alt

সাময়িকী

স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ-এর স্থপতি বঙ্গবন্ধু

একাত্তরের মার্চ এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সূচনা

রফিকুল ইসলাম

: বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

রফিকুল ইসলাম / জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৩৪; মৃত্যু : ৩০ নভেম্বর ২০২১

[ভাষা সংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও সাবেক জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত রফিকুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রথিতযশা লেখক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। সারা জীবন কখনো রাজপথে আবার কখনো বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর রয়েছে অগণ্য ভক্ত-শুভাকাক্সক্ষী ও পাঠক। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এযাবত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিরিশটি। বীরের এই রক্ত¯্রােত মাতার এ অশ্রুধারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার, কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সাহিত্য, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে কয়েকটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক তিনি। ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও নজরুল গবেষণা শুরু করেন। একসময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্?যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বন্দিশিবিরে নির্যাতিত হন। এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ বৃহস্পতিবারের নিয়মিত ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশিত হলো তাঁর ‘স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ-এর স্থপতি বঙ্গবন্ধু; একাত্তরের মার্চ এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সূচনা’ শিরোনামের তাৎপর্যপূর্ণ নিম্মোক্ত প্রবন্ধটি। -ওবায়েদ আকাশ]

১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সর্বত্র জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফা’ গণভোট ইস্যুর ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ পটভূমিকায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের দু’টি আসন ছাড়া পূর্বপাকিস্তানের সমস্ত আসনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাধিক্য ভোটে জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ মোট ২৯৮টি আসন দখল করে। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি ঘোষণায় জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্যে ৩রা মার্চ বুধবার ন’টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের জনসাধারণের সুস্পষ্ট রায়কে পদদলিত করার জন্যে, বাংলার মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যে, পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রের পরিণামে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে ৩রা মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার সমস্ত মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং তারা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ঢাকা সঙ্গে সঙ্গে একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল নগরীতে পরিণত হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, দোকানপাট, যানবাহন সব বন্ধ হয়ে যায়। সংগ্রামী জনতার কাফেলা চারিদিক থেকে পল্টন ময়দানের দিকে আসতে থাকে। চারদিকে কেবল জঙ্গিমিছিল, শেষ পর্যন্ত হোটেল পূর্বাণীর সামনে এক বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয়। ঐ হোটেলে তখন আওয়ামী লীগ পরিষদ দলের সভা চলছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনতাকে ধৈর্যহারা না হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে আহ্বান জানান। কিন্তু জনতা অবিলম্বে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ দিন বিকেলে হোটেল পূর্বাণীতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি মঙ্গলবার সারা ঢাকা শহরে হরতাল, বুধবার সারাদেশে হরতাল এবং ৭ মার্চ রবিবার রেসকোর্সে জনসভা অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন।

২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্রসভাতে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। এই সভাতেই সর্বপ্রথম সবুজ পটভূমিকার উপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনার বাংলার সোনালি মানচিত্র সংবলিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন করা হয়। ২রা মার্চ রাতে ঢাকা শহরে হঠাৎ বেতার মারফত কারফিউ ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ মার্চ অপরাহ্ণে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঐ ঐতিহাসিক সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কর্তৃক ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ঐ ঘোষণাপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ঘোষণা করা হয়

ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকরা কারফিউর বিরুদ্ধে প্রচ- স্লোগান তুলে কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। তাদের স্লোগান ছিল, ‘সান্ধ্য আইন মানি না’, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। সমস্ত শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। রাতে সামরিক বাহিনীর গুলিতে বহু কারফিউ ভঙ্গকারী হতাহত হয়েছিল। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানেও সান্ধ্য আইন জারি করা হয়, তবে চট্টগ্রামে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ৩ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতালের দিনে চট্টগ্রামেও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সেখানে অবাঙালিদের লেলিয়ে দেওয়া হয় বাঙালিদের বিরুদ্ধে। ফলে হামলা সংঘর্ষ, অগ্নিকা- ও গুলিবর্ষণে চট্টগ্রামে ঐ একদিনেই প্রায় চারশত হতাহত হয়। ৩ মার্চ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি গ্রুপের ১২ জন নেতাকে ১০ মার্চ ঢাকায় এক বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান, যাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিম্নোক্ত বিবৃতির মাধ্যমে এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন-

“ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে যখন নিরস্ত্র জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হচ্ছে, শহিদের তাজা খুন যখন রাজপথে শুকিয়ে যায়নি, কতিপয় নিহত ব্যক্তির লাশ এখনও দাফন করা হয়নি, শত শত আহত ব্যক্তি যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করছে, ঠিক সেই সময় ঢাকায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের এক সম্মেলনে বসার জন্য বেতার ঘোষণা মারফতে আমন্ত্রণের প্রস্তাব একটি নির্দয় তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ মার্চ অপরাহ্ণে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঐ ঐতিহাসিক সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কর্তৃক ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ঐ ঘোষণাপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ঘোষণা করা হয়।

৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছে জনসমুদ্র, লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে একই আওয়াজ- স্বাধীনতার বজ্র শপথ। বাতাসে উড়ছে অসংখ্য পতাকা, সোনার বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের পতাকা, স্লোগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে বাঙালির সংগ্রামের প্রতীক বাঁশের লাঠি, অসংখ্য লাঠি। মঞ্চে মাইক থেকে স্লোগান দিচ্ছেন সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগের নেতারা। এই স্লোগানে স্লোগানে উদ্দীপ্ত হচ্ছে জনসমুদ্র- ‘জয় বাংলা’, ‘আপোস না সংগ্রাম- সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘পরিষদ না রাজপথ- রাজপথ রাজপথ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়- বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন এবং ভাষণ শুরু করেন। আমরা তাঁর ঐ ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত করছি-

“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।... কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি, বাংলাদেশের ইতিহাস করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস- মুমুর্ষূ মানুষের করুণ আর্তনাদ- এ দেশের করুণ ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত করার ইতিহাস।... আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।... আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। দেশের অধিকার চাই।... এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।... আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।... আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।... এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে, বাঙালিরা বুঝেশুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।”

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ অপরাহ্ণে রমনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐ ভষণ শুধু ঐতিহাসিক নয়, যুগান্তকারীও বটে। এই ভাষণের মাধ্যমে হাজার বছর বহিরাগত দ্বারা শাসিত, শোষিত ও পদানত একটি হতভাগ্য জাতির জাগরণ ও মুক্ত হবার জন্য সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান জানান। বস্তুতপক্ষে ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্বাধীন জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনা। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণগুলির অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনটি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষণ বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতার পবিত্র সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মাতৃভূমির শৃংখল মোচনে প্রাণ দিয়েছে অগণিত মুক্তিসংগ্রামী। ১৯শে মার্চ ’৭১ জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র বিদ্রোহ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা বলা চলে।

২০শে মার্চ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতাদের যখন আলোচনার প্রহসন চলছিল তখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর, জেনারেল মিঠঠা খান প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতিকে পূর্ণাঙ্গরূপ দিচ্ছিলেন। ২১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মিলিত হওয়ার জন্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো, ১২ জন উপদেষ্টা নিয়ে কঠোর সামরিক প্রহরায় ঢাকা আগমন করেন। ২২ মার্চ ঢাকার সমস্ত সংবাদপত্রের ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নির্ধারিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রঙিন প্রতিকৃতি প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় এবং ২৩ মার্চ তথাকথিত পাকিস্তান দিবসে বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে ঐ পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানানো হয়। ২৩ মার্চ বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিটি গৃহে, প্রতিটি যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়।

২৪ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের সঙ্গে দু’ঘণ্টা স্থায়ী এক সভায় মিলিত হন। আওয়ামী লীগ নেতারা যখন সংকট নিরসনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, ঢাকার মিরপুরে পাক বাহিনীর ইঙ্গিতে অবাঙালিরা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় বাঙালি নিধন অভিযান শুরু করে দিয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন, লুটতরাজ, ধর্ষণ, বস্তুতপক্ষে অবাঙালিরা ২৪ মার্চ থেকেই আরম্ভ করে দেয়, ফলে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বাঙালির জানমাল বিনষ্ট হয়। ২৪ মার্চ যশোরে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের হেড কোয়াটার্সে রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান গেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, উত্তোলন এবং অভিবাদন জানান। যশোর-নদীয়া সীমান্ত মহড়ারত ‘ফার্স্ট ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট’ সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।

ঢাকায় শেখ মুজিবের বাসভবনে সেদিনও বিক্ষুব্ধ জঙ্গী মিছিলের স্রোত। তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার মাথা কেনার শক্তি কারো নেই। বাংলার মানুষের সাথে, শহিদের রক্তের সাথে আমি বেঈমানি করতে পারব না। আমি কঠোরতর সংগ্রামের নির্দেশ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি-না জানি না। দাবি আদায়ের জন্যে আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।’

২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার সঙ্গে ভুট্টোর বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান যে, ‘পরিস্থিতি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।’ সাংবাদিকরা ছুটে এলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে এবং ভুট্টোর বক্তব্যের কথা জানালেন। শুনে বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। শেখ সাহেবের বাসভবনে তখন দেশি ও বিদেশি অসংখ্য সাংবাদিক। একজন খবর নিয়ে এলেন, ইয়াহিয়া খান সাদা পোশাকে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করে বিমানবন্দর বা ক্যান্টনমেন্টের দিকে গিয়েছেন। এই সময় একটা বোয়িং বিমান ঢাকা ছেড়ে করাচির উদ্দেশে চলে গেল, ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে গেলেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান একাত্তর সালের ষোলই মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত বাঙালি নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ধাপ্পা দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ২৫ মার্চ দিন শেষে বিশ্বের নৃশংসতম গণহত্যা অভিযান শুরু করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও তার অনুসারী হন। পঁচিশে মার্চ মধ্য রাত্রিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং পরে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের পূর্বে পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআর ওয়ারলেস যোগে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী প্রেরণ করেন এবং তা চট্টগ্রাম বেতার থেকে ২৬ মার্চ প্রচার করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত শেষে-

“ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই দিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।”

[গণপ্রজান্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠ ফতসিল]

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সশন্ত্রবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বা বাঙালি ‘এথনিক ক্লিনসিং’ শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর থেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চারিদিক থেকে ঘেরাও করে প্রচণ্ড গোলাগুলি, বোমা বর্ষণ, হল ও শিক্ষক কর্মচারীদের বাড়ি বাড়ি এবং ইকবাল ও জগন্নাথ হলের ঘরে ঘরে ঢুকে যে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে, তাতে ১০ জন শিক্ষক, বহু ছাত্র, পরিবার পরিজনসহ বহু কর্মচারী নিহত হন। এছাড়া ২৩ নং নীলক্ষেত শিক্ষক আবাসনের ছাদে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় ৪৪ জনকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান বাহিনী নীলক্ষেতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে ঢুকে কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী এবং আবদুল মজিদকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসনে আরও নিহত হয়েছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর ফজলুর রহমান ও তার দু’জন আত্মীয়।

২৫ মার্চ রাতে ফুলার রোড আবাসিক এলাকায় ঢুকে পাকিস্তানী সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে প্রথমে বেয়নেট চার্জ এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি নরপশুরা ভূ-তত্ত্বের অধ্যাপক মুক্তাদিরকে তার স্ত্রী ও সন্তানের সামনে গুলি করে হত্যার পর লাশ টেনে নিয়ে যায়। ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়- কলাভবন সংলগ্ন শিখ গুরুদুয়ারা, শহিদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত শিবমন্দির, রমনা রেসকোর্স মাঠের দুটো পুরনো কালী মন্দির। স্মরণীয় যে, ২৬ মার্চ সকালে পাক সেনারা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোডের মসজিদে ফজরের নামাজের আজান দানরত মুয়াজ্জিনকে এবং গুরুদুয়ারা, শিব মন্দির ও কালীমন্দিরে ঢুকে পুরোহিতদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ‘অপরারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানে সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে। জগন্নাথ হলের অধ্যাপক ড. রতনলাল চক্রবর্তী সম্পাদিত “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল” গ্রন্থে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’ জগন্নাথ হলে কী ঘটেছিল, তার বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত অংশ-

“১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশেষভাবে জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় রাত বারোটার সময় ইউওটিসির দিকের দেয়াল ভেঙে পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে জগন্নাথ হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। এরপর জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে শুরু হয় নারকীয় কা-। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে। এমনকি টয়লেটে, বাথরুমে ও ছাদে রক্ষিত জলের ট্যাংকের মধ্যে যেখানেই পাওয়া যায় লোকের সন্ধান, সেখানে চলে নির্বিচারে গুলি ও হত্যা। পশ্চিম ভবন, ক্যান্টিন ও ক্যান্টিন সংলগ্ন ছাত্রাবাসে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতা পালিয়েছিল, কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশে বেরিয়ে আসতেই তাদের ওপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ক্রমশ আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের বাসভবন। পাকবাহিনী মেরে ফেলে গোবিন্দ দেবকে এবং পালিত কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার যেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান পুত্র ও আত্মীয়সহ নিহত হন। মারাত্মকভাবে আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা, পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাক মিলিটারি মধুসূধন দেব (মধুদা)-এর বাসা আক্রমণ করে হত্যা করে তার পুত্র, সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, স্ত্রী যোগমায়া যিনি ছিলেন দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুলিতে মধুদাও মারাত্মকভাবে আহত হন। জঘন্যতম পদ্ধতি গ্রহণ করে পাকবাহিনী পরবর্তী ঘটনার অবতরণ করে। পলায়িত ও আতঙ্কগ্রস্ত ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে আসে এবং তাদের এই সব লাশ জগন্নাথ হলের মাঠে জড় করার কাজে লাগায়। পাকবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে এদের মধ্যে দু’একজন লাশ টানার কাজে যোগদান করেনি। কিন্তু অনেকেই রাইফেল ও বেয়নেটের নির্দেশে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্ররা নিহত সহপাঠীদের লাশ, কর্মচারীরা গোবিন্দ দেব, মুনিরুজ্জামান ও মধুদার লাশ টেনে হলের অভ্যন্তরে জড়ো করে। এই কাজ সম্পন্ন হয় মিলিটারি পাহারায়। পরে যারা লাশ টানে তারা এবং বিভিন স্থান হতে ধরে আনা লোকজনকে সারিবদ্ধ হবার নির্দেশ দেয় পাকবাহিনী। এদের মধ্যে শিব বাড়ির কয়েকজন সাধু ছিলেন। মুখে ছিল তাদের দাঁড়ি, পরনে গেরুয়া অন্য একজন ছিল টুপি পরিহিত মুসলমান। কিন্তু মানবতা ও ধর্ম কোনো জ্ঞানই ছিল না পাকবাহিনীর। লাইনে দাঁড়ানো ও সমবেত জনগণের ওপর তারা চালালো মেশিনগান। এক নতুন লোমহর্ষক, হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক দৃশ্যের সূচনা হলো। দূরে বস্তিতে পালিয়েছিল মহিলাগণ, যারা স্বজন হারানোর বেদনায় আর্তনাদ করে উঠল। জগন্নাথ হলের বাতাস একটু জল ও পানির আহাজারিতে ভরে গেল। মরণ যন্ত্রণা ও প্রাণ বাঁচানোর এক করুণ দৃশ্য দেখা গেল। কিছু সময়ের জন্য পাকবাহিনী জগন্নাথ হল ও তৎসংলগ্ন এলাকা ত্যাগ করে। বস্তি হতে ছুটে আসেন মহিলাগণ। বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকেন তাঁদের অনেকেই। যারা অপেক্ষাকৃত কম আহত ছিলেন, তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কেউ কেউ নিজের চেষ্টাতেই পালিয়ে যান জগন্নাথ হলের মাঠ থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে পাকবাহিনীর বুলডোজার নিয়ে। একটা ছোট গর্ত করে ময়লা আবর্জনার মতো মাটি চাপা দেবার কাজটাও এতো অবহেলার সঙ্গে সম্পাদন হয়েছে যে বহু সংখ্যক নিহত ব্যক্তির হাত-পা ও মাথা এবং দেহের অংশ মাটির উপর ছিল। গণকবর থেকে জেগে ওঠা মুষ্টিবদ্ধ হাত যেনো স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রতীক।... যা হোক সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কেবলমাত্র ৩৪ জন ছাত্র জগন্নাথ হলেই শহিদ হয়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে স্বপন চৌধুরী যুদ্ধক্ষেত্রে শহিদ হয় এবং গণপতি হালদার তার জন্মভূমি মঠবাড়িয়ায় পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে। উল্লেখ্য যে, গণপতি হালদার ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর হাত থেকে বেঁচে যায়।... শিক্ষকদের মধ্যে প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. জোতির্ময় গুহ-ঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহিদ হন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিৎবল্লী ও জনৈক রাজকুমারী দেবী তথ্য প্রকাশ করেন যে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের কাছে সাজনা গাছের নিচে খুব স্বল্প পরিসর গর্তে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালের চিকিৎসকগণ চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন।

২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্রসভাতে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। এই সভাতেই সর্বপ্রথম সবুজ পটভূমিকার ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনার বাংলার সোনালি মানচিত্র সংবলিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন করা হয়

জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তিনজন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪ জন ২৬ মার্চেই শহিদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা অজানা অনেক লোক। এদের খুব কম অংশই আমরা জানি। সকলের পরিচিত মধুদা (মধুসুদন দত্ত) জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন। মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান তার কয়েকজন নিকট-আত্মীয়সহ। দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে ও তার পুত্র মতিলাল দে পিতা-পুত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। আরও মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সুনীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, দাসুরাম, ভীর রায়, মনিরাম, জহরলাল রাজভর, মরণ ভরণ রায়, শংকর কুরী প্রমুখ।... কবি আবুল কাশেম, এছাড়াও বহু সংখ্যক অতিথিও এই রাতে পাক বাহিনীর শিকার হয়েছিলেন। ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পাল, জগন্নাথ কলেজের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর প্রমুখ ছাত্র ও অতিথিদের নাম জানা যায়। যারা ২৬ মার্চ জগন্নাথ হলের গণহত্যার নির্মম শিকার হয়েছিলেন।... জগন্নাথ হলের কিছু সংখ্যক ছাত্র তখন রমনার কালী মন্দিরে থাকত, ২৬ মার্চ কালী বাড়িও পাক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। সেখানেও নিহত হয় পাক বাহিনীর হাতে ৫-৬ জন জগন্নাথ হলের ছাত্র। তাদের মধ্যে অর্থনীতির ছাত্র রমণী মোহন ভট্টাচার্য ছিল।... উল্লেখ্য যে, শিববাড়ির ৫ জন সাধুকে ধরে এনে জগন্নাথ হলের মাঠে হত্যা করা হয়েছে। ২৬ মার্চ রাত ১২টার পর হতে ২৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় শতাব্দীর যে নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়েছিল, তা ছিল বিক্ষিপ্ত...।”

তাছাড়া ঢাকা হল সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাসে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ চালায়, যার ফলে নিহত হন হলের সহকারী হাউস টিউটর গণিত বিভাগের শিক্ষক শরাফত আলী এবং পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক এ আর খান খাদিম। পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ রাত্রে বাংলা একাডেমিতে গোলা বর্ষণ করে। এছাড়াও শহিদ মিনার ছিল পাকিস্তান বাহিনীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু। মার্চ মাসের মধ্যে তারা শহিদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়। পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র অভিযান শুরু ও শেষ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যার মাধমে। ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগে তারা তাদের দালাল, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সশস্ত্র ঘাতক বাহিনীর দ্বারা যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে রায়ের বাজার বধ্যভূমি বা মিরপুর গোরস্তানে নির্যাতনের পর হত্যা করেছিল তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যেমন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমদ, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. মর্তুজা, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহী এবং ড. সিরাজুল হক খান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার ফজলে রাব্বী ও ডাক্তার আলীম চৌধুরী। এছাড়াও সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সেরাজউদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার এবং সেলিনা পারভিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির কয়েকজন বিজ্ঞানী।

মোট কথা, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে তাদের গণহত্যাযজ্ঞ শুরু ও শেষ করেছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধনের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে থাকা অবস্থায় সামরিক আদালতে গোপন বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল, কিন্তু ’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজয়ের কারণে তা তখন কার্যকর করতে পারেনি। তবে পরাজিত পাকিস্তান তা কার্যকর করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাদের কতিপয় বাংলাদেশী নামধারী ঘাতকদের দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ-এর স্থপতি বঙ্গবন্ধু

একাত্তরের মার্চ এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সূচনা

রফিকুল ইসলাম

রফিকুল ইসলাম / জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৩৪; মৃত্যু : ৩০ নভেম্বর ২০২১

বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

[ভাষা সংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও সাবেক জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত রফিকুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রথিতযশা লেখক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। সারা জীবন কখনো রাজপথে আবার কখনো বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর রয়েছে অগণ্য ভক্ত-শুভাকাক্সক্ষী ও পাঠক। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এযাবত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিরিশটি। বীরের এই রক্ত¯্রােত মাতার এ অশ্রুধারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার, কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সাহিত্য, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে কয়েকটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক তিনি। ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও নজরুল গবেষণা শুরু করেন। একসময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্?যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বন্দিশিবিরে নির্যাতিত হন। এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ বৃহস্পতিবারের নিয়মিত ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশিত হলো তাঁর ‘স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ-এর স্থপতি বঙ্গবন্ধু; একাত্তরের মার্চ এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সূচনা’ শিরোনামের তাৎপর্যপূর্ণ নিম্মোক্ত প্রবন্ধটি। -ওবায়েদ আকাশ]

১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সর্বত্র জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফা’ গণভোট ইস্যুর ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ পটভূমিকায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের দু’টি আসন ছাড়া পূর্বপাকিস্তানের সমস্ত আসনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাধিক্য ভোটে জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ মোট ২৯৮টি আসন দখল করে। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি ঘোষণায় জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্যে ৩রা মার্চ বুধবার ন’টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের জনসাধারণের সুস্পষ্ট রায়কে পদদলিত করার জন্যে, বাংলার মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যে, পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রের পরিণামে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে ৩রা মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার সমস্ত মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং তারা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ঢাকা সঙ্গে সঙ্গে একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল নগরীতে পরিণত হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, দোকানপাট, যানবাহন সব বন্ধ হয়ে যায়। সংগ্রামী জনতার কাফেলা চারিদিক থেকে পল্টন ময়দানের দিকে আসতে থাকে। চারদিকে কেবল জঙ্গিমিছিল, শেষ পর্যন্ত হোটেল পূর্বাণীর সামনে এক বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয়। ঐ হোটেলে তখন আওয়ামী লীগ পরিষদ দলের সভা চলছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনতাকে ধৈর্যহারা না হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে আহ্বান জানান। কিন্তু জনতা অবিলম্বে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ দিন বিকেলে হোটেল পূর্বাণীতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি মঙ্গলবার সারা ঢাকা শহরে হরতাল, বুধবার সারাদেশে হরতাল এবং ৭ মার্চ রবিবার রেসকোর্সে জনসভা অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন।

২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্রসভাতে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। এই সভাতেই সর্বপ্রথম সবুজ পটভূমিকার উপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনার বাংলার সোনালি মানচিত্র সংবলিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন করা হয়। ২রা মার্চ রাতে ঢাকা শহরে হঠাৎ বেতার মারফত কারফিউ ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ মার্চ অপরাহ্ণে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঐ ঐতিহাসিক সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কর্তৃক ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ঐ ঘোষণাপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ঘোষণা করা হয়

ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকরা কারফিউর বিরুদ্ধে প্রচ- স্লোগান তুলে কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। তাদের স্লোগান ছিল, ‘সান্ধ্য আইন মানি না’, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। সমস্ত শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। রাতে সামরিক বাহিনীর গুলিতে বহু কারফিউ ভঙ্গকারী হতাহত হয়েছিল। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানেও সান্ধ্য আইন জারি করা হয়, তবে চট্টগ্রামে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ৩ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতালের দিনে চট্টগ্রামেও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সেখানে অবাঙালিদের লেলিয়ে দেওয়া হয় বাঙালিদের বিরুদ্ধে। ফলে হামলা সংঘর্ষ, অগ্নিকা- ও গুলিবর্ষণে চট্টগ্রামে ঐ একদিনেই প্রায় চারশত হতাহত হয়। ৩ মার্চ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি গ্রুপের ১২ জন নেতাকে ১০ মার্চ ঢাকায় এক বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান, যাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিম্নোক্ত বিবৃতির মাধ্যমে এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন-

“ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে যখন নিরস্ত্র জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হচ্ছে, শহিদের তাজা খুন যখন রাজপথে শুকিয়ে যায়নি, কতিপয় নিহত ব্যক্তির লাশ এখনও দাফন করা হয়নি, শত শত আহত ব্যক্তি যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করছে, ঠিক সেই সময় ঢাকায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের এক সম্মেলনে বসার জন্য বেতার ঘোষণা মারফতে আমন্ত্রণের প্রস্তাব একটি নির্দয় তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ মার্চ অপরাহ্ণে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঐ ঐতিহাসিক সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কর্তৃক ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ঐ ঘোষণাপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ঘোষণা করা হয়।

৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছে জনসমুদ্র, লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে একই আওয়াজ- স্বাধীনতার বজ্র শপথ। বাতাসে উড়ছে অসংখ্য পতাকা, সোনার বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের পতাকা, স্লোগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে বাঙালির সংগ্রামের প্রতীক বাঁশের লাঠি, অসংখ্য লাঠি। মঞ্চে মাইক থেকে স্লোগান দিচ্ছেন সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগের নেতারা। এই স্লোগানে স্লোগানে উদ্দীপ্ত হচ্ছে জনসমুদ্র- ‘জয় বাংলা’, ‘আপোস না সংগ্রাম- সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘পরিষদ না রাজপথ- রাজপথ রাজপথ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়- বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন এবং ভাষণ শুরু করেন। আমরা তাঁর ঐ ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত করছি-

“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।... কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি, বাংলাদেশের ইতিহাস করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস- মুমুর্ষূ মানুষের করুণ আর্তনাদ- এ দেশের করুণ ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত করার ইতিহাস।... আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।... আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। দেশের অধিকার চাই।... এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।... আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।... আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।... এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে, বাঙালিরা বুঝেশুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।”

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ অপরাহ্ণে রমনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐ ভষণ শুধু ঐতিহাসিক নয়, যুগান্তকারীও বটে। এই ভাষণের মাধ্যমে হাজার বছর বহিরাগত দ্বারা শাসিত, শোষিত ও পদানত একটি হতভাগ্য জাতির জাগরণ ও মুক্ত হবার জন্য সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান জানান। বস্তুতপক্ষে ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্বাধীন জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনা। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণগুলির অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনটি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষণ বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতার পবিত্র সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মাতৃভূমির শৃংখল মোচনে প্রাণ দিয়েছে অগণিত মুক্তিসংগ্রামী। ১৯শে মার্চ ’৭১ জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র বিদ্রোহ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা বলা চলে।

২০শে মার্চ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতাদের যখন আলোচনার প্রহসন চলছিল তখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর, জেনারেল মিঠঠা খান প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতিকে পূর্ণাঙ্গরূপ দিচ্ছিলেন। ২১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মিলিত হওয়ার জন্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো, ১২ জন উপদেষ্টা নিয়ে কঠোর সামরিক প্রহরায় ঢাকা আগমন করেন। ২২ মার্চ ঢাকার সমস্ত সংবাদপত্রের ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নির্ধারিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রঙিন প্রতিকৃতি প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় এবং ২৩ মার্চ তথাকথিত পাকিস্তান দিবসে বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে ঐ পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানানো হয়। ২৩ মার্চ বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিটি গৃহে, প্রতিটি যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়।

২৪ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের সঙ্গে দু’ঘণ্টা স্থায়ী এক সভায় মিলিত হন। আওয়ামী লীগ নেতারা যখন সংকট নিরসনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, ঢাকার মিরপুরে পাক বাহিনীর ইঙ্গিতে অবাঙালিরা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় বাঙালি নিধন অভিযান শুরু করে দিয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন, লুটতরাজ, ধর্ষণ, বস্তুতপক্ষে অবাঙালিরা ২৪ মার্চ থেকেই আরম্ভ করে দেয়, ফলে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বাঙালির জানমাল বিনষ্ট হয়। ২৪ মার্চ যশোরে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের হেড কোয়াটার্সে রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান গেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, উত্তোলন এবং অভিবাদন জানান। যশোর-নদীয়া সীমান্ত মহড়ারত ‘ফার্স্ট ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট’ সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।

ঢাকায় শেখ মুজিবের বাসভবনে সেদিনও বিক্ষুব্ধ জঙ্গী মিছিলের স্রোত। তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার মাথা কেনার শক্তি কারো নেই। বাংলার মানুষের সাথে, শহিদের রক্তের সাথে আমি বেঈমানি করতে পারব না। আমি কঠোরতর সংগ্রামের নির্দেশ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি-না জানি না। দাবি আদায়ের জন্যে আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।’

২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার সঙ্গে ভুট্টোর বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান যে, ‘পরিস্থিতি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।’ সাংবাদিকরা ছুটে এলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে এবং ভুট্টোর বক্তব্যের কথা জানালেন। শুনে বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। শেখ সাহেবের বাসভবনে তখন দেশি ও বিদেশি অসংখ্য সাংবাদিক। একজন খবর নিয়ে এলেন, ইয়াহিয়া খান সাদা পোশাকে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করে বিমানবন্দর বা ক্যান্টনমেন্টের দিকে গিয়েছেন। এই সময় একটা বোয়িং বিমান ঢাকা ছেড়ে করাচির উদ্দেশে চলে গেল, ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে গেলেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান একাত্তর সালের ষোলই মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত বাঙালি নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ধাপ্পা দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ২৫ মার্চ দিন শেষে বিশ্বের নৃশংসতম গণহত্যা অভিযান শুরু করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও তার অনুসারী হন। পঁচিশে মার্চ মধ্য রাত্রিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং পরে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের পূর্বে পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআর ওয়ারলেস যোগে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী প্রেরণ করেন এবং তা চট্টগ্রাম বেতার থেকে ২৬ মার্চ প্রচার করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত শেষে-

“ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই দিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।”

[গণপ্রজান্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠ ফতসিল]

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সশন্ত্রবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বা বাঙালি ‘এথনিক ক্লিনসিং’ শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর থেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চারিদিক থেকে ঘেরাও করে প্রচণ্ড গোলাগুলি, বোমা বর্ষণ, হল ও শিক্ষক কর্মচারীদের বাড়ি বাড়ি এবং ইকবাল ও জগন্নাথ হলের ঘরে ঘরে ঢুকে যে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে, তাতে ১০ জন শিক্ষক, বহু ছাত্র, পরিবার পরিজনসহ বহু কর্মচারী নিহত হন। এছাড়া ২৩ নং নীলক্ষেত শিক্ষক আবাসনের ছাদে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় ৪৪ জনকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান বাহিনী নীলক্ষেতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে ঢুকে কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী এবং আবদুল মজিদকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসনে আরও নিহত হয়েছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর ফজলুর রহমান ও তার দু’জন আত্মীয়।

২৫ মার্চ রাতে ফুলার রোড আবাসিক এলাকায় ঢুকে পাকিস্তানী সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে প্রথমে বেয়নেট চার্জ এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি নরপশুরা ভূ-তত্ত্বের অধ্যাপক মুক্তাদিরকে তার স্ত্রী ও সন্তানের সামনে গুলি করে হত্যার পর লাশ টেনে নিয়ে যায়। ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়- কলাভবন সংলগ্ন শিখ গুরুদুয়ারা, শহিদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত শিবমন্দির, রমনা রেসকোর্স মাঠের দুটো পুরনো কালী মন্দির। স্মরণীয় যে, ২৬ মার্চ সকালে পাক সেনারা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোডের মসজিদে ফজরের নামাজের আজান দানরত মুয়াজ্জিনকে এবং গুরুদুয়ারা, শিব মন্দির ও কালীমন্দিরে ঢুকে পুরোহিতদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ‘অপরারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানে সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে। জগন্নাথ হলের অধ্যাপক ড. রতনলাল চক্রবর্তী সম্পাদিত “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল” গ্রন্থে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’ জগন্নাথ হলে কী ঘটেছিল, তার বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত অংশ-

“১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশেষভাবে জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় রাত বারোটার সময় ইউওটিসির দিকের দেয়াল ভেঙে পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে জগন্নাথ হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। এরপর জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে শুরু হয় নারকীয় কা-। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে। এমনকি টয়লেটে, বাথরুমে ও ছাদে রক্ষিত জলের ট্যাংকের মধ্যে যেখানেই পাওয়া যায় লোকের সন্ধান, সেখানে চলে নির্বিচারে গুলি ও হত্যা। পশ্চিম ভবন, ক্যান্টিন ও ক্যান্টিন সংলগ্ন ছাত্রাবাসে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতা পালিয়েছিল, কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশে বেরিয়ে আসতেই তাদের ওপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ক্রমশ আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের বাসভবন। পাকবাহিনী মেরে ফেলে গোবিন্দ দেবকে এবং পালিত কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার যেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান পুত্র ও আত্মীয়সহ নিহত হন। মারাত্মকভাবে আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা, পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাক মিলিটারি মধুসূধন দেব (মধুদা)-এর বাসা আক্রমণ করে হত্যা করে তার পুত্র, সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, স্ত্রী যোগমায়া যিনি ছিলেন দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুলিতে মধুদাও মারাত্মকভাবে আহত হন। জঘন্যতম পদ্ধতি গ্রহণ করে পাকবাহিনী পরবর্তী ঘটনার অবতরণ করে। পলায়িত ও আতঙ্কগ্রস্ত ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে আসে এবং তাদের এই সব লাশ জগন্নাথ হলের মাঠে জড় করার কাজে লাগায়। পাকবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে এদের মধ্যে দু’একজন লাশ টানার কাজে যোগদান করেনি। কিন্তু অনেকেই রাইফেল ও বেয়নেটের নির্দেশে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্ররা নিহত সহপাঠীদের লাশ, কর্মচারীরা গোবিন্দ দেব, মুনিরুজ্জামান ও মধুদার লাশ টেনে হলের অভ্যন্তরে জড়ো করে। এই কাজ সম্পন্ন হয় মিলিটারি পাহারায়। পরে যারা লাশ টানে তারা এবং বিভিন স্থান হতে ধরে আনা লোকজনকে সারিবদ্ধ হবার নির্দেশ দেয় পাকবাহিনী। এদের মধ্যে শিব বাড়ির কয়েকজন সাধু ছিলেন। মুখে ছিল তাদের দাঁড়ি, পরনে গেরুয়া অন্য একজন ছিল টুপি পরিহিত মুসলমান। কিন্তু মানবতা ও ধর্ম কোনো জ্ঞানই ছিল না পাকবাহিনীর। লাইনে দাঁড়ানো ও সমবেত জনগণের ওপর তারা চালালো মেশিনগান। এক নতুন লোমহর্ষক, হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক দৃশ্যের সূচনা হলো। দূরে বস্তিতে পালিয়েছিল মহিলাগণ, যারা স্বজন হারানোর বেদনায় আর্তনাদ করে উঠল। জগন্নাথ হলের বাতাস একটু জল ও পানির আহাজারিতে ভরে গেল। মরণ যন্ত্রণা ও প্রাণ বাঁচানোর এক করুণ দৃশ্য দেখা গেল। কিছু সময়ের জন্য পাকবাহিনী জগন্নাথ হল ও তৎসংলগ্ন এলাকা ত্যাগ করে। বস্তি হতে ছুটে আসেন মহিলাগণ। বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকেন তাঁদের অনেকেই। যারা অপেক্ষাকৃত কম আহত ছিলেন, তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কেউ কেউ নিজের চেষ্টাতেই পালিয়ে যান জগন্নাথ হলের মাঠ থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে পাকবাহিনীর বুলডোজার নিয়ে। একটা ছোট গর্ত করে ময়লা আবর্জনার মতো মাটি চাপা দেবার কাজটাও এতো অবহেলার সঙ্গে সম্পাদন হয়েছে যে বহু সংখ্যক নিহত ব্যক্তির হাত-পা ও মাথা এবং দেহের অংশ মাটির উপর ছিল। গণকবর থেকে জেগে ওঠা মুষ্টিবদ্ধ হাত যেনো স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রতীক।... যা হোক সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কেবলমাত্র ৩৪ জন ছাত্র জগন্নাথ হলেই শহিদ হয়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে স্বপন চৌধুরী যুদ্ধক্ষেত্রে শহিদ হয় এবং গণপতি হালদার তার জন্মভূমি মঠবাড়িয়ায় পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে। উল্লেখ্য যে, গণপতি হালদার ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর হাত থেকে বেঁচে যায়।... শিক্ষকদের মধ্যে প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. জোতির্ময় গুহ-ঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহিদ হন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিৎবল্লী ও জনৈক রাজকুমারী দেবী তথ্য প্রকাশ করেন যে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের কাছে সাজনা গাছের নিচে খুব স্বল্প পরিসর গর্তে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালের চিকিৎসকগণ চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন।

২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্রসভাতে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। এই সভাতেই সর্বপ্রথম সবুজ পটভূমিকার ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনার বাংলার সোনালি মানচিত্র সংবলিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন করা হয়

জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তিনজন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪ জন ২৬ মার্চেই শহিদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা অজানা অনেক লোক। এদের খুব কম অংশই আমরা জানি। সকলের পরিচিত মধুদা (মধুসুদন দত্ত) জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন। মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান তার কয়েকজন নিকট-আত্মীয়সহ। দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে ও তার পুত্র মতিলাল দে পিতা-পুত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। আরও মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সুনীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, দাসুরাম, ভীর রায়, মনিরাম, জহরলাল রাজভর, মরণ ভরণ রায়, শংকর কুরী প্রমুখ।... কবি আবুল কাশেম, এছাড়াও বহু সংখ্যক অতিথিও এই রাতে পাক বাহিনীর শিকার হয়েছিলেন। ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পাল, জগন্নাথ কলেজের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর প্রমুখ ছাত্র ও অতিথিদের নাম জানা যায়। যারা ২৬ মার্চ জগন্নাথ হলের গণহত্যার নির্মম শিকার হয়েছিলেন।... জগন্নাথ হলের কিছু সংখ্যক ছাত্র তখন রমনার কালী মন্দিরে থাকত, ২৬ মার্চ কালী বাড়িও পাক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। সেখানেও নিহত হয় পাক বাহিনীর হাতে ৫-৬ জন জগন্নাথ হলের ছাত্র। তাদের মধ্যে অর্থনীতির ছাত্র রমণী মোহন ভট্টাচার্য ছিল।... উল্লেখ্য যে, শিববাড়ির ৫ জন সাধুকে ধরে এনে জগন্নাথ হলের মাঠে হত্যা করা হয়েছে। ২৬ মার্চ রাত ১২টার পর হতে ২৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় শতাব্দীর যে নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়েছিল, তা ছিল বিক্ষিপ্ত...।”

তাছাড়া ঢাকা হল সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাসে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ চালায়, যার ফলে নিহত হন হলের সহকারী হাউস টিউটর গণিত বিভাগের শিক্ষক শরাফত আলী এবং পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক এ আর খান খাদিম। পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ রাত্রে বাংলা একাডেমিতে গোলা বর্ষণ করে। এছাড়াও শহিদ মিনার ছিল পাকিস্তান বাহিনীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু। মার্চ মাসের মধ্যে তারা শহিদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়। পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র অভিযান শুরু ও শেষ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যার মাধমে। ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগে তারা তাদের দালাল, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সশস্ত্র ঘাতক বাহিনীর দ্বারা যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে রায়ের বাজার বধ্যভূমি বা মিরপুর গোরস্তানে নির্যাতনের পর হত্যা করেছিল তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যেমন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমদ, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. মর্তুজা, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহী এবং ড. সিরাজুল হক খান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার ফজলে রাব্বী ও ডাক্তার আলীম চৌধুরী। এছাড়াও সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সেরাজউদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার এবং সেলিনা পারভিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির কয়েকজন বিজ্ঞানী।

মোট কথা, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে তাদের গণহত্যাযজ্ঞ শুরু ও শেষ করেছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধনের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে থাকা অবস্থায় সামরিক আদালতে গোপন বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল, কিন্তু ’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজয়ের কারণে তা তখন কার্যকর করতে পারেনি। তবে পরাজিত পাকিস্তান তা কার্যকর করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাদের কতিপয় বাংলাদেশী নামধারী ঘাতকদের দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে।

back to top