ব্রাক্ষণবাড়িয়া : নবীনগরের জালশুকা গ্রামের ঐতিহাসিক বাড়ি -সংবাদ
সময় পরিক্রমায় বিস্মৃত হয়ে যায় অনেক কিছু। কীর্তিমান মানুষ বা তাদের কর্মকে মনে রাখে। নিজ এলাকার নামীদামী মানুষ বা সামাজিক মর্যাদায় উচ্চতর পরিবারের কথা, ক’জনই বা বলতে পারে। নতুন প্রজন্মের হয়তো জানারই সুযোগ হয়না সেসব কিছু। এমনই প্রেক্ষাপট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের জালশুকা গ্রামে দেখা গেছে এক ভিন্নচিত্র।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার পথ পেরুতেই জালশুকা গ্রাম। শহরের খুব কাছে, তাই গ্রামের পিচঢালা পথ দেখে মনে হবে এ যেন শহরই! হাওর-নদী আর ছায়াসুনিবিড় জালশুকায় বহু গুণীর জন্ম। তাদের গুণে জালশুকা আজ হিরন্ময়। এ গ্রামেই এখনও টিকে আছে শত বছর পুরনো একটি কাঁচারি বা বাংলো ঘর। তবে ঐতিহ্যের কাঁচারি আজ প্রায় মানুষশূণ্য।
জরাজীর্ণ প্রায় কাঁচারি ঘরের এক পাশে ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছে ডাকঘর। এক সময় যা ছিল জালশুকা ও আশপাশ এলাকার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ডাকপিয়নের ছোটাছুটি আর চিঠি পোস্টের জন্য মানুষের কোলাহল ছিল এখানে। সময়ের পরিক্রমায় ডাকঘরের সেই কোলাহল থেমেছে। ই-মেইলের যুগে চিঠির আবেদন ফুরিয়েছে।
বাড়ির ভেতরে রয়েছে ১৯৫৫-৫৬ সালে নির্মিত পাকা দালান। এ দালানঘরে থাকা আসবাবপত্রেও আছে আভিজাত্যের ছাপ। সুনসান বাড়িতে ঐতিহ্যের স্থাপনা অবলোকনের পর ভিন্নচিত্র চোখে পড়ে একটি বাড়ির উঠোনে। পাথরে খোদাই করা বায়োগ্রাফি। যে বায়োগ্রাফি বাড়িটির সমৃদ্ধ ইতিহাসকে আবারও সামনে টেনে এনেছে।
বাড়ির ভেতরে পুরনো কাঁচারি ঘর ও ডাকঘর ছাড়াও রয়েছে পাঠাগার। যেটি বাড়ির এক কীর্তিমানের নামে প্রতিষ্ঠিত। পাঠাগারের প্রবেশ পথেই চোখে পড়ে পাথরে খোদাই করা ওই বায়োগ্রাফিটি। যাতে তুলে ধরা হয়েছে বাড়ির গুণী পূর্বপুরুষদের কর্মজীবন ও সাফল্যগাঁথা। জেলার নবীনগর উপজেলার জালসুকা গ্রামের ওই বাড়িটি জালসুকা মোল্লাবাড়ি নামেই স্থানীয়দের কাছে বেশি পরিচিত। পুরনো কাঁচারি ঘরটির সামনে এখনও একটি ডাকবাক্স ঝুলছে। ১৯৫৬ সালে মোল্লাবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ডাকঘরটি অত্র অঞ্চলের মানুষের জন্য ছিল স্বপ্নসমান। এ বাড়ির পূর্বপুরুষ আব্দুর রউফের হাত ধরেই ডাকঘরটি নির্মিত হয় তখন।
পূর্বপুরুষদের এমন কর্ম ও বর্ণাঢ্য জীবনের কথা খচিত হয়েছে ‘হিরন্ময় জালশুকা মোল্লাবাড়ি’ শিরোনামে ওই পাথরে। আনসার আলী মোক্তার, তাঁর ছেলে আব্দুর রউফ আর আব্দুর রউফের দুই ছেলে আবদুর রহিম ও আবদুর রহমানের কথা বলা হয়েছে পাথরে।
পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ধরে রাখতে পাঠাগারটি আধুনিক নকশায় নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১২ সালে সরকারের নিবন্ধন পায় ‘আবদুর রহিম স্মৃতি পাঠাগার’। পাঠাগারের নিচতলাজুড়ে বই রাখার সেলফ নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। চিঠির আবেদন ফুরালেও ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিচতলার এক পাশে ডাকঘরের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া দূর-দূরান্তের অতিথি পাঠকদের জন্য দ্বিতীয়তলায় থাকছে বিশ্রাম বা আবাসন সুবিধা। পাঠাগারটির পেছনেই জালশুকা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান।
পাথরে লেখা আছে- আবদুর রউফ, ইপিইএস। ডাক নাম নওয়াব মিয়া। জালশুকা গ্রামের সম্ভ্রান্ত মোল্লাবাড়ির আনসার আলী মোক্তারের এ সন্তানের জন্ম ১৯০৮ সালে। আবদুর রউফ ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন শেষে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন ইউনিভার্সিটি থেকেও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন অঙ্গরাজ্যের গভর্ণর তাঁকে ‘ওরেগন অ্যাম্বাসেডর টু পাকিস্তান’ হিসেবে বিরল সম্মাননা প্রদান করেন।
ষাটের দশকে অবসর নিয়ে আবদুর রউফ অবসরোত্তর জীবন কাটাতে চলে আসেন নিজ জন্মভিটা নিভৃত জালশুকা গ্রামে। কর্মজীবন বা অবসর- সব সময়ই গ্রামের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন তিনি। ১৯৩৯ সালে জালশুকা গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বড়াইল ও গোসাইপুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখে অনগ্রসর এ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষার আলো। দুর্গম গ্রামে যোগাযোগ সহজ করতে ১৯৫৬ সালে নিজ বাড়িতে ডাকঘর চালু করেন। আনসার আলী মোক্তারের অন্য সন্তানদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হুদা ওরফে লাল মিয়া মুন্সি ও আব্দুল হাই জিল্লু মিয়া। লাল মিয়া ব্রিটিশ-পাকিস্থান আমলে দীর্ঘ ৩৫ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও জিল্লু মিয়া পুলিশের ডিএসপি হিসেবে ব্যুরো অব অ্যান্টিকরাপশনে কর্মরত ছিলেন।
আবদুর রহিম ওরফে হুমায়ুন। তিনি হুমায়ুন চেয়ারম্যান নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। আবদুর রউফের জ্যেষ্ঠ ছেলে হুমায়ুন তদানীন্তন সাদেকপুর পশ্চিম বর্তমানে বড়াইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত একটানা দায়িত্ব পালন করেন।
অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ ও সততার জন্য এলাকার মানুষের কাছে সমুজ্জ্বল তাঁর নাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় হুমায়ুন চেয়ারম্যানের অবদান অসামান্য।
আবদুর রহিম স্বাধীনতা উত্তরকালে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন। ঢাকায় ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। এছাড়া ‘দৈনিক কিষান’ এবং ‘দৈনিক বাংলার মুখ’ সংবাদপত্রে কাজ করেন। ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কুমিল্লার ‘দৈনিক রূপসী বাংলা’র জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আবদুর রহমান ওরফে আবু মিয়া হলেন আবদুর রউফের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ও সুযোগ্য উত্তরসূরি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। আবদুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ১৯৬৪ সালে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৫ সালে এমএ পাশ করে কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। ভৈরব হাজী আসমত আলী কলেজ ও পরবর্তীতে ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরিকালীন পাবলিক রিলেশন বিষয়ে ১৯৮২ সালে অষ্ট্রেলিয়ায় ফেলোশিপ এবং ইউনেস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতে ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং কমিউনিকেশন’ শীর্ষক কোর্সে অংশ নেন।
কথা হয় মোল্লাবাড়ীর বংশধর হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মোল্লাবাড়ির এই অংশটুকুতে কেউ থাকেন না। তবে আমাদের বাড়ির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এখানে পাঠাগার করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই পাঠাগারটি চালু করার জন্য প্রস্তুতি চলছে। এ পাঠাগার থেকে এলাকার মানুষ উপকৃত হবে বলে আশা করি।’ তিনি বলেন, ‘গ্রাম থেকে শহরে চলে গেলে কেউ আর গ্রামের বাড়িটির সেভাবে খোঁজ নেয় না। কিন্তু মোল্লাবাড়ির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাড়ির গুণী মানুষদের জীবনচিত্র তুলে ধরা- যা পাঠাগারে ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে।’
ওই এলাকার বাসিন্দা মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘জালশুকা গ্রামের মোল্লাবাড়ির আলাদা একটা ঐতিহ্য আছে। এ বাড়িতে কেউ না থাকলেও গ্রামের মানুষ বাড়ির সামনে থাকা ঐতিহ্যবাহী কাঁচারী বা বাংলো ঘরের সামনে বসে আড্ডা দেয়। বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে একটি সুন্দর পাঠাগার তৈরির বিষয়টি বেশ আশা জাগানিয়া। এ ছাড়া বাড়ির পূর্বপুরুষদের যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেটা সত্যিই ব্যতিক্রম।’
জালশুকা মােল্লাবাড়ির সন্তান, অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষরা আমাদের জন্য গৌরবের। বাড়ির যে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য রয়েছে- তা এই পাথর সবসময় বহন করবে। নতুন প্রজন্মের কাছে ভালো বার্তা থাকবে। গ্রামের ছেলেরা অন্য দিকে না গিয়ে পাঠাগারটিতে পড়াশুনার সুযোগ পাবে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া : নবীনগরের জালশুকা গ্রামের ঐতিহাসিক বাড়ি -সংবাদ
রোববার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সময় পরিক্রমায় বিস্মৃত হয়ে যায় অনেক কিছু। কীর্তিমান মানুষ বা তাদের কর্মকে মনে রাখে। নিজ এলাকার নামীদামী মানুষ বা সামাজিক মর্যাদায় উচ্চতর পরিবারের কথা, ক’জনই বা বলতে পারে। নতুন প্রজন্মের হয়তো জানারই সুযোগ হয়না সেসব কিছু। এমনই প্রেক্ষাপট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের জালশুকা গ্রামে দেখা গেছে এক ভিন্নচিত্র।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার পথ পেরুতেই জালশুকা গ্রাম। শহরের খুব কাছে, তাই গ্রামের পিচঢালা পথ দেখে মনে হবে এ যেন শহরই! হাওর-নদী আর ছায়াসুনিবিড় জালশুকায় বহু গুণীর জন্ম। তাদের গুণে জালশুকা আজ হিরন্ময়। এ গ্রামেই এখনও টিকে আছে শত বছর পুরনো একটি কাঁচারি বা বাংলো ঘর। তবে ঐতিহ্যের কাঁচারি আজ প্রায় মানুষশূণ্য।
জরাজীর্ণ প্রায় কাঁচারি ঘরের এক পাশে ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছে ডাকঘর। এক সময় যা ছিল জালশুকা ও আশপাশ এলাকার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ডাকপিয়নের ছোটাছুটি আর চিঠি পোস্টের জন্য মানুষের কোলাহল ছিল এখানে। সময়ের পরিক্রমায় ডাকঘরের সেই কোলাহল থেমেছে। ই-মেইলের যুগে চিঠির আবেদন ফুরিয়েছে।
বাড়ির ভেতরে রয়েছে ১৯৫৫-৫৬ সালে নির্মিত পাকা দালান। এ দালানঘরে থাকা আসবাবপত্রেও আছে আভিজাত্যের ছাপ। সুনসান বাড়িতে ঐতিহ্যের স্থাপনা অবলোকনের পর ভিন্নচিত্র চোখে পড়ে একটি বাড়ির উঠোনে। পাথরে খোদাই করা বায়োগ্রাফি। যে বায়োগ্রাফি বাড়িটির সমৃদ্ধ ইতিহাসকে আবারও সামনে টেনে এনেছে।
বাড়ির ভেতরে পুরনো কাঁচারি ঘর ও ডাকঘর ছাড়াও রয়েছে পাঠাগার। যেটি বাড়ির এক কীর্তিমানের নামে প্রতিষ্ঠিত। পাঠাগারের প্রবেশ পথেই চোখে পড়ে পাথরে খোদাই করা ওই বায়োগ্রাফিটি। যাতে তুলে ধরা হয়েছে বাড়ির গুণী পূর্বপুরুষদের কর্মজীবন ও সাফল্যগাঁথা। জেলার নবীনগর উপজেলার জালসুকা গ্রামের ওই বাড়িটি জালসুকা মোল্লাবাড়ি নামেই স্থানীয়দের কাছে বেশি পরিচিত। পুরনো কাঁচারি ঘরটির সামনে এখনও একটি ডাকবাক্স ঝুলছে। ১৯৫৬ সালে মোল্লাবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ডাকঘরটি অত্র অঞ্চলের মানুষের জন্য ছিল স্বপ্নসমান। এ বাড়ির পূর্বপুরুষ আব্দুর রউফের হাত ধরেই ডাকঘরটি নির্মিত হয় তখন।
পূর্বপুরুষদের এমন কর্ম ও বর্ণাঢ্য জীবনের কথা খচিত হয়েছে ‘হিরন্ময় জালশুকা মোল্লাবাড়ি’ শিরোনামে ওই পাথরে। আনসার আলী মোক্তার, তাঁর ছেলে আব্দুর রউফ আর আব্দুর রউফের দুই ছেলে আবদুর রহিম ও আবদুর রহমানের কথা বলা হয়েছে পাথরে।
পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ধরে রাখতে পাঠাগারটি আধুনিক নকশায় নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১২ সালে সরকারের নিবন্ধন পায় ‘আবদুর রহিম স্মৃতি পাঠাগার’। পাঠাগারের নিচতলাজুড়ে বই রাখার সেলফ নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। চিঠির আবেদন ফুরালেও ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিচতলার এক পাশে ডাকঘরের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া দূর-দূরান্তের অতিথি পাঠকদের জন্য দ্বিতীয়তলায় থাকছে বিশ্রাম বা আবাসন সুবিধা। পাঠাগারটির পেছনেই জালশুকা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান।
পাথরে লেখা আছে- আবদুর রউফ, ইপিইএস। ডাক নাম নওয়াব মিয়া। জালশুকা গ্রামের সম্ভ্রান্ত মোল্লাবাড়ির আনসার আলী মোক্তারের এ সন্তানের জন্ম ১৯০৮ সালে। আবদুর রউফ ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন শেষে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন ইউনিভার্সিটি থেকেও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন অঙ্গরাজ্যের গভর্ণর তাঁকে ‘ওরেগন অ্যাম্বাসেডর টু পাকিস্তান’ হিসেবে বিরল সম্মাননা প্রদান করেন।
ষাটের দশকে অবসর নিয়ে আবদুর রউফ অবসরোত্তর জীবন কাটাতে চলে আসেন নিজ জন্মভিটা নিভৃত জালশুকা গ্রামে। কর্মজীবন বা অবসর- সব সময়ই গ্রামের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন তিনি। ১৯৩৯ সালে জালশুকা গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বড়াইল ও গোসাইপুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখে অনগ্রসর এ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষার আলো। দুর্গম গ্রামে যোগাযোগ সহজ করতে ১৯৫৬ সালে নিজ বাড়িতে ডাকঘর চালু করেন। আনসার আলী মোক্তারের অন্য সন্তানদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হুদা ওরফে লাল মিয়া মুন্সি ও আব্দুল হাই জিল্লু মিয়া। লাল মিয়া ব্রিটিশ-পাকিস্থান আমলে দীর্ঘ ৩৫ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও জিল্লু মিয়া পুলিশের ডিএসপি হিসেবে ব্যুরো অব অ্যান্টিকরাপশনে কর্মরত ছিলেন।
আবদুর রহিম ওরফে হুমায়ুন। তিনি হুমায়ুন চেয়ারম্যান নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। আবদুর রউফের জ্যেষ্ঠ ছেলে হুমায়ুন তদানীন্তন সাদেকপুর পশ্চিম বর্তমানে বড়াইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত একটানা দায়িত্ব পালন করেন।
অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ ও সততার জন্য এলাকার মানুষের কাছে সমুজ্জ্বল তাঁর নাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় হুমায়ুন চেয়ারম্যানের অবদান অসামান্য।
আবদুর রহিম স্বাধীনতা উত্তরকালে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন। ঢাকায় ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। এছাড়া ‘দৈনিক কিষান’ এবং ‘দৈনিক বাংলার মুখ’ সংবাদপত্রে কাজ করেন। ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কুমিল্লার ‘দৈনিক রূপসী বাংলা’র জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আবদুর রহমান ওরফে আবু মিয়া হলেন আবদুর রউফের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ও সুযোগ্য উত্তরসূরি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। আবদুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ১৯৬৪ সালে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৫ সালে এমএ পাশ করে কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। ভৈরব হাজী আসমত আলী কলেজ ও পরবর্তীতে ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরিকালীন পাবলিক রিলেশন বিষয়ে ১৯৮২ সালে অষ্ট্রেলিয়ায় ফেলোশিপ এবং ইউনেস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতে ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং কমিউনিকেশন’ শীর্ষক কোর্সে অংশ নেন।
কথা হয় মোল্লাবাড়ীর বংশধর হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মোল্লাবাড়ির এই অংশটুকুতে কেউ থাকেন না। তবে আমাদের বাড়ির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এখানে পাঠাগার করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই পাঠাগারটি চালু করার জন্য প্রস্তুতি চলছে। এ পাঠাগার থেকে এলাকার মানুষ উপকৃত হবে বলে আশা করি।’ তিনি বলেন, ‘গ্রাম থেকে শহরে চলে গেলে কেউ আর গ্রামের বাড়িটির সেভাবে খোঁজ নেয় না। কিন্তু মোল্লাবাড়ির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাড়ির গুণী মানুষদের জীবনচিত্র তুলে ধরা- যা পাঠাগারে ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে।’
ওই এলাকার বাসিন্দা মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘জালশুকা গ্রামের মোল্লাবাড়ির আলাদা একটা ঐতিহ্য আছে। এ বাড়িতে কেউ না থাকলেও গ্রামের মানুষ বাড়ির সামনে থাকা ঐতিহ্যবাহী কাঁচারী বা বাংলো ঘরের সামনে বসে আড্ডা দেয়। বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে একটি সুন্দর পাঠাগার তৈরির বিষয়টি বেশ আশা জাগানিয়া। এ ছাড়া বাড়ির পূর্বপুরুষদের যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেটা সত্যিই ব্যতিক্রম।’
জালশুকা মােল্লাবাড়ির সন্তান, অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষরা আমাদের জন্য গৌরবের। বাড়ির যে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য রয়েছে- তা এই পাথর সবসময় বহন করবে। নতুন প্রজন্মের কাছে ভালো বার্তা থাকবে। গ্রামের ছেলেরা অন্য দিকে না গিয়ে পাঠাগারটিতে পড়াশুনার সুযোগ পাবে।