রাজশাহী : বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠছে বারনই নদী -সংবাদ
রাজশাহী মহানগরীর বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে বারনই নদী। এই দূষিত পানি ব্যবহার করে নদী পাড়ের রাজশাহী ও নাটোরের ৭ উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। নদীতে গোসল করে কিংবা দৈনন্দিন কাজে এর পানি ব্যবহার করে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন চর্মরোগে। দূষণের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে গবাদিপশু ও ফসলের মাঠে। হুমকির মুখে পড়েছে নদীর জীববৈচিত্র।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত রোববার পবার নওহাটা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী এক চর্মরোগ চিকিৎসা ক্যাম্প। রাজশাহী সিভিল সার্জন কার্যালয় ও পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই উদ্যোগে সকাল থেকেই ঢল নামে শত শত অসহায় রোগীর।
ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসা নওহাটার পূর্ব পুঠিয়াপাড়া গ্রামের হেলাল উদ্দিন বলেন, আগে নিয়মিত বারনই নদীতে গোসল করতাম। একদিন নদীর মরা মাছ রান্না করে খেয়েছিলাম। তারপর থেকেই এই চুলকানি রোগে ভুগছি। চামড়া উঠে যাচ্ছে, অসহ্য যন্ত্রণা। একই এলাকার নূরজাহান বেগম জানান, নদীতে গোসল করার পর থেকেই তার শরীরে দাউদের মতো দাগ হয়েছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না।
মহানগরীর পয়নিষ্কাশন, হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং কলকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য দুটি প্রধান খালের মাধ্যমে সরাসরি বারনই নদীতে যাচ্ছে। ফলে পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা, পুঠিয়া এবং নাটোরের দুটি উপজেলার নদীপাড়ের গ্রামগুলোতে চর্মরোগের পাশাপাশি ডায়রিয়া রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. এসআইএম রাজিউল করিম বলেন, এখানে আসা অধিকাংশ রোগীই জানিয়েছেন, নদীর পানি ব্যবহার ও মাছ খাওয়ার কারণে তাদের চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আরও ক্যাম্প করা হবে।
নদী দূষণের কারণে শুধু মানুষই নয়, বিপন্ন হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকাও। নওহাটার জেলে প্রফুল জানান, কয়েক বছর ধরে বিষাক্ত পানিতে নদী-নালা, খাল-বিলের মাছ মরে যাচ্ছে। সরকারিভাবে পোনা ছাড়লেও তা বাঁচে না। যে খালের মাছ ধরে একসময় সংসার চলত, এখন সেই খালের পানি শরীরে লাগলেই ঘা-চুলকানি হয়।
নদী গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার উচিত নগরীর তরল বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলা। তা না হলে আগামীতে আরও বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।
রাজশাহী ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, তরল বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতার দিকে তাকিয়ে না থেকে জরুরি ভিত্তিতে নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধে যুতসই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, নতুবা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে ।
এদিকে রাজশাহী হোজা নদীর যৌবন ফিরিয় দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ। গত রোববার বিকালে রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হোজা নদীটি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া এলাকায় মুসাখান নদে গিয়ে পড়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার। এক সময় নদীটি দিয়ে নৌকা চলাচল করত। নদীতে ধরা পড়ত প্রচুর মাছ। নদীর সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন এসব শুধুই অতীত। অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সময়ে নদীর উপর নির্ধারিত প্রস্থের তুলনায় অনেক ছোট দৈর্ঘ্যের ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে, এতে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলায় নদীটি ভরাট হয়ে গেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দখল-দূষণে হুমকির মুখে পড়েছে নদীটির অস্তিত্ব। এর মধ্যে ৯ কিলোমিটারেই পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। অনেক স্থান দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। আবার ফলিয়ার বিল অংশে নদীর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পুকুর করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এছাড়াও পৌরসভার সিংগাবাজার অংশের নদীর দুই পাশে পৌর এলাকার সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে ওই সেতুর দুই পাশের অনেক জমি ভরাট হয়ে গেছে। কোনো বর্জ্য নদীতে ফেলার নিয়ম নেই। অথচ নদীতে বর্জ্য ফেলছে।
তারা দাবি করেন, নদীটার খনন দরকার, সেই সাথে নদীর সংযোগ খালগুলো পুনঃখনন করা হলে অত্র এলাকার জীববৈচিত্র ব্যাপক প্রাণচঞ্চল্যতা ফিরে আসবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সমন্বয়ই পারবে হোজা নদীর যৌবন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তারা।
রাজশাহী : বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠছে বারনই নদী -সংবাদ
মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রাজশাহী মহানগরীর বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে বারনই নদী। এই দূষিত পানি ব্যবহার করে নদী পাড়ের রাজশাহী ও নাটোরের ৭ উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। নদীতে গোসল করে কিংবা দৈনন্দিন কাজে এর পানি ব্যবহার করে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন চর্মরোগে। দূষণের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে গবাদিপশু ও ফসলের মাঠে। হুমকির মুখে পড়েছে নদীর জীববৈচিত্র।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত রোববার পবার নওহাটা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী এক চর্মরোগ চিকিৎসা ক্যাম্প। রাজশাহী সিভিল সার্জন কার্যালয় ও পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই উদ্যোগে সকাল থেকেই ঢল নামে শত শত অসহায় রোগীর।
ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসা নওহাটার পূর্ব পুঠিয়াপাড়া গ্রামের হেলাল উদ্দিন বলেন, আগে নিয়মিত বারনই নদীতে গোসল করতাম। একদিন নদীর মরা মাছ রান্না করে খেয়েছিলাম। তারপর থেকেই এই চুলকানি রোগে ভুগছি। চামড়া উঠে যাচ্ছে, অসহ্য যন্ত্রণা। একই এলাকার নূরজাহান বেগম জানান, নদীতে গোসল করার পর থেকেই তার শরীরে দাউদের মতো দাগ হয়েছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না।
মহানগরীর পয়নিষ্কাশন, হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং কলকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য দুটি প্রধান খালের মাধ্যমে সরাসরি বারনই নদীতে যাচ্ছে। ফলে পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা, পুঠিয়া এবং নাটোরের দুটি উপজেলার নদীপাড়ের গ্রামগুলোতে চর্মরোগের পাশাপাশি ডায়রিয়া রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. এসআইএম রাজিউল করিম বলেন, এখানে আসা অধিকাংশ রোগীই জানিয়েছেন, নদীর পানি ব্যবহার ও মাছ খাওয়ার কারণে তাদের চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আরও ক্যাম্প করা হবে।
নদী দূষণের কারণে শুধু মানুষই নয়, বিপন্ন হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকাও। নওহাটার জেলে প্রফুল জানান, কয়েক বছর ধরে বিষাক্ত পানিতে নদী-নালা, খাল-বিলের মাছ মরে যাচ্ছে। সরকারিভাবে পোনা ছাড়লেও তা বাঁচে না। যে খালের মাছ ধরে একসময় সংসার চলত, এখন সেই খালের পানি শরীরে লাগলেই ঘা-চুলকানি হয়।
নদী গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার উচিত নগরীর তরল বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলা। তা না হলে আগামীতে আরও বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।
রাজশাহী ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, তরল বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতার দিকে তাকিয়ে না থেকে জরুরি ভিত্তিতে নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধে যুতসই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, নতুবা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে ।
এদিকে রাজশাহী হোজা নদীর যৌবন ফিরিয় দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ। গত রোববার বিকালে রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হোজা নদীটি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া এলাকায় মুসাখান নদে গিয়ে পড়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার। এক সময় নদীটি দিয়ে নৌকা চলাচল করত। নদীতে ধরা পড়ত প্রচুর মাছ। নদীর সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন এসব শুধুই অতীত। অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সময়ে নদীর উপর নির্ধারিত প্রস্থের তুলনায় অনেক ছোট দৈর্ঘ্যের ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে, এতে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলায় নদীটি ভরাট হয়ে গেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দখল-দূষণে হুমকির মুখে পড়েছে নদীটির অস্তিত্ব। এর মধ্যে ৯ কিলোমিটারেই পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। অনেক স্থান দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। আবার ফলিয়ার বিল অংশে নদীর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পুকুর করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এছাড়াও পৌরসভার সিংগাবাজার অংশের নদীর দুই পাশে পৌর এলাকার সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে ওই সেতুর দুই পাশের অনেক জমি ভরাট হয়ে গেছে। কোনো বর্জ্য নদীতে ফেলার নিয়ম নেই। অথচ নদীতে বর্জ্য ফেলছে।
তারা দাবি করেন, নদীটার খনন দরকার, সেই সাথে নদীর সংযোগ খালগুলো পুনঃখনন করা হলে অত্র এলাকার জীববৈচিত্র ব্যাপক প্রাণচঞ্চল্যতা ফিরে আসবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সমন্বয়ই পারবে হোজা নদীর যৌবন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তারা।