত্য প্রীতি না কোন সময়ে কোন কবিতা শুনতে হয়, তাও ভালো জানা আছে। এখন বৃষ্টিমধুর বিকেল। বৃষ্টির কবিতাই তো মধুর লাগবে। আমি সম্রাটের রুচির প্রশংসা করি।

সভাকবি এবারে মিচিনাগার প্রতি অনুগত দৃষ্টিতে তাকালেন। তার অর্থ মহাশয় সুযোগ দিন এবার শুরু করি। প্রিন্সদের অনেকে এবং শোশি ছাড়া সকল সম্রাজ্ঞী মিচিনাগার ওপর বিরক্ত।তার ভাতিজি সম্রাজ্ঞী তেইশি অসম্ভব ক্ষিপ্ত। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেন না, তাকে সবাই ভয় করেন।

সভাকবি প্রথমে চিকেজ তাচিবানাকে কবিতা পাঠের জন্য আহ্বান জানালেন। ওয়াকা কবি তাচিবানা কবিতার একটু ভূমিকা দিয়ে বললেন, বৃষ্টি এসে গেছে। তার আগে প্রেমিক প্রেমিকাকে ফেলে চলে যেতে চাচ্ছিল। বৃষ্টি নামায় আর যেতে পারেনি। তখন প্রেমিকা বলছে :

‘যেতে যদি নাই পারো

চিরদিনের জন্য থাকো

এই বরষায় অনেক কথা

গল্পপ্রাচীন জমে থাকা

ভেজা হৃদয় অরণ্য।’

সম্রাট বাহ বাহ বলে হাতে তালি বাজালেন। অন্যরা তাকে অনুসরণ করলেন।

সভাকবি বললেন, চমৎকার ওয়াকা। আমাদের একটা নিয়ম আছে। নতুন আগত কোনো কবি তার কবিতা পাঠ করতে পারে। নোবুতাকা মুরাসাকিকে জিজ্ঞেস না করেই সভাকবিকে বললেন, তাকাকু কবিতা পাঠ করবে।

সম্রাট বললেন, অবশ্যই নববধূর কবিতা শুনবো। আমার মতো নববধূরও সৌভাগ্য আজকে বৃষ্টি হচ্ছে। বলে অর্থবহ হাসি হাসলেন। অন্যরা হাত তালি দিয়ে দিলেন এবং মিটি মিটি হাসলেন।

সভাকবি তামেতোকির মেয়ে হিসেবে তাকাকুকে আগে থেকেই চেনেন। তবে তাকাকু কবিতা লেখে তা তার জানা নেই। সম্রাট উৎসাহী না হলে হয়ত নোবুতাতাকে বিকল মনোরম হতে হত। সভাকবি সুযোগই দিতেন না।

তবে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন তাকাকু। ভাগ্য ভালো তার মুখস্ত শক্তি অসাধারণ। স্বামীকে বিব্রত অবস্থায় না ফেলে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি কবিতার খাতা আনিনি। আমার জানা ছিল না এরকম একটি মহান আসরে কবিতা পড়তে হবে। মহামান্য সম্রাটের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে উৎসাহিত করেছেন। এ উৎসাহকে আমি আশীর্বাদ বলে মাথা পেতে নিয়েছি।

এত গুছিয়ে কথা বলার জন্য সবাই অবাক হলেন। সম্রাট বাহবা দিয়ে দিলেন। এখানে এখনো কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু হয়ে দাঁড়ায়নি, তাই নবাগত বলে সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তাকে স্বাগত জানালেন।

মুরাসাকি কবিতা নিয়ে কোনো কথা না বলে সরাসরি কবিতা পাঠে চলে গেলেন :

‘বজ্রপাতের বানচিরিক

মেঘের গর্জন সাথে

ঝুম বৃষ্টি আসবে বলে

চাচ্ছো চলে যেতে

অবশেষে থামলে তুমি

বৃষ্টি এলো নেমে।’

সম্রাট এবারে দু’হাত ওপরে তুলে বাহ বাহ বলে তালি বাজালেন। ইমন ছাড়া সবাই অবাক। কারণ তাকে তিনি আগে থেকেই চেনেন। ইঝোমিও জানেন মুরাসাকির কবিতা লেখার হাত আছে।

আকাঝুমি ইমনের কবিতা পাঠ নির্ভর করছে ইঝোমির কবিতা পাঠের ওপর। ইঝোমি কোনো পাগলামো না করলে তিনি কবিতা পাঠ নাও করতে পারেন।

সভাকবি ইঝোমি শিকিবুর নাম ঘোষণা করলেন। ইঝোমির সময়টা ভালো যাচ্ছে না। স্বামী নাখোশ, বাবা ক্ষিপ্ত, প্রেমিক তামেতাকার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। বিরহে মন ভীষণ খারাপ। এখানে আসলে তিনি সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের কবিতা শুনাতে আসেননি, অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রেমিক প্রিন্স তামেতাকাকে কঠিন কবিতা শোনাতে এসেছেন। সম্রাটের কথায় এখানে বসেই তাকে বৃষ্টির কবিতা লিখতে হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে। বললেন, আমি দুটি ওয়াকা পাঠ করব। একটি বৃষ্টির অন্যটি বিরহের। বৃষ্টির কবিতাটি এখানে বসে লেখা।

সম্রাট বললেন, তাই হোক। বৃষ্টির সঙ্গে বিরহের সম্পর্ক রয়েছে।

প্রথম কবিতা :

‘সম্ভবত: ভাবছো তুমি

গ্রীষ্মের আগাম বৃষ্টি

বৃষ্টি নয় তা

তোমার জন্য অশ্রু আমার

যা তোমারই সৃষ্টি।’

সম্রাট বললেন, অদ্ভুত অসাধারণ। দ্বিতীয়টি শুনি।

ইঝোমি পাঠ করলেন :

‘তারা বলে মৃত আজ রাতে

ফিরে আসবে, ফিরে আসবেই

অথচ তুমি আমার পাশে নেই

তা হলে আমার বাসস্থান

সত্যিই কী অশরীরীর বাড়ি!’

সম্রাট কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এই ওয়াকার মর্ম বুঝতে চাইলেন। বুঝলেন কিনা স্পষ্ট বুঝা গেল না, পরে তালি বাজিয়ে দিলেন এবং বাহবার ভঙ্গিতে সম্রাজ্ঞী শোশির দিকে তাকালেন।

সম্রাট বুঝুন বা না বুঝুন একজন ভালো বুঝেছেন। তিনি প্রিন্স তামেতাকা। প্রিয়া ইঝোমির জন্য খুব মায়া হলো তার। মনে হলো অযথাই তিনি তার মনে কষ্ট দিয়েছেন। বড় কষ্ট হচ্ছে তার। মুশকিল হলো তিনি কবিতা লিখতে পারেন না, না হয় একটি সুন্দর কবিতা লিখে ক্ষমা চেয়ে নিতেন। তার উপলব্ধি হলো, প্রতিভাবানেরা একটু জেদিই হয়। এতগুণী তার হৃদয় রাণী, ভাবতেই বুক বুঝি ভরে যায়। কবি ইঝোমির প্রেমিক হয়ে কৃতার্থ বোধ করলেন তিনি।

আরেকজনের বুকও গর্বে ভরে উঠেছে। তিনি বালিকা সম্রাজ্ঞী শোশি। ইঝোমি আসবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আজকে বুঝতে পারলেন সত্যিই এক প্রতিভাময়ী কবি তার লেডি ইন ওয়েটিং। তারপরও তার মনে প্রশ্ন সম্রাজ্ঞী তেইশি ঈর্ষার আগুনে পুড়ছে তো?

আসলেই সবার প্রশংসা এবং সম্রাটের মন্তব্যে সম্রাজ্ঞী তেইশি অন্তরে দারুণ চোট পেয়েছেন। তিনি সেই শোনাগনের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, যেন সেই শোনাগন সাহিত্যের একটি আছারে সম্রাজ্ঞী শোশির সকল দর্পচূর্ণ কবে দিতে পারেন।

সেই শোনাগণের আসলে ভালো প্রস্তুতি নেই। তিনি ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়েছেন। নিজের নাম এ দরবারে এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে, অন্য কেউ তাকে টেক্কা দিতে পারে ভাবতেই পারেননি। কবিতার খাতা নয়, নিবন্ধ প্রবন্ধ আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় লেখা সম্রাজ্ঞী তেইশির প্রশংসায় ভরা ডায়েরি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। বর্ষা বা বৃষ্টির কোনো কবিতা বা নিবন্ধ নেই তাতে। বড় চিন্তিত তিনি।

সভাকবি কিছু বলতে যাবেন তখনই সম্রাট বললেন, আজ আর নয়। তোমাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে জরুরি কাজে যেতে চাই। আমি ভাবছি তোমাদের সকলের কবিতা নিয়ে আমি একটি সংকলন করব। ক্রমশ...

back to top